০৭.
নিউ ইয়র্কে ফিরছে মাইকেল কর্লিয়নি। শরীরটা ঢিল করে দিয়ে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। বার বার এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে মনটা। ওর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় কাছে এসে পড়েছে। কি হয় না হয় কিছুই বলা যায় না, গোটা ব্যাপারটা একেবারে মর্মান্তিকও হয়ে উঠতে পারে।
সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। প্রচুর সময় নিয়ে নিখুঁত, নিচ্ছিদ্র করা হয়েছে পরিকল্পনার প্রতিটি খুঁটিনাটি। এক দুই করে কেটে গেছে চব্বিশটা মাস, দুটো বছর। আর দেরি করা সম্ভব নয়।
গেল হপ্তায় ডন তাঁর ক্যাপোরেজিমিদের ডেকে বসিয়েছিলেন, সেখানে প্রায় সবাই উপস্থিত ছিল। আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের অবসর নেবার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। বাপের মুখে সংকল্পটার কথা শোনা মাত্র বুঝে নিয়েছে মাইকেল, বাবা তার নিজস্ব ভঙ্গিতে ছোট ছেলেকে জানিয়ে দিলেন, সময় হয়েছে এবার।
তিন বছর হলো সিসিলি থেকে ফিরেছে মাইকেল। ওর সাথে কে-এর বিয়ে হয়েছে আজ দুবছর। গত তিন বছর ধরে লেগে থেকে পারিবারিক ব্যবসাটা রপ্ত করে নিয়েছে ও। বেশির ভাগ সময়টা কেটেছে টম হেগেন আর কনের সাথে আলোচনা করে। এতদিন পরিবারটি সম্পর্কে সত্যিকার কোন ধারণাই ছিল না মাইকেলের। কর্লিয়নিরা কত ধনী, তাদের কত শক্তি জানতে পেরে রীতিমত তম্ভিত হয়েছে ও। নিউ ইয়র্ক শহরের মাঝখানে বহু মূল্যবান স্থাবর সম্পত্তি আছে ওদের, এক-আধটা নয়, অনেকগুলো। প্রকাণ্ড সব অফিস বিল্ডিং। ওয়াল স্ট্রীটের দুটো দালালি ব্যবসার অংশীদার ওরা, এরপর আছে লং আইল্যাণ্ডে ব্যাংকের শেয়ার, রেডিমেড পোশাক তৈরি কারখানার শেয়ার। এসব ছাড়া বেআইনী জুয়া ব্যবসা তো আছেই!
ব্যবসা শিখতে গিয়ে সবচেয়ে মজার শিক্ষাটা পেল মাইকেল পরিবারের পুরানো দলিলপত্র ঘাঁটার সময়। যুদ্ধ মাত্র থেমেছে, সেই সময়ের ঘটনা। কর্লিয়নি পরিবারের অনুমতি নিয়ে, তাদেরকে নিয়মিত মোটা টাকা দিয়ে একদল জালিয়াত গানের রেকর্ড নকল করত। বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের জাল ফোনোগ্রা রেকর্ড তৈরি করে কৌশলে সেগুলো পাচার করে দিত, একবারও কেউ তারা ধরা পড়েনি। জানা কথা, এই জাল রেকর্ড বিক্রির টাকার এক পয়সাও গাইয়েরা বা বৈধ রেকর্ড পরিবেশকরা পেত না মাইকেল দেখল, এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জনি ফন্টেন। কারণ, সে সময় জনির রেকর্ডই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হত।
কৌতূহলী হয়ে উঠে হেগেনকে একদিন প্রশ্ন করল মাইকেল, জেনেশুনে তার। ধর্মপুত্রকে কেন ঠকতে দিয়েছিলেন ডন?
শ্রাগ করেছিল হেগেন। বলেছিল, এ হলো ব্যবসার কথা, আর কিছুর সাথে এর তেমন কোন সম্পর্ক তো না থাকাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, তখন জনি খুব বেচাল চলছিল। সেই ছোটবেলা থেকে যাকে ভালবাসে তাকে বিয়ে করে আবার শ্রাগ করল কেন? মার্গট অ্যাশটনকে বিয়ে করতে হবে। ওর ওপর খুব চটে গিয়েছিলেন ডন।
কিন্তু হঠাৎ লোকগুলো তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিল কেন? পুলিশের তাড়া খেয়ে বুঝি?
এদিক ওদিক মাথা নেড়েছিল হেগেন। না। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। ডন তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায়; কনির বিয়ের পরপরই।
পরে এ-ধরনের আরও অনেক ঘটনা লক্ষ করেছে মাইকেল! এসব থেকে ডনের বিচিত্র চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। কারও ওপর অসন্তুষ্ট হলে তার কিছুটা ক্ষতি করতে ইতস্তত করেন না, আবার কিছুদিন পরই দেখা যায় সেই লোকেরই উপকার করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। তার এই আচরণের মধ্যে কোন রকম ধূর্ত বা মতলব থাকে না, তার বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গিই এর কারণ। অথবা। বিব্রহ্মাণ্ডের নিয়মই এই, সেটাকে তিনি ঘন করতে চান না। ভালয় মন্দে জড়িয়ে। থাকাটাই তো সেই নিয়ম, আর সব নিয়মের চেয়ে সেটাই তো স্বাভাবিক।
ওদের বিয়ে হয়েছে নিউ ইংল্যাণ্ডে। নিরিবিলিতে সারা হয়েছে কাজটা। শুধু কে-র বাড়ির লোকজন আর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব উপস্থিত ছিল। বিয়ের পর থেকে উঠানের একটা বাড়িতে উঠে এসেছে ওরা। শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে, উঠানেরআর সব বাসিন্দাদের সাথে নিজেকে সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে কে, ব্যাপারটা লক্ষ করে গর্ব অনুভকাকরে মাইকেল, আবার অবাকও হয়। সেকেলে অর্থে ভাল ইতালীয় বউদের মত কয়েকটা দিন যেতে না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল কে। ফলটা তাতে ভালই হয়েছে। দুবছরের মধ্যে দুই সন্তানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে বাড়ির সবাই মহাখুশি। এ যেন একেবারে সোনায় সোহাগা।
মাইকেল জানে, ওর জন্যে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবে কে। অনেক বলেও তার এই অভ্যাসটা ছাড়াতে পারেনি ও। কোথাও থেকে মাইকেল ফিরে এলে একেবারে ছেলেমানুষের মত খুশি হয়ে ওঠে কে। মাইকেল খুব খুশি হয়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম।
আজকের এই যাত্রার শেষ মানেই এতদিন ধরে যে কাজের প্রস্তুতি চলছে, তার শুরু। ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন ডন। ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। ক্যাপোরেজিমিরা। ওর ঘাড়েই চাপবে এখন সমস্ত দায়-দায়িত্ব। মাইকেল কর্লিয়নির সামনে অগ্নিপরীক্ষা। নির্দেশ এখন তাকেই দিতে হবে। সিদ্ধান্ত এখন তাকেই নিতে হবে। সেই নির্দেশ আর সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে তার নিজের আর পরিবারের ভাগ্য।
.
রোজই খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে খোকার জন্যে খাবার তৈরি করতে হয় কে অ্যাডামসকে। প্রায় রোজই তার চোখে পড়ে কর্লিয়নিদের মা, তার শাশুড়ী, সাথে বডিগার্ড নিয়ে গাড়ি করে কোথায় যেন যাচ্ছেন। ফিরে আসেন ঘণ্টাখানেক পর। কদিন পর কে জানতে পারল রোজ সকালে তিনি প্রার্থনা করার জন্যে গির্জায় যান।
গির্জা থেকে ফিরে রোজই বুড়ি ভদ্রমহিলা একবার ছোট ছেলে মাইকেলের বাড়িতে আসেন। উদ্দেশ্য নতুন নাতিকে দেখা। সেই সুযোগে বৌ-মার হাতের এক কাপ কফি খাওয়াও হয়ে যায়। বাড়িতে পা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তিনি জানতে চান, এখনও কেন ক্যাথলিক হবার কথা ভাবছে না কে? মনেই থাকে না তার যে এরই মধ্যে প্রটেস্ট্যান্ট মতে দীক্ষা দেয়া হয়ে গেছে কে-র ছেলেকে। সেজন্যেই ভাবল কে, দুএকটা প্রশ্ন করলে সেটা দোষের ব্যাপার হবে না জানতে চাইল, প্রত্যেকদিন কেন গির্জায় যান তিনি? ক্যাথলিক হলে তাই বুঝি যেতে হয়?
কে-র কথা শুনে শাড়ী ভাবলেন, রোজ গির্জায় যাবার ভয়েই বোধহয় ক্যাথলিক হচ্ছে না কে। বউকে তাড়াতাড়ি বললেন, না না! এমন অনেক ক্যাথলিক আছে যারা বছরে মাত্র দুবার, ঈস্টারের সময় আর বড়দিনে গির্জায় যায়। এর কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই, যখনই মন চায় তখনই যেতে হয়।
হাসছে কে। বলল, আপনি তাহলে রোজ যান কেন?
অত্যন্ত সহজভাবে মিসেস কর্লিয়নি বললেন, স্বামীর জন্যে যেতে হয় আমাকে। হাতের তর্জনী ঘরের মেঝের দিকে তাক করলেন তিনি। ওঁকে যাতে এই নিচের দিকে নামতে না হয় তার জন্যে। কে-র মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। তারপর বললেন, ওঁর আত্মার জন্যে বোজ প্রার্থনা করি আমি, তারপর তিনি তর্জনীটা তুলে আকাশের দিকটা দেখালেন, যাতে ওই ওপরের দিকে যেতে পারেন আমার স্বামী। কথাগুলো বলার সময় তার চেহারায় দুষ্টামির হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেল, যেন চুপিসারে স্বামীর গোপন মতলব ফাস করে দিচ্ছেন, যেন কোন পরাজিত পক্ষকে জিতিয়ে দিতে চাইছেন। পরিহাসের মতই শোনাল কথাগুলো, কিন্তু ভঙ্গিটা ইতালীয় বুড়িদের মতই রুগম্ভীর। তাছাড়া, ডন কাছেপিঠে না থাকলে যা প্রায়ই দেখা যায়, আজও তাই লক্ষ করল কে, শাশুড়ীর কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে ডনের প্রতি কিছুটা অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেল।
বাবা কেমন আছেন আজ? ভদ্রতা করে জানতে চাইল কে।
কাঁধ ঝাঁকালেন শাশুড়ী। গুলি খাবার পর থেকে ওঁকে আর পুরোপুরি সুস্থ বলা যায় না, বললেন তিনি। আগের সেই মনও নেই আর। কাজ তো সবই এখন মাইকেলকে দিয়ে করান। নিজে আজকাল বাগানে খেলা করে সময় কাটান। ওঁর খেলনা হলো লঙ্কা আর টমেটো গাছগুলো। দেখে কে বলবে, শহুরে লোক? এখনও যেন সেই চাষীর ছোট্ট ছেলেটি। কিন্তু, আসল ব্যাপার কি জানো, পুরুষরা এই রকমই হয়।
বেলা আরেকটু চড়লে দুই ছেলেমেয়েকে সাথে নিয়ে গল্প করার জন্যে আসে কনি কর্লিয়নি। কনিকে খুব ভাল লাগে কে-র। হাসিখুশি মেয়ে, এতটুকু ঈর্ষা বা গর্ব নেই, মেজাজ করে না, আর মাইকেলকে যে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে তা দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। কনির কাছ থেকেই কিছু কিছু ইতালীয় রান্না শিখেছে কে। কিন্তু খালি হাতে বড় একটা আসে না কনি, নিজের রান্না করা খাবার মাইকেলের জন্যে নিয়ে আসে খানিকটা।
যখনই আসে কনি, একটা বিশেষ কথা জিজ্ঞেস করতে কখনও ভুল হয় না তার। প্রশ্নটা আজও করল সে। তার স্বামী কার্লো সম্পর্কে কি ধারণা মাইকেলের? মাইকেল কি পছন্দ করে কার্লোকে? নিজেই আবার মন্তব্য করে, দেখে তো তাই মনে হয়।
বেশ কিছুদিন শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সাথে সম্পর্ক ভাল ছিল না কার্লোর। তবে, একটা করে বছর গেছে, সম্পর্কটাও একটু একটু করে ভাল হয়ে উঠেছে। দেখে মনে হয়, সমস্ত মন-কষাকমি মিটে গেছে। শ্রমিক সংঘে একটা ভাল কাজ দেয়া হয়েছে কার্লোকে, সেখানে খুব মন দিয়ে কাজ করছে সে। তবে খাটনিটা একটু বেশি, সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কনির মুখ থেকে সব সময়ই শোনা যায়, কার্লো সত্যি খুব পছন্দ করে মাইকেলাকে। অবশ্য, কেই বা পছন্দ করে না ওকে? কনির বাবা যেমন সবার প্রিয়পাত্র, তেমনি মাইকেলও সবার প্রিয়পাত্র! মাইকেল যে অবিকল আরেকজন ডন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই কারও। ওকে দেখে ডন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কার্লোও তো সেকথা বলে। মাইকেল যে ওদের পারিবারিক জলপাই তেলের ব্যবসার দায়িত্ব নেবে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কিছু হতে পারে না।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হয়ে যায় কে। কনি যখনই তার স্বামীর কথা তোলে, কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আশা করে, তার সম্পর্কে দুএকটা ভাল কথা কলা কে। কার্লোর প্রশংসা শোনার জন্যে কেমন যেন মুখিয়ে থাকে সে। ঠিক আগ্রহ নয়, আশ্চর্য একটা আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করে সে। প্রসঙ্গটা একদিন মাইকেলের কাছে তুলল কে। সেই সাথে আরও একটা প্রশ্ন জুড়ে দিল সে। সনি কর্লিয়নির নাম পর্যন্ত মুখে আনে না কেউ-কেন? অন্তত কনির সামনে তো নয়ই। কারণটা কি? একদিনের কথা মনে আছে কে-র। সনির প্রসঙ্গ তুলে দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে কেমন অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল কে। ডন আর তার স্ত্রী প্রায় অভদ্রের মত চুপ করে ছিলেন, ইহা পর্যন্ত করেননি। দুজনেই যেন কালা হয়ে গিয়েছিলেন। কোন প্রসঙ্গ এভাবে উপেক্ষা করা যায়, ভাবতেই পারে না কে। শুধু এদেরকেই নয়, কনির সাথেও সনি কর্লিয়নির সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে কে! কৌশলে কনিও এড়িয়ে গেছে প্রসঙ্গটা।
প্রসঙ্গটা মাইকেলও এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কে-র জেদের কাছে পেরে উঠেনি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সনির মৃত্যুটা ব্যাখ্যা করেছিল সে। সে রাতে যা যা ঘটেছিল, সবই জানিয়েছিল ওকে। স্বামী কার্লোর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে লং বীচে টেলিফোন করেছিল, কনি। ফোন ধরেছিল সনি। তারপর রাগে অন্ধ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। সনির ওই রাগ আর বাড়ি ছেড়ে বেরোবার ব্যাপারে দায়ী হলো ওই টেলিফোনটা। সেজন্যেই কনি আর কার্লোর ভয়, কর্লিয়নিরা বোধহয় সনির মৃত্যুর জন্যে পরোক্ষভাবে কনিকে দায়ী বলে মনে করে। তার মানে, সনির মৃত্যুর জন্যে কার্লোকে দোষ দেয়। তবে, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ওরা যে কেউ কার্লোকে খারাপ চোখে দেখে না তার প্রমাণ হলো, ওদেরকে উঠানে জায়গা দেয়া হয়েছে। শ্রমিক সংঘে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, কার্লোও তো আজকাল বদলে গেছে। পুরোপুরি শুধরে গেছে সে। মদ তো সে ছোঁয়ই না। মেয়েমানুষের নেশাও ছুটে গেছে তার। কোন ব্যাপারে বেশি চালাকি করার প্রবণতাও দেখা যায় না তার মধ্যে। আর স্ত্রীর গায়ে তো ভুলেও একবার হাত তোলেনি সেই থেকে। জীবনে আর কখনও তুলবে বলেও মনে হয় না গত দুবছর ধরে কার্লোকে লক্ষ করেছে কর্লিয়নি পরিবার, তারা ওর ব্যবহারে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট, তার বিরুদ্ধে ওদের কারও কোন অভিযোগ নেই। যা ঘটে গেছে-তা নিয়ে কেউ আর মাথাও ঘামায় না এখন, কেউ দোষীও ভাবে না কার্লোকে। সব চুকেবুকে গেছে।
তাই যদি হয়, বলেছিল কে, ওরা যে অহেতুক ভয় পাচ্ছে, সেটা তুমি ভেঙে দিচ্ছ না কেন? ওদেরকে একদিন দাওয়াত করে ডেকে এনে আশ্বস্ত করে দিলেই তো হয়। কনিকে বললেই চলবে। সব সময় ভয়ে কুঁকড়ে থাকে বেচারী, ওর স্বামী সম্পর্কে কি না কি ধারণা করে বসে আছ তোমরা। তারচেয়ে সব কথা খুলে জানিয়ে দিলেই পারো।
না, তা সম্ভব নয়, বলেছিল মাইকেল। আমাদের বাড়ির আলাদা একটা নিয়ম আছে, এসব বিষয় আলোচনা করা হয় না।
তুমি অনুমতি দিলে তোমার হয়ে আমি বলতে পারি কনিকে।
চিন্তিত দেখাচ্ছিল মাইকেলকে। কে বুঝতেই পারছিল না এই ধরনের একটা সহজ কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এত কি চিন্তা করার আছে।
কিছু বোধহয় না বলাই উচিত, কে, বলল মাইকেল। তাতে কোন লাভ হবে না। কনি ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেই। এ এমন একটা ব্যাপার, বাইরে থেকে কিছু করা যায় না।
অবাক হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল কে। হঠাৎ মনে পড়ল, আর সবার সাথে যেরকম সস্নেহ ব্যবহার করে মাইকেল, কনির সাথে তো সেরকম করে না। জানতে চাইল, তবে সনির মৃত্যুর জন্যে কনিকে দায়ী করো তুমি?
একটা নিঃশ্বাস ফেলল মাইকেল। কক্ষনও না। কনি আমার একমাত্র ছোট বোন, ওকে আমি ভালবাসি। ওর কথা ভেবে দুঃখ পাই আমি। কার্লো আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়ে গেছে, কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে কনির উপযুক্ত স্বামী সে নয়। মাঝে মধ্যে এরকম বেখাপ্পা ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়, কি আর করা যাবে বলো আর নয়, কেমন? এবার এসব কথা ভুলে যাওয়া যাক।
ঘ্যানর ঘ্যানর করা স্বভাব নয় কে-র, মাইকেল ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে বুঝতে পেরে চুপ করে গিয়েছিল সে কথা বাড়ায়নি আর। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে তার, মাইকেলের ওপর কোন ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা যায় না। সে রকম কিছু করতে গেলে মাইকেলের ব্যবহার কেমন যেন স্নেহ, মাধুর্য আর প্রীতিশূন্য হয়ে পড়ে। জানে, যে কোন ব্যাপারে একমাত্র সেই পারে নাইকেলের মতের পরিবর্তন ঘটাতে, সেই সাথে এও জানে যে এই ক্ষমতাটা বারবার কাজে লাগালে সেটার ধার কমে যাবে, একসময় আর কোন কাজেই লাগবে না। দীর্ঘ দুবছর ওর সাথে ঘর সংসার করার পর, মাইকেলের ওপর তার প্রেম আরও গাঢ় হয়েছে, আরও গম্ভীর হয়েছে–সব ব্যাপারে এখন আর খুত খুত করে না মনটা।
বিয়ের আগে মাইকেলের ওপর প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ বোধ করত কে, এখন সেটা অন্ধ প্রেমে পরিণত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই মাইকেলের ওপর ভালবাসা বেড়ে যাচ্ছে তার। এর একটা কারণ আছে। মাইকেলের ন্যায় ব্যবহারই সেই কারণ। শুধু কে-র সাথে নয়, সবার সাথে আশ্চর্য ভাল ব্যবহার করে মাইকেল। পরিষ্কার বোঝা যায়, কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না বলে মনে মনে শপথ নিয়ে রেখেছে ও। ছোট বড় সবার সাথে আশ্চর্য একটা সদ্ভাব বজায় রেখে চলে ও। কারও মনে আঘাত দিয়ে কখনও কিছু বলে না। সারাদিন কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকে, কত লোক দেখা করতে আসে ওর সাথে, কারও সাহায্য চাই, কারও পরামর্শ দরকার। সবাই শ্রদ্ধা করে মাইকেলকে, সমীহ করে কথা বলে। দিনে দিনে প্রতিপত্তি বাড়ছে ওর। সেই সাথে বিবেচক হয়ে উঠছে ও, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটছে। এসব তো আছেই, অন্য আরেকটা কারণে মাইকেলের ওপর ভালবাসা দিনে দিনে বেড়ে উঠছে কে-র।
সিসিলি থেকে ফিরে এসেছিল মাইকেল ভাঙা মুখ নিয়ে, সেই থেকে সবাই তার পিছনে লেগেছে, ত্রুটিটা অপারেশন করে সারিয়ে ফেল। বিশেষ করে মাইকেলের মা একেবারে নাছোড়বান্দার মত হয়ে উঠলেন। মাইকেলের কানের কাছে অনবরত টিক টিক করতেন তিনি। এক রবিবারের কথা মনে পড়ে কে-র, সেদিন বাড়ির সবাই একসাথে বসেছে ডিনার খাবে বলে, মাইকেলের মা চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।
আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখিস একবার, মাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন তিনি, ঠিক যেন সিনেমার গুণ্ডা যীশু আর তোর স্ত্রীর কথা ভেবে অন্তত মুখটা সারিয়ে নে। সারিয়ে নিলে আইরিশ মাতালদের মত নাক দিয়ে ওই রকম বিচ্ছিরি পানিও ঝরবে না আর। কত আর বলব তোকে?
মায়ের সাথে তর্ক করা স্বভাব নয় মাইকেলের। আর এ এমন একটা বিষয় যা নিয়ে কোন কথা বলতেই রাজী নয় ও। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল শুধু। একটা উত্তর পর্যন্ত দিল না।
টেবিলের একধারে বসেছিলেন ডন। এতক্ষণ সবই তিনি লক্ষ করছিলেন নিঃশব্দে। কে-র দিকে ফিরে হঠাৎ জানতে চাইলেন, তোমার খারাপ লাগে, কে?
দ্রুত মাথা নাড়ল কে।
ডন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বললেন, মাইকেল এখন তোমার হাতে নেই, ব্যাপারটা নিয়ে তুমি মাথা না ঘামালেই তো পারো।
স্বামীর কথার ওপর বুড়ি ভদ্রমহিলা কথা বললেন না। ডনকে তিনি ভয় করে চলেন, ব্যাপারটা তা নয়, সবার সামনে তার সাথে তর্ক জুড়ে দিলে তার অসম্মান করা হয়।
সন্তানদের মধ্যে কনিকে সবচেয়ে বেশি আদর করেন ডন, সে তখন কিচেনে ছিল, আলোচনার বিষয়টা কি জানতে পারার সাথে সাথে ডাইনিংরুমে এসে ঢুকল সে, বলল, আমিও বলি, অপারেশন করে ত্রুটিটা সারিয়ে নেয়া উচিত মাইকেলের। আমাদের মধ্যে ওই তো সবচেয়ে সুন্দর ছিল দেখতে, আর এখন হয়েছে যাচ্ছে তাই। মাইক, লক্ষ্মী ভাইটি আমার, বলে অপারেশন করাবে তুমি?
চেহারায় নির্লিপ্ত একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে কনির দিকে তাকাল মাইকেল। সবার মনে হলো, কনি কি বলেছে শুনতেই পায়নি সে। উত্তর দেবার তো কোন চেষ্টাই করল না।
কিন্তু কনিও সহজে ছাড়বার পাত্রী নয়। দ্রুত পা চালিয়ে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। বলল, তুমি বললে নেবে ও, বাবা। তুমি ওকে আদেশ করো। বাবার মন পাবার জন্যে তার গলাটা জড়িয়ে ধরল সে। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবার কাঁধে।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবার এত কাছাকাছি একমাত্র ওই যেতে পারে। ডনের প্রতি ওর ভালবাসা দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। এত বড়টি হয়েছে, কিন্তু বাবার সাথে এমন আচরণ করে যেন এখনও কচি খুকী। ডা মেয়ের হাতে মৃদু চাপড় মারলেন কয়েকবার, তারপর বললেন, এই, পাগলী, খিদেতে যে বাপের পেট জ্বলে গেল সেদিকে খেয়াল আছে? টেবিলে আগে স্প্যাগেটি নিয়ে আয়, তারপর যত পারিস বকবক করিস।
বাবা তাকে নিরাশ করায় এবার কনি স্বামীর শরণাপন্ন হলো। বলল, কার্লো, তুমি মাইককে একটু বুঝিয়ে দেখো না, প্লীজ। কথাগুলো এমন ভাবে বলল কনি, যেন কার্লোর সাথেই মাইকেলের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব।
রোদে পোড়া চেহারা কার্লোর, শরীরটা প্রকাণ্ড, সোনানী চুল পরিপাটি করে ছাঁটা, আঁচড়েছেও যত্ন করে। তার হাতে বাড়ির তৈরি এক গ্লাস মদ। গ্লাসটায় চুমুক দিল সে, বলল, মাইক নিজের কথায় চলে। উঠানে আসার পর থেকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেছে কার্লো! কর্লিয়নি পরিবারে তার আসন কোথায় সেটা বুঝে নিয়ে সেই রকম আচরণ করে সে।
গোটা ব্যাপারটার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কে। ব্যাপারটা খুবই সূক্ষ্ম, কখনই প্রকট হয়ে ওঠে না। কিন্তু হাজার হোক সে নারী, আর নারীর একটা চোখে থাকে রাজ্যের চাতুরী, সে চাতুরীর সাহায্যে দেখতে পায় কে, বাবাকে খুশি করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে কনি। তার এই কাজে কোন খুঁত থাকে না, তার কারণ কনি অন্তর থেকেই করে সেটা। কিন্তু তবু যেন সেটাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলা যায় না। বোঝা যায়, বাবার সমর্থন আদায় করাটা তার কাছে খুবই জরুরী একটা ব্যাপার। এ ধরনেরই চেষ্টা অন্যভাবে কার্লোও করে। তবে ডনকে নয়, মাইকেলকে খুশি করার চেষ্টা করে সে। সেদিন যেমন উত্তর দেবার সময় নিজের কপালে আঙুল দিয়ে টোকা মেরেছিল সে। কিন্তু মাইকেলকে দেখে মনে হলো এসব যেন দেখতেই পায়নি ও।
কে কিন্তু মাইকেলের চেহারার বিকৃতি নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না। ওতে ওর কিছুই এসে যায় না। তবে, ওটা সারানো হচ্ছে না বলেই মাইক সাইনাসের কষ্টে ভুগছে, সেটাই ওর একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ। ডাক্তাররা আগেই জানিয়েছে অপারেশন করে মুখের হাড় ঠিকমত বসিয়ে নিলে সাইনাসের উপদ্রবটা বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ ফুটে কিছু বলে না কে, কিন্তু মনে মনে চায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলুক মাইকেল। তবে এও পরিষ্কার বুঝতে পারে ও, কি এক দুর্বোধ্য কারণে মুখের ওই ত্রুটিটাকে পুষে রাখতে চায় তার স্বামী। কে-র বিশ্বাস, কথাটা ডনও বুঝতে পেরেছেন।
ওরা ওদের প্রথম সন্তানের মুখ দেখার পর, ও-কে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ একদিন জানতে চাইল মাইকেল, মুখের এই ত্রুটিটার ব্যাপারে তুমি কি মনে করো, কে? চাও এটা আমি সারিয়ে নিই?
মাথা দুলিয়েছিল কে। নিজের কথা ভেবে নয়, মাইক, ছেলেটার কথা ভেবে তাই চাই। ছেলেপুলেরা কেমন হয় জানোই তো, একটু জ্ঞান-বুদ্ধি হলেই বুঝতে শিখবে যে তুমি দেখতে স্বাভাবিক নও, মনে খুব আঘাত পাবে তখন ও। আমার ছেলে তার বাপের ভাঙা মুখ দেখুক, এ আমি চাই না। কিন্তু আমার কথা যদি জিজ্ঞেস করো তুমি, মাইকেল, সেটাই আমার কাছে একমাত্র সত্য, মাইকেলের মুখ ভাঙা কি হাত কাটা, তাতে আমার কিছুই এসে যায় না।
স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসেছিল মাইকেল। ঠিক আছে। অপারেশন করাব।
হাসপাতাল থেকে কে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করুল মাইকেল, তারপর হাসপাতালে ভর্তি হলো নিজেই। নির্বিমে হয়ে গেল অপারেশন। মুখটা যে এই মাত্র কদিন আগেও বিচ্ছিরিভাবে তুবড়ে ছিল তা আর এখন বোঝাই যায় না।
বাড়িতে আনন্দ আর ধরে না কারও। বিশেষ করে কনি তো মহাখুশি। রোজ তার একবার করে হাসপাতালে মাইকেলকে দেখতে যাওয়া চাই। মাইকেল যেদিন বাড়ি ফিরল, ওকে জড়িয়ে ধরে সে কি চুমো খাওয়া। তার দুচোখে আনন্দ উথলে উঠেছিল। ওরে, কে কোথায় আছিস দেখে যা, এই তো সুন্দর রাজপুত্র ভাইটি আমার! চিৎকার করে আবার মাইকেলের মুখে চুমো খেয়েছিল সে।
একমাত্র ডনের ওপর এর কোন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। সবাই যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তিনি তখন মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, কি আর এমন তফাৎ হলো! কেমন যেন একটা উদাস ভাব লক্ষ করা গেল তার মধ্যে। সবচেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করুল কে। আর কেউ জানুক বা না জানুক, সে তো জানে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজটা করেছে মাইকেল। কে ওকে অনুরোধ করেছিল, তাই। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাইকেলকে কেউ যদি কোন কাজ করাতে পারে, সে শুধু কে। আর কারও অনুরোধ, এমন কি স্বয়ং ডনের আদেশ অমান্য করার মত সৎসাহস রাখে মাইকেল কর্লিয়নি।