চারদিন অরাজকতার ভিতর দিয়ে কাটল। কনফুৎসিয় বলেছেন, বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ, আমি মনে মনে বললুম, তারও বাড়া যবে ডাকু পরে রাজবেশ।
আমান উল্লা বসে আছেন আর্কের ভিতরে। তাঁর চেলা-চামুণ্ডারা শহরের লোককে সাধ্যসাধনা করছে বাচ্চার সঙ্গে লড়াই করবার জন্য। কেউ কান দিচ্ছে না। শহর চোরভাকাতে ভর্তি। যেসব বাড়ি পাকাপোক্ত মাল দিয়ে তৈরী নয়, সেগুলো লুট হচ্ছে। একটুখানি নির্জন রাস্তায় যাবার যো নেই— ওভারকোটের লোভে শীত-কাতুরে ফিচকে ডাকাত সব কিছু করতে প্রস্তুত। টাকার চেয়েও ডাকাতের লোভ ঐ জিনিসের উপর কারণ টাকা দিয়েও কোনো কিছু কেনার উপায় নেই। হাট বসছে না বলে দুধ, মাংস, আলু, পেঁয়াজ কিছুই কেনা যাচ্ছে না। গম-ডালের মুদীও গঁাট হয়ে বসে আছে, দাম চড়বার আশায় কাবুল শহর বাকি দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।।
শ্বেতাঙ্গরা রাস্তায় বেরচ্ছে না; একমাত্র রুশ পাইলটরা নির্ভয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে ভিড় ঠেলে বিমানঘাঁটিতে যাওয়া-আসা করছে। হাতে রাইফেল পর্যন্ত নেই, কোমরে মাত্র একটি পিস্তল।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হলুম খাস কাবুল বাসিন্দাদের ব্যবহার দেখে। রাইফেল ঝুলিয়েছে কাঁধে, বুলেটের বেল্ট বেঁধেছে কোমরে, কেউ পরেছে আড়াআড়ি করে পৈতের মত বুকের উপরে, কেউবা বাজুবন্ধ বানিয়ে বাহুতে, কেউ কাঁকন করে কজীতে, দু-একজন মল করে পায়ে।
যে অস্ত্র বিদ্রোহী, নরঘাতক, দস্যর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দীন আফগানিস্থান নিরম্ন থেকে ক্রয় করেছিল, সে আজ অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত হল।
কিন্তু আশ্চর্য, নগরী রক্ষা করাতে এদের কোনো উৎসাহ নেই। দস্যু জয়লাভ করলে লুষ্ঠিত হবার ভয় নেই, প্রিয়জনের অপমৃত্যুর আশঙ্কা সম্বন্ধে এরা সম্পূর্ণ উদাসীন, সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা এদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি।
মীর আসলম কানে কানে বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন কাবুলের বড় বড় মহল্লার সর্দার আর বাচ্চার ভিতরে গোপনে বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে যে, কাবুলীরা যদি আমান উল্লার হয়ে না লড়ে, তবে বাচ্চা শহর লুট করবে না।
কথাগুলো যীশুখ্রীষ্টের করাঙ্গুলি হয়ে আমার অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দিল। মীর আসলমের খবর সত্য বলে ধরে নিলে কাবুলবাসীর নির্বিকল্প সমাধির চূড়ান্ত সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু হায়, অস্ত্রবলে হীন অর্থসামর্থ্যে দীন যে রাজা শুদ্ধ সাহসের বলে বিশ্বরাজ ইংরেজকে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলেন, অনুর্বর অনুন্নত দেশকে যে রাজা প্রগতিপথে চালিত করবার জন্য আপন সুখশান্তি বিসর্জন দিলেন, বিশ্বের সম্মুখে যে নরপতি আপন দেশের মুখোজ্জল করলেন তাকে বিসর্জন করে কাবুলের লোক বরণ করল ঘৃণ্য নীচ দস্যকে? একেই কি বলে কৃতজ্ঞতা, নিমকহালালি?
তবে কি আমান উল্লা কাফির?
মীর আসলম গর্জন করে বললেন, আলবৎ না; যে-রাজা প্রজার ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করেন না, নমাজ, রোজা যিনি বারণ করেননি, হজে যেতে জকাত দিতে যিনি বাধা দেননি, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মহাপাপ, তাঁর শত্রুর সঙ্গে যোগ দেওয়া তেমনি পাপ। পক্ষান্তরে বাচ্চায়ে সকাও খুনী ডাকাত ওয়াজিব-উল-কৎল, কতলের উপযুক্ত। সে কস্মিনকালেও আমীরউল-মুমিনীন (বাদশা) হতে পারে না।
মীর আসলম বহু শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত। আমার বিবেকবুদ্ধিও তাঁর কথায় সায় দিল। তবু বললুম, কিন্তু আপনি আবার কবে থেকে আমান উল্লার খায়ের খা হলেন?
মীর আসলম আরো জোর হুঙ্কার দিয়ে বললেন, আমি যা বলেছি, তা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। আমি বলি, আমান উল্লা কাফির নয়। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না-জায়িজ অশাস্ত্রীয়।
নাস্তিক রাশান রাজদূতাবাসে গিয়ে শুনি সেখানেও ঐ মত। দেমিফকে বললুম, রেভলিউশন আরম্ভ হয়েছে। তিনি বললেন, না, রেবেলিয়ন। আমি শুধালুম, তফাতটা কি? বললেন, রেভলিউশন প্রগতিকামী, রেবেলিয়ন প্রগতিপরিপন্থী।
ভাবলুম মীর আসলমকে এ-খবরটা দিলে তিনি খুশী হবেন। বুড়ো উল্টে গম্ভীর হয়ে বললেন, সমরকন্দ-বুখারার মুসলিমদের উচিত রুশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। রুশ সরকার তাদের মক্কায় হজ করতে যেতে দেয় না।
খামখেয়ালি ঘোটলাটের আশু আগমন সংবাদ শুনে যে রকম গাঁয়ের পণ্ডিত হতবুদ্ধি হয়ে যান, মৌলানা আর আমি সেই রকম একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাই। মৌলানার বউ যে-বড়লাটকে নিমন্ত্রণ করে বসে আছেন, তিনি কোন্ দিন কোন্ গাড়িতে কি কায়দায় আসবেন, তাঁকে কে অভ্যর্থনা করবেন, তিনি এলে তাকে কোথায় রাখতে হবে, কি খাওয়াতে পরাতে হবে, সে সম্বন্ধে কোনো প্রকারের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবার সুযোগ আমাদের কারো হয়নি–মৌলানার বউও কিছুই জানেন না; তার এই প্রথম বাচ্চা হচ্ছে।
শুনেছি আফগান মেয়েরা ক্ষেতের কাজ খানিকক্ষণের জন্য ক্ষান্ত দিয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে সন্তান প্রসব করে আসন্ন প্রসবার জন্য আফগান পণ্যবাহিনীও নাকি প্রতীক্ষা করে না। সে নাকি বাচ্চা কোলে করে একটু পা চালিয়ে পণ্যবাহিনীতে আবার যোগ দেয়। মৌলানার বউ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে; তার কাছ থেকে এরকম কসরৎ আশা করা অন্যায়। লক্ষণ দেখেও আমরা ঘাবড়ে গেলুম। কিছু খেতে পারেন না, রাত্তিরে ঘুম হয় না, সমস্ত দিন টুলটুল চোখ, মৌলানাকে এক মিনিটের তরে সেই ঢুলুঢুলু চোখের আড়াল হতে দেন না।
অন্যের প্রাণহরণ করা ব্যবসা হলেও নিজের প্রাণ দেবার বেলা সব মানুষের একই আচরণ। ডাক্তার কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরতে রাজী হয় না। সেদিন তাকে যা সাধ্যসাধনা করেছিলুম, তার অর্ধেক তোষামোদে কালো ভঙ্গজ মেয়ের জন্য বিনাপণে নিকষি নটবর বর মেলে। বাড়ি ফেরবার সময় সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে, মৌলানার যদি ছেলে হয়, তবে তাকে ডাক্তারি পড়াব শোনবৈরাগ্যের মত এ হল শোনপ্রতিজ্ঞা।
সিভিল সার্জন যে রকম গরীব রোগীর অর্থসামর্থ্যের প্রতি ক্ষেপ না করে আড়াই গজী প্রেসক্রিপশন্ ঝেড়ে যান, কাবুলী ডাক্তার তেমনি পথ্যির ফিরিস্তি আউড়ে গেলেন। শুনে ভয় পেয়ে মৌলানা আর আমি খাটের তলায় আশ্রয় নিলুম। চারদিন ধরে খাচ্ছি রুটি, দাল আর বিন-দুধ চা–এ দুর্দিনে স্বয়ং আমান উল্লা ওসব ফেন্সি পথ্যি যোগাড় করতে পারবেন না। দুধ! আঙুর!! ডিম!!! বলে কি? পাগল, না মাথা-খারাপ?
আবদুর রহমান সবিনয় নিবেদন করল, সন্ধ্যার সময় তাকে একটা রাইফেল আর দুঘণ্টার ছুটি দিলে সে চেষ্টা করে দেখতে রাজী আছে। ডাকাতিতে আমার মরাল অবজেকশন নেইযস্মিন দেশাচার, তদুপরি প্রবাসে নিয়ম নাস্তি–কিন্তু সব সময় সব ডাকাত তো আর বাড়ি ফেরে না। যদি আবদুর রহমান বাড়ি না ফেরে। তবে বাড়ি অচল হয়ে যাবে।
এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি বাচ্চায়ে সকাও যেন ডাক্তারের বেশ পরে তিস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে করে আমাকে বলছে, হয় দাও আঙুর, না হয় নেব মাথা।