সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আবদুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে সে এসে ঘরে ঢুকল। রুটি, মমলেট, পনির, চা। অন্যদিন খাবার দিয়ে চলে যেত, আজ সামনে দাঁড়িয়ে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল। কী মুশকিল।
মৌলানা এসে বললেন, চিরকুটে লেখা আছে, মাথাপিছু দশ পৌণ্ড লগেজ নিয়ে যেতে দেবে। কি রাখি, কি নিয়ে যাই?
আমি বললুম, যা রেখে যাবে তা আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। আমি আবদুর রহমানকে বলেছি পানশির চলে যেতে। বাড়ি পাহারা দেবার জন্য কেউ থাকবে না, কাজেই সবকিছু লুট হবে।
কারো বাড়িতে সব কিছু সমঝিয়ে দিয়ে গেলে হয় না?
আমি বললুম, এ পরিস্থিতিটা একদিন হতে পারে জেনে আমি ভিতরে ভিতরে খবর নিয়েছিলুম। শুনলুম, যখন চতুর্দিকে লুটতরাজের ভয়, তখন কাউকে মালের জিম্মাদারি নিতে অনুরোধ করা এ দেশের রেওয়াজ নয়। কারণ কেউ যদি জিম্মাদারি নিতে রাজীও হয়, তখন তার বাড়িতে ডবল মালের আশায় লুটের ডবল সম্ভাবনা। মালপত্র যখন সদর রাস্তা দিয়ে যাবে, তখন ডাকাতেরা বেশ করে চিনে নেবে মালগুলো কোন্ বাড়িতে গিয়ে উঠল।
বলে তো দিলুম মৌলানাকে সব কিছু প্রাঞ্জল ভাষায় কিন্তু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন চারিদিকে তাকালুম, তখন মনে যে প্রশ্ন উঠল তার কোনো উত্তর নেই। নিয়ে যাব কি, আর রেখে যাব কি?
ঐ তো আমার দুভলুম রাশান অভিধান। এরা এসেছে মস্কো থেকে ট্রেনে করে তাশক, সেখান থেকে মোটরে করে আমুদরিয়া, তারপর খেয়া পেরিয়ে, খচ্চরের পিঠে চেপে সমস্ত উত্তর আফগানিস্থান পিছনে ফেলে, হিন্দুকুশের চড়াই-ওতরাই ভেঙে এসে পৌঁচেছে কাবুল। ওজন পৌণ্ড ছয়েক হবে।
আমি সাহিত্য সৃষ্টি করি না, কাজেই পাণ্ডুলিপির বালাই নেই–মৌলানার থেকে সেদিক দিয়ে আমার কপাল ভালো কিন্তু শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের ক্লাশে বলাকা, গোরা, শেলি, কীটস সম্বন্ধে যে গাদা গাদা নোট নিয়েছিলুম এবং মূর্খের মত এখানে নিয়ে এসেছিলুম, বরফবর্ষণের দীর্ঘ অবসরে সেগুলোকে যদি কোন কাজে লাগানো যায়, সেই ভরসায়, তার কি হবে? ওজন তো কিছু কম নয়।
আর সব অভিধান, ব্যাকরণ, মিনুদির দেওয়া পূরবী, বিনোদের দেওয়া ছবি, বন্ধুবান্ধবের ফটোগ্রাফ, আর এক বন্ধুর জন্য কাবুলে কেনা দুখানা বোখার কার্পেট? ওজন তিন লাশ।
কাপড়চোপড়? দেরেশি-পাগল কাবুলের লৌকিকতা রক্ষার জন্য স্মোকিঙ, টেল, মর্নিংসুট (কাবুলের সরকারী ভাষায় ব জুর দেরেশি!)। এগুলোর জন্য আমার সিকি পয়সার দরদ নেই কিন্তু যদি জর্মনী যাবার সুযোগ ঘটে, তবে আবার নূতন করে বানাবার পয়সা পাব কোথায়?
ভুলেই গিয়েছিলুম। এক জোড়া চীনা ভাজ। পাতিনেবুর মত রং আর চোখ বন্ধ করে হাত বুলোলে মনে হয় যেন পাতিনেবুরই গায়ে হাত বুলোচ্ছি, একটু জোরে চাপ দিলে বুঝি নখ ভিতরে ঢুকে যাবে।
কত ছছাটখাটো টুকিটাকি। পৃথিবীর আর কারো কাছে এদের কোনো দাম নেই, কিন্তু আমার কাছে এদের প্রত্যেকটি আলাউদ্দীনের প্রদীপ।
সোক্রাতেসকে একদিন তার শিষ্যের পাল শহরের সবচেয়ে সেরা দোকান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সে-দোকানে দুনিয়ার যত সব দামী দামী প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস, অদ্ভুত অদ্ভুত বিলাসসম্ভার, মিশর বাবিলনের কলা-নিদর্শন, পাপিরসের বাণ্ডিল, আলকেমির সরঞ্জাম সব কিছুই ছিল। সোক্রাতেসের চোখের পলক পড়ে না। এটা দেখছেন, সেটা নাড়ছেন আর চোখ দুটো ছানাবড়ার সাইজ পেরিয়ে শেষটায় সসারের আকার ধারণ করেছে। শিষ্যেরা মহাখুশী গুরু যে এত কৃচ্ছ সাধন আর ত্যাগের উপদেশ কপচান সে শুধু কোনো সত্যিকার ভালো জিনিস দেখেননি বলে— এইবার দেখা যাক, গুরু কি বলেন। স্বয়ং প্লাতো গুরুর বিহ্বল ভাব দেখে অস্বস্তি অনুভব করছেন।
দেখা শেষ হলে সোক্রাতেস করুণকণ্ঠে বলেন, হায়, হায়। দুনিয়া কত চিত্র বিচিত্র জিনিসে ভর্তি যার একটারও আমার প্রয়োজন নেই।
আমার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, সোক্রাতেসে আমাতে মাত্র একটি সামান্য তফাত এ ঘরের প্রত্যেকটি জিনিসেরই আমার প্রয়োজন। ব্যস–ঐ একটি মাত্র পার্থক্য। ডার্বি জিতেছে ৫৩৭৮৬ নম্বরের টিকিট। আমি কিনেছিলুম ৫৩৭৮৫ নম্বরের টিকিট। তফাতটা এমন কি হল?
মুসলমানের ছেলে, নিমতলা যাব না, যাব একদিন গোবরা— অবশ্য যদি এই কাবুলী-গর্দিশ কাটিয়ে উঠতে পারি। সেদিন কিছু সঙ্গে নিয়ে যাব না, সেকথাও জানি; কিন্তু তারই জন্য কি আজ সব কিছু কাবুলে ফেলে দেশে যেতে হবে? মক্স করলে সব জিনিসই রপ্ত হয়, এই কি খুদাতালার মতলব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ কুষ্টিয়ার লালন ফকির বলেছেন–
মরার আগে মলে শমন-জ্বালা ঘুচে যায়।
জানগে সে মরা কেমন, মুরশিদ ধরে জানতে হয়।
আবার আরো কে একজন, দাদু না কি, তিনিও তো বলেছেন,
দাদু, মেরা বৈরী মৈ মুওয়া মুকৈ ন্
মারে কোই।
(হে দাদু, আমার বৈরী আমি মরে গিয়েছে, আমাকে কেউ মারতে পারে না)।
কী মুশকিল। সব গুণীরই এক রা। শেয়ালকে কেন বৃথা দোষ দেওয়া। কবীরও তো বলেছেন,
তজো অভিমানা সীখো জ্ঞানা
সতগুরু সঙ্গত তরতা হৈ
কহৈঁ কবীর কোই বিরল হংস
জীবত হী জো মরতা হৈ।।
(অভিমান ত্যাগ করে জ্ঞান শেখো, সৎগুরুর সঙ্গ নিলেই ত্রাণ। কবীর বলেন, জীবনেই মৃত্যুকে লাভ করেছেন সে রকম হংসসাধক বিরল)
কিন্তু কবীরের বচনে বাঁচাও রয়ে গিয়েছে। গোবরার গোরস্তানে যাবার পূর্বেই মৃতের ন্যায় সবকিছুর মায়া কাটাতে পারেন এমন পরমহংস যখন বিরল তখন সে কস্ত করার দায় তো আমার উপর নয়।
ডোম শেষ পর্যন্ত কোন্ বাঁশ বেছে নিয়েছিল আমাদের প্রবাদে তার হদিস মেলে না। বিবেচনা করি, সেটা নিতান্ত কাঁচা এবং গিঁটে ভর্তি না হলে প্রবাদটার কোনো মানে হয়। এ-ডোম তাই শেষ পর্যন্ত কি দিয়ে দশ পৌণ্ডের পুঁটুলি বেঁধেছিল, সেকথা ফাঁস করে দিয়ে আপন আহাম্মুখির শেষ প্রমাণ আপনাদের হাতে তুলে দেবে না।
কিন্তু সেটা পুরানো ধুতিতে বাঁধা বেনের পুঁটুলিই ছিল লিগেজ বা সুটকেসের ভিতরে গোছানো মাল অন্য জিনিস কারণ দশ পৌণ্ড মালের জন্য পাঁচ পৌণ্ডী সুটকেস ব্যবহার করলে মালের পাঁচ পৌণ্ড গিয়ে রইবে হাতে সুটকেসটা। সুকুমার রায়ের কাক যে রকম হিসেব করতে সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার, হাতে রইল পেন্সিল।
অবশ্য জামা-কাপড় পরে নিলুম একগাদা একপ্রস্ত না। কর্তারাও উপদেশ পাঠিয়েছিলেন যে, প্রচুর পরিমাণে গরম জামাকাপড় না পরা থাকলে উপরে গিয়ে শীতে কষ্ট পাব এবং মৌলানার বউয়ের পা খড় দিয়ে কি রকম পেঁচিয়ে বিলিতী সিরকার বোতল বানানো হয়েছিল আবদুর রহমানের সে-বর্ণনাও মনে ছিল।
মৌলানা তার এক পাঞ্জাবী বন্ধুর সঙ্গে আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন।
আবদুর রহমান বসবার ঘরে প্রাণভরে আগুন জ্বালিয়েছে। আমি একটা চেয়ারে বসে। আবদুর রহমান আমার পায়ের কাছে।
আমি বললুম, আবদুর রহমান, তোমার উপর অনেকবার খামকা রাগ করেছি, মাফ করে দিয়ে।
আবদুর রহমান আমার দুহাত তুলে নিয়ে আপন চোখের উপর চেপে ধরল। ভেজা।
আমি বললুম, ছিঃ আবদুর রহমান, এ কি করছ? আর শোনন, যা রইল সব কিছু তোমার।
আমি জানি আমার পাঠক মাত্রই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন, কিন্তু তবু আমি জোর করে বলব, আবদুর রহমান আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে, তার চোখে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম লেখা রয়েছে,–
যেনাহং নামৃত স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং?
রাস্তা দিয়ে চলেছি। পিছনে পুঁটুলি-হাতে আবদুর রহমান।
দু-একবার তার সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করলুম। দেখলুম সে চুপ করে থাকাটাই পছন্দ করছে।
প্রথমেই ডানদিকে পড়ল রুশ রাজদূতাবাস। দেমিদফ পরিবারকে কখনো ভুলব না। বলশফের আত্মাকে নমস্কার জানালুম।
তারপর কাবুল নদী পেরিয়ে সব-ই-দরিয়া হয়ে আর্কের দিকে চললুম। বেশীর ভাগ দোকানপাট বন্ধ— তবু দূর থেকেই দেখতে পেলুম পাঞ্জাবীর দোকান খোলা। দোকানদার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলুম, দেশে যাবেন না? মাথা নাড়িয়ে নীরবে জানালে না। তারপর বিদায়ের সালাম জানিয়ে মাথা নিচু করে দোকানের ভিতরে চলে গেল। আমি জানতুম, কারবার ফেলে এদের কাবুল ছাড়ার উপায় নেই, সব কিছু তৎক্ষণাৎ লুট হয়ে যাবে। অথচ এর চিত্ত এমনি বিকল হয়ে গিয়েছে যে, শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে দুটি কথা বলবার মত মনের জোর এর আর নেই।
বিশ কদম পরে বাঁ দিকে দোস্ত মুহম্মদের বাসা। অবস্থা দেখে বুঝতে বেগ পেতে হল না যে, বাসা লুট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে তার কণামাত্র শোক হওয়ার কথা নয়। এ-বাবতে তিনি সোক্রাতেসের ন্যায় সোক্রাতেস যেমন তত্ত্বচিন্তায় বুদ হয়ে অন্য কোন বস্তুর প্রয়োজন অনুভব করতেন না, দোস্ত মুহম্মদ ঠিক তেমনি রসের সন্ধানে, অদ্ভূতের খোঁজে, গ্রোটেঙ্কের (উদ্ভটের) পিছনে এমনি লেগে থাকতেন যে, অন্য কোনো বস্তুর অভাব তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে পারত না। পতঞ্জলিও ঠিক এই কথাই বলেছেন। চিত্তবৃত্তিনিরোধের পন্থা বালাতে গিয়ে তিনি ঈশ্বর, এবং বীতরাগ মহাপুরুষদের সম্বন্ধে ধ্যান করতে উপদেশ দিয়েছেন কিন্তু সর্বশেষে বলছেন, যথাভিমতধ্যানাঘা, যা খুশী তাই দিয়ে চিত্তচাঞ্চল্য ঠেকাবে। অর্থাৎ ধ্যানটাই মুখ্য, ধ্যানের বিষয়বস্তু গৌণ। দোস্ত মুহম্মদের সাধনা রসের সাধনা।
আরো খানিকটে এগিয়ে বাঁ দিকে মেয়েদের ইস্কুল। বাচ্চার আক্রমণের কয়েক দিন পূর্বে এখানে কর্নেলের বউ তাঁর স্বামীর কথা ভেবে ডুকরে কেঁদেছিলেন। তিনি বেঁচে আছেন কিনা কে জানে। আমার পাশের বাড়ীর কর্নেলের মায়ের কান্না, ইস্কুলের কর্নেল বউয়ের কান্না আরো কত কান্না মিশে গিয়ে অহরহ খুদাতালার তখতের দিকে চলেছে। কিন্তু কেন? কবি বলেছেন,
For men must work
And women must weep
অর্থাৎ কোনো তর্ক নেই, যুক্তি নেই, ন্যায় অন্যায় নেই, মেয়েদের কর্ম হচ্ছে পুরুষের আকাট মূর্খতার জন্য চোখের জল ফেলে খেসারতি দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্য, এ-বেদনাটা প্রকাশও করে আসছে পুরুষই, কবিরূপে। শুনেছি পাঁচ হাজার বৎসরের পুরোনো বাবিলনের প্রস্তরগাত্রে কবিতা পাওয়া গিয়েছে কবি মা-জননীদের চোখের জলের উল্লেখ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
ইস্কুলের পরেই একখানা ছোটো বসতবাড়ি। আমান উল্লার বোনের বিয়ের সময় লক্ষ্ণৌ থেকে যেসব গানেওয়ালী নাচনেওয়ালীদের আনানো হয়েছিল তারা উঠেছিল এই বাড়িতে। তাদের তত্ত্বতাবাশ করার জন্য আমরা কয়েকজন ভারতীয় তাদের কাছে গিয়েছিলুম। আমাদের সঙ্গে কথা কইতে পেয়ে সেই অনাত্মীয় নির্বাসনে তারা কী খুণীটাই না হয়েছিল। জানত, কাবুলে পান পাওয়া যায় না—আর পান না হলে মজলিস জমবে কি করে, ঠুংরি হয়ে যাবে ভজন–তাই তারা সঙ্গে এনেছিল বাবোঝাই পান। আমাদের সেই পান দিয়েছিল অকৃপণ হস্তে, দরাজ-দিলে। লক্ষ্ণৌয়ের পান, কাশীর জর্দা, সেদ্ধ-ছকা খয়ের তিনে মিলে আমার মুখের জড়তা এমনি কেটে দিয়েছিল যে, আমি তখন উর্দু ছেড়েছিলুম একদম লওয়ী কায়দায় বিস্তর মেহেরবানী, গরীব-পরওরী, বন্দা-নওয়াজীর প্রপঞ্চ-ফোড়ন দিয়ে।
কাবুলের নিজস্ব উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নেই। ইরানের ঐতিহ্যও কাবুল স্বীকার করে না। কাবুলে যে দেড় জন কলাবত আছেন তারা গান শিখেছেন যুক্তপ্রদেশে। বাঈজীদের মজলিসে তাই সম দেনেওয়ালার অভাব হতে পারে এই ভয়ে গানের মজলিসে উপস্থিত থাকার জন্য ভারতীয়দের সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ ও সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হয়েছিল। আমরা সামনে বসে বিস্তর মাথা নেড়েছিলুম আর ঘন ঘন শাবাশ, শাবাশ চিৎকারে মজলিস গরম করে তুলেছিলুম।
বাড়ি ফিরে আহারাদির পর যখন শেষ পানটা পকেট থেকে বের করে খেয়ে জানলা দিয়ে পিক ফেললুম তখন আবদুর রহমান ভয়ে ভিরমি যায় আর কি। কাবুলে পানের পিক অজানা কিন্তু যক্ষ্মা অজানা বস্তু নয়।
তারপরই শিক্ষামন্ত্রীর দফতর। একসেলেন্সি ফয়েজ মুহম্মদ খানকে দোস্ত মুহম্মদ দুচোখে দেখতে পারতেন না। আমার কিন্তু মন্দ লাগত না। অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং বড়ই নিরীহ প্রকৃতির লোক। আর পাঁচজনের তুলনায় তিনি লেখাপড়া কিছু কম জানতেন না, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী হতে হলে যতটা দরকার ততটা হয়ত তার ঠিক ছিল না। বাচ্চা রাজা হয়ে আর তাবৎ মন্ত্রীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাঁদের কাছ থেকে গুপ্তধন বের করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীকে নাকি, তুই যা, তুই তো কখনো ঘুস খাসনি বলে নিষ্কৃতি দিয়েছিল। অথচ শিক্ষা বিভাগে টু পাইস কামাবার যে উপায় ছিল না তা নয়। কাবুলে নাকি ঢেউ গোনর কাজ পেলেও অবশ্য সে-কাজ সরকারি হওয়া চাই— দুপয়সা মারা যায়।
লোকটিকে আমার ভালো লাগত নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে। এই বেলা সেটা বলে ফেলি, হাওয়াই-জাহাজ কারো জন্য দাঁড়ায় না, উড়তে পাড়লেই বাঁচে।
চাকরীতে উন্নতি করে মানুষ হয় বুদ্ধির জোরে, নয় ভগবানের কৃপায়। বুদ্ধিমানকে ভগবানও যদি সাহায্য করেন তবে বোকাদের আর পৃথিবীতে বাঁচতে হত না। আমার প্রতি ভগবান সদয়। ছিলেন বলেই বোধ করি শিক্ষামন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই আমার দিকে নেকনজরে তাকিয়েছিলেন। তারপর এক বৎসর যেতে না যেতে অহেতুক একধাক্কায় মাইনে এক শ টাকা বাড়িয়ে সব ভারতীয় শিক্ষকদের উপরে চড়িয়ে দিলেন।
পাঞ্জাবী শিক্ষকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে তার কাছে ডেপুটেশন নিয়ে গিয়ে বললেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর ডিগ্রী বিশ্বভারতীর, এবং বিশ্বভারতী রেকগনাইজড, য়ুনিভার্সিটি নয়।
খাঁটী কথা। সদাশয় ভারতীয় সরকারের নেকনজরে আমার ডিগ্রী এখনো ব্রাত্য। আপনারা কেউ আমাকে চাকরী দিলে বিপদগ্রস্ত হবেন।
শিক্ষামন্ত্রী নাকি বলেছিলেন–আমি বয়ানটা শুনেছি অন্য লোকের কাছ থেকে–সেকথা তার অজানা নয়।
পাঞ্জাবীদের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, আপনার সনদ-সার্টিফিকেটে রয়েছে পাঞ্জাব গবর্নরের দস্তখত। আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্থানেও গবর্নরের অভাব নেই। কিন্তু আগা মুজতবা আলীর কাগজে দস্তখত রয়েছে মশহুর শাইর রবীন্দ্রনাথের। তিনি পৃথিবীর সামনে সমস্ত প্রাচ্যদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন (চশম্ রওশন্ করদে অন্দ্)–।
ভদ্রলোকের ভারি শখ ছিল গুরুদেবকে কাবুলে নিমন্ত্রণ করার। তাঁর শুধু ভয় ছিল যে, দু শ মাইলের মোটর ঝাঁকুনি খেয়ে কবি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর তার কাব্যসৃষ্টিতে বাধা পড়ে তবে তাতে করে ক্ষতি হবে সমস্ত পৃথিবীর। কাবুল কবিকে দেখতে চায়, কিন্তু এমন দুর্ঘটনার নিমিত্তের ভাগী হতে যাবে কেন? আমি সাহস দিয়ে বলতুম, কবি ছফুট তিন ইঞ্চি উঁচু, তার দেহ সুগঠিত এবং হাড়ও মজবুত।
শেষটায় তিনি আল্লা বলে ঝুলে পড়ছিলেন কিন্তু আমান উল্লা বিলেত যাওয়ায় সে গ্রীষ্মে কবিকে আর নিমন্ত্রণ করা গেল না। শীতে বাচ্চা এসে উপস্থিত।
যাক্গে এসব কথা।
বাঁদিকে মুইন-উ-সুলতানের বাড়ি, খানিকটে এগিয়ে গিয়ে তার টেনিস কোর্ট। আজ মুইন-উস-সুলতানে ভাগ্যের হাতে টেনিস বল। কান্দাহার কাবুল তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে।
এই ত মকতব-ই-হবীবিয়া। বাচ্চা আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় মকতটা দখল করে টেবিল চেয়ার, বই ম্যাপ পুড়িয়ে ফেলেছিল। এ শিক্ষায়তন আবার কখন খুলবে কে জানে? এখানেই আমি পড়িয়েছি। শীতে পুকুর জমে গেলে ছেলেদের সঙ্গে তার উপর স্কেটিং করেছি। গাছতলায় বসে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আঙুর কিনে খেয়েছি। মীর আসলমের কাছ থেকে কত তত্ত্বকথা শুনেছি।
রাহুকবলিত কাবুল ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় লোক চলাচল কম। মকতব-ই-হবীবিয়ার বন্ধদ্বার যেন সমস্ত আফগানিস্থানের প্রতীক। শিক্ষাদীক্ষা, শান্তিশৃঙ্খলা, সভ্যতাসংস্কৃতি বর্জন করে আফগানিস্থান তার দ্বার বন্ধ করে দিয়েছে।
শহর ছাড়িয়ে মাঠে নামলুম। হাওয়াই জাহাজের ঘাঁটি আর বেশী দূর নয়। পিছন ফিরে আরেকবার কাবুলের দিকে তাকালুম। এই নিরস নিরানন্দ বিপদসঙ্কুল পুরী ত্যাগ করতে কোনো সুস্থ মানুষের মনে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কিন্তু বোধ হয় এই সব কারণেই যে কয়টি লোকের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জমেছিল তাদের প্রত্যেককে অসাধারণ আত্মজন বলে মনে হতে লাগল। এদের প্রত্যেকেই আমার হৃদয় এতটা দখল করে বসে আছেন যে, এদের সকলকে এক সঙ্গে ত্যাগ করতে গিয়ে মনে হল আমার সত্তাকে যেন কেউ দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে। ফরাসীতে বলে পার্তির সে তা প্য মুরীর, প্রত্যেক বিদায় গ্রহণে রয়েছে খণ্ড-মৃত্যু।
হাওয়াই জাহাজ এল। আমাদের বুচকিগুলো সাড়ম্বর ওজন করা হল। কারো পোঁটলা দশ পৌণ্ডের বেশী হয়ে যাওয়ায় তাদের মস্তকে বজ্রাঘাত। অনেক ভেবেচিন্তে যে কয়টি সামান্য জিনিস নিয়ে মানুষ দেশত্যাগী হচ্ছে তার থেকে ফের জিনিস কমানো যে কত কঠিন সেটা সামনে দাঁড়িয়ে না দেখলে অনুমান করা অসম্ভব। একজন তো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
ডোম যে কাণা হয় তার শেষ প্রমাণও বিমানঘাঁটিতে পেলুম। এইটুকু ওজনের ভিতর আবার এক গুণী একখানা আয়না এনেছেন। লোকটির চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলুম, কই তেমন কিছু খাপসুরৎ অ্যাপলল তো নন। ঘরে আগুন লাগলে মানুষ নাকি ছুটে বেরবার সময় ঝাঁটা নিয়ে বেরিয়েছে, এ কথা তাহলে মিথ্যা নয়।
ওরে আবদুর রহমান, তুই এটা এনেছিস কেন? দশ পৌণ্ডের পুঁটুলিটা এনেছে ঠিক কিন্তু বাঁ হাতে আমার টেনিস র্যাকেটখানা কেন? আবদুর রহমান কি একটা বিড়বিড় করল। বুঝলুম, সে ঐ যাঁকেটখানাকেই আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছিল, তার কারণ ও-জিনিসটা আমি তাকে কখনও ছুতে দিতুম না। আবদুর রহমান আমাদের দেশের ড্রাইভারদের মত। তার বিশ্বাস স্কু মাত্রই এমনভাবে টাইট করতে হয় যে, সেটা যেন আর কখনো ভোলা না যায়। অপটিমাম শব্দটা আমি আবদুর রহমানকে বোঝতে না পেরে শেষটায় কড়া হুকুম দিয়েছিলুম, যাঁকেটটা প্রেসে বাঁধা দূরে থাক, সে যেন ওটার ছায়াও না মাড়ায়।
আবদুর রহমান তাই ভেবেছে, সায়েব নিশ্চয়ই এটা সঙ্গে নিয়ে হিন্দুস্থানে যাবে।
দেখি স্যার ফ্রান্সিস। নিতান্ত সামনে, বয়সে বড়, তাই একটা ছোটাসে ছোটা নড় করলুম। সায়েব এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, গুড মর্নিং, আই উইশ এ গুড জর্নি।
আমি ধন্যবাদ জানালুম।
সায়েব বললেন, ভারতীয়দের সাহায্য করবার জন্য আমি সাধ্য মত চেষ্টা করেছি। প্রয়োজন হলে আশা করি, ভারতবর্ষে সে কথাটি আপনি বলবেন।
আমি বললুম, আমি নিশ্চয়ই সব কথা বলবে।
সায়েব ভোঁতা, না ঘডেল ডিপ্লোমেট ঠিক বুঝতে পারলুম না।
বিদায় নেবার সময় আফগানিস্থানে যে চলে যাচ্ছে সে বলে ব, আমানে খুদা তোমাকে খোদার আমানতে রাখলুম, যে যাচ্ছে না সে বলে ব্ খুদা সপূর্দমৎ–তোমাকে খোদার হাতে সোপর্দ করলুম।
আবদুর রহমান আমার হাতে চুমো খেল। আমি বললুম, ব, আমানে খুদা, আবদুর রহমান, আবদুর রহমান মন্ত্রোচ্চারণের মত একটানা বলে যেতে লাগল ব্ খুদা সপূর্দমৎ, সায়েব, ব্ খুদা সপূর্দমৎ, সায়েব।
হঠাৎ শুনি স্যার ফ্রান্সিস বলছেন, এ-দুর্দিনে যে টেনিস যাঁকেট সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় সে নিশ্চয়ই পাকা স্পোর্টসম্যান।
লিগেশনের এক কর্মচারী বললেন, ওটা দশ পৌণ্ডের বাইরে পড়েছে বলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
সাহেব বললেন, ওটা প্লেনে তুলে দাও।
ঐ একটা গুণ না থাকলে ইংরেজকে কাক-চিলে তুলে নিয়ে যেত।
আবদুর রহমান এবার চেঁচিয়ে বলছে, ব্ খুদা সপূর্দমৎ, সায়েব, ব্ খুদা সপূর্দমৎ। প্রপেলার ভীষণ শব্দ করছে।
আবদুর রহমানের তারস্বরে চীৎকার প্লেনের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছি। হাওয়াই জাহাজ জিনিষটাকে আবদুর রহমান বড্ড ডরায়। তাই খোদাতালার কাছে সে বার বার নিবেদন করছে যে, আমাকে সে তারই হাতে সঁপে দিয়েছে।
প্লেন চলতে আরম্ভ করেছে। শেষ শব্দ শুনতে পেলুম, সপূর্দমৎ। আফগানিস্থানে আমার প্রথম পরিচয়ের আফগান আবদুর রহমান; শেষ দিনে সেই আবদুর রহমান আমায় বিদায় দিল।
উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে এবং এই শেষ বিদায়কে যদি শ্মশান বলি তবে আবদুর রহমান শ্মশানেও আমাকে কাঁধ দিল। স্বয়ং চাণক্য যে কটা পরীক্ষার উল্লেখ করে আপন নির্ঘণ্ট শেষ করেছেন আবদুর রহমান সব কটাই উত্তীর্ণ হল। তাকে বান্ধব বলব না তো কাকে বান্ধব বলব?
বন্ধু আবদুর রহমান, জগদ্বন্ধু তোমার কল্যাণ করুন।
মৌলানা বললেন, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও বলে আপন সীটটা আমায় ছেড়ে দিলেন।
তাকিয়ে দেখি দিকদিগন্ত বিস্তৃত শুভ্র বরফ। আর অ্যারফিল্ডের মাঝখানে, আবদুর রহমানই হবে, তার পাগড়ির ন্যাজ মাথার উপর তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে।
বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।
বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।