২.৭ ডন কর্লিয়নির আহত হবার খবর

০৭.

ডন কর্লিয়নির আহত হবার খবর শুনে জনি ফন্টেন তার গড ফাদারের জন্যে শুধু যে উদ্বিগ্ন হলো তাই নয়, ছবি করার টাকা, যোগান দেবার প্রস্তাবটা এখনও টিকে আছে। কিনা ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নিউ ইয়র্কে যেতে চাইছে ও, হাসপাতালে শায়িত গড ফাদারকে শ্রদ্ধা জানাবে। কিন্তু টেলিফোনে জানিয়ে দেয়া হলো ওকে, ওর নামে কোন অপপ্রচার হোক ডন কলিয়নি তা কোনমতেই চাইবেন না। অগত্যা অপেক্ষা করে থাকাই স্থির করল জনি। এক হপ্তা পর লোক এল টম হেগেনের কাছ থেকে, হ্যাঁ, টাকা যোগান দেয়া হবে, তবে একবারে মাত্র একটা ছবির জন্যে।

এদিকে নিনোকে হলিউডে, ক্যালিফোর্নিয়ায় যা খুশি তাই করতে কোন বাধা দিচ্ছে না জনি। দ্বিতীয় শ্রেণীর অল্প বয়েসী তারকাদের সাথে বেশ জমিয়ে নিয়েছে নিনো। মাঝে মধ্যে তাকে ডেকে পাঠায় জনি, রাতে একসাথে বেরুবে বলে। তবে এ-ব্যাপারে তার উপর নির্ভর করে থাকে না। ডনের গুলি খাওয়া সম্পর্কে কথা উঠলে নিনোবলল, জানিস, আমি একবার তাঁর সংগঠনে একটা চাকরি চেয়েছিলাম। সোজা না করে দিলেন, কোনমতে রাজি হলেন না। অ্যানলে আমার আর ট্রাক চালাতে ভাল লাগছিল না, কিভাবে আরও অনেক টাকা রোজগার করা যায় তার একটা উপায় খুঁজে পেতে চাইছিলাম। ডন আমাকে কি বলেছিলেন জানিন? বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের জন্যে একটা মাত্র নিয়ুতি নির্দিষ্ট হয়ে আছে। আমার নিয়তি নাকি শিল্পী হওয়া।

কথাটা ভেবে দেখল জনি। ওর মনে হলো, তার গড ফাদারের মত বুদ্ধিমান মানুষ দুনিয়ায় বোধ, হয় আর একজনও নেই। দেখে, উনি ঠিকই টের পেয়েছেন, গুণ্ডামি-পাণ্ডামি আর বেআইনী কাজ নিনোকে দিয়ে চলবে না। হয় বোকার মত বিপদে পড়ে যাবে, তা নাহলে কেউ মেরেই ফেলবে। আবোল-তাবোল কথা বলে হারিয়ে বসবে পৈত্রিক প্রাণ। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হলো, নিনো যে শিল্পী হবে তা ৬ন জানলেন কিভাবে? কারণ, দুত্তোর ছাই, ডন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন একদিন না একদিন, নিনোকে আমি সাহায্য করবই। কিন্তু বুঝলেন কিভাবে? বুঝলেন, ভেবে রেখেছিলেন, সময় মত তার মনের ইচ্ছাটা একদিন আমার কানে একটু তুলে দেবেন, আর আমিও তার প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাবশত নিনোর জন্যে চেষ্টা করব। তবে, স্পষ্টভাবে কোন দিনই আমাকে তিনি কিছু করতে বলেননি। এ বিষয়েও শুধু সামান্য একটু আভাস দিয়ে রেখেছিলেন, কাজটা করলে তিনি খুব খুশি হবেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জনি ফন্টেন। তার গড ফাদার নিজেই এখন আহত, মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন, সুতরাং একাডেমি পুরস্কারের আশাটা তার ছেড়ে দেয়াই ভাল। ওদিকে, ওর বিরুদ্ধে লেগে আছে ওলটস, কারও কাছ থেকে কোন সাহায্য পাবে সেই আশা নেই। একান্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগ একমাত্র ডন কর্লিয়নিরই আছে, যার জোরে চাপ দিয়ে দিনকে রাত করা যায়। কর্লিয়নি পরিবারের অন্যান্যদের-খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তার জন্যে এতসব ঝামেলা পোহাতে যাবে।. নিজের সাধ্যমত ওদেরকে সাহায্য করতে চেয়েছে জনি, কিন্তু এক কথায় তা প্রত্যাখ্যান করেছে টম হেগেন।

নিজের ছবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জনি। বেস্টসেলারের লেখক তার নতুন উপন্যাস শেষ করেছেন, জনির আহ্বানে চলে এসেছেন পশ্চিমে। আসার কারণ, এজেন্ট বা স্টুডিওগুলো যাতে বাগড়া দিতে না পারে, নিরিবিলিতে বসে দুজন কথা বলতে চায় ওরা। ঠিক যে ধরনের চাইছে জনি, এই বইটা ঠিক সেই ধরনের। একটা গানও গাইতে হবে না তাকে। সাহস, শক্তি আর পৌরুষ নিয়ে ধুমধাড়াক্কা মার্কা ছবির গল্প, রুক্ষ মেজাজের, কাহিনীর প্রয়োজনে প্রচুর মেয়েমানুষ আর দেদার যৌনতা আমদানি করার অবকাশ আছে। শুধু তাই নয়, গল্পটায় এমন একটা চরিত্র আছে যেটা ঠিক যেন হুবহু নিনোর জন্যেই তৈরিচরিত্রটার কথাবার্তা, আচরণ, কাজকর্ম, এমন কি চেহারা-সুরত পর্যন্ত নিনোর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা ভূতুড়ে। অভিনয়ই করতে হবে না নিনোকে, ক্যামেরার সামনে শুধু ওর নিজের মত করে চলাফেরা করতে হবে।

হাতের কাজ দ্রুত সারছে জনি। কাজে নেমে আবিষ্কার করল, প্রযোজনা সম্পর্কে তার নিজের যেটুকু ধারণা আছে বলে ভাবত সে তার চেয়ে অনেক বেশি জানে সে। তবু একজন নির্বাহী প্রযোজককে চাকরি দিল। লোকটা ব্ল্যাকলিস্টে আছে, তাই কোথাও চাকরি পাচ্ছিল না, কিন্তু এ-কাজে অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে তার। তার এই দুর্বলতার কোন সুযোগ নিল না জনি, ন্যায্য বেতনই দিচ্ছে তাকে। পরিষ্কার বলেও দিয়েছে, তোমাকে আমি ঠকাচ্ছি না, তাই আশা করছি অনেক কাজে খরচ বাঁচিয়ে-দেবে তুমি আমার।

সেই প্রযোজকই একদিন এসে জনিকে বলল, ইউনিয়নের প্রতিনিধিকে ঘুষ দিতে হবে, পঞ্চাশ হাজার ডলার দাও। আশ্চর্য হয়ে গেল জনি। খরচ কমানো দূরের কথা, এ-লোক তো খরচ বাড়ার পায়তারা করছে। লোকটা ওকে জানান, ওভার-টাইম, কর্মী নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে নাকি নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে, টাকাটা দিলে অনেক উটকো মেলা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না জনি, তার সন্দেহ হলো প্রযোজক ধোকা দিয়ে টাকাটা খসাতে চাইছে ওর কাছ থেকে। তাকে বলল ও, তুমি বরং ইউনিয়নের লোকটাকে পাঠিয়ে দাও আমার কাছে।

ইউনিয়ন প্রতিনিধির নাম বিলি গফ। জনির সাথে এসে দেখা করতে দেরি করল না সে।

আমি যতদূর জানি, তাকে বলল জনি, ইউনিয়ন যাতে কোন ঝামেলা বাধাতে না পারে তার ব্যবস্থা করে রেখেছে আমার বন্ধুরা। আমাকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না। সব ঠিক থাকবে।

কে জানিয়েছে কথাটা? প্রশ্ন করুল গফ।

কে জানিয়েছে তা তুমি ভাল করেই জানো, বলল জনি। তার নাম উচ্চারণ করার দরকার নেই, কিন্তু তিনি যা বলেন তাই হয়; তাঁর কথা কখনও অনাথা হয় না।

কিন্তু আগের অবস্থা আর-নেই, সব ওলটপালট হয়ে গেছে, বলল গফ। তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী নিজেই বিপদে পড়েছে, এই দূর পশ্চিমে তার কথা আর খাটবে না।

শ্রাগ করল জনি, বলল, ঠিক আছে, তুমি দুদিন পর দেখা করো আমার সাথে, কেমন?

নিঃশব্দে হাসল গফ। অবশ্যই দেখা করব, জনি, বলল সে। তবে, যদি মনে করে থাকো নিউ ইয়র্কের সাথে যোগাযোগ করে সুবিধে করতে পারবে, মস্ত ভুল করবে তুমি!

কিন্তু নিউ ইয়র্কের সাথে যোগাযোগ করে ভুল করেনি জনি, বরং মস্ত সুবিধে হয়ে গেল তার। হেগেনের সাথে তার অফিসের ফোনে কথা হলো। স্পষ্ট জানিয়ে দিল হেগেন, খবরদার, কোনমতেই টাকা দেবে না ওকে। সব শেষে বলল, বেজন্মাটাকে টাকা দিলে তোমার গড ফাদার ভীষণ রাগ করবেন। টাকা দিলে তার অসম্মান করা হবে, আর এই মুহূর্তে সম্মান হারালে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে তাঁর।

আমি কি গড ফাদারের সাথে কথা বলতে পারি? জানতে চাইল জনি। নাকি তুমিই আলাপ করবে? আসলে ছবির কাজ শুরু করতে আমি আর দেরি করতে চাইছি না।

অসম্ভব। আপাতত তাঁর সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। এখনও গুরুতর অসুস্থ তিনি। একটু চিন্তা করে আবার বলল হেগেন, ঝামেলাটা কিভাবে চুকিয়ে দেয়া যায় সে ব্যাপারে আমি সনির সাথে কথা বলব। টাকা দিতে নিষেধ করার সিদ্ধান্তটা আমি নিজেই নিচ্ছি। হারামজাদা চালবাজি শিখেছে। আমার সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হলে তুমি জানতে পারবে।

ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল জনি, বিরক্তি আর দুশ্চিন্তায় মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ওর। ইউনিয়নের সাথে ঝগড়া করতে যাওয়া মানে গোছা গোছা টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়, কাজকর্ম সব পণ্ড হয়ে যাবে। চিন্তা করে দেখল গোপনে টাকাটা গফকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? ডন তো আর নিজের মুখে তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন না। গুরুত্বের বিচারেডন আর হেগেনের কথার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তবু, অনেক ভেবেচিন্তে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে দেখবে বলে স্থির করল জনি।

অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় নগদ পঞ্চাশ হাজার ডলার বেঁচে গেল ওর। হেগেনের সাথে কথা বলার দুই রাত পর গ্লেনডেলে নিজের বাড়িতে বুলেট বিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া গেল বিলি গফের। এরপর আর ইউনিয়নের সাথে কোনরকম। গোলমালের কথা শোনা যায়নি। তবে, খুনটার ব্যাপারে বেশ একটু বিচলিত হয়ে পড়ল জনি। ডনের দীর্ঘ বাহু এই প্রথম জনির এত কাছাকাছি এমন নির্দয় ভাবে আঘাত হানল।

সময়ের সাথে সাথে কাজে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে জনি। চিত্রনাট্য তৈরি করা, এক একটা চরিত্রের জন্যে পছন্দসই নারী-পুরুষ বাছাই করা, এই রকম প্রযোজনার হাজারটা দিক সামলানো, দম ফেলার ফুরসত নেই ওর। এই ব্যস্ততার মধ্যে কখন যে নিজের গলার কথা, গান গাইতে না পারার কথা ভুলে গেছে তা ও নিজেই জানে না। এর মধ্যে একাডেমি পুরস্কারের প্রতিযোগীদের নামের তালিকা বেরিয়ে গেল, তাতে নিজের নামও দেখল জনি, কিন্তু অস্কার পাবার জন্যে যেসব গান বিবেচনা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেগুলোর একটাও ওকে অনুষ্ঠানে গাইতে বলা হয়নি দেখে মনটা সাংঘাতিক দমে গেল ওর। অথচ টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা দেশে দেখানো হবে অনুষ্ঠানটা। তবু মন থেকে এসব উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে। আবার কাজে ডুবে গেল জনি। বুঝল, ওর গড ফাদার তার প্রভাব খাটাতে পারবেন। না, সুতরাং একাডেমি পুরস্কার পাবার আশা করে লাভ নেই। তবে তালিকাতে যে। ওর নাম আছে তারও একটা মূল্য আছে, এই ভেবে, কিছুটা সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করল ও।

ইতালীয় গানের যে রেকর্ডটা করেছে নিনোর সাথে, সেটা ইদানীংকার করা ওর সবগুলো রেকর্ডের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আর কেউ না জানুক, ও খুব ভাল করেই জানে যে এর বেশিরভাগ কৃতিত্ব নিনোর। পেশাদার গায়ক হিসেবে ওর আর কোন সম্ভাবনা নেই, মনে মনে এটা মেনে নিয়েছে সে।

হপ্তায় একটা দিন জিনি আর মেয়েদের সাথে বসে ডিনার খায় জনি। কাজের চাপ যতই থাক, এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না কখনও। তবে জিনির সাথে শোয় না। এর মধ্যে মেক্সিকোতে গিয়ে একটা ডিভোর্স আদায় করে নিয়েছে ওর দ্বিতীয় স্ত্রী, তার মানে জনি এখন ঝাড়া হাত-পা। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও হবু তারকাদের সাথে প্রেম করার জন্য লালায়িত হয়ে উঠছে না ও। তার একটা কারণ, চিরকালই একটু উন্নাসিক টাইপের মানুষ ও। তবে, মনে পুষে রাখা একটা দুঃখও আছে ওরকমবয়েসী তারকারা, আর এখনও চূড়ায় অবস্থানরতা নায়িকারা ওর প্রেমে জড়িয়ে পড়ে না। প্রায় রোজ রাতেই বাড়ি ফিরে আসে একা, রেকর্ড প্লেয়ারে নিজের একটা পুরানো রেকর্ড চাপায়, হাতে থাকে গ্লাসভর্তি হুইস্কি, গানের সাথে গলা মিলিয়ে গুন গুন করে। নিজের গান শুনে বুঝতে পারে, ভাল, সত্যি খুব ভাল গাইত ও। এত ভাল গায় তা তখন বোঝেনি। ওর নিজের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কণ্ঠস্বরের কথা বাদ দিলেও- ভাল গলা তো অনেকেরই থাকতে পারে-সত্যি আশ্চর্য ভাল গাইত ও। যাকে বলে সত্যিকার একজন খাঁটি শিল্পী, ও ছিল তাই। অথচ ওর নিজেরই জানা ছিল না কথাটা। গান গাইতে ভালবাসত ও। কতটা ভালবাসত তাও তখন বুঝত না। সিগারেট ফুকে, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করে, আর মদ গিলে নিজেই নিজের গুলার বারোটা বাজিয়েছে, ঠিক যখন সমস্ত ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল।

দুএক ঢোঁক মদ খাবার জন্যে মাঝেমধ্যে ওর কাছে আসে নিনো, পুরানো গানগুলো মন দিয়ে শোনে সেও, আর জনি তাকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, শোন, ব্যাটা গেয়ো ভূত, অমন গান তুই তোর বাপের জন্যেও গাসনি।

আর নিনোও তার সেই অদ্ভুত মধুর রহস্যমাখা হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, নারে, গাইনি–গাইবও না কোন দিন। বলার ভঙ্গিতে থাকে সহানুভূতির সুর, জনি কি ভাবছে তা যেন বুঝতে পারছে সে।

অবশেষে নতুন ছবির শুটিং শুরু হবার হপ্তাখানেক আগে একাডেমি পুরস্কার বিতরণের রাত এসে গেল। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিনোকে নিমন্ত্রণ করল জনি। নিনো সোজা প্রত্যাখ্যান করল।

দোস্ত, তোর কাছ থেকে কখনও কোন উপকার চাইনি আমি, বলল জনি, সত্যি কিনা বল? আজ চাইছি, আমার একটা উপকার কর, আয় আমার সাথে। আমি পুরস্কারটা না পেলে, তুই ছাড়া আমার জন্য আর কেউ দুঃখ করার নেই রে!

মুহূর্তের জন্যে চমকে উঠল নিনো। চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, স্তম্ভিত হয়ে গেছে সে। তারপর বলল, একশোবার, নিশ্চয়ই যাব-কথা দিলাম, দোস্ত। একটু থেমে আবার বলল, পুরস্কারটা পেলে ভাল, না পেলে ভুলে যাস। স্রেফ যত পারিস মদ গিলে মাতাল হয়ে পড়িস, পাশে থেকে তোর দেখাশোনা করব আমি। কথা দিচ্ছি, আজ রাতে একফোঁটা মদও ছোঁব না আমি। এবার বল, কেমন বন্ধু আমি।

দোস্ত, জনি ফন্টেন বলল, তুই আমাকে ভালবাসিস।

দিনের শেষে রাত এল, নিনোও তার কথা রাখল। সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ অবস্থায় জনির বাড়িতে এল সে, তাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল জনি থিয়েটারের দিকে, যেখানে পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানটা হবে। ডিনারে জনি ওর বান্ধবী বা প্রাক্তন স্ত্রীদের কাউকে নিমন্ত্রণ করেনি কেন? প্রশ্নটা নিয়ে খানিক মাথা ঘামাল নিনো, কিন্তু কোন সদুত্তর পেল না। বিশেষ করে জিনি, তাকে নিমন্ত্রণ না করার কি কারণ থাকতে পারে? জিনি ওকে উৎসাহ দেবে, সাহস যোগাবে, প্রয়োজনে সান্তনা দেবে–এসব কি একবারও ভেবে দেখেনি জনি? বেশি না, শুধু এক গ্লাস মদ টানতে পারলে ভাল হত, ভাবছে নিনো, দেখেশুনে মনে হচ্ছে সামনে লম্বা আর বাজে একটা রাত পড়ে রয়েছে।

একাডেমি পুরস্কার বিতরণের গোটা ব্যাপারটাই একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগছে নিনোর, কিন্তু শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভিনেতার নাম ঘোষণার পর অন্য রকম হয়ে গেল তার মূর্তি। কানে যখন জনি ফন্টেন নামটা ঢুকল, সব কিছু ভুলে হুবহু ক্যাঙ্গারুর মত শূন্যে লাফ দিতে শুরু করে দিল সে, আর সেই সাথে জনির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল জনি, সেটা ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল নিনো। সে বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে জনির এমন একজনের মানবিক স্পর্শ চাই যার উপর ওর সম্পূর্ণ আস্থা আর বিশ্বাস আছে, সেই সাথে নিন্মের মনটা বিশাল একটা দুখে কাতর হয়ে উঠল এই ভেবে যে এমন একটা পরম গৌরবের মুহূর্তে জনি তারপয়ে ভাল আর কাউকে পেল না।

এরপর যা ঘটতে শুরু করল, রীতিমত দুঃস্বপ্ন বলে মনে হলো নিনোর। সুব প্রথম পুরস্কারগুলো বাগিয়ে নিয়েছে জ্যাক ওলটসের ছবি, ভাই স্টুডিওর পার্টিতে যত সাংবাদিক আর মতলববাজ নারী-পুরুষের দল ভিড় করে এল। মদ ছোবে না বলে কথা দিয়েছে জনিকে, সে-কথা রক্ষা করছে নিনো। কথা দিয়েছে নজর রাখবে জনির উপর সে-কথা রাখার চেষ্টাও করছে সে। কিন্তু এতে তেমন সুবিধে করতে পারছে না। পার্টিতে উপস্থিত মেয়েমানুষগুলো পালা করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জনিকে একটা শোবার ঘরে, অজুহাত হিসেবে প্রত্যেকে বলছে, এসো, জনি, দুটো গল্প করি। নিনো বুঝতে পারছে, শোবার ঘরে ঢোকার পর জনির সাথে একটা কথা বলারও অবকাশ দিচ্ছে না মেয়েগুলো, একটা কথা বলা মানেই তো জনিকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করার সময় থেকে কয়েকটা সেকেণ্ড কমে যাওয়া। যতবার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে জনি, ওকে আগের বারের চেয়ে দুর্বল আর আরও বেশি মাতাল দেখাচ্ছে।

এই ভয়াবহ অবস্থায় জনি যে শুধু একা পড়েছে তা নয়, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছে যে মেয়েটা তারও সেই একই অবস্থা। তবে, তার প্রশংসা করতে হয় এই দেখে যে অবস্থাটা সে পুরোপুরি উপভোগ করছে, জনির মত নেতিয়ে পড়ছে না। উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে একা শুধু নিনোই তাকে প্রত্যাখ্যান করল, বাকি কেউ এই সুবর্ণ সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না।

শেষ দিকে কার যেন মাথায় একটা বৈপ্লবিক চিন্তা খেলে গেল। প্রস্তাব উঠল, দুই প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীকে প্রকাশ্যে যৌন সঙ্গম করতে হবে। বাকি যারা উপস্থিত আছে তারা সবাই দর্শকের ভূমিকা নেবে। কয়েকজন সুযোগসন্ধানী আর উৎসাহী পুরুষ মেয়েটার কাপড়চোপড় খুলে তাকে বিবস্ত্র করে ফেলল, অবশ্য মেয়েটা তাদেরকে যেচে পড়ে সাহায্য করল বলে পুরুষদের দল কাজটায় তেমন আশাপ্রদ মজা পেল না, এসব ব্যাপারে বাধা পেলে মজাটা জমে ভাল। ওদিকে উৎসাহী কয়েকটা মেয়ে এগিয়ে এসেছে জনি ফন্টেনের পোশাক খোলার জন্যে। ঝটপট সেরেও ফেলল তারা কাজটা, চারদিক থেকে হাস্যরোল আর জয়ধ্বনির হিড়িক পড়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, উপস্থিতদের মধ্যে একমাত্র প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি নিনো ভ্যালেন্টি, ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। উলঙ্গ জনিকে মেয়েগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করে, তাকে নিজের মস্ত কাঁধে তুলে নিল। তারপর সবার প্রতিবাদ আর বাধার সাথে লড়তে লড়তে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে এসে উঠে পড়ল।

গাড়ি চালিয়ে জনিকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিনো। ভাবছে, একে যদি সাফল্য বলে, তা দিয়ে ওর দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *