হেমন্তের গোড়ার দিকে শান্তিনিকেতন থেকে মৌলানা জিয়াউদ্দীন এসে কাবুলে পৌঁছলেন। বগদানফ, বেনওয়া, মৌলানা আমাতে মিলে তখন চারইয়ারী জমে উঠল।
জিয়াউদ্দীন অমৃতসরের লোক। ১৯২১ সালের খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ছাড়েন। ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথের শিষ্য হন এবং পরে ভালো বাঙলা শিখেছিলেন। বেশ গান গাইতে পারতেন আর রবীন্দ্রনাথের অনেক গান পাঞ্জাবীতে অনুবাদ করে মূল সুরে গেয়ে শান্তিনিকেতনের সাহিত্যসভায় আসর জমাতেন। এখানে এসে সে সব গান খুব কাজে লেগে গেল, কাবুলের পাঞ্জাবী সমাজ তাকে লুফে নিল। মৌলানা ভালো ফার্সী জানতেন বলে কাবুলীরাও তাকে খুব সম্মান করত।
কিন্তু চারইয়ারী সভাতে ভাঙন ধরল। বগদানফের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তিনি চাকরী ছেড়ে দিয়ে শান্তিনিকেতন চলে গেলেন। বেনওয়া সায়েব তখন বড্ড মনমরা হয়ে গেলেন। কাবুলে তিনি কখনো খুব আরাম বোধ করেননি। এণ্ড্রুজ্ পিয়ার্সনকে বাদ দিলে বেনওয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথের খাঁটী সমজদার। শান্তিনিকেতনের কথা ভেবে ভেবে ভদ্রলোক প্রায়ই উদাস হয়ে যেতেন আর খামকা কাবুলের নিন্দা করতে আরম্ভ করতেন।
বেনওয়া সায়েবই আমাকে একদিন রাশান এম্বেসিতে নিয়ে গেলেন।
প্রথম দর্শনেই তারিশ দেমিদকে আমার বড় ভালো লাগলো। রোগা চেহারা, সাধারণ বাঙালীর মতন উঁচু, সোনালী চুল, চোখের লোম পর্যন্ত সোনালী, শীর্ণ মুখ আর দুটি উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ নীল চোখ। বেনওয়া যখন আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন তিনি মুখ খোলর আগেই যেন চোখ দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিচ্ছিলেন। সাধারণ কন্টিনেন্টালের চেয়ে একটু বেশী ঝুঁকে তিনি হ্যাণ্ডশেক করলেন, আর হাতের চাপ দেওয়ার মাঝ দিয়ে অতি সহজ অভ্যর্থনার সহৃদয়তা প্রকাশ করলেন।
তার স্ত্রীরও রেশমী চুল, তবে তিনি বেশ মোটাসোটা আর হাসিখুশী মুখ। কোথাও কোনো অলঙ্কার পরেননি, লিপষ্টিক রূজ তো নয়ই। হাত দুখানা দেখে মনে হল ঘরের কাজকর্মও বেশ খানিকটা করেন। সাধারণ মেয়েদের কপালের চেয়ে অনেক চওড়া কপাল, মাথার মাঝখানে সিথি আর বাঙালী মেয়েদের মত অযত্নে বাঁধা এলোখোঁপা।
কর্তা কথা বললেন ইংরিজীতে, গিন্নী ফরাসীতে।
অভিজ্ঞান শেষ হতে না হতেই তারিশা দেমিদফ বললেন, চা, অন্য পানীয়, কি খাবেন বলুন।
ইতিমধ্যে দেমিদফ পাপিরসি (রাশান সিগরেট) বাড়িয়ে দিয়ে দেশলাই ধরিয়ে তৈরী।
আমি বাঙালী, বেনওয়া সায়েব শান্তিনিকেতনে থেকে থেকে আধা বাঙালী হয়ে গিয়েছেন আর রাশানরা যে চা খাওয়াতে বাঙালীকেও হার মানায় সে তো জানা কথা।
তবে খাওয়ার কায়দাটা আলাদা। টেবিলের মাঝখানে সামোভার; তাতে জল টবগ করে ফুটছে। এদিকে টি-পটে সকাল বেলা মুঠো পাঁচেক চা আর গরম জল দিয়ে একটা ঘন মিশকালো লিকার তৈরী করা হয়েছে সেটা অবশ্য ততক্ষণে জুড়িয়ে হিম হয়ে গিয়েছে। টি-পট হাতে করে প্রত্যেকের পেয়ালা নিয়ে মাদাম শুধান, কতটা দেব বলুন। পোয়াটাক নিলেই যথেষ্ট; সামোভারের চাবি খুলে টগবগে গরম জল তাতে মিশিয়ে নিলে দুয়ে মিলে তখন বাঙালী চায়ের রঙ ধরে। কায়দাটা মন্দ নয়, একই লিকার দিয়ে কখনো কড়া, কখনো ফিকে যা খুশী খাওয়া যায়। দুধের রেওয়াজ নেই, দুধ গরম করার হাঙ্গামও নেই। সকাল বেলাকার তৈরী লিকারে সমস্ত দিন চলে।
সামোভারটি দেখে মুগ্ধ হলুম। রূপোর তৈরী। দুদিকের হ্যাণ্ডেল, উপরের মুকুট, জল খোলার চাবি, দাঁড়াবার পা সব কিছুতেই পাকা হাতের সুন্দর, সুদক্ষ, সূক্ষ্ম কাজ করা।
তারিফ করে বললুম, আপনাদের রূপোর তাজমহলটি ভারি চমৎকার।
দেমিদফের মুখের উপর মিষ্টি লাজুক হাসি খেলে গেল ছোট ছেলেদের প্রশংসা করলে যে রকম হয়। মাদাম উচ্ছ্বসিত হয়ে বেনওয়া সায়েবকে বললেন, আপনার ভারতীয় বন্ধু ভালো কমপ্লিমেন্ট দিতে জানেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাজমহল ছাড়া ভারতীয় আর কোনো ইমারতের সঙ্গে তুলনা দিলে কিন্তু চলত না মসিয়োঁ; আমি ঐ একটির নাম জানি, ছবি দেখেছি।
তখন দেমিদফ বললেন, সামোভারটি তুলা শহরে তৈরী।
আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। বললুম, কোথায় যেন চেখফ না গর্কির লেখাতে একটা রাশান প্রবাদ পড়েছি, তুলাতে সামোভার নিয়ে যাওয়ার মত। আমরা বাঙলাতে বলি, তেলা মাথায় তেল ঢালা।।
কেরিইং কোল টু নিউ কাসল, বরেলি মে বাস লে জানা ইত্যাদি সব কটাই আলোচিত হল। আমার ফরাসী প্রবাদটিও মনে পড়ছিল, প্যারিসে আপন স্ত্রী নিয়ে যাওয়া কিন্তু অবস্থা বিবেচনা করে সেটা চেপে রাখলুম। হাফিজও যখন বলেছেন, আমি কাজী নই মোল্লা নই, আমি কোন দুঃখে তওবা (অনুতাপ) করতে যাব, আমি ভাবলুম, আমি ফরাসী নই, আমার কি দায় রসাল প্রবাদটা দাখিল করবার।
দেমিদফ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভারতবর্ষের লোক রাশান কথাসাহিত্য পড়ে কি না।
আমি বললুম, গোটা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কোনো মত দেওয়া কঠিন কিন্তু বাঙলা দেশ সম্বন্ধে বলতে পারি সেখানে এককালে ফরাসী সাহিত্য যে আসন নিয়েছিল সেটা কয়েক বৎসর হল রুশকে ছেড়ে দিয়েছে। বাংলা দেশের অনেক গুণী বলেন, চেখ মপার্সার চেয়ে অনেক উঁচু দরের স্রষ্টা।
বাঙলা দেশ কেন সমস্ত ভারতবর্ষই যে ক্রমে ক্রমে রুশ সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়বে সে সম্বন্ধে বেনওয়া সায়েব তখন অনেক আলোচনা করলেন। ভারতবাসীর সঙ্গে রুশের কোন্ জায়গার মনের মিল, অনুভূতির ঐক্য, বাতাবরণের সাদৃশ্য, সে সম্বন্ধে নিরপেক্ষ বেনওয়া অনেকক্ষণ ধরে আপন পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সুন্দর ভাষায় মজলিসী কায়দায় পরিবেষণ করলেন। শান্তিনিকেতন লাইব্রেরীতে যে প্রচুর রাশান নভেল, ছোট গল্পের বই মজুদ আছে সে কথাও বলতে ভুললেন না।
দেমিদফ বললেন, রাশানরা প্রাচ্য না পাশ্চাত্যের লোক তার স্থিরবিচার এখনো হয়নি। সামান্য একটা উদাহরণ নিন না। খাঁটী পশ্চিমের লোক শার্ট পাতলুনের নিচে গুঁজে দেয়, খাট প্রাচ্যের লোক, তা সে আফগানই হোক আর ভারতীয়ই হোক, কুর্তাটা ঝুলিয়ে দেয় পাজামার উপরে। রাশানরা এ দুদলের মাঝখানে–শার্ট পরলে সেটা পাতলুনের নিচে গোঁজে, রাশান কুর্তা পরলে সেটা পাতলুনের উপর ঝুলিয়ে দেয় সে কুর্তাও আবার প্রাচ্য কায়দায় তৈরী, তাতে অনেক রঙ অনেক নক্সা।
দেমিদফের মত অত শান্ত ও ধীর কথা বলতে আমি কম লোককেই শুনেছি। ইংরিজী যে খুব বেশী জানতেন তা নয় তবু যেটুকু জানতেন তার ব্যবহার করতেন বেশ ভেবেচিন্তে, সযত্নে শব্দ বাছাই করে করে।
রাশান সাহিত্যে আমার শখ দেখে তিনি টলস্টয়, গর্কি ও চেখফ ইয়াসনা পলিয়ানাতে যে সব আলাপ আলোচনা করেছিলেন তার অনেক কিছু বর্ণনা করে বললেন, জারের আমলে তার সব কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি— কারণ টলস্টয় আপন মতামত প্রকাশ করার সময় জারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেতেন। জারের পতনের পর নতুন সরকার এতদিন নানা জরুরী কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল— এখন আস্তে আস্তে কিছু কিছু ছাপা হচ্ছে ও সঙ্গে সঙ্গে নানা রহস্যের সমাধান হচ্ছে।
আমি বললুম, সে কি কথা, আমি তো শুনেছি আপনারা আপনাদের প্রাক-বলশেভিক সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহিত নন।
মাদামের মুখ লাল হয়ে উঠল। একটু উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, নিশ্চয় ইংরেজের প্রোপাগাণ্ডা।
আমি আমার ভুল খবরের জন্য হন্তদন্ত হয়ে মাপ চেয়ে বললুম, আমরা রাশান জানিনে, আমরা চেখফ পড়ি ইংরিজীতে, লাল রুশের নিন্দাও পড়ি ইংরিজীতে।
দেমিদফ চুপ করে ছিলেন। ভাব দেখে বুঝলুম তিনি ইংরেজ কি করে না-করে, কি বলে না-বলে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। আপন বক্তব্য পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলে যে অসত্য আপনার থেকে বিলোপ পাবে সে বিষয়ে তার দৃঢ় বিশ্বাস তার মূল বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে বারে বারে প্রকাশ পাচ্ছিল।
আমরা এসেছিলুম চারটের সময়; তখন বাজে প্রায় সাতটা। এর মাকে যে কত পাপিরসি পুড়ল, কত চা চলল গল্পের তোড়ে আমি কিছুমাত্র লক্ষ্য করিনি। এক কাপ শেষ হতেই মাদাম সেটা তুলে নিয়ে এটো চা একটা বড় পাত্রে ঢেলে ফেলেন, লিকার ঢেলে গরম জল মিশিয়ে চিনি দিয়ে আমার অজানাতেই আরেক কাপ সামনে রেখে দেন। জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেন না কতটা লিকারের প্রয়োজন, দু-একবার দেখেই আমার পরিমাণটা শিখে নিয়েছেন। আমি কখনো ধন্যবাদ দিয়েছি, কখনো টলস্টয় গর্কির তর্কের ভিতরে ডুবে যাওয়ায় লক্ষ্য করিনি বলে পরে অনুতাপ প্রকাশ করেছি।
কথার ফাঁকে মাদাম বললেন, আপনারা এখানেই খেয়ে যান। আমি অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললুম, আরেক দিন হবে। বেনওয়া সায়েব তো ছিলেছেড়া ধনুকের মত লাফ দিয়ে উঠে বললেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আজ উঠি, বড় বেশীক্ষণ ধরে আমরা বসে আছি।
আমি একটু বোকা বনে গেলুম। পরে বুঝতে পারলুম বেনওয়া সায়েব খাওয়ার নেমন্তন্নটা অন্য অর্থে ধরে নিয়ে লজ্জা পেয়েছেন। মাদামও দেখি আস্তে আস্তে বেনওয়ার মনের গতি ধরতে পেরেছেন। তখন লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে বললেন, না মসিয়োঁ, আমি সে অর্থে বলিনি; আমি সত্যিই আপনাদের গালগল্পে ভারী খুশী হয়ে ভাবলুম দুমুঠো খাবার জন্য কেন আপনাদের আড্ডাটা ভঙ্গ হয়।
দেমিদফ চুপ করে ছিলেন। ভালো করে কুয়াশাটা কাটাবার জন্য বললেন, পশ্চিম ইয়োরোপীয় এটিকেটে, এ-রকম খেতে বলার অর্থ হয়ত তোমরা এবার ওঠো, আমরা খেতে বসব। আমার স্ত্রী সে ইঙ্গিত করেননি। জানেন তো খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমরা এখনো আমাদের কুর্তা পাতলুনের উপরে পরে থাকি অর্থাৎ আমরা প্রাচ্যদেশীয়।
সকলেই আরাম বোধ করলুম। কিন্তু সে যাত্রা ডিনার হল না। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় দেমিদফ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি রাশান শেখেন না কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি শেখাবেন? তিনি বললেন, নিশ্চয়। with pleasure!
বেনওয়া বললেন, No, not with pleasure বলে আমার দিকে চোখ ঠার দিলেন।
মাদাম বললেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না।
বেনওয়া বললেন, এক ফরাসী লণ্ডনের হোটেলে ঢুকে বলল, Waiter, bring me a cotlette, please? ওয়েটার বলল, with pleasure, Sir. ফরাসী ভয় পেয়ে বলল, No, no, not with pleasure, with potatoes, please?
বেনওয়া বিদগ্ধ ফরাসী। একটুখানি হাল্কা রসিকতা দিয়ে শেষ পাতলা মেঘটুকু কেটে দিয়ে টুক করে বেরিয়ে এলেন।
মাদামও কিছু কম না। শেষ কথা শুনতে পেলুম But I shall give you cotlettes with both pleasure and potatoes.
রাস্তায় বেরিয়ে নেওয়াকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললুম, এ দুটি যথার্থ খাঁটীলোক।