২৫. দূরত্ব

দূরত্ব

ছিয়াশি সালের শেষদিকে ঘটনাটি ঘটে। দেড়মাস পর ফিরবে বলে রুদ্র মোংলায় চিংড়ির ব্যবসা দেখতে গেলে যেহেতু আমার কিছু করার নেই ঢাকায়, ময়মনসিংহে চলে যাই। ময়মনসিংহ থেকে দেড়মাস পর ফিরে দেখি রুদ্র ফেরেনি এখনও। কবে ফিরবে জানতে চাইলে মেরি বলে আরও দুসপ্তাহ দেরি হবে। রুদ্রহীন ঘরটিতে একলা বসে থাকি, ঘরটি খুব খালি খালি লাগে। টেবিলে কবিতার খাতা পড়ে আছে, যেন লিখছিল, এই মাত্র উঠে সে অন্য ঘরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আবার লিখবে কবিতা। আমি চোখ বুজে অন্য ঘর থেকে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষা করি মনে মনে। মনে মনে তার একটি হাত রাখি আমার কাঁধে, শুনি একটি খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কখন এলে? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার! কাঁধের হাতটি ক্রমশ নেমে আসছে বুকে, আরেকটি কাঁধেও আরেকটি উষ্ণ হাত, সেই হাতটিও নেমে আসছে। গা শিথিল হয়ে আসছে আমার, আমার গালে তার দাড়ি- গাল ঘসতে ঘসতে বলছে, সোনা আমার মানিক আমার, বউ আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচি না রে! আমার তৃষ্ণাতর্ ঠোঁট জোড়া সিক্ত হতে চাইছে, ঠোঁটে তার দীর্ঘ দীর্ঘ উষ্ণ সিক্ত চুম্বন। অভূত এক শিহরণ আমার গা কাপাঁচ্ছে। মাথাটি এলিয়ে পড়ে টেবিলের খাতায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পাওয়ায় না পাওয়ায় চণূর্ হই। খাতাটির শেষ পাতায় লিখি, আমার ভাল লাগছে না, ভাল লাগছে না। কেন আসোনি তুমি। বউ ছেড়ে এত দীর্ঘদিন কি করে থাকো তুমি। বড় একা লাগে আমার। তুমিহীন একটি মুহূতর্ও আমার কাছে অসহ্য। আমার আপন কেউ নেই এক তুমি ছাড়া। আমার জীবন কাটে না তুমি ছাড়া। হয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয় তুমি আমার কাছে চলে এসো। গোছানো বিছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকি এক শরীর তৃষ্ণা নিয়ে। একটি বেদনার্ত হাত এগিয়ে যায় বিছানার চাদরে রুদ্রর ফেলে যাওয়া স্পর্শ পেতে, বুলোতে থাকে চাদর। ফেলে যাওয়া ঘ্রাণ পেতে বালিশে মুখ চেপে তার ছিঁটেফোঁটা শুঁকতে শুঁকতে বলি, কবে আসবে তুমি, আমার আর ভাল লাগে না একা থাকতে। তুমি ফিরে এসো প্রাণ। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো। আমার সর্বসুখ তুমি ফিরে এসো। বালিশ ভিজে যায় শব্দহীন কান্নায়। সচকিত হই বাড়ির মানুষদের সম্ভাব্য কোতূহলের কথা ভেবে, দুহাতে চোখ মুছে, মেরিকে ডেকে, আমি না হয় দুসপ্তাহ পর ফিরব, বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে ও বলে, এক্ষুনি যাচ্ছ বৌদি? বসো, চা খেয়ে যাও। শুষ্ক-হাসি ঠোঁটে, বলি, না চায়ের তৃষ্ণা নেই।

রাজাবাজারের মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি। রুদ্রহীন ঢাকা শহর আমার কাছে ধু ধু মরুর মত লাগে। মহাখালি থেকে হঠাৎ ধুত্তরি বলে রিক্সা ঘুরিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাই। ভাল লাগে না ময়মনসিংহ যেতে। অবকাশে আমি অনাকাঙ্খিত অতিথি। মা প্রায়ই বলেন, বাপ মার অমতে বিয়া করছস। খুব সুখে না থাকবি কইছিলি! এখন এত বাপের বাড়ি আসতে হয় কেন? বাবার চোখের সামনে পড়লে কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন, মাকে ডেকে বলেন, ওই ছেড়ি আমার বাসায় আইছে কেন? ওরে বাসা থেইকা ভাগাও। আমার বাসায় আসার ওর কি অধিকার আছে? আমি কি কামাই করি আরেক বেডার বউরে খাওয়ানির জন্য নাকি? ওরে খাওন দিবা না। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতে উদাস বসে রুদ্রকে ভাবি, দিন রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বেচারা। নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। নিশ্চয়ই বউটির কথা মনে করে যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে আসতে চাইছে। পারছে না বলে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিই আঁচলে। আমার এই মগ্নতায় টোকা দিয়ে গীতা বলে, কি রে, কি ভাবস? তর জামাই কই? তারে লইয়া আইলি না কেন?

আমার বুঝি একলা আসা মানা? সবসময় জামাই লইয়া আইতে হইব?

কি, রাগারাগি হইছে নাকি!

নাহ! রাগারাগি হইব কেন!

তাই তো মনে হইতাছে। জামাই আছে ঢাকায়?

নাহ।

গীতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। টুলুর ঠোঁটেও হাসি। এ বাড়িতে গীতার ছোট ভাই টুলু থাকে। কালো-ছেলে মোটা-ছেলে, নাকের-নিচে-শুঁয়োপোকা-মোচ- ছেলে টুলুকে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি দিয়ে ঢাকায় এনে ছোটদা নিজের বাড়িতে রাখছেন। বাঁকা হাসিটি নিয়েই টুলু হাঁক দেয় এক গেলাস জল দে তো নার্গিস। নার্গিস গেলাসে পানি নিয়ে টুলুর হাতে দেয়। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয় একটি মুহূতর্। চোখ সরিয়ে নেয় ও। কেন সরালো চোখ ও! ওর চোখে কি একটি তিরতির ভয় কাপঁ ছিল। পরমার কাজকর্ম করার জন্য অবকাশ থেকে ওকে এনেছে গীতা, পরমার কাজ তো আছেই, বাড়ির আর সব কাজ একাই ও করছে। পরমাকে কোলে নিয়ে বসে ভাবছিলাম নিজের একটি সন্তানের কথা, কোনও একদিন সন্তানের মা হব আমি, রুদ্র নিশ্চয়ই তখন নিজের বাচ্চা রেখে এমন দূরে দূরে পড়ে থাকবে না। ভাবনাটি ছিন্ন করে নার্গিসের উসকোখুসকো চুল, আধোয়া ছেঁড়া মলিন জামা, শুকনো মুখ ।

বিকেল ফুরোতে থাকে, খেয়ে ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পরমাকে আবার কোলে নিয়ে বসেছি সোফায়, নার্গিস বালতির পানিতে ত্যানা ডুবিয়ে জল চিপে ঘর মুছছে। এখনও সে গোসল করেনি, খায়নি। গীতা ভাত খেতে বললে তবে সে খাবে।

কি রে নার্গিস, আছস কেমন?

আপা, ময়মনসিং থেইকা আইছেন কবে? চাপা স্বরে নার্গিস জিজ্ঞেস করে।

আজকেই আইছি।

কবে যাইবেন?

জানিনা। তুই যাইবি ময়মনসিং?

হ।

নার্গিস চকিতে উঠে দাঁড়ায় উত্তেজনায়। গীতা ঘরে ঢুকতেই ও ত্রস্ত উবু হয় ত্যানায়। কি হইতাছে? গীতা প্রশ্ন চোখে নার্গিসের দিকে তাকায়।

ও তো এখনও খায় নাই! ওর তো খাওয়া দরকার! মিনমিন করি। চেঁচায় গীতা, সব কাজ শেষ হইলে পরে খাইব।

আমি নরম স্বরে বলি, ওর কি কোনও ভাল জামা টামা নাই নাকি? গোসল করে নাই কতদিন কে জানে!

এ কথা শুনেই গীতা ওর উবু হওয়া শরীরে একটি লাথি কষিয়ে বলে, বাথরুম মুইছা দেস নাই কেন? ও গোসলখানার মেঝে মুছে এসেছিল, টুলু গিয়ে ভিজিয়েছে আবার। এ কথা নার্গিস বলে না, বলি আমি। আমার এই নাক গলানোয় সে নার্গিসের চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে খাবার ঘরের মেঝেয় ওকে ফেলে শক্ত শক্ত লাথি মারতে থাকে বুকে মুখে। ঘর থেকে হেলে দুলে বেরিয়ে এসে টুলু বলে, দে এইডারে আরো দে, ছেড়িডা বড় শয়তান। আমি দৌড়ে গিয়ে নার্গিসকে গীতার লাথির তল থেকে টেনে সরিয়ে নিই।

গীতা আমার কোল থেকে পরমাকে ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচাতে থাকে, আমার বাড়িতে থাকস, আমার খাস, আবার আমার নামে মানুষের কাছে বিচার দেস? কারও কি ক্ষমতা আছে আমার বিচার করার?

নার্গিসের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, ও আমার কাছে বিচার দেয় নাই। আমিই কইছি।

যেই না বলেছি, পরমাকে টুলুর কোলে দিয়ে গীতা নার্গিসকে টেনে নিয়ে জানালার শিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চুলের মুঠি ধরে ওই শিকেই বার বার মাথা ঠোকাতে থাকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিই, চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে এমুহূর্তে নার্গিসকে নিয়ে বেরিয়ে যাই, পারি না। ইচ্ছে করে ঠেলে সরিয়ে দিই গীতাকে, পারি না। এ বাড়ি আমার নয়, গীতার। তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হবে নার্গিসকে। জঘন্য দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আমার আর ইচ্ছে করে না বাড়িটিতে দুদণ্ড থাকার। আমার সকল অক্ষমতা নিয়ে আমি বেরোই।

বাসে ময়মনসিংহ যেতে যেতে দেখি তিনটে ট্রাক রাস্তার কিনারে উল্টো পড়ে আছে। দুটো বাস খাদে। বাসদুটোর পাশে দশ বারোটি মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। মনে হয় এ বাসটিও বুঝি খাদে পড়বে। এভাবে আমিও হয়ত আজ মরে পড়ে থাকব রাস্তার পাশে। কেউ জানবে না কি আমার নাম, কোথায় আমার বাড়ি। অজ্ঞাত পরিচয় মেয়েকে কোনও এক গণকবরে শুইয়ে দেওয়া হবে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কেউ জানে না আমি আজ বাসে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছি। ঢাকা-ময়মনসিংহ বাসের দুর্ঘটনার খবর তারা জানলেও কেউ জানবে না দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়েছে। ভাবতে ভাবতে হাত ব্যাগ থেকে ছোট একটি কাগজ বের করে নিজের নাম ঠিকানা লিখে কাগজটি ব্যাগে ভরে, নতুন একটি ভাবনার শিকার হই, কি লাভ মৃতদেহের সৎকারে! মরে গেলে কি আর আমি বুঝবো আমার সৎকার মহা আড়ম্বরে করে হচ্ছে কি হচ্ছে না! হলেই বা আমার কি লাভ! গ্রামে পড়ে থাকা আমার লাশটি যদি শেয়াল শকুনে খায়, অথবা যদি সিল্কের কাফনের কাপড়ে আর আতর লোবানের ঘ্রাণে মুড়ে আমাকে ভাল একটি কবরে রাখা হয়, যদি শ্বেত পাথরে বাঁধিয়ে দেওয়া হয় কবর—কি পার্থক্য দুটিতে! মৃত্যুর পর আমার তো বোঝার শক্তি থাকবে না আমাকে কেউ ভালবাসছে কি বাসছে না। তখন যত্ন আত্তি পেলেই কি না পেলেই কি! মা বলেন, কবরে রেখে আসার ঠিক চারদিন পরই নাকি মানুষ ভুলে যায়, যত বড় স্বজন বা বন্ধু হোক সে। ভাবনাটি পাশে বসে থাকে, আমি ব্যাগ থেকে কাগজটি নিয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিই জানালার ওপাশের হাওয়ায়। সন্ধের অন্ধকারের ছেঁড়া কাগজের টুকরো গুলো হারিয়ে যেতে থাকে।

 

