চারদিনের দিন আবদুর রহমান তার দৈনিক বুলেটিনের এক বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে খবর জানালো, বাচ্চা মাইল দশেক হটে গিয়েছে। দিন দশেকের ভিতর শহরের ইস্কুল-কলেজ, আপিসআদালত খুলল।
আমান উল্লা দম ফেলবার ফুরসত পেলেন।
কিন্তু বাচ্চাকে তাড়াতে পেরেও তিনি ভিতরে ভিতরে হার মেনেছেন। দেরেশির আইন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, মেয়ে স্কুল বন্ধ করা হয়েছে আর রাস্তা-ঘাট থেকে ফ্রক-রাউজ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যে সব মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরন তারা পরেন সেই তাম্বু ধরনের বোরকা। হ্যাট পরার সাহস আর পুরুষস্ত্রীলোক কারো নেই–হয় পাগড়ি, নয় পশমের টুপি। যেসব স্কুলকলেজের ছাত্রেরা এই ডামাডোলের বাজারে পালিয়েছিল তাদের ধরে আনবার কোনো চেষ্টা করা হল না করার উপায়ও ছিল না কারণ পুলিশের দল তখনো ফেরার, আসামী ধরবে কে?
মৌলানা বললেন, সবশুদ্ধ মিলিয়ে দেখলে বলতে হবে ভালোই হয়েছে। আমান উল্লা যদি এ যাত্রা বেঁচে যান তবে বুঝতে পারবেন যে দেরেশি চাপানো, পর্দা তুলে দেওয়া আর বৃহস্পতিবারে ছুটির দিন করা এই অনুন্নত দেশের সব চেয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার নয়। বাকি রইল শিক্ষাবিস্তার আর শিল্পবাণিজ্যের প্রসার এবং এ দুটোর বিরুদ্ধে এখনো কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বিপদ কাটার পর আমান উল্লা যদি এই দুটো নিয়ে লেগে যান তবে আর সব আপনার থেকেই হয়ে যাবে।
মীর আসলম এসে বললেন, অবস্থা দেখে বিশেষ ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। শিনওয়ারীরা এখনো মারমুখো হয়ে আছে। আমান উল্লার সঙ্গে তাদের সন্ধির কথাবার্তা চলছে। তার ভিতরে দুটো শর্ত হচ্ছে, তুর্কী থেকে কাবুলী মেয়ে ফিরিয়ে আনা আর রানী সুরাইয়াকে তালাক দেওয়া। রানী নাকি বিদেশে পরপুরুষের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করে মান-ইজ্জৎ খুইয়ে এসেছেন।
আমরা বললুম, সে কি কথা? সমস্ত পৃথিবীর কোথাও তো রানী সুরাইয়া সম্বন্ধে এ রকম বদনাম রটেনি। ভারতবর্ষের লোক পর্দা মানে, তারা পর্যন্ত রানী সুরাইয়ার প্রশংসা ভিন্ন নিন্দা করেনি। শিনওয়ারীরা এ আজগুবি খবর পেলে কোথেকে আর রটাচ্ছে কোন লজ্জায়।
মীর আসলম বললেন, শিনওয়ারী মেয়েরা বিনা পর্দায় খেতের কাজ করে বটে কিন্তু পরপুরুষের দিকে আড়নয়নে তাকালেও তাদের কি অবস্থা হয় সে কথা সকলেই জানে— আমান উল্লাও জানেন। তবে বল দেখি, তিনি কোন্ বুদ্ধিতে সুরাইয়াকে বল নাচে নিয়ে গেলেন? জলালাবাদের মত জংলী শহরেও দু-একখানা বিদেশী খবরের কাগজ আসে— তাতে ছবি বেরিয়েছে রানী পরপুরুষের গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সমস্ত ব্যাপারটা যে কতদূর মারাত্মক আমান উল্লা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি তার মাপেরেছেন, তিনি আমান উল্লাকে পীড়াপীড়ি করছেন সুরাইয়াকে তালাক দেবার জন্য।
রানী-মার প্রতি আমার অগাধ ভক্তি। উল্লসিত হয়ে বললুম, রানী-মা ফের আসরে নেমেছেন? তাহলে আর ভাবনা নেই; শিনওয়ারী, খুগিয়ানী, বাচ্চা, কাচ্চা সবাইকে তিনি তিন দিনের ভিতর চাটনি বানিয়ে দেবেন।
মীর আসলম বললেন, কিন্তু আমান উল্লা তার উপদেশে কান দিচ্ছেন না।
শুনে অত্যন্ত নিরাশ হলুম। মীর আসলম যাবার সময় বললেন, তোমাকে একটা প্রাচীন ফার্সী প্রবাদ শিখিয়ে যাই। রাজ্য চালনা হচ্ছে, সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে জীবন কাটানো। ভেবে চিন্তেই বললুম, জীবন কাটানো–অর্থাৎ সে-সিংহের পিঠ থেকে এক মুহূর্তের জন্য নামবার উপায় নেই। যতক্ষণ উপরে আছ, সিংহ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু তোমাকেও অহরহ সজাগ থাকতে হবে। আমান উল্লা সন্ধির কথাবার্তা তুলেছেন, অর্থাৎ সিংহের পিঠ থেকে নেবে দুদণ্ড জিরোতে চান সেটি হবার জো নেই। শিনওয়ারী-সিংহ এইবার আমান উল্লাকে গিলে ফেলবে।
আমি চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে বললুম, কিন্তু আমার মনে হয় প্রবাদটার জন্মভূমি এদেশে নয়। ভারতবর্ষেই তখৎকে সিংহাসন বলা হয়। আফগানিস্থানে কি সিংহ জানোয়ারটা আছে?
এমন সময় আবদুর রহমান এসে খবর দিল পাশের বাড়ির কর্নেল এসেছেন দেখা করতে। যদিও প্রতিবেশী তবু তার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়নি। খাতির-যত্ন করে বসাতেই তিনি বললেন যে, লড়ায়ে যাবার পূর্বে আমাদের আশীর্বাদ মঙ্গলকামনা ভিক্ষা করতে এসেছেনঃ মীর আসলম তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া (আশীর্বাদ-কামনা) পড়তে আরম্ভ করলেন, আমরাও দুহাত তুলে আমেন, আমেন (তথাস্তু, তথাস্তু) বললুম। আবদুর রহমান তামাক নিয়ে এসেছিল, সেও মাটিতে বসে প্রার্থনায় যোগ দিল।
কর্নেল চলে গেলেন। মীর আসলম বললেন, পাড়া-প্রতিবেশীর আশীর্বাদ ও ক্ষমা ভিক্ষা করে যুদ্ধযাত্রা করা আফগানিস্থানের রেওয়াজ।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় বাচ্চা কাবুল শহরের উত্তর প্রান্তে শহর-রায় ঢুকতে পেরেছিল। সেখানে হবীবিয়া ইস্কুল। ডাকাত দলের অগ্রভাগ বাঙলা আগডোম বাগডোম ছড়ার তারাই অগ্রডোম বা ভ্যানগার্ড ইস্কুলের হস্টেলে প্রথম রাত কাটায়। বেশীর ভাগ ছেলেই ভয়ে পালিয়েছিল, শুধু বাচ্চার জন্মস্থান কুহিন্তানের ছেলেরা দেশের ভাই, শুকুর মুহম্মদের প্রতীক্ষায় আগুন জ্বেলে তৈরী হয়ে বসেছিল। ডাকাতরা হস্টেলের চালচর্বি দিয়ে পোলাও রাধে, ইস্কুলের বেঞ্চিটেবিল, স্টাইনগাস ভলাস্টনের মোটা মোটা অভিধান, ছেলেদের ক্লাসের পাঠ্য বই খাতাপত্র দিয়ে উনুন জ্বালায়। তবে সব চেয়ে তারা নাকি পছন্দ করেছিল ক্যাম্বিস আর কাঠের তৈরী রোল করা মানচিত্র।
আমান উল্লা কাফিরপুথিপত্র কাফিরী, চেয়ার টেবিল কাফিরীর সরঞ্জাম–এসব পুড়িয়ে নাকি তাদের পুণ্যসঞ্চয় হয়েছিল।
ডাকাতেরও ধর্মজ্ঞান আছে। হস্টেলের ছেলেরা যদিও কাফির আমান উল্লার তালিম পেয়ে কাফির হয়ে গিয়েছে তবু তারা তাদের অভুক্ত রাখেনি। শুধু খাওয়ার সময় একটু অতিরিক্ত উৎসাহের চোটে তাদের পিঠে দুচারটে লাথি চাটি মেরেছিল। বাচ্চার দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নে নাকি হস্টেল-বাসিন্দা ছিল; সে মামার হয়ে ফপরদালালি করেছে; তবে বাচ্চার পলায়নের সময় অবস্থাটা বিবেচনা করে কাফিরী তালিম, ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়ে গাজীত্ব লাভ করেছে।
বাড়ি ফেরার সময় দেখলুম ঘোট ঘোট ছেলেরা রাস্তা থেকে বুলেটের খোসা কুড়োচ্ছ।
খবর পেলুম, ব্রিটিশ রাজদূত স্যার ফ্রান্সিস হামফ্রিসের মতে কাবুল আর বিদেশীদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই তিনি আমান উল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের এদেশ থেকে সরিয়ে ফেলবার বন্দোবস্ত করেছেন। আমান উল্লা সহজেই সম্মতি দিয়েছেন, কারণ তিনিও চাননি যে, বিদেশীরা আফগানিস্থানের এই ঘরোয়া ব্যাপারে অনর্থক প্রাণ দেয়। কাবুল বাকি পৃথিবী থেকে তখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলে অ্যারোপ্লেনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
অ্যারোপ্লেন এল। প্রথম মেয়েদের পালা। ফরাসী গেল, জর্মন গেল, ইতালিয় গেল, পোল গেল এককথায় দুনিয়ার অনেক জাতের অনেক স্ত্রীলোক গেল, শুধু ভারতীয় মেয়েদের কথা কেউ শুধালো না। অ্যারোপ্লেনগুলো ভারতীয় অর্থে কেনা, পাইলটরা ভারতীয় তনখা খায়। অথচ সব চেয়ে বিপদাপন্ন ভারতীয় মেয়েরাই অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা আপন আপন লিগেশনের আশ্রয়ে ছিল, কিন্তু ভারতীয়দের দেখে কে? প্রফেসর, দোকানদার, ড্রাইভারের বউকে ব্রিটিশ লিগেশনে স্থান দিলে স্যার ফ্রান্সিস বিদেশী সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে? বামুনের জাত গেলে প্রায়শ্চিত্ত আছে, আর মুসলমানের তো জাত যায় না। কিন্তু ইংরেজের জাতিভেদ বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। তার দেশে যেরকম কাগজে কলমে লেখা, আইনে বাঁধা কন্সটিটুশন নেই ঠিক তেমনি তার জাতিভেদপ্রথা কোনো বাইবেল-প্রেয়ারবুকে আপ্তবাক্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। অথচ সে জাতিভেদ রবীন্দ্রনাথের ভূতের কানমলার মত সে কানমলা না যায় ছাড়ান, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার। দর্শন, অঙ্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হোন, মার্কসিজমের দ্বিগ্বিজয়ী কৌটিল্যই হোন, অথবা কয়লার খনির মজুরই হোন, এই কানমলা স্বীকার করে করে হৌস অব লর্ডসে না পৌঁছানো পর্যন্ত দর্শন মিথ্যা, মার্কসিজম ভুল, শ্রমিকসঙ্ঘের দেওয়া সম্মান ভণ্ডুল। যে এই কানমলা স্বীকার করে না ইংরেজের কাছে সে আধপাগল। তার নাম বার্নাড শ।
বাড়াবাড়ি করছি? মোটেই না। ধান ভানতে শিবের গীত? তাও নয়। বিপ্লব-বিদ্রোহ রক্তপাত-রাহাজানি মাত্রই রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্য–এতক্ষণ সে কথাই হচ্ছিল, এখন তার নন্দীভৃঙ্গী-সম্বাদের পালা।
ইংরেজের এই আভিজাত্য, এই স্নবারি ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে ব্রিটিশ রাজদূতের মনোবৃত্তির যুক্তিযুক্ত অর্থ করা যায় না। ব্রিটিশ লিগেশনের যা আকার তাতে কাবুলের বাদবাকি সব কটা রাজদূতাবাস অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। একখানা ছোটখাট শহর বললেও অত্যুক্তি হয় না নিজের জলের কল, ইলেকটিক পাওয়ার-হৌস, এমন কি ফায়ার-ব্রিগেড পর্যন্ত মৌজুদ। শীতকালে সায়েব-সুবোদের খেলাধুলোর জন্য চা-বাগানের পাতাশুকোবার ঘরের মত যে প্রকাণ্ড বাড়ি থাকে তারই ভিতরে সমস্ত ভারতীয় আশ্রয়প্রার্থীনীর জায়গা হতে পারত। আহারাদি? ব্রিটিশ লিগেশন কাবুল থেকে পালিয়ে আসার সময় যে টিনের খাদ্য ফেলে এসেছিল তাই দিয়ে মেয়েদের পাকা ছমাস চলতে পারত।
ফ্রেঞ্চ লিগেশনের যে মিনিস্টারকে বেনওয়া সায়েব রসিকতা করে সিনিস্টার অব দি ফ্রেঞ্চ নিগেশন বলতেন তিনি পর্যন্ত আশ্রয়প্রার্থী ফরাসীদের মন চাঙ্গা করার জন্য ভাণ্ডার উজাড় করে শ্যাম্পেন খাইয়েছিলেন।
ডাক্তার আসে না, অন্ন জুটছে না, পথ্যের অভাব, দাই নেই, আসন্নপ্রসবার আশ্রয় জুটছে না; তাকে ফেলে রেখে ভারতীয় পয়সায় কেনা হাওয়াই জাহাজ ভারতবর্ষে যাচ্ছে ইংরেজ, ফরাসী, জর্মন, সকল জাতের মেম সায়েবদের নিয়ে! হে দ্রৌপদীশরণ, চক্ৰধারণ, এ দ্রৌপদী যে অন্তঃসত্ত্বা।
উত্তরদিকে থেকে কাবুল শহর আক্রমণ করতে হলে ব্রিটিশ রাজদূতাবাস অতিক্রম করে আরো এক মাইল ফঁকা জায়গা পেরতে হয়। বাচ্চা তাই করে শহর-আরা হস্টেলে পৌঁচেছিল। সুবে আফগানিস্থান জানে সে সময় পাকা চারদিন ব্রিটিশ রাজদূতাবাস তথা মহামান্য স্যার ফ্রান্সিসের জীবন বাচ্চার হাতের তেলোয় পুটি মাছের মত এক গণ্ডুষ জলে খাবি খাচ্ছিল। বাচ্চা ইচ্ছে করলেই যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত লিগেশনকে কচুকাটা করতে পারত— একটু ঔদাসীন্য দেখালেই তার উদগ্রীব সঙ্গীরা সবাইকে কতল করে বাদশাহী লুট পেত, কিন্তু জলকরবাহীর তস্করপুত্র অভিজাততনয়ের প্রাণ দান করল। তবু দ্যদত্ত করুণাল সে-প্রাণ বিপন্ন নারীর দুঃখে বিগলিত হল না।।
গল্প শুনেছি, জর্জ ওয়াশিংটন তার নাতিকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। পথে এক নিগ্রো হ্যাট তুলে দুজনকে নমস্কার করল। ওয়াশিংটন হ্যাট তুলে প্রতিনমস্কার করলেন, কিন্তু নাতি নিগ্রোকে তাচ্ছিল্য করে নমস্কার গ্রহণ করল না। জর্জ ওয়াশিংটন নাতিকে বললেন, নগণ্য নিগ্রো তোমাকে ভদ্রতায় হার মানালো।
দয়া দাক্ষিণ্যে, করুণা ধর্মে মহামান্য সম্রাটের অতিমান্য প্রতিভূ হিজ একসেলেন্সি লেফটেনেন্ট কর্নেল স্যার ফ্রান্সিসকে হার মানালো ডাকুর বাচ্চা!
চিরকুট পেলুম, দেমিদফ লিখেছেন রাশান এম্বেসিতে যেতে। এ রকম চিঠি আর কখনো পাইনি, কারণ কোন কিছুর দরকার হলে তিনি নিজেই আমার বাড়িতে উপস্থিত হতেন।
চেহারা দেখেই বুঝলুম কিছু একটা হয়েছে। দোরের গোড়াতেই বললুম, কি হয়েছে, বলুন। দেমিদফ কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে ঘরে এনে বসালেন। মুখোমুখি হয়ে বসে দুহাত দুজানুর উপর রেখে সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলশফ মারা গিয়েছেন।
আমি বললুম, কি?
দেমিদফ বললেন, আপনি জানতেন যে, বিদ্রোহ আরম্ভ হতেই বলশফ নিজের থেকে আমান উল্লার কাছে উপস্থিত হয়ে বাচ্চায়ে সকাওয়ের দলের উপর অ্যারোপ্লেন থেকে বোমা ফেলার প্রস্তাব করেন। কাল বিকেলে–
আমি ভাবছি, বলশফ কিছুতেই মরতে পারে না, অবিশ্বাস্য।
–কাল বিকেলে অন্য দিনের মত বোমা ফেলে এসে এম্বেসির ক্লাব ঘরে দাবা খেলতে বসেছিলেন। ব্রিচেসের পকেটে ছোট্ট একটি পিস্তল ছিল; বাঁ হাত দিয়ে ঘুটি চালাচ্ছিলেন, ডান হাত পকেটে রেখে পিস্তলের ঘোড়াটা নিয়ে খেলা করছিলেন, জানেন তো, বলশফের স্বভাব, কিছু একটা নাড়াচাড়া না করে বসতে পারতেন না। হঠাৎ টি গারে একটু বেশী চাপ পড়াতেই গুলী পেটের ভিতর দিয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছ পর্যন্ত চলে যায়। ঘণ্টা ছয়েক বেঁচে ছিলেন, ডাক্তার কিছু করতে পারলেন না।
আমার তখনও কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না বলশফের মত বটগাছ কি করে বিনা ঝড়ে পড়ে যেতে পারে। এত লড়াই লড়ে, এত জখম কাটিয়ে উঠে শেষে নিজের হাতে?
দেমিদফ বললেন, আপনার খুব লাগবে আমি জানতুম তাই সংক্ষেপে বললুম; আর যদি কিছু জানতে চান–? আমি বললুম, না।
চলুন, দেখতে যাবেন।
আমি বললুম, না। বাড়ি যাবার জন্য উঠলুম। মাদাম তাড়াতাড়ি আমার সামনে পথ বন্ধ করে বললেন, এখানে খেয়ে যান।
আমি বললুম, না।
টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে বেরবার সময় হঠাৎ যেন শুনতে পেলুম বলশফের গলা, জাসভুইয়িতে, মই প্রিয়াতেল–এই যে বন্ধু, কি রকম? চমকে উঠলুম। আমার মন তখনো বিশ্বাস করছে না, বলশফ নেই। এই টেনিস কোর্টেই তার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল আর এই যে দেউড়ি দিয়ে বেরচ্ছি এরই ভিতর দিয়ে কতবার তার সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি।
বাড়ি এসে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার অজানাতে মন সমস্ত রাত বলশফের কথা ভেবেছে। ঘুম ভাঙতে যেন শুধু সচেতন হলুম। মনে পড়ল তার সঙ্গে শেষ কথাবার্তা। ঠাট্টা করে বলেছিলুম, বলশফ তুমি আমান উল্লার হয়ে লড়ছ কেন? আমান উল্লা রাজা, বাচ্চার দল প্রলেতারিয়েস্ট অব দি প্রলেতারিয়া। তোমার উচিত বাচ্চার দলে যোগ দিয়ে লড়া। বলশফ বলেছিল, বাচ্চা কি করে প্রলেতারিয়া হল? সেও তো রাজার মুকুট পরে এসেছে। রাজায় রাজায় লড়াই। এক রাজা প্রগতিপন্থী, আরেক রাজা প্রগতির শত্রু। চিরকাল প্রগতির জন্য লড়েছি, এখনো লড়ছি, তা সে এৎস্কির নেতৃত্বেই হোক আর আমান উল্লার আদেশেই হোক।
আমান উল্লার সেই চরম দুর্দিনে সব বিদেশীর মধ্যে একমাত্র বলশফের কর্তৃত্বে রাশান পাইলটরাই তাকে সাহায্য করেছিল। বাচ্চা জিতলে তাদের কি অবস্থা হবে সে সম্বন্ধে একদম পরোয়া না করে।
দিন পনরো পরে খবর পেলুম, অ্যারোপ্লেন কাবুল থেকে বিদেশী সব স্ত্রীলোক কাচ্চা-বাচ্চা ঝেঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছে; বিদেশী বলতে এখন বাকি শুধু ভারতীয়। তিন লক্ষে ব্রিটিশ লিগেশনে উপস্থিত হয়ে মৌলানার বউয়ের কথাটা সকাতর সবিনয় নিবেদন করলুম। ব্রিটিশের দয়া অসীম। ভারতবাসিনী-লাদাই উড়ো-জাহাজের প্রথম ক্ষেপেই তিনি স্থান পেলেন। পুনরপি তিন লক্ষ্যে বাড়ি পৌঁছে আঙিনা থেকেই চিৎকার করে বললুম, মৌলানা, কেল্লা ফতেহ, সীট পেয়ে গিয়েছি। বউকে বলো তৈরী হতে। এখন ওজন করাতে নিয়ে যেতে হবে, কর্তারা ওজন জানতে চান।
মৌলানা নিরুত্তর। আমি অবাক। শেষটায় বললেন যে, তাঁর বউ নাকি একা যেতে রাজী নন, বলছেন, মরবার হলে এদেশে স্বামীর সঙ্গেই মরবেন। আমি শুধালুম, তুমি কি বলছ? মৌলানা নিরুত্তর। আমি বললুম, দেখ মৌলানা, তুমি পাঞ্জাবী, কিন্তু শান্তিনিকেতনে থেকে থেকে আর গুরুদেবের মোলায়েম গান গেয়ে গেয়ে তুমি বাঙালীর মত মোলায়েম হয়ে গিয়েছ। বাধি যে রাখি-টাখি এখন বাদ দাও। মৌলানা তবু নিরুত্তর। চটে গিয়ে বললুম, তুমি হিন্দু হয়ে গিয়েছ, তাও আবার ১৮১০ সালের সতীদাহে বিশ্বাস করে। কিন্তু জানো, যে গুরুদেবের নাম শুনে অজ্ঞান হও, তাঁরই ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঠাকুর টাকা দিয়ে সতীদাহের বিরুদ্ধে বিলেতে মোকদ্দমা লড়িয়েছিলেন। মৌলানা নিরুত্তর। এবারে বললুম, শোনো ব্রাদার, এখন ঠাট্টামস্করার সময় নয়, কিন্তু ভেবে দেখো, তোমার বউয়ের কবে বাচ্চা হবে, তার হিসেব-টিসেব রাখোনি না হয় বদ্যি পেলুম, ধাই পেলুম, কিন্তু যদি বাচ্চা হওয়ার পর তোমার বউয়ের বার তিনেক গলা খাঁকারি দিয়ে বললুম–তাহলে আমি দুধ যোগাড় করব কোথা থেকে? বাজারে ফের কবে দুধ উঠবে, তার তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
মৌলানা বউয়ের কাছে গেলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অল্প অল্প কান্নার শব্দ শুনতে পেলুম। মৌলানা বেরিয়ে এসে বললেন, রাজী হচ্ছেন না।
তখন মৌলানাকে বাইরে রেখে ভিতরে গেলুম। বললুম, আপনি যে মৌলানাকে ছেড়ে যেতে চাইছেন না, তার কারণ যে আমি বুঝতে পারছিনে তা নয়; কিন্তু ভেবে দেখুন তো, আপনার
যাওয়াতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনি যদি চলে যান, তবে তিনি যেখানে খুশী কোনো ভাল জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারবেন। শুধু তাই নয়, অবস্থা যদি আরো খারাপ হয়, তবে হয়ত তাঁকেও এদেশ ছাড়তে হবে। আপনি না থাকলে তখন তার পক্ষে সব কিছুই অনেক সহজ হয়ে যাবে। এসব কথা তিনি আপনাকে কিছুই বলেননি, কারণ এখন তিনি নিজের কথা আদপেই ভাবছেন না, ভাবছেন শুধু আপনার মঙ্গলের কথা। আপনি তার স্ত্রী, আপনার কি এদিকে খেয়াল করা উচিত নয়?
ওকালতি করছি আর ভাবছি মৌলানার যদি ছেলে হয়, তবে তাকে ব্যারিস্টারি পড়াব। মেয়ে হলে আমান উল্লার মায়ের হাতে সঁপে দেব।।
ওষুধ ধরল। ভারত নারীর শ্মশানচিকিৎসা স্বামীর স্বার্থের দোহাই পাড়া।
পরদিন সকাল বেলা মৌলানা বউকে নিয়ে অ্যারোডড্রামে গেলেন। বিপদ-আপদ হলে আবদুর রহমানের কাঁধ কাজে লাগবে বলে সেও সঙ্গে গেল। আমি রইলুম বাড়ি পাহারা দিতে। দিন পরিষ্কার ছিল বলে ছাতে দাঁড়িয়ে দেখলুম, পুব থেকে প্রকাণ্ড ভিকা বমার এল, নামল, ফের পুব দিকে চলে গেল। মাটিতে আধ ঘণ্টার বেশী দাঁড়ায়নি কাবুল নিরাপদ স্থান নয়।
জিয়াউদ্দীন ফিরে এসে মুখ ঝামর করে উপরে চলে গেলেন। আবদুর রহমান বলল, মৌলানা সাহেবের বিবির জামা-কাপড় দেখে পাইলট বলল যে, অ্যারোপ্লেন যখন আসমানে অনেক উপরে উঠবে, তখন ঠাণ্ডায় তার পা জমে যাবে। তাই বোধ হয় তারা সঙ্গে খড় এনেছিল— মৌলানা সাহেব সেই খড় দিয়ে তাঁর বিবির দুপা বেশ করে পেঁচিয়ে দিলেন। দেখে মনে হল যেন খড়ে জড়ানো বিলিতী সিরকার বোতল। সব মেয়েদেরই পা এরকম কায়দায় সফর-দুরুস্ত করতে হল।
আমরা দেউড়িতে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলুম। এমন সময় আমাদের সামনে দিয়ে একটা মড়া নিয়ে কয়েকজন লোক চলে যাচ্ছে দেখে আবদুর রহমান হঠাৎ কথাবার্তা বন্ধ করে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। ভারবাহীরা আমার প্রতিবেশী কর্নেলের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আবদুর রহমান কড়া নাড়ল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ, আর্ত ক্রন্দনধ্বনি যেন তীরের মত বাতাস ছিঁড়ে আমার কানে এসে পৌঁছল— মড়া দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢাকাতে যতক্ষণ সময় লাগল, ততক্ষণ গলার পর গলা সে আর্তনাদে যোগ দিতে লাগল। চিৎকারে চিৎকারে মানুষের বেদনা যেন সপ্তম স্বর্গে ভগবানের পায়ের কাছে পৌঁছতে চাইছে।
কান্না যেন হঠাৎ কেউ গলা টিপে বন্ধ করে দিল— মড়া বাড়িতে ঢোকানো হয়েছে, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই নিস্তব্ধতা তখন যেন আমাকে কান্নার চেয়ে আরো বেশী অভিভূত করে ফেলল। আমি ছুটে গিয়ে মৌলানার ঘরে ঢুকলুম। আবদুর রহমান এসে খবর দিল, কর্নেল লড়াইয়ে মারা গিয়েছেন।
মৌলানা দুহাত তুলে দোয়া পড়তে আরম্ভ করলেন। আবদুর রহমান আর আমি যোগ দিলুম। দোয়া শেষে মৌলানা বললেন, লড়াইয়ে যাওয়ার আগে কর্নেল আমাদের দোয়া মাঙতে এসে ছিলেন, আমাদের উপর এখন তার হক আছে। তারপর মৌলানা ওজু করে কুরান শরীফ পড়তে আরম্ভ করলেন।
দুপুরবেলা মৌলানার ঘরে গিয়ে দেখি, কুরান পড়ে পড়ে তার চেহারা অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছে। আসন্নপ্রসবা স্ত্রীর বিরহ ও তার সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা মন থেকে কেটে গিয়েছে।
কর্নেলের প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা জাগল। কোনো কোনো মানুষ মরে গিয়েও অন্যের মনে শান্তির উপলক্ষ্য হয়ে যান।
কিন্তু আমার মনে খেদও জেগে রইল। যে-মানুষটিকে পাঁচ মিনিটের জন্য চিনেছিলুম তাঁর মৃত্যুতে মনে হল যেন একটি শিশু-সন্তান অকালে মারা গেল। আমাদের পরিচয় তার পরিপূর্ণতা পেল না।