০৫.
ভোর চারটে। ডনের অফিস রূমে গোল হয়ে বসে আছে ওরা পাঁচজন–সনি, হেগেন, ক্লেমেঞ্জা, টেসিও, মাইকেল। অভয় দিয়ে পাশেই নিজেদের বাড়িতে স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছে হেগেন। বাইরে এখনও অপেক্ষা করছে পলি গাটো। টেসিওর। লোকেরা পাহারা দিচ্ছে তাকে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে পলিকে চোখের আড়াল করা চলবে না। কিন্তু পলি এসব কিছুই জানে না।
সবাই গভীর মনোযোগের সাথে কনসিলিয়রির কথা শুনছে। প্রথমে সলোযোর প্রস্তাব সম্পর্কে বলল হেগেন। তারপর গডফাদার বেঁচে আছেন শুনে সলোযোর প্রতিক্রিয়াটা বর্ণনা করল।
সাথে সাথে বুঝলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে, বলল সে। কিন্তু ডনের কাছ থেকে কম তো আর শিখিনি, সেগুলোকে কাজে লাগাতেও দেরি করলাম না। তুর্কী খচ্চরটাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ডন বেঁচে আছেন তো কি হয়েছে, শয্যাশায়ী তো বটে, তাকে বোঝাতে মোটেও বেগ পেতে হবে না আমার। সনির দিকে তাকিয়ে খানিকটা আবদারের, খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থনার, খানিকটা কৌতুকের সুরে বলল আবার। সে, দেখো ভাই, রাগ-টাগ কোরো না। ওকে আমার বলতে হয়েছে যে বাপের গদিতে বসার যথেষ্ট আগ্রহ আছে তোমার, বলতে হয়েছে তুমি আমার কথায় ওঠো বসো। ওই গড! আমায় মাফ করো! কুণ্ঠিতভাবে হাসল হেগেন।
মাথা নেড়ে ইশারায় জানাল সনি, কিছু মনে করেনি সে, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিকই করেছে হেগেন।
টেলিফোনটা হাতের কাছে নিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে নাইকেল। হেগেন আর সনিকে খুব মনোযোগের সাথে লক্ষ করছে ও। হেগেন কামরায় ঢুকতেই ছুটে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে সনি, দৃশ্যটা ক্ষীণ একটু ঈর্ষার উদ্রেক করেছে ওর মনে। মনে পড়ে গেছে সনি ওর নিজের বড় ভাই হলেও, দুই ভাইয়ের মধ্যে যতটা ঘনিষ্ঠতা তার চেয়ে সনির সাথে টমের ঘনিষ্ঠতা অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি।
এবার কাজের কথা হোক, বলল সনি। ঠিক করতে হবে, কি করব আমরা। টেসিওকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, আমরা দুজন একটা তালিকা তৈরি করেছি, সেটা প্রথমে দেখো তুমি। ক্লেমেঞ্জাকে তোমার কপিটা দাও, টেসিও।
আমি মনে করি, মাইকেল বলল, চূড়ান্ত আলোচনায় ফ্রেডিরও উপস্থিত থাকা উচিত।
ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল সনি। নিস্তেজ গলায় বলল, ওর কাছ থেকে সাহায্য পাবার কোন আশাই নেই। ডাক্তার বলেছে, প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছে ও, ধকলটা সামলাতে প্রচুর সময় লাগবে। আমি ঠিক বুঝছি না। তবে ফ্রেডি তোর আমার মত নয়, একথা ঠিক। গড় আর বাবা, দুজনকে সমান চোখে দেখে ও। গডকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখলে ভক্তের যে অবস্থা হবার কথা, ওরও ঠিক তাই হয়েছে।
ঠিক আছে, ওকে বাদ দাও, তাড়াতাড়ি বলল হেগেন। করণীয় স্থির করার আগে আরেকটা কথা, বলতে চাই আমি। সলোযো শত্রু, শত্রুকে কখনও তুচ্ছ ভাবতে নেই। এই বাড়ি ছেড়ে একপা বেরুনো চলবে না, তোমার। তোমার জন্যে, একমাত্র নিরাপদ জায়গা এই বাড়ি। সলোযোকে আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করি না। হাসপাতাল পাহারা দেবার কি ব্যবস্থা করেছ?
পুলিশ ঘিরে রেখেছে। ভেতরে এবং বাইরের প্রতি গজে আমাদের লোকও আছে। নিজের তালিকাটা হেগেনের দিকে বাড়িয়ে দিল সনি। দেখে বলো তুমি কি মনে করো।
তালিকাটা নিল হেগেন। পড়তে গিয়ে ভুরু কুঁচকে উঠল তার। তারপর মুখ তুলে বলল, ফর গডস সেক, সনি! ব্যাপারটাকে তুমি ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছ নাকি? ডন কিভাবে নিতেন, ভেবে দেখেছ? যাই ঘটে গিয়ে থাকুক, আক্রোশে অন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের উচিত নয়। মষ্টের গোড়া একজন, সলোযো। ওকে সরিয়ে ফেললেই যে যার খোপে খাপে খাপে বসে যাবে। টাটাগ্লিয়াদের ঘাটাবার দরকারটা কি?
সনি শুনল। তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না। একে একে দুই ক্যাপোরেজিমির দিকে তাকালসে।
কাঁধ ঝাঁকাল টেসিও। জটিল পরিস্থিতি, গম্ভীর হয়ে বলল সে।
সনি এবার ক্লেমেঞ্জার দিকে তাকাল। কিন্তু ক্লেমেঞ্জা কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকল। তাকে উদ্দেশ্য করে সনি বলল, আর সব ব্যাপার পরে আলোচনা করা যাবে। একটা কাজ এক্ষুণি সারা যায়। পলিকে আমাদের দরকার হবে না আর। ওর নামটাই তালিকার মাথায় রাখো।
মাথা ঝাঁকিয়ে বিশালদেহী ক্লেমেঞ্জা সমর্থন করল সনিকে।
লুকার এই অন্তর্ধান আমার ভাল ঠেকছে না, বলল হেগেন। ওর ব্যাপারে সলোযোকে ঘাবড়াতে না দেখে ভাবছি, লুকা টাকা গিলেছে নাকি?
হয়তো কোথাও মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে, বলল সনি।
অসম্ভব। মেয়েমানুষ নিয়ে কখনও বাইরে রাত কাটায় না সে। মাইক, উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত একটু পর পর ফোন করো ওক।
তখুনি রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করল মাইকেল। কিন্তু অপরপ্রান্তে বেল বাজলেও কেউ রিসিভার তুলছে না। হেগেনের দিকে তাকাল মাইক। এদিক ওদিক মাথা নেড়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল।
হঠাৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে সনি বলল, দুত্তোরি ছাই, এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব নাকি! টম, তুমি কনসিলিয়রি, পরামর্শ দাও। বলো কি করা উচিত আমাদের?
হুইস্কির বোতলটা ধীরেসুস্থে তুলে নিল হেগেন। গ্লাসে খানিকটা টেলে নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু গিলে নিয়ে বলল, সলোযোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাব। দরকার মনে করলে আপসও করে ফেলব। ডন সুস্থ হয়ে বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা। তারপর তিনি যা ভাল বুঝবেন আমরা তাই করব। তিনি যা করবেন তাতে বাকি সবগুলো পরিবারের সমর্থন থাকবে। এটুকু আমি জানি।
রাগে মুখটা লাল হয়ে উঠল সনির। সলোযোকে সামলাতে পারব না, আমার সৃম্পর্কে এই তোমার ধারণা?
না, সনির চোখে চোখ রেখে বলল হেগেন। কর্লিয়নিদের সমস্ত ক্ষমতা এখন তোমার হাতে, এবং সে ক্ষমতা কী ভয়ঙ্কর, কতদূর তার বিস্তার, আমার চেয়ে ভালভাবে তা আর কে জানে? ওরকম একশো সলোযোকে গর্ত থেকে বের করে নিয়ে এসে গায়েব করে দেবার ক্ষমতা তোমার আছে। ক্লেমেঞ্জা, টেসিও-এক একজন এক কথায় হাজার লোক জড়ো করে ফেলতে পারবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সামগ্রিক সংগ্রাম ডন চাইবেন না। আমিও চাই না। যুদ্ধের পর দেখা যাবে গোটা পূর্ব উপকূল ধ্বংসের স্তূপ হয়ে গেছে। সবগুলো পরিবার আমাদেরকে দায়ী করবে। অসংখ্য শত্রু তৈরি করব আমরা। তোমার বাবা কখনোই যা চান না।
বাবা যদি নাই বাঁচেন, তখন কি, পরামর্শ দেবে, কনসিলিয়রি?
সনির কণ্ঠস্বরের কাঠিন্য অনুভব করে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল হেগেন। তারপর কণ্ঠে আগের চেয়ে দৃঢ়তা এনে বলল, সলোযোর সাথে আপোস করো, এই পরামর্শ তখনও দেব আমি। তুমি আমার পরামর্শ শুনবে না, একথা জেনেও। একটু থেমে হেগেন আবার বলল, হিসাব করলে দেখা যাবে কর্লিয়নিদের মোট ক্ষমতার অর্ধেক ধরা হয় ডনের রাজনৈতিক যোগাযোগ আর তার ব্যক্তিগত প্রতিপত্তিকে। ডন মারা গেলে ক্ষমতার এই অংশ থেকে তুমি বঞ্চিত হবে। তখন কর্লিয়নিদেরকে সমর্থন করার কোন কারণ থাকবে না, কারও, সুতরাং সবগুলো পরিবারের সমর্থন পাবে সলোযো আর টাটাগ্লিয়ারা, কারণ দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী, সর্বনাশা যুদ্ধের সূচনা হোক তা কেউই চায় না। ডন যদি না বাঁচেন, আপোস করা ছাড়া টিকে থাকার উপায় নেই। আগে টিকে থাকার প্রশ্ন। দুর্বল ভিৎ মজবুত হোক, তখন প্রতিশোধের কথা ভাবা যাবে।
তুমি তো ব্যাপারটাকে হালকা করে দেখবেই, উত্তেজনায় কাঁপছে সনি। গুলি তো আর ওরা তোমার বাবাকে করেনি!
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল হেগেনের। উত্তর দিতে এক সেকেণ্ডও দেরি করল না সে। কথার ভঙ্গিতে, চোখে মুখে আশ্চর্য একটা গর্ব ফুটে উঠল তার। ভুল করছ, সনি। তোমরা যেমন তাঁর সুপুত্র, তেমনি আমিও তার সুপুত্র। তার কাছে তোমরা যতটুকু ঋণী, তারচেয়ে অনেক বেশি ঋণী আমি। তোমরা যতটুকু কৃতজ্ঞ তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আমি। তোমরা তাকে যতটুকু শ্রদ্ধা করো তার চেয়ে ঢের বেশি শ্রদ্ধা করি আমি। একথা ঠিক, এই ভয়ঙ্কর বিপদে তোমার মত দিশেহারা হইনি আমি, তার কারণ ডনের কাছ থেকেই শিখেছি বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরী। তোমাকে যা বলছি সব ব্যবসা-বুদ্ধির কথা। ব্যক্তিগতভাবে আমার ইচ্ছা করছে সব শালাকে নিজের হাতে খুন করি।
শেষের দিকে হেগেনের কর আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়তে লজ্জা পেল সনি। হেগেন থামতেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল সে। কী যন্ত্রণা, আমি কি সত্যি সত্যি তাই বলতে চাইছি! বলতে আসলে তাই চেয়েছে সনি। তার ধারণা, রক্তের সম্পর্কের সাথে আর কোন সম্পর্কের তুলনা চলে না।
একটা অস্বস্তিকর নীরবতা জমাট বাধছে। অস্বস্তি বোধ করছে সবাই।
বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসল সনি। শান্তভাবে বলল, ঠিক আছে, তাই হোক। প্রতিশোধ নেবার কোন চেষ্টা আমরা করব না। বাবার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত। মুখ তুলে হেগেনের দিকে তাকাল সে। টম, আমি চাই উঠান ছেড়ে বাইরে বেরুবে না তুমি। একবার ছেড়ে দিয়েছে, দ্বিতীয়বার ছাড়ার জন্যে ধরবে না। কোনরকম ঝুঁকি নেবে না তুমি।
ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল সনি। বলল, মাইক, তোরও সাবধানে থাকা উচিত। অবশ্য, ব্যবসার সাথে জড়িত নয়, এমন কাউকে নিয়ে সলোযো টানাহেঁচড়া করবে বলে মনে করি না আমি। তা করলে সবাই বিরক্ত হবে ওর ওপর। তবু, সাবধানের মার নেই।
এরপর টেসিওর দিকে ফিরল সনি। বলল, তোমার সব লোককে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখো। শহরের কোথায় কি ঘটছে, খুঁটিনাটি সব খবর তোমার কাছ থেকে পেতে চাই আমি।
বিশালদেহী ক্লেমেঞ্জার দিকে তাকাল সনি। বেশি দেরি না করে পলি গাটোর ব্যাপারটা ইতি করো। তারপর টেসিওর লোকদের ছেড়ে দিয়ে তোমার লোকদের হাতে তুলে দাও উঠানের দায়িত্ব। টেসিওর দিকে আবার ফিরল সনি। হাসপাতালে তোমার লোকই থাকুক।
কনসিলিয়রির দিকে তাকাল সনি। বলল, কাল সকালে তোমার প্রথম কাজ সলোযো আর টাটাগ্লিয়ার সাথে আলোচনা শুরু করা! ফোন করে অথবা লোক পাঠিয়ে, যেভাবে ভাল মনে করবে, যোগাযোগ করো ওদের সাথে।
ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল সনি। কি যেন ভাবছে সে।
সবাই ধৈর্য ধরে বসে আছে, সনির নির্দেশ অনুযায়ী কিভাবে কি করতে হবে তার একটা ছক তৈরি করে নিচ্ছে মনে মনে।
মাইক, বলল সনি, ক্লেমেঞ্জার দুজন লোককে সাথে নিয়ে লুকার বাড়িতে যাবি তুই কাল। যতক্ষণ সে ফিরে না আসে বা কোন খবর না পাস, অপেক্ষা করবি ওখানে। একটু থেমে চিন্তিত ভাবে আবার বলল সে, পাগলটা হয়তো.খবর শুনেই সোযোকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। টাকার লোভে গড ফাদারের সাথে বেঈমানী করেছে এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
হেগেন ইতস্তত করছে দেখে তার দিকে তাকাল সনি, চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
কাঁধ ঝাঁকাল কনসিলিয়রি, তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল, মাইককে খোলাখুলিভাবে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ওকে এসবের বাইরে রাখলেই বোধহয় ভাল হয়।
তাই তো! ঠিক বলেছ তুমি, টম, সায় দিয়ে বলে উঠল সনি। মাইক, কোথাও যেতে হবে না তোকে। তার চেয়ে জরুরী কাজটাই বরং কর তুই, এখানে বসে ফোন সামলা।
কথা বলল না মাইকেল। সঙ্কোচ, লজ্জা বোধ করছে ও খারাপ লাগছে এই ভেবে যে এ-বাড়িরই ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ওর উপর তেমন আস্থা নেই কারও। সবাই ধরেই নিয়েছে, এই বিপদে সে কোন গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করতে অক্ষম। আরেকটা ব্যাপার দৃষ্টি এড়ায়নি ওর। ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর চেহারায় কোনরকম ভাবের প্রকাশ নেই। ভাবল, নিশ্চয়ই ওরা অসন্তোষ আর ঘৃণা লুকাবার চেষ্টা করছে। মৃদু কাধ ঝাঁকিয়ে ক্রাডল থেকে রিসিভার তুলল ও। ডায়াল করল। শুনতে পাচ্ছে লুকা ব্রাসির বাড়িতে ফোনটা বাজছে। বেজেই চলেছে।