অবকাশ সেই আগের মত আছে। বেঁচে আছে। মা সুহৃদকে পরম আদরে মানুষ করছেন। নিজের রক্ত-যাওয়া-অসুখ টির কোনও চিকিৎসা নেই জানার পর তিনি আর অভিযোগও করেন না এ নিয়ে। এমএড পাশ করার পর বাবার আদেশে শহরের ভাল ইশকুলগুলোয় শিক্ষিকা হওয়ার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেছে হাসিনা। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগে পাশ করা হাসিনার পক্ষে বিএড এমএড ডিগ্রি নিয়েও চাকরি জোটেনা ভাল। কিন্তু বাবা লেগে থাকেন নতুন নতুন ইশকুলের খোঁজ করতে। স্বজন খুঁজতে থাকেন প্রীতি পেতে। ইয়াসমিনের উদ্ভিদবিদ্যায় মন নেই। মন প্রাণীবিদ্যায়। কলেজের নানারকম বান্ধবী-প্রাণী নিয়ে তার সময় কাটে। দাদা আরোগ্য বিতানে ওষধু ব্যবসায় যতটুকু মন দেন, তার চেয়ে বেশি দেন চিঠি লেখায়। প্রতি সপ্তাহে বত্রিশ পৃষ্ঠা লম্বা চিঠি লেখেন শীলাকে। প্রেমের চিঠি। ঘরে ফিরে তিনি মুমু মুমু বলে কাছে ডাকেন হাসিনাকে। তার সদারাগ মুখে হাসি ফোটাতে প্রায়ই সোনার গয়না আর দামি শাড়ি কিনে আনেন। হাসিনার মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ কাজ।

আমার নাম হাসিনা সস্তা আমার হাসি না প্রতিদিনই বস্তা বস্তা অভিযোগ নিয়ে বসে দাদার সামনে। দাদা দুপুরে ফেরার পর বলে সে, মাকে নাকি সে বলেছিল আলু দিয়ে মুরগির মাংস রাঁধতে, মা পটল দিয়ে রেঁধেছেন। তার যেভাবে ইচ্ছে করে সেভাবে যদি তার খাওয়া দাওয়া না হয়, তবে তার আর স্বামীর সংসার করার ইচ্ছে নেই। এ কথা শুনেই দাদা দৌড়ে ঘরবার হয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে লিলির মাকে ডেকে বলেন, রাত্রে যদি আলু দিয়া মুরগির মাংস না রান্ধ্যা তাইলে পিটাইয়া তোমার লাশ ফালাইয়া দিয়াম।

মা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে চিল্লিয়ে বলেন, লিলির মারে কস কেন? আমারে ক। আমি পটল দিয়া মাংস রানছি। রাইন্ধা যে অন্যায় করছি তার শাস্তি দে আমারে। পিটাইয়া লাশ ফালাইয়া রাখ। এইটাই ত বাকি আছে করার। মার কথার উত্তর না দিয়ে লিলির মার মুখে থাপড় দিয়ে দাদা গলা ছাড়েন, মুমু যেইভাবে কইব, ঠিক সেইভাবে চলবা। উল্ডা পাল্ডা কর তো মরবা। লিলির মা ফুঁপিয়ে বলতে থাকে, আপনেরা নিজেগোর মধ্যে গোস্বা করেন। আর রাগ ঢালেন আমার উপরে। আমি এই বাড়িত আর কাম করতাম না। লিলির মার ঘাড় ধরে বেলগাছের দিকে ধাক্কা দিয়ে দাদা বলেন, যাও গা, এক্ষুনি বাইর হও বাড়ি থেইকা। লিলির মাকে বাধা দেন মা, বলেন, সুহৃদের দাদা আসুক, তারে সব কইয়া পরে তুমি বাড়ি থেইকা যাইবা। মা দাদার উদ্দেশ্যে গলা নামিয়ে বলেন, আমি যে মা, লেখাপড়া না জানলেও, আইএ বিএ না পাশ করলেও আমি তো তর মা। আমারে ত একটওু মায়ের সম্মান দেস না! দাদা উঠোন থেকে টিনের ঘরটির বারান্দায় উঠেছেন মাত্র, ভেতর থেকে হাসিনা বলে, কইতে পারো না, সম্মান আশা করে কেন! আপন দেওরের সাথে লীলা কইরা আবার ছেলের সামনে সম্মান আশা করে! দাদা সায় দেন হাসিনার কথায়, উচিত কথা শুনাইয়া দেওয়া দরকার ছিল। বাবা ফিরলে মা আদ্যোপান্ত বলেন ঘটনা। এও বলেন, হাসিনা মনে করতাছে আমার ছেড়ারে সে নিজে বিয়াইয়া লইছে। বাবা দাদাকে ডাকেন, হাসিনাকে ডাকেন। বৈঠকঘরে বসে নিচু গলায় কথা বলেন দুজনের সঙ্গে। মা অন্য ঘরে অপেক্ষা করেন এই আশায় যে বাবা এবার একটি আইন করে দেবেন বাড়িতে যেন মার সঙ্গে রয়ে সয়ে কথা বলে পুত্রবধূ। পুত্রবধূ আজ যদি শাশুড়িকে অসম্মান করে, কাল শ্বশুরকেও করবে। কিন্তু শলা পরামর্শ বিচার যা হয়, তা হল এখন থেকে হাসিনার দায়িত্বে সংসার চলবে। অনেকদিন পর হাসিনার সদারাগ মুখ টিকে এক চিলতে হাসি খেলে।

হাসিনার হাতে সংসারের ক্ষমতা যেদিন চলে গেল, ছোটদা ময়মনসিংহে আসেন। সংসারের হস্তান্তর দেখে মাকে বলেন, ঠিকই হইছে মা, আপনে এখন আর সংসারের ঝামেলায় যাইবেন কেন? বৌদিই সব সামলাক। কিন্তু ছোটদা একা কেন? বউরে কি তার বাপের বাড়িত রাইখ্যা আইছ না কি? না বউ আনেননি ছোটদা। একা এসেছেন। সুহৃদকে দেখতে এসেছেন। সুহৃদকে দেখা যদি মূল উদ্দেশ্য হত, তবে তিনি ছেলের সঙ্গে মাত্র দুমিনিট কাটিয়ে কি রে বেড়াইতে যাইবি নাকি চল বলে আমাকে নিয়ে বেরোতে চান? কই যাইবা? চল চল। তরে একটা নতুন জায়গায় নিয়া যাই। নতুন জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে ঘুড়ির মত ওড়ে। ছোটদা দিন দিন সুদর্শন হচ্ছেন। শরীরে কোনও মেদ নেই। লম্বা ছিপছিপে। দেখে মনে হয় বয়স কমছে তার। ছোটদাকে এমনই বালক বালক লাগে দেখতে যে যখন তিনি আমাকে ক্যান্টনমেণ্টের এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে নিয়ে গেলেন সন্ধেয়, অফিসারের সুন্দরী কচি বউটি বলল, কি কামাল, উনি কি তোমার বড় বোন নাকি? ছোটদা বাড়িটিতে বেশ য়চ্ছন্দে পায়চারি করতে করতে বললেন, কি যে বল, ও আমার আট বছরের ছোট। ছোটদা গীতার সঙ্গে যে সূরে আর ঢংয়ে কথা বলেন, নীনার সঙ্গেও একইরকম করে বলেন। নীনার চিবুক তুলে ধরে বলেন, বাহ দারুণ লাগতাছে তো! আমার নিজের চোখ কান কিছুকে বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় না যে আমার সামনের মানুষটি সৈণ্ত্র হিসেবে নাম কামিয়েছেন। চা টা কিছু খাবা? নীনা জিজ্ঞেস করে। ছোটদা বলে ওঠেন, না না কিছু খাব না। তোমারে দেখতে আসলাম সুন্দরী। দেইখা মন জুড়াইল। এখন যাই। ছোটদার ঠোঁটে অবিকল একই হাসি গীতার সঙ্গে প্রেম করার সময় যে হাসিটি তাঁর ঠোঁটে শোভা পেত। নীনা না না করে ওঠে, কি বল, বোনরে নিয়া আসছ কিছু খাও। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ছোটদা হাত ধরে টেনে নিয়ে আসেন নীনাকে, প্রায় বুকের কাছে লেপ্টে থাকে ছোটদার সুন্দরীটি। যাও কই? কিচ্ছু খাবো না, কখন তোমার জামাই আইসা পড়ব, আজকে যাইগা, আরেকদিন আসব নে। বলে সুন্দরীর গালে আঙুলের আলতো আদর রেখে ছোটদা বেরোন। জিজ্ঞেস করি ছোটদাকে, কে এই মেয়ে?

গায়িকা পিলু মমতাজের ছোট বোন।

তা তোমার সাথে পরিচয় কেমনে?

ফ্লাইটে পরিচয়। প্রায়ই বিদেশ যায়।

ও।

মেয়েটা খুব ভাল। আমাকে কিছু গাহেক দিছে। ধান্দার জিনিস বেচি।

বিমানের ক্রুরা দেশে বিক্রি করার জন্য বিদেশ থেকে কিনে আনা তাদের জিনিসপত্রকে বলে ধান্দার জিনিস। ওগুলো নিজের ব্যবহারের বলে কাস্টম পার করে লাভে বিক্রি করেন মানুষের কাছে। নির্দিষ্ট কিছু লোক কেনে। এগুলা কর কেন? ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আরে ধান্দাই ত আসল। ধান্দাতেই তো পয়সা। বেতন আর কত পাই! ছোটদা ঠোঁট ওল্টান।

শোন, গীতার কাছে কিন্তু কোনওদিন কইস না এই মেয়ের কথা।

কেন, কি হইব কইলে?

উপায় নাই। আমি কোনও মেয়ের সাথে কথা কইলে গীতা কোনওদিন সহ্য করে নাই। সর্বনাশ হইয়া যাবে জানলে।

ছোটদা সে দিনই চলে যান ঢাকায়। তাঁর ময়মনসিংহে আসার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল গীতাদের পিয়নপাড়ার বাড়িতে টাকা দিয়ে যাওয়া। ওখানে ভাঙা টিনের ঘর ভেঙে দিয়ে এখন দালান তোলা হচ্ছে।

বাবা আগের মত প্রতাপ নিয়েই আছেন। বড়দাদা মারা যাওয়ার পর বড়দাদার নামে যত জমি বাবা কিনেছিলেন, নিজের এবং ভাইদের নামে সমান ভাগ করে দেবেন উদ্দেশ্য নিয়ে যখন গ্রামে গিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য ভ্রাতা রিয়াজউদ্দিন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সিরাজউদ্দিনকে সঙ্গী করে বাবার মাথা মুলি বাঁশের আঘাতে ধরাতলে ফেলে ফের যদি গ্রামমুখো হন তবে জীবন নিয়ে আর ফিরতে হবে না হুমকি দিয়ে শহরের আপদকে শহরে বিদেয় করেন। বাবা বাড়ি ফিরে সাতদিন যত না শরীরের তার চেয়ে বেশি মনের অসুখে ভগু তে থাকেন। সারা জীবন আমি এ কি করলাম হায় হায় করেন, মা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ওদের ভালর জন্যই তো করছেন, এখন আর পস্তাইয়া কি হইব! শরীর সারে বাবার, মনের হাহারবও দূর হয়। জমির নেশা ধাঁ করে ছুটে এসে আবার তাঁকে কামড়ে ধরে। নানির বাড়ির পাশে কড়ইতলা, তার সামনে বিশাল খোলা মাঠ, ছোটবেলায় যে মাঠে আমরা গোল্লাছুট ডাংগুলি চোর চোর ক্রিকেট ইত্যাদি রাজ্যির খেলা খেলতাম, যে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম, বস্তির মেয়েরা গোসল করত কাপড় ধুতো, মাঠের কিনারে বেড়ার যত ঘর ছিল সব কিনে নিয়ে ভেঙে চুরে বুজে সাফ করে পঁচিশটি বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন বাবা। দেয়াল তুলে দিয়েছেন রজব আলী কলোনির চারদিকে। দেয়াল তুলতে গিয়ে নানির বাড়ি থেকে বেরোবার রাস্তা গেছে বন্ধ হয়ে। নানি অনুযোগ করেন। কি গো নোমানের বাপ, রাস্তা যে বন্ধ কইরা দিলাইন! বাবা নানিকে কৈফিয়ত দেন না। কেবল আকুয়ায় জমি কিনে তাঁর আশ মেটে না। অবকাশের দেয়াল ঘেঁষা বাড়ির মালিক প্রফুল্ল ভট্টাচার্য মরে যাওয়ার পর যেদিন টপু করে তাঁর বউটিও মরে গেলেন, একটিই মেয়ে বোম্বে থাকে, সে মেয়ে মায়ের সৎকার করতে আসেনি, ঘর বাড়ি জিনিসপত্র জায়গাজমির দায়িত্ব নিতেও না, বাবা তক্কে তক্কে রইলেন প্রফুল্লর জমিটি সস্তায় কারও কাছ থেকে কিনতে পারেন কি না। বাবার তক্কে তক্কের মাথায় চাটি মেরে একদিন পরিমল সাহা প্রফুল্লর বাড়িতে বাস শুরু করলেন। প্রফুল্লর উত্তরাধিকারি জমি নিতে আসেনি, অনাত্মীয় প্রতিবেশি পরিমল সাহা প্রফুল্লর জায়গা দখল করে নিয়ে, বাবার বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে নতুন ঘর তোলার স্পর্ধা দেখিয়েছে। কেন তুলবে ঘর, বাবা পরিমলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। মা বলেন, এ তো আর এমন না যে আপনের জায়গার উপরে ঘর তুলছে, আপনের কোনও ক্ষতি করছে! খামাকা মানুষের বিরুদ্ধে লাগেন কেন! বাবার কটমট করে তাকানো চোখের দিকে তিক্ততা ছুঁড়ে দেন,ছোটলোকের পয়সা হইলে মানুষরে আর মানুষ জ্ঞান করে না। মা ঠিক বলেননি, বাবা কিন্তু কিছু মানুষকে নিজের ভাইয়ের ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাইদের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। আমানউদদৌলা গফরগাওঁ এ চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, গফরগাওঁ থেকে নেত্রকোনা বদলি হয়ে ওখানেও আরেকটি বিয়ে করেছেন। ভাইদের একাধিক বিয়েতে বাবার কোনও আপত্তি নেই। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহে এলে চেম্বারে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমানউদদৌলা, চাকরি বাকরি কেমন চলছে, টাকা পয়সা কেমন রোজগার হচ্ছে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন বাবা, কখনও তাঁর বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন না। আমানউদদৌলার ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া করার সমস্ত খরচ দিচ্ছেন। প্রতি মাসেই আমানউদদৌলার বড় বউ এসে ছেলেমেয়ের ইশকুল কলেজের বেতন, মাস্টারদের বেতন, বই খাতা কেনার টাকা, বাড়িভাড়া এমনকি খাওয়ার দাওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে যান বাবার কাছ থেকে। বংশ প্রতিপালনে বাবার কোনও না নেই। হাসিনাকে বিএডএমএড পাশ করিয়ে ইশকুলের শিক্ষিকা বানানোর জন্য বাবার অতি-আবেগ দেখে মা একদিন বলেছিলেন, ছেলের বউএর লাইগা এত যে করতাছেন, ইয়াসমিনের কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াডাও তো ঠিক মত দেন না! মানুষ তো নিজের মেয়ের জন্য করে, মেয়ে বাদ দিয়া ছেলের বউরে লইয়া পড়ছেন কেন?

বাবা ধমকে থামান মাকে, ছেলের বউ লেহাপড়া শিইখা নাম করলে কার লাভ? ইশকুল কলেজের মাস্টার হইলে কার লাভ? মাইনষে কি কইব হাসিনা মমতাজ অমুক ইশকুল বা অমুক কলেজে মাস্টারি করে? কইব ডাক্তার রজব আলীর ছেলের বউ মাস্টারি করে। ছেলের বউ আইছে আমার বংশে, মেয়ে ত যাইব গা পরের বংশে। মার গলায় ধিক্কারের সুর ওঠে, বংশ বংশ বংশ। বংশ ধুইয়া পানি খাইবাইন? আপনের মেয়ের আপনের প্রতি যে দরদ, সেই দরদ কি ছেলের বউএর কাছ থেইকা পাইবাইন? নিজের নামের কথা এত ভাবেন, নিজের বউরে যে কিছু দেন না, এই সব যদি মানুষে জানে, আপনের নাম কই যাইব?

মার প্যাঁচাল শোনার জন্য বাবা অপেক্ষা করেন না। তিনি চেম্বারে চলে যান রোগী দেখতে। তাঁর অনেক রোগী। আলাদা চেম্বার করার পর থেকে কিছু কিছু বাঁধা মেয়ে-রোগী নিয়ে চেম্বারের দরজা বন্ধ করতে শুরু করেছেন। মা একদিন বাবার পছন্দের গাজরের হালুয়া বানিয়ে বাটিতে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চেম্বারে, বাবা যেন রোগি দেখার ফাঁকে হালুয়াটুকু খান। চেম্বারের বন্ধ দরজায় টোকা দিয়েছেন অনেকক্ষণ। টোকার পর টোকা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাবা যখন টোকার জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে দরজা খুলেছেন, প্যাণ্টের বোতামও তখনও খোলাই ছিল তাঁর, লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ওয়াক থু বলে বেরিয়ে এসেছেন মা। মার ওয়াক থুতে বাবার কিছু যায় আসে না। তিনি বাজার না পাঠালে বাড়িতে সবাইকে উপোস থাকতে হবে, তিনি বাড়ি থেকে বের করে দিলে সবাইকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। তাঁর শক্তির কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মা প্রায়ই বলেন, মেট্রিকটা পাশ করলে একটা চাকরি করতে পারতাম। চাকরি করলে কবেই যে পারতাম এই বাড়ি থেইকা চইলা যাইতে! কোনও একটি চাকরি করতে পারলেই মা ভাবেন, মার আর পরোয়া করতে হতো না বাবাকে।

মা জ্বরে সাধারণত কাতর হন না, জ্বর নিয়েই সংসার ধর্ম পালন করেন, কিন্তু জ্বর মাকে একদিন এমনই কাবু করল তিনি বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারালেন। মার জন্য ভাল কোম্পানির এমক্সিসিলিন পাঠাতে বলেছি দাদাকে। এখন বাড়ির কারও ছোটখাট অসুখ বিসুখে আমিই চিকিৎসা করার উদ্যোগ নিই। আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে দাদা তিনদিন পর দশটি ক্যাপসুল এনে মাকে দেন খেতে। মা ঘড়ি দেখে আট ঘন্টা পর পর ওষধু খাচ্ছেন। সাতদিন পরও জ্বর সারছে না মার, জ্বর নিয়ে উদাস তাকিয়েছিলেন জানালায়। কপালে হাত দিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে। কপালে রাখা আমার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে মা বললেন, কাছে বসো মা, তোমারে একটা গোপন কথা বলি। মা কখনও কোনও গোপন কথা বলার জন্য এত কোমল কণ্ঠে আমাকে পাশে বসতে বলেন না। গোপন কথা তো মার আছেই একটি, বাবার সঙ্গে রাজিয়া বেগমের সম্পর্কে সত্যিকার কি, তা নতুন করে আবিষ্কার করে শোনানো। গোপন কথা শোনার জন্য আমার ভেতরে কোনও কৌতূহলের অঙ্কুরোদগম হয় না। নিস্পৃহ দৃষ্টিটি ঘুরতে থাকে মার মুখে, বালিশে, চাদরে, জানালায়, রঙিন কাচে। মা খুব ধীরে ধীরে বলেন, তোমার বাবার অত্যাচারে একদিন ভাবলাম আমি যাইগা এই বাড়ি থেইকা। সত্যিই সত্যিই ভাবলাম। কিন্তু কই যাই, কার কাছে যাই! যাই কইলেই তো যাওয়া যায় না। এই যে মাঝে মাঝে রাগ কইরা কই জঙ্গলে চইলা যাবো, জঙ্গলে কি আর সত্যি সত্যি চইলা যাওয়া যায়! যায় না। মা থামেন, জানালার ওপারে বুকে মেঘ জমা আকাশটির নীল নীল কষ্টের দিকে তাকিয়ে বলেন, ছোটবেলায় আমার এক মাস্টার ছিল, বাসায় আইসা আরবি পড়াইত। মাস্টারটা আমারে খুব পছন্দ করত। কয়েক বছর আগে তার খোঁজ নিছিলাম কই আছে সে, কি অবস্থা। শুনলাম সে বিয়া করছিল, বউটা মইরা গেছে। সেই মাস্টাররে একটা চিঠি লিখলাম একদিন। সোজাসুজিই জিগাস করলাম , আমাকে বিয়া করতে সে রাজি আছে কি না। খুব উৎসাহ নিয়া সে আসল আমার সাথে দেখা করতে। পার্কে গিয়া দেখা করলাম। জানে যে আমার বিয়া হইছে এক ডাক্তারের সাথে। ডাক্তারের বিরাট নাম। বড় বাড়ি। আমারে প্রথম কথা জিগাইল, তোমার জমি জমা কিরম আছে? জমিজমা? আমি ত অবাক। জমির কথা জিগাস করে কেন? আমি যা সত্য তাই কইলাম। কইলাম আমার কোনো জমিজমা নাই, টাকা পয়সা নাই। শুইনা সে আর উৎসাহ দেখাইল না।

তার মানে তোমার জমিজমা থাকলে তোমারে বিয়া করত!

হ।

তুমি মুন্সি বেডারে বিয়া করতে চাইছিলা? নাক সিঁটকে বলি।

তোমার বাপের শয়তানি আর দেখতে ইচ্ছা করে না। তাই রাগ কইরা ওই লোকরে ডাকছিলাম। তোমার বাপরে দেখাইয়া দিতে চাইছিলাম, আমিও চইলা যাইতে পারি। পারলাম না।

তুমি গেলে গা আমাদের কি হইব চিন্তা করছ?

তোমাদের কথা ভাইবাই ত কোথাও যাওয়ার চিন্তা কইরাও পারি না। তোমরা বড় হইয়া গেছ। তারপরও যাইতে পারি না। তোমরা ঘর সংসার করবা, ছেলেমেয়ে হবে। মা গেছে গা আরেক বেডার সাথে এইডা তো ছেলেমেয়ের জন্য কলঙ্ক। বাপে সাত বেডি নিয়া থাকলেও কোনও কলঙ্ক হয় না।

মার মলিন মুখ টির দিকে তাকিয়ে থাকি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন, আত্মহত্যা করলে গুনাহ হয় বইলা আইজও করি নাই। গুনাহ না হইলে কবেই করতাম!

মার মলিন মুখ থেকে চোখ সরিয়ে দিশি এমক্সিসিলিনের মলিন স্ট্রিপটি নাড়তে নাড়তে চোখ চলে যায় ওষুধের নামে, ওষধু তৈরির তারিখে, ওষধু বাতিল হওয়ার তারিখে। বাতিলের তারিখ তিন বছর সাত মাস আগের। দাদা কি ইচ্ছে করেই মাকে এই বাতিল ওষধু দিয়েছেন? আমার বিশ্বাস হয় না ইচ্ছে করে দিয়েছেন। মাকে বলি না যে এই ওষধু ওষুধ হিসেবে অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে, এ দিয়ে জ্বর সারবে না। মাকে বলি না কিন্তু দাদাকে গিয়ে বলি, ডেট এক্সপায়ারড হইয়া গেছে ওষুধের! ভেবেছিলাম তিনি বলবেন যে তিনি দেখেননি বাতিলের তারিখ, এক্ষুনি তারিখ পার হয়নি এমন ওষধু পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর নির্লিপ্ত মুখ এবং সে মুখে এক্সপাইরি ডেট পার হইলে কিচ্ছু হয় না, ওষধু ঠিক আছে, বাক্যটি শুনে আমি অনেকক্ষণ বাকশূন্য দাঁড়িয়ে থাকি। একটি হু হু হাওয়া এসে আমার ওপর আছড়ে পড়ে। আকাশের নীল নীল কষ্টগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে আমাকে ভেজাতে থাকে, ভাবি, ভেজা গা মুছে মার বালিশের পাশ থেকে নষ্ট ওষধু টি নিয়ে গোপনে ফেলে দেব, নতুন ওষধু কিনে মার বালিশের কাছে ঠিক আগের ওষুধের মতই গোপনে রেখে দেব। মা সুস্থ হয়ে উঠবেন, কোনওদিন জানবেন না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি তাঁকে ঠকাতে চেয়েছিলেন। মার জীবনটির কথা ভাবার অবসর আমার কখনও হয়নি। ভাল ছাত্রী হওয়ার পরও মাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মার যখন দশ কি এগারো বছর বয়স। স্বামী সেই বিয়ের পর থেকে অন্য মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে করে যাচ্ছেন। চারটে ছেলেমেয়ের ওপর ভরসা করে সংসারের ঘানি টেনে গেছেন মা। দুটো ছেলে বিয়ে করে পর হয়ে গেছে। নিজের নাতিকে লালন পালন করছেন, এর বিনিময়ে বছরে দুটো শাড়ি পান। বাচ্চা রাখার জন্য দাসি নিযুক্ত করা হলেও শাড়ি দেওয়া হয়। মা কোনও ব্যতিক্রম নন। মার আসলে অভাবে থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে। কোনও শাড়ি গয়নার প্রয়োজন নেই মার। কোনও তেল সাবানের প্রয়োজন নেই। ডিম দধু কলারও প্রয়োজন নেই। মার প্রয়োজন সামান্য একটু ভালবাসা। সেটি পেতে চাতক পাখির মত বসে থাকেন। মার চোখের জলে লকলক করে বড় হচ্ছে একটি পদ্মফুল। দিন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, কোনও মেয়ে মহিলা যেদিন আর ভিড়বে না, তখন নিশ্চয়ই স্থির হবেন বাবা। ষাট সত্তর পার হলে, আশি, নব্বই বছরে এসে হয়ত তিনি মার দিকে ফিরবেন। কিন্তু মা, মনে মনে বলি, জীবন ফুরিয়ে গেলে ভালবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে কি লাভ? ও কি আর ভালবেসে ফেরা! ও নিতান্তই সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে কেবল বাকল টুকু নিয়ে আর কিছু করার নেই বলে ফেরা।

মাকে বলি নার্গিসের ওপর গীতার অকথ্য নির্যাতনের কাহিনীটি। শুনে কোনও মন্তব্য করেন না তিনি। মার নৈঃশব্দ আমাকে ধীরে ধীরে মার পাশ থেকে উঠিয়ে অন্য ঘরে নিতে থাকে। পেছন থেকে তিনি বলেন, কামাল কি একলা আইছিল সেদিন? নাকি গীতারে ওর বাপের বাড়িত রাইখা সুহৃদরে দেখতে আইছিল?

জানি না। খেয়ালি উত্তর আমার।

নার্গিসরে বাসায় একলা রাইখা আসা উচিত হয় নাই।

মন্তব্যটি আমাকে থামায়। কেন উচিত হয়নি জিজ্ঞেস করি। মা বলেন, টুলুটা ভাল না। আমি সুহৃদরে নিয়া কয়দিন ছিলাম না কামালের বাসায়? টুলু ত রাইতে গিয়া নার্গিসরে ধরছিল। গীতারে অনেক কইছি নার্গিসরে আমার সাথে দিয়া দেও। দিল না।

মার এ কথা শোনার পর আমি বেরিয়ে একটি রিক্সা নিয়ে কৃষ্টপুর নার্গিসদের বাড়ি গিয়ে তার মাকে বলি যেন ঢাকা থেকে তার মেয়েকে নিয়ে আসে, দেরি না করে। সে তার মেয়েকে নিয়ে আসতে প্রস্তুত কিন্তু গাড়িভাড়া নেই। কোনওদিন ঢাকায় যায়নি না নার্গিসের বাবা, না মা। কথা দিই কাল আমি টাকা নিয়ে আসব। টাকা হলে বাসে চড়ে বা ট্রেনে চড়ে যেন চলে যায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দেব। ঢাকায় নেমে কোনও রিক্সাঅলাকে বললে একেবারে নয়াপল্টনে বাড়ির সামনে থামাবে। ফেরার পথে চোখ্যে ভাসাতে থাকি টাকা যোগাড় করার উপায় কি কি আছে সামনে। ভাবনার জালে ঢিল ছোঁড়ে চড়পাড়া মোড়ের একটি জটলা। জটলার মুখ গুলো চেনা। শেষ বষের্ আটকে থাকা সাত আটজন পুরোনো সহপাঠী দাঁড়িয়ে। উদ্বিগ্ন মুখ সবার। রিক্সা থামিয়ে কি হয়েছে, র‌্যাগডের উৎসব মনে হচ্ছে! বলতেই রতিশ দেবনাথ বলল, রিজওয়ান মারা গেছে।

আমাদের রিজওয়ান?

হ্যাঁ আমাদের রিজওয়ান।

মারা গেছে মানে?

পেথিডিন নিত। বেশি নেশা করতে গিয়া মাসল রিলাক্সেন্ট নিছিল। চরপাড়া হোটেলের একটা রুম ভাড়া নিয়া থাকত। সকালে হোটেলের মালিক দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুইখা দেখে এই অবস্থা। সিরিঞ্জ আর এম্পটি ভায়াল পইরা রইছে। বোঝে নাই যে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেশান না থাকলে মাসল প্যারালাইসিস হইয়া লাংগস কাজ করবে না। আরে ডায়াফ্রাম যদি মুভ না করে, লাংগসের ফাংশান তো হবে না!

বেচারা।

মৃত্যু এত সহজে ঘটে যায়। এই বেঁচে থাকছি, মুত্যুর ভাবনা ছিঁটে ফোঁটা নেই, হঠাৎ মৃত্যু এসে বলল, চল। সময় ব্যয় না করে বাড়ির দিকে যাই। কেউ সুখে মরে, কেউ দুঃখে মরে। সুখে যারা মরে, তাদেরই ভাল। জীবনের কোনও যন্ত্রণাই তাদের পাওয়া হয়নি। রিজওয়ানের হয়ত কোনও যন্ত্রণা পাওয়া হত না। ডাক্তার হয়েছে, তার ওপর আবার পুরুষ মানুষ। কেউ তাকে ঠকাবার ছিল না। কেউ তাকে ধর্ষণ করবারও ছিল না। রিজওয়ানের বাবার অঢেল টাকা, বাবা নিশ্চয়ই পুত্রের সুখের জন্য টাকা ব্যয় করতেও কোনওরকম দ্বিধা করতেন না। বাড়ি ফিরে আমি টাকার কথা ভাবি আবার। মার কাছে টাকা নেই। বাবার কাছে চাওয়ার প্রশ্ন আসে না। তিনি আমাকে পারলে বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেন। দাদা তো বদলে গেছেন, তিনি আমার হাত পাতার দিকে বড় জোর থুতু ছিটোতে পারেন। ইয়াসমিনকে কথা দিয়ে যে চাকরির প্রথম বেতনের টাকা পেলে ওকে আমি নতুন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেব, ওর হারমোনিয়ামটি নিয়ে যাই ছোটবাজারে সুর তরঙ্গ দোকানটিতে, যে দোকান থেকে এটি কিনে ছিলাম। পাঁচশ টাকায় কিনছি, বেচলে কত দিবেন? সুর তরঙ্গে খাটো ধুতি পরা গোল ফ্রেমের চশমা চোখের বুড়োটি বললেন, দেড়শ দিতে পারি। দরাদরি করে তিনশ টাকা পাওয়া গেল। সেই টাকা নিয়ে কালের জন্য দেরি করিনি আমি। সেদিনই কৃষ্টপুর গিয়ে নার্গিসের মার হাতে টাকা কটি দিয়ে আসি। বারবার করে বলে আসি যেন কাল ভোরেই চলে যায় তারা ঢাকায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দিয়ে আসি কাগজে। বাড়ি ফিরে এলে মা জিজ্ঞেস করেন, হারমোনিয়াম কই থইয়া আইছস?

আমি কোনও উত্তর দিই না।

 

রুদ্রর চিঠি পাওয়ার পর ঢাকা ছুটি। সকালে ইন্দিরা রোডের বাড়িতে পৌঁছে দেখি সে ঘরে নেই। ঘরে তার ঘ্রাণ আছে, সে নেই। একটু আগেই নাকি বেরিয়েছে। সারাদিন অপেক্ষায় বসে থাকি। রুদ্র ফেরে না। রাত হয়। ফেরে না। অপেক্ষায় রাত জেগে থাকি, যদি গভীর রাত্তিরে হলেও ফেরে,যদি শেষ রাতের দিকেও ফেরে। কোথাও হয়ত আড্ডায় বসে গেছে, কোথাও হয়ত রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তুমুল জমে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পর ঢাকায় এসে ঢাকার আড্ডা থেকে নিজেকে তুলে আনা কঠিন, এ বুঝি আমি। ভোরের আলো আমার গা স্পর্শ করে। চোখচুলচিবুক স্পর্শ করে। বুক থেকে কিরণ ছড়িয়ে যায় বাকি শরীরে। রুদ্রর স্পর্শ নেই। একা বিছানায় তার মাথার বালিশটিকে বুকে চেপে শুয়ে থাকি। সকাল চলে যায়। রুদ্র আসে দুপুরবেলা। ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে একটু চমকায় সে।

কখন এলে?

আজ নয়, কাল এসেছি।

কাল?

হ্যাঁ কাল।

রাতে বাড়ি ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?

ছিলাম কোথাও।

কোথাওটি কোথায়?

ছিলাম।

কোথায়?

রুদ্র কোনও উত্তর না দিয়ে তোয়ালে আর লুঙ্গি নিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। এত সময় নিয়ে গোসল করতে তাকে এর আগে দেখিনি। গোসল সেরে এসে সগু ন্ধি সাবানের ঘ্রাণ নিয়ে শরীরময়,বলে, খেয়েছো?

হ্যাঁ, খেয়েছি।

তাহলে বসো তুমি। আমি খেয়ে আসি।

রুদ্র খাবার টেবিলের দিকে চলে যায়। আমি বিছানায় শুয়ে ভাবি, কেন সে বলল না কোথায় ছিল! কেন শুধু ছিলাম শব্দের আড়ালে ঢেকে রাখল কোথায় ছিল! ভাবনা আমাকে কোথাও নিয়ে পৌঁছয় না। এত সময় নিয়ে খেতে রুদ্রকে এর আগে আমি দেখিনি। তার স্পর্শ পেতে আমার শরীরের প্রতিটি কণা উন্মুখ হয়ে আছে। ইচ্ছে করে খাবার টেবিলে তার পাশের চেয়ারে বসে দেখি কি করে খাচ্ছে সে। নিশ্চয়ই কাল রাতে খায়নি। তা না হলে আমাকে একটুও স্পর্শ না করে সে কেন এমন চলে গেল খেতে! অভিমান আর আশঙ্কা আমাকে জাপটে ধরে রাখে। রুদ্র খেয়ে ফিরলে পাশে বসতে বলি। তার হাতখানি হাতে নিয়ে বলি, তুমি মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছে! আমাকে।

নাহ। এড়িয়ে যাবো কেন?

কোথায় ছিলে কাল রাতে বললে না যে!

বললাম তো ছিলাম!

কোথায়? কোনও বন্ধুর বাড়ি?

না।

কোনও আড্ডায়?

না।

তবে?

রুদ্র চপু করে থাকে, তার মৌনতা ক্রমে অসহ্য হয়ে আমাকে মর্মন্তুদ বেদনায় মন্থর করে। শ্বাস-কষ্ট হতে থাকে। রুদ্র তুমি বলে ফেলো, বলে ফেললে আমার কষ্ট যাবে। কিন্তু সে কি যায়! সে তো আরও বাড়ে। রুদ্র বলে সে নারায়ণ গঞ্জ ছিল। নারায়ণ গঞ্জ কেন, কোনও বন্ধু থাকে ওখানে? না। কেন গিয়েছো তবে? কার সঙ্গে গিয়েছো? একা। কার কাছে? কারও কাছে নয়। কোথায় ছিলে রাতে? টানবাজারে। রুদ্রর ভাষাহীন দুটো চোখ আমার চোখে পড়ে থাকে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ শুনি। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়, রুদ্র কি আমাকে বলতে চায় সে গেছে টানবাজার পতিতালয়ে রাত কাটাতে! না রুদ্র তুমি আর যা কিছুই বল, এ কথাটি বোলো না। ওখানে সারারাত তুমি কোনও চায়ের দোকানে, মদের দোকানে অথবা রাস্তায় ফুটপাতে গাছের তলে সারারাত শুয়েছিলে, এরকম কিছু বল। আমার চোখে আকুতি। কিন্তু রুদ্র বলে, টানবাজারে সে রাত কাটিয়েছে এক পতিতার ঘরে। আমার চোখে আকুলতা, পতিতা তো মানুষই রুদ্র, তোমার মায়ের মত, বোনের মত। বল যে তোমার ক্ষিদে পেয়েছে বলে পতিতাটি তোমাকে খেতে দিয়েছে, এত ঘুম পাচ্ছিল নেশা করে যে তুমি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে। বল যে সারারাত বেঘোরে ঘুমিয়ে তুমি উঠে এসেছো। বল যে স্পর্শ করনি অন্য কারও শরীর। সেই যে কথা দিয়েছিলে স্পর্শ করবে না, বল যে তুমি তোমার কথা রেখেছো। বল যে কেবল এ ঠোঁটেই তুমি কেবল চুমু খাও, অন্য ঠোঁটে নয়। বল অন্য কোনও শরীরের জন্য তুমি তৃষ্ণাতর্ হও না। রুদ্র আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে না, পতিতার সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের কথা বলে । আমার দিকে এক জগত অন্ধকার ছুঁড়ে দিয়ে বলে যায়। আমি স্তব্ধ বসে থাকি। শ্বাসের জন্য কোনও হাওয়া পাই না। সাজানো ঘরটি দেখি, রুদ্রকে দেখি, আমার সংসার দেখি। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস অল্প অল্প করে জোড়া দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম আবার। হায় জীবন! যেন এ সংসার নয়, আস্ত একটি শ্মশান। শ্মশান জুড়ে মৃত মানুষের মত শুয়ে থাকি। আমি পুড়ছি, পুড়ে ছাই হচ্ছি। কিন্তু একটি শক্তি আমি হঠাৎই অর্জন করি নিজের ভেতর। সেই শক্তি আমাকে দাউ দাউ আগুন থেকে টেনে সরায়, আমার অস্তিত্বের অবশিষ্টটুকু বাঁচায়। পতিতার শরীর থেকে আনা রসগন্ধ ধুয়ে ফেলা রুদ্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। দুপুরে খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমোয় সে, এ তার স্বভাব। ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে বাইরে বেরোবে। রাতে পেট ভরে মদ খাবে। রাতে হাতের কাছে আমি থাকলে আমার শরীরে, তা না হলে অন্য যে কোনও নারী- শরীরে উপগত হবে। রুদ্রর প্রতিদিনকার জীবনে কোনও এক বিন্দু এদিক ওদিক হবে না। একরত্তি না। আমার জন্য তার স্বভাবের এতটুকু বদল হবে না। নিজেকে ধিক্কার দিই। সেই ফুলশয্যার রাতেই তো তাকে আমার ত্যাগ করা উচিত ছিল, কি দরকার ছিল এতগুলো বছর এই প্রেম বয়ে বেড়ানো! একবার যে মানুষ বিশ্বাস ভাঙে, সে সবসময়ই ভাঙে। ভাঙাই তার স্বভাব। ভাঙাই তার নেশা।

নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, তালাক দিতে হলে কি করতে হয়?

ভাঙা গলায় বলে রুদ্র, উকিলের কাছে যেতে হয়, কি কারণ সম্পর্কে ভাঙার, এসব বলতে হয়। নানান ঝামেলা। লক্ষ করি, আগের বারের মত আমি কাঁদছি না। এক ফোঁটা জল নেই চোখে। স্তব্ধতার ভেতর থেকে একটি পাথুরে কন্ঠ, উকিলের বাড়ি কোথায় বল, যাব আমি, আজই। কেবল আমি কেন, তুমিও চল। তুমিতো বেশ ভাল করেই জানো আমাদের এই সম্পর্কটির কোনও অর্থ নেই। সুতরাং এ আমার আর রাগ করে তোমাকে ত্যাগ করা নয়। চল দুজনই কাজটি করি। সম্পর্কটি ছিন্ন করি। আর বিশ্বাস কর, আমার একেবারেই মনে হচ্ছে না যে তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছো বলে আমাদের সম্পর্কে শেষ হওয়া উচিত। সম্পর্কটি শেষ হওয়া উচিত, তুমি আমাকে ভাল বাসো না বলে।

ভাল তোমাকে আমি বাসি। রুদ্র জোর দিয়ে বলে।

যে ভালবাসায় বিশ্বাস নেই!

বিশ্বাস আমি তোমাকে করি।

তুমি কর আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাসের কথা ভেবেছো? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? বিশ্বাস না থাকলে কি ভালবাসা যায়!

শিল্পের মানুষদের একটু এরকম হয়ই। শিল্পের মানুষেরা সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে না। তোমার তা বোঝা উচিত। আমি শিল্পের মানুষ জেনেই তো আমাকে বিয়ে করেছো। তবে আর এত প্রশ্ন করো কেন?

সমাজের নিয়ম কানুনের কথা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিস, সেই বিশ্বাসের কথা হচ্ছে।

আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি, শিল্পের মানুষ হলে সাত খুন মাপ তাই না! শিল্পের মানুষ বলে যা কিছু করার স্বাধীনতা তোমার আছে। শিল্পের মানুষ না হলে বুঝি নেই!আমিও তো কবিতা লিখি, তাই বলে আমিও তাই তাই করতে পারব যা তুমি কর? নাকি আমার সেই স্বাধীনতা নেই যেহেতু আমি ভাল কবিতা লিখি না? যেহেতু তুমি ভাল লেখো, তুমি পারো! নাকি তুমি পুরুষ হয়েছো বলে পারো। আমি মেয়ে বলে আমার সে স্বাধীনতা থাকতে নেই?

রুদ্র চপু করে থাকে। অনেকক্ষণ সে চেয়ে থাকে জানালায়, একটি উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই সামনে। শাদা চুনকাম করা একটি দেয়াল শুধু আমি রুদ্রর চোখে চেয়ে থাকি। অনেককক্ষণ ওভাবেই দেয়ালে চেয়ে থেকে সে বলে, শেষবারের মত ক্ষমা করতে পারো না?

গতবারও তো শেষবার বলেছিলে? সত্যিকার শেষবার তোমার কোনওদিন হবে না। হবে।

সে আগেও বলেছিলে। আসলে কি জানো, এ তোমার স্বভাব। স্বভাব বদলানো এত সহজে সম্ভব নয়।

ঠিক আছে আমাকে আরও সময় দাও। আমি স্বভাব বদলাবো।

কেন বদলাবে? তুমি কি সত্যিই চাও বদলাতে? চাইলে তুমি সেই শুরু থেকেই পারতে বদলাতে। আর বদলানোর প্রয়োজনটাই বা কি? তুমি তো মনে করো না তোমার স্বভাবে কোনও ত্রুটি আছে।

রুদ্র বিছানা ছেড়ে উঠে যায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলতে বলতে, তোমাকে তো কতবার বলেছি,আমার সঙ্গে থাকো সবসময়। বিয়ের পর থেকে কতদিন আমার সঙ্গে থেকেছো বল! তোমার দ্বিধা ভাঙতেই লেগেছে তিন বছর। এভাবে একজন পুরুষ পারে নাকি একা থাকতে?

আমি তো পেরেছি একা থাকতে।

মেয়েদের জন্য যা সম্ভব, পুরুষের জন্য তা সম্ভব নয়।

কেন সম্ভব নয়?

যে কারণই হোক, আমি পারিনি। ঢাকা ফিরে তোমাকে বাড়িতে না দেখে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাই বেরিয়ে গিয়ে মদ খেয়েছি। আর মদ খাওয়ার কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছে।

মনে হচ্ছে রাগ হলেই তুমি মদ খাও! আর যেন খাও না? তুমি না রাগ হলে মদ খাও না? তুমি কি সুখে থাকলে মদ খাও না?

মদের কথা বাদ দাও। সম্পর্কের শুরু থেকে যে আমার সঙ্গে থাকোনি সেটার কি বলবে?

ভাল করেই জানো ময়মনসিংহে থাকতে হয়েছে মেডিকেলে লেখাপড়া করার জন্য। এখন তো ঢাকায় পাকাপাকি থাকার আমার কোনও অসুবিধে নেই। দৌড়োচ্ছে! তো তুমিই।

আমার সঙ্গে শুরু থেকেই থাকা উচিত ছিল তোমার।

তার মানে তুমি কি বলতে চাও আমার ডাক্তারি পড়া ছেড়ে তোমার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল? তোমার সুবিধের জন্য। তাই তো? যেন তোমার কোনও স্খলন না হয়! আচ্ছা, আমার যখন চাকরি হবে, সে যে মোংলা বা মিঠেখালিতে হবে, তার তো কোনও কথা নেই। আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে, তুমি চিংড়ির ঘের দেখতে যাবে বা ধান বিক্রি করতে যাবে, তোমার সঙ্গে মোংলা মিঠেখালি যেতে হবে কারণ যদি তোমার শরীর উত্তেজিত হয় সেই উত্তেজনা মেটাতে যেন একটি মেয়েমানুষের শরীর তুমি হাতের কাছে পাও?

রুদ্র চপু করে থাকে। আমি বলি,যখন তোমাকে ছাড়া থাকি, আমার শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে আমি তো অন্য কোনও পুরুষের কাছে যাই না। অন্য কোনও পুরুষের কোনও ভাবনাই তো আমার মাথায় উঁকি দেয় না। আমি তো পারি না, তুমি পারো কি করে! এর কারণ কি জানো? এর কারণ হল, আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই অন্য পুরুষের কাছে যেতে পারি না। আর তুমি আমাকে ভালবাসো না বলেই পারো। খুব সহজ উত্তর।

সহজ উত্তরটি রুদ্র মানবে না জানি। সে বলবে সে আমাকে ভালবাসে। সে যে অন্য মেয়েদের সঙ্গে শুয়েছে, সে ভালবেসে নয়। রুদ্রর উত্তরও খুব সহজ। কিন্তু সহজ উত্তরটি না দিয়ে রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে, আমি মুক্ত দাম্পত্যে বিশ্বাস করি। তোমাকে আগেই বলেছি। যে দাম্পত্যে কোনও বন্ধন নেই। যে দাম্পত্য আর সব দাম্পত্য জীবনের মত নয়। যে দাম্পত্য জীবনে আমার কোনও শ্বাসকষ্ট হবে না। আমার মনে হবে না আমি আটকা পড়েছি। যে দাম্পত্য কোনও খাঁচা হয়, বরং মুক্ত আকাশ।

রুদ্র তার লেখার টেবিলের চেয়ারে বসে বিছানায় পা তুলে দিয়ে বলে,—হ্যাঁ। তাই তো তোমাকে বলেছি। বলেছি যে কোনও আঁটসাঁট জামা আমাকে পরাতে চেও না।

তার মানে কি এই যে তুমি যে কোনও মেয়ের সঙ্গে শোয়ার স্বাধীনতা চাও!

তুমি সঙ্গে থাকলে আমি তো সে চাই না।

আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি চাও?

চাই না। হয়ে যায়।

হয়ে যায় মানে?

হয়ে যায় মানে হয়ে যায়।

ধর আমারও যদি হয়ে যায়!

তার মানে? চকিতে ভুরু কুঁচকে ওঠে রুদ্রর। পা নেমে যায় বিছানা থেকে। বিছানায় তার মুখোমুখি বসে, কুঁচকে থাকা ভুরুর তলে তার সঙ্কুচিত হয়ে আসা চোখের মণিতে চেয়ে বলি, মানে হল, তুমি যখন আমার সঙ্গে না থাকো, তখন আমার যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে শোয়া হয়ে যায়!

কি বললে?

বললাম, আমারও যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে শোয়া হয়ে যায়, যখন তুমি আমার সঙ্গে না থাকো!

বাজে কথা বলো না। দাঁত চিবিয়ে ধমকে ওঠে রুদ্র, ধমকে দলা দলা ঘেন্না।

বাজে কথা তো নয়। তোমার যেটি করার অধিকার আছে, তা আমার থাকবে না কেন? নরম স্বর আমার।

অধিকারের কথা হচ্ছে না, কাল মাতাল ছিলাম। রুদ্রর স্বরও নরম।

এটা কোনও অজুহাত নয়। মদ খাওয়া তোমার নেশা। তুমি প্রতিরাতেই মাতাল হও।

না, হই না। প্রতিরাতে আমি মদ খাই না।

তবে কি বলতে চাও, যে, যে রাতে তুমি মদ খাবে, মাতাল হবে, সে রাতগুলোয় তোমার মেয়েমানুষ চাই যেমন করে হোক, আমি হলে আমি, না হলে অন্য কেউ!

রুদ্র একটি বই হাতে নিয়ে চোখ ফেলে রাখে বইয়ের পাতায়। যেন এ মুহূর্তে আমার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে বইটি পড়া তার জরুরি। বইটি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলি— আমার সঙ্গে কথা বল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। বল তোমার কেমন লাগবে আমিও যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে ঘরে ফিরি? ধর আজ রাতে আমি ঘরে ফিরব না। অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে কাল দুপুরে ফিরব।

রুদ্র চোখ ছোট করে তাকায় আমার দিকে, বইটি টেনে নিয়ে বলে—প্রতিশোধ নিতে চাও?

প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছি না, জানতে চাইছি এর নাম কি মুক্ত দাম্পত্য নয? নাকি মুক্ত দাম্পত্য কেবল নিজের বেলায় চাচ্ছ, আমার বেলায় নয়!

আমি তো বলেছি যে ভুলটি কাল হয়েছে আমার, আর হবে না এমন।

কেন হবে না ভুলটি আর? কারণ আমি পছন্দ করি না বলে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তুমি তো পছন্দ কর। তোমার তো কোনও অসুবিধে নেই একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে করতে!

শরীরের সম্পর্কটিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? এতে তো মনের কোনও সম্পর্কে হচ্ছে না।

ঠিক আছে, আমারও মনের কোনও সম্পর্কে হবে না কারও সঙ্গে। কেবল শরীরের। মানবে?

অনেকক্ষণ ভাবে রুদ্র। এরপর মাথা নাড়ে। তা সে মেনে নেবে না।

আমি হেসে বলি, আসলে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। এ আমার রুচিতে বাঁধে। তুমি চাইলেও এ জিনিস আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু তুমি যে বলতে, তুমি নাকি নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস কর। তা-ই দেখলাম। দেখলাম কেমন বিশ্বাস কর। তুমি আসলে সমতার কথা বলো, বলা একধরণের ফ্যাশন কি না। শিল্পের মানুষ হলে তাই বলতে হয় কি না। অথবা খুব প্র−গ্রসিভ সাজতে হলে এসব না বললে চলে না কি না। তুমি সমতায় বিশ্বাস করো ভাবো, কারণ বউ নিয়ে শহর ঘুরে বেড়াও, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও, বউকে ঘরবন্দি করোনি, বউকে ঘরের কাজকর্ম করার জন্য রাখোনি। তাই বোধহয় একধরনের পুলক অনুভব কর ভেবে যে তুমি খুব প্রগতির পক্ষের মানুষ। অবশ্য প্রগতির পক্ষের মানুষ হওয়া খুব সহজ কথা, সমতার কথা বলাও খুব সহজ। কিন্তু নিজের জীবনে চর্চা করতে গেলেই কঠিন। ঠিক না?

যৌথ সিদ্ধান্তে তালাক ঘটানোর কথা বলি, রুদ্র রাজি হয় না। সাফ সাফ বলে দেয় তালাকের জন্য উকিলের কাছে সে যাবে না। বারবারই সে বলে প্রথম তার অসুখ ধরা পড়ার পর যে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনওদিন সে অন্য মেয়েমানুষের কাছে যাবে না, তা সে রেখেছে, কেবল সেদিনই টানবাজারে হঠাৎ করে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেছে। আমি যেন এবারের মত, এবং এটিই শেষবার, তাকে ক্ষমা করে দিই। আমি যেন তালাকের মত ভয়ঙ্কর বিষয়টির কথা একটওু না ভাবি আর। রুদ্রর কোনও বাক্যই আমাকে স্বস্তি দেয় না। আমার মনে হয় না রুদ্র কেবল সেদিনই গিয়েছে নতুন করে পতিতালয়ে। আমার মন বলে, রুদ্র সেই যে তার কিশোর বয়সে যাওয়া শুরু করেছিল, সে যাওয়া কখনো বন্ধ করেনি। আমাকে সংক্রামিত করার পর অনুতপ্ত অন্ধকার নামে কবিতাই লিখেছে শুধু সত্যিকার অনুতপ্ত হয়নি। শব্দ রচনা করা আর শব্দকে বিশ্বাস করা এক জিনিস নয়। অস্থিরতা আমাকে কামড়ে খেতে থাকে। এমন কোনও উকিলকে আমি চিনি না যাকে তালাকের কাগজ তৈরি করতে বলব। আমার অবশ্য যাওয়া হয় সেই উকিলের কাছে, যে উকিল আমাদের বিয়ের কাগজ তৈরি করেছিলেন, রুদ্রকে নিয়েই যাওয়া হয়, সে আরও দুদিন পর। বলেছিলাম তুমি যদি না যাও, তবে একাই যাবো আমি। যে করেই হোক যাবো। যদিও আমি কাগজের কোনও সম্পর্কে বিশ্বাস করি না, ভালবাসি বলেই তোমার কাছে এসেছিলাম, বিয়ের কাগজের কারণে নয়। তালাকের কাগজটিও একটি কাগজ যদিও, কিন্তু এ কাগজটি আমার শরীরকে তোমার দাবি থেকে মুক্ত করবে। অন্তত আইনত। উকিল অবাক দেখে যে আমরা এসেছি তালাকনামায় সই করতে। ঠা ঠা করে হেসে বললেন বাড়ি যান, ঝগড়াঝাটি মীমাংসা করে ফেলেন। আপনাদের মত চমৎকার জুটি আর আছে নাকি? হুইল চেয়ারে বসে থাকা পঙ্গু উকিল তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন, অপবূর্ সুন্দরী স্ত্রীটি এসে রুদ্রকে দেখে ট্রেতে করে চা বিস্কুট সেমাই সাজিয়ে নিয়ে এসে দিব্যি সাহিত্যের গল্পে বসে গেলেন। স্ত্রীটি সাহিত্যরস কেবল আস্বাদন করেন না, রীতিমত সাহিত্য রচনা করেন। নিজে একটি বই লিখছেন। রুদ্র আর আমি ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে স্ত্রীটির প্রথম বই লেখার উত্তেজনা এবং আনন্দ দুটোই উপভোগ করি। কে বলবে যে আমি আর রুদ্র পরস্পরকে তালাক দিতে এসেছি! চা বিস্কুট খেয়ে, সাহিত্যের গল্প শেষ করে উঠে আসার আগে উকিলকে বলি, ঝগড়াঝাটি হয়নি আমাদের। মীমাংসা করার কিছু নেই। কিন্তু সম্পর্কটি চুকিয়ে ফেলা ভাল।

আরও কিছুদিন সময় নেন। ভাবেন। হুমজিক্যালি কিছু করবেন না।

আমার আর ভাবার কিছু নেই, ভেবেই এসেছি।

উকিল গম্ভীর হয়ে মাস গেলে পর আমাকে আবার যেতে বলেন, কি কারণে আমি তালাক দিতে চাই, তাঁকে সব জানাতে হবে, তিনি যদি মনে করেন, কারণগুলো তালাক ঘটানোর জন্য উপযোগী, তবেই তালাক হবে, নচেৎ নয়। মোটা অংকের একটি টাকার কথাও বললেন নিয়ে যেতে।

 

যদিও রুদ্র প্রায়ই বলে শরীর মেলাই চল, শরীরে বসত করে মন রূপ পাখি কিন্তু এবার জলজ্যান্ত আমাকে হাতের কাছে পেয়েও শরীর সম্পণূর্ মেলায় না সে। যদিও চুমু খায়, স্তনজোড়া দলে পিষে উতল নদীর −স্রাত নামায় শরীরে, আর আমি তীব্র তৃষ্ণায় খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত তাকে আঁকড়ে ধরি, তাকে আশ্রয় করি, যেন নিয়ে তীরে ভেড়ায় আমাকে, যেন বাঁচায়, সে নিষ্ঠুরের মত কেড়ে নেয় খড়কুটো, পাশ ফিরে শোয়। তার অঙ্গ শীতল নয়, অথচ পাশ ফিরে শোয়। তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে আমার প্রতি অঙ্গ, তবু পাশ ফিরে শোয়। কেন? আমার জেগে থাকা শরীরের পাশে সে নিশ্চল পড়ে থাকে। সে কি ঘুমিয়ে থাকে? না সে ঘুমোয় না। বিচ্ছিত হব বলে এ কি তার অভিমান? না তাও নয়। তবে কি? এর পরের রাতে অন্য ঘরে ঘুমোতে যায় রুদ্র। আমি এপাশ ওপাশ করি, হাত পা ছুঁড়ি, শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়, শরীর ভিজতে থাকে কামে, ঘামে। রুদ্রর স্পর্শ গন্ধ আমার শরীরে বিষম জোয়ার আনে, আমি পারি না নিজেকে অবদমনের ডালাপালায় আবৃত করতে।

কেন দূরে দূরে থাকছো? তোমার কি ইচ্ছে করে না? কী হয়েছে তোমার?

কি হয়েছে সে ঘটনাটিও সে বলে মাঝরাতে। তার আবার অসুখ করেছে।

সে দেখায় তার শিশ্নের গোড়ার লাল গোটা। আমাকে সে কিছুতেই এবার সংক্রামিত করতে চায় না। তার বিশ্বাস সেদিন টানবাজার থেকেই অসুখ টি সে বয়ে এনেছে।

পুরুষাঙ্গটি আড়াল করে অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলি, না তুমি টানবাজার থেকে আনোনি এটি। এত দ্রুত এই অসুখ ফুটে বেরোবে না। তুমি কি টানবাজারের আগে আর কোনও বাজারে যাওনি?

কি বলতে চাইছ?

কি বলতে চাইছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।

রুদ্রর বুঝতে না পারার কোনও কারণ নেই। অনেকক্ষণ বিমূঢ় বসে থেকে সে বলে আগে দএু কবার দুর্ঘটনা ঘটেছে হঠাৎ হঠাৎ।

কোথায়? বানিশান্তায়?

মাথা নাড়ে ধীরে। বানিশান্তায় ঘটেছে। বানিশান্তায় যে সে নিয়মিতই যায় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ঢাকায় আমি যখন তার পাশে থাকি, পতিতালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন সে বোধ করে না। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে যখনই সে মোংলা বন্দরে যায়, বানিশান্তার লোভ সম্বরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। রুদ্রর কাছে আমি একটি শরীর ছাড়া, এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু নই। নিজের ওপর ঘৃণা হয় আমার।

তুমি তো বলেছিলে সেই তিরাশির পর আর ঘটেনি কিছু কেবল সেদিন টানবাজারেই ঘটল!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। দীর্ঘশ্বাস আমিও ফেলি।

সেই পরিচয়ের শুরু থেকে আমাকে মিথ্যে বলে আসছ। ঘা না বেরোলে তো এবারও তুমি মুখোশের আড়ালেই থাকতে আর বলতে তুমি সম্পণূর্ আমার আছ, শুদ্ধ আছ। টানবাজারের ঘটনার কথাও লুকোতে।

রুদ্রর মুখ টি খুব করুণ দেখায়। কোনও পতিতাকে আমি কি ঘণৃা করি? নিজেকে প্রশ্ন করি, বারবার করি। উত্তর মেলে, না। রুদ্রকে কি ঘৃণা করি? না। করি না। বরং রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার। পরদিন তাকে শাহবাগে নিয়ে যাই পেনিসিলিন নিতে। সেই একই ওষুধের দোকানের একই কর্মচারি রুদ্রকে ভেতরের ঘরে নিয়ে টেবিলে উপুড় করে শুইয়ে নিতম্বে ইনজেকশনটি দেয়। সুঁইএর যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ ভোগে না রুদ্র। দুজন আগের মত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, শাহবাগে, সাকুরায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই দিয়ে রাত করে ঘরে ফিরি। পরদিন সকালে যখন আমি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরছি, রুদ্র আকাশ থেকে পড়ে।

কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছে!?

ময়মনসিংহে।

ময়মনসিংহে কেন?

যাচ্ছি।

কবে ফিরবে?

জানি না।

জানো না কবে ফিরবে?

না।

কবে ফিরবে ঠিক করে বল।

হয়ত ফিরবই না।

তার মানে?

তার কি মানে, তা তাকে বুঝে নিতে বলি। বলি যে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছি মানে?

চলে যাচ্ছি মানে চলে যাচ্ছি। এক মাস পর উকিলের কাছে গিয়ে কাগজ সই করব।

তাহলে এসব করলে কেন? ইনজেকশন দেওয়ালে কেন?

সে তো তোমার জন্য। তোমার ভালর জন্য।

আমার ভালর জন্য যদি ভাবনা কর, তবে আমার সঙ্গে থাকো।

ভাবনা করলেই বুঝি থাকতে হয়!

কেন নয়?

দূরে থেকেও তো তোমার ভাল চাইতে পারি আমি। পারি না?

কি দরকার! দূরেই যদি থাকো, তবে আর আমার কিসে ভাল হবে তা নিয়ে ভাববে কেন!

হেসে বলি, তাতে কি? এত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে না কি? সে তো আছেই।

তবে আর যাচ্ছে! কেন! চল নতুন করে শুরু করি সব।

নাহ।

নাহ কেন।

আমি একটা মেয়েমানুষের শরীর, আমি আর কিছু নই, তোমার এই ধারণাটি, তোমার এই বিশ্বাসটি আমি অস্বীকার করতে চাচ্ছি।

কে বলল এটা আমার বিশ্বাস?

নিজেকে জিজ্ঞেস কর। উত্তর পাবে।

সংসারের মায়া ত্যাগ করে পাকাপাকিভাবে ময়মনসিংহে ফেরার পথে একটি রাত কাটাতে থামি ছোটদার বাড়িতে। ছোটদার বিদেশ ভ্রমণের গল্প শুনে খেয়ে দেয়ে যেই না ঘুমিয়েছি, মুহুর্মুহু দরজা ধাক্কার শব্দে সবাই ঘুম ভেঙে জেগে উঠি মধ্যরাতে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। পাড় মাতাল।

কি হয়েছে, কি চাও?

রুদ্র চিৎকার করে, বেরিয়ে এসো।

কেন?

তুমি আমার বিয়ে করা বউ, আমি যা বলছি তাই তোমাকে শুনতে হবে, বেরিয়ে এসো, তা না হলে পুলিশ ডাকব। কোনও শুয়োরের বাচ্চাই আমাকে থামাতে পারবে না। চলে যাও। চিৎকার করো না।

আমি করবই চিৎকার। তুমি যতক্ষণ না বেরোচ্ছ, চিৎকার করব।

আমি বেরোবো না। চলে যাও তুমি।

কেন বেরোবে না? তোমাকে বেরোতেই হবে। আমি দরজা জানালা সব ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। এখনও বেরোও। বাড়ি চল। বেরোও বলছি।

রুদ্রর চিৎকারে পাড়া জাগে। দরজা ক্রমাগত লাথি মেরে ভাঙতে চাইছে সে।

ছোটদা আমাকে টেনে সরিয়ে আনেন জানালা থেকে। লজ্জায় আনত মুখটি বুকে চেপে আমাকে জড়িয়ে রাখেন দুবাহুতে, শুইয়ে দেন বিছানায়, পাশে শুয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন, ছোটদার এই আদর পেয়ে আমার ভেতরের জমে থাকা কান্নাগুলো সমস্ত বাধা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে তিনি রুদ্ধ স্বরে বলতে থাকেন, শক্ত হ, শক্ত হ। পরদিন সকালে গীতা নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে দিয়ে আসে কমলাপুর ইশটিশনে। ঝকঝকে লাল রঙের এই টয়োটা করোলাটি গীতার জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন ছোটদা।

আমি যে রুদ্রকে ত্যাগ করে এসেছি, অবকাশের কাউকে না বললেও বোঝে সবাই। সুটকেস থেকে আমার কাপড় চোপড় বের করে মা আলনায়, আলমারিতে গুছিয়ে রাখেন। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দেন। এলোমেলো কাগজ সরিয়ে টেবিলটি সাজিয়ে দেন। ফুলদানিতে তাজা একটি গোলাপ এনে রাখেন। দুদিন পর চাকরির কাগজ আসে। নকলা উপজেলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র মেডিকেল অফিসার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পদে আমার চাকরি। কাগজ পাওয়ার পরদিন বাবা আমাকে ট্রেনে করে জামালপুর নিয়ে যান। জামালপুর থেকে বাসে করে শেরপুর, ওখানে সিভিলসার্জনের আপিসে বসে চাকরিতে যোগদানের কাগজে সই করি। সাতদিনের মধ্যে আমাকে নকলার স্বাস্থকে−ন্দ্র কাজ শুরু করতে হবে। বাবাই আমাকে আর আমার সুটকেসটিকে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে শম্ভগু ঞ্জ, শম্ভগু ঞ্জ থেকে বাসে চড়ে ফুলপুর, ফুলপুর থেকে রিক্সায় করে নকলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র দিয়ে আসেন। গ্রামের ভেতর ধান, পাট, কড়াইশুঁটির ক্ষেতের মধ্যিখানে একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের কিনারে কয়েকটি শাদা দোতলা বাড়ি, ডাক্তারদের সরকারি আবাস। স্বাস্থ্যকে−ন্দ্রর বড় ডাক্তার আবদুল মান্নান। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন সরকারি বাড়িতে। আবদুল মান্নান দাড়িঅলা লম্বা পাঞ্জাবি পরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ডাক্তার। তাঁর বাড়িতে আপাতত আমার থাকার ব্যবস্থা করা হল। বাবা হয়ত তাঁকেই ভেবেছেন সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সারাদিন হাসপাতালে রোগী দেখে রাতে আমার আশ্রয়ে ফিরতেই আবদুল মান্নানের চোখ নেকড়ের চোখের মত জ্বলে, দেখি। তাঁর থাবা থেকে গা বাঁচাতে আমাকে বেশিদিন সন্ত্রস্ত থাকতে হয়নি, নকলা থেকে বদলি ঘটিয়ে আমাকে ময়মনসিংহ শহরে এনেছেন বাবা। শহরের সদর স্বাস্থ্য আপিসে কাজ বলতে কিছু নেই। আমি কাজ চাই। ব্যস্ততা চাই। কাচারির পাশে লাল দালানে অলস বসে থাকা ডাক্তার নূরুল হককে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাকে পাঠিয়ে দেন এমন জায়গায় যেখানে প্রচুর কাজ, যেখানে সকালদুপুরবিকেলরাত কেবল কাজ। যেখানে এতটুকু শ্বাস ফেলার সময় আমি পাবো না।

আমি যখন শহরের সূর্যকান্ত হাসপাতালে বানের জলের সঙ্গে ভেসে আসা কলেরায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছি, রুদ্র মোংলায় বসে লিখছে

আর একবার তুমি বৃষ্টি দাও, দূরের আকাশ—
তরুণ শস্যের ক্ষেত জ্বলে যাচ্ছে করাল খরায়।
চাষাবাদে অনভিজ্ঞ কৃষকের নেই কোনও সেচ,
কেবল হৃদয় জুড়ে অকৃত্রিম শস্য-ভালবাসা।

একবার মেঘ দাও, ক্ষমা দাও বৃষ্টির ভাষায়,
জীবনের একমুঠো শস্য তুমি বিনাশ করো না।
আমাকে ফলতে দাও নৈরাজ্যের দুষিত দুপুরে,
হতে দাও শস্য ভার-অবনত সোনালি খামার।

ফিরে নাও বিরহের তপ্ত খরা, অনল দূরত্ব
মেঘ দাও, বৃষ্টি দাও জীবনের ব্যথিত শরীরে।
দহনে চৌচির হিয়া, ও আকাশ, মরমিয়া হাত
ছোঁয়াও মেঘের বুকে জল হয়ে ঝরুক আদোর।

লাঙলে হৃদয় চিরে বীজ বুনে ভালবাসা-ধান
একদিন অপেক্ষায় ছিল এক বিরান প্রান্তর,
তুমি তাকে মেঘ দিলে, বৃষ্টি দিলে, দিলে সম্ভাবনা,
ফসলের স্বপ্ন হল খরাজীণর্ অনাবাদি মাটি—

অনুতপ্ত অন্ধকার হল স্নিগ্ধ সকালের রোদ।
যে মাটি পুড়েছে দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নহীন ক্লেদে,
প্লাবনের পরাজয় জমে জমে যে হয়েছে ভূমি—
দিয়েছিলে মেঘ তাকে, বৃষ্টি, জল, সকল আকাশ।

দিয়েছিলে সম্ভাবনা, দিয়েছিলে প্রথম প্রকাশ,
উড়বার স্বপ্ন শুধু দিয়েছিলে, দাও নাই ডানা।
সমস্ত জীবনটারে তুলে এনে দিয়েছিলে হাতে,
দাও নাই অতি তুচ্ছ নিভৃতের একান্ত ঠিকানা।

আমার যা ছিল, সব রুদ্রকেই দিয়েছিলাম আমি। অতি তুচ্ছ নিভৃতের ঠিকানাও। এ সম্ভবত তার সান্ত্বনা যে কিছু একটা তাকে দেওয়ার আমার অভাব ছিল, তাই এমন গোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু কিছু একটা তাকে দিইনি বলেই সম্পর্কটির এই দশা আজ। অথচ কোনও গোপন কিছু ছিল না আমার। নিজের জন্য কিচ্ছু ছিল না। উকিলের কাগজে আমি সই করেছি, দাবি মত টাকাও দিয়ে এসেছি। এরপর আর খোঁজ নিইনি কি ঘটেছে। শুধু এটুকু জানি, রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয় আমার, আবার এও জানি রুদ্রকে আমি ভালবাসি, রুদ্র ছাড়াও জীবন যাপন করা অসম্ভব। যে রকম হুট করে বিয়ের কাগজে সই করেছিলাম, তালাকের কাগজেও তেমন করে করেছি। স্বপ্নহীন ধূসর জীবন নিয়ে বসে থেকে থেকে নিজেকে বারবার বলছি, যে তোমাকে অপমান করেছে, তার কাছে আর যেও না মেয়ে, আর কষ্ট পেও না। তোমার প্রেমের এতটুকু মূল্য সে দেয়নি। কোনওদিনই সে দেবে না। মুক্ত দাম্পত্যে সে বিশ্বাস করে, যে দাম্পত্যে কোনও প্রতিশ্রুতি থাকে না। সে যে কোনও ঘাটের জল খাওয়া ছেলে, যে করেই হোক সুখের −স্রাতে গা ভাসাবে সে, পাড়ে কে একা দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়, ফিরে তাকাবে না। রুদ্রকে ত্যাগ করেছি, কিন্তু তার স্মৃতিগুলোই আমাকে দুবেলা গুছোতে হয়। রুদ্রকে ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু নির্জন দুপুরে বাড়ির বারান্দায় বসে উঠোনের খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে যে মানুষের কথা ভাবি, না ভেবে পারি না, সে রুদ্র। বুক মুচড়ে একটি অসহ্য কষ্ট উঠে আসে চোখে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি যেন রুদ্র নামক দুঃস্বপ্নটি, পেছনে ফেলে আসা আমার কালো অতীতটি আমাকে আর স্পর্শ করতে না পারে। আমি ব্যর্থ হতে থাকি। আমি বুঝি, খুব গোপনে গোপনে বুঝি, রুদ্রর জন্য ভালবাসা আমার আজও ফুরোয়নি। কিন্তু আমিই কি চাই এ ফুরোক!

ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো সর্বগ্রাসী প্রেম।
ব্যথিত স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি নিরুদ্দেশ খেয়া,
কোথাও বন্ধন নেই, স্নেহময় শীতলতা নেই,
কোথায় আশ্রয় নেই, ক্ষমা নেই, সুবিপুল ক্ষমা।

সারাদিন অন্ধকার চাষ করে ফিরে আসি ঘরে,
সারারাত বেদনার বীজ বুনি বুকের ভেতর—
তুমি তো আশ্রয় জানি, ফিরে আসবার স্নিগ্ধ নীড়,
মায়ের আঁচল তুমি—ফিরে এসো নিকষিত হেম।

আমাকে ভাঙছে ঋতু প্রকৃতি ও বিরুদ্ধ সময়,
মানুষের নৃশংসতা, ক্ষমাহীন চেতনার নোখ।
আমাকে ভাঙছে প্রেম, একই সাথে প্রেমহীনতাও—
না পেয়ে কেঁদেছি যত, পেয়ে বুঝি তারচে অধিক।

আমাকে জবাই করে নৈরাজ্যের নিরাকার চাকু
অস্থির অ−শ্বর ক্ষুর অবিশ্বাস আমাকে পোড়ায়।
সভয়ে গুটিয়ে রাখি বিশ্বাসের সুকোমল ডানা,
আশ্বিনের চাঁদ ওঠে, জেনে যায় অবিশ্বাসী নাম।

চারপাশে ফণা তোলে অন্ধ জল—ফিরে এসো তীর,
ফিরে এসো খড়কুটো, ভাসমান কাঠের শরীর।
পরিত্রাণ ফিরে এসো, তুলে নাও আমার সকল,
আমার ব্যর্থতা, পাপ, ভালবাসা, ঘণৃা ও আদোর।
রাতের সুতীব্র স্রোত হু হু করে টেনে নিয়ে যায়,
ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো রোদের সকাল।

কিন্তু কার কাছে ফিরব! সে তো আমাকে দুঃখ দেবে আরও। দুঃখ দেবে জেনেও যখন তাঁর শ্মশান কবিতাটি পড়ি, চোখে জল জমে। আমি ভেঙে পড়ি ভালবাসায়, বেদনায়।

বাড়াই তৃষ্ণার হাত, ফিরে আসে শূন্যতাকে ছুঁয়ে
তুমি নেই, নিষ্প্রদীপ মহড়ায় জ্বলে থাকে একা
পাথরের মত ঠাণ্ডা একজোড়া মানবিক চোখ,
তৃষ্ণাতর্ শরীর জুড়ে জেগে থাকে ব্যথিত রোদন।

নরম আলোর চাঁদ মরে যায় অঘ্রাণের রাতে,
বেঁচে থাকে ভালবাসা, নক্ষত্রের আলোকিত স্মৃতি।
তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস, বেদনার ঘ্রাণ,
তোমার না থাকা জুড়ে জেগে থাকে সহস্র শ্মশান।

জীবন গুছিয়ে নিয়েছি ময়মনসিংহে। অবকাশে নিজের ঘরটি আবার নতুন করে গুছিয়েছি। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। ঘরের মেয়ে তো ঘরেই ছিল, কেবল হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। সেই উধাও হওয়ার পাট চুকেছে। পুরোটাই কি চুকেছে! হঠাৎ একদিন এক মন-খারাপ-করা বিকেলে ঢাকায় এসো, আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, টেলিগ্রামটি পেয়ে উতল হাওয়ায় ভাসি, আমি যে রুদ্রর কেউ নই আর, সব সম্পর্ক যে চুকে বুকে গেছে, ভুলে গিয়ে, দুদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা ছুটি। দরজায় কড়া নাড়ি, রুদ্র দরজা খুলে দেয়। যেন জানতই আমি আসব। কথাহীন নিঃশব্দে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি দুজন। একটি উষ্ণ হাত আমাকে আলতো স্পর্শ করে। একটি স্পর্শই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেয় সমস্ত শরীরে। আমাকে সে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে রাখে অনেকক্ষণ। কাঁদে। আমার কাঁধে, বুকে ফোঁটা ফোঁটা জল। কণ্ঠের নিচে কষ্ট জমে থাকে, কেঁদো না, এই ছোট্ট কথাটি জমা-কষ্টের তলে চাপা পড়ে। চোখের জল মুছিয়ে দিই তার। ঘরটি দেখি, সেই আগের মত সব, যেভাবে ছিল। দুচোখে সংসার দেখি আমার। রুদ্র আমার ঘাড়ে গলায়, আমার চিবুকে বুকে, ঠোঁটে, চোখের পাতায় চুমু খায়, সারা শরীরে আগের মত চুমু। দীর্ঘদিনের না-স্পর্শ শরীর রুদ্রর স্পর্শে তছনছ হয়ে যায়। যেন আগের মত জীবন আমাদের। যেন আগের মত আমরা যৌথজীবনের স্বপ্ন নিয়ে শরীর এবং হৃদয় বিনিময় করছি। পারিনি ভাবতে রুদ্র আমার কেউ নয়। মিলনে মিথুনে তৃপ্ত রুদ্র আমার চিবুক তুলে হেসে বলেছে, কি নিজেকে তো খুব শুদ্ধ মানুষ ভাবো তো! এবার? আমি তো তোমার পর পুরুষ, আমার সঙ্গে শুলে যে!

রুদ্রর দগুালে দুহাত রেখে হেসে উঠি। আঙুলের আদর দিয়ে সারা মুখে, বলি, তোমাকে ভালবাসি তাই।

ভালবাসো তাহলে চলে গেলেই বা কেন? আর চলেই যদি গেলে তাহলে এলেই বা কেন?

তুমি ডাকলে যে।

আমি ডাকলেই বা কি? আমার সঙ্গে তো তুমি কোনও সম্পর্কে রাখোনি।

আমি তো এখনও নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।

যুদ্ধ কেন?

নিজেকে যেন ভালবাসতে পারি। অন্যকে ভালবাসতে ভালবাসতে এই হয়েছে যে নিজেকেও যে ভালবাসা উচিত, সেটি ভুলে গিয়েছিলাম।

আমার বুকে মাথা রেখে ছোট্ট শিশুর মত শুয়ে থাকে রুদ্র। চুলে আঙুল বুলিয়ে দিই। বলে, চল উকিলের কাছে আবার। তালাকের কাগজটি তিনি যেন তৈরি না করেন।

আমি ম্লান হাসি।

সে রাতে কেঁপে জ্বর আসে আমার। পরদিনও জ্বর হু হু করে কেবলই বাড়ে। দুপুরবেলা আমার ওই জ্বর-শরীরের পাশ থেকে রুদ্র উঠে যায় কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ে, কে নাড়ে, কে জানে! পাশের ঘরে অতিথির সঙ্গে কথা বলছে রুদ্র। একটু জলের জন্য কাতরাই, রুদ্র নেই। ঘন্টা দুই পর সে ফেরে, খানিকক্ষণের জন্য।

কে এসেছে?

নেলি।

সেই নেলি! রুদ্রর নেলিখালা।

রুদ্র আর নেলির টুকরো টুকরো কথা, হাসি, অট্টহাসি, ফিসফিস, খিলখিল ভেসে আসে শোবার ঘরে। আমি সব নিয়ে জ্বরে ভুগি। মনে হতে থাকে রুদ্র আজও নেলিকে ভালবাসে। কিছু কিছু ভালবাসা আছে, সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও, থেকে যায়। জ্বর আমাকে যত না কাপাঁয়, তার চেয়ে বেশি কাপাঁয় নিঃসঙ্গতা। আরও ঘন্টা দুই গেলে রুদ্র যখন নেলিকে বিদেয় দিয়ে ফিরে আসে শোবার ঘরে, আমি জ্বর-কণ্ঠে জড়-কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, নেলি কি করে জানল এ বাড়ির ঠিকানা?

আগে এসেছে।

প্রায়ই আসে বুঝি।

প্রায়ই না। মাঝে মাঝে।

ও।

আমার কি সামান্য ঈর্ষা হয়! হয়। প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না, তুমি হও যার তার খেলুড়ে পুরুষ। যার তার পুরুষকে আমি আমার বলি না।

প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি, ফুলশয্যা কাকে বলে আমি জানি। কাকে বলে সারারাত জেগে থাকা বন্দরের ভয়ানক রাত। আমি জানি, আমার হাড় মাংস জানে, জানে বন্দরের সব কটি সাম্পান মাঝি, জানে কা−র্গার শ্রমিক, ভোরের লঞ্চ জানে, তুমিও কি কিছু কম জানো? ভালবাসা কতটুকু সর্বনাশা হলে সাঁতার না জানা দেহ রূপসার জলে ভেসে ফের ফিরে আসে। দিগন্তের ওইপার থেকে ফের, চতুর্দোলায় দুলে, দ্বিধার আগুনে পুড়ে ফের, নর্দমায় পড়ে থাকা মাতালের অপুষ্ট বাহুতে মুখ রেখে আরেকবার কেঁদে উঠতে ফের ফিরে আসে, বানিশান্তা থেকে তুলে আনা পুঁজ রক্ত চুমুকে চুমুকে নিতে ফিরে আসে ভিনদেশি বেভুল বালিকা। তুমি মদে চুর, তুমি ঘুমে ঘোর, তবু তুমি কিছু কম জানো না, তোমাকে ভেলায় তুলে আমি বেহুলা হয়েছি কতবার কত ক্লান্ত যমুনায়।

 

যেদিন জ্বর সারে, দুজন বাইরে বেরোই। সেই আগের মত বেরোই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে কিছু তরুণ কবির সভা বসেছে। সভায় আমাদেরও অংশ নেওয়ার কথা। বসে যাই ঘাসে, সেই আগের মত ঘাসে। এরশাদের এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনের প্রতিবাদে পাল্টা একটি কবিতা উৎসব তৈরি করার জন্য সভাটি। কিছু তরুণ কবি, আমি, রুদ্র জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রথম সভার উপস্থিত সদস্য হিসেবে কাগজে সই করি। এসবে রুদ্র অত্যন্ত উৎসাহী। বহুদিন থেকে স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখছে, এবার একটি মোক্ষম অস ্ত্র তার হাতে, এক উৎসব দিয়ে আরেক উৎসব ঠেকানো। গুটিকয় হাতে গোনা সরকারি আর ইসলামপন্থী কবি এরশাদের দলে ভিড়েছে, বাকি সব জাতীয় কবিতা উৎসবে। এরশাদ ওই গুটিকয় নিয়েই নিজের কবিতা উৎসবের নাম দিয়েছেন এশীয় কবিতা উৎসব। এশীয়র আয়োজন বন্ধ ঘরে, জাতীয় খোলা রাস্তায়। এশীয় ঢুকে যায় কুয়োয়, জাতীয় সাঁতার কাটে সমুদ্রে।

 

জাতীয় কবিতা উৎসব নিয়ে রুদ্রর উৎসাহ যখন চরমে, এদিক ওদিক ছুটোছুটির করতে চায় সে, পারে না। ছুটোছুটি তো দূরের কথা, হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়, আগে দশ গজ হাঁটলে হত, এখন চার গজেই হয়। দিন দিন কমে আসছে দূরত্ব। রুদ্র তবু দমে যায় না, থেমে থেমে হলেও হাঁটে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটির রং বদল হচ্ছে, কালচে হয়ে আসছে, ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কালচের ত্বক। যেন আঙুল নয়, গাছের শেকড় এটি। রোগটি নিশ্চিত বারজারস ডিজিজ। আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেলে পা কেটে ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই। আশংকায় নীল হয়ে থাকি। সিগারেট বন্ধ কর। তোমার রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এ হচ্ছে একধরনের পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। তোমার ইন্টারমিটেন্ট ক্লডিকেশন হচ্ছে। এ তোমার কাফ মাসলে হচ্ছে, ফুটে হচ্ছে। এরপর পা রেস্টে থাকলেও ব্যথা হবে। রুদ্র বিশ্বাস করে না সিগারেটের জন্য এসব হতে পারে। কত লোক তো সিগারেট খায়, তাদের হয় না! সবার হয় না, কারও কারও হয়। আমার উপদেশ বাজে কবিতার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেওয়ার মত সে উড়িয়ে দেয়। বড় ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলবে আশায় শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে ডাক্তার প্রজেশ কুমার রায়ের কাছে রুদ্রকে নিয়ে যাই। যে কথাটি তাকে বারবার বলেছি, ডাক্তার প্রজেশও তাই বলেন, সিগারেট ছাড়তে হবে। তা না হলে পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। ডাক্তার কিছু ওষধু ও লিখে দেন। যতদিন ঢাকায় থাকি, রুদ্রকে নিয়মিত ওষধু খাওয়াই, গামলার গরম জলে তার পা দুটো ডুবিয়ে রাখি যেন রক্তনালী সামান্য হলেও প্রসারিত হয়। রুদ্রর ঠোঁট থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিই। ভীষণ রাগ করে সে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে প্রতি সন্ধেয় সে মদ খেতে চলে যায়, টাকা বেশি থাকলে সাকুরায়, কম থাকলে মেথরপট্টিতে। রাস্তায় সুন্দরী মেয়ে দেখলে রিক্সায় বসে এক চোখ টিপে শিস বাজায়, খাসা মাল বলে চেঁচিয়ে ওঠে, হি হি করে হাসে। আমার সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে, আমি আর কোনও বাধা নই রুদ্রর এসব কাজে। অবশ্য ছিলামই বা কবে! ময়মনসিংহে ফেরত যাওয়ার আগে বার বার বলি নিয়মিত ওষধু খেতে, ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলতে, বলি, জীবনের চেয়ে মূল্যবান অন্য কিছু নয়। রুদ্রর প্রেমিকা বা স্ত্রী মনে হয় না নিজেকে, বরং মনে হয় একজন বন্ধু একজন শুভাকাঙ্খি, একজন ডাক্তার।

 

রুদ্র মদ সিগারেট গাঁজা চরস আর মেয়েমানুষের নেশায় আগের মতই বুঁদ হয়ে থাকে। আমার তো ছিল রুদ্রর নেশাই, সেটি কাটাতে আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। ওদিকে রুদ্র টলতে টলতে বলছে

তুমি আমার জীবন্ত ক্রাচ, তোমাকে চাই।
যেদিকে যাই, যেদিকে ফিরি,
স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতে,
আমার এখন তোমাকে চাই।

নাহ, কারও জীবন্ত ক্রাচ হওয়ার জন্য জীবন আমার নয়। নিজের জীবনকে অন্যের ক্রাচ হওয়ার জন্য বিসর্জন আমি দিতে পারি না। রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মায়া হয় নিজের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *