রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ কানমন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন, ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করে আমান উল্লা আরো ভালো রকমেই বুঝতে পারলেন যে, চোরের যদি তিন দিন হয় তবে সাধুর মাত্র এক দিন। সেই একদিনের হকের জোরে তিনি লড়াই জিতেছেন–এখন আবার দুশমনের পালা। আমান উল্লা তার জন্য তৈরী হতে লাগলেন।
জমাখরচের খাতা খুলে দেখলেন, জমায় লেখা, আমান উল্লা খান দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে জনসাধারণের হৃদয় জয় করেছেন, তিনি আর আমীর আমান উল্লা নন— তিনি গাজী বাদশাহ আমান উল্লা খান।
খরচে লেখা, নসর উল্লার মোল্লার দল যদিও আসর থেকে সরে গিয়েছে তবু তাদের বিশ্বাস নেই। আমান উল্লা ফরাসী জানতেন
রেকুলের পূর মিয়ো সোতের, অর্থাৎ ভালো করে লাফ দেওয়ার জন্য পিছিয়ে যাওয়া প্রবাদটা তার অজানা ছিল না।।। কিন্তু আমান উল্লা মনে মনে স্থির করলেন, মোল্লারা সরকারী রাস্তার কোন্ খানে খানাখন্দ বানিয়ে রাখবে সে ভয় অহরহ বুকের ভিতর পুষে রাখলে দেশসংস্কারের মোটর টপ গিয়ারে চালান অসম্ভব। অথচ পুরা স্পীডে মোটর না চালিয়ে উপায় নেইসাধুর মাত্র এক দিন।
কাবুলে পৌঁছে যে দিকে তাকাই সেখানেই দেখি হরেকরকম সরকারী উর্দিপরা স্কুল-কলেজের ছেলেছোকরারা ঘোরাঘুরি করছে। খবর নিয়ে শুনি কোনোটা উর্দি ফরাসী স্কুলের, কোনোটা জর্মন, কোনোটা ইংরিজী আর কোনোটা মিলিটারি স্কুলের। শুধু তাই নয়, গাঁয়ের পাঠশালা পাশ করে যারা শহরে এসেছে তাদের জন্য ফ্রি বোর্ডিং, লজিং, জামাকাপড়, কেতাবপত্র, ইস্ট মেন্টবক্স, ডিক্সনরি, ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য খচ্চরের ভাড়া, এক কথায় অল ফাউণ্ড।
ভারতবর্ষের হয়ে আমি বললুম, নাথিং লস্ট।
প্যারিসফের্তা সইফুল আলম বুঝিয়ে বললেন, আপনি ভেবেছেন অল ফাউণ্ড হলে বিদ্যেও বুঝি সঙ্গে সঙ্গে জুটে যায়। মোটই না। হস্টেল থেকে ছেলেরা প্রায়ই পালায়।
আমি বললুম, ধরে আনার বন্দোবস্ত নেই?
সইফুল আলম বললেন, গাঁয়ের ছেলেরা শক্ত হাড়ে তৈরী। পালিয়ে বাড়ি না গিয়ে যেখানে সেখানে দিন কাটাতে পারে। তারও দাওয়াই আমান উল্লা বের করেছেন। হস্টেল থেকে পালানো মাত্রই আমরা সরকারকে খবর দিই। সরকারের তরফ থেকে তখন দুজন সেপাই ছছাকরার গায়ের বাড়িতে গিয়ে আসর জমিয়ে বসে, তিন বেলা খায় দায় এবং যদিও হুকুম নেই তবু সকলের জানা কথা যে, কোর্মা-কালিয়া না পেলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ছেলের বাপকে তিন বেলা মার লাগায়। বাপ তখ ছেলেকে খুজতে বেরোয়। সে এসে হস্টেলে হাজিরা দেবে, হেডমাস্টারের চিঠি গায়ে পৌঁছবে যে আসামী ধরা দিয়েছে তখন সেপাইরা বাপের ভালো দুম্বাটি কেটে বিদায়-ভোজ খেয়ে তাকে হুশিয়ার না করে শহরে ফিরবে। পরিস্থিতিটার পুনরাবৃত্তিতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
আমি বললুম, কিন্তু পড়াশোনায় যদি কেউ নিতান্তই গর্দভ হয় তবে?
পর পর তিনবার যদি ফেল মারে তবে হেডমাস্টার বিবেচনা করে দেখবেন তাকে ডিসমিস করা যায় কি না? বুদ্ধিশুদ্ধি আছে অথচ পড়াশোনায় ঢিটেমি করছে জানলে তার তখনো ছুটি নেই।
এর পর কোন দেশের রাজা আর কি করতে পারেন?
মিলিটারি স্কুলের ভার তুর্কদের হাতে। তুর্কী জেনারেলদের ঐতিহ্য বার্লিনের পৎদাম সমরবিদ্যায়তনের সঙ্গে জড়ানো; তাই শুনলুম স্কুলটি জর্মন কায়দায় গড়া। সেখানে কি রকম উন্নতি হচ্ছে তার খবর কেউ দিতে পারলেন না। শুধু অধ্যাপক বেনওয়া বললেন, ইস্কুলটা তুলে দিলে আফগানিস্থানের কিছু ক্ষতি হবে না।
মেয়েদের শিক্ষার জন্য আমান উল্লা আর তাঁর বেগম বিবি সুরাইয়া উঠে পড়ে লেগেছেন। বোরকা পরে এক কাবুল শহরেই প্রায় দুহাজার মেয়ে ইস্কুলে যায়, উঁচু পাঁচিলঘেরা আঙিনায় বাস্কেটবল, ভলিবল খেলে। সইফুল আলম বললেন, লিখতে পড়তে, আঁক কষতে শেখে, সেই যথেষ্ট। আর তাও যদি না শেখে আমার অন্তত কোন আপত্তি নেই। হারেমের বন্ধ হওয়ার বাইরে এসে লাফালাফি করছে এই কি যথেষ্ট নয়?
আমি সর্বান্তঃকরণে সায় দিলুম। সইফুল আলম কানে কানে বললেন, কিন্তু একজন লোক একদম সায় দিচ্ছেন না। রানী-মা।।
শুনে একটু ঘাবড়ে গেলুম। দুই শত্রু নিপাত করে, তৃতীয় শত্রুকে ঠাণ্ডা রেখে যিনি আমান উল্লাকে বাদশা বানাতে পেরেছেন তাঁর রায়ের একটা মূল্য আছে বই কি? তার মতে নাকি এত শিক্ষার খোরাক আফগানিস্থান হজম করতে পারবে না। এই নিয়ে নাকি মাতাপুত্রে মনোমালিন্যও হয়েছে মাতা অভিমানভরে পুত্রকে উপদেশ দেওয়া বন্ধ করেছেন। বধু সুরাইয়াও নাকি শাশুড়ীকে অবজ্ঞা করেন।
কিন্তু কাবুল শহর তখন আমান উল্লার চাবুক খেয়ে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে দেরেশি পরে। দেরেশি কথাটা ইংরিজী ড্রেস থেকে এসেছে অর্থাৎ হ্যাট, কোট, টাই, পাতলুন। খবর নিয়ে জানতে পারলুম, সরকারী কর্মচারী হলেই তাকে দেরেশি পরতে হয় তা সে বিশ টাকার কেরানীই হোক, আর দশ টাকার সিপাই-ই হোক। শুধু তাই নয়, দেরেশি পরা না থাকলে কাবুল নাগরিক সরকারী বাগানে পর্যন্ত ঢুকতে পায় না। একদিকে সরকারী চাপ, অন্যদিকে বাইরের চাকচিক্যের প্রতি অনুন্নত জাতির মোহ, মাঝখানে সিনেমার উস্কানি, তিনে মিলে কাবুল দেরেশিপাগল হয়ে উঠেছে।
ইন্তেক আবদুর রহমানের মনে ছোঁয়া লেগেছে। আমি বাড়িতে শিলওয়ার পরে বসে থাকলে সে খুতখুত করে; আটপৌরে সুট পরে বেরতে গেলে নীলকৃষ্ণ দেরেশি পরার উপদেশ দেয়।
মেয়েরাও তাল রেখে চলেছেন। আমীর হবীব উল্লা হারেমের মেয়েদের ফ্রক ব্লাউজ পরাতেন। আমান উল্লার আমলে দেখি ভদ্রমহিলা মাত্রেই উঁচু হিলের জুতো, হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক, আস্বচ্ছ সিল্কের মোজা, লম্বাহাতার আঁটসাট ব্লাউজ, দস্তানা আর হ্যাট পরে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। হ্যাটের সামনে একখানা অতি পাতলা নেট ঝুলছে বলে চেহারাখানা পষ্টাপষ্টি দেখা যায় না। যে মহিলার যত সাহস তার নেটের বুনুনি তো দিলে।
Figure কথাটার ফরাসী উচ্চারণ ফিগুর, অর্থ— মুখের চেহারা। ফরাসী অধ্যাপক বেনওয়া বলতেন, কাবুলী মেয়েদের ফিগার বোঝা যায় বটে, কিন্তু ফিগুর দেখবার উপায় নেই।
কিন্তু দেশের ধনদৌলত না বাড়িয়ে তো নিত্য নিত্য নূতন স্কুল-কলেজ খোলা যায় না, দেরেশি দেখানো যায় না, ফিগার ফলানো যায় না। ধনদৌলত বাড়াতে হলে আজকের দিনে কলকারখানা বানিয়ে শিল্পবাণিজ্যের প্রসার করতে হয়। তার জন্য প্রচুর পুজির দরকার। আফগানিস্থানের গাঁটে সে কড়ি নেই–বিদেশীদের হাতে দেশের শিল্পবাণিজ্য ছেড়ে দিতেও বাদশা নারাজ। আমান উল্লার পিতামহ দোর্দণ্ডপ্রতাপ আবদুর রহমান বলতেন, আফগানিস্থান সেদিনই রেলগাড়ি চালাবে যেদিন সে নিজের হাতে রেলগাড়ি তৈরী করতে পারবে। পিতা হবীব উল্লা সে আইন ঠিক ঠিক মেনে চলেননি। তবে কাবুলের বিজলী বাতির জন্য যে কলকজা কিনেছিলেন সেটা কাবুলী টাকায়। আমান উল্লা কি করবেন ঠিক মনস্থির করতে পারছিলেন না— ন্যাশনাল লোন তোলার উপদেশ কেউ কেউ তাকে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাহলে সবাইকে সুদ দিতে হয় এবং সুদ দেওয়া-নেওয়া ইসলামে বারণ।
হয়ত আমান উল্লা ভেবেছিলেন যে, দেশের গুরুভারের খানিকটে নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেশের আর পাঁচজনের কাঁধে যদি ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া যায় তাহলে প্রগতির পথে চলার সুবিধে হবে। আমান উল্লা বললেন, পার্লিমেন্ট তৈরী করো।
সে পার্লিমেন্টের স্বরূপ দেখতে পেলুম পাগমান গিয়ে।
কাবুল থেকে পাগমান কুড়িমাইল রাস্তা। বাস চলাচল আছে। সমস্ত শহরটা গড়ে তোেলা হয়েছে পাহাড়ের থাকে থাকে। দূর থেকে মনে হয় যেন একটা শাখ কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার ভঁজে ভাঁজে ঘোট ঘোট বাঙলো; অনেকটা ইতালিয়ান ভিলার মত। সমস্ত পাগমান শহর জুড়ে আপেল নাসপাতির গাছ বাঙলোগুলোকে ঘিরে রেখেছে অরি চূড়ার বরফগলা ঝরনা রাস্তার এক পাশের নালা দিয়ে থাকে থাকে নেমে এসেছে। পিচ ঢালা পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে উঠছি আর দেখছি দুদিকে ঘন সবুজের নিবিড় স্তব্ধ সুষুপ্তি। কোনো দিকে কোনো প্রকার জীবনযাত্রার চঞ্চলতা নেই, কঠিন পাথরের খাড়া দেয়াল নেই, ঘিনঘিনে হলদে রঙের বাড়িঘরদোর নেই। কিছুতেই মনে হয় না যে, নীরস কর্কশ আফগানিস্থানের ভিতর দিয়ে চলেছি, থেকে থেকে ভুল লাগে আর চোখ চেয়ে থাকে সামনের মোড় ফিরতেই নেবুর ঝুড়ি-কাঁধে খাসিয়া মেয়েগুলোকে দেখবে বলে।
বাদশা আমীর-ওমরাহ নিয়ে গ্রীষ্মকালটা এখানে কাটান। এক সপ্তাহের জন্য তামাম আফগানিস্থান এখানে জড়ো হয় জশন বা স্বাধীনতা দিবসের আমোদ আহলাদ করার জন্য। দল বেঁধে আপন আপন তাঁবু সঙ্গে নিয়ে এসে তারা রাস্তার দুদিকে যেখানে সেখানে সেগুলো খাটায়। সমস্ত দিন কাটায় চঁদমারি, মঙ্গোল নাচ, পল্টনের কুচকাওয়াজ দেখে, না হয় চায়ের দোকানে আড়া জমিয়ে; রাত্রে তাঁবুতে তাঁবুতে শুরু হয় গানের মজলিস। আজি এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই; জোয়ান হইব গোড়া হতে তবে এ জীবন দোহরাই— ধরনের ওস্তাদী গানের রেওয়াজ প্রায় নেই, হরেকরকম ফতুজানকে অনেকরকম সাধ্য-সাধনা। করে ডাকাডাকি করা হচ্ছে এসব গানের আসল ঝোঁক। মাঝে মাঝে একজন অতিরিক্ত উৎসাহে লাফ দিয়ে উঠে দুচার চক্কর নাচ ভী দেখিয়ে দেয়। আর সবাই গানের ফাঁকে ফাঁকে সাবাস সাবাস বলে নাচনেওয়ালাকে উৎসাহ দেয়।
এ-রকম মজলিসে বেশীক্ষণ বসা কঠিন। বন্ধ ঘরে যদি সবাই সিগারেট ফোঁকে তবে নিজেকেও সিগারেট ধরাতে হয় না হলে চোখ জ্বালা করে, গলা খুসখুস করতে থাকে। এসব মজলিসে আপনিও যদি মনের ভিতর কোনো ফতুজান বা কদম্ববনবিহারিণীর ছবি একে গলা মিলিয়ে না মিললেও আপত্তি নেই— চিৎকার করে গান না জোড়েন তবে দেখবেন ক্রমেই কানে তালা লেগে আসছে, শেষটায় ফাটার উপক্রম। রাগবি খেলার সঙ্গে এ-সব গানের অনেক দিক দিয়ে মিল আছে— তাই এর রসভোগ করতে হয় বেশ একটু তফাতে আলগোছে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু আমার বার বার মনে হল পাগমান হৈ-হল্লার জায়গা নয়। নিঝরের ঝরঝর, পত্র-পল্লবের মৃদু মর্মর, অচেনা পাখির একটানা কূজন, পচা পাইনের সোঁদা সোঁদা গন্ধ, সবসুদ্ধ মিলে গিয়ে এখানে বেলা দ্বিপ্রহরেও মানুষের চোখে তন্দ্রা আসে। ভর গ্রীষ্মকাল, গাছের তলায় বসলে তবু শীত শীত করে কোটের কলারটা তুলে দিতে ইচ্ছে করে, মনে হয় পেয়ালা, প্রিয়া, কবিতার বই কিছুরই প্রয়োজন নেই, একখানা ব্যাপার পেলে ওমটা ঠিক জমত।
ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। চোখ মেলে দেখি এক অপরূপ মূর্তি। কঁচাপাকা লম্বা দাড়িওয়ালা, ঘামে-ভেজা, আজন্ম অত অধৌত, পীত দন্তকৌমুদী বিকশিত এক আফগান সামনে দাঁড়িয়ে। এরূপ আফগান অনেক দেখেছি, কিন্তু এর পরনে ধারালো ক্রীজওয়ালা সদ্য নূতন কালো পাতলুন, কালো ওয়েস্টকোট, স্টার্চ করা শক্ত শার্ট, কোণ-ভাঙা স্টিফ কলার, কালো টাই, দু বোতামওয়ালা নব্যতম কাটের মর্নিং-কোট আর একমাথা বাবরি চুলের উপর দেড়ফুট উঁচু চকচকে সিল্কের অপেরা-হ্যাট। সব কিছু আনকোরা ঝা-চকচকে নূতন; দেখে মনে হল যেন এই মাত্র দর্জির কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে বের করে গাছতলায় দাঁড়িয়ে পরা হয়েছে। যা তা দেরেশি নয়, ষোল আনা মনিং-সুট। প্যারেডের দিনে লাট-বেলাট এই রকম সুট পরে সেলুট নেন।
বেল্টের অভাবে পাজামার নোংরা নেওয়ার দিয়ে পাতলুন বাঁধা, কালো ওয়েস্টকোট আর পাতলুনের সঙ্গমস্থল থেকে একমুঠো ধবধবে সাদা শার্ট বেরিয়ে এসেছে, টাইটাও ওয়েস্টকোটের উপরে ঝুলছে।
বাঁ হাতে পাগড়ির কাপড় দিয়ে বানানো বোঁচকা, ডান হাতে ফিতেয় বাঁধা একজোড়া নূতন কালো বুট। তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি পায়ে জুতো মোজা নেই!
আমাকে পশতু ভাষায় অভিবাদন করে বোঁচকাটা কাঁধে ফেলে, লম্বা হাতে বুট জোড়া দোলাতে দোলাতে ওরাংওটাঙের মত বড় রাস্তার দিকে রওয়ানা হল।
আমি তো ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলুম না যে, এ রকমের আফগান এ-ধরনের সুট পেলেই বা কোথায়, আর এর প্রয়োজনই বা তার কি। কিন্তু ঐ এক মূর্তি নয়। বন থেকে বেরবার আগে হুবহু এক দ্বিতীয় মূর্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ। সে দেখি এক মুচির সামনে উবু হয়ে বসে গল্প জুড়েছে আর মুচি তার বুটে তলায় লোহা ঠুকে ঠুকে আল্পনা এঁকে দিচ্ছে।
পরের দিন আমান উল্লার বক্তৃতা। সভায় যাবার পথে এ-রকম আরো ডজনখানেক মূর্তির সঙ্গে দেখা হল। সেখানে গিয়ে দেখি সভার সবচেয়ে ভালো জায়গায়, প্ল্যাটফর্মের মুখোমুখি প্রায় শদেড়েক লোক এ-রকম মর্নি-সুটের ইউনিফর্ম পরে বসে আছে। এরাই
প্রথম আফগান পার্লিমেন্টের সদস্য।
যে তাজিক, হাজারা, মঙ্গোল, পাঠান আপন আপন জাতীয় পোষাক পরে এতকাল স্বচ্ছন্দে ঘরে-বাইরে ঘোরাফেরা করেছে, বিদেশীর মুগ্ধদৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, আজ তারা বিকট বিজাতীয় বেশভূষা ধারণ করে সভাস্থলে কাঠের মত বসে আছে। শুনেছি অনভ্যাসের ফোঁটা চড়চড় করে, কিন্তু এদের তো শুধু কপালে ফোঁটা দেওয়া হয়নি, সর্বাঙ্গে যেন কৃষ্ণচন্দন লেপে দেওয়া হয়েছে!
আমান উল্লা দেশের ভূতভবিষ্যবর্তমান সম্বন্ধে অনেক খাঁটী কথা বললেন। কাবুলের লোক হাততালি দিল। সদস্যদের তালিম দেওয়া হয়েছিল কিনা জানিনে, তারা এলোপাতাড়ি হাততালি দিয়ে লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকায়; ফরেন অফিসের কর্তারা আরো বেশী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করেন। বিদেশী রাজদূতেরা অপলক দৃষ্টিতে আমান উল্লার দিকে তাকিয়ে সেদিন বুঝতে পারলুম রাজদূত হতে হলে কতদূর আত্মসংযম, কত জোর চিত্তজয়ের প্রয়োজন।
জানি, সুট ভালো করে পরতে পারা না-পারার উপর কিছুই নির্ভর করে না কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, কি প্রয়োজন ছিল লেফাফাদুরস্ত হওয়ার লোভে দেড়শ জন গাঁওবুড়াকে লাঞ্ছিত করে নিজে বিড়ম্বিত হওয়ার?
আমান উল্লার বক্তৃতা এরা কতদূর বুঝতে পেরেছিল জানিনে— ভাষা এক হলেই তো আর ভাবের বাজারের বেচাকেনা সহজ সরল হয়ে ওঠে না। শুনেছি, পুরানো বোতলও নাকি নয়া মদ সইতে পারে না।