২.৬ বিশাল রেকর্ডিং স্টুডিওতে বসে

০৬.

বিশাল রেকর্ডিং স্টুডিওতে বসে একটা হলুদ প্যাডে খরচের হিসাব কষছে জনি ফন্টেন। সার বেধে ভিতরে ঢুকছে মিউজিসিয়ানরা, সেই অল্প বয়সে জনি যখন ব্যাণ্ড পাটির সাথে ঘুরে ঘুরে গান গাইত তখন থেকেই এদেরকে চেনে ও। পপ গানের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন আজকের সঙ্গীত পরিচালক, জনির জীবন যখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে বসেছিল তখন এই লোকটার কাছ থেকে সহানুভূতি পেয়েছিল সে। সব মিউজিসিয়ানকে একতাড়া করে স্বরলিপির কাগজ দিচ্ছে লোকটা। নার্ম এডি নীলস। হাতে এত কাজ তার যে দম ফেলার ফুরসত পর্যন্ত নেই, তবু জনির প্রতি বিশেষ খাতির দেখিয়ে এই রেকর্ডটা করে দেবার দায়িত্ব নিয়েছে সে।

একটা পিয়ানোর সামনে বসে আছে নিনো ভ্যালেন্টি। ভয়ে ভয়ে, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পিয়ানোর কী-গুলোর গায়ে আঙুল চালিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলছে। সেই সাথে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছে হুইস্কি ভরা গ্লাসে। এতে অবশ্য উদ্বেগ বোধ করছে না জনি, সে জানে, মাতাল হোক বা না হোক ওর সমান ভাল গাইবে নিনো, তাছাড়া আজকের এই কাজে নিনো খুব বেশি দক্ষতা না দেখালেও কিছু এসে যাবে না।

পুরানো কিছু ইতালীয় আর সিসিলীয় গানের ব্যবস্থা করেছে এডি নীলস। এগুলোর সাথে সেই যে কনি কর্লিয়নির বিয়ের দিন দ্বন্দ্বযুদ্ধের দ্বৈত সংগীত গেয়েছিল নিনো আর জনি, সেটাও বিশেষভাবে রেকর্ড করা হবে আজ। জনির এই রেকর্ড করার পিছনে একটা মাত্র কারণ কাজ করছে, এসব গান বড় বেশি ভালবাসেন জনির গড় ফাদার, এই রেকর্ডটা বড়দিনের তোফা একটা উপহার হবে। তাছাড়া, এখন কেন যেন মনে হচ্ছে ওর, রেকর্ডটা বিক্রিও হবে খুব। তবে লাখ দশেক হবে বলে আশা করা যায় না। জনি ভাবছে, ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে ডন তার কাছ থেকে কি প্রতিদান চাইতে পারেন তা সে বেশি দেরি না করেই আঁচ করে নিতে পেরেছে। ব্যাপারটা জানার পর তার উপর খুশি হবেন ডন, কারণ নিনোও তো তার ধর্মপুত্র।

হলুদ প্যাড আর ক্লিপবোর্ড পাশের চেয়ারে রেখে উঠে দাঁড়াল জনি, এগিয়ে এল পিয়ানোর দিকে। ওহে দেশী! নিলোকে সম্বোধন করল ও। মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করছে নিনো, একটু অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। সামনের দিকে বুকে তার শোল্ডার ব্লেডে হাত ঘষে দিল জনি। ঘাবড়াবার কিছু নেই, ঢিল দে, পেশীতে। বলল ও। আজ যদি ভাল গাইতে পারিস, হলিউডের সবচেয়ে সেরা আর বিখ্যাত নিতম্বিনী জোগাড় করে দেব তোকে।

দ্রুত এক ঢোক হুইস্কি গিলে নিয়ে জানতে চাইল নিনো, কে সে, ল্যাসি নাকি?

হেসে উঠল জনি, বলল, না। আমি ডীন ডান-এর কথা বলছি। কড়া মাল, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল নিনের মুখ, তবু সেই চেহারায় একটা কৃত্রিম হতাশার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, কেন, ল্যাসিকে জুটিয়ে দিতে পারিস না?

মিশ্র সংগীতের প্রথম গানের সুর বেজে উঠল অর্কেস্ট্রাতে, গভীর ধ্যানমগ্নতার সাথে শুনছে জনি। সবগুলো গানের বৈশিষ্ট্যের দিকে বিশেষ নজর রেখে একবার করে বাজিয়ে নেবে এডি নীলস। তারপর রেকর্ডের জন্যে প্রথম টেক হবে। মন দিয়ে শুনে রপ্ত করে নিচ্ছে জনি কিভাবে গাইবে প্রতিটি পদ, কিভাবে শুরু করবে প্রতিটি গান। জানা আছে বেশিক্ষণ টিকবে না ওর নিজের গলা, বেশি সময় ধরে নিনোই গাইবে, তার সাথে ও শুধু তাল মিলিয়ে যাবে। অবশ্য সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের দ্বৈত সংগীতটা ছাড়া, ওটার জন্যে সাবধানে জিইয়ে রাখতে হবে গলাটাকে।

নিনোকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল জনি, দুজন এগিয়ে গিয়ে যে যার মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল। শুরুতেই ভুল করে বসল নিনো, তারপর আবার সেই একই ভুল করল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ তাকে অভয় দেবার জন্যে ঠাট্টা শুরু করে দিল জনি, কিরে, মতলবটা কি? ওভারটাই বাগাতে চাস বুঝি?

ম্যাণ্ডোলিনটা হাতে নেই বলে ঠিক সুবিধে লাগছে না।

একটু চিন্তা করে বলল জনি, মদের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মনে কর ওটাই তোর ম্যাণ্ডোলিন।.

তাই করল নিনো, আর সম্ভবত তাতেই কাজ হলো। গাওয়ার সময় মাঝে মধ্যেই গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে বটে সে, কিন্তু দারুণ, খানা গাইছে। সহজ সুরে গাইছে জনিও, ইচ্ছা করেই গলায় তেমন জোর আনছে না, তা সত্ত্বেও নিজের গলার ঝালানো, শান দেয়া পেশাদারী নিপুণতা দেখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে। দশ বছরের গানের চর্চা কিছু তাহলে শিখিয়েছে তাকে।

ওদের সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের দ্বৈত সংগীতটা রেকর্ডের শেষ গান, এবার গলা ছেড়ে গাইল জনি। রেকর্ড শেষ হতে গলায় ব্যথা অনুভব করছে ও। গানটার শেষে মিউজিসিয়ানরাও সাংঘাতিক অনুপ্রাণিত হয়ে উঠল। ঝানু মিউজিসিয়ান ওরা, গান যত ভালই হোক না কেন ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠা স্বভাব নয় ওদের, কিন্তু ঘটল ঠিক তাই। যন্ত্রগুলো কষে পিটিয়ে, তালে তালে পা ঠুকে অভিনন্দন জানাচ্ছে ওরা। ড্রামাররাও মনের সুখে খুব একচোট ভাম পেটাল।

থামতে হচ্ছে প্রায়ই, আলোচনা করে নিতে হচ্ছে। একটানা প্রায় চার ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর সেদিনের মত কাজ বন্ধ করল ওরা। জনির কাছে এসে ফিসফিস করে এডি নীলস বলল, জনি, গলাটা তো আশ্চর্য ভাল শোনাল! তোমার গলা বোধহয় তৈরি হয়ে গেছে একটা রেকর্ড করার জন্যে। নতুন একটা গান আছে আমার হাতে, ঠিক যেন তোমার জন্যে তৈরি।

এদিক ওদিক মাথা দোলাল জনি, বলল, হয়েছে, এডি, আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না। দু ঘন্টা পর আমার গলার অবস্থা এমন হবে যে শুধু কথা বললেই কর্কশ শোনাবে কানে.। ক্রোমার কি মনে হয়, আজকের মত এই রকম আরও খাটতে হবে নাকি আমাদেরকে?

কাল একবার স্টুডিওতে আসতে হবে নিনোকে, চিন্তিত ভাবে বলল এড়ি। কিছু কিছু ভুল হয়েছে ওর। তবে যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে দেখছি অনেক ভাল করেছে ও। কিছু যদি পছন্দ না হয় আমার, সাউণ্ড ট্রেকনিশিয়ানদেরকে দিয়ে শুধরে নেব আমি, কেমন?

ঠিক আছে, বলল জনি। প্রেসিংটা শুনতে পাব কবে?

কাল রাতে; বলল এডি! তোমার বাড়িতে?

ঠিক আছে, বলল জনি। অসংখ্য ধন্যবাদ, এড়ি। নিনোর হাত ধরে স্টুডিও থেকে বাইরে বেরিয়ে এল ও। জিনির বাড়িতে নয়, নিজের বাড়িতে এল জনি।

শেষ বিকেলে পৌঁছে গেছে বেলা। নেশা এখনও পুরো কাটেনি নিনোর। শাওয়ার সেরে তাকে ঘুমিয়ে নেবার প্রামর্শ দিল জনি। রাত এগারোটায় বড় একটা পার্টিতে যেতে হবে ওদেরকে।

 ঘুম থেকে ওঠার পর নিনোকে নিয়ে বসল জনি। সংক্ষেপে একটু ধারণা পাইয়ে দিল তাকে আজ রাতের পার্টি সম্পর্কে।

বলল, চিত্রতারকাদের একটা ক্লাব আছে, নাম লোনলি হার্টস। পার্টিটা হচ্ছে এই ক্লাবের তরফ থেকে। ওখানে আজ তুই যে-সব মেয়েদেরকে দেখতে পাবি, এর আগে তাদেরকে তুই সিনেমার পর্দায় ধরাছোঁয়ার বাইরে মোহিনী মায়াবিনী হিসেবে দেখেছিস। লক্ষ-কোটি লোক এদের সাথে যদি প্রেম করার একটা মাত্র সুযোগ পায়, প্রত্যেকে তাদের একটা করে হাত কেটে দিতে রাজি হবে। এইসব মেয়েমানুষরা আজকের এই পার্টিতে কেন আসবে, আন্দাজ করতে পারিস? মুচকি একটু হেসে নিজেই জবাব দিল জনি, এদের প্রত্যেকের একটা করে পুরুষ দরকার, খুব দরকার। কেন বল তো? কারণ শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ তাগড়া যোয়ান পুরুষের অভাব বোধ করে এরা, অথচ এই সব পুরুষদের আলিঙ্গন আর আদর সোহাগ, ভালবাসা আর প্রেম ছাড়া এদের চলে কিভাবে, বয়স না হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে। আসল কথা ওটাই, বয়স একটু বেশি হয়ে গেছে। তাই বলে খুব বেশি হয়নি, হলিউডের অর্থাৎ দুনিয়ার সেরা সুন্দরী বলতে এখনও এদেরকেই বোঝায়, সে-কথা ভুলিস না। অবশ্য সামনে থেকে দেখলেই তা বুঝতে পারবি। আর একটা ব্যাপার। সদ্য বেড়ে ওঠা যুবতীদের মত এধাও আদর সোহাগ জিনিসটা অভিজাত শ্রেণীর কাছ থেকে অভিজাত ভঙ্গিতে পেত আশা করে।

তোর গলায় কি হয়েছে.রে, জনি? জানতে চাইল নিনো।

গলা একেবারে নামিয়ে বলল জনি, একটু গাইলেই গুলার শক্তি ফুরিয়ে যায়। এই যে আজ গাইলাম, এরপর আর একমাস গাইতে পারব না। তবে, গলা-ভাঙাটা দুএকদিনের মধ্যে সেরে যায়।

চিন্তার কথা, তাই না? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল নিনো।

শ্রাগ করল জনি। বলল, শোন, নিনো, একটা কথা বলে রাখি তোকে। খবরদার, আজ রাতে ভুলেও তুই খুব বেশি মাতাল হয়ে পড়বি না। হলিউডের এই রক্তচোষা রাক্ষসীগুলোকে দেখিয়ে দিতে হবে যে আমার এই গেঁয়ো বন্ধুটি নতুন আমদানি হতে পারে, কিন্তু সে আহাম্মক নয়, আসরটাকে মাতিয়ে রাখতে হবে তোকেই, বুঝলি? শোন, এই মেয়েমানুষগুলোর প্রতিপত্তি তুই কল্পনাও করতে পারবি না, এরা রাতকে দিন করতে পারে, দিনকে রাত। ইচ্ছা করলেই ভাল ভাল কাজ জুটিয়ে দিতে পারে তোকে। নিজের যদি সুবিধে হয়, একটু না হয় মিষ্টি ব্যবহার করলি ওদের সাথে, ক্ষতি কি।

গ্লাসে আবার মদ ঢালছে নিনো, বলল, টক বা ঝাল আমার ব্যবহারে কখনও দেখেছিস? এক চুমুকে গ্লাসটা নিঃশেষ করে নিঃশব্দে হাসল সে, বলল, এসব বাজে কথা বাদদ, আসল কথা বল, ডীনা ডানের কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারবি

নিরাশ হবার কোন কারণই নেই তোর, বলল জনি! তুই যা ভাবছিস ব্যাপারটা সেরকম নয়।

.

লোনলি হার্টস, নামটা হলিউডের কম বয়েসী নায়কদের দেয়া। তাদের উপস্থিতি এখানে বাধ্যতামূলক।

ক্লাবের সভ্যরা প্রতি শুক্রবার দিন জড়ো হয় ওলটস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রেস এজেন্ট রক ম্যাক এরয়ের প্রাসাদোপম বাড়িতে। এই লোকটাকে জন-সংযোগ উপদেষ্টাও.বলা হয়ে থাকে। বাড়িটার মালিক আসলে জ্যাক ওলটস। এই পার্টির ধারণাটাও প্রথম তার মাথায় আসে! যে-সব তারকাদের জন্যে ওর স্টুডিও আজও কোটি কোটি ডলার রোজগার করছে, তাদের কারও কারও বয়স একটু বেশি হয়ে গেছে। আলোর কেরামতি আর মেকআপম্যানদের যাদু সাহায্য না করলে এদের যে সত্যি বয়স হয়েছে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। সেজন্যে ব্যাপারটা একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার একটা শাখাও গজিয়েছে, বয়স বেশি হয়ে গেলে যা হয়-এই সব নায়িকাদের শারীরিক সজীবতা আর মানসিক ঘূর্তিও লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। যাকে বলে প্রেমে পড়া। সেটা তাদের আর হয়ে উঠছে মা। অথচ আর তো কিছুর অভাব নেই, টাকা আছে অঢেল, খ্যাতি আছে। প্রচুর, নিজেদেরকে দুনিয়ার সেরা সুন্দরী বলে ভাবার অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে, সুতরাং বয়স বাড়লে কি হবে, দেমাকে এখনও মাটিতে পা পড়ে না ওদের কারও। পার্টিগুলোর ব্যবস্থা করার পিছনে ওলটসের একমাত্র কারণ, এইসব সুন্দরী মেয়েগুলো যাতে তাদের প্রেমিক খুঁজে নেবার সুযোগ পায়। প্রথমে এক রাতের শষ্যাসঙ্গিনী হবে, তারপর এতে যদি পূরুষটাকে মজাতে পারে, ঠিকমত যদি ফেলতে পারে ফাঁদে, অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিছানার সঙ্গী থেকে শুরু করে ক্রমশ ধাপে ধাপে উঠে যাওয়ার পথ করে নেয়া। পার্টিগুলোর মান অনেক সময় নামতে নামতে এমন যৌন বিকৃতি এবং মারপিটের পর্যায়ে দাঁড়ায়, পুলিশী ঝামেলা পর্যন্ত বেধে যায়। এসব দেখে ওলটস সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্টিগুলো অনুষ্ঠিত হবে জন-সংযোগ উপদেষ্টার বাড়িতে, তাতে যে-কোন হাঙ্গামা হলে মিটিয়ে দিতে পারবে সে। সাংবাদিক আর পুলিশদেরকে টাকা-পয়সা যা দেবার দিয়ে আয়ত্তে আনকে পরিস্থিতি, যাতে গোলমাল খুব বেশি দূর গড়াতে না পারে।

স্টুডিওর বেতনভুক যুবক অভিনেতারা যারা এখনও তারকার পর্যায়ে উন্নীত হয়নি তাদের কারও কারও কাছে শুক্রবারের এই পার্টিতে উপস্থিতিটা তেমন লোভনীয় বলে মনে হয় না। অধিকাংশ সময় তাদের কাছে পার্টির আসল উদ্দেশ্য গোপন করে যাওয়া হয়, তাদের জানানো হয় অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র অচিরে মুক্তি পেতে যাচ্ছে এমন একটা ছবি দেখানো হবে, পার্টিটা সেই উপলক্ষেই। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়। অবাঞ্ছিতদের এড়িয়ে যাওয়া যায়, আবার অনুষ্ঠানগুলোর গায়ে পেশাদারী রঙও চড়ানো হয়।

পার্টিতে অল্পবয়েসী, অপেক্ষাকৃত ছোট তারকাদের প্রবেশাধিকার নেই, অন্তত কৌশলে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। আভাসে ইঙ্গিতে নিষেধ করা হলেও, প্রায় সবাই সেটার অর্থ বুঝতে পারে।

ছবি দেখানো হয় গভীর রাতে। এগারোটায় পৌঁছুল ওরা, জনি আর নিনো। দামী পোশাক পরে ফিটফাট বাবু সেজে আছে রক ম্যাক এলরয়, প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে যায়। জনিকে দেখে অবাক তো হলোই, আন্তরিক আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, আমি কি ভুল দেখছি? এখানে কি করছ তুমি?

তার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল জনি, নিনো, আমার দেশী বন্ধু, আচ্ছাগুলো দেখাবার জন্যে সাথে নিয়ে বেরিয়েছি।

নিনোর সাথে হ্যান্ডশেক করল ম্যাক এলরয়, তারপর খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে মন্তব্য করল, একে ওরা জ্যান্ত, কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ওদেরকে পথ দেখিয়ে বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছে দিল সে।

পিছনের চাতালে পাশাপাশি কয়েকটা বড় আকারের কামরা, প্রত্যেকটি কামরার প্রকাণ্ড কাঁচের দরজার সামনে একটা করে বাগান আর স্বচ্ছ পানিতে টইটুম্বুর পুকুর। চাতালে প্রায় শখানেক লোক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, তাদের সবার হারে মদের গ্লাস। পুরো এলাকাটা এমন কৌশলে আলোকিত করে রাখা হয়েছে যাতে মেয়েদের মুখ আর গায়ের চামড়া আরও সুন্দর লাগে দেখতে। কিশোর বয়সে অন্ধকার সিনেমা হলের সাদা পর্দায় রঙিন ছবিগুলোতে এইসব মেয়েদেরকেই দেখেছে নিনো। সেই বয়সে রোমান্টিক স্বপ্ন দেখত সে, সে-সব স্বপ্নের মধ্যে এরাই ছিল ওর প্রেমিকা। কিন্তু এখন এদের মোটাসোটা আর ল চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওর, মেকআপ ব্যবহার করে সং সেজে আছে সবাই। ওদের শরীর আর মনে প্রচণ্ড ক্লান্তি জমেছে, তা কোনভাবেই লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সময়ের সাথে সাথে ওদের মোহিনী রূপে ভাটা পড়েছে, তা আর কোন দিন ফিরে পাবার নয়। হাঁটার ধরন, কথা বলার কায়দা, তাকাবার ভঙ্গি সব কিছুর মধ্যে সেই আগেকার স্মৃতি ফিরে আসে ঠিক, কিন্তু আগের সেই প্রাণ চাঞ্চল্য নেই, মোমের পুতুলের মত লাগছে, নিস্তেজতাকিয়ে থাকলেও পুরুষের শরীর কামনায় কাতর হয়ে ওঠে না। একটা গ্লাসে হুইস্কি ভরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিনো, শেষ পর্যন্ত গিয়ে থামল যেখানে একগাদা মদের বোতল্প সাজানো রয়েছে। ছায়ার মত ওর সাথে লেগে রয়েছে জনিও। ওখানে দাঁড়িয়ে মদ গিলছে দুজন, হঠাৎ এক সময় ঠিক ওদের পিছন থেকেই শোনা গেল মিষ্টি সুরের ঝংকারের মত একটা কণ্ঠস্বর। অতি পরিচিত, আশ্চর্য মধুর গলা, চিনতে ভুল হলো না ও। কথা বলছে ডীনা ডান।

লক্ষ কোটি পুরুষের মত নিনোর কানেও এই সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর চিরকালের জন্যে লেগে আছে। দুবার একাডেমি পুরস্কার পেয়েছে ডীনা ডান। ভীনা ডান.যে ছবিতে থাকে, বলে দেয়া যায় রে ছবি সবচেয়ে বেশি টাকা কামারে। ওর অভিনীত একটা ছবি এত বেশি টাকা রোজগার করেছে যে সেই রেকর্ড এখন পর্যন্ত আর কোন ছবি ভাঙতে পারেনি। সিনেমার পর্দায় ওর মধ্যে এমন একটা কোমল, মৌন, পরিচ্ছন্ন বিড়ালসুলভ নারীত্বের লাবণ্য ফুটে ওঠে যা দেখে কোন পুরুষ-এর পক্ষে অবিচলিত থাকা সম্ভব নয়। সব পুরুষের গোপন মানসপ্রিয়া ও, নিনোও ওকে স্বপ্নের মধ্যে একান্ত আপন করে পেয়ে ধন্য মনে করেছে নিজেকে। কিন্তু কিংবদন্তীর সেই রূপসীর মুখে যে কথা বেরুল তা শোনার জন্যে তৈরি ছিল না নিনো।

অ্যাই শালা,হারামজাদা জনি, বলল ডীনা ডান, তোমার জন্যে আবার আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয়েছিল-কারণ, আমাকে নিয়ে মাত্র একটা রাত খেলা করে শরীরটাকে শুধু গরম করেই তুললে, দ্বিতীয় বারের জন্যে আবার ফিরে এলে না কি মনে করে?

মুখটা বাড়িয়ে দিল ডীনা ডান, তাতে চুমো খেলো জনি। বলল, ওই এক রাতেই যে একমাসের জন্যে ছিবড়ে করে ফেলেছিলে তুমি আমাকে এসো, এবার তোমাকে আমার খালাত ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইতালির লড়িয়ে ষড় একটা, হয়তো তোমার সাথে তাল বজায় রেখে সমান টেক্কা দিতে পারবে।

ঘাড় ফিরিয়ে নিনোর দিকে তাকাল ডীনা, চোখেমুখে তেমন উৎসাহ ফুটল না তার। ছবির আগাম দেখার উৎসাহ কি খুব বেশি ওর? প্রশ্নটার তাৎপর্য এখনই বোঝার কথা নয় নিনোর, কিন্তু উনা কি বলতে চাইছে জনি তা পরিষ্কার বুঝতে পারল।

নিঃশব্দে হাসল জনি। বলল, এর আগে কখনও সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয়। তোমাকে দিয়েই হাতে খড়িটা হয়ে যাক না ওর?

ডীনা নিঃশব্দে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে এল নির্জন একটা জায়গায়, ভীতি আর, উত্তেজনা কমাবার জন্যে বড় একটা গ্লাস ভর্তি হইস্কি ঢক টক করে গিলে নিতে হলো নিনোকে। নির্বিকার থাকার শত চেষ্টা করলেও কাজটা খুব কঠিন। অ্যাংলো স্যাক্সন ধাচের সৌন্দর্যের প্রতীক বলা যায় ডীনা ডানকে, নাকের ডগাটা চোখা, চেহারাটা তীক্ষ্ণ। কোথাও এতটুকু খুঁত নেই। এই চেহারা, এই মায়াময় সৌন্দর্য নিনো ভ্যালেন্টির অতি পরিচিত। নির্জুন শোবার ঘরে একা দেখেছে ওকে সে, ভগ্ন হৃদয়ে কাঁদছে, একগাদা ছেলেপিলে রেখে মারা গেছে পাইলট স্বামী। আরেকবার ওকে মানসিক আঘাত পেতে দেখেছে, প্রচণ্ড রাগে অস্থির দেখাচ্ছিল, কারণ লম্পট ক্লার্ক গেবল ওর যৌবন লুটে নিয়ে আরেক মেয়েমানুষের লোভে ওকে শ্রাগ করে চলে যায়। কিন্তু চরম অপমানিত হলেও তখনও ওকে আশ্চর্য গাভীর্যমণ্ডিত গৌরবে উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল। (ডীনা ডান কখনও যৌনাবেদনময়ীর ভূমিকায় অভিনয় করে না।) ওকে সে সফলপ্রেমের দৃশ্যে মনের মানুষের আলিঙ্গনে পিষ্ট হতে দেখেছে, আর দেখেছে কমপক্ষে ছয়বার কি করুণ আর সুন্দর ভাবে মরে যেতে। ওকে দেখেছে; ওর সম্পর্কে কত চমকপ্রদ গল্প শুনেছে, তার স্বপ্নে নায়িকা ছিল ও, অথচ তাকে একা পেয়ে প্রথমে যে কথাটা বলল ডীনা তা শোনার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না নিনো।

মেয়েদের যৌন তৃপ্তি মেটাতে পারে এমন পুরুষ এ শহরে দুএকজনই আছে, বলল সে। তার মধ্যে,জনি ফন্টেন একজন বাকি সবাই মুরোদহীন, রুগ–ওদের মুখের ভেতর এক ট্রাক ভর্তি স্প্যানিশ মাছি পুরে দিলেও কোন মেয়েমানুষকে যৌন তৃপ্তি দিতে পারবে না ওরা। নিনোর একটা হাত ধরে লোক চলাচল আর প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে আনল তাকে ডীনা।

কোমল মাধুর্যের সাথে নিনোর বিষয়ে জানতে চাইছে চীনা। ওর ভূমিকাটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নিনোর। অভিজাত ধনী পরিবারের দুলালী কন্যা তার আস্তাবলের সহিস কিংবা গাড়ির ড্রাইভারের প্রতি নেহাত দয়া দেখিয়ে কুশলাদি নিচ্ছে; কিন্তু এই ছোকরা যদি ওর সাথে প্রেম করতে চায় (এই ভূমিকায় যদি স্পেসার ট্রেসি অভিনয় করে), রূঢ় প্রত্যাখ্যান ছাড়া কিছুই জুটবে না তার কপালে; অথবা (ভূমিকাটিতে যদি ক্লার্ক গেবল অভিনয় করে) ছোকরার প্রেমে উন্মাদিনী হয়ে এই ধনীর দুলালী সব শ্রাগ করে তার সাথে পালিয়ে যাবে। যাই হোক, ডীনা ভান যে ভূমিকাই নিয়ে থাকুক, কিছু এসে যাচ্ছে না নিনোর। এক সময় আবিষ্কার করল ও, দিব্যি গড় গড় করে বলে খাচ্ছে কিভাবে একসাথে নিউ ইয়র্কে বড় হয়েছে সে আর জনি ফন্টেন কবে থেকেঁ ওরা ছোটখাট ক্লাবের আমন্ত্রণ পেয়ে গাইতে শুরু করে। অদ্ভুত মনোযোগ আর সহানুভূতির ছাপ ফুটে উঠেছে উনার চেহারায়। হালকা কথাচ্ছলে একবার জানতে চাইল ও, আচ্ছা, তুমি জানো, হারামজাদা জ্যাক ওলটসের কাছ থেকে কিভাবে ওই ভূমিকাটা আদায় করল জনি?

সেই মুহূর্তে শক্ত কাঠ হয়ে গেল নিনো, মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইল, এ ব্যাপারে কিছুই জানে না সে। কথা বের করার জন্যে উীনাও কোন চাপ দিল না।

ছবি দেখাবার সময় হয়ে এসেছে। হঠাৎ প্রায় আগুনের ছ্যাঁকা লাগার মত উত্তাপ অনুভব করল নিনো, দেখল তার একটা হাত ধরেছে উীনা ডান, তাকে বন্দা করে নিয়ে এল বাড়ির অন্দর মহলের একটা কামরার ভিতর। কামরাটা কোন জানালা নেই, খাকার মধ্যে আছে দুজন করে বসতে পারে এই ধরনের পঞ্চাশটা সোফা। সেগুলো কামরার চারদিকে এমন ভাবে ছড়িয়ে সাজানো হয়েছে যে, দেখে মনে হয় নির্জন এক একটা দ্বীপ ওগুলো, একটার সাথে আরেকটার কোন যোগাযোগ নেই।

প্রত্যেক জোড়া সোফার সামনে একটা করে ছোট, নিচু টেবিল রয়েছে, তাতে কাঁচের জার ভর্তি বরফ, গ্লাস, মদের বোল, আর সিগারেট দেখতে পাচ্ছে নিনো। সঙ্গিনীকে একটা সিগারেট দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিল সে। তারপর দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে নিল দুজনের জন্যে। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। এর একটু পরই সব আলো নিভে গেল, নিখাদ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল সব।

নিজেকে প্রস্তুত করে নিল নিনো, এবার সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটবে। হলিউড একটা নোংরা জায়গা, এ-সম্পর্কে রঙবেরঙের অনেক কাহিনী:শোনা আছে তার। কিন্তু তৈরি হয়ে নেবার জন্যে সামান্যতম সুযোগ না দিয়ে, সৌজন্যতা দেখিয়ে অনুমতি না নিয়ে, বন্ধুসুলভ আমন্ত্রণ না জানিয়েই ডীনা ডান যে তার পুরুষাঙ্গ নিয়ে এভাবে নাড়াচাড়া শুরু করে দেবে তা সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। একটু একটু করে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে নিনো, আর প্রাণপণ চেষ্টা করছে পর্দায় চোখ রেখে ছবি দেখতে। কিন্তু এই অবস্থায় না পারছে সে ছবির দিকে মন দিতে, না পারছে মদের স্বাদ নিতে। এর আগে জীবনে কখনও এমন প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠেনি সে। তার কারণ খানিকটা সম্ভবত এই যে এখন যে-নারী অন্ধকারে তার সেবায় নিয়োজিত এই নারীই ছিল তার কৈশোর জীবনের সব রঙিন স্বপ্নের বিষয়বস্তু।

অথচ, অনুভব করছে নিনো, এই ঘটনায় তার পৌরুষ অপমানিত হচ্ছে। তাই পৃথিবী বিখ্যাত উীনা ডান যখন পরিতৃপ্ত হয়ে ওর প্যান্টের বোতাম-টোতাম লাগিয়ে আবার ওকে গুছিয়ে দিল, বিশাল একটা স্বস্তিবোধ করল নিনো, অম্লান বদনে ওকে এক গ্লাস মদ ঢেলে দিল সে, অন্ধকারেই আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল ওকে, তারপর পরম আনন্দ আর আয়েশের সুরে বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে ছবিটা খুবই চমৎকার।

সোফায় হাত পা এলিয়ে দেয়া ডীনা ডান-এর শরীরটা পাথরের মত শক্ত হয়ে উঠল, অনুভব করল নিনো। সবিস্ময়ে ভাবছে সে, এও কি সম্ভব যে ও তার কাছ থেকে দুএকটা প্রশংসা বাক্য আশা করছে? অন্ধকারে হাতড়ে যে বোতলটা পেল সেটা থেকে নিজের গ্লাসে মদ ভরে নিল সে। ভাবছে, মরুকগে। তার সাথে একটা পুরুষ বেশ্যার মত আচরণ করেছে ও। সঙ্গত কারণেই এখন. এই ধরনের সব মেয়ের ওপর ঠাণ্ডা একটা বিদ্বেষ অনুভব করছে সে। আরও পনেরো মিনিট দেখল ওরা ছবিটা। সোফার উপর, এক প্রান্তে কাত হয়ে শুয়ে আছে সে, যাতে পরস্পরের গায়ে ছোঁয়া না লাগে।

শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল ভীনা ডানই, অমন সাধুর মত ভাব করে আছ কেন, তোমার যে ভাল লেগেছে তা তো বোঝাই গেছে। ফিসফিস করে বলল, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা আশ্চর্য কর্কশ শোনাল। একটা বাড়ির মত বড় তোমার ওটা।

গ্লাসে আরও গোটা দুই চুমুক দিয়ে নিল নিনো, তারপর সহজ মৃদু গলায় বলল, ওটাই ওর স্বাভাবিক আকার। আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলে তখন যদি ওটা দেখতে।

মৃদু হাসল ডীনা। ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোন কথা বলল না ও। আলো জ্বলে ওঠার পর চোখ কুঁচকে নিজের চারদিকে তাকাল নিনো। বুঝল অন্ধকারেই রীতিমত একটা বল ড্যান্স হয়ে গেছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কিছুই শুনতে পায়নি সে। তবে মেয়েদের কারও কারও চেহারায় পরম তৃপ্তির চকচকে একটা ভাব ফুটে রয়েছে, বিড়ালের মত জ্বলছে চোখগুলো, সদ্য খুব এক দফা হয়ে গেলে যেমনটি দেখায়। ধীর, ক্লান্ত পায়ে প্রজেকশন রূম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেরিয়ে এসেই নিনোকে ছেড়ে একজন বয়স্ক লোকের সাথে কথা বলতে চলে গেল ভীনা। লোকটাকে চিনতে পারল নিনো, একজন বিখ্যাত অভিনেতা, কিন্তু এখন অবশ্য একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয় সে। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে নিনোর, ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছে মদের গ্লাসে। ওর পাশে এসে দাঁড়াল জনি ফন্টেন।

বলল; কি, দোস্ত, চুটিয়ে মজা করছিস তো?

নিঃশব্দে হাসল নিনো। ঠিক বুঝতে পারছি না। কেমন যেন অন্যরকম। এখন আমি আমার পুরানো আস্তানায় ফিরে গিয়ে বলতে পারব, ঙীনা ডান আমাকে দখল করেছিল।

হেসে উঠল জনি। ও যদি তোকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়, আরও ভাল খেলা দেবে। দাওয়াত দিয়েছে নাকি?

এদিক ওদিক মাথা দোলাল নিনো। ছবিটা আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল, বলল সে।

এবার কিন্তু হাসল না জনি। সিরিয়াস হ, নিনো, বলল ও। ওর মত একটা মেয়ে তোর জন্যে কি না করতে পারে। এত কিসের দাম তোর, তোকে আমি চিনি না? কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই যার তার সাথে শুয়ে পড়তিস তুই, অৰীকার করতে পারবি? ব্যাটা, এমন সব মেয়েকে নিয়ে ঝুলে পড়তিস, ভাবতে গেলে এখনও আমার বমি পায় আর দুঃস্বপ্ন দেখি।

বদ্ধ মাতালের মত গ্লাস ধরা হাতটা নাড়ল নিনো, গলাটা চড়িয়ে বলল, যা, দেখতে তারা খারাপ, কিন্তু মেয়েমানুষ তো বটে। কামরার একধার থেকে ঘাড় ফিরিয়ে ওঁদের দিকে তাকাল ভীনা ডান। তার উদ্দেশে হাতের গ্লাসটা নেড়ে সৌজন্যতা দেখাতে ত্রুটি করল না নিনো।

হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল জনি, বুঝলাম, তুই একটা পাড়াগেঁয়ে ভূত।

নেশাগ্রস্ত ভঙ্গিতে হাসল নিনো, বলল, থাকবও তাই।

নিনোকে বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না জনির। জানে, যতটা ভান করছে ততটা নেশা হয়নি তার। ভান করার একমাত্র কারণ, এমন সব কথা বলতে চাইছে সে এখন যেগুলো সুস্থ সচেতন অবস্থায় বলা অভদ্রতার সামিল হয়ে যাবে। নিনোর কাঁধে একটা হাত রেখে সস্নেহে বলল ও, তুই ব্যাটা বুদ্ধির একটা ডিপো। জানিস, এক বছরের চুক্তি হয়ে গেছে-এখন তুই যা খুশি করতে পারিস, যা খুশি তাই বলতে পারিস–চাইলেও তাকে আমি বিদায় করে দিতে পারি না।

কৃত্রিম ধূর্তামি ফুটে উঠল নিনোর চেহারায়। বলল, সত্যি? ইচ্ছা করলেও তুই আমার পাছায় লাথি মেরে ভাগিয়ে দিতে পারিস না?

পারি না, বলল জনি।

তাহলে তোকে আমি ইয়ে করি, বলল নিনো।

মুহূর্তের জুনে চমকে উঠে রেগে যাচ্ছিল জনি। বেপরোয়া, তাচ্ছিল্যের হাসিটা দেখতে পাচ্ছে নিনোর মুখে। রাগটা দমিয়ে আনতে পারল জনি, গত কয়েক বছরে অবশ্যই কিছু সুবুদ্ধি হয়েছে ওর, অথবা শ্রেষ্ঠ তারকার রাজাসন থেকে পতনের ফলে ওর অনুভূতি আর সহনশীলতা নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়েছে। এই এক নিমেষেই নিনোকে বুঝে ফেলল ও, বুঝে ফেলল কেন তার ছেলেবেলার গানের সাথী সাফল্যের মুখ দেখেনি, এখনই বা কেন সাফল্য লাভের সমস্ত সম্ভাবনা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে। সাফল্যের জন্যে মূল্য দেবার চিন্তাটাই সহ্য হয় না নিনোর, তার জন্যে কেউ কিছু করছে বুঝতে পারলেই অপমান বোধ করে সে।

নিনোর হাত ধরে টেনে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে এল জনি। এবার সত্যি নেশা হয়েছে, কোনমতে টলতে টলতে হাঁটতে পারছে এখন নিনো। নরম গলায়, সমবেদনা আদায়ের সুরে কথা বলছে জনি, ঠিক আছে, ভাই, তুই শুধু আমার জন্যে গাইবি। তোর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আমি কিছু টাকা কামিয়ে নিতে চাই। তুই কিভাবে জীবন কাটাবিসে-ব্যাপারে কথা দিচ্ছি, একটুও মাথা ঘামাব না আমি। তোর যা খুশি, শ্বা করতে মন চায়, তাই করবি। তোকে শুধু একটা কাজ করতে হবে, আমার জন্যে গাইবি, যাতে দুটো পয়সার মুখ দেখি আমি। জানিসই তো, আমি আর গাইতে পারি না। আমার কথা সব বুঝতে পারছিসতো, দোস্ত?

শিরদাঁড়া খাড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়াল নিনো। তার জন্যে গাইব আমি, জনি, বলল সে। গলার আওয়াজ জড়িয়ে যাচ্ছে তার, বোঝা যায় কি যায় না। এখন তো তোর চেয়ে ভাল গাই আমি। গায়ক হিসেবে আমি তোর চেয়ে সব সময়ই ভাল, সেটা জানিস তো?

দাঁড়িয়ে পড়েছে জুনি, ভাবছে, আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার। কিন্তু জানে ও, গলা যখন ভাল ছিল ওর, সমান হওয়া তো দূরের কথা, ওর ধারেকাছে ঘেঁষার উপযুক্ততাও ছিল না নিনোর। ছেলেবেলায় একটানা অত বছর গেয়েছে দুজন, তখনও তার চেয়ে ওর গলা শতগুণ ভাল ছিল। বুঝতে পারছে ও, একটা উত্তর পাবার জন্যে অপেক্ষা করছে নিনো, ক্যালিফোর্নিয়ার চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে টলছে। তোকে আমি ইয়ে করি, নরম সুরে বলল জনি। সাথে সাথে হো হো করে হেসে উঠল ওরা, সেই আগের মত, যখন ওরা দুজনেই প্রাণচঞ্চল তরুণ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *