মোটর ছাড়ল অনেক বেলায়। কাজেই বেলাবেলি কাবুল পৌঁছবার আর কোনো ভরসাই রইল না।
পেশাওয়ার থেকে জলালাবাদ এক শ মাইল, জালালাবাদ থেকে কাবুল আরো এক শ মাইল। শাস্ত্রে লেখে সকালে পেশাওয়ার ছেড়ে সন্ধ্যায় জলালাবাদ পৌঁছবে। পরদিন ভোরবেলা জলালাবাদ ছেড়ে সন্ধ্যায় কাবুল। তখনই বোঝা উচিত ছিল যে, শাস্ত্র মানে অল্প লোকেই। পরে জানলুম একমাত্র মেল বাস ছাড়া আর কেউ শাস্ত্রনির্দিষ্ট বেগে চলে না।
জলালাবাদের আশেপাশে গাঁয়ের ছেলেরা রাস্তায় খেলাধুলো করছে। তারি এক খেলা মোটরের জন্য রাস্তায় গোলকধাঁধা বানিয়ে দেওয়া। কায়দাটা নূতন। কাবুলীরা যে আণ্ডার মত শক্ত টুপির চতুর্দিকে পাগড়ি জড়ায় ছোঁড়া সই টুপি এমনভাবে রাস্তায় সাজিয়ে রাখে যে, হুশিয়ার হয়ে গাড়ি না চালালে দুটো চারটে থেলে দেবার সম্ভাবনা। দূর থেকে সেগুলো দেখতে পেলেই সর্দারজী দাড়িগোঁফের ভিতরে বিড়বিড় করে কি একটা গালাগাল দিয়ে মোটরের বেগ কমান। কয়েকবার এ রকম লক্ষ্য করার পর বললুম, দিন না দুটো-চারটে থেলে। ছোঁড়াদের তাহলে আক্কেল হয়। সর্দারজী বললেন, খুদা পনাহ,। এমন কর্ম করতে নেই। আর টায়ার ফঁসাতে চাইনে। আমি বুঝতে না পেরে বললুম, সে কি কথা, এই টুপিগুলো আপনার টায়ার ছাদা করে দেবে? তিনি বললেন, আপনি খেলাটার আসল মর্মই ধরতে পারেননি। টুপির ভিতরে রয়েছে মাটিতে শক্ত করে পোঁতা লম্বা লোহা। যদি টুপি বাঁচিয়ে চলি তবে গাড়ি বাঁচানো হল, যদি টুপি থেৎলাই, তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজের পায়ে কুড়োল মারা হল।
আমি বললুম, অর্থাৎ ছোকরারা মোটরওয়ালাদের শেখাতে চায়, পরের অপকার করিলে নিজের অপকার হয়।
সর্দারজী বললেন, ওঃ, আপনার কি পরিষ্কার মাথা।
বেতারবাণী বললেন, কিন্তু প্রশ্ন, এই মহান শিক্ষা এল কোথা হতে?
আমি নিবেদন করলুম, আপনিই বলুন।
তিনি বললেন, ছোঁড়াদের খেলাতে রয়েছে, বৌদ্ধধর্মের মহান আদর্শের ভগ্নাবশেষ। জানেন, এককালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রচুর প্রসারপ্রতিপত্তি ছিল।
আমি বললুম, তাই তো শুনেছি।
তিনি বললেন, শুনেছি মানে? একটুখানি ডাইনে হটলেই পোঁছবেন হাদ্দায়। সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে দেখতে পাবেন কত বৌদ্ধ মূর্তি বেরিয়েছে মাটির তলা থেকে। আপনি কি ভাবছেন, সে আমলের লোক নানা রকম মূর্তি জড়ো করে যাদুঘর বানাত?
এ যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন, কনিষ্কের আমলে গান্ধারবাসীরা যাদুঘর নির্মাণ করিত কি না?
ফেল মারলুম। কিন্তু বাঙালী আর কিছু পারুক না পারুক, বাজে তর্কে খুব মজবুত। বললুম, কিন্তু কাল রাত্রে সরাইয়ে নিজের জান-মাল, থুড়ি, মালজান সম্বন্ধে যে সতর্কতার হুঙ্কার শুনতে পেলুম তা থেকে তো মনে হল না প্রভু তথাগতের সাম্যমৈত্রীর বাণী শুনছি।
বেতারবার্তা বললেন, ঠিক ধরেছেন। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে অহিংস শিশুশাবক ও এলোমে ধর্ম। পূর্ণবয়স্ক, প্রাণবন্ত দুধ পুরুষের ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।
আমি বললুম, বিলক্ষণ।
সর্দারজী খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন, আমি তো গ্রন্থসাহেব মানি কিন্তু একথা বার বার স্বীকার করব যে, এই আধাইনসান পাঠান জাতকে কেউ যদি ধর্মের পথে নিয়ে যেতে পারে তবে সে ইসলাম।
আমি তো ভয় পেয়ে গেলুম। এইবার লাগে বুঝি। আধাইনসান অর্থাৎ অর্ধ-মনুষ বললে কার রক্ত গরম না হয়। কিন্তু বেতারবাণী অত্যন্ত সৌম্য বৌদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আপনি বিদেশী এবং আমাদের সকলের চেয়ে বেশী লোকজনের সংস্রবে এসেছেন, তার উপর আপনি বয়সে প্রবীণ। আপনার এই মত শুনে ভারী খুশী হলুম।
আমি আরো আশ্চর্য হয়ে গেলুম। কৌতূহল দমন করতে না পেরে গাড়ির ঝড়ঝড়ানির সঙ্গে গলা মিলিয়ে সর্দারজীকে আস্তে আস্তে উর্দুতে শুধালুম, একি কাণ্ড? আপনি এর জাত তুলে একে আধা-ইনসান বললেন আর ইনি খুশী হয়ে আপনাকে তসলীম করলেন!
সর্দারজী আরো আশ্চর্য হয়ে বললেন, ইনি চটবেন কেন? ইনি তো কাবুলী।
আমি আরো সাত হাত জলে। ফের শুধালুম, কাবুলী পাঠান নয়?
সর্দারজী তখন আমার অজ্ঞতা ধরতে পেরে বুঝিয়ে বললেন, আফগানিস্থানের অধিবাসী পাঠান। কিন্তু খাস কাবুলের লোক ইরান দেশ থেকে এসে সেখানে বাড়িঘরদোর বেঁধে শহর জমিয়েছে। তাদের মাতৃভাষা ফার্সী। পাঠানের মাতৃভাষা পশতু। বেতারের সায়েব পশতু ভাষার এক বর্ণও বোঝে না।
আমি বললুম, তা না হয় বুঝলুম, কিন্তু কলকাতার কাবুলীওয়ালারা তো ফার্সী বোঝে না।।
তার কারণ কলকাতার কাবুলীরা কাবুলের লোক নয়। তারা সীমান্ত, খাইবার বড় জোর চমন কান্দাহারের বাসিন্দা। খাস কাবুলী পারতপক্ষে কাবুল শহরের সীমানার বাইরে যায় না। যে দুদশ জন যায় তারা সদাগর। তাদেরও পাল্লা ঐ পেশাওয়ার অবধি।
এত জ্ঞান দান করেও সর্দারজীর আশ মিটল না। আমাকে শুধালেন, আপনি কাবুলীওয়ালা, কাবুলীওয়ালা বলেন কেন? কাবুলের লোক হয়। হবে কাবুলী, নয় কাবুলওয়ালা। কাবুলীওয়ালা হয় কি করে?
হকচকিয়ে গেলুম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কাবুলীওয়ালা। গুরুকে বাঁচাই কি করে? আর বাঁচাতে তো হবেই, কারণ—
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।।
সামলে নিয়ে বললুম, এই আপনি যে রকম জওয়াহিরাত বলেন। জওহর হল এক বচন; জওয়াহির বহুবচন। জওরাহিরে ফের আত লাগিয়ে আরো বহুবচন হয় কি প্রকারে?
শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় কিন্তু মাছ দিয়ে মাছ ঢাকা যায় কি না সে প্রশ্ন অন্য যে কোনো দেশে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কিন্তু পাঠানমলুকের আইন, এক খুনের বদলে আরেক খুন। তাই সে যাত্রা সর্দারজীর সামনে ইজ্জত বজায় রেখে ফঁড় কাটাতে পারলুম।
অবশ্য দরকার ছিল না। সর্দারজী তখন মোড় নিতে ব্যস্ত। আমি ভাবলুম, ম্যাপে দেখেছি জলালাবাদ থেকে কাবুল সোজা নাকবরাবর রাস্তা গাড়ি আবার মোড় নিচ্ছে কেন?
বেতারবাণী হল, সেই ভালো, আজ যখন কিছুতেই কাবুল পৌঁছন যাবে না তখন নিমলার বাগানেই রাত কাটানো যাক।
দুরে থেকেই সারি সারি চিনার গাছ চোখে পড়ল। সুপারির চেয়ে উঁচু সোজা আকাশ ফুড়ে উঠেছে। বুক অবধি ডালপাতা নেই, বাকিটুকু মসৃণ ঘন পল্লবে আন্দোলিত। আমাদের বাঁশপাতার সঙ্গে কচি অশথপাতার সৌন্দর্য মিলিয়ে দিয়ে দীর্ঘ বিনুনির মত যদি কোনো পল্লবের কল্পনা করা যায় তবে তাই হয় চিনারের পাতা। কিন্তু তার দেহটির সঙ্গে অন্য কোনো গাছের তুলনা হয় না। ইরানী কবিরা উচ্ছ্বসিত হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তন্বঙ্গী তরুণীর রূপভঙ্গিমা রাগরঙ্গিমার সঙ্গে চিনারের দেহসৌষ্ঠবের তুলনা করে এখনো তৃপ্ত হননি। মৃদুমন্দ বাতাসে চিনার যখন তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ধীরে মন্থরে আন্দোলিত করে তখন রসকষহীন পাঠান পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বারে বারে তার দিকে তাকায়। সুপারির দোলের সঙ্গে এর খানিকটা মিল আছে কিন্তু সুপারির রঙ শ্যামলিমাহীন কর্কশ, আর সমস্তক্ষণ ভয় হয়, এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ল।
মনে হয়, মানুষ ছাড়া অন্য যে-কোনো প্রাণী চিনারের দেহচ্ছন্দকে তরুণীর চেয়ে মধুর বলে স্বীকার করবে।
বেতারওয়ালা ভারতবর্ষের ইতিহাসের কোনো খবরই রাখেন না। সর্দারজীর কাছ থেকে বেশী আশা করাও অন্যায় কিন্তু তিনিই বললেন নিমলার বাগান আর তাজমহলের বাগান নাকি একই সময়কার। নিমলার বাগানে যে প্রাসাদ ছিল সেটি অভিযান আক্রমণ সহ না করতে পেরে অদৃশ্য হয়েছে কিন্তু সারিবধানো রমণীয় চিনারগুলো নাকি শাহজাহানের হুকুমে পোঁতা। সর্দারজীর ঐতিহাসিক সত্যতা এখানে অবশ্য উদ্ভিদবিদ্যা দিয়ে পরখ করে নেবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু এই অজানা অচেনা দেশে শাহজাহানের তৈরী তাজের কনিষ্ঠ উদ্যানে ঢুকছি কল্পনা করাতে যে মুখ উদ্ভিদতত্ত্বের মোহনুর দিয়ে সে মায়াজাল ছিন্ন করে কি এমন চরম মোক্ষাভ! বাগানে আর এমন কিছু চারুশিল্পও নেই যার কৃতিত্ব শাহজাহানকে দিয়ে দিলে অন্য কারো ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে। আর এ কথাও তো সত্য যে শাহজাহানের আসন উঁচু করার জন্য নিমলার বাগানের প্রয়োজন হয় না— এক তাজই তার পক্ষে যথেষ্ট।
তবু স্বীকার করতে হবে অতি অল্প আয়াসের মধ্যে উদ্যানটি প্রাণাভিরাম। চিনারের সারি, জল দিয়ে বাগান তাজা রাখবার জন্য মাঝখানে নালা আর অসংখ্য নরগিস ফুলের চারা। নরগিস ফুল দেখতে অনেকটা রজনীগন্ধার মত, চারা হুবহু একই রকম অর্থাৎ ট্যুবরোজ জাতীয়। গ্রীক দেবতা নারসিসাস নাকি আপন রূপে মুগ্ধ হয়ে সমস্ত দিন নদীর জলে আপন চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। দেবতারা বিরক্ত হয়ে শেষটায় তাকে নদীর পারের ফুল গাছে পরিবর্তিত করে দিলেন। এখনো নারসিসাস ফুল— ফার্সীতে নরগিস ঠিক তেমনি নদীর জলে আপন ছায়ার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যা কাটল নালার পারে, নরগি বনের এক পাশে, চিনার মর্মরের মাঝখানে। সূর্যাস্তের শেষ আভাটুকু চিনার-পল্লব থেকে মুছে যাওয়ার পর ডাকবাঙলোর খানসামা আহার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে সেখানেই চারপাই আনিয়ে শুয়ে পড়লুম।
শেষরাত্রে ঘুম ভাঙল অপূর্ব মাধুরীর মাঝখানে। হঠাৎ শুনি নিতান্ত কানের পাশে জলের কুলুকুলু শব্দ আর আমার সর্বদেহ জড়িয়ে, নাকমুখ ছাপিয়ে কোন্ অজানা সৌরভ সুন্দরীর মধুর নিশ্বাস।
শেষরাত্রে নৌকা যখন বিল ছেড়ে নদীতে নামে তখন যেমন নদীর কুলকুল শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, জানলার পাশে শিউলি গাছ থাকলে শরতের অতি ভোরে যে রকম তা টুটে যায় এখানে তাই হল, কিন্তু দুয়ে মিলে গিয়ে। এ সঙ্গীত বহুবার শুনেছি কিন্তু তার সঙ্গে এহেন সৌরভসোহাগ জীবনে আর কখনো পাইনি।
সেই আধা-আলোঅন্ধকারে চেয়ে দেখি দিনের বেলার শুকনো নালা জলে ভরে গিয়ে দুই কূল ছাপিয়ে, নরগিসের পা ধুয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। বুঝলুম, নালার উজানে দিনের বেলায় বাঁধ দিয়ে জল বন্ধ করা হয়েছিল–তোরের আজানের সময় নিমলার বাগানের পালা; বাঁধ খুলে দিতেই নালা ছাপিয়ে জল ছুটেছে-তারি পরশে নরগিস নয়ন মেলে তাকিয়েছে। এর গান ওর সৌরভে মিশে গিয়েছে।
আর যে-চিনারের পদপ্রান্তে উভয়ের সঙ্গীত সৌরভ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে সে তার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতসুর্যের প্রথম রশ্মির নবীন অভিষেকের জন্য। দেখতে না-দেখতে চিনার সোনার মুকুট পরে নিল— পদপ্রান্তে পুষ্পবনের গন্ধধূপে বৈতালিক মুখরিত হয়ে উঠল।
এদিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার,
আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার?