৪.০১ সিসিলি

শেষ পর্ব

০১.

সিসিলি।

একই ধাঁচে গড়ে উঠেছে সবগুলো গ্রাম। মাঝখানে মস্ত এক ফাঁকা জায়গা, সেখানে বিরাট এক কৃত্রিম ঝর্ণা, ঝর্ণার চারদিক ঘিরে গ্রামের বাড়ি-ঘর। এই গ্রামটা বড় রাস্তার ধারে বলে কয়েকটা মুদি আর মদের দোকান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর কাছ থেকে সামান্য একটু তফাতে খুদে একটা কাফেও রয়েছে। কাফের সামনে ছোট্ট ঢাল, সেখানে তিনটে টেবিল ফেলা।

রাখালেরা, অর্থাৎ মাইকেল কর্লিয়নির দুই বডিগার্ড, কার্লো আর ফ্যাব্রিযযিয়ো, চাতালে উঠে এসে একটা টেবিল দখল করে বসল। একটু পরই সেখানে এসে জুটল মাইকেল। কিন্তু যে মেয়েগুলোর পিছু নিয়ে এদিকে এসেছে ওরা, তাদের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না কোথাও। গ্রামটাকে নির্জীব, ফাঁকা, আর বৈরী লাগছে মাইকেলের। এদিক ওদিক ঘুর ঘুর করছে ধুলোমাখা কয়েকটা বাচ্চা ছেলে। তারপর চোখে পড়ল ভাবঘুরে চরিত্রের, বিশ্ব-সংসার সম্পর্কে উদাসীন এক গাধা। গ্রামটা যেন এদেরকে নিয়েই। ওদের দেখে বেরিয়ে এল কাফের মালিক! বেঁটে, ছোটখাটো মানুষ, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় গায়ে শক্তি রাখে। চেহারায় আন্তরিক আনন্দের ছাপ ফুটিয়ে তুলে অভিবাদন করল সে। এদিকে আপনারা নতুন, তাই আমার ছেলেদের কথা জানেন না, টেবিলে এক প্লেট ভাজা মটর রেখে বলল সে, একটু শুধু চেখে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন কি আশ্চর্য হাত ওদের। এত ভাল মদ ইটালির আর কোথাও পাবেন না। নিজস্ব বাগানের আঙুর দিয়ে আমার ছেলেরা নিজের হাতে তৈরি করেছে এই মদ। এর সাথে আবার লেবু আর কমলা মিশিয়েছে। একবার খেলে ভুলতে পারবেন না।

অর্ডার দিবার আগে মাইকেলের দিকে একবার তাকাল ফ্যাব্রিযযিয়ো।

প্রচুর মদ দরকার এখন ওর, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। দরাজ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সবচেয়ে বড় জগ ভরে মদ আনতে বলল সে। জিভে ঠেকতে যা দেরি, সাথে সাথে মালিকের কথা স্বীকার করে নিল ওরা। যতটুকু বলেছে মদটা তার চেয়েও ভাল। রঙটা ঘন বেগুনী, ব্র্যাণ্ডির চেয়েও কড়া।

জানা কথা, বলল ফ্যাৱিষযিয়ো, এদিকের সব মেয়েকে চেনেন আপনি। আসার পথে কয়েকজন সুন্দরী চোখে পড়ল, তাদের একজনকে দেখে, ইশারায় মাইকেলকে দেখাল সে, আমাদের এই মনিব ভদ্রলোকের মাথায় বাজ পড়েছে।

কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠল মালিকের চোখে। খুঁটিয়ে দেখছে এখন। মাইকেলকে। এর আগে পর্যন্ত চোয়াল ভাঙা লোকটাকে দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি তার। কিন্তু মাথায় বাজ পড়েছে যার, তাকে আর সাধারণ বলে মনে করা যায় না। তার যন্ত্রণায় কাতর হওয়াটাই তো নিয়ম। সত্যি? সত্যি আপনার মাথায় বাজ পড়েছে, বন্ধু? তাহলে আমার একটা পরামর্শ নিন, আরও কয়েকটা বোতল সাথে করে নিয়ে যান, রাতে ঘুমাতে চাইলে এগুলোর সাহায্য দরকার হবে আপনার।

মেয়েটার খোঁজ দিতে পারেন? মাথার চুল অস্বাভাবিক কোকড়া, গায়ের রঙ দুধের সরের মত, খুব কার্লো আর খুব বড় বড় চোখ? শান্ত উদ্বেগের সাথে জানতে চাইল মাইকেল। খুব সুন্দরী, খুব লম্বা, হাসলে টোল পড়ে গালে, মাইকেলের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে, তা নাহলে লক্ষ করতে ভুল করত না যে তার কথা শুনতে শুনতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে মালিকের হোরা। বান্ধবীদের সাথে এদিকেই তো এল। দেখেছেন নাকি?

না, দেখিনি, গম্ভীর মুখে কথাটা বলে দ্রুত পিছন ফিরল মালিক, হন হন করে হেঁটে কাফের ভেতর গায়েব হয়ে গেল।

ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা, ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে মদ খাচ্ছে। খানিক পরই শেষ হয়ে গেল জগটা, কিন্তু গলা ভেজেনি। আরও মদ চাইছে ওরা। অথচ মালিকের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না কোথাও। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ফ্যাব্রিযুয়িয়ো। খোঁজ নিতে গেল। একটু পরই ফিরে এল সে। চলো, কর্লিয়নির দিকে হাঁটা দেয়া যাক, সেটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে, বলল সে। যা ভেবেছি ঠিক তাই। মেয়েটা ওরই। কাফের পিছনে বসে মাথা গরম করছে এখন সে, আমাদের ক্ষতি করতে চায়।

যৌন ব্যাপারে সিসিলীয়রা সাঙ্ঘাতিক স্পর্শকাতর, কিন্তু এত দিন এই দ্বীপে বসবাস করার পরও এটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মাইকেল। তাছাড়া, কাফের মালিক লোকটার আচরণ একজন সিসিলীয়র পক্ষেও বেশি রক্ষণশীল হয়ে যাচ্ছে। সামান্য একটা ব্যাপার, কেউ তো আর তাকে অপমান করেনি, তাহলে এত বাড়াবাড়ি করার কি মানে?

কিন্তু মালিকের আচরণটাকে কার্লো আর ফ্যাব্রিযযিয়ো অতি স্বাভাবিক বলেই ধরে নিচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে ভুল জায়গায় টোকা মারা হয়ে গেছে, সুতরাং এ-ব্যাপারে করার আর কিছুই নেই, এই রকম কিছু একটা ভাবছে ওরা। অপেক্ষা করছে। মাইকেল কখন চেয়ার ছেড়ে উঠে রওনা দেবে।

কি বলছিল, জানো? মাইকেলকে বলল ফ্যাব্রিযযিয়ো। ভারি জবরদস্ত দুই ছেলে ওর, তাদের একটা খবর দিলেই নাকি তারা ছুটে এসে আমাদের ছাল ছাড়িয়ে নেবে। হারামজাদার কথা শোনো। কই, ওঠো, এখানে বসে থেকে আর কি লাভ?

চোখ তুলে তাকাল মাইকেল। অমনি মুখের ভেতর জিভ জমে একেবারে বরফ হয়ে গেল ফ্যাব্রিযযিয়োর। ঠাণ্ডা ছুরির মত ধারালো দৃষ্টি মাইকেলের চোখে। পারলে পিছিয়ে যেত ফ্যাব্রিযযিয়ো, কিন্তু হাত-পা অবশ হয়ে গেছে তার। ঘন ঘন ঢোক গিলছে।

মাইকেলের এই চেহারা ওদের পরিচিত নয়। এর আগে পর্যন্ত ওকে চুপচাপ থাকতে দেখেছে ওরা। আমেরিকানরা যেমন হয়, সব সময় শান্তশিষ্ট, নম, সাদাসিধে। তবে এটুকু বুঝত, সিসিলিতে এসে যখন গা ঢাকা দিতে হয়েছে, তখন পুরুষোচিত কিছু একটা ঘটিয়েছে তো বটেই। কিন্তু কর্লিয়নি দৃষ্টি কাকে বলে জানা ছিল না ওদের। এই প্রথম দেখছে। ফ্যাব্রিযযিয়ো জানে, এখন একচুল নড়লে বা একটু শব্দ করলে মাইকেলের তরফ থেকে বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।

মাইকেলের আসল পরিচয় আর কীর্তির কথা সিসিলিতে একমাত্র ডন টমাসিনো জানেন, জানেন বলে তিনি ওর সাথে সতর্ক আচরণও করে থাকেন। তারই মত একজন বলে মনে করেন ওকে, প্রাপ্য সম্মান আর শ্রদ্ধা দেখাতে ভুল করেন না। কিন্তু এই অশিক্ষিত রাখালেরা ওর সম্পর্কে কিছু জানে না, তবে না জানলেও মনগড়া একটা কিছু ভেবে নিতে তো আর বাধা নেই। তাদের সেই ভাবনাটা মোটেও বিচক্ষণ কিছু নয়। ছুরির মত ধারাল ওই হিম দৃষ্টি ফ্যাকাসে আড়ষ্ট মুখ, বরফ যেমন ধোয়া ছাড়ে তেমনি শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রাগের ভাপ–এসব দেখে হ্যাঁৎ করে উঠল ওদের বুক। মাইকেলকে চেনে বলে ধারণা ছিল ওদের, সেই ধারণাটা এক নিমেষে মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে। ওকে এখন অজানা একটা ভীতি বলে মনে হচ্ছে ওদের।

অপেক্ষার মুহূর্তগুলো শেষ হয়েছে মাইকেলের। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও, রাখালদের কাছ থেকে যথাযোগ্য মনোযোগ আর সম্মান আদায় করা গেছে। এতক্ষণে মুখ খুলল ও, আমার কাছে নিয়ে এসো ওকে।

একমুহূর্ত দেরি বা ইতস্তত করল না ওরা। দুজনেই কাঁধে তুলে নিল যার যার বন্দুক, দৃঢ় পায়ে সোজা গিয়ে ঢুকল কাফের ভেতর। খানিক পরই বেরিয়ে এল। ওরা। মাঝখানে দেখা যাচ্ছে কাফের মালিককে। একটু সতর্ক দেখাচ্ছে লোকটাকে, কিন্তু ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে যায়নি।

চেয়ারে হেলান লি মাইকেল। কয়েক সেকেন্ড সময় লি ও, লোকটাকে দেখে নিল ভাল করে। আপনার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করায়, শান্ত গলায় বলল ও, লাম আপনি নাকি রাগ করেছেন। সেজন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে পারি আমি, কিন্তু আল ব্যাপার হলো, আমি একজন বিদেশী, এখানকার রীতিনীতি ভাল বুঝি না। আমাকে ভুল বুঝবেন, সেটা আমার কাম্য নয়। আপনাকে বা আপনার মেয়েকে অপমান করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে।

হতভম্ব দেখাচ্ছে কার্লো আর ফ্যাবিযিয়োকে। কই, ওদের সাথে কথা বলার সময় মাইকেলের গলার আওয়াজ তো এমন শোনায়নি কখনও! অপরাধ হয়ে থাকলে ক্ষমা চাইল মাইকেল, অথচ কথার সুরে ফুটে উঠল কর্তত আর আদেশ। আগের চেয়েও এখন আর সাবধান হয়ে গেল মালিক। মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল সে। পরিষ্কার টের পেয়ে গেছে, যার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সে কোন চাষাভূষো নয়, কর্তা। গোছের একজন কেউ না হয়েই যায় না।

আপনি কে? জানতে চাইল সে। আমার মেয়ের সাথে কি দরকার আপনার?

আমি একজন আমেরিকান, কোন রকম দ্বিধা বা সতর্কতা দেখা যাচ্ছে না মাইকেলের মাঝে, পুলিশের ভয়ে এখানে পালিয়ে এসে লুকিয়ে আছি। একটা যদি খবর দেন পুলিশকে, সাথে সাথে এক বস্তা টাকা পেয়ে যাবেন আপনি। কিন্তু তাতে লাভ হবে না কিছুই। আপনার মেয়ে তার বাপকে তো হারাবেই, তার ওপর বেচারীর কপালে স্বামীও জুটবে না। একটু সময় দিল ও কথাগুলো যাতে লোকটার মনে ভাল করে গেথে বসে। তারপর বলল, ভদ্রতা বজায় রেখে চলাফেরা করি আমি, ধর্মের ওপরেও আস্থা আছে, সুতরাং আমাকে দিয়ে আপনার মেয়ের কোন ক্ষতি হবে না। তার অসম্মান করা আমার ইচ্ছা নয়। তবে, ওর সাথে কথা বলতে চাই। কথা বলে যদি দেখি, আমাদের মনের মিল হচ্ছে, তাহলে ওকে বিয়ে করব। আর মনের মিল যদি না হয়, এই শেষ, জীবনে কখনও আপনি বা আপনার মেয়ে দেখতে পাবেন না আমাকে। মনের মিল হবে কি হবে না, তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। যদি হয়, আমার স্ত্রীর বাপের যা যা জানা উচিত তার সবই আপনাকে জানাব আমি।

শুধু কার্লো আর ফ্যাব্রিযযিয়ো নয়, এবার কাফের মালিকও অবাক হয়ে তাকাল মাইকেলের মুখের দিকে। ভক্তি আর শ্রদ্ধার সাথে ফিসফিস করে বলল ফ্যাব্রিযযিয়ো, ঠাট্টা নয়, সত্যি বাজ পড়েছে।

কাফের মালিকের চেহারা থেকে বিতৃষ্ণা আর রাগের ছাপ মুছে গেছে, চিড়, ধরেছে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে। মাইকেলের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকার পর অত্যন্ত সাবধানে জানতে চাইল সে, আপনি কি বন্ধুদের বন্ধু?

সাধারণ একজন সিসিলীয় মাফিয়া শব্দটা ইচ্ছা করলেই হঠাৎ উচ্চারণ করতে পারে না, তাই মাইকেল মাফিয়া সংগঠনের সদস্য কিনা তা এর চেয়ে সহজ করে জানতে চাওয়ার আর কোন উপায় নেই মালিকের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সরাসরি প্রশ্নটা কখনোই করা হয় না।

না, বলল মাইকেল। আমি একজন বিদেশী।

মাইকেলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরেকবার চোখ বুলাল কাফের মালিক। বাঁ চোয়ালটা ভাঙা, এর একটা তাৎপর্য অবশ্যই আছে–তাছাড়া অমন লম্বা পা সচরাচর দেখা যায় না সিসিলিতে। এরপর কাফের মালিক নির্ভয়ে সোজাসুজি দুই দেহরক্ষীর দিকে তাকাল। কাঁধে লুপাল বন্দুক, মাইকেলের নির্দেশের অপেক্ষায় ঠার একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। হন হন করে কাফেতে ঢুকে তাকে বলেছিল, ওদের মনিব কথা বলতে চায় তার সাথে। খেঁকিয়ে উঠেছিল সে, শালা বানচোত বলে গালাগাল দিয়ে বলেছিল, এই মুহূর্তে তারা যেন চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যায়। কিন্তু ওরা ভয় তো পায়ইনি, উত্তেজিতও হয়নি। বরং শুভানুধ্যায়ীর মত বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে .ওদের একজন বলেছিল, দয়া করে নিজের অসুবিধে করবেন না। আমার কথা বিশ্বাস করুন, মনিবের কথা শুনলে আপনার কোন ক্ষতি হবে না! একবার বাইরে এসে ওর কথা শুনুন, তাতে আপনার ভালই হবে। দেহরক্ষীর কথা শুনে কন যেন মাথা ঠাণ্ডা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল সে, মনে হয়েছিল বাইরে বেরিয়ে এসে লোকটার কথা শুনলেই বোধহয় ভাল হয়।

এখন অচেনা লোকটার কথা শুনে ভাবছে, আর যাই হোক, এই লোককে অপমান করা উচিত হবে না তার। কি থেকে কি হয়ে যায় তার কোন ঠিক নেই, তারচেয়ে এর সাথে ভদ্র আচরণ করাই সবদিক থেকে ভাল। তবু চেহারা আর কণ্ঠস্বর থেকে অনিচ্ছার ভাবটুকু এড়াতে পারল না সে। আমার নাম ভিটেলি। গ্রামের ওপর ওই পাহাড়ে আমার বাড়ি। রবিবার বিকেলে আসুন আপনি। বাড়িতে নয়, এখানে। এখান থেকে নিয়ে যাব আপনাকে।

মুখ খুলতে যাচ্ছিল ফ্যাৱিষযিয়ো, কিন্তু মাইকেল তার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল। বুকের রক্ত ছলকে উঠল ফ্যাৱিযযিয়োর, মুখের ভেতর শক্ত কাঠ হয়ে গেল জিভটা। ব্যাপারটা লক্ষ করুল ভিটেলি। তাই মাইকেল উঠে দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিতে তাড়াতাড়ি সেটা ধরে একটু হাসল সে। অচেনা লোকটাকে খেপিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য নয় তার। খোঁজ-খবর তো অবশ্যই নিতে হবে, মন স্থির করে ফেলেছে সে, সেগুলো যদি ঠিক মত মিলে না যায়, চিন্তা কি, মরণ বাড় বেড়ে ওঠা বাছাধন মাইকেলকে অভ্যর্থনা করার জন্যে তো জবরদস্ত ছেলে দুটো রয়েইছে, শট গানগুলোয় আজই তেল দিয়ে রাখবে তারা।

বন্ধুর বন্ধুদের সাথে এক-আধটু সম্পর্ক আছে বৈকি ভিটেলির, কিন্তু তাদের সাহায্য নিতে হবে বলে মনে করছে না সে। সিসিলির লোকেরা অকারণ সৌভাগ্যে। বিশ্বাস করে, সে-ও এই মুহূর্তে তাই করছে। মেয়ের রূপ আছে, এই রূপই এবার তাদের পরিবারের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে। সেটা মন্দ কি? তাছাড়া, পড়ার কয়েকটা উঠতি বয়েসের ছোকরা এরই মধ্যে ওর চারপাশে মাছির মত ডনডন করতে শুরু করেছে, সুযোগ পেলে এই মুখ ভাঙা ছেলেটা তাদেরকে ভাগিয়ে দিতে পারবে। অচেনা আগন্তুককে খুশি করার জন্যে তাকে সবচেয়ে ভাল একটা মদের বোতল উপহার দিল ভিটেলি। লক্ষ কল, ওদের বিল মেটাল মাইকেল নয়, দেহরক্ষীদের একজন। তার মানে, দেহরক্ষীদের চেয়ে ওর মর্যাদা অনেক বেশি, বুঝতে পারল সে।

ঘুরে বেড়াতে আর ভাল লাগছে না মাইকেলের! একটা গ্যারেজ খুঁজে বের কবতে বেগ পেতে হলো না ওদের। গাড়ি আর ড্রাইভার ভাড়া করে ডিনারের আগেই কর্লিয়নিতে ফিরে এল ওরা।

বাড়ি ফিরেই ডাক্তার তাজাকে সব কথা জানিয়ে দিল রাখালরা। রাতেই বাগানে বসে ডন টমাসিনোকে তিনি বললেন, খবর শুনেছেন? আজ নাকি আমাদের বন্ধুর মাথায় বাজ পড়েছিল।

ডন টমাসিনো অস্বস্তির সাথে বললেন, পালার্মোর ছোকরাগুলোর মাথায়। দুএকটা বাজ পড়লে শান্তি পেতাম আমি! বড় শহরগুলোয় নতুন একদল মাফিয়া সর্দারের উত্থান ঘটছে, তিনি তাদের কথা বলছেন। ওরা তার মত পুরানো নেতাদের সাথে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে রেষারেষি করছে। সে যাই হোক, ডাক্তার তাজা কিন্তুনাছোড়বান্দা, তিনি ডন টমাসিনোকে সব কথা সবিস্তারে শোনালেন।

রোববারে রাখালদেরকে আপনি আমার সাথে যেতে নিষেধ করবেন, ডন। টমাসিনোকে বলল মাইকেল। মেয়ের বাড়ির লোকদের সাথে ডিনার খেতে বসব আমি আর বাইরে ঘুরঘুর করবে ওরা, সেটা ভাল দেখায় না।

একটু গম্ভীর হলেন মাসিনো। এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। একটা কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি মাইকেল। তোমার নিরাপত্তার জন্যে আমি তোমার বাবার কাছে দায়ী। এমন কোন অনুরোধ কোরো না যেটা আমি রাখতে পারব না। একটু থেমে রীতিমত অসন্তুষ্ট গলায় আবার বললেন, আরও শুনলাম, তুমি নাকি বিয়ের কথাও তুলেছ। কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তুমিই ভাল বোঝো–কিন্তু তোমার বাবার কাছে নোক পাঠিয়ে তার অনুমতিটা আগে নিতে হবে আমাকে, তা নাহলে আমি মত দিতে পারব না :

ডন টমাসিনো একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক, তাই অত্যন্ত সাবধানে, ভেবেচিন্তে কথা বলছে মাইকেল। যাই বলুন তিনি, তাকে অপমান করে বা তার মনে আঘাত দিয়ে কিছু বলতে পারে না সে। বাবা কেমন মানুষ সে তো আপনি জানেন, ডন। টমাসিনো। একবার কেউ যদি তাঁর কথায় না বলে, স্রেফ কালা বনে যান তিনি। যতক্ষণ না আবার হ্যাঁ বলছে সে ততক্ষণ তিনি শ্রুতিশক্তি ফিরে পান না। আপনি জানেন না, আপনার জানার কথাও নয়, বাবা কিন্তু অনেকবার আমার মুখে না শুনেছেন। দেহরক্ষীরা আমার সাথে যাবে, আপনার এই শর্তটা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার জানা থাকা দরকার আপনার, তা হলো, বিয়ে করার যদি ইচ্ছে হয় আমার, কারও অনুমতি ছাড়াই বিয়ে হবে। এতে আপনার মনে করার কিছু নেই। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিজের বাপকে নাক গলাতে দিইনি, এখন যদি আপনাকে নাক গলাতে দিই, তাকে যে অপমান করা হয়।

বিয়ে তাহলে হতেই হয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন টমাসিনো। শোনো তাহলে, তোমার ওই বাজটিকে খুব ভাল করেই চিনি আমি। শুধু সুন্দরী নয়, স্বভাব চরিত্রের দিক থেকেও ভারি ভাল। পরিবারটিও কারও সাতে-পঁচে থাকে না, ওরা সবাই খুব ভাল মানুষ। তুমি যদি ওদের মর্যাদা হানির কারণ হও, মেয়ের বাপটি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেবে না। সেক্ষেত্রে মান বাঁচাবার জন্যে তোমাকেও আবার রক্তপাত ঘটাতে হবে। তাছাড়া, পরিবারটির সাথে আমার খাতির আছে, তাই তেমন কিছু ঘটতে দিতে পারি না আমি।

কেমন মেয়ে কে জানে! বলল মাইকেল। আমাকে দেখেই হয়তো নাক সিটকাবে। একেবারে ছেলে মানুষ তো, আমাকে হয়তো বুড়ো ভাববে। ডাক্তার তাজা আর ডন টমাসিনো নিঃশব্দে হাসছেন। উপহার ইত্যাদি নিতে হবে, সেজন্যে কিছু টাকা লাগবে আমার। আর একটা গাড়ি।

সব দায়িত্ব ফ্যাব্রিযযিয়োর ওপর ছেড়ে দিলেই হবে, বললেন ডন টমাসিনো। ছোকরা নৌ-বহরে যন্ত্রপাতির কাজ শিখেছিল। ভারি চালাক-চতুর। কাল সকালে পাবে তুমি টাকা, সকালেই সব কথা জানিয়ে তোমার বাবাকে খবর পাঠাব আমি। এ-কাজে বাধা দিতে পারবে না তুমি।

ডাক্তার তাজার দিকে ফিরল মাইকেল।,নাক দিয়ে এই যে অবিরাম সর্দি ঝরছে, এটা বন্ধ করার কোন ওষুধ আছে আপনার কাছে? সারাক্ষণ যদি নাক ঝাড়ি, মেয়েটা ভাববে কি?

কিসসু চিন্তা কোরো না, বললেন ডাক্তার তজা। রওনা হবার আগে একটা ওষুধ লাগিয়ে দেব। জায়গাটা একটু অসাড় হয়ে থাকবে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, তুমি তো আর এখুনি ওকে চুমু খেতে যাচ্ছ না। নিজের রসিকতাটায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন তাজা, তার সাথে-যোগ দিলেন ডন টমাসিনো।

রবিবারের জন্যে একটা আলফা রোমিও গাড়ির ব্যবস্থা হলো। একটু পুরানো, কিন্তু কাজ চলবে। বাসে চেপে পালার্মোয় গেল মাইকেল নিজে, মেয়েটি আর তার বাড়ির লোকজনদের জন্যে কিছু উপহার কিনে আনল। ইতিমধ্যে মেয়েটির নাম জানা হয়ে গেছে: অ্যাপলোনিয়া। রবিবার আসার আগ পর্যন্ত রোজ রাতে তার সুন্দর নাম, সুন্দর চেহারার কথা ভাবে সে। ঘুম আসে না, তাই মদ খেতে হয় প্রচুর। বুড়ি পরিচারিকার ওপর নির্দেশ আছে, সে যেন রাতের জন্যে এক বোতল মদ খাটের পাশে রেখে দেয়। প্রতিটি বোতল নিষ্ঠার সাথে শেষ করছে মাইকেল, যাতে একটু অন্তত ঘুম হয়।

রোববার। সিসিলির সব কটা গির্জায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। এই সসয় ভিটেলিদের গ্রামে পৌঁছুল মাইকেল। কাফের বাইরে আলফা রোমিও দাঁড় করাল ও। পিছনের সীটে বসে আছে কার্লো আর ফ্যাব্রিযযিয়ো। আগেই বলা আছে, কাফেতে অপেক্ষা করবে ওরা দুজন, মালিকের বাড়িতে যাবে না। কাফের দরজায় তালা ঝুলছে, চাতালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে ভিটেলি। করমর্দন এবং কুশলাদি বিনিময়ের পর উপহার তিনটে হাতে নিয়ে তার পিছু পিছু চলল মাইকেল। পাহাড়ের ওপর বাড়িটা দেখে চমৎকৃত হলো ও। বেশ বড় বাড়ি, গ্রামের আর সব কুটিরের মত খেলো নয়। বোঝা গেল ভিটেলি পরিবার সচ্ছল।

বাড়ির ভেতর পরিবেশটা এত ঘরোয়া যে চেনা চেনা লাগছে মাইকেলের। যীশুর মায়ের কয়েকটা মূর্তি দেখা যাচ্ছে, কাঁচ দিয়ে ঘেরা, পায়ের কাছে প্রদীপ জেলে রাখা হয়েছে। ঘরের ভেতর অপেক্ষা করছে ভিটেলির দুই ছেলে, আর সবার মত এরাও রোববারের উপযুক্ত কাপড়-চোপড় পরেছে। শক্তসমর্থ তাগড়া দুই ভাই, বড়জোর সবে উনিশ পেরিয়েছে, যদিও খামারে প্রচণ্ড খাটতে হয় বলে বয়সটা একটু বেশি দেখাচ্ছে। ওদের মায়ের গড়নও বেশ বলিষ্ঠ, স্বামীর মতই মোটা। ঘরে বা ঘরের আশপাশে ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না মেয়েটার।

আনুষ্ঠানিকভাবে সবার সাথে মাইকেলের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো, কিন্তু কারও একটা কথাও কানে ঢুকছে না ওর। যে ঘরটায় নিয়ে এসে বসানো হলো ওকে, সেটা বৈঠকখানাও হতে পারে, আবার খাবার ঘরও হতে পারে। মাঝারি আকারের ঘর, আসবাবে ভর্তি, সিসিলীয় মধ্যবিত্তের সচ্ছলতার ছাপ ফুটে রয়েছে চারদিকে।

সিনর ভিটেলি আর সিনরা ডিটেলিকে নিজের হাতে তাদের উপহার দুটো দিল মাইকেল। মেয়ের বাপের জন্যে সোনার সিগার কাটার আর মায়ের জন্যে এক থান কাপড় পালার্মোর সবেচেয়ে মিহি আর মূল্যবান জিনিস। মেয়েটার উপহার বের করুল না ও। সিনর ভিটেলি আর সিনরা ভিটেলি, দুজনই একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর সংযত ভঙ্গিতে ধন্যবাদ জানাল মাইকেলকে। নিজের ভুলটা ধরতে পারল ও, আরও দেরি করে দেয়া উচিত ছিল উপহারগুলো। সাধারণ নিয়ম হলো দ্বিতীয় বার আসার আগে কিছু দিতে নেই।

দেশ-গ্রামের লোকেরা রেখে ঢেকে কথা বলতে জানে না, যা বলে পরিষ্কার। স্পষ্টভাবে বলে, ভিটেলিও তাই বলছে। বাড়িতে যে আসবে তাকেই আমরা আদর করে ডেকে নেব, অতটা নগণ্য পরিবার ভেব না আমাদেরকে। তুমি আমাদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পেয়েছ, তার কারণ ডন টমাসিনো তোমার পক্ষ নিয়ে সুপারিশ করেছে আমাকে। সবাই জানে ডন টমাসিনো এই এলাকার একজন সভ্রান্ত কর্তা ব্যক্তি। তার কথা অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। শুধু সেজন্যেই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি তোমাকে। কিন্তু একটা ব্যাপারে তুমি যেন ভুল বুঝো না। আমার মেয়ে সম্পর্কে সত্যি যদি তোমার কোন সৎ ইচ্ছা থাকে, তোমার আর তোমার পরিবার সম্পর্কে সব কথা জানতে হবে আমাকে।

সবিনয়ে মাথা দোলাল মাইকেল, যখন যা কিছু জানতে চাইবেন সবই বলব আপনাকে আমি, বলল ও।

হাত নেড়ে বলল ভিটেলি, তার আগে দেখতে হবে সব কথা জানার সত্যি কোন প্রয়োজন আছে কিনা। পরের ব্যাপারে নাক গলানো স্বভাব নয় আমার। আজকের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, ডন টমাসিনোর সুপারিশে আজ আমরা। তোমাকে বন্ধু মনে করে ঘরে ডেকে বসিয়েছি। তিনি যদি বলেন, তোমাকে আমরা নির্ভয়ে পরিবারের একজন বলে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে বোধহয় সব কিছু খুঁটিয়ে জানার দরকার হবে না।

নাকের ভেতর ওষুধ লাগানো হয়েছে, ফলে সেটা অসাড় মত হয়ে আছে। মাইকেলের, ওষুধের গন্ধ ছাড়া আর কোন গন্ধ ঢোকার পথ পাচ্ছে না, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওষুধের তীব্র গন্ধকে হারিয়ে অদ্ভুত মিষ্টি একটা সুগন্ধ পেল ও। সাথে সাথে বুঝল, নিঃশব্দ পায়ে কাছেপিঠে কোথাও এসেছে মেয়েটা। ঘাড়। ফেরাতেই দেখল, ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পিছন দিকের খিলান দেয়া দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। ঘন কার্লো কোকড়ানো একরাশ মাথার চুলে কোন ফুল নেই তার, অথচ তাজা লেবু ফুলের গন্ধ নিয়ে এসেছে সাথে করে। পরনে সাদাসিধে কার্লো পোশাক, কোন অলঙ্কার পরেনি সন্দেহ নেই এটাই তার তুলে রাখা সবচেয়ে ভাল পোশাক, শুধু রোববারে পরে ছোট্ট এক টুকরো হলুদ সোনার মত হাসি ফুটল তার মুখে, চোরা চাহনিতে চকিতে একবার তাকাল, চোখ নামিয়ে নিয়ে সলাজ কুণ্ঠার। সাথে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসল মায়ের পাশে।

 আবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল মাইকেলের। রক্তে বাণ ডেকেছে ওর, শরীরের। প্রতিটি অঙ্গে দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠেছে। এ ঠিক কামনা নয়, ভোগ স্পৃহা নয়, এ হলো মেয়েটাকে আয়ত্ত করার উন্মত্ত প্রতিজ্ঞা, বাধ ভাঙা আকাঙ্ক্ষা। বহু-কথিত ইটালীয় পুরুষদের সেই প্রাচীন ঈর্ষা এই প্রথম অনুভব করছে মাইকেল। এই মুহূর্তে ভুল করেও কেউ যদি স্পর্শ করে এই মেয়েকে, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে সাথে সাথে তাকে হত্যা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে ও। হাড় কিপটে যেভাবে স্বর্ণমুদ্রার অধিকারী হতে চায়, বর্গাচাষী যেভাবে তার ফসলের ভাগ চায়, মাইকেলও সেভাবে অধিকার করতে চাইছে মেয়েটাকে ও জানে, ওর উন্মত্ত আকাক্ষা থেকে কেউ ওকে এক চুল টলাতে পারবে না, এই মেয়ের স্বামী তাকে পেতেই হবে, কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। সম্পূর্ণ দখল করতে হবে ওকে, ঘরের ভেতর তালা-চাবি দিয়ে আটক করতে হবে, শুধু নিজের জন্যে বন্দিনী করে রাখতে হবে। এ এমন এক মুহূর্ত, এখন যদি কেউ অ্যাপলোনিয়ার দিকে তাকায়, মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটে যাবে মাইকেলের। দুনিয়ার সমস্ত পুরুষ এখন মাইকেলের ঘৃণা আর সন্দেহের পাত্র। নিজের আর অ্যাপলোনিয়ার অস্তিত্ব ছাড়া দুনিয়ার আর কারও উপস্থিতি অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে ওর কাছে। মেয়েটা হাসি মুখে একবার ভাইদের একজনের দিকে ফিরে তাকাল। সাথে সাথে নিজের অজান্তেই ছেলেটার দিকে এমন কটমট করে দৃষ্টি হানল মাইকেল, ঘরের কারও বুঝতে বাকি থাকল না যে এ হলো সেই প্রাচীন বাজ পড়ার ঘটনা, যেমন খাঁটি তেমনি শক্তিশালী বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলো সবাই। কোন সন্দেহ নেই, ছেলেটা এখন থেকে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটার হাতে একদলা কাদা-মাটির মত নরম হয়ে থাকবে। এ অবস্থা বেশিদিন থাকবে না, সবকিছুর মত এটারও পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু কিই বা এসে যায় তাতে!

পালার্মো থেকে নতুন কেনা পোশাক পরে এসেছে মাইকেল, আজ আর ওকে মোটা কাপড় পরা গেঁয়ো চাষা দেখাচ্ছে না। ডন বা সমমানের কোন পদের অধিকারী ও, অনুমান করে নিল ওরা। মুখটা ভাঙা বলে, মাইকেলের ধারণা তার চেহারায় আর কোন সৌন্দর্য নেই, আসলে কিন্তু অতটা খারাপ দেখায় না ওকে। আরেক পাশ থেকে তাকালে ভয়ঙ্কর সুদর্শন পুরুষ বলে মনে হয়, বিকৃতিটা মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। সবাই জানে সিসিলি এমন একটা দেশ যেখানে বিকলাঙ্গ উপাধি পেতে হলে নির্দয় খুনে স্বভাবের বিরাট একদল লোকের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। সিসিলিতে শারীরিক ত্রুটির আলাদা একটা মর্যাদা আছে।

মেয়েটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে মাইকেল। সুগোল মুখের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মাথা ঘুরছে ওর। ঠোঁট জোড়ায় অতি বেশি রক্তের চাপ, ফলে সে দুটোর রঙ হয়ে উঠেছে ঘন নীল। নামটা উচ্চারণ করবে, সে সাহস হলো না মাইকেলের। ঝাঁ ঝাঁ করছে সমগ্র অস্তিত্ব। সেদিন তোমাকে কমলা বনের ধারে দেখলাম। পালিয়ে গেলে তুমি। আশা করি ভয় পাওনি আমাকে দেখে, বলল ও

মুহূর্তের জন্যে চোখ তুলে তাকাল মেয়ে। দ্রুত অথচ সংক্ষিপ্ত ভাবে মাথা নাড়ল শুধু একবার। কিন্তু চোখ দুটো এত সুন্দর, সেই সৌন্দর্যে মগজ ঝলসে যাবে ভেবে তাকিয়ে থাকতে পারল না মাইকেল, মেয়েটা চোখ নামিয়ে নেবার আগেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল ও।

অ্যাপলোনিয়া, ঝাঁঝের সাথে বলল মা, বেচারার সাথে কথা বলো। কত দূর থেকে এসেছে তোমাকে দেখার জন্য।

তবু ঘন কালো চোখের পাপড়িগুলো পাখির ডানার মত সযত্নে ঢেকে রেখেছে অ্যাপলোনিয়ার চোখ দুটোকে।

উপহারটা সোনালী কাগজে মোড়া, সেটা তার হাতে দিল মাইকেল নিয়েই কোলের ওপর ফেলে রাখল অ্যাপলোনিয়া।

আহা, মেয়ে, বলল, ওর বাবা, দেখোই না খুলে।

হাত দুটো তবু নড়ে না। ছোট ছোট হাত, জ্বাল দেয়া ঘন দুধের সরের মত রঙ!

ক্ষীণ অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল মায়ের চেহারায়, হাত বাড়িয়ে মেয়ের কোল থেকে প্যাকেটটা তুলে নিল! খুব যত্নের সাথে, যাতে মূল্যবান কাগজটা ছিঁড়ে না যায়, খুলে ফেলল প্যাকেটটা। ভেতরে লাল রঙের মখমল দিয়ে তৈরি গহনার বাক্স, দেখেই হাত দুটো থেমে গেল মায়ের। এ-ধরনের জিনিস আগে কখনও দেখেনি সে, হাতে নেয়া তো দূরের কথা, কিভাবে খুলতে হয় জানবে কোত্থেকে! তবে সহজাত উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে বাক্স খুলে বের করে ফেলল উপহারটা।

সোনার একটা নেকলেস, খুব ভারী। হকচকিয়ে গেল ওরা সবাই অসম্ভব মূল্যবান একটা জিনিস, কিন্তু সেটা কারণ নয়, এদের সমাজে সোনা উপহার দেয়ার একটা অর্থ-সম্পর্কটাকে পবিত্র রূপ দেয়ার একান্ত গভীর ইচ্ছা প্রকাশ। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার চেয়ে কম নয় ব্যাপারটা, অন্তত বিয়ের প্রস্তাব দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে মাইকেল, উপহারটার মাধ্যমে এ-কথা পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছে সে। সমস্ত দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠল পরিবারটি, মাইকেলের উদ্দেশ্যটা যে সৎ তা বুঝতে পারল। সেই সাথে তার আর্থিক সঙ্গতি সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা জন্মাল ওদের মনে।

এখনও উপহারটা হাত দিয়ে ছোয়নি অ্যাপলোনিয়া। নেকলেসটা ওকে দেখাবার জন্যে একটু তুলে ধরল ওর মা। চোখের দীর্ঘ পাতা তুলে নেকলেসটার দিকে নয়, সরাসরি মাইকেলের দিকে তাকাল মেয়ে। হরিণীর মত চোখ, গাঢ় রঙের মায়াময় গভীরতায় ভরপুর এই প্রথম তার কণ্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য হলো মাইকেলের সে-রে তারুণ্যের সজীবতা, মখমলের মত লজ্জার কোমলতা–কান দিয়ে ঢুকে ওর শরীরে আর রক্তে তুমুল আলোড়ন তুলল।

ধন্যবাদ, মৃদু কণ্ঠে বলল অ্যাপলোনিয়া।

চোখ ফিরিয়ে নিল মাইকেল, একবারে দুতিন সেকেণ্ডের বেশি তাকাতে পারছে না অ্যাপলোনিয়ার দিকে সত্যি সত্যি ভয় হচ্ছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে পুড়ে যাবে চোখ দুটো তাছাড়া, ওর দিকে তাকালেই নিজেকে বশে রাখতে পারছে না মাইকেল, মনের ভেতর সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার বাবার সাথে কথা বলছে ও, তাছাড়া আর করার আছে কি তার? তবে এরই মাঝে চোখে পড়েছে, অ্যাপলোনিয়ার পরনে সেকেলে ঢিলেঢালা পোশাক থাকলেও, কাপড় ভেদ করে ফুটে উঠেছে যৌবনের ভাজ, রেখা আর চুড়াগুলো। মুখটা লজ্জায় রাঙা, তাতে গায়ের রঙ আরও ঘন আর গাঢ় দেখাচ্ছে।

এবার বিদায় চাইতে হয়। ওর সাথে বাকি সবাইও উঠে দাঁড়াল। নিয়ম মত সবাই বিদায় দেবার পর ওর সামনে এসে দাঁড়াল অ্যাপলোনিয়া। হাতটা বাড়িয়ে দিল সে। বুক কাঁপছে মাইকেলের। হাতে হাত স্পর্শ করতেই সারা শরীর শিউরে উঠল ওর। অ্যাপলোনিয়ার হাতের ত্বক একটু কর্কশ। চাষী পরিবারের মেয়েদের যেমন হয়ে থাকে। গলা বুজে গেছে মাইকেলের, ব্যাকুল ইচ্ছেটা মাথা কুটে মরছে মনের ভেতর, কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। ওর সাথে পাহাড় থেকে নেমেগাড়ি পর্যন্ত এলো সিনর ভিটেলি। ডিনার খেতে নিমন্ত্রণ করল আগামী রবিবার। দাওয়াত কবুল করে মাথা নাড়ল বটে মাইকেল, কিন্তু মনে মনে জানে, অ্যাপলোনিয়াকে আবার না দেখে পুরো এক হপ্তা কিছুতেই থাকতে পারবে না সে।

রাখাল দেহরক্ষীদের সাথে না নিয়ে পরদিনই কাফেতে চলে এল মাইকেল, গাড়ি থেকে নেমে চাতালে বসল অ্যাপলোনিয়ার বাপের সাথে গল্প করতে। অবশেষে দয়া হলো সিনর ভিটেলির, স্ত্রী আর মেয়েকে খবর পাঠাল সে, তারা এসে যেন একটু সঙ্গ দেয় বেচারা মাইকেলকে। এবারের দেখা-সাক্ষাতে জড়তা ভাব অতটা নেই। কিছুটা লজ্জা কেটেছে অ্যাপলোনিয়ার, আর সে বেশ দুএকটা কথাও বলল। রোজকার পোশাক, ছাপা কাপড়ের ফ্রক পরেছে, সুন্দর মানিয়েছে ওর গায়ের রঙের সাথে।

পরদিনও তাই ঘটল, তফাত কেবল এই যে মাইকেলের উপহার দেয়া সোনার নেকলেসটা পরে এসেছে অ্যাপলোনিয়া। ব্যাপারটা লক্ষ করে ওর চোখে চোখ রেখে হাসল মাইকেল। বোঝাই যায়, অ্যাপলোনিয়ার তরফ থেকে এটা একটা ইঙ্গিত।

ওকে সাথে নিয়ে পাহাড়ে চড়ল মাইকেল, অবশ্য ওদের পিছনেই রয়েছে সিনরা ভিটেলি। কিন্তু তাতে কি, গায়ের সাথে গায়ের ছোঁয়াছোয়ি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার। হোঁচট খেয়ে একেবারে ওর গায়ের ওপর পড়ে গেল একবার। অ্যাপলোনিয়া, যেন তৈরি হয়েই ছিল মাইকেল, সাথে সাথে ধরে ফেলল তাকে। উষ্ণ, সজীব শরীরের স্পর্শ পেতেই রক্তে যেন বাণ ডাকল ওর। পিছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছে সিনরা ভিটেলি, কিন্তু দুজনের কেউই তা লক্ষ করল না। মা জানে, মেয়ে তার পাহাড়ী ছাগলের মত পটু, এপথে যেতে-আসতে সেই জাঙ্গিয়া ছাড়ার পর থেকে কখনও হোঁচট খায়নি। সেটাই হাসির কারণ। হাসিটা আরও বড় হলো এই কথা ভেবে যে এই হোঁচট খাওয়ার ছুতোয় যতটা পারা যায় মেয়ের গায়ে হাত দিতে পারবে ছোকরা, বিয়ের আগে আর কোন সুযোগ সুটছে না ওর কপালে।

পরবর্তী দুহপ্তা চলল এইভাবে ধীরে ধীরে সঙ্কোচ কেটে যাচ্ছে মাইকেলেরও, রোজই কিছু না কিছু একটা উপহার নিয়ে আসে অ্যাপলোনিয়ার জন্যে। তবে মুরুব্বি স্থানীয় কেউ একজন উপস্থিত না থাকলে দেখা হয় না ওদের। হাজার হোক গ্রামের মেয়ে, কোনরকম অক্ষরজ্ঞান হয়েছে মাত্র, দুনিয়া সম্পর্কে ভাল মন্দ কোন ধারণাই নেই তার। কিন্তু আশ্চর্য একটা প্রাণচাঞ্চল্য আছে, আছে প্রাণের উচ্ছ্বাস আর সজীবতা, সেই সাথে ভাব প্রকাশে ভাষার বাধা, তাই আরও রহস্যময়ী লাগে ওকে। মাইকেলের অনুরোধে বিয়ের তারিখ খুব তাড়াতাড়ি স্থির করা হলো। ইতিমধ্যে অ্যাপলোনিয়ার জানা হয়ে গেছে মাইকেল যে শুধু ওকে দেখে মুগ্ধ তাই নয়, সে একটা বিরাট ধনী পরিবারের ছেলেও বটে। দুহপ্তা পর এক রবিবারে ধার্য হলো বিয়ের তারিখ।

এবার কাজে হাত দিলেন ডন টমাসিনো। আমেরিকা থেকে তাকে জানানো হয়েছে কোন আদেশ বা বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে না মাইকেলকে, কিন্তু সম্ভাব্য সমস্ত প্রাথমিক সতর্কতা যেন অবলম্বন করা হয়। নিজের বডিগার্ড দিয়ে মাইকেলকে ঘিরে রাখার জন্যে বর-কর্তা হলেন তিনি। বরযাত্রী হয়ে কর্লিয়নি থেকে গেল কার্লো আর ফ্যাব্রিযযিয়ো, ওদের সাথে ডাক্তার তাজাও গেলেন। আগেই ঠিক করা হয়েছে, বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে মাইকেল পাথরের পাচিল ঘেরা ডাক্তার তাজার বাড়িতেই থাকবে।

বিয়েটা সম্পন্ন হলো চাষী পরিবারের রীতি অনুযায়ী। বরযাত্রী, বর-কনে আর নিমন্ত্রিত মেহমানদের গায়ে ফুল ছুঁড়ে মারল গ্রামবাসীরা। গির্জা থেকে পায়ে হেঁটে ফিরল সবাই কনের বাড়ি। বিয়ের শোভাযাত্রাটা হলো দেখবার মত, যেমন দীর্ঘ তেমনি রঙচঙে। চিনি মাখানো কাগজি বাদাম আর চিনির মিষ্টি ছুঁড়ে মারা হলো প্রতিবেশীদের দিকে। অবশিষ্ট মিষ্টি দিয়ে তৈরি হলো ফুলশয্যার ওপর চিনির ঢিপি। এটা শুধু নিয়মরক্ষার জন্যে করা, কারণ কর্লিয়নি গ্রামের বাইরে ডাক্তার তাজার। বাগানবাড়িতে কাটবে বর-কনের প্রথম রাতটা। বিয়ের সোজ চলবে মাঝরাতের পরও, কিন্তু বর-কনে আলফা রোমিওতে চড়ে বিদায় নেবে অনেক আগেই।

রওনা হবার সময় একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হয়ে গেল মাইকেল। সম্ভবত অ্যাপলোনিয়ার আবদারে তার মা-ও ওদের সাথে গাড়িতে উঠছে। মাইকেলের মন্মেভাব টের পেয়ে শ্বশুর এগিয়ে এসে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। একেবারে কচি বয়স মেয়েটার, কুমারী, তাই একটু ভয় পেয়ে গেছে। বিয়ের পরদিন সকালে ও হয়তো কারও সাথে কথা বলতে চাইবে। এরকম ক্ষেত্রে এক-আধটু গোলমাল তো হতেই পারে। তা যদি হয়, ওকে সব বুঝিয়ে দেবার জন্যে কাউকে দরকার।

অ্যাপলোনিয়ার দিকে তাকাল মাইকেল। গম্ভীর হরিণ চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে সে। মৃদু হেসে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল মাইকেল। তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

কর্লিয়নিতে ওদের সাথে অ্যাপলোনিয়ার মা এল বটে, কিন্তু ভদ্রমহিলা যথেষ্ট কাণ্ড-জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে দ্রুত দৃশ্যপট থেকে কেটে পড়ল। ডাক্তার তাজার বাড়িতে পৌঁছেই প্রথমে সে পরিচারিকাদের সাথে কি যেন পরামর্শ করল, জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো মেয়েকে, তারপর অন্দরমহলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিশাল একটা ঘরে ফুলশয্যা পাতা হয়েছে, নববধুকে নিয়ে সেখানে মাইকেল একাই ঢুকল।

বিয়ের সাজ-পোশাক এখনও খোলেনি অ্যাপলোনিয়া, ওপরে শুধু একটা সিল্কের আলখাল্লা জড়িয়ে নিয়েছে। আগেই গাড়ি থেকে ওর ট্রাঙ্ক আর সুটকেস শোবার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘরের ভেতর ছোট্ট একটা টেবিল, তার ওপর এক প্লেট বিয়ের কেক আর এক বোতল মদ দেখা যাচ্ছে। খাটটা প্রকাণ্ড, ঝালর দিয়ে ঘেরা, না তাকালেও চোখে পড়ছে সারাক্ষণ। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তরুণী। অপেক্ষা করছে। প্রথম উদ্যোগ মাইকেল নেবে, এই আশায়।

কিন্তু আজব এক আড়ষ্টতায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল, একচুল নড়ার শক্তি পাচ্ছে না সে। এতদিন নিজের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে এই মেয়েকে কামনা করেছে, এখন তাকে একাকিনী পেয়েও, তার স্বামিত্ব অর্জন করেও তাকে স্পর্শ করার জন্য হাত উঠছে না। এই তো সেই অপরূপ মুখ, রোজ রাতে স্বপ্নের ঘোরে দেখেছে সে, এই তো সেই যৌবপুষ্ট সজীব শরীর, তাকে জড়িয়ে ধরার পথে আজ আর কোন বাধাই নেই, তবু সেদিকে এগোতে পারছে না কেন। ধীরে ধীরে নড়ে উঠল অ্যাপলোনিয়া, বিয়ের শালটা খুলে ফেলল গা থেকে, ঝুলিয়ে রাখল একটা চেয়ারে। তারপর মাথা থেকে নামাল বিয়ের মুকুট, ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল সেটা। পালার্মো থেকে নিয়ে আসা নানারকম সুবাস আর ক্রীম সাজানো রয়েছে একটা টেবিলে, সেদিকে তাকাল অ্যাপলোনিয়া।

ও কি চাইছে ঘরটা অন্ধকার করে দিই? কাপড় ছাড়ার জন্যে অন্ধকারের আশ্রয় ভাল লাগবে ওর? চিন্তাটা মাথায় আসতেই হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল মাইকেল। তাতে কিন্তু অন্ধকার দূর হলো না জানালাগুলো খোলা রয়েছে, উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে সিসিলির জ্যোছনা। একটা বাদ। দিয়ে বাকি জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে দিল ও। সবগুলো বন্ধ করলে গুমোট হয়ে উঠবে পরিবেশটা।

তবু টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল অ্যাপলোনিয়া, একচুল নড়ছে না। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল মাইকেল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাগানে বসে গল্প করছেন ডাক্তার তাজা আর ডন টমাসিনো, তাদের সাথে যোগ দিল ও। বাড়ির মেয়েরা এরই মধ্যে শোবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে। এক গ্লাস মদ খেলো মাইকেল। মনে মনে ভাবছে ফিরে গিয়ে দেখবে, অ্যাপলোনিয়া রাতের পোশাক পরেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পোশাক খোলার ব্যাপারে মেয়েকে পরামর্শ দেয়নি মা, কথাটা ভেবে একটু অবাক হলো মাইকেল। আবার ভাবল, এমনও হতে পারে যে মায়ের সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে অ্যাপলোনিয়া। সে হয়তো মাইকেলের সহযোগিতা পাবে বলে আশা করে আছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই, মুখ ফুটে কথাটা প্রকাশ করা তার সাধ্যের বাইরে। মাইকেল জানে, এ মেয়ে আশ্চর্য নিষ্পাপ, কোমল, অতটা এগোবে সে-দুঃসাহস নেই।

পা টিপে টিপে শোবার ঘরে ফিরে এল মাইকেল। প্রথমেই লক্ষ করল, একমাত্র যে জানালাটা খোলা ছিল সেটাও এখন বন্ধ ঘন অন্ধকারে ঘরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একবার ভাকল অ্যাপলোনিয়ার নাম ধরে ডাকবে নাকি। কিন্তু মন তাতে সায় দিল না। অন্ধের মত নিঃশব্দ পায়ে এগোল ও। হাতড়ে স্পর্শ করল খাটটা। ঝুঁকে পড়তেই আঁধারের ভেতর চোখে পড়ল বিছানার ওপর কি যেন পড়ে রয়েছে, সম্ভবত অ্যাপলোনিয়াই। অন্ধকারটা চোখে: আরও একটু সয়ে আসতে নিজের অনুমানটা সঠিক বলে বুঝতে পারল ও। ওর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে অ্যাপলোনিয়া। মনটা একটু দমে গেল ওর। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?

ধীরে ধীরে কাপড় ছাড়ল মাইকেল। তারপর দুরুদুরু বুকে ঢুকল চাদরের নিচে। হাত বাড়াতেই রেশমের মত নরম তুকের ছোঁয়া অনুভব করল ও। শিউরে উঠল মাইকেল। ঢোক গিলল নিজের অজান্তেই। টের পেল নিঃশ্বাসগুলো কি গরম! শরীবের পাশে শুয়ে রয়েছে আরেকটা শরীর, দুটোই ওর নিজের শরীর, কিন্তু তবু কেন যেন চোর চোর মনে হচ্ছে নিজেকে, হাত বাড়াতে ভয় লাগছে। হঠাৎ টের পেল, অ্যাপলোনিয়ার গায়ে নাইট-গাডন নেই। মেয়ের সাহস দেখে ভীষণ খুশি মাইকেল। এই আনন্দই তাকে একটু সাহস যোগাল। অত্যন্ত যত্নের সাথে, খুব আলগোছে, একটা হাত রাখল নববধুর কাঁধে। কি এক পরম পাবার আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সারা শরীর। একটু চাপ দিল অ্যাপলোনিয়ার কাঁধে। নিজের দিকে ওকে ফেরাতে চাইল ও

প্রথমে কাঠ হয়ে পড়ে থাকল অ্যাপলোনিয়া। তারপর সাড়া দিল সে। ধীরে ধীরে ফিরল। অদ্ভুত এক পুলকে ছেয়ে গেল মাইকেলের মন, কি এক পরম তৃপ্তি পাবার ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষায় অস্থির হয়ে উঠল ও এখনও ওর দিকে ফিরছে অ্যাপলোনিয়া, তার কোমল বুকের স্পর্শ পেল ও।

পরমুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল দুজনের শরীরে। পরস্পরের আলিঙ্গনে ধরা দিল ওরা। নববধুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল মাইকেল, তার পাতলা ঠোঁটে গাঢ় চুমু খেলো। নগ্ন দুটো শরীর পরস্পরের সাথে সেঁটে আছে।

আঁটো রেশমের মত অ্যাপলোনিয়ার শরীর। কুমারী মেয়ের অধীর কামনায়, ব্যাকুল আগ্রহে উন্মাদিনী হয়ে উঠে সে-ও দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে মাইকেলকে। ভাবের আদান প্রদান চলছে ওদের মাঝে, কিন্তু কোন ভাষার সাহায্য নিচ্ছে না ওরা। অ্যাপলোনিয়ার কুমারী শরীরটার ওপর খেলা করছে মাইকেলের দুই হাত, কোথা থেকে কোথায় না চলে যাচ্ছে। তার শরীরে ঠোঁট ঘষছে ও। আর অ্যাপলোনিয়া? খানিক আগে পর্যন্ত নিজেকে ধন্য, কৃতজ্ঞ আর সৌভাগ্যবতী বলে মনে করছিল সে, কিন্তু এখন সে গর্ব অনুভব করছে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে পুলকিত হয়ে উঠেছে শরীর। তার প্রতিটি অঙ্গ, সবটুকু মাধুর্য, সমস্ত আবেগ দিয়ে ধন্য করতে চাইছে মাইকেলকে। নিজের ভেতর মাইকেলের উদ্দেশে আশ্চর্য একটা ব্যাকুল আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে-আমাকে নাও! আমাকে নাও! গর্ব অনুভব করার সেটাই তার কারণ, শুধু হাত পেতে নেবার পাত্রী নয় সে, মাইকেলকে দেবারও অনেক কিছু রয়েছে তার এবং মাইকেল নিচ্ছেও প্রাণভরে। সেখানেই অ্যাপলোনিয়ার সার্থকতা।

যত পাচ্ছে তত আরও বেশি করে পেতে চাইছে মাইকেল। নির্লজ্জেরও একটা লজ্জার সীমা থাকে কিন্তু ও সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে বেপরোয়া, দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। আর অ্যাপলোনিয়া তাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে, প্ররোচনা দিচ্ছে।

এক সময় জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা হলো অ্যাপলোনিয়ার। এত আনন্দ, এত উত্তেজনা, এত সুখ সহ্য করার সাধ্য নেই তার। সারা শরীরে বিদ্যুতের প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, গুঙিয়ে উঠল সে। আনন্দের আতিশয্যে অস্থির হয়ে পড়ল। ওর অবস্থাটা বুঝতে পারল মাইকেল। নিজেও ধৈর্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ও। মিলনের চরম মুহূর্তে অ্যাপলোনিয়ার মুখ থেকে সশব্দে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। মিলন চরিতার্থ হবার পরও কেউ কাউকে ছাড়ল না, দুর্দম আকর্ষণে একজন আরেকজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। কেউ কাউকে ছেড়ে দিলেই যেন হিম শীতল অন্ধকারে মৃত্যু এসে ছুঁয়ে দেবে ওদেরকে।

অনগ্রসর সমাজ কৌমার্যকে এত মূল্য দেয় কেন, আজ রাতে তা খানিকটা বুঝতে পারল মাইকেল কর্লিয়নি। এসব ওর কাছে নতুন নয়, কিন্তু, আজকের মত এমন লাগেনি কখনও আর। আজকের তৃপ্তির সাথে সেসব ঘটনার কোন তুলনাই হতে পারে না। আজ সে তার নিজের পৌরুষকে উপলব্ধি করতে পেরেছে।

এরপর হপ্তার পর হপ্তা ধরে প্রতিদিন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মাইকেলের উপলব্ধি আরও প্রখর হলো। সঙ্গিনী নয়, অ্যাপলোনিয়া ওর ক্রীতদাসীর মত হয়ে উঠেছে। অনগ্রসর সমাজে মেয়েদের যৌবন এক অমূল্য সম্পদ, অকাতরে শুধু স্বামীকে বিলিয়ে দেবার সাধনায় জীবন কাটে ওদের। এই সাধনার উপকরণ হলো প্রেম আর স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যবতী তরুণীর শরীর আর মনে যখন প্রথম যৌন চেতনা জাগে তখন সে হয় পাকা ফলটির মত মধুর। সেই ফল যখন নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেবার জন্যে উন্মুখ হয়ে ওঠে তখনই তো তাকে পেয়ে মজা।

নিরানন্দ বাগান বাড়িটা অ্যাপলোনিয়ার কোমল স্পর্শ পেয়ে সজীব হয়ে উঠেছে। ফুলশয্যার পরদিনই মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সে। প্রাণচঞ্চল মাধুরী দিয়ে গোটা বাড়িটা আলোকিত করে রেখেছে ও। লজ্জা এখনও কাটেনি তার, কিন্তু খাবার টেবিলে সবার জন্যে হাজির থাকে, এটা সেটা এগিয়ে দেয়, কার কি লাগবে না লাগবে জিজ্ঞেস করে। আজকাল প্রায় রোজ রাতেই ওদের সাথে খেতে বসেন ডন টমাসিনো।

বাগানে তিনজনের আড্ডাটা আবার শুরু হয়েছে। মদ খেতে খেতে পুরানো। গল্পগুলো আরেকবার করে শোনান ডাক্তার তাজা। বাগানের সবখানে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতপাথরের মূর্তি, তাদের গলায় লাল ফুলের মালা, সেগুলো দুলতে থাকে বাতাসে। বড় আনন্দে কাটে প্রতিটি সন্ধ্যা। আর রাতে নব দম্পতি ঘন্টার পর ঘণ্টা ব্যগ্র ব্যাকুলতার মধ্যে কাটায়। দুজনকে নিয়ে দুজন একেবারে উন্মাদ হয়ে আছে। অদ্ভুত এক নেশার ঘোরে সময়টা কাটছে মাইকেলের। অ্যাপলোনিয়ার শরীরের গঠনে কোন খুঁত দেখতে পায় না ও। ওর দিকে যখন তাকায়, তার দৃষ্টিতে কামনা মদির লালসা দেখতে পায়। দেখে দেখে মনের আশ মেটে না ওর। গায়ে এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ আছে অ্যাপলোনিয়ার, মেয়েমানুষের গায়ের সৌরভ নাকে ঢোকা মাত্র কামনার আগুন ধরিয়ে দেয় শরীরে। অ্যাপলোনিয়া এখনও লজ্জাবতী, কিন্তু। অৰীকার করতে পারবে না মাইকেল, ওর ক্ষুধা রাক্ষুসীর মত। তার যৌন কামনা ওর। লালসার চেয়ে কোন অংশে কম তীব্র নয়; অসীম ক্লান্তিতে এক একদিন ঘুমিয়ে পড়ে ওরা, তখন হয়তো ভোর হয়ে এসেছে। আবার এক একদিন কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না মাইকেলের। জানালার চৌকাঠে পা তুলে বসে থাকে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অ্যাপলোনিয়ার নগ্ন শরীরের দিকে। ভোর হয়ে যায়, বেলা চড়ে, তবু চোখ। ফেরাতে পারে না। এমন সুন্দর মুখাবয়ব আর কখনও দেখেনি ও। না, দেখেছে–শুধু ইতালির শিল্পীর আঁকা বইতে, ঠিক যেন যীশুর চুমারী মায়ের চেহারা। না, তার চেয়েও সুন্দর, সে চেহারায় অ্যাপলোনিয়ার মত কৌমার্য ফোটে না।

বিয়ের পর প্রথম কটা দিন রোজ আলফা রোমিও চড়ে পিকনিক করতে গেল ওরা। একদিন মাইকেলকে ডেকে ডন টমাসিনো বললেন, মাইকেল, তোমার আর একটু সতর্ক হয়ে চলা দরকার।

অবাক হয়ে জানতে চাইল মাইকেল, কেন বলুন তো?

ডন টমাসিনো জানালেন, বিয়েটা ধুমধামের সাথে হওয়ায় ইটালির এই এলাকায় মাইকেলের পরিচয় কারও আর জানতে বাঁকি নেই, তাই কর্লিয়নি পরিবারের শত্রুদের চোখ খুলে গেছে। তিনি আভাস দিলেন শত্রুদের লম্বা হাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এই ছোট্ট দ্বীপেও পৌচেছে।

বাগানবাড়ির চারদিকে সশস্ত্রগার্ড মোতায়েন করা হলো। বাড়ির ভেতর থাকল আরও দুজন সশস্ত্র প্রহরী, কার্লো আর ফ্যাবিযিয়ো। সেদিন থেকে বলতে গেলে বাড়ির ভেতর বন্দী জীবন কাটাতে শুরু করল মাইকেল আর অ্যাপলোনিয়া।

অ্যাপলোনিয়াকে নিয়েই সময় কাটে মাইকেলের। তাকে ইংরেজি লিখতে আর পড়তে শেখায়, বাড়ির উঠানে গাড়ি চালানো শেখায়, কিছু কিছু আদব-কায়দা রপ্ত করার জন্যে তালিমও দেয়। এই সময়টা খুবই অন্যমনস্ক দেখায় ডন টমাসিনোকে। সব সময় কি যেন চিন্তা করেন, ভাল করে কথা বলেন না কারও সাথে। ব্যাপারটা কি জানার জন্যে ডাক্তার তাজাকে একদিন প্রশ্ন করল মাইকেল। ডাক্তার বললেন, পালার্মোয় কিছু মাফিয়া নেতা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তাদের সাথে বিরোধ দেখা দিয়েছে চুন টমাসিনোর।

এর মধ্যে একদিন এক ঘটনা ঘটল। বাড়ির বুড়ি ঝি এক পেয়ালা জলপাইয়ের আচার নিয়ে দেখা করতে এল মাইকেলের সাথে। সোজা বাগানে ঢুকে পড়ল সে। গ্রামেরই মেয়ে বুড়ি, এখানেই বড় হয়েছে সে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে মাইকেলকে দেখল সে, তারপর জিজ্ঞেস করল, সবাই একটা কথা বলছে, তা কি সত্যি? নিউ ইয়র্ক শহরের গড ফাদার, ডন ভিটো কর্লিয়নির ছেলে তুমি?

গোপনীয়তা এতদূর প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়লেন ডন টমাসিনো। কিন্তু বুড়ির সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র নেই, সে মাইকেলের দিকে এমন নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন মাইকেল কি উত্তর দেয় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে তার। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল মাইকেল। বাবাকে তুমি চেনো? জিজ্ঞেস করল ও।

মেটে রঙের আখরোটের মত কোঁচকানো মুখ বুড়ির, নাম/ফিলোমিনা। দাঁতগুলো ফিকে লাল রঙের, মুখের পাতলা খোলের ভেতর দেখা যায় সেগুলো। মাইকেলের ফাইফরমাস খাটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওর সাথে বিশেষ কথা বলার গরজ দেখায়নি সে, কিন্তু আজ বুড়ি ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে শুধু কথা বলতে আসেনি, তার জীবনের মস্ত বড় একটা ভীতিও দূর করতে এসেছে। মাইকেলের কথা শুনে হাসল। বুড়ি, দুই কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল তার আঁকিবুকি কাটা ঠোট্টজোড়া। অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞ দৃষ্টি ফুটে উঠল চোখে। গড ফাদার সুস্থ থাকুন, বলল সে। যীশু তার মঙ্গল করুন। মাইকেলের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করুল সে, জানো, এই যে আজও আমি বেঁচে আছি, এ কার দান? গড ফাদারের। তিনি একবার আমার এটা, বুড়ি হাত দিয়ে নিজের মাথাটা দেখাল, বাঁচিয়েছিলেন। হ্যাঁ, মাইকেল কর্লিয়নি, তার দয়ায় সেবার আমার এই প্রিয় প্রাণটা রক্ষা পায়।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আরও অনেক কথা বলার আছে ফিলোমিনার। উৎসাহ দেবার জন্যে একটু হাসল মাইকেল।

কিন্তু কি ভেবে যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে চুপসে গেল বুড়ির চেহারা। খানিক ইতস্তত করার পর জানতে চাইল সে, আরেকটা কথা! আচ্ছা, লুকা ব্রাসি সত্যি মারা গেছে কিনা তুমি জানো, বাবা?

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল মাইকেল, অমনি পরম স্বস্তির একটা ভাব ফুটে উঠল বুড়ির চেহারায়, মস্ত একটা হাঁফ ছাড়ল সে। বুকে ক্রুশ চিহ্ন একে বলল, যীশু মাফ করুন আমাকে, কিন্তু তবু চাই ওর আত্মা যেন অনন্ত নরকে পোড়ে।

বুড়ির কথা শুনে লুকা ব্রাসি সম্পর্কে অনেক আগের কৌতূহলটা আবার নতুন করে জেগে উঠল মাইকেলের মনে! বহুবার এই কৌতূহল মেটাবার চেষ্টা করেছে ও, কিন্তু হেগেন.আর সনি মুখ খুলতে রাজী হয়নি। লুকা সম্পর্কে এমন একটা রহস্য আছে যা নাকি একশো বছরের বুড়ো না হওয়া পর্যন্ত মাইকেলের শোনা উচিত নয়। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে কথাটা জানার সুযোগ পেয়ে সেটাকে হাতছাড়া করার ইচ্ছে হলো না মাইকেলের। ও ধরেই নিয়েছে যে বুড়ি ব্রাসি-রহস্য অবশ্যই জানে। বুড়ির হাত ধরল ও, টেনে নিয়ে এসে নিজের পাশে বসল, তারপর তাকে এক গ্লাস মদ খেতে দিয়ে বলল, পুরানো দিনের অনেক কথা জানো তুমি, তাই না? সে-সব আমি শুনতে চাই। তুমি আমাকে বাবা আর লুকা ৰাসির গল্প বলো। কোথায় ওদের দেখা হলো, কে ওরা, কাকে কেমন চোখে দেখত… শুনেছি, লুকা নাকি বাবাকে সাংঘাতিক ভক্তি করত…কোন ভয় নেই তোমার, সব কথা নিয়ে বলো আমাকে।

কিন্তু ভয় তবু দুর হয় না ফিলোমিনার। অপ্রতিভভাবে অনুমতির জন্যে ডন টমাসিনোর দিকে তাকাল সে। মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি। মাইকেলের উৎসাহ লক্ষ করে বুড়িকে মুখ বুজে থাকার নির্দেশ দিতে পারলেন না। ফিলোমিনার। কিসমিসের মত কালো চোখে খানিকটা স্বস্তি ফিরে এল, কোঁচকানো মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল একটু। গল্প বলতে শুরু করল সে। তার মুখ থেকে লুকা ব্রাসির গল্প শুনেই সন্ধ্যাটা কাটিয়ে দিল সেদিন ওরা।

ত্রিশ বছর আগের কথা।

নিউ ইয়র্ক। টেনথ এভিনিউ ইতালীয়দের পাড়া। ধাত্রীর কাজ করে ফিলোমিনা। এই সব ইতালীয় মেয়েরা ফি বছর বাচ্চা বিয়োয়, ভালই রোজগার হয়। তার। নিজের পেশায় যথেষ্ট জ্ঞান রাখে সে। প্রসবের সময় যদি কখনও অস্বাভাবিক জটিলতা দেখা দেয় বাড়ির কর্তারা ফিলোমিনার কথা অগ্রাহ্য করে ডাক্তার ডাকে। ডাক্তাররা ফিলোমিনার কাছ থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে শিক্ষা লাভ করে ফিরে যায়। একটা মুদির দোকান আছে তার স্বামীর, তাতেও ভাল রোজগার হয় ওদের। কিন্তু স্বামী তার বাধ্য নয়, যখন যা ইচ্ছা তখন তাই করে বেড়ায়। মদ হত্যা খায়ই, জুয়াও খেলে। আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করাটা তত তার একটা দুরারোগ্য ব্যাধি। এই করতে করতে লোকটা মারা গেল। ফিলোমিনা তার আত্মার কল্যাণের জন্যে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে। তবে মারা যাবার সময় লোকটা তার জন্যে এক পয়সাও রেখে যায়নি।

এক নিশুতি রাতের ঘটনা। ফিলোমিনার জীবনে সেটা একটা অভিশপ্ত রাতও বটে। পাড়ার সব ভাল মানুষ যে যার বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে, এই সময় কে যেন তার দরজায় টোকা দিল। এত রাতে কে ডাকে? ভয় পায়নি ফিলোমিনা, কারণ সে জানে, পাপ আর পাপীতে ভরা এই দুনিয়ায় নিরাপদে ঢোকার জন্যে খুব বৃদ্ধি করে। এই নিশুতি রাতকেই বেছে নেয় শিশুরা। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিয়ে দরজা খুলে দিল সে সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে দেখেই শিউরে উঠল ফিলোমিনা। সুকা ব্রাসি! ইতালীয় পাড়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর লোক বলে বদনাম আছে এর। তাছাড়া, পাড়ার সবাই জানে, লুকা বিয়ে করেনি। তার মানে, কোন অবৈধ কাজ করিয়ে নেবার জন্যে এসেছে। ফিলোমিনার স্বামী তখনও বেঁচে, তাই লুকাকে দেখে প্রথমে তার স্বামীর নিরাপত্তার কথাটাই মনে পড়ল। ভাবল, লুকা নিশ্চয়ই তার স্বামীর কোন ক্ষতি করতে এসেছে। ছোটখাট কোন ব্যাপারে কেউ সাহায্য করতে। অৰীকার করলে লুকা তার চরম সর্বনাশ করতে দ্বিধা করে না।

অনিষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে লুকা, কিন্তু ফিলোমিনার স্বামী তার লক্ষ্য নয়। বলল, এ পাড়া থেকে কিছুটা দূরে একটা মেয়ের প্রসব হবে, এখুনি সেখানে যেতে হবে ফিলোমিনাকে। সেই মুহূর্তে বুঝে নিল ফিলোমিনা, নিশ্চয়ই কোথাও কোন গোলমাল আছে তাকিয়ে দেখল, পাষাগটাকে আজ রাতে কেমন যেন অস্থির, উন্মাদ মত দেখাচ্ছে। ভূতে পাওয়া মানুষের মত দিশাহারা। খুব ভয়ে ভয়ে মৃদু আপত্তি জানাল ফিলোমিনা। কর্কশ একটা চাপা আওয়াজ বেরিয়ে এল লুকার গলার ভেতর থেকে। ফিলোমিনার হাতে কয়েকটা কাগজের নোট গুঁজে দিয়ে গভীরভাবে। বলল সে, কথা নয়। আমার সাথে এসো সেই জলদগম্ভীর আদেশ অমান্য করার সাহস হলো না ফিলোমিনার।

একট। ফোর্ড গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। ড্রাইভারের সীটে বসে আছে কারই এক সহচর। পাড়ার বাইরে সেই বাড়িটায় পৌঁছুতে আধঘন্টাও লাগল না। লং আইল্যান্ড সিটির ঠিক পূলের ওপর ছোট্ট কাঁঠের তৈরি বাড়িটা। খুব জোর হলে কোনরকমে দুটো পরিবার থাকতে পারে ওখানে, কিন্তু একটু পরই জানা গেল লুকা আর তার সহচররা ছাড়া আর কেউ থাকে না।

ভেতরে ঢুকে ফিলোমিনা দেখল কয়েকজন গুণ্ডা কিচেনে বসে মদ গিলছে আর জুয়া খেলছে। ওপর তলার একটা বেডরুমে তাকে নিয়ে এল লুকা। অল্প বয়েসী একটা মেয়ে শুয়ে আছে খাটে। খুবই সুন্দরী। রঙের প্রলেপ রয়েছে মুখে, চুলগুলো লাল, পেটটা শুয়োরের মত ফুলে উঠেছে। দেখে আইরিশ বলে মনে হলো, চেহারায় ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে শুয়ে আছে সে। ওদের দুজনকে দেখেই আঁতকে উঠল, হ্যাঁ আঁতকে উঠল, তারপর দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে পাশ ফিরল। লকা ব্রাসির চেহারায় ভয়ঙ্কর একটা বিদ্বেষের ভাব লেপ্টে রয়েছে, তাই দেখে ঠক ঠক করে কাঁপছে ফিলোমিনা।

নিঃশব্দে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল লুকা ব্রাসি। ধাত্রী ফিলেমিনাকে সাহায্য করল লুকারই দুজন সহকারী। পোয়াতী তেমন কষ্ট পেল না, সহজেই বেরিয়ে এল বাচ্চাটা। সাথে সাথে ক্লান্তিতে ঢলে পড়ল মা, ঘুমিয়ে পড়ল। খবর পেয়ে কামরায় ফিরে এল লুকা।

নবজাতককে কম্বলে জড়িয়ে নিয়ে এগোল ফিলোমিনা। লুকা ব্রাসির সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, তার দিকে বাড়িয়ে ধরল বাচ্চাকে, বলল, আমার কাজ শেষ। আপনি যদি এর বাবা হন, নিন।

ফিলোমিনার দিকে নিঃশব্দে তাকাল লুকা। ভয়ে আবার কাঁপতে শুরু করল ফিলোমিনা। আবার সেই পাগলের মত দেখাচ্ছে লুকাকে, কি যেন একটা অশুভ শক্তি ভর করেছে তার ওপর, কি যেন একটা অসম্ভব কথা চিন্তা করছে সে।

হ্যাঁ, আমিই ওর বাবা,কর্কশ গলায় বলল লুকা কিন্তু এই বংশের কেউ বেঁচে থাকুক তা আমি চাই না। ওকে নিয়ে বেসমেন্টে চলে যাও, ফেলে দাও চুলোয়।

ফিলোমিনার মনে হলো, ঠিক কি বলতে চাইছে লুকা তা সে বুঝতে পারছে না। বংশের কথা কেন তুলল সে? মেয়েটা ইতালীয় নয়, সেজন্যে? নাকি সে বেশ্যা বলে? অথবা লুকার ঔরসে যে জন্মেছে তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই, যোগ্য নয়? কিন্তু পরমুহূর্তে ভাবল, এসব কিছু না, ব্যাপারটা আসলে লুকার নির্দয় একটা ঠাট্টা।

 আপনার সন্তান, কার কি বলার আছে-যা ইচ্ছে করুন। ছোট্ট পোটলাটা লুকার দিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল ফিলোমিনা।

 ঠিক এই সময় ঘুম ভেঙে গেল মায়ের। পাশ ফিরল সে, ওদের দিকে তাকাল। দেখল, থমথম করছে লুকার চেহারা। কম্বলে জড়ানো পোটলাটা ঠেলে ফিরিয়ে দিচ্ছে ফিলোমিনার বুকের ওপর। লুকা! আঁতকে উঠল মা। ও, লুকা! ওকে তুমি মাফ করো! সদ্যজাত সন্তানের হয়ে ক্ষমা চাইল সে। ওকে রেহাই দাও! তোমার পায়ে পড়ি, ওকে নয়, তুমি আমাকে…

ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল লুকা।

ফিলোমিনা দেখল, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। সদ্যজাত শিশুর মায়ের দিকে তাকাল ফিলোমিনা। তার চেহারাতেও ফুটে উঠেছে তীব্র ঘৃণা। দুই হিংস্র জানোয়ার যেন পরস্পরকে চিনতে পেরে প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, দুজনের কেউই এখন দুনিয়ার কোন ব্যাপারে সচেতন নয়, শিশুটির কথাও ভুলে গেছে ওরা পরস্পরের প্রতি ওদের ঘৃণা আর ক্রোধ প্রতি সেকেণ্ডে শুধু বেড়েই চলেছে।

হিংস্র পশুর মত পরস্পরের দিকে আরও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওরা। অদ্ভুত এক পৈশাচিক লালসা ফুটে উঠেছে লুকার চেহারায়। খুনের নেশায় পাগল দেখাচ্ছে ওকে।

ধীরে ধীরে ফিলোমিনার দিকে ফিরুল লুকা। ছ্যাৎ করে উঠল ফিলোমিনার বুক। সভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সে।

যা করতে বলেছি তাই করো–যাও, চাপা কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল নিস্তব্ধ কামরার ভেতর। আবার বলল লুকা, তোমার কোন অভাব রাখব না। যাও।

ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ফিলোমিনা। কথা বেরুল না মুখ থেকে। দ্রুত মাথা নাড়তে পারুল শুধু। কিন্তু সেটা লুকার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে যথেষ্ট নয়। বুঝতে পেরে প্রাণপণ চেষ্টায় ফিসফিস করে বলল, আমাকে মাফ করুন। আপনি ওর বাপ, যা হয় আপনি করুন।

তিন সেকেণ্ড নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল লুকা। তারপর শার্টের ভেতর হাত গলিয়ে একটা ছোরা বের করল। তোমাকে কাটব, বলল সে।

এরপর কিছুক্ষণ হুঁশ ছিল না ফিলোমিনার। কারণ আবার যখন সুস্থ বোধ করল সে, চিন্তা শক্তি ফিরে পেল, দেখল বাড়িটার নিচে বেসমেন্টে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড চুলোটা। সদ্যজাত শিশুকে এখনও বুকের সাথে জাপটে ধরে আছে সে। আশ্চর্য, মায়ের পেট থেকে বেরুবার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও কাঁদেনি সে–যেন প্রতিবাদ করে কোন লাভ নেই জানতে পেরে চুপচাপ থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু ফিলোমিনা চাইছে, একবার অন্তত কেঁদে উঠুক বাচ্চাটা। তাতে যদি লুকার প্রাণে একটু দয়া হয় একটা চিমটি কাটলেই ব্যথা পেয়ে কেঁদে ওঠে ও, কিন্তু দিশেহারা ফিলোমিনার মাথায় বুদ্ধিটা এল না।

চুলোর দরজা কেউ একজন খুলে দিয়ে গেছে। ভেতরে আগুন দেখা যাচ্ছে। বেসমেন্টে লুকা আর ফিলোমিনা ছাড়া কেউ নেই। চারদিকে গরম পানির পাইপ দেখা যাচ্ছে, ঘামের মত বিন্দু বিন্দু পানি ঝরছে পাইপের গা থেকে। ইঁদুর-ইঁদুর বোটকা একটা গন্ধ ঢুকছে নাকে!

ছোরাটা আবার কখন যেন বের করে হাতে নিয়েছে লুকা। ফিলোমিনা জানে, ওকে খুন করার জন্যে তৈরি হয়ে আছে সে।

আগুনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল ফিলোমিনা। ধীরে ধীরে লুকার দিকে তাকাল আরেকবার। বুঝতে পারল, প্রকৃতিস্থ অবস্থায় নেই লোকটা! মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। শয়তানের চেহারাও বুঝি এমন বীভৎস নয়। খালি হাতটা দিয়ে ওকে ধাক্কা দিল সে। ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে চুলোর ভোলা দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল ফিলোমিন।

অসহায় ফিলোমিনা জানে, কিছুই তার করার নেই। লুকার হুকুম অমান্য করতে পারে সে, তাতে খুন হতে হবে। কিন্তু খুন হয়ে লাভ কি যদি না বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়?

গল্প থামিয়ে চুপ করল ফিলোমিনা। তাকে এক গ্লাস মদ দিল মাইকেল! সেটা খেয়ে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকল সে। ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠল, বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছে সে।

কাজটা তুমি করলে? কোমল গলায় জানতে চাইল মাইকেল।

উপর নিচে মাথা দোলাল ফিলোমিনা।

তারপর কি হলো?

গল্পটা আবার বলতে শুরু করল ফিলোসিনা এক বান্ডিল টাকা দিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিল লুকা। বিদায় দেবার আগে গভীর সুরে জানাল, মুখ খুললে মরতে হবে ফিলোমিনাকে। ফিলোমিনা মুখ খোলেনি। কিন্তু দুদিন পরই পুলিশ এসে বেঁধে নিয়ে গেল লুকাকে। কারণ শিশুর মাকে খুন করেছিল সে।

কয়েক দিন বাড়ি ছেড়ে ভয়ে কোথাও বের হত না ফিলোমিনা। তারপর মনস্থির করে গড ফাদারের কাছে গেল সে, তাকে সব কথা খুলে বলল সব শুনে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর সম্পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে ফিলোমিনাকে বললেন, তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু এ-ব্যাপারে কাউকে তুমি কিছু বোলো না।

গড ফাদারের আশ্বাস পেয়েও খুব একটা নিরাপদ বোধ করেনি ফিলোমিনা। তার কারণ, লুকা ব্রাসি তখনও ডন কর্লিয়নির কাজ করে না

ডন কর্লিয়নি কোন পদক্ষেপ নেবার আগেই সেলে বসে লুকা ব্রাসি আত্মহত্যার চেষ্টা করল। ভাঙা কাঁচের টুকরো দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলেছিল, কিন্তু দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় বেঁচে গেল সে। ওদিকে, সে সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই তাকে পুলিশ এবং আইনের হাত থেকে বঁচাবার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে ফেললেন ডন কর্লিয়নি। আদালতে প্রমাণ দাখিল করার মত কিছুই পেল না পুলিশ, বেকসুর খালাস পেয় গেল লুকা।

ডন কর্লিয়নি ফিলোমিনাকে সম্পূর্ণ আশ্বাস দিলেও পুলিশ বা লুকার তরফ থেকে বিপদ হতে পারে এই ভয় কাটেনি তার কাজে মন বসে না, সব সময় গা ছমছম করে। শেষ পর্যন্ত সব কথা খুলে বলল স্বামীকে লোকটা ভাল ছিল, সব কথা বুঝল সে! মুদি দোকান বিক্রি করে ইটালিতে ফিরে আসতে রাজী হলো।

ফিরে এল ওরা। আমেরিকায় কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছিল ফিলোমিনার স্বামী, কিন্তু ইটালিতে ফিরে এলে দুর্বল লোকটা সব টাকা উড়িয়ে দিল। তাই তো আজ এই অবস্থা ফিলোমিনার, পরের দোরে চাকরানীর কাজ করতে হচ্ছে।

শেষ হলো ফিলোমিনার গল্প। মাইকেলের হাত থেকে আরেক গ্লাস মদ নিয়ে খেলো সে।

মাইকেল কর্লিয়নি, বলল বুড়ি, তোমার বাবা খুব ভাল মানুষ, যখনই গির্জায় যাই তখনই তার জন্যে প্রার্থনা করি। আমার আশীর্বাদ সব সময় তার সাথে আছে। টাকার দরকার হলে কখনও তিনি নিরাশ করেননি, খবর পেয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেন আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, বুঝলে তো এখন? উনি শুধু আমার প্রাণই বাঁচাননি, বেঁচে থাকার জন্যে সাহায্যও করেছেন। তাকে বোলে, মৃত্যুর পর তার কোন ভয। নেই। আমি তার আত্মার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করি।

বুড়ি ফিলোমিনা বিদায় নিয়ে চলে গেল।

যা বলল তা কি সত্যি? ডন টমাসিনোকে জিজ্ঞেস করল মাইকেল।

 নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালেন মাফিয়া নেতা ডন টমাসিনো; সব সত্যি।

একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল মাইকেল। কেন কেউ ওকে গল্পটা বলতে চায়নি, এখন বুঝতে পারছে ও। সন্দেহ নেই, গল্প বটে একখানা! আর লুকাও একজন মানুষ বটে!

পরদিন সকালের দিকে মাইকেলের ইচ্ছা হলো, গত রাতে ফিলোমিনার বলা গল্পটা নিয়ে ডন টমাসিনোর সাথে একটু আলোচনা করবে ও। কিন্তু তাঁর খোঁজ নিতে গিয়ে জাল, বিশেষ একটা জরুরী বার্তা পেয়ে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে পালার্মোয় চলে যেতে হয়েছে তাকে।

সন্ধ্যায় ফিরলেন ডন টমাসিনো। মাইকেলকে ডেকে পাঠালেন তিনি। ওকে নিয়ে নির্জন একটা কামরায় ঢুকলেন। তারপর বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে মাইকেল। এখনও কো কথা বলেনি ও। আমেরিকা থেকে খবর এসেছে। কথা বলছেন ডন টমাসিনো। তার কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ আর দুঃখ।-খারাপ খবর! সাঙ্ঘাতিক খারাপ খবর! সনি, সান্তনো র্লিয়নি খুন হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *