০৭.
লং বীচ।
ওদের বডিগার্ড তথা ড্রাইভার রকো ল্যাম্পনি ডন কর্লিয়নি আর টম হেগেনকে নিয়ে উঠানে পৌঁছুল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
আমাদের ড্রাইভার রকোর ওপর একটু নজর রেখো, বাড়ির ভিতর ঢুকেই টম হেগেনকে বললেন ডন কর্লিয়নি। ওকে আমার এর চেয়ে ভাল কাজের যোগ্য বলে মনে হয়েছে।
গড ফাদারের মন্তব্য শুনে একটু অবাক হলো হেগেন। একটা কথাও বলেনি সারাদিন রকে। পিছনের সীটের আরোহী দুজনের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। ওরা যখন বাইরে বেরিয়ে ব্যাংকের সামনে গাড়ির কাছে এসেছিল, ডনের জন্যে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল বকো ল্যাম্পনি সব কাজই সে সুচারু ভাবে করেছিল, কিন্তু কোন শিক্ষিত চালকের চেয়ে বেশি কিছু করেনি। বোঝা গেল, ডন নিশ্চয় এমন কিছু দেখেছেন যা চোখে পড়েনি টম হেগেনের।
এরপর টমকে বিদায় করে দিলেন ডন। বলে দিলেন রাতের খাবারের পর আবার যেন ফিরে আসে সে। ব্যস্ততার কিছু নেই, টম যেন একটু বিশ্রাম করে নেয়। কারণ গভীর রাত পর্যন্ত শলা-পরামর্শ চলবে ডন আরও বললেন, ক্লেমে আর টেসিওকেও উপস্থিত থাকতে হবে। দশটার সময় আসে যেন তারা, তার আগে নয়। শান্তি-বৈঠকে কি হয়েছে না হয়েছে, ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওকে টম যেন সব জানিয়ে দেয়।
রাত দশটা। তাঁর কোণার ঘরে ওদের তিন জনের জন্য অপেক্ষা করছেন ডন কর্লিয়নি। এই কামরাটা তার অফিস, তার আইন সম্পর্কিত বইয়ের লাইব্রেরিও বটে এটা, তার বিশেষ টেলিফোনটাও রয়েছে এখানে। একটা ট্রেতে বরফ, সোডা, হুইস্কির বোতল রয়েছে। নির্দেশ দিতে শুরু করেছেন ডন। বলছেন, আজ আমরা শান্তি করলাম। আমি আমার কথা দিয়েছি, ধর্ম সাক্ষী রেখেছি। তোমাদের সকলের জন্যে সেটাই যথেষ্ট হওয়া উচিত। তবে আমাদের বন্ধুরা সবাই অতটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তুই এখনও আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু আর কোন অপ্রত্যাশিত অঘটন যেন না ঘটে, তারপর হেগেনের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন, বোচ্চিচ্চিওর জামিনদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে তো?
মাথা দুলিয়ে বলল হেগেন, বাড়ি পৌঁছেই ক্লেমেঞ্জাকে ফোন করে দিয়েছিলাম।
প্রকাণ্ডদেহী ক্লেমেঞ্জার দিকে ফিরলেন ডন। ক্যাপোরেজিমি মাথা দুলিয়ে বলল, সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি। আচ্ছা, গড ফাদার, বোচ্চিচ্চিওরা যতটা ভান করে, কোন সিসিলীয়র পক্ষে অতটা বোকা হওয়া কি সম্ভব?
একটু হাসলেন ডন কর্লিয়নি। কিন্তু ভাল রোজগার করার মত বুদ্ধি আছে ওদের। তার চেয়ে বেশি বুদ্ধি থাকার দরকারটা কি শুনি? এ দুনিয়ায় এত যে গণ্ডগোল, সে সব বোচ্ছিচ্চিওরা বাধায় না। তবে, হ্যাঁ, একথাও সত্যি-সিসিলীয় মাথা নেই ওদের।
যুদ্ধ থেমে গেছে। সবার মনে স্বস্তি। নিজের হাতে পানীয় মেশালেন ডন কর্লিয়নি, প্রত্যেকের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিলেন। নিজের গ্লাসে সযতে চুমুক দিচ্ছেন। চুরুট ধরালেন একটা। তারপর বললেন, সনি কেন, কিভাবে মারা গেল সে ব্যাপারে কোন অনুসন্ধান হোক, এ আমি চাই না। ওসব শোধবোধ হয়ে গেছে। অন্যান্য পরিবারের সাথে সহযোগিতা করতে চাই আমি। তারা যদি একটু বেশি লোভ করে, আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করে, তবুও। আমি চাই এমন কিছু যেন না ঘটে, যাতে এই শান্তি নষ্ট হয়, যতদিন না মাইকেলকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার একটা বন্দোবস্ত করা যায়। এই চিন্তাটাই যেন তোমাদের মনে সব কিছুর আগে থাকে, এই আমি চাই। মনে রেখো, সে যখন ফিরে আসবে, যেন সম্পূর্ণ নিরাপদভাবেই আসতে পারে। না, আমি টাটাগ্লিয়া অথবা বার্জিনিদের তরফ থেকে কোন বিপদের কথা বলছি না। আমার যত ভাবনা পুলিশদেরকে নিয়েই। ওর বিরুদ্ধে বাস্তব প্রমাণ যা আছে, সমস্ত আমরা দূর করে দিতে পারি। ওই ওয়েটারও সাক্ষ্য দেবে না আর এই প্রত্যক্ষদশী বা পিস্তলধারী বা ওকে যাই বলো না কেন, সেও সাক্ষ্য দেবে না। বাস্তব প্রমাণগুলোর কথা তো আমরা জানিই, তাই ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমাদের দেখতে হবে শুধু পুলিশ যেন মিথ্যে সাক্ষী তৈরি করে না রাখে। কারণ, ওদের ইনফর্মাররা হয়তো জেনেই বলেছে যে ক্যাপটেনকে মাইকেল কর্লিয়নিই খুন করেছে। বেশ। এবার তাহলে আমাদের দাবি কি হবে? আমাদের দাবি হবে, নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবার পুলিশের এই ধারণা শুধরে দেবার জন্যে এবার তাদের যথাসাধ্য করুক। ওদের যে সব ইনফর্মাররা পুলিশের সাথে সহযোগিতা করে, তারা নতুন নতুন বিবৃতি দিক। আমার বিশ্বাস, আজ দুপুরে আমার কথা শুনে ওরা সবাই বুঝতে পেরেছে যে, এই কাজটা করে দিলে তাদেরই সুবিধা হবে। কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়। আমাদের দিক থেকে এমন একটা নিখুঁত বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ব্যাপারটা নিয়ে ভবিষ্যতে কোন দিন মাইকেলকে ডাকতে বা বিপদে পড়তে না হয়। তা না হলে, এদেশে ওর ফিরে এসেই বা কি লাভ? কাজেই, এসো সবাই মিলে একটু চিন্তা করা যাক। এটাই হলো এখনকার জন্যে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
কি জানো, প্রত্যেক মানুষকে জীবনে একবার অন্তত নির্বোধের মত কাজ করতে দেয়া উচিত সেই রকম একটা কাজ আমিও করছি। আমি চাই আমাদের উঠানের চারদিকে যত জমি আছে তার সবটা কিনে ফেলা হোক, সমস্ত বাড়ি কিনে ফেলা হোক। কেউ তার জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালে আমার বাগান দেখতে পাবে, এ আমি চাই না। এক মাইল দূর থেকেও তা যেন কেউ দেখতে না পায়। আমি উঠানের চারধারে পাচিল চাই, রাতদিন চব্বিশ ঘন্টার জন্যে সতর্ক পাহারা চাই! পাচিলে একটা ফটক চাই। এক কথায়, একটা দুর্গের মত দুর্ভেদ্য জায়গায় বাস করতে চাইছি আমি তোমাদের জানিয়ে রাখছি, কাজ করতে আর কখনও শহরে যাব না। ধরে নাও, আধা-অবসর নিয়েছি। বাগানে কাজ করার ইচ্ছা হয়েছে। আমার নিজের বাড়িতে থাকব যদি কখনও বের হই, শুধু কোথাও ছুটি কাটাতে বের হব। অথবা বিশেষ কোন জরুরী কাজ পড়লে যদি বের হতে বাধ্য হই। তখন আমি আশা করব সব রকম সতর্কতা যেন অবলম্বন করা হয়। দেখো, আমাকে তোমরা কেউ ভুল বুঝো না। ভেবো না আমি কিছু পাকিয়ে তুলছি। আমি শুধু খানিকটা বিচক্ষণ হতে চাইছি। অবশ্য চিরকালই আমি তাই। বেঁচে থাকার মধ্যে অসাবধানতার মত আর কোন জিনিসে আমার অরুচি নেই। মেয়েমানুষ আর শিশুদের অসাবধান হওয়া সাজে, পুরুষদের সাজে না। ধীরে-সুস্থে সমস্ত ব্যবস্থা করো, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমাদের বন্ধুদের যেন আবার শঙ্কিত করে তুলে না। এমন ভাবে ধীরে-সুস্থে করো, যাতে কারও চোখে কিছুই অস্বাভাবিক না ঠেকে।
এখন থেকে ক্রমশ তোমাদের তিনজনের হাতে বেশি করে কাজের ভার দেব আমি। সান্তিনোর দলটা ভেঙে ওই দলের লোকদের তোমরা নিজেদের দলে নিয়ে নাও। এই আমার ইচ্ছা। এটা লক্ষ করে আমাদের বন্ধুদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত, বোঝা উচিত আমি সত্যি সত্যিই শান্তি চাই। টম, আমি চাই তুমি একদল লোককে লাস ভেগাসে পাঠাও। সেখানে সত্যি কি হচ্ছে না হচ্ছে সে-ব্যাপারে একটা পূর্ণচিত্র দেবে তুমি আমাকে। ব্যাপারটা জানতে চাই আমি। আসলে ওখানে কি হচ্ছে জানাবে আমাকে। আমি নাকি নিজের ছেলেকে চিনতেই পারব না। ও নাকি এখন ভাল রাঁধতে পারে, অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে নাকি ফুর্তি করতে পারে। কি আশ্চর্য, এসব করার বয়স তো কবেই শেষ হয়ে গেছে ওর। অথচ ছোট বেলায় ও বড় বেশি গভীর ছিল, তাছাড়া কোন দিনই আমাদের পারিবারিক ব্যবসাতে ওকে মানায় না। সে যাই হোক, এবার ওখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জানা দরকার আমার।
ধীর শান্ত গলায় বলল হেগেন, আপনার জামাইকে পাঠাই? ও তো নেভাডারই ছেলে, ও-দিককার হালচাল সব জানে সে।
মাথা নেড়ে বললেন ডন কর্লিয়নি, না। ছেলে-মেয়েরা কেউ কাছে না থাকলে আমার স্ত্রীর বড় একা লাগে। আমি চাই কনি আর তার স্বামীকে উঠানের একটা বাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আসা হোক। একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেয়া হোক কার্লোকে। ওর সাথে হয়তো বড় কর্কশ ব্যবহার করা হয়ে গেছে। তাছাড়া, মুখ বিকৃত করে বললেন ডন কর্লিয়নি, আমার ছেলের অভাব। ওকে জুয়ার ব্যবসা থেকে সরিয়ে এনে ইউনিয়নের কাজে লাগাঁও। কিছু খাতাপত্র দেখতে পারবে, প্রচুর কথাও বলতে পারবে। বেশ সুন্দর কথা বলে। সামান্য একটু তাচ্ছিল্যের সুর শোনা গেল ডনের গলায়।
মাথা দুলিয়ে তাকে সমর্থন করে হেগেন বলল, বেশ। ক্লেমেঞ্জা আর আমি আমাদের সমস্ত লোককে যাচাই করে ভেগাসে পাঠাবার জন্যে কয়েকজনকে নির্বাচন করব। যদি বলেন, কয়েকদিনের জন্য ফ্রেডিকে আনিয়ে নিতে পারি।
মাথা নাড়ালেন ডন। বললেন, কিসের জন্যে? কেন? আমার স্ত্রীই তো আমাদের রান্না করতে পারেন। ও ওখানেই থাকুক।
অস্বস্তির সাথে চেয়ারে নড়েচড়ে উঠল ওরা তিনজনই। এতদিন টের পায়নি ওরা যে ফ্রেডির বাবা ছেলের উপর এতটা অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। ওদের এখন সন্দেহ হচ্ছে, এর পিছনে নিশ্চয়ই এমন কিছু কারণ আছে যা ওদের কারও জানা নেই।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডন কর্লিয়নি বললেন, আশা করছি, এই বছর বাগানে কিছু ভাল মিষ্টি লঙ্কা আর টম্যাটো কলাব। আমাদের খেতে যত লাগবে তার চেয়েও বেশি। সেগুলো তোমাদেরকে উপহার দেব। এই বুড়ো বয়সে এবার আমি একটু শান্তি চাই। একটু নির্জনতা চাই। একটু মনের সুখ চাই। ব্যস, এইটুকই তোমাদেরকে বলতে চেয়েছি। ইচ্ছা হয় তো আরেক গ্লাস পানীয় নাও না তোমরা সবাই। ইঙ্গিতে ওদেরকে বিদায় জানাচ্ছেন।
উঠে পড়ল ওরা তিনজন। ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওকে তাদের গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, তাদের সাথে আরও বারকতক আলোচনায় বসার কথা স্থির করে এল হেগেন। ডনের নির্দেশ পালন করতে হলে অনেক খুঁটিনাটি কার্যকর ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হবে ওদেরকে। আবার বাড়ির ভিতর ফিরে এল হেগেন। ডন কর্লিয়নি ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, জানে ও।
কোট আর টাই খুলে সোফার উপর শুয়ে পড়েছেন ডন। তাঁর কঠিন চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফুটে এখন আরও নরম দেখাচ্ছে। একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে ডন বললেন, এবার বলো তো, কনসিলিয়রি, আমার আজকের কথাবার্তার কোনটাতে কি তোমার আপত্তি আছে?
মুখ খুলতে একটু সময় লি হেগেন। তারপর বলল, তা নেই। কিন্তু গোটা ব্যাপারটার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব দেখতে পাচ্ছি আমি। আপনার সাথে ঠিক যেন মিলছে না। আপনি বলছেন, সান্তিনোকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তা আপনি জানতে চান না, প্রতিশোধ নিতে চান না। এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এও জানি, আপনি কথা দিয়েছেন শান্তি রক্ষা করবেন, সুতরাং নিশ্চয়ই শান্তি রক্ষা করবেন। তবু আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে আজ আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে আপনার শত্রুদের জয়লাভ বলে মনে হচ্ছে, সেটা আপনি সত্যি সত্যি তাদের। দিচ্ছেন। আমার জন্যে আপনি একটা অপূর্ব হেয়ালির সৃষ্টি করেছেন, আমি তার কোন উত্তরই খুঁজে পাচ্ছি না। তাই বুঝতেই পারছি না আপনাকে আমি সমর্থন করব, নাকি আপত্তি জানাব।
পরম পরিতৃপ্তির একটা ভাব দেখা গেল ডনের মুখে। তিনি বললেন, সবার চেয়ে আমাকে ভাল বোঝ তুমি। যদিও তুমি সিসিলীয় নও, তোমাকে সিসিলীয় বানিয়েছি আমি। যা বললে তার সবই সত্যি। তবে এর একটা সমাধানও আছে। খেলা শেষ হবার আগে তুমিও সেটা জানতে পারবে। তুমি তাহলে স্বীকার করছ যে সবাইকেই আমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতে হবে আর আমিও আমার কথা রাখব। আমার আদেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হোক, এই আমি চাই। দেখো, টম, সবচেয়ে বড় কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হবে মাইকেলকে। এই কথাটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বল মনেও করৰে আর কাজেও দেখাবে। যত টাকা লাগে লাগুক, আইনের গলিঘুজি খুঁজে দেখো। ও বাড়ি এলে কোথাও যেন কোন বিপদ ঢোকার ফুটো না থাকে। ফৌজদারী আইন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলো কয়েকজন বিচারকের নাম দেব তোমাকে, তারা তোমার সাথে গোপনে আলোচনা করবেন কিন্তু সমস্যাটার সুচারু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সব রকম বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে চলতে হবে আমাদের।
হেগেন বলল, আমি বাস্তব প্রমাণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি শুধু ভাবছি ওরা না কোথাও কোন মিথ্যে, জাল ষড়যন্ত্র তৈরি করে রাখে। তাছাড়া, মাইকেল একবার গ্রেপ্তার হলে ক্যাপটেন ম্যাকাঙ্কির কোন পুলিশ-বন্ধুও খুন করতে পারে ওকে। ওর সেলে ঢুকে ওকে মেরে ফেলা বা লোক দিয়ে খুন করানো পানির মত সহজ। আমি যতদূর বুঝি, ওর ধরা পড়ার, অভিযুক্ত হবার ঝুঁকিটুকুও নিতে পারি না আমরা।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেনে ডন কর্লিয়নি বললেন, জানি, আমি জানি। মুশকিলটা তো ওখানেই। কিন্তু তাই বলে খুব বেশি দেরিও করা যায় না। গোলমাল নিসিলীতেও আছে। ওখানকার ছোকরারাও আর গুরুজনদের কথামত চলছে না। তাছাড়া এখান থেকে যাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের সাথে ওখানকার সেকেলে ডনরা পেরে উঠছে না। যদি দুদলের মাঝখানে পড়ে যায় মাইকেল? অবশ্য সে ব্যাপারেও কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি আমি। এখনও ভাল একটা গোপন আশ্রয়েই আছে ও। কিন্তু সে আশ্রয়ও চিরকাল নিরাপদ থাকবে না। শান্তি ফিরিয়ে আনার সেটাও একটা কারণ। সিসিলীতে বন্ধু-বান্ধব আছে বার্ভিনির, তারা খুঁজছে মাইকেলকে। এই তো তোমার হেঁয়ালির পেয়ে গেলে একটা উত্তর। আমার ছেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে শান্তিচুক্তি করতে হলো। আর কোন উপায় ছিল না।
এত খবর কোত্থেকে পেলেন ডন, সে কথা জানতে চেয়ে সময় নষ্ট করল না টম। বিন্দুমাত্র অবাকও হলো না, আর এ কথাও সত্যি যে হেঁয়ালির খানিকটা সমাধানও পাওয়া গেল। সে জানতে চাইল, খুঁটিনাটি বন্দোবস্ত করার জন্যে যখন টাটাগ্লিয়ার লোকদের সাথে দেখা করব, তখন কি আমি দাবি তুলবয়ে যারা ড্রাগ ব্যবসায় মধ্যস্থতা করবে তারা পুলিশের চেনা হলে চলবে না? দাগী আসামীকে অল্প শান্তি দিতে বিচারকের অন্তি বোধ করতে পারেন।
এটুকু বুঝে নেবার মত বৃদ্ধি ওদের থাকা উচিত, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন ডন কর্লিয়নি। কথাটা তুলো, তবে দাবির সুরে নয়। আমরা যথাসাধ্য করব, কিন্তু ওরা যদি একটা পেশাদার ড্রাগের দালালকে কাজে লাগায়, আর সে ব্যাট ধরা পড়ে, তাকে আমরা কোন সাহায্যই করব না। সোজা বলে দেব, কিছু করার উপায় নেই। তবে বলার দরকার হবে না, বার্জিনি ঠিক বুঝে নেবে। লক্ষ করেছ কি, এ ব্যাপারে নিজের মতামত একবারও জানাল না ও। এ সবের সাথে ও যে কোনভাবে জড়িত, বোঝাই যাচ্ছিল না। এই ধরনের লোকেরা কখনও হেরে যাওয়ার দলে থাকে না।
চমকে উঠল হেগেন। আপনি বলতে চাইছেন প্রথম থেকেই সলোযো আর টাটাগ্লিয়ার পিছনে ছিল ও?
টাটাগ্লিয়াটা তো একটা দালাল, একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন ডন কর্লিয়নি। সান্তিনোর সঙ্গে লড়াই করে ও কখনও পেরে উঠত না। সে জন্যেই কি হয়েছিল না হয়েছিল আমার জানার দরকার নেই। ওতে বার্জিনির হাত ছিল, এইটুকু জানাই আমার জন্যে যথেষ্ট।
কথাটা মনে গেঁথে রাখল হেগেন। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে ও, কিছু কিছু সূত্র দিচ্ছেন বটে ডন, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু চেপে যাচ্ছেন তিনি। সেটা যে কি তাও জানে হেগেন, সেই সাথে এও জানে যে এ প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করা শোভা পায় না। গুড নাইট বলে বাড়ি ফেরার জন্যে উঠে পড়ল সে। কিন্তু একটা কথা বলতে বাকি আছে তখনও ডন কর্লিয়নির।
মনে রেখো, মাইকেলকে কিভাবে বাড়ি আনা যায়, মাথা ঘামিয়ে তার একটা উপায় বের করতে হবে। আরেকটা কথা। আমাদের টেলিফোনের লোকটার সাথে। প্রয়োজনীয় কথা বলো, যাতে ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওকে প্রতি মাসে কেকটা টেলিফোন করে আর ওরাই বা কাকে কটা টেলিফোন করে তার একটা তালিকা। পাই আমি। না, কোন কারণে সন্দেহ করছি না ওদেরকে। হলপ করে বলতে পারি, আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না ওরা। তবে বড় ঘটনার আগে ছোটখাট সমস্ত খুটিনাটি জানা থাকলেও কোন ক্ষতি নেই।
মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল হেগেন। ভাবছে, কে জানে ওর ওপরেও গড ফাদার কোন উপায়ে নজর রাখছেন কিনা। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজের সন্দেহের কথা ভেবে লজ্জা পেল টম। সে যাই হোক, এবার ও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছে গড় ফাদারের সূক্ষ্ম জটিল মনে কোন সুদূরপ্রসারী কাজের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে, তার তুলনায় সেদিনকার ঘটনাবলী একটা কৌশলী পশ্চাদপসারণ ছাড়া কিছুই নয়। তাছাড়া সেই একটা রহস্যময় সূত্র উহ্য রয়েছে, যার কথা কেউ উল্লেখ করেনি। টম নিজেও প্রশ্ন করে জেনে নিতে সাহস পায়নি, ডন কর্লিয়নি উপেক্ষা করে গেছেন। সমস্ত কিছু থেকেই একটা বোঝাপড়ার দিনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে সেই দিনটাতে কি ঘটবে না।