৪.০৬ লাস ভেগাসে মাইকেল কর্লিয়নি

০৬.

বেশ রাত করে লাস ভেগাসে পৌঁছুল মাইকেল কর্লিয়নি। ওর নিষেধ ছিল, তাই অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে এয়ারপোর্টে যায়নি কেউ। সাথে মাত্র দুজনকে নিয়ে এসেছে মাইকেল। টম হেগেন আর অ্যালবার্ট নেরি। অ্যালবার্ট নেরি ওর নতুন বডিগার্ড।

হোটেলের সবচেয়ে সৌখিন স্যুইটটা আলাদা করে রাখা হয়েছে ওদের জন্যে। যাদের সাথে দৈখা করতে চেয়েছে মাইকেল তারা সবাই অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছে।

ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা করুল ফ্রেডি। শরীরে মেদ জমেছে ফ্রেডির, চেহারায় আগের চেয়ে অনেক বেশি অমায়িক ভাব। মেজাজটা সদা প্রফুল্ল, পোশাক-আশাক অত্যন্ত মূল্যবান আর সৌখিন। নিখুঁতভাবে কাটা অ্যাশ কালারের রেশমী স্যুট পরেছে, তার সাথে মিল রেখে টাই, মোজা ইত্যাদি।চুল ছেটেছে কুর দিয়ে, তাতে ফিল্মস্টারদের মত উদ্ভাসিত হয়ে থাকে চেহারাটা। সযত্নে কামিয়েছে দাড়ি-গোঁফ, ঝক ঝক করছে মুখটা। ওর হাতের নখের যত্ন নেয় বিউটি পারলারের প্রফেশনালরা। চার বছর আগে নিউইয়র্ক থেকে রপ্তানি করা ফ্রেডি, আর এই ফ্রেডির মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে ফ্রেডি, ছোট ভাই মাইকেলের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। মুখটাকে সারিয়ে নিয়ে খুব ভাল করেছ। নিশ্চয়ই কে রাজি করিয়েছে তোমাকে? কেমন আছে ও? এদিকে বেড়াতে আসবেনা?

মৃদু হাসল মাইকেল। বলল, আরে, তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। কে? ও তো এবারই আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ওর যে আরেকটা বাচ্চা হবে, তার ওপর বড়টার ঝক্কি পোহাতে হয়। তাছাড়া, আমার এবারের আসাটা বেড়াতে আসা নয়, ফ্রেডি। কাজ সেরে কাল রাতের প্লেনেই ফিরতে হবে আমাকে, খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে পরও সকালে।

সে দেখা যাবেখন, বলল ফ্রেডি। আগে কিছু মুখে দাও। আমাদের হোটেলে এমন একজন বাবুর্চি আছে যার তুলনা হয় না, একবার খেলে তার হাতের রান্না ভুলতে পারবে না তুমি এখানেই সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কিন্তু তার আগে কাপড় চোপড় ছেড়ে গোসল সারো। ওরা সবাই তৈরি হয়েই আছে, তুমি ডাকলেই দেখা করতে আসবে।

সহজ, শান্তভাবে বলল মাইকেল, মো গ্রীনকে সবার শেষে ডেকো, কেমন? জনি আর নিনো খাবে আমাদের সাথে। সি আর ডাক্তারও। ওদের সাথে খেতে বসেই কথা বলব আমি। টম হেগেনের দিকে তাকাল ও। আর কাউকে ডাকতে চাও, টম?

কথা বলল না টম, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল শুধু। যতটুকু প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক কম খাতির করেছে তাকে ফ্রেডি। কারণটা অবশ্য বুঝতে পারছে হেগেন। ফ্রেডির বাবা ছেলের ওপর সাঙ্ঘাতিক চটে আছেন, তার রাগ দূর করার জন্যে কনসিলিয়রি হিসেবে হেগেন যদি চেষ্টা না করে বা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় তাহলে তো তার ওপর ফ্রেডি অসন্তুষ্ট হবেই। গড ফাদারের রাগ দূর করার চেষ্টা খুশি মনেই করত হেগেন, কিন্তু ছেলের ওপর তার রাগের কারণটাই জানা নেই ওর। কারও ওপর অসন্তুষ্ট হলে বা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা উচ্চারণ করেন না ৬ন কর্লিয়নি। তার আচরণেই শুধু অসন্তোষ প্রকাশ পায়।

রাত বারোটায় মাইকেলের সুইটে ডিনার খেতে বসল ওরা। ঘরে ঢুকেই মাইকেলকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুমো খেল লুসি মানচিনি। কিন্তু অপারেশন করিয়ে মুখটাকে কেমন দেখাচ্ছে সে-বিষয়ে কোন মন্তব্য করল না। ডাক্তার জুস সীগলের মাঝে কোন ইতস্তত ভাব বা জড়তা দেখা গেল না। সবাইকে এক রকম ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মাইকেলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। ওর মুখটা পরীক্ষা করুল, টিপেটিপে দেখল মাংসের ভেতর হাড়টা, তারপর বলল, বাহু, চমৎকার! চমৎকার জোড়া লেগেছে। সাইনাস নিয়ে আর কোন অসুবিধে নেই তো?

কোনও অসুবিধে নেই, হাসি মুখে বলল, মাইকেল। আপনার সহযোগিতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, ডাক্তার।

বিশেষভাবে আয়োজিত এই ডিনারের মধ্যমণি মাইকেল। ওর কথা, তাকানো, হাবভাব-সব কিছুর ভেতর ডন কর্লিয়নির সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছে ওরা। কেন, কিভাবে কে জানে, ওকে দেখে সেই একই ভক্তি, সেই একই ধরনের ভয় ভয় ভাব জাগছে সবার মনে। সন্দেহ নেই, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কেননা মাইকেলের আচার-ব্যবহারে এতটুকু অস্বাভাবিকতা নেই। কেউ যাতে কুণ্ঠা বা অপ্রতিভ বোধ না করে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ও।

ডন-এর সাথে উপস্থিত থাকার সময় যে নিয়ম পালন করে টম হেগেন, এখনও সেই একই নিয়ম মেনে চলছে সে, মাইকেলকে সামনে রেখে নিজে খানিকটা পিছনে সরে রয়েছে। একজন নতুন লোককে দেখছে সবাই, তার সম্পর্কে ওদের কারও কিছু জানা নেই। খাবার পরিবেশনের আগে সে জানাল, তার খিদে নেই। কথাটা বলৈ ঘুরে দাঁড়াল সে, এগিয়ে গেল দরজা পর্যন্ত, কিন্তু কামরা থেকে বেরিয়ে গেল না। দরজার কাছেই একটা আরাম কেদারায় নিঃশব্দে বসল, চোখের সামনে মেলে ধরুল একটা স্থানীয় খবরের কাগজ।

কয়েক দফা মদ খাবার পর ডিনারে বসল ওরা, তারপর বিদায় করে দেয়া হলো ওয়েটারদের।

শুনলাম, জনির দিকে ফিরে বলল মাইকেল, তোমার গলা নাকি ডাল হয়ে গেছে? আগের চেয়ে ভাল? আরও উলাম, তোমার আগের ভক্তরা নাকি দল আরও ভারি করে ফিরে এসেছে তোমার কাছে? খুশির খবর। কস্থ্যাচুলেশনস।

ধন্যবাদ দিল জনি। কৌতূহলে অস্থির হয়ে পড়েছে সে। মনে মনে ভাবছে, ওর সাথে দেখা করতে চাওয়ার কারণ কি মাইকেলের? ওর কাছ থেকে না জানি কি চাইবে ওরা।

সবাই তাকিয়ে আছে মাইকেলের দিকে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল, এখনও কেউ তার কথা শোনার জন্যে তৈরি হতে বাকি আছে কিনা, তারপর ধীরে ধীরে শুরু করল মাইকেল, কর্নিয়নি পরিবার এই লাস ভেগাসে উঠে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জলপাই তেলের ব্যবসাতে আমাদের সমস্ত অংশ বিক্রি করে দিয়ে আমরা এখানে এসে নতুন করে ব্যবসা এবং বসবাস শুরু করব। আমরা তিনজন-ডন, আমি আর টম হেগেন–এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছি। কর্নিয়নি পরিবারের ভবিষ্যৎ এখানেই নিহিত, এব্যাপারে আমরা তিনজনই একমত। তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখুনি বা আসছে বছরই উঠে আসছি আমরা, ব্যপারটা তা নয়। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে, তার জন্যে সময় দরকার। দুই, তিন, এমন কি চার বছরও লেগে যেতে পারে তবে, তোমাদেরকে জানানো হলো মোটামুটি এই রকম একটা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, এবং ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। আমাদের বন্ধুরা এখানের এই হোটেল আর ক্যাসিনোর কিছু শেয়ারের মালিক, লাস ভেগাসে সেটাই হবে আমাদের ভিত্তি। মো দ্বীনের কাছ থেকে আমাদের বন্ধুরা তার শেয়ারগুলো কিনে নেবে, তার মানে বন্ধুরা দুটোরই একচ্ছত্র মালিক হবে।

ফ্রেডির গোল চাঁদের মত মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল। এর আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই ব্যবসাটাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে মো গ্রীন, তার শেয়ার সে বিক্রি করে দিতে রাজী হবে কেন?

হবে, বিরক্ত বা উত্তেজিত না হয়ে শান্তভাবে কল মাইকেল। যাতে রাজী হয় সেইরকম প্রস্তাবই দেয়া হবে তাকে।

কথাগুলো সহজ আর স্বাভাবিকভাবে বলা হলেও, মুহূর্তে বদলে গেল কামরার পরিবেশ, কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছে সবার চেহারা। তার কারণটা সম্ভবত এই যে, মাইকেল এই মুহূর্তে যা বলল ঠিক সেই কথাগুলোই ওই একই ভঙ্গিতে প্রায়ই বলে থাকেন ডন কর্লিয়নি।

এখানে আমাদের পারিবারিক ব্যবসাটাকে চালু করার জন্যে, জনি ফন্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল মাইকেল, তোমার কাছ থেকে খানিকটা সাহায্য আশা করছেন ডন। আমাদের জানানো হয়েছে, লোককে জুয়া খেলার দিকে টানতে হলে লোভনীয় আমোদ-প্রমোদের আয়োজন করতে হয়। ডন আশা করে আছেন, তুমি আমাদের সাথে পাঁচ বছরের জন্যে একটা চুক্তি সই করবে। সেই চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে, বছরে অন্তত পাঁচবার আমাদের মঞ্চে দেখা দেবে তুমি, প্রতিবার হয়তো পাঁচ দিনের জন্যে। আমরা আরও আশা করছি, সিনেমা লাইনে তোমার যত বন্ধু আছে তাদেরকেও তুমি ওই ধরনের চুক্তি সই করায় রাজী করাতে পারবে! এতদিন তো তারা তোমার কাছ থেকে শুধু উপকারই পেয়ে এসেছে, এবার তোমার জন্যেও কিছু করুক ওরা।

একশোবার, মাইক, বলল জনি। আমার গড ফাদারের যে কোন নির্দেশ মাথা পেতে নেব আমি। বলল বটে, কিন্তু করে ক্ষীণ একটু অনিশ্চয়তার আভাস পাওয়া গেল।

মৃদু একটু হাসল মাইকেল। চুক্তির ফলে তোমার বা তোমার বন্ধুদের ঠকতে হবে না, বলল ও। তোমরা সবাই শেয়ার পাবে হোটেলের শুধু তাই নয়, তোমার। খাতিরের নোক আরও কেউ যদি থাকে, যাদেরকে দিয়ে কাজ হবে বলে মনে করো, তাদেরকেও শেয়ার দেয়া হবে। তুমি হয়তো আমার ওপর ঠিক বিশ্বাস রাখতে পারছ না, তাই তোমাকে জানাচ্ছি, কথাটা আমার নয়–ডন নিজে এ-কথা বলেছেন।

লাল হয়ে উঠল জনির মুখ। দ্রুত বলল সে, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না, ব্যাপারটা তা নয়, মাইক। কিন্তু একটা খবর তুমি বোধ হয় জানো না, এদিকে আরও গোটা দশেক হোটেল আর ক্যাসিনো তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। কর্লিয়নি পরিবার যখন আসবে, তখন হয়তো দেখা যাবে বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে, তার আগেই বাজার দখল করে নিয়েছে অন্যেরা। আমি যতদূর জানি, কর্লিয়নি পরিবার একচেটিয়া ব্যবসাতে বিশ্বাস করে। কিন্তু তোমরা যদি দেরি করে আসো, সেটি হবার জো নেই।

মাইকেল নয় জনির কথার উত্তর দেবার জন্যে এবার মুখ খুলল টম হেগেন, নতুন যে হোটেলগুলো তৈরি হচ্ছে তার বেশির ভাগই কর্লিয়নি পরিবারের বন্ধুদের। টাকায় তৈরি হচ্ছে। তার মানে, সাথে সাথে বুঝে নিল জনি, ওগুলোর মালিকও। কর্লিয়নি পরিবার। বোঝা যাচ্ছে যন্তু পার্সেন্টই শেয়ার দেয়া হোক সবাই খুব ভাল টাকা পাবে।

ঠিক আছে, বলল জনি। এখন থেকেই শুরু করে দিচ্ছি আমি।

লুসি আর ডাক্তার জুলস সীগল পাশাপাশি বসে আছে, এবার তাদের দিকে মনোযোগ দিল মাইকেল। জুলসকে বলল, ডাক্তার, আপনি ঋণী করে রেখেছেন। আমাকে, সে ঋণ আমি শোধ দিতে চাই। জানতে পেরেছি, আপনি নাকি আবার মানুষ কাটাকাটি করতে চান, অথচ হাসপাতালগুলো আপনাকে কোন সুযোগ দেবে না বলে ঠিক করে রেখেছে। কারণটা সম্ভবত সেই অ্যাবরশন সংক্রান্ত গোলমাল। সে যাক। এখন আপনার মুখ থেকে আমার জানা দরকার, সত্যিই কি তাই চান আপনি? ( মৃদু হাসল তুলস। বলল, চাই তো বটেই। কিন্তু ডাক্তারি দুনিয়ার পরিবেশটা কি রকম তা আপনার জানা নেই। যার যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, ওরা সেটা গ্রাহ্য করে না। এ ব্যাপারে আপনি আমার জন্যে কিছু করতে পারবেন বলে আমি মনে করি না।

অন্যমনস্কভাবে মাথা দোলাল মাইকেল। তারপর বলল, হয়তো আপনার কথাই ঠিক। আমার প্রসঙ্গটা একটু অন্যরকম। যথেষ্ট নামডাক আছে এমন কিছু লোক লাস ভেগাসে খুব বড় একটা হাসপাতাল তৈরি করতে যাচ্ছে, তারা আমাদের বন্ধু। এখনই তো অনেক বড় হয়ে গেছে শহরটা, তার ওপর এটাকে বাড়াবার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, তাতে এখানে একটা আধুনিক হাসপাতালের দরকার হবেই, তাই না? ওদেরকে আমরা যদি অনুরোধ করি, ওরা হয়তো আপনাকে ওদের অপারেশনরুমে কাজ করার অনুমতি দেবে। ওদের জন্যে তো সেটা হবে সোনায় সোহাগা। এই মরুভূমির মাঝখানে আপনার মত দক্ষ সার্জন ওরা পাবে কোথায়? আপনার মত বা আপনার তুলনায় অর্ধেক ভাল? আপনাকে কাজ করতে দেবার অনুরোধ করা মানে ওদের একটা মস্ত উপকার করে দিতে চাওয়া। তাই বলছি, ওসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না। ভাল কথা, বননাম আপনি নাকি বিয়ে করছেন লুসিকে?

আগে বউ পোষার সামর্থ্য হোক তো।

ছটফট করে উঠে বলল লুসি, মাইকেল, লক্ষ্মী ভাই আমার, তুমি যদি হাসপাতালটা তৈরি না করো, চিরকাল আইবুড়ো থাকতে হবে আমাকে।

লুসির কথায় হাসতে শুরু করল সবাই, কিন্তু জুলস হাসছে না। বেশ। কিন্তু এই চাকরির সাথে কোন শর্ত থাকবে না তো?

অদ্ভুত ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে জুলসের দিকে তাকাল মাইকেল; অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, না, কোনও শর্ত থাকবে না। আপনার কাছে ঋণী আমি, সেটা শোধ করার প্রস্তাব দিচ্ছি শুধু, তার বেশি কিছু নয়।

মৃদু গলায় বলল লুসি, তুমি কিছু মনে কোরো না, মাইক।

লুসির দিকে তাকাল মাইকেল, হাসল। না, মনে করার কি আছে? জুলসের দিকে তাকাল ও, বলল, আপনি কিন্তু বোকার মত কথা বললেন। কর্লিয়নি পরিবার আপনাকে কিছুটা সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছিল, তা করতে পেরে খুশিই হয়েছিলাম, কারও উপকার করার সুযোগ পেলে কর্লিয়নি পরিবার গর্ববোধ করে। আমাকে কি আপনি এই বোকা মনে করলেন যে তারপর আপনাকে এমন কাজ করতে বলব যা করতে খারাপ লাগবে আপনার? আর যদি বলিই তাতেই বা আপনার মনে করার কি আছে? আপনি যখন বিপদে পড়লেন, আমরা ছাড়া আর কে সাহায্য। করার জন্যে এগিয়ে গিয়েছিল, বলুন? আপনার হয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিল কেউ? তুলেছিল কেউ একটা আঙুল? যখন শুনলাম আবার আপনি অপারেশন থিয়েটারে কাজ করতে চান, আপনার জন্যে কি ব্যবস্থা করা যায় তাই নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামালাম আমি। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, এর পিছনে কতটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে আমাকে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব। কিন্তু তার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে কিছু চাইতে হবে, তা আমি ভাবিনি পর্যন্ত। তবে আপনি আমাদের বন্ধু থাকবেন, এটুকু আশা করেছি। আপনার আচরণে বন্ধুত প্রকাশ পেলে আমিও তাহলে বুঝব, আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের জন্যে আপনি যা করে থাকেন, আমার জন্যেও তাই করবেন। শর্ত যদি কিছু থাকে, ওইটুকুই। আপনার আপত্তি থাকলে আপনি তা অস্বীকারও করতে পারেন।

মাথা নিচু করে চুপিসাড়ে একটু হাসল টম হেগেন। স্বয়ং ডনও এমন চমৎকারভাবে বলতে পারতেন কিনা সন্দেহ।

লাল হয়ে উঠল জুলস সীগলের মুখ। দেখুন, আমি ঠিক তা বোঝাতে চাইনি। আপনার বাবা এবং আপনার কাছে ঋণী আমি, সে ঋণ অৰীকার করব, এ হতে পারে না। যাই হোক, আমার প্রশ্নটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। কি বলেছি, ভুলে যান।

মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মাইকেল, ফাইন। হাসপাতালটা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আজ থেকে আপনি এই হোটেল, ক্যাসিনো আর যে হোটেলগুলো তৈরি হয়ে এসেছে তার সবগুলোর মেডিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করে দিন। লোকজন। যা লাগে, বহাল করুন। কেনাকাটার একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলুন। আর হ্যাঁ, এখন থেকে আপনি এতগুলো প্রতিষ্ঠানের মেডিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে বেতন পাবেন। বেতন, আনুষঙ্গিক সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে পরে আপনি এক সময় টমের সাথে আলোচনা করে সব ঠিকঠাক করে নেবেন। এবার লুসির দিকে তাকাল মাইকেল। তোমার জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা ভেবে রেখেছি আমি। হোটেলগুলোর গ্রাউন্ড ফ্লোরে অনেক দোকান হবে, সেগুলো যাতে একটা নিয়মের মধ্যে বিলি করা হয় এবং ভাড়া আদায় থেকে শুরু করে সমন্বয় রক্ষা পর্যন্ত সমস্ত কাজ যাতে সুষ্ঠু ভাবে সারা যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে তোমাকে। মোট কথা, তুমিই হবে ওদিকটার সর্বেসর্বা। টাকা পয়সা তুমিই সব আদায় করবে। তার ওপর আরও কাজ আছে তোমার। ধরো, ক্যাসিনোর বিভিন্ন কাজে প্রচুর মেয়ে দরকার হবে, তাদের নিয়োগ করার দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। ব্যাপারটা কি দাঁড়াল তাহলে? হাসল মাইকেল। ডাক্তার জুলস সীল তোমাকে যদি বিয়ে না করে, তুমি অন্তত একজন ধনী আইবুড়ো হতে পারবে।

পরিবেশটা হালকা হয়ে গেছে, আবার হাসছে সবাই। কিন্তু ফ্রেডি হাসছে না।

মুখটা থমথম করছে ওর, ঘন ঘন চুরুট ফুকছে সে। তার দিকে আরেকবার তাকাল মাইকেল, মৃদু গলায় বলল, দেখো, ফ্রেডি, আমার ওপর রাগ করা উচিত নয় তোমার। আমি ডনের স্রেফ একজন মেসেঞ্জার, তার বেশি কিছু না। তোমাকে কি করতে হবে না হবে তা তুমি নিশ্চয়ই জানতে পারবে ডনের কাছ থেকে। আমার ধারণা, তোমার পছন্দ হবে না এমন কাজ তোমাকে করতে বলবেন না তিনি। বিশেষ করে সবাই যখন বলছে তুমি এখানে দারুণ কাজ দেখাচ্ছ।

খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করলেও, মনটা খুত খুত করছে ফ্রেডির। তাই যদি হয়, ডন আমার ওগর চটে আছেন কেন? ক্যাসিনোটা লোকসান দিচ্ছে বলে কি? কিন্তু ক্যাসিনোর ওদিকটা আমার দেখবার কথা নয়, ওটা মম গ্রীনের দায়িত্ব। আমার কাজ তো আমি ঠিকমতই করে যাচ্ছি, ওই বুড়ো ভদ্রলোককে খুশি করার জন্যে আর কি করতে পারি আমি?

ওসব ভেবে মন খারাপ কোরো না,কলল মাইকেল। ভাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ও, তাকাল জনির দিকে। জানতে চাইল, কত আশা করুলাম, দেখা হবে নিনোর সাথে। কোথায় সে?

শ্রাগ করল জনি। দেখা করার অবস্থা তার থাকলে তো! সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ ও, নার্সের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছি। এদিকে আমাদের ডাক্তার কি বলেছেন জানো? ওকে নাকি পাগল সাব্যস্ত করে কোথাও আটকে রেখে তারপর ওর চিকিৎসা করতে হবে, তা না হলে ওর সুস্থ হবার কোন আশা নেই। ও নাকি একরকম আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। আমাদের নিনো!

অবাক হয়ে গেল মাইকেল। চিন্তিতভাবে কয়েক মুহূর্ত জনির দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, নিনো নিজেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে? এ আবার কি ধরনের কথা! কারও মনে আঘাত দিয়েছে বা কোন নীচ কাজ করেছে বলে তো শুনিনি কখনও। সবকিছু হেসে উড়িয়ে দেয়াই ওর স্বভাব, কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না তার। একটু যা দুর্বলতা আছে বলে জানতাম ওই মদের ওপর।

ওই মদই তো কাল হয়েছে ওর, বলল জনি। মিছিলের মত টাকা আসছে ওর পকেটে। শুধু ছবিতে গান গেয়েই লক্ষ লক্ষ ডলার কামাতে পারে ও। একটা ছবিতে অভিনয়ের জন্যে এখন পঞ্চাশ হাজার ডলার করে পাচ্ছে। একটা কানাকড়িও থাকে, সব উড়িয়ে দেয়। সেই ছোটবেলার বন্ধু ও আমার, একটা খারাপ কাজ করতে দেখিনি কখনও। জানি না কি ভূতে ধরেছে হারামজাদাকে, মদ খেয়ে মরার পণ করেছে শালা।

কি যেন বলতে যাচ্ছিল জুলস, এই সময় নক হলো দরজায়। দরজার সবচেয়ে কাছে বসে খবরের কাগজ পড়ছে অপরিচিত লোকটা, সবাই আশা করল সেই দরজা খুলে দেবে, কিন্তু এক চুল নড়তে পর্যন্ত দেখা গেল না তাকে। যেমন কাগজ পড়ছিল তেমনি পড়তে লাগল। ব্যাপারটা লক্ষ করে অবাক হলো জুলস। দরজা খুলে দিল টম। হেগেন।

হেগেনকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল মো যীন। লম্বা লম্বা পা ফেলে কামরার ভেতর ঢুকল সে। পিছনে দুজন বডিগার্ড।

গুণ্ডা হিসেবে তো বটেই, সুদর্শন পুরুষ হিসেবেও নামডাক আছে মো গ্রীনের। ছয় ফিটের ওপর লম্বা, হাড়গুলো চওড়া, প্রচণ্ড শক্তি রাখে শরীরে। ব্রুকলিনে একটা সংঘবদ্ধ অপরাধী দল ছিল, তাদের ভাড়াটে খুনী হিসেবে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল সে। তারপর বেশি রোজগারের আশায় জুয়ার ব্যবসা শুরু করেছিল। ভালই আয় করছিল জুয়ার আড্ডা বসিয়ে, কিন্তু আরও টাকার লোভে আমেরিকার পশ্চিমে চলে আসে সে। সে-ই সবার আগে টের পেয়েছিল অপরাধীদের জন্যে লাস ভেগাস সাঙ্ঘাতিক সম্ভাবনাময় একটা জায়গা। প্রথম দিকে হাতে গোণা যে কটা হোটেল ক্যাসিনো হয়েছে এদিকে তার একটা ওর নিজেরই তৈরি। ওর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, হঠাৎ করে প্রচণ্ড রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মাথায় রক্ত চড়ে গেলে কাউকে গ্রাহ্য করে না সে। সেজন্যেই হোটেলের সবাই যমের মত ভয় করে তাকে। তাদের মধ্যে ফ্রেডি, লসি, জুলস সীগলও বাদ যায় না। এরা সবাই যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে রগচটা মো গ্রীনকে।

ঠিক এই মুহূর্তে প্রচণ্ড রেগে আছে মো গ্রীন, কিন্তু অন্যান্য সময় নিজেকে সে সামলে রাখার কোন চেষ্টা করে না, এখন করছে। সুদর্শন চেহারাটা কেমন যেন কদর্য বীভৎস হয়ে উঠেছে। সোজা এগিয়ে এসে মাইকেল কর্লিয়নির সামনে দাঁড়াল সে, হাত রাখল দুকোমরে। কখন তোমার সময় হবে আমার সাথে কথা বলার, সেজন্যে অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না, মাইকেল, ভরাট, কর্তৃত্বের সুরে বলল মম গ্রীন। কাল জরুরী কিছু কাজ আছে আমার, তাই ভাবলাম, এখনই ধরব তোমাকে। কিছু বলার আছে তোমার?

নিঃশব্দে মো গ্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে মাইকেল! ওর চেহারায় বিস্ময় এবং বন্ধুভাব, দুটোরই ছায়া ফুটে উঠেছে। মৃদু হাসল ও। খুব ভাল করেছ তুমি, গ্রীন, টম হেগেনের দিকে তাকান মাইকেল। গলা ভেজাবার জন্যে ওকে কিছু এনে দাও, টম।

মাইকেল হুকুম করছে টম হেগেনকে, ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না মো গ্রীনের।

খবরের কাগজের ওপর দিয়ে মো গ্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালবার্ট নেরি, দুচোখে শাপদের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি। ওর কাছেই দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মো গ্রীনের বডিগার্ডরা, তাদের দিকে ভুলেও একবার তাকাচ্ছে না নেরি। জানে, হিংসাত্মক ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই, অন্তত লাস ভেগাসে নেই। এব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। কেউ যদি সেই নিষেধ অমান্য করে কোন গোলমাল করে, তার বিচার হবে না, কিন্তু শাস্তি হবে। এত কড়াকড়ির কারণ হলো, ভেগাসে কোন গোলযোগ হলে পুলিশের বদনাম হবে, আর পুলিশের বদনাম হলে তারা অপরাধী এবং বেআইনী ব্যবসায়ীদেরকে আইনের প্রশ্রয় দিতে পারবে না। লাস ভেগাসকে জুয়াড়ীদের তীর্থস্থান করার সমস্ত স্বপ্ন বানচাল হয়ে যাবে।

ঘাড় ফিরিয়ে নিজের বডিগার্ডদের দিকে তাকাল মো গ্রীন। হাত নেড়ে পাইকারীভাবে কয়েকজনকে দেখিয়ে বলল, এদের সবার জন্য কিছু চিপের ব্যবস্থা করো, এরা সবাই হোটেলের খরচায় জুয়া খেলবে এখন। সবাই বুঝল জুলস, লুলি, জনি ফন্টেন আর মাইকেলের বডিগার্ড আলবার্ট নেরিকে কামর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে সে।

ব্যাপারটা হাসিমুখেই মেনে নিল মাইকেল। চমৎকার! সায় দিয়ে বলল ও।

মাইকেল কি বলে শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল অ্যালবার্ট নেরি, এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে সবার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।

কামরায় রইল ফ্রেডি, টম হেগেন, মো গ্রীন আর মাইকেল।

মদের গ্লাসটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল মো গ্রীন। অনেক কষ্টে রাগ চেপে রেখেছে সে, কিন্তু মুখটা তার টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ভরাট গলায় জানতে চাইল, এসব কি শুনছি আমি, মাইকেল? এত বড় স্পর্ধা হতে পারে কারও, এ তো আমি ভাবতেই পারি না। তোমরা নাকি আমার হোটেলের শেয়ারগুলো সব কিনে নিতে চাও? শোনো তাহলে, নিঃশব্দে হাসছে মো, তোমার বাপকে গিয়ে প্রস্তাব দাও, আমিই তোমাদের সব শেয়ার কিনে নিতে চেয়েছি। যত্তোসব! আমার শেয়ার কেলনার সুর দেখছে, ইহ!

এতটুকু উত্তেজিত হলো না মাইকেল, শান্তভাবে যুক্তি দেখাবার সুরে কথা বলছে সে, কেন তুমি শেয়ারগুলো বেচতে চাও না, সেটা আমাকে বুঝতে দাও, মো। যে-ই খেলতে আসে ক্যাসিনোতে, সেই প্রচুর টাকা জিতে নিয়ে যাচ্ছে, অন্তত সেই রকম হিসেবই দিয়েছ তুমি আমাদের। প্রতিটি বাড়িতেই লোকসান দিচ্ছে ক্যাসিনো! গলদটা কোথায়, ঠিক জানি না আমরা, কিন্তু গলদ যে একটা আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, তাই না? যে ব্যবসায় প্রতি সেকেণ্ডে লোকসান দিচ্ছ, সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার পেছনে তোমার উদ্দেশ্য কি? তারচেয়ে পুরোটা ছেড়ে দাও আমাদের হাতে আমরা চেষ্টা করে দেখি গলদটা দূর করতে পারি কিনা 

চাপা, কর্কশ শব্দে হেসে উঠল মো ণীন। যত শালার ভুইফোড় আমার কপালে এসে জুটেছে। তোমাদের অবস্থা যখন খারাপ, দম বেরিয়ে যায় যায়, তখন উপকার করার জন্যে ফ্রেডিকে নিলাম আমি, আর তার বিনিময়ে তোমরা এখন আমারই পাছায় লাথি মেরে ভাগাতে চাইছ। নিজেদেরকে কি মনে করেছ তোমরা? শোনা, আমাকে যা তা ধরে নিয়ে কিছু করতে যেয়ো না, তাতে পরে তোমাদের পস্তাতে হবে। আমি আমার শেয়ার বিক্রি করছি না, কেউ আমাকে এখান থেকে তাড়াতেও পারছে না। কর্লিয়নিদের সাথে টক্কর দিতে পারে এমন কিছু বন্ধু-বান্ধব আমারও আছে। তারা আমাকে সমর্থন করবে।

এখনও উত্তেজিত হচ্ছে না মাইকেল। গলায় আওয়াজ চড়ল না ওর, চেহারায় রাগের কোন ছাপ ফুটল না, শান্তভাবে বলল, ফ্রেডিকে তুমি আমাদের উপকার করার জন্যে নাওনি, কর্লিয়নি পরিবার তোমাকে মোটা টাকা দিয়েছিল বলে নিয়েছিলে। তুমি তখন তোমার হোটেলের জন্যে ফার্নিচার কিনতে পারছিলে না, ভুলে গেলে এরই মধ্যে? ক্যাসিনো চালু করার জন্যে মোটা টাকার দরকার ছিল অথচ একটা পয়সা ছিল না তোমার কাছে। এসব ভূলে যাচ্ছ কেন, সেটা কি তোমার উচিত হচ্ছে? আরও ব্যাপার আছে। ফ্রেডির জামিন হয়েছিল শলিনারি পরিবার, তাই তুমি ওকে নিতে রাজী হওয়ায় তারা তোমাকে কতরকম সুবিধে করে দিয়েছে তার হিসেব করে দেখেছ কখনও? কম্মিনি পরিবার তোমার কাছে সামান্য একটু ঋণী যদি হয়েও থাকে অনেকদিন আগেই তা শোধ করে দিয়েছে। যাই হোক, তোমার এত রাগ করার কি আছে তা কিন্তু বুঝতে পারছি না আমি। তুমি কি ভাবছ আমরা তোমাকে ঠকাবার মতলব করেছি? সে রকম কোন ইচ্ছে আমাদের নেই, মো। ন্যায্য একটা দাম বলো তুমি, আমরা ঠিক সেই দামেই কিনে নেব তোমার শেয়ারগুলো। এতে অন্যায়টা কোথায়? তোমার ক্যাসিনো যদি লাভের ব্যাপার হত তাহলে প্রস্তাবটাই তুলতাম না আমরা, কেননা কারও রুজির ওপর হাত দেয়া আমাদের নীতি নয়। কিন্তু ক্যাসিনো তো প্রতি মুহূর্তে লোকসান দিচ্ছে। এটাকে বিক্রি করে দেয়াই তো তোমার জন্যে বুদ্ধিমানে কাজ হবে। একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝবে, আমরা আসলে তোমার উপকার করতে চাইছি।

দ্রুত মাথা নাড়ল মো গ্রীন। তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, কর্লিয়নি পরিবারের এখন ডুবন্ত অবস্থা, সে গায়ের জোর এখন আর নেই তোমদের। যা খুশি তাই করে বেড়ানো এখন আর তোমাদের পক্ষে ব নয়। গড় ফাদার সুস্থ হলে আলাদা কথা ছিল। অন্যান্য পরিবারগুলো তোমাদেরকে নিউ ইয়র্ক থেকে ভাগিয়ে দিচ্ছে। সেজন্যেই তোমরা মতলব ফেঁদে এখানে পালিয়ে এসে সবার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, সুবিধে করতে পারবে না তোমরা। বরং আমার পরামর্শটা গ্রহণ করো, মাইকেল, অন্য কোথাও আশ্রয় খোজো, এখানে তোমাদের জায়গা নেই। যদি ভাল চাও তো মন থেকে আমার শেয়ার কেলনার কথা মুছে ফেল।

মৃদু গলায় বলল মাইকেল, তবে কি এই সব কথা ভেবেই তুমি সাহস পেয়েছ ফ্রেডিকে সবার সামনে অপমান করার?

চমকে উঠল টম হেগেন। ঝট করে তাকাল সে ফ্রেডির দিকে।

লাল হয়ে উঠেছে ফ্রেডির মুখ। তাড়াতাড়ি বলল সে, আহা, মাইক, ওসব ব্যাপার টেনে আনার দরকারটা কি? ওটা কোন ব্যাপারই নয়। যা ঘটে গেছে, ঘটে গেছে–আমি বা মো কেউ কিছু মনে করিনি। হঠাৎ একজন মানুষের রাগ তো হতেই পারে, মো-রও তাই হয়েছিল। এমনিতে ওর সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক, আমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে ঝগড়া নেই। কি বলো, মো?,

চেহারায় অদ্ভুত একটা আক্রোশ ফুটে উঠেছে মো গ্রীনের ফ্রেডির দিকে তাকাল সে, বলল, ঠিক। পরমুহূর্তে মাইকেলের দিকে ফিরল। ভাল করে একটা ব্যবসা চালাতে হলে লোকজনদের পাছায় লাথি না মারলে চলে না। ফ্রেডির ওপর খেপে গিয়েছিলাম আমি, কাল হোটেলের সব মেয়ের সাথে প্রেম করতে শুরু করে দিয়েছিল ও, ককটেল-ওয়েট্রেসদেরও বাদ দিচ্ছিল না। ফলে ওরা যে কাজে গাফিলতি করবে সে তো জানা কথা। সাবধান করতে গেলাম, উল্টে আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিল। তাই বাধ্য হয়ে ওর গালে চড় মেরেছি আমি। উচিত শিক্ষা দেবার জন্যে দরকার ছিল ওটার।

ভাবের কোন চিহ্নমাত্র নেই মাইকেলের চেহারায়। বড় ভাইয়ের দিকে তাকাল ও, জানতে চাইল, উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার, ফ্রেডি?

মুখ হাঁড়ি করে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল ফ্রেডি, কিন্তু জবাব দিল না।

নিঃশব্দে হাসছে মো যীন। ও শালার কাণ্ড শুনলে মাথা ঘুরে যাবে তোমার, মাইকেল। শুয়োরটা একসাথে দুটো মেয়েকে নিয়ে শুতো, পুরানো সেই স্যাণ্ডউইচের নিয়মে। ফ্রেডির দিকে তাকাল সে। তবে, হ্যাঁ, একশো বার স্বীকার করব আমি, মেয়েগুলোকে সত্যি তুমি একেবারে মজিয়ে ফেলেছিলে, যাকে বলে পুরোপুরি ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলা। আমার বিশ্বাস, তুমি ছেড়ে দিলে আর কারও পক্ষে ওদেরকে সুখী করা সম্ভব নয়।

আশ্চর্য হয়ে হেগেনের দিকে তাকাল মাইকেল! দুজনেই বুঝল ফ্রেডির ওপর এটাই ডনের রাগের কারণ। যৌন ব্যাপারে রীতিমত গোড়া তিনি, দুজন মেয়েকে বিছানায় নিয়ে শোয়াটাকে চরম দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না। ফ্রেডির ওপর অসন্তুষ্ট হবার আরও বড় কারণ এখন জানতে পারল হেগেন। মো গ্রীনের মত একজন লোকের হাতে ব্যক্তিগত অপমান সহ্য করলে কর্লিয়নি পরিবারের অসম্মান হয়।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মাইকেল। তার কথায় বিদায়ের সুর বেজে উঠল, কালই নিউ ইয়র্কে ফিরে যাচ্ছি আমি, তার মানে রাতেই ডেবে ঠিক করে রেখো কত দাম চাইবে তুমি শেয়ারগুলোর। কাল সকালে জানতে হবে আমাকে।

শুয়োরর বাচ্চা! ভেবেছিস এভাবে আমাকে খসাতে পারবি? হিংস্র ভঙ্গিতে বলল মো গ্রীন। গুণ্ডামি ছেড়ে দেবার আগে তোর চেয়ে ঢের বেশি মানুষ খুন করেছি আমি। নিউ ইয়র্কে যাব আমি। স্বয়ং ডনের সাথে কথা বলব।আমার একটা প্রস্তাব আছে তার কাছে।

ভয় পেয়ে গেল ফ্রেডি, অসহায়ভাবে হেগেনের দিকে তাকাল সে। তুমি তো কনলিয়রি, টম, ডনের সাথে কথা বলে তাকে তুমি পরামর্শ দিতে পারো।

ঠিক এই সময় মাইকেলের হিম-শীতল ব্যক্তিত্বের ক্ষুরধার স্পর্শ অনুভব করল ভেগাসের লোক দুজন। নিচু গলায়, কিন্তু তীক্ষ্ণষরে বলল মাইকেল, ডন কর্লিয়নি আধা-অবসর নিয়েছেন পারিবারিক ব্যবসা এখন আমার হাতে। টম হেগেনকে। আমি কনসিলিয়রির পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন থেকে আমার উকিল ও। কিছুদিনের মধ্যেই সপরিবারে চলে আসছে এখানে, আইনগত সমস্ত ঝামেলা ও-ই সামলাবে। সুতরাং কারও যদি কিছু বলার থাকে, আমাকেই বলতে হবে। এখন আমিই সব।

কামরার ভেতর জমাট নিস্তব্ধতা। কেউ কথা বলছে না।

মৃদু গলায় আবার বলল মাইকেল, ফ্রেডি, তুমি আমার বড়, তাই তোমার ওপর আমার শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আজ এই প্রথম আর শেষবারের মত তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি আমি, আর কখনও বাইরের কারও সাথে একজোট হয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলতে যেয়ো না। আজ যা করেছ তুমি তা আমি ডমের কাছে উল্লেখ পর্যন্ত করব না। মো গ্রীনের দিকে ফিরুল মাইকেল। কেউ যদি তোমাকে সাহায্য করতে চায়, তাকে কখনও অপমান করতে নেই। শুনেছিলাম তোমার রাগ একটু বেশি। কিন্তু যুক্তির বিরুদ্ধেও তুমি রাগ দেখাতে কুণ্ঠিত হও না, তা আমার জানা ছিল না। এই রাগ পুষে না রেখে যদি ক্যাসিনো কেন লোকসানে চলছে সেদিকে একটু নজর দিতে, নিজেরই সেবা করা হত সেটা। কর্লিয়নি পরিবার বিস্তর টাকা ঢেলেছে ওতে, কথাটা তুমি ভুলে যেতে চাইলেও আমরা তোমাকে ভুলতে দেব না। এত সব কথা আমাকে তুমি বলতে বাধ্য করলে, কিন্তু তোমাকে গালমন্দ করার জন্যে এখানে আমি আসিনি। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আমার হাত এখনও বাড়িয়ে রেখেছি-তুমি যদি সেই হাতে থুতু ফেল, সেটা তোমার ব্যাপার, তুমি বুঝবে। বলার আর কিছু নেই আমার।

একবারও গলা চড়ায়নি মাইকেল, কিন্তু কথাগুলো শুনে ফ্রেডি আর মো গ্রীন একেবারে চুপসে গেল পালা করে ওদের দুজনের দিকে তাকাল মাইকেল, তারপর সরে গেল টেবিলের কাছ থেকে। তার মানে বিদায় হতে বলছে ওদেরকে।

উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল টম হেগেন; আনুষ্ঠানিক বিদায় অর্থাৎ গুড নাইট না বলেই কামরা থেকে বেরিয়ে গেল মো গ্রীন আর ফ্রেডি।

পরদিন সকালেই মো গ্রীন খবর পাঠাল মাইকেলের কাছে। না, যত দামই দেয়া হোক না কেন, সে তার শেয়ার বিক্রি করবে না। খবরটা দিয়ে গেল ফ্রেডি। শ্রাগ করল মাইকেল। বলল, নিউ ইয়র্কে ফিরে যাচ্ছি আমি, তবে তার আগে নিনোকে দেখতে চাই একবার।

নিনোর স্যুইটে পৌঁছে ওরা দেখল সোফায় শুয়ে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে জনি ফন্টেন। বেডরুমের পর্দা ফেলা রয়েছে, সেখানে ডাক্তার জুলস সীগল পরীক্ষা করছে। নিনোকে। খানিক পরই তুলে দেয়া হলো পর্দা।

নিনো ভ্যালেন্টির চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেল মাইকেল। চোখের সামনে এই মুহূর্তেও যেন ভেঙে পড়ছে লোকটা। ঢিল পড়েছে পেশীতে, প্রায় বুড়োই দেখাচ্ছে তাকে। ধীরে ধীরে তার বিছানার পাশে বসল মাইকেল। বলল, নিনো, কেমন আছ তুমি? শেষ পর্যন্ত তোমার দেখা মিলল, সেজন্যে ভীষণ খুশি হয়েছি আমি ডন তোমার কথা সব সময় জানতে চান।

নিঃশব্দে হাল নিনো, সেই দাঁত বের করা পুরানো হাসি। গড ফাদারকে বোলো, আমি মারা যাচ্ছি। তাকে জানিয়ে এই নাচ-গানের ব্যবসাটা তার জলপাই তেল ব্যবসার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক।

তুমি সেরে উঠবে, নিনো, বলল মাইকেল। কোন ব্যাপারে তোমার কি কোন দুশ্চিন্তা আছে? বা তোমার জন্যে কি কিছু করার আছে কর্লিয়নি পরিবারের? আমাকে বলতে পারো। তেমন কিছু আছে, ভাই?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল নিনো ভ্যালেন্টি। নেই, কিছুই নেই।

 কয়েক মিনিট গল্প করে বিদায় নিল মাইকেল।

এয়ারপোটে ওদের সাথে এল ফ্রেডি। তবে মাইকেলের অনুরোধে প্লেন ছাড়ার আগেই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল সে। টম হেগেন, মাইকেল আর অ্যালবার্ট নেরি প্লেনে চড়ল।

ওকে ভাল করে মেপে নিয়েছ তো? নেরির দিকে ফিরে জানতে চাইল মাইকেল। নিজের মাথায় তর্জনী দিয়ে একটা টোকা মারল নেরি। মো গ্রীনকে গুছিয়ে নম্বর দিয়ে রেখেছি এখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *