আমান উল্লা ইয়োরোপ থেকে নিয়ে এলেন একগাদা দামী আসবাবপত্র, অগুনতি মোটর গাড়ি আর বক্তৃতা দেবার বদ অভ্যাস। প্রাচ্যদেশের লোক খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আরামে গা এলিয়ে দেয়, পশ্চিমে ডিনারের পর স্পীচ, লাঞ্চের পর অরেটরি–তাও আবার যত সব শিরঃপীড়াদায়ক পোলিটিক্যাল বিষয় নিয়ে।
সায়েবরা বিলেতে লাঞ্চে ডিনারে আমান উল্লাকে যে নেশার পয়লা পাত্র খাইয়ে দিয়েছিল তার খোয়ারি তিনি চালালেন কাবুলে ফিরে এসে, মাত্রা বাড়িয়ে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝেড়ে। পর পর তিনদিনে নাকি তিনি একুনে ত্রিশ ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
কিন্তু কারো কথায় তো আর গায়ে ফোস্কা পড়ে না, কাবুলে চিঁড়ের প্রচলন নেই—কাজেই শ্রোতারা কেউ ঘুমলো, কেউ শুনলে, দু-একজন মনে মনে ইউরোপে তাঁর বাজে খর্চার আঁক কষলো।
তারপর আরম্ভ হল সংস্কারের পালা। একদিন সকাল বেলা মৌলানার বাড়ি যেতে গিয়ে দেখি পনবো আনা দোকানপাট বন্ধ। বড় দোকানের ভিতর গ্রামোফোন-ফোটোগ্রাফের দোকানটা খোলা ছিল। দোকানদার পাঞ্জাবী, অমৃতসরের লোক; আমাদের সঙ্গে ভাব ছিল।
খবর শুনে বিশ্বাস হল না। আমান উল্লার হুকুম, কার্পেটের উপর পদ্মাসনে বসে দোকান চালাবার কায়দা বেআইনী করা হল; সব দোকানে বিলিতী কায়দায় চেয়ার টেবিল চাই।
আমি বললুম, সে কি কথা? ছুতোর কামার, কালাইগর, মুচী?
সব, সব।
ছোট ঘোট খোপের ভিতর চেয়ার টেবিল ঢোকাবে কি করে, পাবেই বা কোথায়?
নিরুত্তর।
যারা পয়সাওয়ালা, যাদের দোকানে জায়গা আছে?
রাতারাতি মেজ-কুর্সি পাবে কোথায়? ছুতোরও ভয়ে দোকান বন্ধ করেছে। বলে, চেয়ারে বসে টেবিলে তক্তা রেখে সে নাকি বাঁদা চালাতে শেখেনি।
আগের থেকে নোটিশ দিয়ে হুশিয়ার করা হয়নি?
না। জানেন তো, আমান উল্লা বাদশার সব কুছ ঝটপট্।
পাক্কা তিন সপ্তাহ চোদ্দ আনা দোকানপাট বন্ধ রইল। গম ডাল অবশ্যি পিছনের দরজা দিয়ে আড়ালে আবডালে বিক্রি হল, তাদের উপরে চোটপাট করে পুলিশ দুপয়সা কামিয়ে নিল।
আমান উল্লা হার মানলেন কিনা জানিনে তবে তিন সপ্তাহ পরে একে একে সব দোকানই খুলল—পূর্ববৎ, অর্থাৎ বিন্ চেয়ারটেবিল। কাবুলের সবাই এই ব্যাপারে চটে গিয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু রাজার খামখেয়ালিতে তারা অভ্যস্ত বলে অত্যধিক উষ্মবোধ করেনি। কাবুলীদের এ মনোভাবটা আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি কারণ আমরা ভারতরর্ষে অত্যাচার-অবিচারে অভ্যস্ত বটে, কিন্তু খামখেয়ালি বড় একটা দেখতে পাইনে।
আমার মনে খটকা লাগল। পাগমনের পাগলামির কথা মনে পড়ল–গাঁয়ের লোককে শহরে ডেকে এনে মর্নিংসুট পরাবার বিড়ম্বনা। এ যে তারি পুনরাবৃত্তি; এ যে আরো পীড়াদায়ক, মূল্যহীন, অর্থহীন, ইয়োরোপর অন্ধানুকরণ।
মীর আলমের সঙ্গে দেখা হলে পর তিনি আমাকে সবিস্তর আলোচনা না করতে দিয়ে যেটুকু বললেন বাঙলা ছন্দে তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—
কয়লাওয়ালার দোস্তী? তওবা!
ময়লা হতে রেহাই নাই
আতরওয়ালার বাক্স বন্ধ
দিলখুশ তবু পাই খুশবাই।
আমি বললুম, এ তো হল সূত্র, ব্যাখ্যা করুন।
মীর আসলম বললেন, পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে ইংরেজ ফরাসী প্রভৃতি ফিরিঙ্গী সম্প্রদায়ের সঙ্গে গাত্র ঘর্ষণ করতঃ আমান উল্লা যে কৃষ্ণপ্রস্তর চূর্ণ সর্বাঙ্গে লেপন করিয়া আসিয়াছেন তদ্বারা তিনি কাবুলহট্ট মসীলিপ্ত করিবার বাসনা প্রকাশ করিতেছেন।
তথাপি অস্মদ্দেশীয় বিদগ্ধজনের শোক কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইত যদি নৃপতি প্রস্তরচূর্ণের সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ প্রস্তরখণ্ডও আনয়ন করিতেন। তদ্বারা ইন্ধন প্রজ্বলিত করিলে দীন দেশের শৈত্য নিবারিত হইত।
আমি বললুম, চেয়ারটেবিল চালানো যদি মসীলেপন মাত্রই হয় তবে তা নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর দুঃখ করবার কি আছে বলুন।
মীর আসলম বললেন, অযথা শক্তিক্ষয়। নৃপতির অবমাননা। ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কিন্তু আর পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেখলুম যে, তাঁরা মীর আসলমের মত কালো চশমা পরে ভবিষ্যৎ এত কালো করে দেখছেন না। ছোরাদের চোখে তো গোলাপী চশমা; গোলাপী বললেও ভুল বলা হয়–সে চশমা লাল টকটকে, রক্ত-মাখানো। তারা বলে, যে সব বদমায়েশরা এখনো কার্পেটে বসে দোকান চালাচ্ছে তাদের ধরে ধরে কামানের মুখে বেঁধে হাজারো টুকরো করে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। আমান উল্লা নিতান্ত ঠাণ্ডা বাদশা বলেই তাদের রেহাই দিয়েছেন।
ভেবে চিন্তে আমি গোলাপী চশমাই পরলুম।
তার কিছুদিন পরে আরেক নয়া সংস্কারের খবর আনলেন মৌলানা। আফগান সেপাইদের মানা করা হয়েছে, তারা যেন কোনো মোল্লাকে মুরশীদ না বানায় অর্থাৎ গুরু স্বীকার করে যেন মন্ত্র না নেয়।
খাঁটী ইসলামে গুরু ধরার রেওয়াজ নেই। পণ্ডিতেরা বলেন, কুরান শরীফ কিতাবুম্মুবীন অর্থাৎ খোলা কিতাব; তাতেই জীবনযাত্রার প্রণালী আর পরলোকের জন্য পুণ্য সঞ্চয়ের পন্থা সোজা ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে; গুরু মেনে নিয়ে তার অন্ধানুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই।
অন্য দল বলেন, একথা আরবদের জন্য খাটতে পারে, কারণ তারা আরবীতে কুরান পড়তে পারে। কিন্তু ইরানী, কাবুলীরা আরবী জানে না; গুরু না নিলে কি উপায়?
এ-তর্কের শেষ কখনো হবে না।
কিন্তু বিষয়টা যদি ধর্মের গণ্ডির ভিতরেই বন্ধ থাকত, তবে আমান উল্লা গুরু-ধরা বারণ করতেন না। কারণ, যদিও মানুষ গুরু স্বীকার করে ধর্মের জন্য, তবু দেখা যায় যে, শেষ পর্যন্ত গুরু দুনিয়াদারীর সব ব্যাপারেও উপদেশ দিতে আরম্ভ করেছেন এবং গুরুর উপদেশ সাক্ষাৎ আদেশ।
তাহলে দাঁড়ালো এই যে, আমান উল্লার আদেশের বিরুদ্ধে মোল্লা যদি তার শিষ্য কোনো সেপাইকে পাল্টা আদেশ দেন, তবে সে সেপাই মোল্লার আদেশই যে মেনে নেবে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
চার্চ বনাম স্টেট।
গোলাপী চশমাটা কপালে তুলে অনুসন্ধান করলুম, দেয়ালে কোনো লেখা ফুটে উঠেছে কিনা, আমান উল্লা কেন হঠাৎ এ আদেশ জারী করলেন। তবে কি কোনো অবাধ্যতা, কোনো বিদ্রোহ, কোনো? কিন্তু এসব সন্দেহ কাবুলে মুখ ফুটে বলা তো দূরের কথা, ভাবতে পর্যন্ত ভয় হয়।
আমার শেষ ভরসা মীর আসলম। তিনি দেখি কালো চশমায় আরেক পোঁচ ভুসো মাখিয়ে রাজনৈতিক আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। খবরটা দেখলুম তিনি বহু পূর্বেই জেনে গিয়েছেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ইহলোক পরলোক সর্বলোকের জন্যই গুরু নিষ্প্রয়োজন। তৎসত্ত্বেও যদি কেহ অনুসন্ধান করে, তবে তাহাকে প্রতিরোধ করাও তোেধিক নিপ্রয়োজন।
আমি বললুম, কিন্তু আপনি যখন আপনার ভারতীয় গুরুর কথা স্মরণ করেন, তখনই তো দেখেছি তার প্রশংসায় আপনি পঞ্চমুখ।
মীর আসলম বললেন, গুরু দ্বিবিধ; যে গুরুগৃহে প্রবেশ করার দিন তোমার মনে হইবে, গুরু ভিন্ন পদমাত্র অগ্রসর হইতে পারো না এবং ত্যাগ করার দিন মনে হইবে, গুরুতে তোমার প্রয়োজন নাই, তিনিই যথার্থ গুরু গুরুর আদর্শ তিনি যেন একদিন শিষ্যের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন হইতে পারেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর গুরু শিষ্যকে প্রতিদিন পরাধীন হইতে পরাধীনতর করেন। অবশেষে গুরুবিনা সে-শিষ্য নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস কর্ম পর্যন্ত সুসম্পন্ন করিতে পারে না। আমার গুরু প্রথম শ্রেণীর। আফগান সৈন্যের গুরু দ্বিতীয় শ্রেণীর।
আমি বললুম, অর্থাৎ আপনার গুরু আপনাকে স্বাধীন করলেন; আফগান সেপাইয়ের গুরু তাকে পরাধীন করেন। পরাধীনতা ভালো জিনিস নয়, তবে কেন বলেন, গুরু নিষ্প্রয়োজন? বরঞ্চ বলুন, গুরুগ্রহণ সেখানে অপকর্ম।
মীর আসলম বললেন, ভদ্র, সত্য কথা বলিয়াছ, কিন্তু প্রশ্ন, সংসারে কয়জন লোক স্বাধীন হইয়া চলিতে ভালোবাসে বা চলিতে পারে। যাহারা পারে না, তাহাদের জন্য অন্য কি উপায়?
আমি বললুম, খুদায় মালুম। কিন্তু উপস্থিত বলুন, সৈন্যদের বিদ্রোহ করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা?
মীর আসলম বললেন, নৃপতির সন্নিকটস্থ সেনাবাহিনী কখনো বিদ্রোহ করে না, যতক্ষণ না সিংহাসনের জন্য অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত হন।
আমি ভারী খুশী হয়ে বিদায় নিতে গিয়ে বললুম, কয়েক দিন হল লক্ষ্য করছি, আপনার ভাষা থেকে আপনি কঠিন আরবী শব্দ কমিয়ে আনছেন। সেটা কি সজ্ঞানে?
মীর আসলম পরম পরিতোষ সহকারে মাথা দোলাতে দোলাতে হঠাৎ অত্যন্ত গ্রাম্য কাবুলী ফার্সীতে বললেন, এ্যাদ্দিনে বুঝতে পারলে চঁাদ? তবে হক কথা শুনে নাও। আর বছর যখন হেথায় এলে তখন ফার্সী জানতে ঢু-টু। তাইতে তোমায় তালিম দেবার জন্য আরবী শব্দের বেড়া বানাতুম, তুমি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে পেরোতে; গোগাড়ার দিকে ঠ্যাঙগুলো জখম-টখমও হয়েছে। এখন দিব্যি আরবী ঘোড়ার মত আরবী বেড়া ডিঙোচ্ছে বলে খামকা বখেড়া বাঁধার কম্ম বন্ধ করে দিলুম। গুরু এখন ফালতো। মাথার ভসভসে ঘিলুতে তুরপুন সিধোলো?
আমি বাড়ি ফেরার সময় ভাবলুম, লোকটি সত্যিকার পণ্ডিত। গুরু কি করে নিজেকে নিষ্প্রয়োজন করে তোলেন, সেটা হাতেকলমে দেখিয়ে দিলেন।
তারপর বেশী দিন যায়নি, এমন সময় একদিন নোটিশ পেলুম, একদল আফগান মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তুর্কীতে পাঠানো হবে; স্বয়ং বাদশা উপস্থিত থেকে তাদের বিদায়-আশীর্বাদ দেবেন।
আমি যাইনি। বৃটিশ রাজদূতাবাসের এক উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মচারীর মুখ থেকে বর্ণনাটা শুনলুম। তার নাম বলব না, সে নাম এখনো মাঝে মাঝে ভারতবর্ষের খবরের কাগজে ধূমকেতুর মত দেখা দেয়। বললেন, গিয়ে দেখি, জনকুড়ি কাবুলী মেয়ে গার্ল গাইডের ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে। আমান উল্লা স্বয়ং উপস্থিত, অনেক সরকারী কর্মচারী, বিদেশী রাজদূতাবাসের গণ্যমান্য সভ্যগণ, আর একপাশে মহিলারা। রানী সুরাইয়াও আছেন, হ্যাটের সামনে পাতলা নেটের পরদা।
আমান উল্লা উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধে অনেক খাঁটি.এবং পুরানো কথা দিয়ে অবতরণিকা শেষ করে বললেন, আমি পর্দা-প্রথার পক্ষপাতী নই, তাই আমি এই মেয়েদের বিনা বোরকার তুর্কী পাঠাচ্ছি। কিন্তু আমি স্বাধীনতাপ্রয়াসী; তাই কাবুলের কোন মেয়ে যদি মুখের সামনের পর্দা ফেলে দিয়ে রাস্তায় বেরোতে চায়, তবে আমি তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। আবার আমি কাউকে জোর করতেও চাইনে, এমন কি, মহিষী সুরাইয়াও যদি বোরকা পরাই পছন্দ করেন, তাতেও আমার আপত্তি নেই।
কর্মচারিটি বললেন, এতটা ভালোয়-ভালোয় চলল। কিন্তু আমান উল্লার বক্তৃতা শেষ হতেই রানী সুরাইয়া এগিয়ে এসে নাটকি ঢঙে হ্যাটের সামনের পর্দা ছিঁড়ে ফেললেন। কাবুল শহরের লোক সভাস্থলে আফগানিস্থানের রাজমহিষীর মুখ দেখতে পেল।
কর্মচারিটির রসবোধ অত্যন্ত কম, তাই বর্ণনাটা দিলেন নিতান্ত নীরস-নির্জলা। কিন্তু খুঁটিয়ে খুটিয়ে যে জিজ্ঞেস করব, তারও উপায় নেই। হয়ত ঘুঘু এসেছেন রিপোর্ট তৈরি করবার মতলব নিয়ে ঘটনাটা ভারতবাসীর মনে কি রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তাই হবে রিপোর্টের মশলা। আমিও পোকার খেলার জুয়াড়ীয় মত মুখ করে বসে রইলুম।
যাবার সময় বললেন, এরকমধারা ড্রামাটিক কায়দায় পর্দা ছেড়ার কি প্রয়োজন ছিল। রয়েসয়ে করলেই ভালো হত না?
আমি মনে মনে বললুম, ইংরেজের সনাতন পন্থা। সব কিছু রয়েসয়ে। সব কিছু টাপেটোপে। তা সে ইংরিজী লেখাপড়া চালানোই হোক, আর ঢাকাই মসলিনের বুক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করাই হোক। ছুঁচ হয়ে ঢুকবে, মুষল হয়ে বেরবে।
কিছু একটা বলতে হয়। নিবেদন করলুম, এসব বিষয়ে এককালে ভারতবাসী মাত্রই কোনো না কোনো মত পোষণ করত। কারণ তখনকার দিনে আফগানিস্থান ভারতবর্ষের মুখের দিকে না তাকিয়ে কোনো কাজ করত না, কিন্তু এখন আমান উল্লা নিজের চোখে সমস্ত পশ্চিম দেখে এসেছেন, রাস্তা তার চেনা হয়ে গিয়েছে; আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু দেখব, মঙ্গল কামনা করব, ব্যস।
কর্মচারী চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে ভাবলুম।
কিন্তু একটা কথা এখানে আমি আমার পাঠকদের বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, আমি এবং কাবুলের আর পাঁচজন তখন আমান উল্লার এসব সংস্কার নিয়ে দিনরাত মাথা ঘামাইনি। মানুষের স্বভাব আপন ব্যক্তিগত সুখদুঃখকে বড় করে দেখা হাতের সামনের আপন মুঠি হিমালয় পাহাড়কে ঢেকে রাখে। দ্বিতীয়ত যে-সব সংস্কার করা হচ্ছিল তার একটাও আমার মত পাঁচজনের স্বার্থকে স্পর্শ করেনি। সুট সঙ্গে নিয়েই আমরা কাবুল গিয়েছি, কাজেই সুট পরার আইন আমাদের বিচলিত করবে কেন; আর আমরা পাতলা নেটের ব্যবসাও করিনে যে, মহারানী তার হ্যাটের নেট ছিঁড়ে ফেললে আমাদের দেউলে হতে হবে এবং সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, ইরান-আফগানিস্থানের বাদশা দেশের লোকের মাল-জানের মালিক। আর সকলেই জানে এই দুই বস্তুই অত্যন্ত ফানী–নশ্বর। নশ্বর জিনিস এমনি যাবে অমনিও যাবে— বাদশাহের খামখেয়ালি নিমিত্তের ভাগী মাত্র। রাজা বাদশা তো আর গাধাখচ্চর নন যে, শুধু দেশের মোট পিঠে করে বইবেন আর জাবর কাটবেন–তারা হলেন গিয়ে তাজী ঘোড়ার জাত। দেশটাকে পিঠে নিয়ে যেমন হঠাৎ প্রগতির দিকে খামকা ঊর্বশ্বাসে ছুটবেন, তেমনি কারণে অকারণে সোয়ারকে দুটো চারটে লাথিচাটও মারবেন। তাই বলে ত আর ঘোড়ার দানাপানি বন্ধ করে দেওয়া যায় না।
কাজেই কাবুল শহরের লোকজন খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুমচ্ছে, বেরিয়ে বেড়াচ্ছে।
এমন সময় আমান উল্লার প্রতিজ্ঞা যে, তিনি সব মেয়েদের বেপর্দায় বেরবার সাহায্য করবেন এক ভিন্নরূপ নিয়ে প্রকাশ পেল। শোনা গেল বাদশার হুকুম, কোনো স্ত্রীলোক যদি বেপর্দা বেরতে চায় তবে তার স্বামী যেন কোনো ওজর-আপত্তি না করে। যাদের আপত্তি আছে, তারা যেন বউদের তালাক দিয়ে দেয়। আর তারা যদি সরকারী চাকরী করে, তবে আমান উল্লা দেখে নেবেন। কি দেখে নেবেন? সেটা পষ্টাপষ্টি বলা হয়নি, তবে চাকরীটাও হয়ত বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে একই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। সাধে কি আর বাঙলায় বলি, বিবিজান চলে যান লবেজান করে। শুধু বিবিজান চলে গেলে সুস্থ মানুষ প্রেমিকদের কথা আলাদা–লবে-জান হবে কেন? সঙ্গে সঙ্গে চাকরীটা গেলে পর মানুষ অনাহারে লবেজান হয়।
মীর আসলম বললেন, গিন্নীকে গিয়ে বনু, ওগো চোখে সুরমা লাগিয়ে বে-বোরকায় কাবুল শহরে এট্টা রোদ মেরে এস। বিশ্বাস করবে না ভায়া, বদনা ছুঁড়ে মারলে। তা জানো তো, মোল্লার পাগড়ি, বদনাটাই খেল টোল। আম্মা অবশ্যি টাল খেয়ে খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম।
আমি বললুম, হাঁ হাঁ জানি, পাগড়ি অনেক কাজে লাগে।
মীর আসলম বললেন, ছাই জানো, বে করলে জানতে। বেয়াড়া বউকে তোমার তো আর বেঁধে রাখতে হয় না।
আমি বললুম, বাজে কথা। আমান উল্লা কাঁচ করে কেটে দিয়েছেন। আর ভালোই করেছেন, বউকে বেঁধে রাখতে হয় মনের শিকল দিয়ে, হৃদয়ের জিঞ্জির দিয়ে।
মীর আসলম বললেন, হৃদয়মনের কথা ওঠে যেখানে তরুণতরুণীর ব্যাপার। ষাট বছরের বুড়ো ষোল বছরের বউকে কোন্ মনের শেকল দিয়ে বাঁধতে পারে বলো? সেখানে কাবিননামা, সর্বাঙ্গ ঢাকা-বোরকা, আর পাগড়ির ন্যাজ।
আমি বললুম, তাতো বটেই।
মীর আসলম বললেন, আমান উল্লা যে পর্দা ছোড়ার জন্য তন্বী লাগিয়েছেন, তাতে জোয়ানদের কি? বেদনাটা সেখানে নয়। বুড়া সর্দারদের ভিতর চিংড়ি বউদের ঠেকাবার জন্য সামাল সামাল রব পড়ে গিয়েছে।
আমি শুধালুম, তরুণীরা চঞ্চল হয়ে উঠেছেন নাকি?
তিনি বললেন, ভ্যালা রে বিপদ, আমাকে তুমি নওরোজের আকবর বাদশা ঠাওরালে নাকি? চিংড়িদের আমি চিন কোত্থেকে? ইস্তক মেয়ে নেই, ছেলের বউও নেই। গিন্নীর বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু বয়স পঁড়িয়ে হাফ-টিকিট কেটেছেন, দেখলে বোঝা যায় শ খানেক হবে।
আমি বললুম, তবে কি বুড়োরা খামকা ভয় পেয়েছেন?
মীর আসলম বললেন, শোনো। খুলে বলি। আমান উল্লার হুকুম শোনা মাত্র চিংড়িরা যদি লাফ দিয়ে উঠত, তবে বুড়োরাও না হয় তার একটা দাওয়াই বের করত; এই মনে করো তুমি যদি হঠাৎ তলোয়ার নিয়ে কাউকে হামলা করো, সেও কিছু একটা করবে। বীর হলে লড়বে, বকরীর কলিজা হলে ন্যাজ দেখাবে। কিন্তু এ তো বাপু তা নয়, এ হল মাথার ওপর ঝোলানো নাঙা তলোয়ার। চিংড়িরা হয়ত সব চুপ করে বসে আছে রাস্তায় তো এখনো চাদের হাট বসেনি কিন্তু এক একজন এক এক শ খানা তলোয়ার হয়ে চঁাদির ওপর ঝুলে আছেন। চোখ দুটি বন্ধ করে একটিবার দেখে নাও, বাপু।
শিউরে উঠলুম।