৩৩. এক অপরূপ মূর্তি

একদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি চোখের সামনে। দাঁড়িয়ে এক অপরূপ মূর্তি। চেনা চেনা মনে হল অথচ যেন অচেনা। তার হাতের ট্রের দিকে নজর যেতে দেখি সেটা সম্পূর্ণ চেনা। তার উপরকার রুটি, মাখন, মামলেটু, বাসি কাবাবও নিত্যিকার চেহারা নিয়ে উপস্থিত। ধূম দেখলে বহ্নির উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয়; সকালবেলা আমার ঘরে এ রকমের ট্রে হাওয়ায় দুলতে পারে না, বাহক আবদুর রহমানের উপস্থিতি স্বীকার করতে হয়।

কিন্তু কী বেশভূষা! পাজামা পরেনি, পরেছে পাতলুন। কয়েদীদের পাতলুনের মত সেটা নেমে এসেছে হাঁটুর ইঞ্চি তিনেক নিচে; উরুতে আবার সে পাতলুন এমনি টাইট যে, মনে হয় সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী নাইট সাটিনের ব্রিচেস্ পরেছেন। শার্ট, কিন্তু কলার নেই। খোলা গলার উপর একটা টাই বাঁধা। গলা বন্ধ কোট, কিন্তু এত ছোট সাইজের যে, বোম লাগানোর প্রশ্নই ওঠে না— তাই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শার্ট আর টাই। দুকান ছোঁয়া হ্যাট, ভুরু পর্যন্ত গিলে ফেলেছে। দোকানে যে রকম হ্যাট-স্ট্যাণ্ডের উপর খাড়া করানো থাকে।

পায়ে নাগরাই, চোখে হাসি, মুখে খুশী।

আবদুর রহমানের সঙ্গে এক বছর ঘর করেছি। চটে গিয়ে মাঝে মাঝে তাকে হস্তীর সঙ্গে নানাদিক দিয়ে তুলনা করেছি, কিন্তু সে যে সম্পূর্ণ সুস্থ, তার মাথায় যে ছিট নেই সে বিষয়ে আমার মনে দৃঢ়প্রত্যয় ছিল। তাই চোখ বন্ধ করে বললুম, বুঝিয়ে বল।

আমার যে খটকা লাগবে সে বিষয়ে সে সচেতন ছিল বলে বলল, দেরেশি পুশিদম–অর্থাৎ সুট পরেছি।

আমি শুধালুম, সরকারী চাকরী পেলে লোকে দেরেশি পরে; আমার চাকরী ছেড়ে দিচ্ছ নাকি?

আবদুর রহমান বলল, তওবা, তওবা, আপনি সায়েব আমার সরকার, আমার রুটি দেনেওয়ালা।

তবে?

সকালবেলা রুটি কিনতে গেলে পর পুলিশ ধরলো। বলল, বাদশার হুকুম আজ থেকে কাবুলের রাস্তায় পাজামা, কুর্তা, জোব্বা পরে বেরোনো বারণ— সবাইকে দেরেশি পরতে হবে। আমার কাছ থেকে এক পাই জরিমানাও আদায় করল। রুটি কিনে ফেরবার পথে আর দুতিনটে পুলিশ ধরল। আপনার দোহাই পেড়ে কোনো গতিকে বাড়ি ফিরেছি। বাড়ির সামনে আমাদের পড়শী কর্নেল সায়েবের সঙ্গে দেখা, তিনি ডেকে নিয়ে এই দেরেশি দিলেন, আমাকে তিনি বড্ড স্নেহ করেন কিনা, আমিও তার ফাইফরমাশ করে দিই।

গুম হয়ে শুনলুম। শেষটায় বললুম, দর্জির দোকানে তো এখন ভিড় হওয়ার কথা। দুদিন বাদে গিয়ে তোমার পছন্দমত একটা দেরেশি করিয়ে নিয়ে।

আবদুর রহমান হিসেবী লোক; বলল, এই তো বেশ।

আমি বললুম, চুপ। আর দুপুরবেলা এক জোড়া বুট কিনে নিয়ো।

আবদুর রহমান কলরব করে বলল, না হুজুর তার দরকার নেই। পুলিশের ফিরিস্তিতে বুটের নাম নেই।

প্রথমটায় অবাক হলাম। পরে বুঝলুম ঠিকই তো; লক্ষ্মণ না হয় সীতাদেবীর পায়ের দিকে তাকাতে পারেন–রাজাপ্রজায় তো সে সম্পর্ক নয়!

বললুম, চুপ। দুপুর বেলা কিনবে। আর দেখো, এবার হ্যাটটা খুলে ফেলল।

আবদুর রহমান চুপ।

বললুম, খুলে ফেলল।

আবদুর রহমান আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হুজুরের সামনে? তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ মনে পড়ল উত্তর আফগানিস্থান তুর্কিস্থানে মানুষ শয়তানের ভয় পেলে পাগড়ি খুলে ফেলে। শুধু-মাথা দেখলে নাকি শয়তান পালায়। তাই আবদুর রহমান ফাঁপরে পড়েছে। তখন মনে পড়ল যে, হৌস অব কমন্সে হ্যাট না পরা থাকলে কথা কইতে দেয় না। বললুম, থাক তাহলে তোমার মাথার হ্যাট।

রাস্তায় বেরিয়ে দেখি শহর অন্যদিনের তুলনায় ফাঁকা। দেরেশির অভাবে লোকজন বাড়ি থেকে বেরতে পারেনি। পর্দা তুলে দেওয়াতে যেমন রাস্তাঘাটে মেয়েদের ভিড় বাড়ার কথা ছিল তেমনি দেরেশির রেওয়াজ এক নূতন ধরনের পর্দা হয়ে পুরুষদের হারেমবন্ধ করল।

যারা বেরিয়েছে তাদের দেরেশির বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। যত: রকম ছেড়া, নোংরা, শরীরের তুলনায় হয় ছোট নয় বড়, কোট-পাতলুন, প্লাস-ফোর্স, ব্রিচেস দিয়ে যত রকমের সম্ভব অসম্ভব খিচুড়ি পাকানো যেতে পারে তাই পরে কাবুল শহর রাস্তায় বেরিয়েছে গোটা দশেক পাগলাগারদকে হলিউডের গ্রীনরুমে ছেড়ে দিলেও এর চেয়ে বিপর্যয় কাণ্ড সম্ভবপর হত না।

ইয়োরোপীয়রা বেরিয়েছে তামাশা দেখতে। আমার লজ্জায় মাথা কাটা গেল। আফগানিস্থানকে আমি কখনো পর ভাবিনি।

শহরতলী দিয়ে আমাকে কাজে যেতে হয়। সেখানে দেখি আরো কঠোর দৃশ্য। গ্রামের লাকড়ীওলা, সজীওলা, আণ্ডাওলা যেই শহরের চৌহদ্দির ভিতরে পা দেয় অমনি পুলিশ তাদের ধরে ধরে এক এক পাই করে জরিমানা করে। বেচারীদের কোনো রসিদ দেওয়া হয় না; কাজেই দশ পা যেতে না যেতে তাদের কাছ থেকে অন্য পুলিশ এসে আবার নূতন করে জরিমানা আদায় করে। দুনিয়ার যত পুলিশ সেদিন কাবুলের শহরতলীতে জড়ো হয়েছে। খবর নিয়ে শুনলুম যারা এ সময়ে অফ-ডিউটি তারাও উর্দি পরে পয়সা রোজকার করতে লেগে গিয়েছে— জরিমানার পয়সা নাকি সরকারী তহবিলে জমা দেওয়ার কোনো বন্দোবস্ত করা হয়নি।

দিবাদ্বিপ্রহরে যে কাবুলী পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমনোতে রেকর্ড ব্রেক করতে পারে, তার ব্যস্ততা দেখে মনে হল, যেন তার বাস্তুবাড়িতে আগুন লেগেছে।

এ অত্যাচার কদিন ধরে চলেছিল বলতে পারিনে।

 

দুই সপ্তাহ ধরে দেশের খবরের কাগজ চিঠিপত্র পাইনি। খবর নিয়ে শুনলুম জলালাবাদ-কাবুলের রাস্তা বরফে ঢাকা পড়ায় মেল-বাস আসতে পারেনি; দু-একজন ফিসফিস করে বলল, রাস্তায় নাকি লুটতরাজও হচ্ছে। মীর আসলম সাবধান করে গেলেন যেন যেখানে সেখানে যা তা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করি।

 

অন্য কাজ শেষ হলে মেয়েদের ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস ও সেকেণ্ড মিস্ট্রেসকে আমি ইংরিজী পড়াতুম। আফগান মেয়েরা চালাক; জানে যে, ধনীর কাছ থেকে টাকা বের করা শক্ত, কিন্তু গরীবের দরাজ-হাত। জ্ঞানের বেলাতেও এই নীতি খাটবে ভেবে এই দুই মহিলা আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

হেড মিস্টেসের বয়স পঞ্চাশের উপর; মাতৃভাষা বাদ দিলে জীবনে তিনি এই প্রথম ভাষা শিখছেন। কাজেই কাবুলের পাথরফাটা শীতেও তাকে আমি ইংরিজী বানান শেখাতে গিয়ে ঘেমে উঠতুম। ইংরিজী ভাষা শিখতে বসেছেন, কিন্তু ঐ এক বিষয় ছাড়া দুনিয়ার আর সব জিনিষে তার কৌতূহলের সীমা ছিল না। বিশেষ করে মাস্টার মশায়ের বয়স কত, দেশ কোথায়, দেশের জন্য মন খারাপ হয় কিনা কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই তাঁর বাধতো না। তবে খুব সম্ভব আমার এপেনডিক্সের সাইজ ও এ-জগতে আমার জন্মাবার কি প্রয়োজন ছিল, এ দুটো প্রশ্ন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেননি। আমার উত্তর দেবার কায়দাও ছিল বিচিত্র। আমার দেশ? আমার দেশ হল Bengal বানানটা শিখে নিন, বি ই এন জি এ এল। উচ্চারণটাও শিখে নিন; কেউ বলে বেন্‌গোল, আবার কেউ বলে বেঙোল। ঠিক তেমনি France— এফ আর—। তিনি বলতেন, বুঝেছি, বুঝেছি, তা বলুন তো, বাঙালী মেয়েরা দেখতে কি রকম? শুনেছি তাদের খুব বড় চুল হয়, জুলফে-বাঙাল বলে একরকম তেল এদেশে পাওয়া যায়। আপনি কী তেল মাখেন? আমাদের দুজনার এই চাপান-উতোরের মাঝখানে পড়ে ইংরিজী ভাষা বেশী এগতে পারতো না, বিশেষ করে তিনি যখন আমাকে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেন। মায়ের কথা বলার ফাঁকে ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখাবার এলেম আমার পেটে নেই।

সেকেণ্ড মিস্টেসের বয়স কম— ত্রিশ হয় না হয়। দুটি বাচ্চার মা, থলথলে দেহ, খাঁদা নাক, মুখে এক গাদা হাসি, পরনে বারো মাস শ্লিপওভার, লম্বা-হাতা ব্লাউজ আর নেভি ব্লু ফ্রক। কর্নেলের বউ, বুদ্ধিশুদ্ধি আছে আর আমি যখন কর্ত্রীর প্রশ্নের চাপে নাজেহাল হতুম, তখন তিনি মিটমিটিয়ে হাসতেন আর নিতান্ত বেয়াড়া প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলে মাঝে মাঝে উদ্ধার করে দিতেন।

জোর শীত কিন্তু তখনো বরফ পড়েনি এমন সময় একদিন পড়াতে গিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি কর্নেলের বউ বইয়ের উপর মুখ গুঁজে টেবিলে ঝুঁকে পড়েছেন আর কর্ত্রী তার পিঠে হাত বুলোচ্ছন। আমার পায়ের শব্দ শুনে কর্নেলের বউ ধড়মড় করে উঠে বসলেন। দেখি আর দিনের মত মুখের হাসির স্বাগতসম্ভাষণ নেই। চোখ দুটো লাল, নাকের ডগার চামড়া যেন ছড়ে গিয়েছে।

এসব জিনিষ লক্ষ্য করতে নেই। আমি বই খুলে পড়াতে আরম্ভ করলুম। দুমিনিটও যায়নি, হঠাৎ আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝখানে কর্নেলের বউ দুহাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলুম। কর্ত্রী শান্তভাবে তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকলেন, অধীর হয় না, অধীর হয়ে না। খুদাতালা মেহেরবান। বিশ্বাস হারিয়ো না, শান্ত হও।

আমি চোখের ঠারে কর্ত্রীকে শুধালুম, আমি তাহলে উঠি?

তিনি ঘাড় নেড়ে যেতে বারণ করলেন। দুমিনিট যেতে না যেতে আবার কান্না, আবার সান্ত্বনা; আমি যে সে অবস্থায় কি করব ভেবেই পাচ্ছিলুম না। কান্নার সঙ্গে মিশিয়ে যা বলছিলেন তার থেকে গোড়ার দিকে মাত্র এইটুকু বুঝলুম যে, তিনি তাঁর স্বামীর অমঙ্গল চিন্তা করে দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ভালো করে কিছু বলতে গেলেই কর্ত্রী বাধা দিয়ে তাঁকে ওসব কথা তুলতে বারণ করছিলেন। বুঝলুম যে, অমঙ্গল চিন্তা সম্পূর্ণ অমূলক নয় এবং এমন সব কারণও তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে, সেগুলো প্রকাশ্যে বলা বাঞ্ছনীয় নয়।

কিন্তু তিনি তখন এমনি আত্মকতৃত্ব হারিয়ে বসেছেন যে, তাঁকে ঠেকানো মুশকিল। কখনও বলেন, শিনওয়ারীরা বর্বর জানোয়ার কখনো বলেন, সাত দিন ধরে সরকারী কোনো খবর পাওয়া যায়নি, কখনো বলেন, শিনওয়ারীরা শহরে পৌঁছলে কোনো অফিসার পরিবারের রক্ষা নেই।

জলালাবাদ অঞ্চলে লুঠতরাজ হচ্ছে আগেই গুজব হিসেবে শুনেছিলুম; তার সঙ্গে এসব ছেড়াছেড়া খবর জুড়ে দিয়ে বুঝতে পারলুম যে, সে অঞ্চলে শিনওয়ারীরা বিদ্রোহ করে কাবুলের দিকে রওয়ানা হয়েছে, আমান উল্লা তাদের ঠেকাবার জন্য যে ফৌজ পাঠিয়েছিলেন সাতদিন ধরে তাদের সম্বন্ধে কোনো বিশ্বাস্য খবর পাওয়া যায়নি, আর কাবুলের অফিসার-মহলে গুজব, সে বাহিনীর অফিসাররা শিনওয়ারীদের হাতে ধরা পড়েছেন।

এত বড় দুঃসংবাদ ইংরিজী পড়ার চেষ্টা দিয়ে দমন করা অসম্ভব। আর আমি এসব সংবাদ জেনে ফেলেছি সেটাও কত্ৰী আদপেই পছন্দ করছিলেন না। কিন্তু কর্নেলের বউকে তিনি কিছুতেই ঠেকাতেও পারছিলেন না। শেষটায় আমি এক রকম জোর করে ওঠবার চেষ্টা করলে কর্নেলের বউ হঠাৎ চোখ মুছে বললেন, না, মুআল্লিম সাহেব, আপনি যাবেন না, আমি পড়াতে মন দিচ্ছি।

এ রকম পড়া আমাকে যেন জীবনে আর না পড়াতে হয়। এবার যখন ভেঙ্গে পড়লেন, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, বাদশা আমান উল্লার মত যারা গোপ রেখেছে তাদের ধরে ধরে উপরের ঠোঁট কেটে ফেলছে। আমান উল্লা ঠিক নাকের তলায় একটুখানি গোঁফ রাখেন–সেই টুথব্রাশ মুস্টাশ ফ্যাশান ফৌজী অফিসারদের ভিতর ছড়িয়ে পড়েছিল।

এবারে আমি একটু সান্ত্বনা দেবার সুযোগ পেলুম। বললুম, লড়াইয়ের সময় কত রকম গুজব রটে সে সব কি বিশ্বাস করতে আছে? আপনি অধীর হয়ে পড়েছেন তাই অমঙ্গল সংবাদ মাত্রই বিশ্বাস করছেন।

আবার চোখ মুছে উঠে বসলেন। আমি যে পর-পুরুষ সে কথা ভুলে গিয়ে হঠাৎ আমার দুহাত চেপে ধরে বললেন, মুআল্লিম সায়েব, সত্যি বলুন, ইমান দিয়ে বলুন, আপনি কয় সপ্তাহ ধরে হিন্দুস্থানের চিঠি পাননি?

হিন্দুস্থানের ডাক শিনওয়ারী অঞ্চল হয়ে কাবুলে আসে। তিন সপ্তাহ ধরে সে ডাক বন্ধ ছিল।

আমি উঠে দাঁড়ালুম। তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বললুম, আমি এ সপ্তাহেই দেশের চিঠি পেয়েছি।

তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন দেখে আমি বললুম, আপনি তো আর পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে মেশেন না যে, হক খবর পাবেন। মেয়েরা স্বভাবতই একটুখানি বেশী ভয় পায়, আর নানারকম গুজব রটায়। তাই তো বাদশাহ আমান উল্লা পরদা পছন্দ করেন না।

কর্ত্রী আমার সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এসে বললেন, যে সব খবর শুনলেন সেগুলো আর কাউকে বলবেন না।

আমি বললুম, এসব খবর নয়, গুজব। গুজব রটালে শুধু কি আপনাদের বিপদ? আমি বিদেশী, আমাকে আরো বেশী সাবধানে থাকতে হয়।

রাস্তায় বেরিয়ে একা হতেই বুঝলুম, মিথ্যা সান্ত্বনা দেবার  বিড়ম্বনাটা কি। সেটা কাটাবার জন্য পাঞ্জাবী গ্রামোফোনওলার দোকানে ঢুকলুম। আমার গ্রামোফোন নেই, আমি রেকর্ড কিনিনে তবু দেশের ভাই শুকুর মুহম্মদ বলে দোকানদার আমাকে সব সময় আদর-আপ্যায়ন করত। জিজ্ঞেস করলুম, মৌলানার বাঙলা রেকর্ডগুলো কলকাতা থেকে এসেছে?

দোকানদার বলল না, এবং ভাবগতিক দেখে বুঝলুম খোঁচাখুচি করলে কারণটা বলতেও তার বাধবে না। আমি কিন্তু তাকে না ঘাঁটিয়েই খানকয়েক রেকর্ড শুনে বাড়ি চলে এলুম।।

কিন্তু ঘাটাঘাটি খোঁচাখুচি কিছুই করতে হল না। স্তরে স্তরে বরফ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম গুজব এসে কাবুলের বাজারে ভূপীকৃত হতে লাগল। সে-বাজার অন্ন বিক্রয় করে অর্থের পরিবর্তে, কিন্তু সন্দেশ দেয় বিনামূল্যে এবং বিনামূল্যের জিনিস যে ভেজাল হবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? খবরের চেয়ে গুজব রটল বেশী।

কিন্তু এ-বিষয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ রইল না যে, আমান উল্লা অস্ত্রবলে বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হননি, এখন যদি অর্থবলে কিছু করতে পারেন।

পূর্বেই বলেছি আফগানিস্থানের উপজাতি উপজাতিতে খুনোখুনি লড়াই প্রায় বারোমাস লেগে থাকে। সন্ধির ফলে কখনো কখনো অস্ত্রসংবরণ হলেও মিত্ৰতাহৃদ্যতার অবকাশ সেখানে নেই। কাজেই আফগান কূটনীতির প্রথম সূত্র : কোনো উপজাতি যদি কখনো রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তবে তৎক্ষণাৎ সেই উপজাতির শত্রুপক্ষকে অর্থ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে। যদি অর্থে বশ না হয়, তবে রাইফেল দেবে। রাইফেল পেলে আফগান পরমোৎসাহে শত্রুকে আক্রমণ করবে–কাষ্ঠ-রসিকেরা বলেন সে আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য বন্দুকগুলোর তাগ পরীক্ষা করা।

কিন্তু এস্থলে দেখা গেল, বিদ্রোহের নীল-ছাপটা তৈরী করেছেন মোল্লারা এবং তারা একথাটা সব উপজাতিকে বেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যদি কোনো উপজাতি কাফির আমান উল্লার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তবে তারা তখন দীন ইসলামের রক্ষাকর্তা। রাইফেল কিম্বা টাকার লোভে অথবা ঐতিহ্যগত সনাতন শত্রুতার স্মরণে তখন যারা আমান উল্লার পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়বে তারাও তখন আমান উল্লার মতই কাফির। শুধু যে তারাই তখন দোজখে যাবে তা নয়, তাদের পূর্বতন অধস্তন চতুর্দশ পুরুষ যেন স্বর্গদ্বার দর্শন করবার আশা মনে পোষণ না করে।

এ বড় ভয়ঙ্কর অভিসম্পাত। ইহলোকে বক্ষলগ্ন থাকবে রাইফেল, পরলোকে হুরী, এই পুরুষ-প্রকৃতির উপর আফগান-দর্শন সংস্থাপিত। কোনোটাতেই চোট লাগলে চলবে না। কিন্তু প্রশ্ন আমান উল্লা কি সত্যই কাফির?

এবারে মোল্লারা যে মোক্ষম যুক্তি দেখাল তার বিরুদ্ধে কোনো শিনওয়ারী কোনো খুগিয়ানী একটি কথাও বলতে পারল না। মোল্লারা বলল, নিজের চোখে দেখিসনি আমান উল্লা গণ্ডা পাঁচেক কাবুলী মেয়ে মুস্তফা কামালকে ভেট পাঠিয়েছে; তারা যে একরাত জলালাবাদে কাটিয়ে গেল, তখন দেখিসনি, তারা বেপর্দা বেহায়ার মতন বাজারের মাঝখানে গটগট করে মোটর থেকে উঠল নামল?

কথা সত্যি যে, বিস্তর শিনওয়ারী খুগিয়ানী সেদিনকার হাটবারে জলালাবাদ এসেছিল ও সেখানে বেপর্দা কাবুলী মেয়েদের দেখেছিল। আরো সত্যি যে, গাজী মুস্তফা কামাল পাশা আফগান মোল্লাদের কাছ থেকে কখনো গুড কণ্ডাক্টের প্রাইজ পাননি।

তবু নাকি এক মূর্খ বলেছিল যে, মেয়েরা তুর্কী যাচ্ছে ডাক্তারি শিখতে। শুনে নাকি শিনওয়ারীরা অট্টহাস্য করেছিল— মেয়ে ডাক্তার! কে কবে শুনেছে মেয়েছেলে ডাক্তার হয়। তার চেয়ে বললেই হয়, মেয়েগুলো তুর্কীতে যাচ্ছে গোঁপ গজাবার জন্য।

কে তখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে যে, শিনওয়ারী মেয়েরাই বিনা পর্দায় ক্ষেতে-খামারে কাজ করে, কে বোঝাবে যে, বুড়ীদাদীমা যখন হলুদ-পট্টী বাঁধতে, কপালে জোঁক লাগাতে পুরুষের চেয়েও পাকাপোক্ত তখন কাবুলী মেয়েরাই বা ডাক্তার হতে পারবে না কেন? কিন্তু এ সব বাজে তর্ক, নিস্ফল আলোচনা। আসল একটা কারণের উল্লেখ কেউ কেউ করেছিলেন। কিন্তু সেটা কতদূর সত্য, অনুসন্ধান করেও জানতে পারিনি। আমান উল্লা নাকি রাজকোষের অর্থ বাড়াবার জন্য প্রতি আফগানের উপর পাঁচ মুদ্রা ট্যাক্স বসিয়েছিলেন।

আমান উল্লা এ সব কথাই আস্তে আস্তে জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু আর পাঁচজনের মত তিনিও সেই ফার্সী বয়েৎটী জানতেন, সোনার রত্তিটুকু থাকলে মানুষ মরা কুকুরকেও আদর করে। আমান উল্লা সব উজিরদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, উপজাতিকে ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে কে কি জানেন?

আমার বন্ধু আধা-পাগলা দোস্ত মুহম্মদ ভুল বলেননি; দেখা গেল অনেকেই অনেক কিছু জানেন, শুধু জানেন না, কোন্ উপজাতির সঙ্গে কোন্ উপজাতির শত্রুতা, কোন্ উপজাতির বড় বড় সর্দার উপস্থিত কারা, কাদের মধ্যস্থতায় তাদের কাছে গোপনে ঘুষ পাঠানো যায়, কোন্ মোল্লার কোন্ খুড়ো উপস্থিত কাবুলে যে, তার উপর চোটপাট করলে দেশের ভাইপো শায়েস্তা হবেন অর্থাৎ জানবার মত কিছুই জানেন না।

তখন অনাদৃত উপেক্ষিত প্রাচীন ঐতিহ্যপন্থী বৃদ্ধদের ডাকা হল–তারা বললেন যে, গত দশ বৎসর ধরে তারা কোনো প্রকার কাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন না বলে আফগান উপজাতিদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। রাজানুকম্পা বিগলিত হয়ে যে অর্থবারি তাদের পয়ঃপ্রণালী দিয়ে উপজাতিদের কাছে পৌঁছত, সে-সব পয়ঃপ্রণালী দশ বৎসরের অনাদরে জঞ্জালাবদ্ধ। এখন বন্যা ভিন্ন অন্য উপায় নেই।

অনেক ভেবে-চিন্তে আমান উল্লা তার ভগিনীপতি আলী আহমদ খানকে জলালাবাদ পাঠালেন। শিনওয়ারীদের টাকার বানে ভাসিয়ে দেবার জন্য সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, কেউ বলে দশ লাখ, কেউ বলে বিশ লাখ।

শাস্ত্রের তর্কে, দর্শনের লড়াইয়ে দিশেহারা হলে ওমর খৈয়াম মৃৎপাত্র ভরে সুরা পান করতেন। সেই মাটির ভাড়ই নাকি তখন তাকে গভীরতম সত্যের সন্ধান দিত।

আমার মৃৎপাত্র আবদুর রহমান। তাকে সব খুলে বলে তার মতামত জানতে চাইলুম। গোড়ার দিকে সে আমাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে বারণ করত, কিন্তু শিনওয়ারী বিদ্রোহের পাকাপাকি খবর শহরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজার গল্প গল্পের রাজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুর রহমান বরফের জহুরী, আর সেই বরফই তার মাপকাঠি। সে বলল, নানা লোকে নানা কথা কয়, তার হিশেব-নিকেশ আমি করব কি করে? কিন্তু একটা কথা ভুলবেন না, হুজুর, এই বরফ ভেঙে শিনওয়ারীরা কিছুতেই কাবুল পৌঁছতে পারবে না। ওদের শীতের জামা নেই। বরফ গলুক, তারপর দেখা যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলুম, তাই বুঝি প্রবাদ, কাবুল স্বর্ণহীন হোক আপত্তি নেই, কিন্তু বরফহীন যেন না হয়।

ভেবে দেখলুম আবদুর রহমান কিছু অন্যায় বলেনি। ইতিহাসে দেখেছি, বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের বিদ্রোহবিপ্লবও ছেড়া কাঁথা গায়ে টেনে দিয়ে নিদ্রা যায় মনের হরিষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *