এক বৃদ্ধা দুঃখ করে বলেছিলেন, পালা-পরবে নেমন্তন্ন পেলে অরক্ষণীয়া মেয়ে থাকলে মায়ের মহা বিপদ উপস্থিত হয়। রেখে গেলে গলার আল, নিয়ে গেলে লোকের গাল। তারপর বুঝিয়ে বলেছিলেন, বাড়িতে যদি মেয়েকে রেখে যাও তাহলে সমস্তক্ষণ দুর্ভাবনা, ভালো করলুম না মন্দ করলুম; সঙ্গে যদি নিয়ে যাও তবে সকলের কাছ থেকে একই গালাগাল, এতদিন ধরে বিয়ে দাওনি কেন?
দেশভ্রমণে দেখলুম একই অবস্থা। মোকামে পৌঁছেই প্রশ্ন, দেশটার ঐতিহাসিক পটভূমিকা দেব, কি দেব না। যদি না দাও তবে সমস্তক্ষণ দুর্ভাবনা, ভালো করলুম, না, মন্দ করলুম। যদি দাও তবে লোকের গালাগাল নিশ্চিত খেতে হবে। বিশেষ করে আফগানিস্থানের বেলা, কারণ, অরক্ষণীয়া কন্যার যে রকম বিয়ে হয়নি, আফগানিস্থানেরও ইতিহাস তেমনি লেখা হয়নি। আফগানিস্থানের প্রাচীন ইতিহাস পোঁতা আছে সে দেশের মাটির তলায়, আর ভারতবর্ষের পুরাণমহাভারতে। আফগানিস্থান গরীব দেশ, ইতিহাস গড়ার জন্য মাটি ভাঙবার ফুরসৎ আফগানের নেই, মাটি যদি সে নিতান্তই খোঁড়ে তবে সে কাবুলী মোঁ-জো-দড় বের করার জন্য নয়— কয়লার খনি পাবার আশায়। পুরাণ ঘাঁটাঘাঁটি করার মত পাণ্ডিত্য কাবুলীর এখনো হয়নি আমাদেরই কতটা হয়েছে কে জানে? পুরাণের কতটা সত্যিকার ইতিহাস আর কতটা ইতিহাস-পাগলাদের বোকা বানাবার জন্য পুরাণকারের নির্মম অট্টহাস তারই মীমাংসা করতে অর্ধেক জীবন কেটে যায়।
আফগানিস্থানের অর্বাচীন ইতিহাস নানা ফার্সী পাণ্ডুলিপিতে এদেশে ওদেশে, অন্ততঃ চারখানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আছে। এদেশের মাল নিয়ে পণ্ডিতেরা নাড়াচাড়া করেছেন মাহমুদ, বাবুরের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের পাঠান-তুর্কী-মোগল যুগের ইতিহাস লেখার জন্য। কিন্তু বাবুরের আত্মজীবনী সঙ্গে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় পণ্ডিত–আফগানের কথাই ওঠে না–কাবুল হিন্দুকুশ, বদখশান্ বল্খ্ মৈমানা হিরাতে ঘোরাঘুরি করেননি কারণ আফগান ইতিহাস লেখার শিরঃপীড়া নিয়ে ভারতীয় পণ্ডিত এখনও উদ্বস্ত হননি। অথচ এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আফগানিস্থানের ইতিহাস না লিখে ভারত-ইতিহাস লেখবার জো নেই, আফগান রাজনীতি না জেনে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ঠাণ্ডা রাখবার কোনো মধ্যমনারায়ণ নেই।
গোদের উপর আরেক বিষফোঁড়া আফগানিস্থানের উত্তর ভাগ অর্থাৎ বল্খ্-বদখশানের ইতিহাস তার সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার (গ্রীক অক্ষুস, সংস্কৃত বন্ধু) ওপারের তুর্কীস্থানের সঙ্গে, পশ্চিমভাগ অর্থাৎ হিরাত অঞ্চল ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাৎ কাবুল জলালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রঙ ধরেছে। আফগানিস্থানের তুলনায় সুইটজারল্যাণ্ডের ইতিহাস লেখা ঢের সোজ। যদিও সেখানে তিনটে ভিন্ন জাত আর চারটে ভাষা নিয়ে কারবার।
আর শেষ বিপদ, যে দুচারখানা কেতাব পত্র আছে সেগুলো খুললেই দেখতে পাবেন, পণ্ডিতেরা সব রামদা উঁচিয়ে আছেন। গান্ধার লিখেই সেই রামদা–?–উঁচিয়েছেন অর্থাৎ গান্ধার কোথায়? কাম্বোজ বলেই সেই খড়্গ–?–অর্থাৎ কাম্বোজ বলতে কি বোঝো? কম্বুকণ্ঠী বা কম্বুগ্রীব বলতে বোঝায় যার গলায় শখের গায়ের তিনটে দাগ কাটা রয়েছে যেমনতর বুদ্ধের গলায়। কাম্বোজ দেশ কি তবে গিরি উপত্যকার কণ্ঠী-ঝোলানো দেশ আফগানিস্থান, অথবা কম্বু যেখানে পাওয়া যায় অর্থাৎ সমুদ্র-পারের দেশ বেলুচিস্থান? এমন কি দেশগুলোর নামের পর্যন্ত ঠিক ঠিক বানান নেই, যেমন ধরুন বল্খ্, কখনো বল্হিকা কখনো বাল্হিকা, কখনো বাল্হীকা। সে কি তবে ফেরদৌসী উল্লিখিত বল্খ্, যেখানে জরথুস্ত্র রাজা গুশ্ৎআস্প্কে আবেস্তা মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন? সেখান থেকেই কি আজকের দিনের কাবুলীর জাফরান আর হিঙ নিয়ে আসে? কারণ ঐ দুয়ের নামই তো সংস্কৃতে বাল্হিকম্।
রাসেল বলেছেন, পণ্ডিতজন যে স্থলে মতানৈক্য প্রকাশ করেন মূর্খ যেন তথায় ভাষণ না করে।
আমার ঠিক উল্টো বিশ্বাস আমার মনে হয় ঠিক ঐ জায়গায়ই তার কিছু বলার সুযোগ–পণ্ডিতরা তখন একজোট হতে পারেন না বলে সে বারোয়ারি কিল থেকে নিষ্কৃতি পায়।
পণ্ডিতে মূখে মিলে আফগানিস্থান সম্বন্ধে যে সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন তার মোটামুটি তত্ত্ব এই–
আর্যজাতি আফগানিস্থান, খাইবারপাস হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিল— পামির, দার্দিস্থান বা পৈশাচভূমি কাশ্মীর হয়ে নয়। বোগাজ কো-ই বর্ণিত মিতানি রাজ্য ধ্বংসের পরে যদি এসে থাকে তবে প্রচলিত আফগান কিংবদন্তী যে আফগানরা ইহুদীদের অন্যতম পথভ্রষ্ট উপজাতি সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। অর্থাৎ কিংবদন্তী দেশ ঠিক রেখেছে কিন্তু পাত্র নিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে।
গান্ধারী কান্দাহার থেকে এসেছিলেন। পাঠান মেয়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ দেখেই বোধকরি মহাভারতকার তাকে শতপুত্রবতীরূপে কল্পনা করেছিলেন।
বৌদ্ধধর্ম-অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-ভারতবর্ষ ও আফগানিস্থানের ইতিহাস স্পষ্টতর রূপ নিতে আরম্ভ করে। উত্তর-ভারতের ষোলটি রাজ্যের নির্ঘণ্টে গান্ধার ও কাঘোজের উল্লেখ পাই। তাদের বিস্তৃতি প্রসার সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে পণ্ডিতেরা সেই রামদা দেখান।
এ-যুগে এবং তারপরও বহুযুগ ধরে ভারত ও আফগানিস্থানের মধ্যে যে রকম কোনো সীমান্তরেখা ছিল না, ঠিক তেমনি আফগান ও ইন্দো-ইরানিয়ান ভূমি পারস্যের মধ্যে কোনো সীমান্তভূমি ছিল না। বন্ধু বা আমুদরিয়ার উভয় পারের দেশকে সংস্কৃত সাহিত্যে ভারতের অংশরূপে ধরা হয়েছে, প্রাচীন ইরানী সাহিত্যে তাকে আবার ইরানের অংশরূপে গণ্য করা হয়েছে।
তারপর ইরানী রাজা সায়েরাস (কুরশ) সম্পূর্ণ আফগানিস্থান দখল করে ভারতবর্ষের সিন্ধুনদ পর্যন্ত অগ্রসর হন। সিকন্দর শাহের সিন্ধুদেশ জয় পর্যন্ত আফগানিস্থান ও পশ্চিম-সিন্ধু ইরানের অধীনে থাকে।
সিকন্দর উত্তর-আফগানিস্থান হয়ে ভারতবর্ষে ঢোকেন কিন্তু তার প্রধান সৈন্যদল খাইবারপাস হয়ে পেশাওয়ারে পৌঁছয়। খাইবার পেরোবার সময় সীমান্তের পার্বত্য জাতি পাহাড়ের চূড়াতে বসে সিকন্দরী সৈন্যদলকে এতই উদ্ব্যস্ত করেছিল যে গ্রীক সেনাপতি তাদের শহর গ্রাম জ্বালিয়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সিকন্দরের সিন্ধুজয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে রকম জোর দাগ কেটে গিয়েছে তেমনি গ্রীক অধিকারের ফলে আফগানিস্থানও ভৌগগালিক আরিয়া, আরাখোসিয়া, গেদ্রোসিয়া, পারাপানিসোদাই ও দ্রাঙ্গিয়ানা অর্থাৎ হিরাত, বল, কাবুল, গজনী ও কান্দাহার প্রদেশে বিভক্ত হয়ে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক রূপ নিতে আরম্ভ করে।
সিকন্দর শাহের মৃত্যুর কয়েক বৎসরের মধ্যেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সমস্ত উত্তর-ভারতবর্ষ দখল করে গ্রীকদের মুখোমুখি হন ফলে হিন্দুকুশের উত্তরের বাহিক প্রদেশ ছাড়া সমস্ত আফগানিস্থান তাঁর অধীনে আসে। মৌর্যবংশের পতন ও শুঙ্গবংশের অভ্যুদয় পর্যন্ত আফগানিস্থান ভারতবর্ষের অংশ হয়ে থাকে।
ভারতীয় আর্যদের চতুর্বেদ ও ইরানী আর্যদের আবেস্তা একই সভ্যতার বিকাশ। কিন্তু মৌর্যযুগে এক দিকে যেমন বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মের প্রসার হয় অন্যদিকে তেমনি ইরানী ও গ্রীক ভাস্কর শিল্প ভারতীয় কলাকে প্রায় সম্পূর্ণ অভিভূত করে ফেলে। অশোকের বিজয়স্তম্ভের মসৃণতা ইরানী ও তার রসবস্তু গ্রীক। সে-যুগের বিশুদ্ধ ভারতীয় কলার যে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তার আকার রূঢ়, গতি পঙ্কিল কিন্তু সে ভবিষ্যৎ বিকাশের আশায় পূর্ণগর্ভ।
অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য মাধ্যন্তিক নামক শ্রমণকে আফগানিস্থানে পাঠান। সমস্ত দেশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল কিনা বলবার উপায় নেই কিন্তু মনে হয় আফগানিস্থানের অনুর্বরতা বর্ণাশ্রমধর্মের অন্তরায় ছিল বলে আফগান জনসাধারণের পক্ষে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল। দুই শতাব্দীর ভিতরেই আফগানিস্থানের বহু গ্রীক সিথিয়ান ও তুর্ক বুদ্ধের শরণ নিয়ে ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে বেদ-আবেস্তার ঐতিহ্য বৌদ্ধধর্মের ভিতর দিয়ে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখে।
উত্তর-আফগানিস্থানের বল্খ্ প্রদেশ মৌর্য সম্রাটদের যুগে গ্রীক সাম্রাজ্যের অংশীভূত ছিল। মৌর্যবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বল্খ্ অঞ্চলে গ্রীকদের ভিতর অন্তঃকলহ সৃষ্টি হয় ও বলখের গ্রীকগণ হিন্দুকুশ অতিক্রম করে কাবুল উপত্যকা দখল করে। তারপর পাঞ্জাবে ঢুকে গিয়ে আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদের একজন রাজা মেনালের (পালিধর্মগ্রন্থ মিলিন্দপহোর রাজা মিলিন্দ) নাকি পূর্বে পাটলিপুত্র ও দক্ষিণে (আধুনিক) করাচী পর্যন্ত আক্রমণ করেন।
মধ্য ও দক্ষিণ-আফগানিস্থান তথা পশ্চিম-ভারতের গ্রীক রাজাদের কোনো ভালো বর্ণনা পাবার উপায় নেই। শুধু এক বিষয়ে ঐতিহাসিকের তৃষ্ণা তারা মেটাতে জানেন। কাবুল থেকে ত্রিশ মাইল দূরে বেগ্রাম উপত্যকায় এদের তৈরী হাজার হাজার মুদ্রা প্রতি বৎসর মাটির তলা থেকে বেরোয়। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০ থেকে খ্রষ্টপূর্ব ১২০ রাজ্যকালের ভিতর অন্তত উনত্রিশজন রাজা ও তিনজন। রানীর নাম চিহ্নিত মুদ্রা এ-যাবৎ পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর উপরে গ্রীক ও খরোষ্ঠী এবং শেষের দিকের মুদ্রাগুলোর উপরে গ্রীক ও ব্রাহ্মী হরফে লেখা রাজারানীর নাম পাওয়া যায়।
এ যুগে রাজায় রাজায় বিস্তর যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছিল কিন্তু আফগানিস্থান ও পশ্চিম ভারতের যোগসূত্র অটুট ছিল।
আবার দুর্যোগ উপস্থিত হল। আমুদরিয়ার উত্তরের শক জাতি ইউয়ে-চিদের হাতে পরাজিত হয়ে আফগানিস্থান ছেয়ে ফেলল। কাবুল দখল করে তারা দক্ষিণ পশ্চিম দুদিকেই ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ-আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান ও সিন্ধুদেশে তাদের বসতি পাকাপাকি হলে পর এই অঞ্চলের নাম সংস্কৃতে শকদ্বীপ ও ইরানীতে সন্তান হয়। বর্বর শকেরা ইরানী, গ্রীক ও ভারতীয়দের সংস্রবে এসে কিছুটা সভ্য হয়েছিল বটে কিন্তু আফগানিস্থানের ইতিহাসে তারা কিছু দিয়ে যেতে পারেনি।
শকদের হারায় ইন্দো-পার্থিয়ানরা। এদের শেষ রাজা গন্ধফারনেস, নাকি যীশু খ্রীষ্টের শিষ্য সেন্ট টমাসের হাতে খ্ৰীষ্টান হন। কিন্তু এই সেন্ট টমাসের হাতেই নাকি আবিসিনিয়াবাসী হাবশীরাও খ্ৰীষ্টান হয় ও এরই কাছে মালাবার ও তামিলনাড়ের হিন্দুরাও নাকি খ্ৰীষ্টধর্ম গ্রহণ করে। মাদ্রাজের কয়েক মাইল দূরে এক পাহাড়ের উপর সেন্ট টমাসের কবর দেখানো হয়। কাজেই আফগানিস্থানে খ্ৰীষ্টধর্ম প্রচার বোধ করি বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কুষণ সম্রাটদের ইতিহাস ভারতে অজানা নয়। কুষণ-বংশের দ্বিতীয় রাজা বিম শক এবং ইরানী পার্থিয়ানদের হারিয়ে আফগানিস্থান দখল করেন। কনিষ্ক পশ্চিমে ইরান-সীমান্ত ও উত্তরে কাশগড় খোটান, ইয়ারকন্দ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। পেশাওয়ারের বাইরে কনিষ্ক যে স্কুপ নির্মাণ করিয়ে বুদ্ধের দেহাস্থি রক্ষা করেন তার জন্য তিনি গ্রীক শিল্পী নিযুক্ত করেন। সে-শিল্পী ভারতীয় গ্রীক না আফগান গ্ৰীক বলা কঠিন— দরকারও নেই-কারণ পশ্চিম-ভারত ও আফগানিস্থানের মধ্যে তখনন সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্য ছিল না।
যে-ভূপে কনিষ্ক শেষ বৌদ্ধ অধিবেশনের প্রতিবেদন তাম্রফলকে খোদাই করে রেখেছিলেন তার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। জলালাবাদে যে অসংখ্য স্থূপ এখনো খোলা হয়নি তারই একটার ভিতরে যদি সে প্রতিবেদন পাওয়া যায় তাহলে আফগান ঐতিহাসিকেরা (?) আশ্চর্য হবেন না। কনিষ্ককে যদি ভারতীয় রাজা বলা হয় তাহলে তাকে আফগান রাজা বলতেও কোনো আপত্তি নেই। ধর্মের কথা এখানে অবান্তর কনিষ্ক বৌদ্ধ হওয়ার বহুপূর্বেই আফগানিস্থান তথাগতের শরণ নিয়েছিল।
ভারতবর্ষে কুষণ-রাজ্য পতনের পরও আফগানিস্থানে কিদার কুষণগণ দু শ বছর রাজত্ব করেন।
এ যুগের সবচেয়ে মহৎ বাণী গান্ধার শিল্পে প্রকাশ পায়। ভারতীয় ও গ্রীক শিল্পীর যুগ্ম প্রচেষ্টায় যে কলা বৌদ্ধধর্মকে রূপায়িত করে তার শেষ নিদর্শন দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতবর্ষে পাওয়া যায়। তার যৌবনমধ্যাহ্ন আফগানিস্থান ও পূর্ব-তুর্কীস্থানের ষষ্ঠ শতকের শিল্পে স্বপ্রকাশ। গুপ্তযুগের শিল্পপ্রচেষ্টা গান্ধারের কাছে কতটা ঋণী তার ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। ভারতবর্ষের সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ কখনো কখনো গান্ধার শিল্পের নিন্দা করেছে–যেদিন বৃহত্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখব সেদিন জানব যে, ভারতবর্ষ ও আফগানিস্থানকে পৃথক করে দেখা পরবর্তী যুগের কুসংস্কার। বৌদ্ধধর্মের অনুপ্রেরণায় ভারত অনুভূতির ক্ষেত্রে যে সার্বভৌমিকত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল পরবর্তী যুগে তা আর কখনো সম্ভবপর হয়নি। আফগানিস্থানের ভূগর্ভ থেকে যেমন যেমন গান্ধার শিল্পের নিদর্শন বেরোবে সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের চারুকলার ইতিহাস লেখা হয়ে ভারতবর্ষকে তার ঋণ স্বীকার করাতে বাধ্য করবে।
ভারতবর্ষে যখন গুপ্ত-সম্রাটদের সুশাসনে সনাতনধর্ম বৈষ্ণব রূপ নিয়ে প্রকাশ পেল, আফগানিস্থান তখনো বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করেনি। মৌর্যদের মত গুপ্তরা আফগানিস্থান জয় করার চেষ্টা করেননি, কিন্তু আফগানিস্থানে পরবর্তী যুগের শক শাসনপতিগণ হীনবল। পঞ্চম শতকের চীন পর্যটক ফা-হিয়েন কাবুল খাইবার হয়ে ভারতবর্ষে আসবার সাহস করেননি, খুব সম্ভব আফগান সীমান্তের অরাজকতা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে অনেক দূরের অনেক কঠিন রাস্তা পামির কাশ্মীর হয়ে ভারতবর্ষ পৌঁছান।
তারপর বর্বর হুণ অভিযান ঠেকাতে গিয়ে ইরানের রাজা ফিরোজ প্রাণ দেন। হূণ অভিযান আফগানিস্থানের বহু মঠ ধ্বংস করে ভারতবর্ষে পৌঁছয়— গুপ্ত সম্রাটদের সঙ্গে তাদের যে সব লড়াই হয় সেগুলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে লেখা আছে। এই তুণ এবং আফগানদের সংমিশ্রণের ফলে পরবর্তী যুগে রাজপুত বংশের সূত্রপাত।
সপ্তম শতকে হিউয়েন-সাঙ তাশক সমরকন্দ হয়ে, আমুদরিয়া অতিক্রম করে কাবুল পৌঁছন। কাবুল তখন কিছু হিন্দু, কিছু বৌদ্ধ। ততদিনে ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের নবজীবন লাভের স্পন্দন কাবুল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। শান্ত ভারতবাসীই যখন বেশীদিন বৌদ্ধধর্ম সইতে পারল
তখন দুর্ধর্ষ আফগানের পক্ষে যে জীবে দয়ার বাণী মেনে চলতে কষ্ট হয়েছিল তাতে বিশেষ সন্দেহ করার কারণ নেই। হিউয়েন-সাঙ কান্দাহার গজনী কাবুলকে ভারতবর্ষের অংশরূপে গণ্য করেছেন।
এখন আরব ঐতিহাসিকদের যুগ। তাদের মতে আরবরা যখন প্রথম আফগানিস্থানে এসে পৌঁছয় তখন সে-দেশ কনিষ্কের বংশধর তুকী রাজার অধীনে ছিল। কিন্তু পরে তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী সিংহাসন দখল করে ব্ৰহ্মণ্য রাজ্য স্থাপন করেন। ৮৭১ সনে ইয়াকুব-বিনলয়েস কাবুল দখল করেন। শাহিয়া বংশ তখন পাঞ্জাবে এসে আশ্রয় নেন শেষ রাজা ত্রিলোচন পাল গজনীর সুলতান মাহমুদের হাতে ১০২১ সনে পরাজিত হন। আফগানিস্থানের শেষ হিন্দু রাজবংশের বাকি ইতিহাস কাশ্মীরে। কহণের রাজতরঙ্গিণীতে তাঁদের বর্ণনা আছে।
এখানে এসে ভারতীয় পণ্ডিতগণ এক প্রকাণ্ড ঢেরা কাটেন। আমি পণ্ডিত নই, আমার মনে হয় তার কোনোই কারণ নেই। প্রথম আর্য অভিযানের সময় কিম্বা তারও পূর্ব থেকে আফগানিস্থান ও ভারতবর্ষ নানা যুদ্ধ বিগ্রহের ভিতর দিয়ে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত একই ঐতিহ্য নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখবার চেষ্টা করেছে। যদি বলা হয় আফগানরা মুসলমান হয়ে গেল বলে তাদের অন্য ইতিহাস তাহলে বলি, তারা একদিন অগ্নিউপাসনা করেছিল, গ্রীক দেবদেবীর পূজা করেছিল, বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবুও যখন দুই দেশের ইতিহাস পৃথক করা যায় না, তখন তাদের মুসলমান হওয়াতেই হঠাৎ কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? বুদ্ধের শরণ নিয়ে কাবুলী যখন মগধবাসী হয়নি তখন ইসলাম গ্রহণ করে সে আরবও হয়ে যায়নি। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে মুসলিম আফগানিস্থান বিশেষ করে কান্দাহার, গজনী, কাবুল, জলালাবাদ— বাদ দিলে ফ্রন্টিয়ার, বানু, কোহাট এমন কি পাঞ্জাবও বাদ দিতে হয়।
পার্থক্য তবে কোথায়? যদি কোনো পার্থক্য থাকে, তবে সে শুধু এইটুকু যে, মাহমুদ-গজনীর পূর্বে ভারতবর্ষের লিখিত ইতিহাস নেই, মাহমুদের পরে প্রতি যুগে নানা ভূগোল, নানা ইতিহাস লেখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জ্ঞান-অজ্ঞানের শক্ত জমি চোরাবালির উপর তো আর ইতিহাসের তাজমহল খাড়া করা হয় না।
মাহমুদের ইতিহাস নূতন করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁর সভাপণ্ডিত অল-বীরানীর কথা বাদ দেবার উপায় নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে ছয়জন পণ্ডিতের নাম করলে অল-বীরূনীর নাম করতে হয়। সংস্কৃত-আরবী অভিধান ব্যাকরণ সে যুগে ছিল না (এখনো নেই), অল-বীরূনী ও ভারতীয় ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোনো মাধ্যম ভাষা ছিল না। তৎসত্ত্বেও এই মহাপুরুষ কি করে সংস্কৃত শিখে, হিন্দুর জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষ, কাব্য, অলঙ্কার, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সম্বন্ধে হকীক-ই-হিন্দ নামক বিরাট গ্রন্থ লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন সে এক অবিশ্বাস্য প্রহেলিকা।
একাদশ শতাব্দীতে অল-বীরূনী ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ লিখেছিলেন— প্রত্যুত্তরে আজ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় আফগানিস্থান সম্বন্ধে পুস্তক লেখেননি। এক দারশীপূহ ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ আরবী ও সংস্কৃতে এরকম অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখাতে পারেননি। এই বিংশ শতকেই কটি লোক সংস্কৃত আরবী দুই-ই জানেন আঙুলে গুণে বলা যায়।
ভারতবর্ষের পাঠান তুর্কী সম্রাটেরা আফগানিস্থানের দিকে ফিরেও তাকাননি, কিন্তু আফগানিস্থানের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংস্কৃতিগত সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি। একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। আলাউদ্দীন খিলজীর সভাকবি আমীর খুসরু ফার্সীতে কাব্য রচনা করেছিলেন। তার নাম ইরানে কেউ শোননননি, কিন্তু কাবুল-কান্দাহারে আজকের দিনেও তার প্রতিপত্তি হাজিফ-সাদীর চেয়ে কম নয়। ইশকিয়া কাব্যে দেবলা দেবী ও খিজর খানের প্রেমের কাহিনী পড়েননি এমন শিক্ষিত মৌলবী আফগানিস্থানে আজও বিরল।
আফগানিস্থান বিশেষ করে গজনীর দৌত্যে উত্তর-ভারতবর্ষে ফার্সী ভাষা তার সাহিত্যসম্পদ, বাইজনটাইন সেরাসীন ইরানী স্থাপত্য, ইতিহাস-লিখনপদ্ধতি, ইউনানী ভেষজবিজ্ঞান, আরবীফার্সী শাস্ত্রচর্চা ইত্যাদি প্রচলিত হয়ে, নূতন নূতন ধারা বয়ে নব নব বিকাশের পথে এগিয়ে চলল। একদিন আফগানিস্থান গ্রীক ও ভারতবাসীকে মিলিয়ে দিয়ে গান্ধার-কলার সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল, পাঠান-তুর্কী যুগে সেই আফগানিস্থান আরব-ইরানের সঙ্গে ভারতবর্ষের হাত মিলিয়ে দিল।
তারপর তৈমুরের অভিযান।
তৈমুরের মৃত্যুর পর তার বংশধরগণ সমরকন্দ ও হিরাতে নূতন শিল্পপ্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু আফগানিস্থানের হিরাত অতি সহজেই তুর্কীস্থানের সমরকন্দকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তৈমুরের পুত্র শাহরুখ চীন দেশ থেকে শিল্পী আনিয়ে ইরানীদের সঙ্গে মিলিয়ে হিরাতে নবীন চারুকলার পত্তন করেন। তৈমুরের পুত্রবধূ গৌহর শাদ শিক্ষাদীক্ষায় রানী এলিজাবেথ, ক্যাথরিনের চেয়ে কোনো অংশে ন্যূন ছিলেন না। তার আপন অর্থে তৈরী মসজিদ-মাদ্রাসা দেখে তৈমুরের প্রপৌত্র বাবুর বাদশাহ চোখ ফেরাতে পারেননি। এখনো আফগানিস্থানে যেটুকু দেখবার আছে, সে ঐ হিরাতে যে কয়টি মিনার ইংরেজের বর্বরতা সত্ত্বেও এখনো বেঁচে আছে, সেগুলো দেখে বোঝা যায় মধ্য-এশিয়ার সর্বকলাশিল্প কী আশ্চর্য প্রাণবলে সম্মিলিত হয়ে এই অনুর্বর দেশে কী অপূর্ব মরূদ্যান সৃষ্টি করেছিল।
অল-বীরূনীর পর গৌহর শাদ, তারপর বাবুর বাদশাহ।
শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিতের নির্লজ্জ জাত্যভিমানের চূড়ান্ত প্রকাশ হয় যখন সে বাবরের আত্মজীবনী অপেক্ষা জুলিয়াস সীজারের আত্মজীবনীর বেশী প্রশংসা করে। কিন্তু সে আলোচনা উপস্থিত মুলতুবি থাক।
আফগানিস্থান ভ্রমণে যাবার সময় একখানা বই সঙ্গে নিয়ে গেলেই যথেষ্ট–সে-বই বাবুরের আত্মজীবনী। বাবুর কান্দাহার গজনী কাবুল হিরাতের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে আজকের আফগানিস্থানের বিশেষ তফাত নেই।
বাবুর ফরগনার রাজা নন, আফগানিস্থানের শাহানশাহ নন, দিল্লীর সম্রাটও নন। আত্মজীবনীর অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশ পায়, বাবুর এসবের অতীত অত্যন্ত সাধারণ মাটির-গড়া মানুষ। হিন্দুস্থানের নববর্ষার প্রথম দিনে তিনি আনন্দে অধীর, জলালাবাদের আখ খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ— সেই আখ আপন দেশ ফরগনায় পোঁতবার জন্য টবে করে হিন্দুকুশের ভিতর দিয়ে চালান করেছেন, আর ঠিক তেমনি হিরাত থেকে গৌহর শাদের জ্ঞানবিজ্ঞান শিল্পকলা টবে করে নিয়ে এসে দিল্লীতে পুঁতে ভাবছেন এর ভবিষ্যৎ কি, এ তরু মঞ্জরিত হবে তো?
হয়েছিল। তাজমহল।
বাবুর ভারতবর্ষ ভালবাসেননি। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল বলে বুঝতে পেরেছিলেন, ফরগনা কাবুলের লোভে যে বিজয়ী বীর দিল্লীর তখৎ ত্যাগ করে সে মূর্খ। দিল্লীতে নূতন সাম্রাজ্য স্থাপনা করলেন তিনি আপন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু দেহ কাবুলে পাঠাবার হুকুম দিলেন মরবার সময়।
সমস্ত কাবুল শহরে যদি দেখবার মত কিছু থাকে, তবে সে বাবুরের কবর।
হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব। নব মৌর্য সাম্রাজ্য।
নাদির উত্তর-ভারতবর্ষ লণ্ডভণ্ড করে ফেরার পথে আফগানিস্থানে নিহত হন। লুষ্ঠিত ঐশ্বর্য আফগান আহমদ শাহ আবদালীর (সাদদোজাই দূররানী) হস্তগত হয়। ১৭৪৭ সালের সমস্ত আফগানিস্থান নিয়ে সর্বপ্রথম নিজস্ব রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হল। ১৭৬১ সালে পানিপথ। ১৭৯৩ সালে শিখদের নবজীবন।
ইতিমধ্যে মহাকাল শ্বেতবর্ণ ধারণ করে ভারতবর্ষে তাণ্ডবলীলা আরম্ভ করেছেন। ভারত-আফগানের ইতিহাসে এই প্রথম এক জাতের মানুষ দেখা দিল যে এই দুই দেশের কোনো দেশকেই আপন বলে স্বীকার করল না। এ যেন চিরস্থায়ী তৈমুর-নাদির।
উনবিংশ এবং বিংশ শতকে ইংরেজ হয় আফগানিস্থান জয় করে রাজ্য স্থাপনা করার চেষ্টা করেছে, নয় আফগান সিংহাসনে আপন পুতুল বসিয়ে রুশের মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আফগানিস্থান জয় করা কঠিন না হলেও দখল করা অসম্ভব। বিশেষত, কাফির ইংরেজের পক্ষে। আফগান মোল্লার অজ্ঞতা তার পাহাড়েরই মত উঁচু, কিন্তু ইংরেজকে সে বিলক্ষণ চেনে।
ইংরেজের পরম সৌভাগ্য যে, ১৮৫৭ সালে আমীর দোস্ত মুহম্মদ ইংরেজকে দোন্তী দেখিয়েছিলেন। তার চরম সৌভাগ্য যে, ১৯১৫ সালে রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ আমীর হবীব উল্লাকে ভারত আক্রমণে উৎসাহিত করতে পারেননি।
কিন্তু তিন বারের বার বেল টাকে পড়ল। আমান উল্লা ইংরেজকে সামান্য উত্তম-মধ্যম দিয়েই স্বাধীনতা পেয়ে গেলেন। তাই বোধ হয় কাবুলীর বলে খুদা-দাদ আফগানিস্থান অর্থাৎ বিধিদত্ত আফগানিস্থান।
জিন্দাবাদ খুদা-দাদ আফগানিস্থান!