৩১. শীত আর বসন্ত ঘরে বসে

শীত আর বসন্ত ঘরে বসে, ডুব সাঁতার দিয়ে কাটাতে হল।

এদেশে বসন্তের সঙ্গে আমাদের বর্ষার তুলনা হয়। সেখানে গ্রীষ্মকালে ধরণী তপ্তশয়নে পিপাসার্তা হয়ে পড়ে থাকেন, আষাঢ়স্য যে কোনো দিবসেই হোক ইন্দ্রপুরীর নববর্ষণ বারতা পেয়ে নূতন প্রাণে সঞ্জীবিত হন। এখানে শীতকালে ধরিত্রী প্রাণহীন স্পন্দন-বিহীন মহানিদ্রায় লুটিয়ে পড়েন, তার পর নববসন্তের প্রথম রৌদ্রে চোখ মেলে তাকান। সে তাকানো প্রথম ফুটে ওঠে গাছে গাছে।

দূর থেকে মনে হল ফ্যাকাশে সাদা গাছগুলোতে বুঝি কোনোরকম সবুজ পোকা লেগেছে। কাছে গিয়ে দেখি গাছে গাছে অগুণতি ছোট্ট ছোট্ট পাতার কুঁড়ি; জন্মের সময় কুকুরছানার বন্ধ চোখের মত। তারপর কয়েকদিন লক্ষ্য করিনি, হঠাৎ একদিন সকালবেলা দেখি সেগুলো ফুটেছে আর দুটি দুটি করে পাতা ফুটে বেরিয়েছে— গাছগুলো যেন সমস্ত শীতকাল বকপাখির মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ ডানা মেলে ওড়বার উপক্রম করেছে। সহস্র সহস্র সবুজ বলাকা যেন মেলে ধরেছে লক্ষ লক্ষ অঙ্কুরের পাখা।

ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বৃন্দীর।

গাছে গাছে দেখন-হাসি, পাতায় পাতায় আড়াআড়ি–কে কাকে ছেড়ে তাড়াতাড়ি গজিয়ে উঠবে। কোনো গাছ গোড়ার দিকে সাড়া দেয়নি, হঠাৎ একদিন একসঙ্গে অনেকগুলো চোখ মেলে দেখে আর সবাই ঢের এগিয়ে গেছে, সে তখন এমনি জোর ছুট লাগাল যে, দেখতে না দেখতে আর সবাইকে পিছনে ফেলে, বাজী জিতে, মাথায় আইভি মুকুট পরে সগর্বে দুলতে লাগল। কেউ সারা গায়ে কিছু না পরে শুধু মাথায় সবুজ মুকুট পরল, কেউ ধীরেসুস্থে সর্বাঙ্গে যেন সবুজ চন্দনের ফোঁটা পরতে লাগল। এতদিন বাতাস শুকনো ভাঁলের ভিতর দিয়ে হুহু করে ছুটে চলে যেত, এখন দেখি কী আদরে পাতাগুলোর গায়ে ইনিয়েবিনিয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

কাবুল নদীর বুকের উপর জমে-যাওয়া বরফের জগদ্দল-পাথর ফেটে চৌচির হল। পাহাড় থেকে নেমে এল গম্ভীর গর্জনে শত শত নব জলধারা— সঙ্গে নেমে আসছে লক্ষ লক্ষ পাথরের মুড়ি আর বরফের টুকরো। নদীর উপরে কাঠের পুলগুলো কাঁপতে আরম্ভ করেছে— সিকন্দর শাহের আমল থেকে তার হাঁটু ভেঙে কতবার নুয়ে পড়েছে, ভেসে গিয়েছে, ফের দাঁড়িয়ে উঠেছে তার হিসেব কেউ কখনো রাখতে পারেনি।

উপরে তাকিয়ে দেখি গভীর নীলাম্বুজের মত নবীন নীলাকাশ হংসশুভ্র মেঘের ঝালর ঝুলিয়ে চন্দ্রাতপ সাজিয়েছে।

উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখি সবুজের বন্যায় জনপদ অরণ্য ডুবে গিয়েছে। এ রকম সবুজ দেখেই পূর্ববঙ্গের কবি প্রিয়ার শ্যামল রঙের স্মরণে বলেছিলেন,

ও বন্ধুয়া, কোন্ বন-ধোওয়া ছাওলা নীলা পানি,
গোসল করি হইলা তুমি সকল রঙের রানী।

কিন্তু এ-উপত্যকা এবনরাজি এ-রকম সবুজ পেল কোথা থেকে?

নীলাকাশের নীল আর সোনালী রোদের হলদে মিশিয়ে।

কিন্তু আমাদের বর্ষা আর এদেশের বসন্তে একটা গভীর পার্থক্য রয়েছে। বর্ষায় আমাদের মন ঘরমুখো হয়, এদেশের জনপ্রাণীর মন বাহিরমুখো হয়। গাছপালার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে সুপ্তোথিত নব যৌবনের স্পন্দন অনুভব করে তারই স্মরণে কবি বলেছেন

শপথ করিনু রাত্রে পাপ পথে আর যেন নাহি ধায়,
প্রভাতে দ্বারেতে দেখি শপথ মধুঋতু কি করি উপায়!

শুধু ওমর খৈয়াম দোটানার ভিতর থাকা পছন্দ করেন না। তিনি গর্জন করে বললেন,

বিধিবিধানের শীতপরিধান
ফাগুন আগুনে দহন করে।
আয়ুবিহঙ্গ উড়ে চলে যায়
হে সাকি, পেয়ালা অধরে ধরো।*

কাবুলীরা তাই বেরিয়ে পড়েছে, না বেরিয়ে উপায়ও নেই— শীতের জ্বালানী কাঠ ফুরিয়ে এসেছে, দুম্বা ভেড়ার জাবনা তলায় এসে ঠেকেছে, শুটকি মাংসের পোকা কিলবিল করছে। এখন আতপ্ত বসন্তের রোদে শরীরকে কিঞ্চিৎ তাতানো যায়, দুম্বা ভেড়া কচি ঘাসে চরানো যায় আর আধখেঁচড়া শিকারের জন্য দুচার দল পাখিও আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। আবদুর রহমান বললো, পানশির অঞ্চলে ভাঙা বরফের তলায় কি এক রকমের মাছও নাকি এখন ধরা যায়। অনুমান করলুম, কোন রকমের স্প্রিং ট্রাউটই হবে।

 

রথ দেখার সময় যারা কলা বেচার দিকেও মাঝে মাঝে নজর দেন তাদের মুখে শুনেছি কুবের যে যক্ষকে ঠিক একটি বৎসরের জন্যই নির্বাসন দিয়েছিলেন তার একটা গভীর কারণ আছে। ছয় ঋতুতে ছয় রকম করে প্রিয়ার বিরহযন্ত্রণা ভোগ না করা পর্যন্ত মানুষ নাকি পরিপূর্ণ বিচ্ছেদবেদনার স্বরূপ চিনতে পারে না; আর বিদ জনকে এক বছরের বেশী শাস্তি দেওয়াতেও নাকি কোনো সুক্ষ চতুরতা নেই–সোজা বাংলায় তখন তাকে বলে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া মাত্র।

আফগান-সরকার অযথা বি-সন্তোষী নন বলে ছয়টি ঋতু পূর্ণ হওয়া মাত্রই আমাকে পাণ্ডববর্জিত গণ্ডগ্রামের নির্বাসন থেকে মুক্তি দিয়ে শহরে চাকরী দিলেন। এবারে বাসা পেলুম লব-ই-দরিয়ায় অর্থাৎ কাবুল নদীর পারে, রাশান দূতাবাসের গা ঘেঁষে, বেনওয়া সায়েবের সঙ্গে একই বাড়িতে।

প্রকাণ্ড সে বাড়ি। ছোটখাটো দুর্গ বললেও ভুল হয় না। চারদিকে উঁচু দেয়াল, ভিতরে চকমেলানো একতলা দোতলা নিয়ে ছাব্বিশখানা বড় বড় কামরা। মাঝখানের চত্বরে ফুলের বাগান, জলের ফোয়ারাটা পর্যন্ত বাদ যায়নি। বড় লোকের বাড়ি সরকারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে— বেনওয়া সায়েব ফন্দি-ফিকির করে বাড়িটা বাগিয়েছিলেন।

আমি নিলুম এক কোণে চারটে ঘর আর বেনওয়া সায়েব রইলেন আরেক কোণে আর চারটে ঘর নিয়ে। বাকি বাড়িটা খাঁখাঁ করে, আর সে এতই প্রকাণ্ড যে আবদুর রহমানের সঙ্গীত রবও কায়ক্লেশে আঙ্গিনা পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছয়।

শহরে এসে গুষ্টিসুখ অনুভব করার সুবিধে হল। রাশান রাজদূতাবাসে রোজই যাই— দুদিন না গেলে দেমিদফ এসে দেখা দেন। সইফুল আলম মাঝে মাঝে ঢু মেরে যান, সোমথ বউ সম্বন্ধে অহরহ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মৌলানার দাড়ির দর্শনও মাঝে মাঝে পাই, দোস্ত মুহম্মদ ঘূর্ণিবায়ুর মত বেলা-অবেলায় চক্কর মেরে বেরবার সময় কলাড মুলা ফেলে যান, বিদগ্ধ মীর আসলম সুসিদ্ধ চৈনিক যুষ পান করে যান, তা ছাড়া ইনি উনি তিনি তো আছেনই আর নিতান্ত বান্ধব বাড়ন্ত হলে বিরহী যক্ষ বেনওয়া তো হাতের নাগাল।

রাশান রাজদূতাবাসে আরো অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল; দেমিফকে বাদ দিলে সকলের পয়লা নাম করতে হয় বলশফের। নামের সঙ্গে অর্থ মিলিয়ে তাঁর দেহ-ব্যঢেরস্ক, বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশুমহাবাহু বললে আবদুর রহমান বরঞ্চ অপাংক্তেয় হতে পারে, ইনি সে বর্ণনা গলাধঃকরণ করে অনায়াসে সেকেণ্ড হেলপিঙ চাইতে পারেন।

আবদুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করে দেবার সময় যে দ্বিতীয় নরদানবের কথা বলেছিলুম ইনিই সে-বিভীষিকা।

বহুবার এর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি— কাবুল বাজারের মত পপুলার লীগ অব নেশনসে আজ পর্যন্ত এমন দেশী বিদেশী চোখে পড়েনি যে তাঁকে দেখে হকচকিয়ে যায়নি।

হুশিয়ার সোয়ার হলে তক্ষুনি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেছে বহু ঘোড়াকে ঘাবড়ে গিয়ে সামনের পা দুটো আকাশে তুলতে দেখেছি।

টেনিস-কোর্টে রেকেট নিয়ে নামলে শত্রুপক্ষ বেজ-লাইনের দশ হাত দূরে তারের জালের গা ঘেঁষে দাঁড়াত। বলশফ বেজে দাঁড়ালে তার কোনো পার্টনার নেটে দাঁড়াতে রাজী হত না, শত্রুপক্ষের তো কথাই ওঠে না। তাঁতের রেকেট ঘন ঘন ছিঁড়ে যেত বলে অ্যালুমিনিয়ম জাতীয় ধাতুর রেকেট নিয়ে তিনি তাড় হাঁকড়াতেন, স্বচ্ছন্দে নেট ডিঙোতে পারতেন–লাফ দেবার প্রয়োজন হত নাআর ঝোলা নেট টাইট করার জন্য এক হাতে হ্যাণ্ডেল ঘোরাতেন মেয়েরা যেরকম সেলাই কলের হাতল ঘোরায়।

শুনেছি বিলেতে কোনো কোনো ফিলম্ নাকি যোলো বছরের কম বয়স হলে দেখতে দেয় না— চরিত্র দোষ হবে বলে; যাদের ওজন এক শ ষাট পৌণ্ডেরকম তাদের ঠিক তেমনি বলশফের সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করা বারণ ছিল, পাছে হাতের নড়া কাঁধ থেকে খসে যায়। মহিলাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা।

বীরপুরুষ হিসেবে রাশান রাজদূতাবাসে বলশফের খাতির ছিল। ১৯১৬ সাল থেকে বলশেভিক বিদ্রোহের শেষ পর্যন্ত তিনি  বিস্তর লড়াই লড়েছেন। ১৯১৬-১৭ সালের শীতকালে যখন রুশবাহিনী পোল্যাণ্ডে লড়াই হেরে পালায় তখন বলশফ রাশান ক্যাভালরিতে ছোকরা অফিসার। সেবারে ঘোড়ায় চড়ে পালাবার সময় তার পিঠের চোদ্দ জায়গায় জখম হয়েছিল বিস্তর ঝুলোষুলির পর একদিন শার্ট খুলে তিনি আমায় দাগগুলো দেখিয়েছিলেন। কোনো কোনোটা তখনো আধ ইঞ্চি পরিমাণ গভীর। আমি ঠাট্টা করে বলেছিলুম, পৃষ্ঠে তব অস্ত্র-লেখা।।

বলশফকে কেউ কখনো চটাতে পারেনি বলেই রসিকতাটা করেছিলুম। তিনি ভারতবর্ষের ক্ষাত্র বীরত্বের, কোড় শুনে বললেন, যদি সেদিন না পালাতুম তবে হ্রৎস্কির আমলে পোলদের বেধড়ক পাল্টা মার দেবার মুখ থেকে যে বঞ্চিত হতুম, তার কি?

মাদাম দেমিদফ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আর জানেন তোত, মসিয়োঁ, ঐ লড়াইতেই সোভিয়েট রাশার অনেক পথ সুরাহা হয়ে যায়।

বলশফের একটা মস্ত দোষ দুদণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারেন। হাত দুখানা নিয়ে যে কি করবেন ঠিক করতে পারেন না বলে এটা সেটা নিয়ে সব সময় নাড়াচাড়া করেন, বেখেয়ালে একটু বেশী চাপ দিতেই কর্কদ্ভুটা পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। তিনি ঘরে ঢুকলেই আমরা টুকিটাকি সব জিনিষ তার হাতের নাগাল থেকে সরিয়ে ফেলতুম। আমার ঘরে ঢুকলে আমি তৎক্ষণাৎ তাকে একথালা আন্ত আখরোট খেতে দিতুম।

দুটো একটা খেতেন মাঝে সাঝে যাওয়ার পর দেখা যেত সব কটি আখরোটের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছেন, চহারমগজশিকন (হাতুড়ি) না দেওয়া সত্ত্বেও।

এ রকম অজাতশত্ৰু লোক সমস্ত কাবুল শহরে আমি দুটি দেখিনি। একদিন তাই যখন দেমিদফের ঘরে আলোচনা হচ্ছিল তখন বলশফের সবচেয়ে দিলী-দোস্ত রোগাপটকা সিয়েশকফ বললেন, বলশফের সঙ্গে সকলের বন্ধুত্ব তার গায়ের জোরের ভয়ে।

বলশফ বললেন, তা হলে তো তোমার সবচেয়ে বেশী শত্রু থাকার কথা।

স্মিয়েশকফ যা বললেন, পদাবলীর ভাষায় প্রকাশ করলে তার রূপ হয়

বঁধু তোমার গরবে গরবিনী হাম
রূপসী তুহারি রূপে—

বাকিটা তিনি আর প্রাণের ভয়ে বলেননি।

বলশফ বললেন, নোগা লোকের ঐ এক মস্ত দোষ। খামকা বাজে তর্ক করে। বলে কি না ভয়ে বন্ধুত্ব। যতসব পরস্পরদ্রোহী, আত্মঘাতী বাক্যাড়ম্বর।

বলশফ সম্বন্ধে এত কথা বললুম তার কারণ তিনি তখন আমান উল্লার অ্যার-ফোর্সের ডাঙর পাইলট। বলশেভিক-বিদ্রোহ জুড়িয়ে গিয়ে থিতিয়ে যাওয়ায় তাঁর সঙ্কটাকাঙ্ক্ষী মন কাবুলে এসে নূতন বিপদের সন্ধানে আমান উল্লার চাকরী নিয়েছিল।

শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমান উল্লার সেবা করেছিলেন।

————–
* অনুবাদকের নাম মনে নেই বলে দুঃখিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *