০২.
বৃহস্পতিবার সকাল। শহরে নিজের আইন অফিসে এসে পৌঁছল টম হেগেন। আগামীকাল ভার্সিল সলোমোর সাথে সাক্ষাৎকারের দিন ঠিক হয়েছে, তাই কাগজ কলমের বাকি কাজ সেরে, গুছিয়ে তুলে রাখতে চায় সে। ডন অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন সাক্ষাৎকারটিকে, নিজেদেরকে প্রস্তুত করার জন্যে গোটা একটা সন্ধ্যা ব্যয় করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি হেগেনকে। সন্ধ্যার মীটিংয়ে হালকা মনে উপস্থিত থাকার জন্যে হাতের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে সে।
মঙ্গলবার গভীর রাতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরে এসেই ওলটসের ব্যাপারটা রিপোর্ট করেছিল হেগেন। সব শুনে মোটেও অবাক হননি ডন। হেগেন যখন সেই ছোট সুন্দর মেয়েটার কথা বলল, অসন্তোষে তার মুখের চেহারা বদলে গেল। কী জঘন্য!মৃদু কণ্ঠে মন্তব্য করলেন তিনি। চরম ঘৃণা এবং আপত্তি প্রকাশ করার সময় এই দুটো শব্দ ব্যবহার করেন ডন কর্লিয়নি।
সব শুনে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন তিনি। লোকটার সত্যিকার পৌরুষ আছে কি?
ডনের এই প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্ধ কি হতে পারে তাই নিয়ে অনেক মাথা ঘামাতে হয়েছে হেগেনকে। দীর্ঘ দিন সান্নিধ্য লাভের ফলে সে জানে সাধারণ মানুষ আর ডনের মূল্যবোধের মধ্যে এত বেশি পার্থক্য রয়েছে যে তার একটা কথার অর্থ সাধারণভাবে যা হওয়া উচিত অনেক সময় তা না হয়ে অনেক বেশি গভীর অর্থ বহন করে।
ঠিক কি জানতে চাইছেন ডন? ওলটসের ব্যক্তিত্ব আছে কিনা? তার মছিবীজোর আছে কি? অবশ্যই আছে। কিন্তু হেগেন বুঝল, ডন এসব জানতে চাননি। কিতে, ধাপ্পায় বিচলিত হয় না, সেই মুরোদ আছে কি নোকটার? সিনেমা তৈরিতে বাধা পড়লে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হবে তাকে, তার সবচেয়ে বড় অভিনেতা হেরোইনে আসক্ত এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় উঠবে–এসব ঝুঁকি নেবার মত ক্ষমতা আছে কি তার? অবশ্যই আছে। কিন্তু ডন এসবও জানতে চাননি।
প্রশ্নটার সঠিক অর্থ নিজেই বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করতে পেরেছে হেগেন। ডন জানতে চাইছেন, আত্মসম্মান রক্ষার জন্যে, প্রতিশোধ নেবার জন্যে স্ব হারাবার ঝুঁকি নিতেও পিছপা হবে না, এতটা পৌরুষ কি আছে ওলটসের?
বড় একটা হাসে না হেগেন, কিন্তু এই ঘটনা উপলক্ষে মৃদু একটু হেসেছে সে, এবং ডনের সাথে কিঞ্চিত রসিকতা করে বলেছে, আপনি আসলে জানতে চাইছেন ওলটস একজন সিসিলীয় কিনা।
প্রশ্নের অর্থ আবিষ্কার করে ফেলায় হেগেনের বলার মধ্যে একটা আত্মপ্রসাদের সুর ফুটে উঠল, সন্তুষ্টচিত্তে মাথা নেড়ে সেটা এবং প্রশ্নের ব্যাখ্যাটাকে মেনে নিলেন। উন।
পরদিনও এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন ডন, এবং বিকেলে হেগেনকে তার বাড়িতে ডেকে কিছু আদেশ দিয়েছিলেন। দিনের বাকি অংশটা সেই আদেশ পালন করতেই কেটে গিয়েছিল হেগেনের। ডনের প্রতি শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে পড়েছিল সে। তিনি যে সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন, এ ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহই ছিল না।
অফিসে বসে ওলটসের একটা ফোন পাবে বলে আশা করছে হেগেন। যুদ্ধের ছবিটায় জনি ফন্টেনকে প্রধান ভূমিকায় নেয়া হবে, এই খবরটা দেবার জন্যে ফোন তাকে করতেই হবে।
ফোনটা হঠাৎ ঝন ঝন করে বেজে উঠল, কিন্তু হেগেন রিসিভার তুলে কানে ঠেকাতে ওলটসের নয়, আমেরিগো বনাসেরার গলা পেল।
কৃতজ্ঞতায় অভিভূত বনাসেরার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। সে যে ডনের কাছে চিরঋণী, হেগেনের মাধ্যমে উনকে এই কথাটা জানাবার জন্যে ফোন করেছে সে। জানাল, গড ফাদার যখনই বলবেন তখনই তার জন্যে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারবে সে।
ডেলি নিউজ কাগজটার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল হেগেন। ভিতরের পৃষ্ঠায় বড় একটা ফটো ছাপা হয়েছে। রাস্তার উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কেভিন মুনান আর জেরি ওয়াগনার। মানুষের শরীর বলে চেনা কঠিন, থেঁতলানো মাংসের দুটো পিণ্ড যেন। এরা মরেনি বলে রিপোর্টারও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তার মন্তব্য হলো, মুখ মেরামত করতে হলে প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্য নিতে হবে, এবং দুজনকেই মাসের পর মাস থাকতে হবে হাসপাতালে।
পলি গাটো লোকটাকে খুব দক্ষ মনে হচ্ছে, ভাবল হেগেন। ওরধন্যে ভাল কিছু একটা করার কথা বলতে হবে ক্লেমেঞ্জাকে। চিন্তাটা নোট করে রা ফেস।
এরপর গভীর মনোযোগ আর দক্ষতার সাথে হিসাব কষতে শুরু ক হেগেন। ঝাড়া তিন ঘণ্টা কাজ করে ডন কর্লিয়নির জমিজমা থেকে যা আয় হয় র একটা পাকা হিসাব, জলপাই তেল আমদানি আর স্থাপত্য কোম্পানির লাভ লোকসানের হার ইত্যাদি বের করে ফেলল সে, কোন ব্যবসাই বর্তমানে বিশেষ লাভের মুখ দেখছে না, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, এবার মোটা মুনাফা আশা করা যেতে পারে।
এই সময় ফোন এল ওলটসের।
কুত্তার বাচ্চা, তোমাকে আমি জেলের ঘানি টানাব! ঘৃণায়, ক্ষোভে বিকৃত শোনাচ্ছে ওলটসের কষ্ঠর। শেষ হয়ে যেতে পারি আমি, কিন্তু তবু আমার হাত থেকে তুমি শালার রক্ষা নেই। আর ওই শালা বেজন্মা জনি, ওর আমি পুরুষাঙ্গ যদি কেটে না নিই তো কি বলেছি। সাবধানে থেকো, শালা ইতালীয় গর্ভাব!
শান্ত এবং নরম গলায় বলল হেগেন, একটু ভুল করছেন। আমি ইতালীয় নই–আধা জার্মান, আধা আইরিশ।
কয়েক মুহূর্ত অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া পেল না হেগেন, তারপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার শব্দ পেল। মুচকি একটু হাসল সে। এত গালমন্দ করল বটে ওলটস, কিন্তু ডন সম্পর্কে একটা কটু কথা তো দূরের কথা, তার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।
প্রতিভার কদর আছে, ভাবল হেগেন।
.
দশজন লোকের জায়গা হবে এতবড় একটা খাটে এক ঘুমায় ওলটস। বয়স বেশি হওয়া সত্ত্বেও তার শারীরিক উদ্যমে তেমন ভাটা পড়েনি, তবে কিশোরী মেয়ে ছাড়া আজকাল কেউ তাকে উত্তেজিত করতে পারে না। এবং সন্ধ্যার পর খানিকক্ষণের মধ্যেই সাধ এবং সাধ্য নিঃশেষ হয়ে যায় তার।
আজ বৃহস্পতিবারে কেন যেন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল তার। চোখ মেলে পায়ের কাছে পরিচিত একটা আকৃতি দেখে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল সে। হাত বাড়িয়ে জ্বেলে দিল বেড ল্যাম্পটা। যা দেখল তাতে মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। গলগল করে বেরিয়ে এসে পুরু দামী গালিচার উপর ছিটকে পড়ল দুর্গন্ধময় বমি।
তার প্রিয় ঘোড়া খার্তুমের কাটা মুণ্ড এক দলা জমাট বাঁধা রক্তের উপর বসানো রয়েছে। সাদা দড়ির মত দেখা যাচ্ছে স্নায়ুগুলোকে, চোখ থেকে সোনালী চকচকে ভাব অদৃশ্য হয়েছে, পচন ধরা ক্ষতবিক্ষত আপেলের মত চেহারা হয়েছে সে দুটোর। আতঙ্কে, দুঃখে, ঘৃণায় চেঁচিয়ে উঠল ওল্টস।
বাটলার এবং চাকর বাকররা যে যেখানে ছিল ছুটে এল সবাই। কর্তাকে উন্মাদের মত চেঁচামেচি করতে দেখে ঘাবড়ে গেল বাটলার, দেরি না করে ওলটসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং স্টুডিওর প্রধান সহকারীকে ফোন করুল সে। তবে এরা এসে পৌঁছবার আগেই হেগেনকে একচোট গাল দিয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়েছে ওলটু।
ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে গিয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে সে। একোন জাতের নোক যে ছোট্ট একটা অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি বলে ছয় লাখ ডলারের বিশ্ববিখ্যাত একটা ঘোড়াকে অবলীলায় মেরে ফেলতে পারে? একটু সতর্ক করার প্রয়োজনটুকুও বোধ করল না! হত্যার ধরনের মধ্যেও তাৎপর্য রয়েছে। এই বিভৎস নিষ্ঠুরতা এমন একজন মানুষের পরিচয় প্রকাশ করছে যে নিজেই আইন, নিজেকে ছাড়া আর কাউকে, আর কিছুকে, এমন কি সৃষ্টিকর্তাকেও গ্রাহ্য করে না। ইতিমধ্যে খবর পেয়েছে ওল্টস, ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিল খার্তুমকে, তারপর কুড়াল দিয়ে আলাদা করা হয়েছে ওই তিনকোণা মুটাকে। তার মানে, আস্তাবলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বানচাল হয়ে গেছে। ইনভেস্টিগেশন ফার্মের যারা পাহারায় ছিল তারা বলছে রাতে তারা কোন শব্দই পায়নি। এ অসম্ভব। তার মানে টাকা খেয়েছে ওরা।
প্রেসিডেন্টের সাথে খাতির রয়েছে তার। এফ. বি: আই.-এর পরিচালক তার বন্ধু–এসব জেনেও অখ্যাত একজন ইতালীয় তেল আমদানিকারক তাকে খুন করতে যাচ্ছে–নিশ্চয়ই তাই, ব্যাপারটা উপলব্ধি করে শিউরে উঠল ওলটস। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কিন্তু দিবালোকের মত বাস্তব। কী আশ্চর্য, পরিস্থিতি এরকম হয়ে উঠলে পৃথিবীটা দাঁড়াবে কোথায়, খারাপের আর বাকি থাকল কি!
ডাক্তারের দেয়া মৃদু সিডেটিভ খেয়ে শরীরটাকে ঠাণ্ডা করে নিল ওলটস। দেশের মানুষের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়া চলবে না তার, ভাবছে সে। কেউ তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে এটা জানাজানি হয়ে গেলে মুখ দেখাবে কিভাবে সে? যা হবার হয়েছে, এবার সাবধানে পা ফেলতে হবে। সামান্য একটা কারণে জেদ ধরে বসে এই লোভনীয় জীবনটার সমাপ্তি ঘটাবার কোন মানে হয় না। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কর্লিয়নিকে নাগালের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে একদিন।
ডাক্তার সহ উপস্থিত সবাইকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে দেয়া হলো যে এ ব্যাপারে আসল সত্যটা কেউ প্রকাশ করবে না। খবরের কাগজে খবর পাঠানো হলো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা গেছে খার্তুম। ওলটসের নিজের জমিতে অতি গোপনীয়তার সাথে সমাধিস্থ করা হলো ঘোড়াটার দুই অংশ।
এর ছয় ঘণ্টা পর একটা টেলিফোন কল পেল জনি ফন্টেন। ছায়াছবির নির্বাহী প্রযোজক জানাল, জনি যেন শু্যটিংয়ের জন্যে তৈরি হয়ে আগামী সোমবার স্টুডিওতে হাজির হয়।
.
প্রস্তুতি সভায় হাজির থাকার জন্যে সন্ধ্যায় ডনের বাড়িতে এল হেগেন। ডনের নির্দেশে তার বড় ছেলে সনি কর্লিয়নিও বৈঠকে বসেছে। তার কিউপিড আকৃতির মস্ত ভারি মুখে ক্লান্তি আর অবসাদের ছাপ, বারবার একটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে স্কচ হুইস্কি খাচ্ছে সে। তাই দেখে হেগেন ভাবল, এখনও নিশ্চয়ই সেই মেয়েটার সাথে ধুমসে প্রেম চালাচ্ছে সনি। আরেকটা দুশ্চিন্তার কারণ বটে।
ডি নোবিলি চুরুট টানতে টানতে আরাম কেদারায় বসলেন ডন। জানতে চাইলেন, দকারী সব জানা হয়ে গেছে আমাদের?
একটা ফাইল খুলল হেগেন। প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা আছে এতে। কারও হাতে এটা পড়লে তথ্যগুলোর মর্ম উদ্ধার করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিল হৈগেন। বলল, আমাদের সহযোগিতা চাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসছেনসলোযো। দশ লক্ষ ডলার পজি চাইবেন উনি এবং আইন যাতে আমাদেরকে কোনভাবে বিরক্ত না করে তার নিখুঁত ব্যবস্থা করবেন। এর বিনিময়ে ব্যবসা থেকে যা লাভ হবে তার একটা অংশ পাব আমরা, কিন্তু সেটার পরিমাণ সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
হেগেন লক্ষ করল সনি কর্লিয়নি তার কথা মন দিয়ে শুনছে না, নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে সে। আবার শুরু করল হেগেন, সলোযোর জামিন হচ্ছে টাটাগ্লিয়া পরিবার। লাভের একটা অংশ তারাও হয়তো নেবে। এটা ডাগের ব্যবসা, পপি ফুলের ব্যবসা-তুরস্কে এই ফুলের চাষ হয়। ব্যবসার অন্ধিসন্ধি সব জানা আছে সলোযোর, তুরস্কের সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে ভাল যোগাযোগও আছে। পপি ফুল তুরস্ক থেকে পাঠানো হয় সিসিলিতে, সেখানে তার কারখানা আছে, কারখানায় আফিম থেকে তৈরি করা হয় হেরোইন, কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত নিখুঁত, কোন ঝুঁকি নেই। হেরোইন বা মরফিন যাই তৈরি করা হোক, সেগুলো এদেশে নিয়ে এসে বিলি করাটাই হলো সমস্যা। তাছাড়া, পুঁজির ব্যাপারটাও রয়েছে। দশ লাখ ডলার তো আর মুখের কথা নয়।
হেগেন দেখল, ডনের চেহারায় একটু বিরূপ ভাব ফুটল। ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে কৌশলে উট দেখানো পছন্দ করেন না তিনি।
তাড়াতাড়ি আবার প্রসঙ্গে ফিরে এল হেগেন, বলল, সলোযোকে ওরা তুর্ক। বলে ডাকে। কারণ তুরস্কে অনেক দিন ছিলেন উনি, তাছাড়া, গুজব আছে, তুর্কী স্ত্রী আর ছেলেমেয়েও নাকি আছে তাঁর। আরেকটা কারণ, ওস্তাদ একজন মারা খেলোয়াড় উনি। পুলিশের খাতায় নাম টোকা আছে তাঁর, একবার ইতালীতে, একবার এ-দেশে জেল খাটতে হয়েছে–ড্রাগ ব্যবসায়ী হিসেবে চেনে ওঁকে কর্তৃপক্ষ। এতে করে আমাদের সুবিধে হতে পারে এইটুকু যে সাক্ষী দেবার জন্যে ওঁকে কখনও ডাকা হবে না। এছাড়া, আমেরিকান স্ত্রী এবং তিনটে ছেলেমেয়ের বাপ তিনি-এদের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকার অভাব হবে না এ নিশ্চয়তা পেলে যে-কোন ঝুঁকি নিতে রাজি তিনি।
চুরুটে টান দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন ডন। তুমি কি বলো, সনি?
বাপের অধীনে থেকে হাঁফ ধরে গেছে সনির•• স্বাধীনভাবে কিছু একটা করতে চায় সে, জানে হেগেন। উত্তরে কিছু বলবে, জানা আছে তার।
গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে হুইস্কির স্বাদ নিল সনি, মুখ বিকৃত করে বলল, ওই সাদা পাউডারে বড় বেশি লাভ। তাই বিপদও বেশি। পিছনে থেকে উৎসাহ আর পুঁজি যোগান দেয়া যেতে পারে, মন্দ হয় না সেটা কিন্তু নিজেরা আমরা এ কাজে হাত দেব না। মামলা হলে বিশ বছরও ঝুলতে হতে পারে।
চুরুটে আরেকটা টান দিলেন ডন। তোমার মত কি, টম?
যা সত্য বলে মনে করছে তাই বলার জন্যে মনে মনে তৈরি হলো হেগেন। ডন যে সলোযোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন, ইতিমধ্যে তা বুঝতে পেরেছে সে। তার ধারণা, যা দৈবাৎ হয় এবার তাই হয়েছে গোটা ব্যাপারটা ভাল করে তলিয়ে দেখেননি ডন। যথেষ্ট দূরদৃষ্টির সাহায্য নিচ্ছেন না তিনি।
হেগেনকে ইতস্তুত করতে দেখে তাকে উৎসাহ দেবার জন্যে ডন বললেন, যা ভাবছ, বলেই ফেলো, টম। মনিবদের সাথে সিসিলীয় কনসিলিয়রিরাও সব সময় একমত হয় না। হেসে উঠলেন ডন, তার সাথে ওরা যোগ দিল,
আমি মনে করি প্রস্তাবটা আপনার গ্রহণ করা উচিত। এই ব্যবসাতে লাভের পরিমাণ খুব বেশি, আমরা এতে না ঢুকলে আর কেউ ঢুকে জায়গাটা দখল করে নেবে। টাটাগ্রিয়ারা এ সুযোগ ছাড়বে বলে আমি মনে করি না। প্রচুর আয় হলে আরও বেশি পুলিশের বন্ধুত্ব আর রাজনৈতিক প্রভাব কিনতে কোন অসুবিধেই হবে না ওদের। ক্ষমতার দিক থেকে আমাদেরকে টপকে যাবে ওরা। তখন হয়তো আমরা যা নিয়ে আছি তার উপর ভাগ বসাবার ফন্দি করবে। ভবিষ্যতের সেরা ব্যবসা হতে যাচ্ছে ড্রাগ ব্যবসা, এখনই এতে যদি আমরা না ঢুকি, এক সময় পিছিয়ে পড়ব! আমাদের যা আছে তাও হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয় আছে। আজই হয়তো এসব ঘটবে না, কিন্তু দশ বছর পরের কথা ভাবছি আমি।
হেগেনের মনে হলো উনকে প্রভাবিত করতে পেরেছে সে। সন্দেহ নেই, চুরুটের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, বেঈমানটার সাথে দেখা করার সময় ঠিক হয়েছে?
হেগেন ভাবছে, ডন হয়তো শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যাবেন। বলল, সকাল দশটায় এখানে আসবেন তিনি।
আমি চাই তার সাথে কথা বলার সময় তোমরা দুজনেই আমার সাথে থাকবে, বললেন ডন। আড়মোড়া ভেঙে ছেলের দিকে ফিরলেন হঠাৎ করে। সনির একটা হাত ধরে বললেন, আজ রাতে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করলে কেমন হয়, সান্তিনো? আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছ? ভূতের মত লাগে না? একটু নজর দাও শরীরটার দিকে-যৌবন কারও চিরকাল থাকে নাকি?
হেগেন যে প্রশ্ন করতে সাহস পায়নি বাপের কাছ থেকে স্নেহটুকু পেয়ে সেই প্রশ্নটা করে বসল সনি, সলোযোকে কাল তুমি কি বলবে, বাবা?
মৃদু হাসলেন ডন কর্লিয়নি। বললেন, খুঁটিনাটি সব তথ্য না জেনে এখুনি বলি কিভাবে? তাছাড়া,আজ রাতে যা শিখলাম তা নিয়ে একটু ভাবতেও তো সময় দরকার। যাই বলো, আমি তো আর ঝোঁকের বশে, চলি, না। দরজার দিকে এগোলেন তিনি, তারপর হঠাৎ থেমে ঘুরে দাঁড়ালেন, কথার পিঠে কথা বলার ভঙ্গিতে হেগনকে বললেন, আচ্ছা, যুদ্ধের আগে নারী-ব্যবসা করে খরচ চালাত সলোযো, তোমার ফাইলে সে কথাটা লেখা আছে কি? টাটাগ্লিয়ারাও তো আজকাল ওই ব্যবসা ধরেছে। মনে থাকতে থাকতে এ কথাটাও লিখে রাখো।
ডনের কণ্ঠস্বরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ লক্ষ্য করে লাল হয়ে উঠল হেগেনের মুখ। তথ্যটা প্রাসঙ্গিক নয় মনে করে উল্লেখ করেনি সে। তবে ডন শুনলে তার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে, এই রকম একটা চিন্তা উদয় হয়েছিল তার মনে। মেয়ে, সেক্স ইত্যাদি বিষয়ে ডন কর্লিয়নি সাংঘাতিক গোড়া এবং রক্ষণশীল, একথা সবাই জানে।
মাঝারি আকারের লোক ভার্সিল সোযো। স্বাস্থ্যটা খুব ভাল। একবার তাকালেই মেনে নিতে হয় গায়ে জোর আছে বটে লোকটার। গায়ের রং তেমন ফর্সা নয় বলে তুরস্কের লোক বলে ভুল করে অনেকে। নাকটা খাড়া। চোখ দুটো কালো এবং দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতার সাথে অদ্ভুত একটা নিষ্ঠুরতার ভাব আছে।
অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে অফিসে নিয়ে এল সনি কর্লিয়নি। হেগেনকে নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছেন ডন। সলোযোর দিকে তাকিয়ে হেগেন ভাবছে, লুকা ব্রাসি ছাড়া এমন সাংঘাতিক চেহারার লোক আর কখনও দেখেনি, সে। ডন যদি এখন তাকে জিজ্ঞেস করেন এই তুর্ক লোকটার সত্যিকার পৌরুষ আছে কিনা, এক কথায় জবাব দেবে সে, আছে। শক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের এমন স্পষ্ট ছাপ আর কোন মানুষের চেহারায় দেখেনি হেগেন। সলোহোর পাশে বসা ডনকে আজ যেমন বৈশিষ্ট্যহীন, সাদামাঠা বলে মনে হচ্ছে, এর আগে কখনও তা মনে হয়নি। ডনের অভিবাদনের ভঙ্গিটাও সরল গেঁয়ো মনে হলো।
আন্তরিক ভঙ্গিতে করমর্দনের পালা চুকল। তারপর সেই কাজের কথা তুলল সলোযো। প্রথমে নিজের ড্রাগ ব্যবসা সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করল সে। কোথাও কোন বিপদের ঝুঁকি নেই। তুরস্কের পপি ফুলের খেত থেকে বছরে এই পরিমাপ আফিম পায় সে। ফ্রান্সের কারখানায় মরফিন তৈরি হয়, সিসিলির কারখানায় হেরোইন। ওই দেশের দুই কারখানায় চোরাকারবারের মাল পৌঁছানো যতটা নিরাপদ হওয়া সম্ভব ততটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাগ আমদানি করার জন্যে তুলনামূলক ভাবে সামান্য লোকসান দিতে হবে, তার কারণ সবাই জানে সরাসরি ঘুষ দিয়ে এফ. বি. আই-এর সহযোগিতা আদায় করা এক কথায় অসম্ভব। কিন্তু লাভের পরিমাণ এত বেশি, সে তুলনায় বিপদ নেই বললেই চলে।
সলোযো থামতে ভদ্র বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন ডন, তাহলে আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন? কোন দিক থেকে আমি আপনার উদারতার যোগ্য হলাম?
প্রশ্নটাকে কিভাবে সে নিল, সলোহোর মুখ দেখে কিছুই তা বোঝা গেল না। বলল, ক্যাশ বিশ লক্ষ ডলার চাই আমার। এর সমান জরুরী কথা, সাহায্যকারী এমন একজন বন্ধু চাই আমি, সমস্ত বড় বড় জায়গায় যার ক্ষমতাবান মিত্র আছে। এই ক্যবসায় আমার প্রতিনিধিরা মাঝে মধ্যেই ধরা পড়বে, ঠেকানো যাবে না। নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, ধরা পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ থাকবে না। সুতরাং, এমনিতেও বিচার করে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া যাবে না। আমি এমন একজন বন্ধু চাই যিনি গ্যারান্টি দেবেন যে ধরা পড়লেও আমার প্রতিনিধিদেরকে দুএক বছরের বেশি জেল খাটতে হবে না। শুধু এই ব্যবস্থা করা গেলেই প্রতিনিধিরা। ব্যবসার গোপনীয়তা ফাঁস করে দেবে না। শাস্তির মেয়াদ বেশি হলে, বলা যায় না, তারা হয়তো মুখ খুলবে। তা যদি খোল তাদের ওপরের স্তরের লোকজনের বিপদ হতে পারে। মোটকথা, আইনের হাত থেকে কিছুটা আড়াল চাই আমি, ডন কর্লিয়নি, একটু থেমে গাম্ভীর্যের সাথে বলল সলোযো, শুনেছি, বুট-পালিশ ওয়ালাদের পকেটে যত চাঁদির টাকা আছে আপনার পকেটে তার চেয়ে কম জজসাহেব নেই।
এই প্রশংসার কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না ডন। জানতে চাইলেন, শতকরা কত পাব আমরা?
চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল সলোযোর। আধাআধি- ভাগ হবে, একটু বিরতি নিল সে, তারপর মোলায়েম সুরে ফিসফিস করে বলল, ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ ডলার পাবেন প্রথম বছর। এরপর বাড়তেই থাকবে।
টাটাগ্লিয়ারা কত পাবে?
কেমন যেন অপ্রতিভ দেখাল সলোযোকে। ওদেরকে আমি নিজের ভাগ থেকে কিছু দেব। এ-কাজে ওদের কাছ থেকে একটু সহযোগিতা পেতে হবে আমাকে।
শুধু টাকা জোগাব আর আইনকে ঠেকিয়ে রাখব, কার্যকরী দিকটা নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, বিনিময়ে পাব লাভের আধাআধি বখরা-ঠিক এই কথা বলতে চাইছেন আপনি, তাই না?
দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সলোযো, বলল, বিশ লক্ষ ডলার দেয়াকে শুধু টাকা জোগানোর মত ছোট করে দেখতে পারছি না আমি। আপনার কাছে ব্যাপারটা যদি তাই হয়, আপনাকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই, ডন কর্লিয়নি।
অটল এবং শান্ত দেখাচ্ছে ডনকে। মৃদু কণ্ঠে কথা বলছেন তিনি। টাটাগ্লিয়াদের ওপর আমার শ্রদ্ধা আছে, তাই আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম–অবশ্য আমি,শুনেছি যে আপনি নিজেও একজন সম্মানীয় ভদ্রলোক। আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না আমি-কেন, তাও বলছি। আপনার এই ব্যবসায় খুব বেশি লাভ, খুব বেশি ঝুঁকি। এর সাথে নিজেকে জড়ালে আমার অন্য সব ব্যবসা বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। রাজনীতিক বন্ধুদের সংখ্যা আর্মার কম নয় সত্যি, কিন্তু জুয়ার বদলে যদি ড্রাগের ব্যবসা ধরি, এদের কজন আমার সত্যিকার বন্ধু থাকবে, বলা কঠিন। ড্রাগের কারবার-বড় নোংরা ব্যাপার, সলোযো কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলে তাকে বাধা দিলেন তিনি, বললেন, না, না, বাধা দেবেন না। আমি নিজের মতামত দিচ্ছি না, ওদের দৃষ্টি ভঙ্গির কথা বলতে চাইছি। কে কিভাবে রোজগার করে বেঁচে থাকে তা ভেবে সময় নষ্ট করি না আমি। আমার বক্তব্য হলো আপনার ব্যবসায় বড় বেশি ঝুঁকি, লোভে পড়ে আমার পরিবারকে বা পরিবারের জীবিকাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারি না আমি।
চকিতে সনি কর্লিয়নি এবং টম হেগেনের দিকে একবার করে তাকাল সলোযো, এটা ছাড়া তার নৈরাশ্যের কোন লক্ষণ প্রকাশ পেল না। তাকে সমর্থন করে ওরা কেউ কিছু বলুক, এই রকম একটা সূক্ষ্ম আবেদন ফুটে উঠল তার তাকাবার ভঙ্গিতে। তারপর ডনকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বিশ লাখের নিরাপত্তা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন?
নিরুত্তাপ একটু হাসি দেখা দিল ডনের ঠোঁটে। না।
তবু আরেকবার বলল সলোযো, টাটাগ্লিয়ারা আপনার বিশ লাখেরও গ্যারান্টি দেবে।
ঠিক এই সময় অমার্জনীয় ভুল করে বসল সনি। সাগ্রহে জানতে চাইল সে, কোন সুদ না নিয়েই আমাদের পুঁজি ফেরত দেবার জামিন হবে ওরা?
চালে ভুল করে হেগেনকে একেবারে স্তম্ভিত করে দিল সনি। ক্ষোভে, ভয়ে, বিস্ময়ে নিষ্প্রাণ শুকনো কাঠ হয়ে গেল সে। দেখতে পেল, বরফের মত ঠাণ্ডা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন ডন কর্লিয়নি, দৃষ্টিতে বাঘের চাপা আক্রোশ।
চোখ দুটো আরেকবার অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করে উঠল ভার্সিল সলোযোর, এখন সেখানে সন্তুষ্টির ভাব ঝিলিক দিচ্ছে। ডন কর্লিয়নির দুর্গম দুর্গ প্রান্তদের দেয়ালে ফাটল দেখতে পেয়েছে সে, সেটাই তাকে পুলকিত, উল্লসিত করে তুলেছে।
এরপর যখন মুখ খুললেন ডন, তার গলার সুর থেকে বিদায়ের বার্তা পেল সনোযো। তিনি বললেন, অল্পবয়েসীদের লোভ বেশি, এবং ভদ্রতাবোধ নেই বলে বড়দের কথায় নাক গলায়। ছেলেমেয়েদেরকে আবেগ দিয়ে ভালবাসা উচিত নয়, আমি যেমন ঠিক তাই করে মাথায় তুলে ফেলেছি–নিজের চোখেই তো দেখলেন সব। আমার উত্তরটাই একমাত্র উত্ত, সিনর সলোযো।
সৌজন্য প্রকাশে ত্রুটি করল না সলোযো। রীতি মোতাবেক বো করল সে, করমর্দন সারল, তারপর হেগেনের সাথে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল গাড়িতে ওঠার জন্যে। বিদায় দেবার সময়ও তার চেহারায় ভাবের কোন প্রকাশ দেখল নহেগেন।
হেগেন কামরায় ফিরে আসতেই ডন জানতে চাইলেন, কেমন মনে হলো লোকটাকে তোমার?
একজন সিসিলীয়, তিক্ত সুরে বলল হেগেন।
চিন্তিতভাবে মাথা ঝাঁকালেন ডন। তারপর ছেলের দিকে ফিরে তীক্ষ্ণ চাপা গলায় বললেন, কত বড় ভুল করেছ তা তুমি নিজেও জানে না। মনের কথা পরিবারের বাইরে কাউকে কখনও জানতে দিতে নেই। অল্পবয়েসী মেয়েটার সঙ্গ শ্রাগ করো, ওসব করে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছ তুমি। এবার একটু কাজ শেখো-এবং এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।
নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সনি।
হেগেন এক গ্লাস অ্যানিসেট দিল ডনকে। চোখ তুলে তিনি বললেন, লুকা ব্রাসিকে খবর দাও তার সাথে আমি দেখা করতে চেয়েছি।
.
তিনমাস পরের ঘটনা।
অফিসে বসে তাড়াহুড়োর মধ্যে কাজ সারছে হেগেন, ইচ্ছা স্ত্রী আর ছেলে মেয়েদের জন্যে বড়দিনের কেনাকাটা করতে বেরুবে। প্রথম বিঘ্ন সৃষ্টি করল জনি ফন্টেন, টেলিফোনের এ প্রান্ত থেকেও বোঝা গেল আনন্দে একেবারে আটখানা হয়ে আছে সে। জামাল, ছবির শুটিং শেষ। এমন একটা উপহার পাঠাচ্ছে, যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে ডনের। জিনিসটা কি? দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে অধৈর্য হয়ে উঠলেও কৌতূহলটা দমন করতে পারল না হেগেন। তা বলা যাবে না! গলা ছেড়ে একচোট হো হো করে হেসে নিল জনি। বড় দিনের মজাটাই তো ওখানে?
একটু পর হেগেনের সেক্রেটারি এসে জানাল কনি কর্লিয়নি টেলিফোন করেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হেগেন ভাবল, বিয়ের পর থেকে বড় জ্বালাতন করছে কনি। স্বামীর নামে নালিশ ছাড়া কথা নেই ওর মুখে। ঝগড়া-ঝাটি করে বাপের বাড়ি চলে আসে, কদিন কাটিয়ে তারপর আবার যায়। আর স্বামী কার্লো রিটসিও অকর্মার ধাড়ী। ভাল একটা ব্যবসায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে, কিন্তু সেটারও সে বারোটা বাজাচ্ছে। বৌকে তো মারধোর করেই, তাছাড়া জুয়া খেলে, বেশ্যাবাড়ি যায়, বেসামাল মদ খায়। এসব কথা বাপের বাড়ির আর কাউকে নয়, শুধু হেগেনকে বলেছে কনি। আজ আবার বোধহয় নতুন কোন দুঃখের কাহিনী শোনাতে চাইছে মেয়েটা, ভাবল হেগেন।
কিন্তু না, কনি শুধু জানতে চাইল, বড়দিনে কি উপহার দিয়ে খুশি করা যেতে পারেবাবাকে। জানতে চাইছে সনি, ফেউ আর মাইকেলকেই বা কি দেয়া যায়? মায়ের উপহারটা আগেই ঠিক করে রেখেছে সে। হেগেনের একটা পরামর্শও পছন্দ হলো না তার, তাই টেলিফোন ছেড়ে দিল তাড়াতাড়ি।
এরপর আবার একটা ফোন এল। চুলোয় যাক সব, কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে ভাল হৈগেন। অফিস থেকে কেটে পড়বে এবার সে। কিন্তু টেলিফোনটা না ধরে এড়িয়ে যাবার কথা একবারও ভাল না। সেক্রেটারি এসে জানাল ফোনে ডাকছে মাইক কর্লিয়নি।মনটা খুশি হয়ে উঠল এবার হেগেনের। মাইককে ওর খুব ভাল লাগে। ১ টম, টেলিফোনে বলল মাইকেল কর্লিয়নি, বড় দিনের আগেই জরুরী একটা কথা বলতে চাই বাবাকে। কে-কে নিয়ে কাল আমি শহরে যাচ্ছি, বাবা বাড়িতে থাকবেন তো?
তা থাকবেন, বলল হেগেন। তোমার জন্যে কিছু করার আছে আমার?
ডনের মতই তার এই ছোট ছেলেটির স্বভাব খুব চাপা। সে বলল, না। ধন্যবাদ, টম। বড় দিনে দেখা হবে, কেমন? লং বীচে সবাই থাকবে তো?
থাকবে, বলল হেগেন। গল্প-গুজবের ধার দিয়ে না গিয়ে মাইক রিসিভার নামিয়ে রাখতে মৃদু একটু হাসল সে।
বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু তার জন্যে যেন খাবার রাখা হয়, এই কথাটা স্ত্রীকে জানাবার দায়িত্ব সেক্রেটারিকে দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল হেগেন। মেসির দোকানের দিকে হাঁটছে সে, একজন লোক ওর সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। সবিস্ময়ে হেগেন দেখল লোকটা সলোযো।
হেগেনের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল সলোযো, বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই তোমাকে। ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা গাড়ির দরজা ঝট করে খুলে গেল এই সময়। উঠে পড়ো গাড়িতে, ব্যস্তভাবে বলল সে। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল হেগেন। ঘাবড়ায়নি সে, ভয়ও পায়নি, শুধু বিরক্ত হয়েছে। এখন আমি সময় দিতে পারব না।
এই সময় পিছনে দুই জোড়া বুট জুতোর শব্দ কানে ঢুকল হেগেনের। নিমেষে সব বুঝে ফেলল সে। হঠাৎ অবশ, দুর্বল হয়ে উঠল তার পা দুটো।
নরম সুরে বলল সলোয়য, উঠে পড়ো। আমরা চাইলে এতক্ষণে তুমি মরে যেতে। তেমন কোন ইচ্ছে আমাদের নেই, বুঝতেই পারছ। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
সলোযোকে বিশ্বাস না করেই গাড়িতে উঠল হেগেন।
.
হেগেনকে সত্যি কথাটা বলেনি মাইকেল কর্লিয়নি। নিউ ইয়র্কে আসলে সে আগেই পৌচেছে, ফোন করেছিল হোটেল পেনসিলভেনিয়ার একটা কামরা থেকে।
মাইকেল রিসিভার নামিয়ে রাখছে, ওর দিকে চোখ রেখে অ্যাশট্রেতে গুঁজে নিভিয়ে দিচ্ছে সিগারেটটা কে অ্যাডামসু, বলল, বাহ, চমৎকার মিথ্যে কথা বলতে পারো তো!
বিছানায় ওর পাশে বসল মাইকেল। পারি, বলল সে, শুধু তোমার জন্যে। বাড়ির ওরা যদি জানে এখানে রয়েছি আমরা, এক্ষুণি, ডেকে পাঠাবে। ডিনার, থিয়েটার, একসাথে ঘুমানো-চুলোয় যাবে সব। বিয়ের আগে এসব আমাদের বাড়িতে চলে না। কে-কে জড়িয়ে ধরল মাইকেল, আলতোভাবে একটা চুমো খেলো তার ঠোঁটে।
ধীরে ধীরে কে-কে বিছানার উপর শুইয়ে দিল মাইকেল। আদর পাবার উন্মুখ প্রত্যাশায় চোখ বুজে অপেক্ষা করছে কে। বড় মিষ্টি মুখ, অপার আনন্দে ভরাট মনে ভাবছে মাইকেল, যুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলোয় ঠিক এই রকম মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ের স্বপ্ন দেখত সে। কে-কে পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে ও। জীবনের একটা দিবে সার্থকতা এসেছে ওর।
ডিনার খেয়ে থিয়েটার দেখতে যাবে, তার আগে পর্যন্ত সময়টা মত্ত আবেগে প্রেম করে কাটাল ওরা।
বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখল উজ্জ্বল আলোকমালায় চারদিক ঝকমক করছে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো উপচে পড়ছে ক্রেতার ভিড়ে। মাইক জানতে চাইল, বড়দিনের কি উপহার নেবে তুমি?
শুধু তোমাকে নেব, গাড়িতে মাইকের গা ঘেঁষে, তার একটা কাঁধে মাথ রেখে বলল কে। তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করবেন বলে মনে হয়?
মৃদু গলায় বলল মাইকেল, সেটা বড় কথা নয়। তোমার মা বাবা আমাকে কিভাবে নেবেন, আমি তাই ভাবছি।
মাথা তুলল কে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, যেভাবেই নিক, তাতে কিছু এসে যায় না।
আইনগত অধিকার নিয়ে নিজের নাম বদল করার কথাও ভেবেছি, বলল মাইকেল। কিন্তু কিছু যদি ঘটে, নাম বদলেও লাভ হবে না। তারপর ঠাট্টার সুরে জানতে চাইল, সত্যি তুমি কর্লিয়নি নামটা দিতে চাও?
প্রশ্নটাকে গাম্ভীর্যের সাথে নিল কে; দৃঢ় স্বরে বলল হ্যাঁ।
বড়দিনের হপ্তাটা শেষ হবার আগেই বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে ওরা। দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে গোপনে সারা হবে কাজটা। মাইকেল ভাবছে, ব্যাপারটা বাবাকে অন্তত জানানো দরকার। কিন্তু নিজের মা বাবা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে কে-র। শুনেই ওরা ভাববে আমি অন্তঃসত্ত্বা, মাইকেলকে বলেছে সে।
মুচকি হেসে মাইকেল বলেছে, আমার ওরাওঁ তাই ভাববে, সন্দেহ নেই।
গীতি নাটক দেখে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা, মাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে সে বলল, বিয়ের পর কি পেটাবে তুমি আমাকে, আর তারপর আকাশ থেকে পেড়ে এনে চাঁদ তারা উপহার দেবে?
হাসল মাইকেল, বলল, আমার উচ্চাশার কথা বলা হয়নি তোমাকে! গণিতের অধ্যাপক হব আমি। তারপর জানতে চাইল, হোটেলে ফেরার আগে কিছু খাবে নাকি?
মাথা নাড়ল কে। মাইকেলের চোখে চোখ রেখে অকারণ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সে, মৃদু একটু শিউরে উঠল শরীরটা। সে পুলক অনুভব করছে, বুঝতে একটুও দেরি হলো না মাইকেলের। শীত লাগছে ওর। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল কে কে, তারপর চুমো খেলো।
হোটেলের লবিতে পৌঁছে নিউজপেপার স্ট্যান্ডের দিকে কে-কে ঠেলে দিয়ে বলল মাইকেল, তুমি কাগজ কেননা, আমি চাবি আনতে যাচ্ছি।
চাবি নিয়ে ফিরতে একটু দেরি হলো মাইকেলের। অনেক লোকের ভিড় লবিতে, অধৈর্যের সাথে কে-কে খুঁজছে সে।
হাতে খবরের কাগজ নিয়ে এক ধারে দাঁড়িয়ে আছে কে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাইকেলের দিকে। ওকে দেখতে পেয়েই পা চালিয়ে এগিয়ে এল মাইকেল।
কে-এর দুচোখ থেকে টপ টুপ করে দুফোঁটা পানি ঝরে পড়ল লবির মেঝেতে। মাইক! ও মাইক! ফুঁপিয়ে উঠল সে।
ছোঁ মেরে কাগজটা নিল মাইকেল, চোখের সামনে তুলেই দেখল বাবার ছবি, রাস্তার উপর খানিকটা রক্তের মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন তিনি। ছবিতে আরও দেখা যাচ্ছে, ফুটপাথ ঘেষে বসে কাঁদছে একজন লোক-মাইকেলের মেজো ভাই সে, ফ্রেডি। সাংঘাতিক একটা শীত অনুভব করছে মাইকেল-ভয় বা শোকে নয়, প্রচণ্ড আক্রোশ আর ক্রোধে। চাপা কণ্ঠে বলল ও, ঘরে চলো। কিন্তু হাত ধরে লিফটের কাছে নিয়ে যেতে হলো কে-কে। লিফটে উঠে কথা বলল না ওরা।
কামরায় ঢুকে খাটে বসল মাইকেল, কাগজটী খুলে পড়তে শুরু করল। হেডিংটা বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে-তথাকথিত চোরাকারবারী ভিটো কলিয়নি গুলিতে আহত। কড়া পুলিশ প্রহরায় অস্ত্রোপচার। ব্যাপক রক্তক্ষয়ী গুণ্ডা-যুদ্ধের আশঙ্কা।
পায়ে জোর পাচ্ছে না মাইকেল। বাবা মারা যাননি। বাবাকে ওরা মেরে ফেলতে পারেনি, বিড়বিড় করে বলল ও। খবরটা পড়ল আরেকবার। বিকেল পাঁচটায় গুলি খেয়েছেন ডন। তারমানে, ভাবছে মাইকেল, কে-এর সাথে সে যখন, প্রেম করছিল, ডিনার খাচ্ছিল, নাটক উপভোগ করছিল বাবা তখন গুলি খেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলেন। সাংঘাতিক অপরাধী মনে হলো নিজেকে তার।
আমরা হাসপাতালে যাব? জানতে চাইল কে।
আগে বাড়িতে ফোন করা দরকার, বলল মাইকেল। বাবা বেঁচে গেছেন, শত্রুরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠবে। বুঝতে পারছি না কি চাল দেরে এখন ওরা।
বাড়ির দুটো টেলিফোনই এনগেজড, লাইন পাবার জন্যে বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো মাইকেলকে। হ্যাঁ, বলুন,শেষ পর্যন্ত সনির গলা পেল সে।
সনি, আমি মাইকেল।
বিরাট একটা হাঁফ ছাড়ল অপর প্রান্তে সনি, বলল, ও ভাই, বাঁচালি! তোর জন্যে কি দুশ্চিন্তাটাই না করছিলাম সবাই। কোথায় যে থাকিস! সেই গ্রামে লোক পাঠিয়েছি তোর খবর নিতে।
এসব কথার উপর কোন মন্তব্য করল না মাইকেল। কেমন আছেন বাবা? জানতে চাইল সে। বেশি লেগেছে?
বেশি মানে? সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর লেগেছে! বলল সনি। পাঁচ পাঁচটা গুলি খেয়েছেন বাবা। তবে দুর্বল তো আর নন! গর্বের সুর ফুটে উঠল তার বলার ভঙ্গিতে। ডাক্তাররা সবাই বলছে সেরে উঠবেন। তুই কোথায় বল তো? সাংঘাতিক ব্যস্ত আমি, কথা বলতে পারছি না…।
নিউ ইয়র্কে, বলল মাইকেল, কেন, আমি আসছি একথা বলেনি টম?
কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল সনি,টমকে হাইজ্যাক করেছে ওরা। সেজন্যেই তোর কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। টমের স্ত্রী এখানে রয়েছে, কিন্তু সে বা পুলিশ এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। ওরা জানুক তা চাইছি না আমি। এ কাজ যারা করেছে তারা নিশ্চয়ই পাগল। এক্ষুণি আসছিস তো? সাবধান, মুখ খুলবি না। কিছু বলবি?
না, বলল মাইকেল। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে সংক্ষেপে জানতে চাইল সে, কারা, সনি?
জানি কারা, বলল সনি। লুকা ব্রাসিকে শুধু বলার অপেক্ষা, তারপরই দোকানে ঝোলানো মাংস হয়ে যাবে। ঘুটি সব এখনও আমাদের হাতে।
ট্যাক্সি নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি, বলে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল মাইকেল।
চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। ভাবছে। সনির কথায় বোঝা গেল লুকা ব্রাসি খবর পায়নি এখনও। কেন?
খবরের কাগজগুলো প্রেস থেকে ছেপে বেরুবার পর তিন ঘণ্টার বেশি পেরিয়ে গেছে। খবরটা নিশ্চয়ই রেডিওর মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে।.তবু লুকার কানে খবর যায়নি, তা কেমন করে হয়।
ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না মাইকেল। ভাবছে আর ভাবছে। কোথায় সে? কোথায় গেল লুকা ব্রাসি?
ঠিক তখন ঠিক এই প্রশ্নটা নিয়েই ভাবছে টম হেগেন।
লং বীচে সনিকর্লিয়নিও তাই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে–লুকার হলো কি?
.
সেদিন বিকেলের ঘটনা।
জলপাই তেল কোম্পানির ম্যানেজারের তৈরি করা হিসাবের কাগজ-পত্র দেখা শেষ করে ডন কর্লিয়নি যখন উঠলেন তখন পৌনে পাঁচটা বাজে। কোটটা গায়ে চড়িয়ে মেজো ছেলের মাথায় আস্তে একটা গাট্টা মারলেন তিনি, বললেন, গাড়ি নিয়ে আসতে বলো গাটোকে। বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি আমি।
বিরক্তির সাথে বলল ফ্রেডি, সেই আমাকেই গাড়ি আনতে যেতে হবে। সকালে ধ্ৰুলি জানিয়েছে শরীর খারাপ তার, ফের সর্দি লেগেছে।
একটু চিন্তিত হলেন ডন কর্লিয়নি, বললেন, এই মাসে পরপর তিনবার শরীর খারাপ করল ওর। টমকে বলবে এ-কাজের জন্যে ভাল স্বাস্থ্যের একজন লোক চাই।
সরল মনে ফ্রেডি বলল, পলি কিন্তু ভাল ছেলে। অসুখের নাম করে কঁকি, দিচ্ছে, তা নয়। নিশ্চয়ই শরীর খারাপ হচ্ছে ওর। গাড়ি নিয়ে আসা, এতে আর কষ্ট কি! অফিস কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে।
হেগেনের অফিসে ফোন করলেন ডন কর্লিয়নি, কিন্তু তাকে পেলেন না। ফোন করে বাড়ি থেকেও কারও সাড়া পেলেন না। বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে। তাকালেন তিনি। দালানের সামনে গাড়ি নিয়ে এসেছে ফ্রেডি দেখতে পেলেন। ফেণ্ডারে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত দুটো ভাজ করে অপেক্ষা করছে সে।
ওভারকোট পরতে ডনকে সাহায্য করল ম্যানেজার। মৃদু গলায় ধন্যবাদ জানিয়ে দরজার দিকে এগোলেন তিনি। দুই প্রস্থ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন, তারপর বেরিয়ে এলেন রাস্তায়।
শীতের ছোট দিন, এখুনি কমে এসেছে দিনের আলো বাবাকে দেখে সিধে হয়ে দাঁড়াল ফ্রেডি, তারপর বুইকটাকে ঘুরে ওপাশের দরজা দিয়ে ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল।
ফুটপাথ থেকে গাড়িতে উঠতে গিয়ে একটু ইতস্তত করছেন ডন কর্লিয়নি। শেষ পর্যন্ত উঠলেন না গাড়িতে। মোড়ের কাছাকাছি ফলের একটা দোকান, সেদিকে এগোচ্ছেন।
অসময়ের ফল, দেখতে বড় ভাল লাগছে ডন কর্লিয়নির। সবুজ রঙের বাক্সে সাজানো হলুদ পীচ, কমলালেবু জুলজুল করছে। এই দোকানটার দিকে পা বাড়ানো আজকাল একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার। তাঁকে দেখে একেবারে লাফ দিয়ে উঠল দোকানের মালিক। হাত দিয়ে না ছুঁয়ে আঙুল তুলে ফলগুলো দেখাচ্ছেন তিনি। তার বাছাইয়ের সমালোচনা করে একবার শুধু দোকানদার দেখিয়ে দিল একটা ফলের নিচের দিকে পচন ধরেছে। কাগজের ঠোঙাটা বাঁ হাতে নিয়ে দোকানদারকে পাঁচ ডলারের একটা নোট দিলেন তিনি। কি পয়সা ফেরত নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবেন, ঠিক এই সময় রাস্তার বাঁকে হাজির হলো দুজন লোক। ওদেরকে দেখামাত্র বুঝলেন তিনি, এবার কি ঘটবে।
কালো ওভারকোট পরে আছে ওরা। কপালের উপর টেনে নামানো কালো টুপি, চেহারা যাতে চিনতে পারা না যায়। ডনকর্লিয়নি সতর্ক হয়ে উঠবেন, তা ওরা ভাবতেই পারেনি। নিমেষে বিদ্যুৎ খেলে গেল ডন কর্লিয়নির শরীরে। এমন ভারি একজন মানুষ, কিন্তু তার কি আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা! ফলের ঠোঙা ফেলে দিয়ে ঝড়ের বেগে দৌড়াচ্ছেন গাড়ির দিকে। সেই সাথে চিৎকার করে সতর্ক করছেন ছেলেকে, ফ্রিডো! ফ্রিডো!
এতক্ষণে হুঁশ ফিরুল আততায়ীদের, সাথে সাথে পিস্তল তুলে গুলি করতে শুরু করল ওরা।
প্রথম গুলির আঘাতটা হাতুড়ির বাড়ির মত পিঠে অনুভব করলেন ডন কর্লিয়নি। কিন্তু কিছুই হলো না তার, এখনও তিনি দৌড়াচ্ছেন গাড়ির দিকে। এরপর একই সাথে দুটো গুলি বিদ্ধ করল তাকে। দুটোই লাগল নিতম্বে। ছিটকে রাস্তার একধারে পড়ে গেলেন তিনি।
রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছে ঠোঙার ফলগুলো, সেগুলোয় পা লেগে পিছলে যাবার ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে আসছে আততায়ীরা। কাছে এসে পড়েছে। ডন কৃর্লিয়নিকে এবার ওরা শেষ করার জন্যে গুলি করতে যাচ্ছে।
ডন কর্লিয়নি ছেলের নাম ধরে ডাকার পর ইতিমধ্যে মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পেরিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে ছাদের উপর দিয়ে উঁকি মেরে ব্যাপারটা কি বোঝার বা দেখার চেষ্টা করেছে সে।
কাছ থেকে আততায়ীদের হাতের পিস্তল গর্জে উঠল আবার। একটা গুলি ডনের মাংসল বাহুতে, অপরটা ডান পায়ের গোড়ালিতে লাগল। তার শরীরের পাশে রক্তের ছোট ছোট পুকুর তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন।
নার্ভাস হয়ে গাড়ি থেকে নামার সময় শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করেনি ফ্রেডি। খুনীরা ইচ্ছে করলে মেরে ফেলতে পারে তাকে। কিন্তু ফ্রেডির কাছে পিস্তল আছে ভেবে, এবং এমনিতেই কাজটায় দেরি হয়ে গেছে বলে ওরা আর সময় নষ্ট না করে ছুটে পালাতে শুরু করল, চোখের পলকে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। রক্তাপ্লুত বাপকে নিয়ে রাস্তায় ফ্রেডি একা।
পথিকরা সবাই এখানে সেখানে গা ঢাকা দিয়েছে, কেউ কেউ সটান শুয়ে পড়েছে রাস্তার উপর। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ফ্রেডি। লাল, রক্তের পুকুরে নিঃসাড় পড়ে থাকা বাপের দিকে বুদ্ধর মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। ইতিমধ্যে রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। টলে পড়ে যাচ্ছে দেখে কেউ একজন তাকে ধরে বসিয়ে দিল ফুটপাথের কিনারায়।
ভিড় জমে গেছে রাস্তায়। তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজ তুলে ঝড়ের বেগে ছুটে এল পুলিশের প্রথম গাড়িটা। সেটার পিছনেই ডেইলি নিউজের রেডিও কার। কারটা তখনও থামেনি, লাফ দিয়ে নেমে রক্তাক্তনকর্লিয়নির ছবি তুলছে ফটোগ্রাফার।
অ্যাম্বুলেন্স এল আরও একটু পর। ফ্রেডি কাঁদছে, এবার তার উপর নজর পড়ল ফটোগ্রাফারের। বড় সড় মুখ, পুরু ঠোঁট, বিরাট নাক, অথচ চেঁচিয়ে কাঁদছে লোকটা-দৃশ্যটা মজার বলে মনে হলো ফটোগ্রাফারের।
একের পর এক আরও কয়েকটা পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছুল। ফ্রেডির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল একজন ডিটেকটিভ, জেরা করছে তাকে। হতভম্ব ফ্রেডি অবশ্য তার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারল না। অবস্থাটা বুঝতে পেরে নিজেই তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে নিল ডিটেকটিভ। তারপর শিস দিয়ে কাছে ডাকল সহকারীকে।
এক মুহূর্ত পর সাদা পোশাক পরা একদল ডিটেকটিভ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল ফ্রেডিকে। তার শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে নেয়া হলো পিস্তলটা। তারপর দাঁড় করানো হলো তাকে, নাম্বার প্লেটহীন একটা গাড়িতে ভোলা হলো, ভিড়ের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেল গাড়িটা। সেটাকে অনুসরণ করল রেডিও কার।
.
ডন কর্লিয়নি গুলি খাবার আধঘণ্টার মধ্যে পর পর পাঁচটা টেলিফোন পেল সনি কর্লিয়নি। ডিটেকটিভ জন ফিলিপস ওদের টাকা খায়, সেই করল প্রথম টেলিফোন। পুলিশের প্রথম গাড়িতে চড়ে অকুস্থলে গিয়েছিল সে।
আমার গলা চিনতে পারছ? জানতে চাইল ফিলিপস।
পারছি, বলল সনি। এইমাত্র ঘুম থেকে তুলেছে তাকে স্ত্রী। শরীরটা তাজা ঝরঝরে।
কোন ভূমিকা করল না ফিলিপস। বলল, অফিসের বাইরে কেউ তোমার বাবাকে গুলি করেছে। এই মিনিট পনেরো আগে। ফ্রেঞ্চ হাসাপাতালে আছেন উনি। আঘাতগুলো মারাত্মক। ফ্রেডিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছেচেলসি থানায়, ছাড়া পেলেই একজন ডাক্তারকে দিয়ে ওকে পরীক্ষা করিয়ে নিলে ভাল হয়। আমি এখন হাসপাতালে যাচ্ছি, যখন যা খবর হয় জানাব তোমাকে।
স্বামীর চেহারা লাল, ৰীভৎস হয়ে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে গেল সা; ফিসফিস করে জানতে চাইল, কি হয়েছে?
অধৈর্যের সাথে স্ত্রীকে চুপ করতে ইশারা করে সনি প্রশ্ন করল, বাবা বেঁচে আছেন কিনা ঠিক জানো?
জানি, বলল ফিলিপস। মারাত্মক ভাবে আঘাত পেয়েছেন, তবে বেঁচে আছেন।
ধন্যবাদ। হাজার ডলার পাবে,কাল সকালে। বাড়ি থেকো।
ফোন নামিয়ে রেখে নিজেকে স্থির রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে,সনি। জানে, প্রচণ্ড রাগই হলো ওর নিজের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এবং এটা এমন একটা অভাবিত পরিস্থিতি যখন এই রাগই গোটা পরিবারটার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
সবচেয়ে আগে দরকার টমকে খবর দেয়া। ফোনের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছে সনি, ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল সেটা। ঘোড়দৌড়ের একজন বুক মেকারের ফোন, টাকা দিয়ে ডনের অফিস এলাকায় রাখা হয়েছে তাকে। জানাল, ডন কর্লিয়নি মারা গেছেন। সনি জেরা করে বুঝল বুক মেকারকে যে খুবরটা দিয়েছে সে ডনের কাছাকাছি যায়নি। ডিটেকটিভ ফিলিপসের খবরটাই সত্যি, নতুন খবরটাকে গুরুত্ব দিল না সে। এরপরই ফোন করল ডেলি নিউজের রিপোর্টার। সে নিজের পরিচয় দিতেই যোগাযোগ কেটে দিল সনি।
এবার হেগেনের বাড়িতে ফোন করল সে। টম ফিরেছে?
না।
হেগেনের স্ত্রীকে বলল সনি, টম বাড়ি ফিরলেই আমাকে যেন ফোন করে।
নিঃশব্দে বসে ভাবছে সনি। কাজটা যে সলোযোর তা সে প্রথমেই ধরে নিয়েছে। কিন্তু ডনের মত মহারথীকে আক্রমণ করার দুঃসাহস তার থাকতে পারে না। তার মানে একাজে অন্যান্য ক্ষমতাবানদের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে সে।
আবার টেলিফোন। অপরপ্রান্তের কণ্ঠস্বর আশ্চর্য নরম আর অস্বাভাবিক শান্ত লাগল সনির কানে। কে, সান্তিনো কর্লিয়নি?
বলছি।
টম হেগেন আমাদের হাতে, অপর প্রান্ত থেকে বলছে লোকটা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তাকে, আমাদের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে সে। আগে তার মুখ থেকে আমাদের বক্তব্য শুনুন, তার আগে কিছু করে বসবেন না, তাতে শুধু অশান্তিরই সৃষ্টি হবে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এবার মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুদ্ধিমানের মত নির্দেশ মেনে চলতে হবে সবাইকে। দয়া করে আপনার সেই বিখ্যাত রাগটা দেখাবেন না! কণ্ঠস্বরে মৃদু ব্যঙ্গের সুর। সনির মনে হলো, গলাটা সলোযোর হতে পারে।
নিচু, ম্লান সুরে সে বলল, বেশ। ক্লিক করে একটা শব্দ হলে সাথে সাথে। চট করে রিস্টওয়াচটা দেখে নিল সে, তারপর টেলিফোন কলটার নির্দিষ্ট সময় টেবিল কুথের উপর লিখে রাখল।
রান্নাঘরের টেবিলে মাথা নিচু করে বসে ভাবছে সনি।
কি হয়েছে, সনি? জানতে চাইল সাণ্ডা।
স্ত্রীর দিকে তাকাল সনি। বাবাকে গুলি করেছে ওরা, শান্ত ভাবে বলল সে। কিন্তু সাণ্ডার মুখ বিকৃত হয়ে উঠছে দেখে মারমুখো হয়ে উঠে কর্কশ গলায় আবার বলল, চেঁচামেচিকোরো না, বাবা বেঁচে আছেন। ভয়ের আর কিছু নেই।
আবার ফোন এসেছে।
মোটাসোটা ক্লেমেঞ্জা হাঁপাচ্ছে অপর প্রান্তে। তোমার বাবার খবর পেয়েছ?
তবে মারা যাননি তিনি, বলল সনি। তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙল ক্লেমেঞ্জাই, আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠছে তার কণ্ঠস্বর। থ্যাঙ্ক গড! থ্যাঙ্ক গড! পরমুহূর্তে উদ্বেগের সাথে বলল, ঠিক খবর পেয়েছ? আমি শুলাম।
বাবা বেঁচে আছেন, বলল সনি। ক্লেমেঞ্জা র প্রতিটি উচ্চারণের উত্থান পতন, স্বরের সূক্ষ্ম ভাব ইত্যাদি গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে চেষ্টা করছে সে। আবেগটাকে খাঁটি বলেই মনে হলো তার। কিন্তু সেই সাথে একথাও মনে পড়ে গেল যে ভাল অভিনয় করাটা এই লোকের কাজেরই একটা অঙ্গ।
খেলা এবার তোমাকে চালিয়ে যেতে হবে, বলল ক্লেমেঞ্জা। কি করতে হবে বলে দাও আমাকে।
বাবার বাড়িতে চলে যাও তুমি, পলি গাটোকে ডেকে নাও।
হাসপাতালে আর তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠাতে হবে না?
না, বলল সনি। শুধু তোমাকে আর পলি গাটোকে চাই আমি।
আবার দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকল ওরা। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করছে ক্লেমেঞ্জা।
পরিবেশটাকে একটু স্বাভাবিক করার জন্যে আবার বলল সনি, সে হারামজাদা করছেটা কি? গেছে কোথায়?
এখন আর হাঁপাচ্ছে না ক্লেমেঞ্জা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কথা বলছে সে। সর্দি লেগেছে বলে বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি পলি। শীতকালটা অসুখ বিসুখেই কাটল ওর।
হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল সনি। গত দুমাসে কবার বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি ও, জানো?
বেশ কয়েকবার তো হবেই,বলল ক্লেমেঞ্জা। আমি তো হাজার বার জিজ্ঞেস করেছি অন্য লোক দরকার কিনা; কিন্তু ফ্রেডির একই উত্তর, দরকার নেই। বিপদ আপদ দেখা দেয়নি, দশটা বছর নির্বিমে কেটেছে, তাই তেমন গুরুত্ব দিইনি
হু, বলল সনি। পলিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে এসো, ওখানে দেখা হবে। রিসিভারটা খটাং করে রেখে দিল সে।
খুঁপিয়ে কাঁদছে সাণ্ডা, তার দিকে তাকিয়ে বেসুরো গলায় বলল সনি, নিজেদের লোক ফোন করলে বাবার ব্যক্তিগত নাম্বারে পাওয়া যাবে আমাকে। আর কেউ ফোন করলে কিছু জানো বলে স্বীকার করবে না। টমের স্ত্রীকে বলবে, কাজে বেরিয়েছে, ফিরতে দেরি হবে টমের। একটু চিন্তা করল সে, তারপর আবার বলল, দুজন লোককে এখানে রেখে যাচ্ছি। সাার চোখে ভয় দেখে বিরক্ত হলো সে। ভয় পেয়ো না, বেশি, অস্থির হয়ো না-খুব জরুরী না হলে ফোন কোরো না আমাকে।
বাইরে বেরিয়ে এল সনি। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ডিসেম্বরের শীতল বাতাস ছুটোছুটি করছে প্রাঙ্গণ জুড়ে। রাতে একা বেরিয়ে একটুও ভয় পেল না সনি। এবানের সবগুলো, অর্থাৎ আটটা বাড়ির মালিক তারাই। প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে দুপাশের বাড়ি দুটো পারিবারিক অনুচরদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে, স্ত্রী পুত্র আর অতিথিদের নিয়ে থাকে তারা। এইসব বিশেষ অতিথিদের কোন পিছুটান নেই, সবাই তারা হাত পা ঝাজা পুরুষ মানুষ। এরা থাকে বেসমেন্টে। অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো বাকি ছয়টার একটছবাড়িতে সপরিবারে থাকে টম হেগেন, আরেকটাতে থাকে সনি। ছোট এবং সাদাসিঁধে বাড়িটিতে থাকেন ডন। অপর বাড়িগুলোতে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেয়া হয়েছে ডনর অবসর প্রাপ্ত বন্ধুদেরকে। তবে ডন চাইলেই তারা বাড়ি খালি করে দেবে। নিরীহুদর্শন বিশাল প্রাঙ্গণটা আসলে একটা দুর্গম দু। বিশেষ। প্রতিটি বাড়িতে ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা আছে।
রাস্তা পেরিয়ে বাবার বাড়িতে ঢুকল সনি, নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে পা দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, মা?
মিষ্টি লঙ্কা ভাজার গন্ধ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সনির মা। একটা হাত ধরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল সনি, বল, তৈরি হয়ে নাও, হাসপাতালে যেতে হবে। ব্যস্ত হবার কিছু নেই, বাবা আহত হয়েছেন।
একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি ইতালীয় ভাষায় বললেন, ওরা বুঝি গুলি করেছে ওকে?
মাথা ঝাঁকাল সনি। চোখ নামিয়ে নিলেন সনির মা, তারপর ফিরে এলেন রান্নাঘরে। তার পিছু পিছু সনিও এল। দেখল, চুলোটা ভোলেন তিনি, তারপর আবার বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন উপর তলায়। প্লেট থেকে কয়েকটা মিষ্টি লঙ্কা আর ঝুড়ি থেকে একটু রুটি ছিঁড়ে নিয়ে আনাড়ি হাতে একটা স্যাণ্ডউইচ তৈরি করল সনি, তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে নামছে গরম জলপাই তেল।
এর একটু পর সর্বশেষ প্রান্তের বাবার অফিস কামরায় এল সনি, তালা মারা একটা বাক্স থেকে তাঁর ব্যক্তিগত টেলিফোনটা বের করল।এটা একটা বিশেষ টেলিফোন, নাম ঠিকানা সব ভূয়া।
প্রথমে সনি ফোন করল লুকা ব্রাসিকে। অপরপ্রান্তে সাড়া নেই কারও। এরপর ফোন করল টেসিওকে। লোকটা ব্রুকলিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার মাথা, ডমের প্রতি এর আনুগত্য সম্পর্কে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
খবরটা জানিয়ে দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিল সনি টেসিওকে। অতি বিশ্বস্ত পঞ্চাশজন প্রহরীর ব্যবস্থা করতে হবে তাকে, হাসপাতাল পাহারা আর লং বীচে কাজ করতে যেতে হবে তাদেরকে।
তবে কি ওরা ক্লেমেঞ্জাকেও সাবাড় করেছে? জানতে চাইল টেসিও।
ঠিক এক্ষুণি ক্লেমেঞ্জার লোকজনকে কাজে লাগাচ্ছি না, বলল সনি।
অনেক কিছু বুঝে নিল টেসিও। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বলল সে, কিছু মনে কোরো না, সনি। তোমার বাবা এখন ঠিক যে কথাগুলো বলতেন, আমি তাই বলছি-ধীরেসুস্থে এগোও, বেশি তাড়াহুড়ো করতে যেয়ো না। ক্লেমেঞ্জা বিশ্বাসঘাতক এ আমি বিশ্বাস করি না।
ধন্যবাদ, টেসিও, বলল সনি। বিশ্বাস আমিও করি না, কিন্তু তৰু সাবধান হওয়া উচিত নয় কি?
উচিত।
আরেকটা কাজের কথা; বলল সনি। বোস্টন থেকে বিশ্বস্ত কয়েকজন লোককে নিউ হ্যাম্পশেয়ারের হ্যানভার কলেজে পাঠাও, তারা মাইকেলকে এখানে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। গণ্ডগোল মেটা না পর্যন্ত ওকে বাইরে রাখতে চাই না। এক্ষেত্রেও শুধু সাবধান হতে চাইছি আমি, তার বেশি কিছু নয়।
ঠিক আছে, বলল টেসিও। সবাইকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে আমিও আসছি তোমার কাছে। আমার সব লোককে তুমি তো চেনো, তাই না?
হ্যাঁ, রিসিভার রেখে দিল সনি। ওয়ালসেফ খুলে নীল রঙের চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটা খাতা বের করল সে। ইনডেক্স নাম্বার দেখে নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় চোখ রেখে দেখল তাতে লেখা রয়েছে রে ফ্যারেল, পাঁচশো ডলার, খৃস্টমাস ঈভ! এর নিচে টোকা রয়েছে একটা ফোন নাম্বার।
সেই নাম্বারে ডায়াল করে বলল, ফ্যারেল?
হ্যাঁ।
আমি সনি কর্লিয়নি। তোমার কাছ থেকে এখুনি একটু কাজ চাই আমি। তোমাকে দুটো ফোন নাম্বার দিচ্ছি। গত তিন মাস আগে থেকে আজ পর্যন্ত কত কল কোথা থেকে কোথায় আসা-যাওয়া করেছে, সব আমাকে জানাতে হবে। এরপর ফ্যারেলকে পলি গাটো আর ক্লেমেঞ্জার ফোন নাম্বার জানাল সনি। জরুরী কাজ। রাত বারোটার মধ্যে জানতে চাই আমি। বড়দিনটা যাতে তোমার আরও আনন্দে কাটে তার ব্যবস্থা করব।
আরেকবার ফোন করল সে লুকা ব্রাসির নাম্বারে। উত্তর নেই। দুশ্চিন্তাটাকে মন থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল সে। একবার খবর পেলেই হয়, ভাবছে সে, সাইক্লোনের মত ছুটে আসবে লুকা।
রিভলভিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে সনি। একটু পরই আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করবে বাড়ি। কার ঘাড়ে কি দায়িত্ব চাপাতে হবে সব ঠিক করতে হবে তাকে। নিরিবিলিতে বসে এই প্রথম টের পাচ্ছে সে পরিস্থিতিটা কতটুকু বিপজ্জনক।
কর্লিয়নি পরিবারকে আজ দশ বছর পর আবার যুদ্ধে ডাকা হয়েছে। তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করার সাহ৷ কারও থাকতে পারে, দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবেনি একথা। পিছনে সলোযো রয়েছে, কিন্তু নিউ ইয়র্কের বড় বড় পাঁচটি পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে একটির সমর্থন ছাড়া এ-কাজের কথা ভাবতেও সাহস পায়নি সে।
টাটাগ্লিয়া পরিবারের কথাতেই নেচেছে সলোযো, ভাবছে সনি। এখন কি হবে? হয় সামগ্রিক যুদ্ধ, নয় সলোহোর শর্তে আপোস। চতুর তুর্ক আকস্মিক দারুণ ফন্দি এঁটেছিল, কিন্তু ওর কপাল খারাপ। বাবা মারা গেলে বিকল্প উপায়টার কথা ভাবা যেত। কিন্তু বাবা বেঁচে আছেন। এর একটাই মানে, সামগ্রিক যুদ্ধ।
সে-যুদ্ধের পরিণাম কি? আপন মনে মুচকি একটু হাসল সনি। কর্লিয়নি পরিবারের হাতে বিশেষ ক্ষমতা এবং লুকা ব্রাসি রয়েছে, সুতরাং এই যুদ্ধের পরিণাম একটাই হতে পারে।
তবু খুঁত খুঁত করছে সনির মনটা। লুকা ব্রাসি গেল কোথায়?