ডাকাত সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথায় পড়ল।
মোল্লারা আশীর্বাদ করলেন।
পরদিন ফরমান বেরলো। তার মূল বক্তব্য, আমান উল্লা কাফির, কারণ সে ছেলেদের এলজেব্রা শেখাত, ভূগোল পড়াত, বলত পৃথিবী গোল। বিংশ শতাব্দীতে এ রকম ফরমান বেরতে পারে সে কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু বাচ্চার মত ডাকাত যখন তখ-নশীন হতে পারে তখন এরকম ফরমান আর অবিশ্বাস করার কোনো উপায় থাকে না। শুধু তাই নয়, ফরমানের তলায় মোল্লাদের সই ছাড়াও দেখতে পেলুম সই রয়েছে আমান উল্লার মন্ত্রীদের।
মীর আসলম বললেন, পেটের উপর সঙ্গীন ঠেকিয়া সইগুলো আদায় করা হয়েছে। না হলে বলো, কোন্ সুস্থ লোক বাচ্চাকে বাদশাহী দেবার ফরমানে নাম সই করতে পারে? রাগের চোটে
তার চোখ-মুখ তখন লাল হয়ে গিয়েছে, দাড়ি ডাইনে-বাঁয়ে ছড়িয়ে। পড়েছে। গর্জন করে বললেন, ওয়াজিব-উ-কল প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যাকে দেখা মাত্র কতল করা সে কি না বাদশাহ হল!
আমি বললুম, আপনি যা বলছেন তা খুবই ঠিক; কিন্তু আশা করি এসব কথা যেখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন না।
মীর আসলম বললেন, শোনন, সৈয়দ মুজতবা আলী, আমান উল্লার নিন্দা যখন আমি করেছি তখন সকলের সামনেই করেছি; বাচ্চায়ে সকাওয়ের বিরুদ্ধে যা বলবার তাও আমি প্রকাশ্যে বলি। তুমি কি ভাবছ কাবুল শহরের মোল্লারা আমাকে চেনে না, ফরমানের তলায় আমার সই লাগাতে পারলে ওরা খুশী হয় না? কিন্তু ওরা ভালো করেই জানে যে, আমার বাঁ হাত কেটে ফেললেও আমার ডান হাত সই করবে না। ওরা ভালো করেই জানে যে, আমি ফতোয়া দিয়ে বসে আছি, বাচ্চায়ে সকাও ওয়াজিব্-উ্ল্-কৎল–অবশ্য বধ্য।
মীর আসলম চলে যাওয়ার পর মৌলানা বললেন, যতদিন আফগানিস্থানে মীর আলমের মত একটি লোকও বেঁচে থাকবেন ততদিন এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমি সায় দিয়ে বললুম, হক কথা, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের ভাবনা এই বেলা একটু ভেবে নিলে ভালো হয় না?
দুজনে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলুম : কখনো মুখ ফুটে কখনো যার যার আপন মনে। বিষয় : বাচ্চা তার ফরমানে আমান উল্লা যে কাফির সে কথা সপ্রমাণ করে বলেছে, এবং যেসব দেশী-বিদেশী মাস্টার প্রফেসর আমান উল্লাকে এ সব কর্মে সাহায্য করত, তাদের ডিসমিস করা হল; স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হল।
শেষটায় মৌলানা বললেন, অত ভেবে কন্দ হবে। আমরা ছাড়া আরো লোকও তো ডিসমিস হয়েছে দেখাই যাক না তারা কি করে। মৌলানার বিশ্বাস দশটা গাধা মিললে একটা ঘোড়া হয়।
কিন্তু এসব নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা।
আবু হৌসেন নাটক যারা দেখেছেন, তাঁরা হয়ত ভাবছেন যে, কাবুলে তখন জোর রগড়। কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনায় তখন আমীর ফকির সকলেরই রসকষ কাবুল নদীর জলের মত জমে গিয়ে বরফ হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাও শহরবাসীকে সন্দেহের দোদুলদোলায় বেশীক্ষণ দোলালো না। হুকুম হলে আমান উল্লার মন্ত্রীদের ধরে নিয়ে এসো, আর তাদের বাড়ি লুঠ করো।
সে লুঠ কিস্তিতে কিস্তিতে হল। বাচ্চার খাস-পেয়ারারা প্রথম খবর পেয়েছিল বলে তারা প্রথম কিস্তিতে টাকা-পয়সা, গয়নাগাটী দামী টুকিটাকি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় কিস্তিতে সাধারণ ডাকাতরা আসবাবপত্র, কার্পেট, বাসন-কোসন, জামা-কাপড় বেছে বেছে নিয়ে গেল, তৃতীয় কিস্তিতে আর সব ঝড়ের মুখে উড়ে গেল শেষটায় রাস্তার লোক কাঠের দরজা-জানালা পর্যন্ত ভেঙে নিয়ে গিয়ে শীত ভাঙালো।।
মন্ত্রীদের খালি পায়ে বরফের উপর দাঁড় করিয়ে হরেক রকম সম্ভব অসম্ভব অত্যাচার করা হল গুপ্তধন বের করবার আশায়। তার বর্ণনা শুনে কাবুলের লোক পর্যন্ত শিউরে উঠেছিল মৌলানা আর আমি শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলুম।
তারপর আমান উল্লার ইয়ারবক্সি, ফৌজের অফিসারদের পালা। বন্ধ দোর-জানালা ভেদ করে গভীর রাত্রে চিৎকার আসত ডাকু পড়েছে। সে আবার সরকারী ডাকু তার সঙ্গে লড়াই করার উপায় নেই, তার হাত থেকে পালাবার পথ নেই।
কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেল রাস্তার উপর শীতে জমে-যাওয়া রক্ত, উলঙ্গ মড়া, রাত্রে ভীত নরনারীর আর্ত চিৎকার সবই সত্য হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, অভ্যাস হল না শুধু শুকনো রুটি, নুন আর বিনা দুধ চিনিতে চা খাওয়ার। মায়ের কথা মনে পড়ল; তিনি একদিন বলেছিলেন, চা-বাগানের কুলীরা যে প্রচুর পরিমাণে বিনা দুধ চিনিতে লিকার খায় সে পানের তৃপ্তির জন্য নয়, ক্ষুধা মারবার জন্য। দেখলুম অতি সত্যি কথা, কিন্তু শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কাবুলে ম্যালেরিয়া নেই, থাকলে তারপর চা-বাগানের কুলীর যা হয়, আমারও তাই হত এবং তার পরমা গতি কোথায়, বাঙালীকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। মৌলানাকে জিজ্ঞেস করলুম, না খেতে পেয়ে, বুলেট খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, এ-তিন মার্গের ভিতর মরার পক্ষে কোনটা প্রশস্ততম বলো তো।
মৌলানা কবিতা আওড়ালেন আরেক মৌলানার–কবি সাদীর —
চূন আহঙ্গে রক্ত কুন জানে পাক্,
চি বর তখ্ৎ মুরদন্ চি বর্ সরে খাক্?
পরমায়ু যবে প্রস্তুত হয় মহাপ্রস্থান তরে
একই মৃত্যু–সিংহাসনেতে অথবা ধূলির পরে।
বাচ্চার ফরমান জারির দিন সাতেক পরে ভারতীয়, ফরাসী, জর্মন শিক্ষক-অধ্যাপকেরা এক ঘরোয়া সভায় স্থির করলেন, স্যার ফ্রান্সিসকে তাদের দুরবস্থা নিবেদন করে হাওয়াই জাহাজে করে ভারতবর্ষে যাওয়ার জন্য বন্দোবস্ত ভিক্ষা করা।
অধ্যাপকেরা বললেন, কাবুল থেকে বেরবার রাস্তা চতুর্দিকে বন্ধ; স্যার ফ্রান্সিস বললেন, হাঁ; অধ্যাপকেরা নিবেদন করলেন, কাবুলে কোনো ব্যাঙ্ক নেই বলে তাদের জমানো যা কিছু সম্বল তা পেশাওয়ারে এবং সে পয়সা আবার কোনো উপায় নেই; স্যার ফ্রান্সিস বললে, হুঁ; অধ্যাপকেরা কাতর অনুনয়ে জানালেন, স্ত্রী-পরিবার নিয়ে তারা অনাহারে আছেন; সায়েব বললেন, অ; অধ্যাপকেরা মরীয়া হয়ে বললেন, এখানে থাকলে তিলে তিলে মৃত্যু; সায়েব বললেন, আ।
একদিকে ফুল্লরার বারমাসী, অন্যদিকে সায়েবের অ, আ করে বর্ণমালা পাঠ। ক্লাশ সিক্সের ছেলে আর প্রথম ভাগের খোকাবাবু যেন একই ঘরে পড়াশোনা করছেন।
বর্ণমালা যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল তখন সায়েব বললেন, এখানকার ব্রিটিশ লিগেশন ইংলণ্ডের ব্রিটিশ সরকারের মুখপাত্র। ভারতবাসীদের সুখ-সুবিধা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ব্রিটিশ লিগেশনের কর্তব্য নয়। আমি যদি কিছু করতে পারি, তবে সেটা ফেবার হিসেবে করব, আপনাদের কোনো রাইট নেই।
যাত্রাগানে বিস্তর দুর্যোধন দেখেছি। সায়েবের চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, না, কিছু কিছু গরমিল রয়েছে। দুর্যোধন ফেবার, রাইট কোনো হিসেবেই পাঁচখানা গাঁ দিতে রাজী হননি, ইনি ফেবারেবল কনসিডারেশন করতে রাজী আছেন।
এ অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ হলে হয়ত তিনি বগল বাজিয়ে সুখবর দেবার জন্য পাণ্ডব-শিবিরে ছুটে যেতেন, কিন্তু আমার মনে পড়ল যুধিষ্ঠিরের কথা। একটি মিথ্যে কথা বলবার জন্যে তাঁকে নরক দর্শন করতে হয়েছিল। ভাবলুম, এদিকে দুর্যোধন, ওদিকে বাচ্চায়ে সকাও, এর মাঝখানে যদি সাহস সঞ্চয় করে একটিবারের মত এই জীবনে সত্যি কথা বলে ফেলতে পারি তবে অন্তত একবারের মত স্বর্গ দর্শন লাভ হলে হতেও পারে। বললুম, হাওয়াই জাহাজগুলো ভারতীয় পয়সায় কেনা, পাইলটরা ভারতীয় তনখা খায়, পেশাওয়ারের বিমানঘাঁটি ভারতের নিজস্ব— এ অবস্থায় আমাদের কি কোনো হক নেই? ব্রিটিশ লিগেশন যে ভারতীয় অর্থে তৈরি, সায়েব যে ভারতীয় নিমক খান, সেকথা আর ভদ্রতা করে বললুম না।
সায়েব ভয়ঙ্কর চটে গেলেন, অধ্যাপকরাও ভয় পেয়ে গেলেন। বুঝলুম, জীবনমরণের ব্যাপার— ভারতীয়েরা কোনো গতিকে দেশে ফিরে যেতে পেলে রক্ষা পান মেহেরবানী, হক নিয়ে নাহক তর্ক করে কোনো লাভ নেই। বললুম, আমি যা বলেছি, সে আমার ব্যক্তিগত মত। আমি নিজে কোনো ফেবার চাইনে, কিন্তু আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা যেন আর পাঁচজনের স্বার্থে আঘাত না করে।
এর পর কথা কাটাকাটি করে আর কোনো লাভ নেই। আমার যা বক্তব্য সায়েব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন, আর সায়েবের বক্তব্য ভারতবাসীর কাছে কিছু নূতন নয়— ফেবার শব্দ দরখাস্তে যিনি যত ইনিয়ে-বিনিয়ে লিখতে পারেন, তাকেই আমরা ভারতবর্ষে গেল এক শ বছর ধরে ইংরিজীতে সুপণ্ডিত বলে সেলাম করে আসছি।
সেই সন্ধ্যায়ই খবর পেলুম, যে সব ভারতবাসী স্বদেশে ফিরে যেতে চান, তাদের একটা ফিরিস্তি তৈরি করা হয়েছে। সায়েব স্বহস্তে আমার নামে ঢ্যারা কেটে দিয়েছেন।
আবদুর রহমান এখন শুধু আগুনের তদারকি করে। বাদাম নেই যে, খোসা ছাড়াবে, কালি নেই যে, জুতো পালিশ করবে। না খেয়ে খেয়ে রোগা হয়ে গিয়েছে, দেখলে দুঃখ হয়।
মৌলানা শুতে গিয়েছেন। আবদুর রহমান ঘরে ঢুকল। আমি বললুম, আবদুর রহমান, সব দিকে তো ডাকাতের পাল রাস্তা বন্ধ করে আছে। পানশিরে যাবার উপায় আছে?
আবদুর রহমান আমার দুহাত আপন হাতে তুলে নিয়ে শুধু চুমো খায়, আর চোখে চেপে ধরে; বলে, সেই ভালো হুজুর, সেই ভালো। চলুন আমার দেশে। এরকম শুকনো রুটি আর মুন খেলে দুদিন বাদে আপনি আর বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না। তার চেয়ে ভালো খাওয়ার জিনিষ আমাদেরই বাড়িতে আছে। কিছু না হোক, বাদাম, কিসমিস, পেস্তা, আঞ্জীর, মোলায়েম পনীর, আর হুজুর, আমার নিজের তিনটে দুম্বা আছে। আর একটি মাস, জোর দেড় মাস, তারপর বরফ গলতে আরম্ভ করলেই আপনাকে নদী থেকে মাছ ধরে এনে খাওয়াব। ভেজে, সেঁকে, পুড়িয়ে যেরকম আপনার ভালো লাগে। আপনি আমাকে মাছের কত গল্প বলেছেন, আমি আপনাকে খাইয়ে দেখাব। আরামে শোবেন, ঘুমবেন, জানলা দিয়ে দেখবেন—
আবদুর রহমানকে বাধা দিতে কষ্টবোধ হল। বেচারী অনেক দিন পরে আবার প্রাণ খুলে কথা বলতে আরম্ভ করেছে, পানশিরের পুরানো স্বপ্নে নূতন রঙ লাগিয়ে আমার চোখে চটক লাগাবার চেষ্টা করছে; তার মাঝখানে ভোরের কাকের কর্কশ কা-কা করে তার সুখ-স্বপ্ন কেটে ফেলতে অত্যন্ত বাধো বাধো ঠেকল। বললুম, না, আবদুর রহমান, আমি যাব না, আমি বলছি, তুমি চলে যাও। জানো তো আমার চাকরি গেছে, তোমাকে মাইনে দেবার টাকা আমার নেই। ডাল-চাল ফুরিয়ে গিয়ে গমে এসে ঠেকেছে, তাও তো আর বেশী দিন চলবে না। তুমি বাড়ি চলে যাও, খুদা যদি ফের সুদিন করেন, তবে আবার দেখা হবে।
ব্যাপারটা বুঝতে আবদুর রহমানের একটু সময় লাগল। যখন বুঝল, তখন চুপ করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমারও মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু করিই বা কি? আবদুর রহমানের সঙ্গে বহু সন্ধ্যা, বহু যামিনী কাটিয়ে বুঝতে পেরেছি যে, সে যদি নিজের থেকে কোনো জিনিস না বোঝে, তবে আমার যুক্তিতর্ক তার মনের কোনো কোণে ঠাঁই পায় না। আমার ব্যবস্থাটা যে তার আদপেই পছন্দ হয়নি, সেটা বুঝতে পারলুম, কিন্তু আমি আশা করেছিলুম, সে আপত্তি জানাবে, আমি তাহলে তর্কাতর্কি করে তাকে খানিকটা শায়েস্তা করে নিয়ে আসব। দেখলুম তা নয়, সরল শোক আর সোজা সুপারি গাছে মিল রয়েছে; একবার পা হড়কালে আপত্তি-অজুহাতের শাখা-প্রশাখা নেই বলে সোজা ভূমিতলে অবতরণ।।
খানিকক্ষণ পরে নিজের থেকেই ঘরে ফিরে এল। মাথা নিচু করে বলল, আপনি নিজের হাতে মেপে সকাল বেলা দুমুঠো আটা দেবেন। আমার তাইতেই চলবে।
কি করে লোকটাকে বোঝাই যে, আমার অজানা নয় সে মাসখানেক ধরে দুমুঠো আটা দিয়েই দুবেলা চালাচ্ছে। আর খাবারের কথাই তো আসল কথা নয়। আমার প্রস্তাবে যে সে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করেছে, সেটা লাঘব করি কি করে? যুক্তিতর্ক তো বৃথা পূর্বেই বলেছি, ভাবলুম, মৌলানাকে ডাকি। কিন্তু ডাকতে হল না। আবদুর রহমান বলল, যখন সবকিছু পাওয়া যেত, তখন আমি এখানে যা খেয়েছি, আমার বাবা তার শ্বশুর বাড়িতেও সেরকম খায়নি। তারপর বেশ একটু গলা চড়িয়ে বলল, আর আজ কিছু জুটছে না বলে আমাকে খেদিয়ে দিতে চান? আমি কি এতই নিমকহারাম?
অনেক কিছু বলল। কিছুটা যুক্তি, বেশীর ভাগ জীবনস্মৃতি, অল্পবিস্তর ভর্ৎসনা, সবকিছু ছাপিয়ে অভিমান। কখনো বলে, দেরেশি করিয়ে দেননি, কখনো বলে, নূতন লেপ কিনে দেননি কাবুলের কটা সর্দারের ওরকম লেপ আছে, আমি গেলে বাড়ি পাহারা দেবে কে, আমাকে তাড়িয়ে দেবার হক আপনার সম্পূর্ণ আছে— আপনার আমি কি খেদমত করতে পেরেছি?
যেন পানশিরের বরফপাত। গাদাগাদা, পাঁজা-পাঁজা। আমি যেন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, আর আমার উপর সে বরফ জমে উঠছে। আবদুর রহমানই আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন বলেছিল, তখন নাকি সেই বরফ-আস্তরণের ভিতর বেশ ওম বোধ হয়। আমিও আরাম বোধ করলুম।
কিন্তু না খেতে পেয়ে আবদুর রহমানের পানশিরী তাগদ মিইয়ে গিয়েছে। সাত দিন ধরে বরফ পড়ল না— মিনিট খানেক বর্ষণ করেই আবদুর রহমান থেমে গেল। আমি বললুম, তা তো বটেই, তুমি চলে গেলে আমাকে বাঁচাবে কে? অতটা ভেবে দেখিনি।
আবদুর রহমান তদ্দণ্ডেই খুশ। সরল লোককে নিয়ে এই হল মস্ত সুবিধে। তক্ষুনি হাসিমুখে আগুনের তদারকিতে বসে গেল।
তারপর মন থেকে যে শেষ গ্লানিটুকু কেটে গিয়েছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলুম শুতে যাবার সময়। তোষকের তলায় লেপ গুঁজে দিতে দিতে বলল, জানেন, সায়েব, আমি যদি বাড়ি চলে যাই তবে বাবা কি করবে? প্রথম আমার কাছ থেকে একটা বুলেটের দাম চেয়ে নেবে; তারপর আমাকে গুলী করে মারবে। কতবার আমাকে বলেছে, তোর মত হতভাগাকে মারবার জন্য যে গাঁটের পয়সায় বুলেট কেনে সে তোর চেয়েও হতভাগা।
আমি বললুম, ও, তাই বুঝি তুমি পানশির যেতে চাও না? প্রাণের ভয়ে?
আবদুর রহমান প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। তারপর হাসল। আমারও হাসি পেল যে আবদুর রহমান এতদিন ধরে শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে রূপ ধারণ করে বিরাজ করত আমার আলবাল-সিঞ্চনে সে যে একদিন রসবোধকিশলয়ে মুকুলিত হয়ে সরসতরুবর হবে সে আশা করিনি।
আবদুর রহমান একখানা খোলা-চিঠি দিয়ে গেল; উপরে আমান উল্লার পলায়নের তারিখ।
কমরত ব্ শিকনদ–
এতদিন বাদে মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। আগা আহমদের মাইনের পাঁচবছরের জমানো তিন শ টাকা আর তার ভাইয়ের রাইফেল লোপাট মেরে আফ্রিদী মুল্লুকে চললুম। সেখানে গিয়ে পিতৃ-পিতামহের ব্যবসা ফাঁদব। শুনতে পাই খাইবারপাসের ইংরেজ অফিসার পাকড়ে পাকড়ে খালাসীর পয়সা আদায় করার প্রাচীন ব্যবসা উপযুক্ত লোকের অভাবে অত্যন্ত দুরবস্থায় পড়েছে।
কিন্তু আচ্ছা ইংরিজী জাননেওয়ালা একজন দোভাষীর আমার প্রয়োজন— আমার ইংরিজী বিদ্যে তো জান! তোমার যদি কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে তবে পত্রপাঠ জলালাবাদের বাজারে এসে আমার অনুসন্ধান করো। মাইনে? কাবুলে এক বছরে যা কামাও, আমি এক মাসে তোমাকে তাই দেব। কাবুলের ডাকাতের চাকর হওয়ার চেয়ে আমার বেরাদর হয়ে ইমান-ইনসাফে কামানো
পয়সার বখরাদার হওয়া ঢের ভালো।
আমান উল্লা নেই— তবু ফী আমানিল্লা।*
দোস্ত মুহম্মদ
পুঃ আগা আহমদ সঙ্গে আছে। কাঁধে আমান উল্লার বিলি করা একখানা উৎকৃষ্ট মাউজার রাইফেল।
রাজা হয়ে ভিস্তিওয়ালার ডাকাত ছেলে ইচ্ছাঅনিচ্ছায় রাজপ্রাসাদে কি রঙ্গরস করল তার গল্প আস্তে আস্তে বাজারময় ছড়াতে আরম্ভ করল। আধুনিক ঔপন্যাসিকের বালীগঞ্জের কাল্পনিক ডাইনিঙরুমে পাড়াগেঁয়ে ছেলে যা করে তারই রাজসংস্করণ। নূতনত্ব কিছু নেই। তবে একটা গল্প আমার বড় ভালো লাগল। মৌলানার কপি রাইট।
আমান উল্লা লণ্ডনে পঞ্চম জর্জের সঙ্গে যে রোলস-রয়েস চড়ে কুচকাওয়াজ পালাপরবে যেতেন রাজা জর্জ সেই বজরার মত মোটর আমান উল্লাকে বিদায়-ভেট দেন। সে গাড়ি রাক্ষসের মত তেল খেত বলে আমান উল্লা পালাবার সময় সেখানা কাবুলে ফেলে যান।
বাচ্চা রাজা হয়ে বিশেষ করে সেই মোটরই পাঠাল বাস্তুগাঁয়ে বউকে নিয়ে আসবার জন্য। বউ নাকি তখন বাচ্চার বাচ্চার মাথার উকুন বাছছিল। সারা গায়ের হুলুস্কুলের মাঝখানে বাচ্চার বউ নাকি ড্রাইভারকে বলল, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল, নিজে এসে আমাকে খচ্চরে বসিয়ে যেন নিয়ে যায়।
দিগ্বিজয় করে বুদ্ধদেব যখন কপিলবস্তু ফিরেছিলেন তখন যশোধরা এমনি ধারা অভিমান করেছিলেন।
———–
* আমান উল্লা কথার অর্থ আল্লার আমানত এবং ফী আমান উল্লা কথার অর্থ (তোমাকে) আল্লার আমানতে রাখলুম।