১৩. শুভবিবাহ

শুভবিবাহ

চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে তার মেয়ে বিনিকে নিয়ে বেড়াতে আসে শীলা। শীলা এসেছে খবর পেয়ে দাদা অস্থির হয়ে ওঠেন। বান্ধবী নিলমের বাড়িতে শীলা উঠেছে। শহরের কাচিঝুলির বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে গফরগাঁওএ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে শীলার মা, ভাই বোন। গফরগাওঁ য়ে যাওয়ার পথে ময়মনসিংহ শহরে থেমেছে শীলা, নিলমের সঙ্গেও দেখা হল,জন্মের শহরটিও দেখা হল। কিন্তু দেখতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় দাদার সঙ্গে। দাদার সঙ্গে দেখা হোক শীলা চেয়েছিলই বলে দেখা হয়। সে দেখা থমকে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোমুখি। সে দেখা বুকের মধ্যে একশ কথা জমা থাকার পর একটি কথাও উচ্চাজ্ঞরত না হওয়ার দেখা। সে দেখা অপলক তাকিয়ে থেকে ভিজে ওঠা চোখ আড়াল করতে ডানে বা বামে কোথাও তাকানো। শীলাকে দাদা বাড়িতে আসতে বলেন। নিজে বাজার করেন রুই মাছ, কই মাছ, চিংড়ি মাছ, চিতল মাছ, কিন্তু শীলা যদি মাছ খেতে পছন্দ না করে, তাই সঙ্গে খাসির মাংস, মুরগির মাংস, এমন কি কবুতরের মাংসও—মা সারাদিন ধরে সব রান্না করেন। সন্ধের দিকে বিনিকে সঙ্গে নিয়ে শীলা অবকাশে আসে। সেই আগের মতই আছে শীলা, আগের সেই পানপাতার মত মখু টি আছে, আগের সেই চোখ, চোখের হাসি, গালে শুধু মেচেতার কিছু কালো দাগ পড়েছে। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে শীলা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেন, ভাল আছ শীলা? আহা কতদিন পর তোমারে দেখলাম। কি সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে তোমার! খেতে বসে শীলা বারবারই বলে, কি দরকার ছিল এত কিছুর! শীলার পাতে মাছ মাংস তুলে দিতে দিতে মা বলেন, নোমান শখ কইরা কিনছে, খাও। খাওয়ার পর বিনিকে বারান্দায় খেলতে পাঠিয়ে দাদার ঘরে বসে দাদাকে তার দুঃসহ জীবনের কথা বলে সে। নিজের ভেজা চোখ হাতের তেলোয় মুছে দাদা শীলার চোখের জল মুছিয়ে দেন। শীলা চলে যাওয়ার পর দাদা উদাস শুয়ে থাকেন বিছানায়, চোখ খোলা জানালায়। বাইরের হাওয়া এসে দাদার ভিজে চোখ শুকিয়ে নেয় বারবার। দাদার গালে মেচেতার নয়, চোখের জল শুকোনোর দাগ লেগে থাকে। এভাবে অনেকদিন উদাস মন নিয়ে থেকে বাড়িতে তিনি বলে দিলেন, কেউ যেন তার বিয়ের জন্য আর পাষনী খুঁজে না বেড়ায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি বিয়ে করবেন না। সবাই থ। থ হওয়া সবাইকে সপ্তাহ খানিক পর তিনি জানালেন, যদি বিয়ে করতেই হয় তবে তিনি শীলাকে করবেন। শীলাকে বিয়ে! সবাই আরও থ। বিয়ে হওয়া বাচ্চাঅলা শীলাকে কি করে দাদা বিয়ে করবেন! শীলা স্বামী ছেড়ে দেবে শিগগির। তারপর শীলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন, বিনি আছে তো ক্ষতি কি, বিনি তো শীলারই মেয়ে। দাদা বড় বড় চিঠি লিখতে থাকেন শীলাকে। চিঠিগুলো নিলমের হাতে দিয়ে আসেন,নিলম নিজের চিঠির খামে পুরে দাদার চিঠি ডাকে পাঠিয়ে দেয় চট্টগ্রামে। একদিন খুব ভোরবেলা নিলম এল বাড়িতে, দাদা সারারাত না ঘুমিয়ে নিলম আসার আগেই কাপড়চোপড় পরে তৈরি ছিলেন। দুজন যাচ্ছেন চট্টগ্রামে শীলার কাছে। দাদার পথ আগলাবে এমন শক্তি নেই কারও। দাদা উদভ্রান্তের মত নিলমের সঙ্গে চট্টগ্রাম চলে গেলেন।

চট্টগ্রামে এক সপ্তাহ কাটিয়ে দাদা ফিরে এলেন। এ সম্পণূর্ নতুন এক দাদা। তিনি আর খোলা জানালা সামনে নিয়ে উদাস শুয়ে থাকেন না, বরং শীলা ছাড়া অন্য যে কাউকে বিয়ে করার শখ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মত বেড়ে যায়। চট্টগ্রামে কি ঘটনা ঘটেছে, তা তিনি বাড়ির কাউকে বলেন না। কেবল তাই নয়, শীলা নামটি তিনি মুখে নেন না, যেন শীলা বলে পৃথিবীতে কেউ নেই কিছু নেই। কেউ জানতে চাইলে তিনি পাথরের ওপর বসা পতেঙ্গা সমুদ্র বন্দরে তোলা নিজের কয়েকটি ফটো দেখান আর বলেন চট্টগ্রাম জায়গাটা খারাপ না, ভালই।

দাদার বন্ধুবান্ধবদের বিয়ে তো বিয়ে, বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে গেছে, এমন কি যে আদুভাই ফরহাদের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আগে বিয়ের নামগন্ধ নেওয়া নিষেধ ছিল, তিনিও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ দিয়ে বিয়ে করে ফেলেছেন। দাদার তো আর কিছু পাশ দেওয়ার নেই। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছেন, এখনও যদি বিয়ে না করেন, তবে বাকি জীবনে আর বিয়ে করতে পারবেন বলে, দাদার অনেক বন্ধুরাই ধারণা দিয়েছে,মনে হয় না। দাদা প্রতি সপ্তাহেই মেয়ে দেখছেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আবার সেই একই মুশকিল, পছন্দ হচ্ছে না কাউকে। ফাইসন্স কোম্পানীর নতুন প্রতিনিধি ফজলুল করিম দাদার চেয়ে বছর চারেকের ছোট, এ শহরে নতুন এসে শহরের আচার ব্যবহার বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে করে ফেলেছেন, বউ ইয়াসমিনের ক্লাসের এক মেয়েকে। ফজলুল করিমের বউ দেখে এসে দাদা ইয়াসমিনকে ধমকের সুরে বললেন তর ক্লাসে এত সুন্দর মেয়ে ছিল, আগে কস নাই ত!

মেয়ে ত আছেই, কিন্তু তোমার মত বুড়ারে বিয়া করব নাকি আমার ক্লাসের মেয়েরা!

কয়েক বছরের বছরের ছোট হওয়া এমন কিছু না।

দাদা শার্ট প্যাণ্টের বোতাম খুলে বসে থাকেন সোফায়। তিনি যে শরীরটিকে বয়ে নিয়ে ঘরে নিয়ে শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে আসবেন, তাঁর সেই উদ্যমটুকওু হারিয়ে গেছে।

ইয়াসমিনের ক্লাসের মেয়েরা তোমার চেয়ে পনর বছরের ছোট দাদা। আমি বলি।

তাইলে তর ক্লাসের কোনও মেয়ে টেয়ে দেখ না!

মেডিকেলের মেয়ে?

না মেডিকেলের মেয়ে বিয়া করা যাবে না।

কেন?

মেয়ে কয়েক বছর পর ডাক্তার হইয়া যাইব। সাবমিসিভ হইব না।

সাবমিসিভ চাও কেন?

আরে মেয়ের উপরে থাকতে হইব না আমার? বউ আমারে মাইনা না চললে ত চলবে না।

ও তোমার ত আবার ডাক্তারদেরে স্যার ডাকতে হয়। মেডিকেলের মেয়েরা ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভরে বিয়া করে না, ওই স্বপ্ন বাদ দেও।

মেডিকেল ত বাদই। মেডিকেলে সুন্দরী মেয়েরা পড়ে না।

দাদার আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এমন এক মেয়ে চাই, মেয়ে এমএ পাশ হলেও চলবে না, কারণ দাদার এম এ পাশ হয় নি, দাদার চেয়ে বেশি শিক্ষিত মেয়ে হলে বিপদ। দাদা আমার ইশকুল বা মুমিনুন্নিসা কলেজের পুরোনো বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন।

কেউ কি ছিল না সুন্দরী?

আমি বলি, মমতা ছিল কিন্তু ওর তো বিয়া হইয়া গেছে।

আরেকটা মমতা ছিল তো তর ইশকুলে, বাঘমারা থাকত। ভাল ছাত্রী, হেভি সুন্দরী।

ওরও বিয়া হইয়া গেছে।

এই মুশকিল সুন্দরী মেয়েগুলার ইশকুলে থাকতেই বিয়া হইয়া যায়। আইএ বিএ যারা পাশ কইরা ফালায়, অথচ বিয়া হয় না, তারা দেখবি, দুনিয়ার পচা দেখতে। হয় দাঁত উঁচা, নয় ঠোঁট উঁচা। কিছু একটা উঁচাই।

মা বলেন, নোমান, কত ভাল ভাল মেয়ে দেখলি, তর কাউরে পছন্দ হইল না, না জানি শেষ পর্যন্ত তর কপালে কী আছে।

কপালের কথায় দাদা সামান্য উদ্যম ফিরে পান, তিনি শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বারান্দার চেয়ারে বসে গা চুলকোতে চুলকোতে বলেন, সুন্দরী মেয়ে না পাইলে বিয়াই করতাম না ইনশাল্লাহ। অসুন্দরী মেয়েরে বিয়া করার চেয়ে সারাজীবন আনম্যারেড থাকা ভাল।

সেবনিরে দেইখা আইলাম, কি সুন্দর মেয়ে, তর পছন্দ হইল না। মেয়েটা খুব নামাজি, পর্দা করে। আদব কায়দা জানে, বিএ পাশ করছে।

বেশি নামাজি আবার ভালা না মা। দাদা একগাল হেসে বলেন।

ওই সেবনিরে বিয়া না কইরা ভালই হইছে। মার বোরখার জ্বালায় বাঁচি না। বাড়ির মধ্যে দুই বোরখাউলি থাকলে বিপদ আছে। আমি ফোড়ন কাটি।

মা ধমকে ওঠেন, সাবধানে কথা ক নাসরিন।

মার ধমক আমার কানে পৌঁছয় না। পৌঁছয় না কারণ আমি মুমিনুন্নিসার মেয়েদের মুখের ছবি চোখ্যে ভাসাচ্ছি। সুন্দরী কে ছিল দেখতে। বিড়বিড় করি, মুমিনুন্নিসা কলেজে আর্টসে একটা সুন্দরী মেয়ে পড়ত। ও আবার নাফিসার বান্ধবী।

নাফিসা কেডা?

নাফিসা আমার সাথে মডেলেও পড়ছে, মুমিনুন্নিসায় পড়ছে।

ওই নাফিসা! উফ, ভুটকি। তর বান্ধবীগুলাও যা না! এক তো চন্দনা চাকমারে বন্ধু বানাইলি, নাক বোঁচা চাকমা। তর চয়েস দেখলে আমার .. কি কইতাম।

নাফিসাকে দাদা চেনেন। এ বাড়িতে এসেছেও ও। ওর বড় ভাই আবার দাদার সঙ্গে একই কলেজে একই ক্লাসে কোনও এক কালে পড়ত। এখন রাশভারি ভদ্রলোক, ঢাকায় চাকরি বাকরি করেন।

নাফিসা তো মেডিকেলে ভর্তি হইছে।

তা সুন্দরী মেয়েডা কেডা, ক।

নাম হাসিনা। আর্টস এ পড়ত, মুমিনুন্নিসায়, কথাবার্তা বেশি হয় নাই। নাফিসার সাথে খাতির ছিল খুব।

দাদা সিদ্ধান্ত নেন, এই মেয়ে তিনি দেখবেন।

 

নাফিসার কাছ থেকে হাসিনার একটা ফটো এনে দেখালাম দাদাকে। দাদা বললেন, এই মেয়ে তিনি দেখতে যাবেন। ব্যস, আয়োজন হল মেয়ে দেখার, দাদা মেয়ে দেখে এসে বললেন, চলে।

চলে মানে? বিয়া করবা?

আহামরি কিছু না দেখতে, তবে করা যায় বিয়া।

দাদার মুখে করা যায় বিয়া, এই বাক্যটি আমাদের বিস্মিত করে,আনন্দিতও। কারণ দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বিয়ের জন্য ঝুলে থাকতে থাকতে দাদার জন্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত পাত্রদায়গ্রস্ত আত্মীয় আমরা ভুগেছি। দাদার পছন্দের কথা শুনে বাবা বললেন, মেয়ের বাবা কি করে, বাড়ির অবস্থা কিরকম, ভাইয়েরা কি করে, এইসব না জাইনা বিয়া করার জন্য লাফাইলে চলবে?

হাসিনা তার বোনের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করত, তার বোনের স্বামী ছিল রেলওয়ে ইস্কুলের মাস্টার। সেই রেলওয়ে ইস্কুলে ছোটবেলায় হাসিনাও পড়ত, নাফিসাও পড়ত। মুমিনুন্নিসায় হাসিনা মানবিক বিভাগে, নাফিসা অমানবিকে অর্থাৎ বিজ্ঞানে, আমার সঙ্গে। নাফিসাই একদিন দূরে টিনের চালায় ক্লাস করা হাসিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, মানবিকে পড়া মেয়েদের সঙ্গে অমানবিকের মেয়েদের দেখা হয় না বড়। হাসিনার সঙ্গেও দেখা হত না। সেই হাসিনা, ডাগর চোখের হাসিনা আমার দাদার বউ হবে! বাহ! যা আমার জানা ছিল না, নাফিসার কাছ থেকেই জানি, হাসিনার বাপ নেই, মা আছে। কিছু ভাই আছে, কিছু বোনও। এটুকু ছাড়া আর বেশি তথ্য আমি বাড়িতে জানাতে পারি না। দাদা খবর নিয়ে আরও তথ্য যোগাড় করে জানালেন, ফুলপুর শহর থেকে মাইল দশেক ভেতরে অর্জুনখিলা গ্রামে মেয়ের মা থাকেন, ভাই একজন চাকরি করে ফুলপুর শহরে, আরেকজন ময়মনসিংহ শহরে, খুব বড় কোনও চাকরি নয়, কিন্তু চাকরি। খেয়ে পরে চলে যায়। আরেক ভাই টুডাইল্যা, গ্রামে বসে আছে, বড় বোন যার বাড়িতে মেয়ে থাকত,তার নাম কুসুম। কুসুমের দু ছেলে। সম্প্রতি স্বামী ত্যাগ করে এক বিবাহিত লোকের সঙ্গে ভেগে গেছে, বিয়েও হয়েছে সে লোকের সঙ্গে। দ্বিতীয় বোন, পারভিন। অবশ্য পারভিনকে ছোটবেলায় পালক দেওয়া হয়েছিল ওর নিজের ফুফুর কাছে। ফুফুকেই মা বলে ডাকে পারভিন, আর নিজের মাকে ডাকে মামি বলে। পারভিনের ভাসুর হচ্ছেন স্বয়ং আমানুল্লাহ চৌধুরি, ছোটদার চাকরির মামাচাচা। তথ্য বাবা শোনেন, কিন্তু তথ্য পছন্দ হয় না। মেয়ে সুন্দরী, মেয়ে মুমিনুন্নেসায় বিএ পড়ে, এ জেনেও বাবা মখু ভার করে থাকেন। মেয়ের বাবাভাই ধন সম্পদ করেনি, নামও নেই শহরে, ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ের বড় বোন স্বামী ছেড়ে দিয়ে অন্য লোকের সঙ্গে চলে গেছে, এই জিনিসটি বাবাকে খোঁচাতে থাকে। এই জিনিসটি যে দাদাকে খোঁচায় না তা নয়, কিন্তু সুন্দরী মেয়ের যে আকাল দেশে, এ মেয়ে নাকচ করে দিলে তিনি আশংকা করেন পৃথিবীতে সুন্দরী বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

দাদাই যা আছে কপালে বলে ঠায় বসে রইলেন, বিয়ে এ মেয়েকেই করবেন তিনি। বাবাকে অহর্নিশি বলতে থাকেন মা, রাজি হইয়া যান, এহন যদি বিয়া না হয় নোমানের, জীবনে হয়ত আর হইবই না। বাবাকে বলে কয়ে না থেকে নিমরাজি করার পর পর ই দাদা তারিখ নিয়ে বসলেন। ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে বিয়ে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে তিনি দৌড়ে দৌড়ে কেনাকাটা শুরু করলেন। বাড়ি সাজানোর যা বাকি ছিল, সেরে ফেললেন। আমার জন্য হলুদ, ইয়াসমিনের নীল আর গীতার জন্য সবুজ রঙের কাতান শাড়ি কিনলেন, বিয়েতে পরার জন্য। গায়ে হলুদ এ পরার জন্যও সবাইকে লাল পাড় হলুদ শাড়ি দিলেন। সাজানো কুলো থেকে শুরু করে, মেয়ের জন্য শাড়ি কাপড় প্রসাধন, কেবল মেয়ের জন্যই শাড়ি নয়, মেয়ের মা নানি দাদি ইত্যাদি সবার জন্যই সব কেনা হল। সবকিছুর টাকা অবশ্য বাবা দিচ্ছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ বাবাকেই পোষাতে হবে, যেহেতু তিনি বাবা। শখের জিনিসপাতির খরচ দাদার পকেট থেকে। যেমন পৃথিবীতে সব চেয়ে সুন্দর বউভাতের নিমনণ্ত্র পত্র করার ইচ্ছেয় তিনি মখমলের লাল কাপড়ে নিমন্ত্রণপত্র নয় নিমনণ্ত্র কাব্য লিখে আনলেন, শিল্পী দিয়ে হাতে লিখিয়ে। একটি লাল সুসজ্জিত সুঅঙ্কিত লম্বা কৌটোয় মখমলের কাপড়টি থাকবে, কাপড়ের দুদিকে ঝুনঝুনিঅলা রুপোর কাঠি। নিমনণ্ত্র কাব্যটি পড়তেও হয় রাজাবাদশাদের কাছে পাঠানো ফরমান পড়ার মত। দাদার মাথা থেকে আরও নানা সুড়সুড় করে আরও শিল্প বেরোচ্ছে, নিজের ঘরখানা রাজাবাদশাহদের ঘরের মত সাজিয়েছেন। বিয়ের খাট সাজানোর জন্য শহরের সেরা শিল্পীদের বলে রেখেছেন। কয়েকহাজার গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকায় খাট সাজানো হবে। লাল কার্পেট পেতে দিতে হবে কালো ফটক থেকে ঘর অবদি। বাবার কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে বউএর জন্য লাল বেনারসি আর প্রচুর সোনার গয়না দাদা নিজে ঢাকা গিয়ে কিনে আনেন। বিয়ের বাজার সারতেই মাস কেটে যায়।

গায়ে হলুদের দিন আমরা, আমি, রুনুখালা, ইয়াসমিন, ছোটদা, গীতা ফুলপুরের অর্জুনখিলা গ্রামে গিয়ে হাসিনার গায়ে হলুদ লাগিয়ে আসি। সাজানো কুলোয় সাজিয়ে নিই হাসিনার জন্য হলুদ শাড়ি, আর মুখে মাখার সপ্তবণর্ রং। কুলোর পেছনে বত্রিশ রকমের মিষ্টির প্যাকেট। পরদিন দাদার গায়েও হলুদ। দাদা শীতল পাটিতে বসে থাকেন বারান্দায়। আত্মীয়রা দাদার মুখে হলুদ লাগান। সেই শীতল পাটিটি আবার চারজনে ধরে বিছাতে হয়। চারজনের একজন হয়ে প্রচণ্ড উৎসাহে যখন আমি পাটির এক কোণ ধরি, রুনুখালা দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে কোণ কেড়ে নিয়ে বললেন, তর ধরা যাবে না।

কেন ধরা যাবে না?

কারণ আছে। পরে বলব।

আমি পাটি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ম্রিয়মান বসে থাকি। কেন শীতল পাটিটি আমার ধরা যাবে না,এই প্রশ্ন মন থেকে দূর হয় না। রুনুখালা পরে বললেন, তর তো মিনস হইছে, তাই।

কে কইছে হইছে? হয় নাই ত!

ও আমি ভাবছিলাম, হইছে।

হইলেই বা কি? যদি হইত!

ওইসময় শরীর পবিত্র থাকে না। আর বিয়ে শাদির সময় খুব পবিত্র হাতে সবকিছু ধরতে হয়।

শুভ কাজে অশুভ জিনিস দূরে রাখতে হয়।

ও এই কথা!

মাকে ডেকে বলি, মা ওইগুলা হইলে নাকি গায়ে হলুদের পাটি ছোঁয়া যায় না?

মা বললেন, নাপাক শইলে না ছোঁয়াই ভাল।

না ছোঁয়াই ভাল কেন? ছুঁইলে কি হয়?

কি হয় ছুঁইলে মা তা বলেন না, মার ব্যস্ততা বিষম। ঝুনুখালা বলেন, অমঙ্গল হয়। কি রকম অমঙ্গল তা জানতে চেয়েছি, উত্তর পাইনি। বাড়ির পেছনে বাড়ি জীবনদের, জীবনের বিয়ের সময় দেখেছি শীতলপাটির তলে পান সপুারি রাখছেন জীবনের মা, পান সপুারির প্রয়োজন কি তা আমার বোঝা হয়নি। জীবনের বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানটিই আমার দেখা হয়েছে, বরের সামনে আয়না ধরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কি দেখছেন, আয়নায় জীবনের সুন্দর মুখটি, বরের মখু থেকে কথা বেরোয় না, একজন বলে দিল বলতে চাঁদমখু । এরকমই নাকি নিয়ম। নিয়মগুলো আমার অদ্ভুত লাগে। ডলি পালের বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম, ওখানে আগুনের চারদিকে পোতা হয়েছিল চারটি কলাগাছ, কলাগাছের চারপাশ দিয়ে বরবউকে সাত পাক দিতে হল, সারাদিন উপোস থাকা মেয়ে ক্লান্ত শরীরে পাক দিচ্ছিল। জীবনের গায়ে হলুদের দিন রং খেলা হয়েছিল, খেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমি পালিয়ে বাড়ি চলে এসেছি, রঙ খেলার সময় ছুটোছুটি দাপাদাপি আমার স্নায়ুকে বিকল করে দেয়। একইরকম মাহবুবার বোনের গায়ে হলুদের দিন, ওখানেও বরের এক বন্ধু আমাকে রঙ দিতে নিয়েছিল, আমি ছিটকে সরে আসি, দৌড়ে বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে, আমার কেবলই মনে হয় রঙের উদ্দেশ্য বুঝি গায়ে হাত দেওয়া। মাহবুবা আমার চলে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছে। নিজেকে আলগোছে বাঁচিয়ে চলি আমি, ছুটোছুটি দাপাদাপি কাড়াকাড়ি এসবে আমার বড় ভয়।

দাদার গায়ে হলুদে বাড়ির মেয়েরা সব হলুদ শাড়ি পরি। যারাই এসেছে বাড়িতে, এসেছে হলুদ শাড়ি পরে। নানি অবশ্য হলুদ শাড়ি পরেননি। তিনি শাদা শাড়িতেই দাদার মুখে হলুদ লাগিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, সুখী হইও দোয়া করি। নানির কাছে সখু জিনিসটির মূল্য অনেক, মার কাছেও। ছোটদা দূরে আছেন কিন্তু সুখে আছেন এই জিনিসটি ভেবে মা ছোটদার না থাকার কষ্টকে সান্ত্বনা দেন। বাড়ি ভরে গেল হলুদে, হলুদ শাড়িতে, মিষ্টিতে, উৎসবে। নানিবাড়ির সবাই এল, সবাই দাদার শরীরে হলুদ মেখে দিল। হাসিনার বাড়ি থেকে লোক এসে হলুদ দিয়ে গেল দাদার গালে কপালে। দাদাকে বড় নিরীহ দেখতে লাগছিল। হাসিনার আত্মীয়রা পেট পুরে পোলাও মাংস খেয়ে বিদেয় হল। শ্বশুরবাড়ির লোক না হলে ঠিক ঠিকই দাদা চাষাভুষো লোকগুলোকে আনকুথ বলে গাল দিতেন।

 

এরপর তো বিয়ের ধুম। কালো ফটকের সামনে গাছপাতা ফুলপাতায় চমৎকার একটি প্রবেশদ্বার বানানো হয়েছে। বাবার বন্ধুদের গাড়ি ধার করে বাবা, আমরা ছোটরা, দাদার বন্ধুরা গেলাম অর্জুনখিলায়। দাদার মত নিলাজ লোক মুখে রুমাল চেপে বসে রইলেন, মাথায় টোপর, পরনে শাদা শেরওয়ানি, শাদা পাজামা, শাদা নাগরা। বাইরে শামিয়ানার তলে বসে কাজীকে কবুল বললেন, ভেতর ঘরে হাসিনা কাজীর সামনে একই কথা বলল, কবুল। মেয়েদের অবশ্য অমুক লোকের অমুক পুত্রের সঙ্গে এত টাকা দেনমোহরে বিবাহ করিতে রাজি আছ কি না জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলা শোভন দেখায় না, কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদতে হয়, কেঁদে কেটে ক্লান্ত হলে মা খালাদের কিছু ঠেলা গুঁতো খেয়ে শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়। হাসিনা খুব একটা সময় নেয়নি কবুল বলতে। হাসিনার কবুল বলা মানে বিয়ে ঘটে যাওয়া। এবার বিদায় নেবার পালা। হাসিনার মা বাবার হাতে মেয়ে সমপর্ণ করলেন। আমি অবাক হয়ে সব কাণ্ড দেখছিলাম, বিয়ের এমন সব কাণ্ড এত কাছ থেকে আমার আগে দেখা হয় নি। ফুলে সাজানো গাড়িতে দাদা বউ নিয়ে বসলেন, দুপাশে আমি আমি ইয়াসমিন, পেছনের গাড়িতে বরযাষনী। দাদা সব কিছুর নীল নকশা আগে থেকেই এঁকে রেখেছিলেন। নীল নকশা অনুযায়ী আমরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলাম বাড়িতে বরবধূর গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান জমকালো করতে, কুলো থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটোতে বরবধূর গায়ে। কুলো হাতে নিয়ে ফুল ছিটোচ্ছি লাল কাপের্টের কিনারে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বাবা লোক খুঁজছেন বউ বরণ করার জন্য। মা দাঁড়িয়ে ছিলেন খোলা দরজার সামনে বরবধূ বরণ করতে। সারাদিন বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি এই ক্ষণটির। মার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাবার বন্ধুদের বউ। মাকে দরজার সামনে থেকে তুমি সর, দূরে যাও, দূরে যাও বলে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে বাবা এম এ কাহারের ছোটভাই আবদুল মোমিনের বউকে বিগলিত হেসে বললেন, ভাবী আসেন আপনে, আমার ছেলে আর ছেলের বউরে বরণ করেন। মা পেছনে পড়ে রইলেন, ধনী আবদুল মোমিনের সোনার গয়নায় মোড়া বউটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাদার আর লাল ঘোমটা মাথার নতমখু হাসিনার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করলেন। রুনুখালা অবাক তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য, বাড়িতে মা তার ছেলে আর ছেলের বউরে ঢোকালো না! ঢোকালো অন্য কেউ! রুনুখালা সরে যান দৃশ্য থেকে। দাদার কিনে দেওয়া না-কাতান শাড়ি পরে পুত্রবধূসহ পুত্রের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মা বিড়বিড় করে দোয়া পড়েন দাদা আর দাদার বউএর সুখী জীবনের জন্য।

দাদার সাজানো ঘর, বিছানায় ছড়ানো লাল গোলাপের পাপড়ি, ওর মাধ্যে লাল বেনারসি পরা বউ বসেছে। দাদা এঘর ওঘর করেন। দাদাকে দেখে আগের দাদাই মনে হয়, কিন্তু আবার ভাবি এ দাদা আগের দাদা নয়, এ বিবাহিত দাদা। ঠোটেঁ একটি কাঁপা কাপাঁ বিব্রত হাসি লেগে থাকে দাদার। রাতে সোফায় বসে পা নাড়ছিলেন তিনি, বাবা অন্যদিনের মতই বললেন, অনেক রাত হইছে, যাও শুইয়া পড় গিয়া। দাদা শুতে যাবেন তাঁর ঘরে, আগের রাতেও একা শুয়েছেন, আজ তাঁর বিছানায় আরেকজন, যার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়নি, প্রেম হয়নি। আমি ভাবছিলাম কি কথা বলবে দুজন! দুটো অচেনা মানুষ! ইচ্ছে করে দাদার ঘরের দরজায় কান পেতে শুনি কী হচ্ছে ভেতরে! দাদা যদি বউএর কোনও খুঁত আবিষ্কার করেন এই রাতে, তবে আবার রাতেই সোফায় এসে বসে থাকেন কি না। অনেক রাত অবদি বিষম কৌতূুহলের যনণ্ত্রায় আমার ঘুম হয় না।

সকালে দাদা বেরোলেন আগে, পেছন পেছন হাসিনা। দাদার লজ্জা লজ্জা মখু , পেছনে হাসিনার নির্লজ্জ হাসি। বাড়ির সবার চোখ দুজনের মুখে।

ছোটদা চোখ নাচিয়ে বললেন কী বৌদি, নাকের ফুল খুলছিলা রাতে?

হাসিনা খসখসে গলায় বলল কিছু হয় নাই তো।

জিজ্ঞেস করি, নাকের ফুল খুলতে হয় কেন?

হাসিনা আমার পিঠে খোঁচা মেরে বলল, বিয়ের রাতে খুলতে হয়।

কেন খুলতে হয়?

জানো না?

না তো!

ওইগুলা হওয়া মানেই নাকের ফুল খোলা।

ওইগুলা কোনগুলা?

হাসিনা জোরে হাসল।

নিজেকে খুব বোকা মনে হয় আমার। হাসিনা খুব সহজে সহজ হয়ে যায়। ছোটদা বয়সে অনেক বড় হলেও ছোটদাকে দিব্যি নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। গীতাকেও। অবলীলায় তুমি সম্বোধন করছে। সে বড় বউ বলেই নাকি দাদার যারা ছোট, তাদের তার ছোট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। হাসিনাকে অবাক হয়ে দেখি, আমার মনে হয় না মুমিনুন্নিসা কলেজে পড়া এটি সেই মেয়ে, যে মেয়েটিকে দূর থেকে দেখতাম হাঁটছে চত্বরে, নাফিসার সঙ্গে হাতে হাত ধরে।

আনুর মা, বাড়ির নতুন কাজের মহিলা, বালতিতে পানি নিয়ে ঘর মুছতে এল, বললাম, দেখছ নতুন বউরে?

বউএর শইলে তো গোসত নাই।

তা ঠিক, হাসিনার শরীরে মেদমাংসের অভাব, আমার যেমন।

আর বউ তো সকালে গোসলও করল না, কাপড়ও লাড়ল না !

কেন, এই শীতের সময় সকালের ঠাণ্ডা পানিতে কেউ কি গোসল করে নাকি!

হ। সকালে ঘুম থেইকা উইঠাই গোসল কইরা,শইলের কাপড় ধইয়া পরে ঘরে যাইতে হয়।

কেন, দুপুরে গোসল করলে হয় না? আর কাপড় না ধইলে হয় না?

আনুর মা সজোরে মাথা নাড়ে, নিশ্চিত কণ্ঠে বলে, না।

কৌতূুহল আমাকে গ্রাস করছে। হাসিনাকে বলি, কী নাকি গোসল করতে হয়, আর কাপড় ভিজাইতে?

হাসিনা বলল, ওইগুলা হইলে হয়।

ওইগুলা কোনগুলা?

হাসিনা এবারও জোরে হাসল। আমার জানা হল না ওইগুলা কোনগুলা। হাসিনা আর আমি যদিও মুমিনুন্নিসা কলেজে এক বর্ষেই পড়েছি, তাকে আমার মোটেও বান্ধবী গোছের কিছু বলে মনে হয় না, বরং দাদার বউ বলেই মনে হয়। দুদিন পর বউভাতের অনুষ্ঠান। দাদা সকাল থেকে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই চালিয়ে দিয়েছেন ক্যাসেটে। এক পাশ শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিয়ে যান ক্যাসেট, সানাই বেজে চলে সারাদিন। সপুুরুষ দাদা দামি স্যুট পরেছেন, পায়ে বিদেশি জুতো, মেইড ইন ইটালি। মাঠে বিশাল শামিয়ানার নিচে টেবিল চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে। ভেতরের উঠোনেও। টিনের ঘরের পাশে বিশাল গতর্ খুঁড়ে বাবুর্চিরা বিশাল বিশাল পাতিলে বিশাল বিশাল চামচে নেড়ে নেড়ে পোলাও মাংস রান্না করছে। হাসিনা বউভাতের নতুন শাড়ি পরে বিছানায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। অতিথি আসছে উপহার নিয়ে, অতিথি বলতে আত্মীয় স্বজন, দাদার বন্ধু বাবার বন্ধু ছোটদার বন্ধু, আমার আর ইয়াসমিনের কিছু বান্ধবী। কেউ একজন কাগজে লিখে রাখছে উপহারদাতা বা দাষনীর নাম উপহারগুলো এক কোণে জমিয়ে রাখছে। অতিথিরা বউএর মখু দেখে এক এক করে খেতে চলে যাচ্ছে; পুরুষেরা মাঠে, মেয়েমহিলা উঠোনে। দুপুর থেকে বিকেল অবদি এই চলে। ভিড়ের মধ্যে আমার হাঁসফাঁস লাগে। রাত্তিরে ভিড় কমে আসে। তখন উপহার খোলার পালা। কাচের বাসনপত্র, পিতলের কলস, ঘড়ি, শাড়ি, সোনার গয়না ইত্যাদি উপহারে ঘর ভরে ওঠে। দাদা উপহারগুলো নিয়ে নিজের ঘরে গুছিয়ে রাখেন।

 

মাস গেলে হাসিনা আমার কাছে তার একটি সমস্যার কথা বলতে আসে। সমস্যাটি এক আমার কাছে ছাড়া আর কারও কাছে বলা যাবে না। সমস্যাটি কি? হবু ডাক্তার কান পাতে।

বিয়ের প্রথম প্রথম স্বামী স্ত্রীর মিলনের সময় আমি একটা জিনিস পাইতাম, সেইটা আজকাল আর পাইনা।

মিলন শব্দটি শুনে কান লাল হয়ে ওঠে। কানকে আমি যথাসম্ভব বাদামিতে ফিরিয়ে বলি,—কি জিনিস পাইতা?

একটা তৃপ্তি।

আগে পাইতা এখন পাও না, কেন?

তাই তো আমার জিজ্ঞাসা, পাই না কেন?

ইন্টারকোসর্ হইলে তো মেইল অরগান থেকে মানে টেসটিসের পেছন দিকের কয়েল্ড টিউব এপিডিডাইমিস থেকে ভাস ডিফারেন্স হয়ে স্পার্ম চলে যায় ব্লাডারের ওপর দিয়ে ব্লাডারের পেছনেই সেমিনেল ভেসিক্যাল নামের গ্ল্যান্ডে, সেমিনেল ভেসিকেলে সেমিনেল ফ্লুইডএর সাথে মিক্সড হয়ে সিমেন ফর্ম কইরা স্পার্ম ইউরেথ্রা দিয়া পাস করে।

আমি একটি কলম নিয়ে শাদা কাগজে ছবি এঁকে স্পার্মের গতি প্রকৃতি বুঝিয়ে দিই হাসিনাকে। এই হল টেসটিস, এই সেমিনাল ভেসিক্যাল, ভাস ডিফারেন্স, এই হল ইউরিনারি ব্লাডার, এই প্রসটেট, এরপর তীর চিহ্ন দিই ইওরেথ্রার দিকে।

হাসিনার খসখসে কণ্ঠটি তেতে ওঠে, তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমি বলতাছি তৃপ্তির কথা, পাই না কেন!

হাতে কলম আমার, কলমটি দ্রুত নড়ে, কলমটি একবার গালে, একবার চিবুকে, একবার চুলে।

ইজাকুলেশন কি হয়?

বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা নাড়তে নাড়তে নিজের কর্কশ কণ্ঠটি থেকে চেষ্টা করে ফিসফিস আওয়াজ বের করতে ,পারে না। যে কোনও শব্দই তার গলা থেকে ঢোল বাজিয়ে বের হয়। কেউ যেন আচমকা ঘরে না ঢুকে এই গোপন কথা না শোনে, শব্দও যেন ঘরের বাইরে কম যেতে পারে, ভেতর থেকে ছিটকিনি এটেঁ দিই দরজায়।

ইজাকুলেশন কি?

সিমেন সিক্রেশান।

সিমেন কি?

কও কি? সিমেন বুঝো না? মেইল অরগানের যে সিক্রেশান, সেইটারে সিমেন বলে।

ওইটা হয়।

তাইলে ত কোনও অসুবিধা দেখতাছি না।

হাসিনা হতাশার শ্বাস ফেলে চলে যায়। চিকিৎসাবিদ্যার বই ঘেঁটে হাসিনার প্রশ্নের কোথাও কোনও উত্তর আছে কি না খুঁজি। সেক্সুয়াল রিলেশান সম্পর্কে যত কথা আছে সব সারারাত ধরে পড়ে পরদিন বিনে পয়সায় ডাক্তারির উপদেশ দেওয়ার জন্য তাকে ডাকি। হাসিনা দৌড়ে আসে উপদেশ লুফে নিতে। যত লজ্জা ছিল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে আমি যেন দাদার বোন নই, হাসিনাার ননদ নই, একজন ডাক্তার কেবল, এভাবে জিজ্ঞেস করি,— আচ্ছা, তোমার স্বামীর কি ইরেকশান হয়?

তা হয়। হবে না কেন?

তোমার কি ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান হয়?

ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান মানে কি?

মানে তোমার ভ্যাজাইনা থেকে কি কিছু নির্গত হয়?

হ। সেইটা হয়।

প্রিম্যাচিয়র ইজাকুলেশন হয় কি? মানে ইরেকশানের পরই সিমেন বার হয় কি?

না না সেইরকম কিছু হয় না। টাইম তো অনেকক্ষণ নেয়। বরং আগের চেয়ে বেশি। কিন্তু তৃপ্তি পাই না।

তোমার কি ডিসপেরিনিয়া আছে? মানে কপুলেশানের সময় কি তোমার পেইন হয়? না।

ভ্যাজাইনিসমুস আছে কি? মাসল স্পাসম বেশি হওয়ার কারণে তা হয়। অথবা হাইপোথাইরোডিসম থাকলে সেক্সুয়াল ডিসফাংশান হইতে পারে।

তা তো জানি না, সব আগের মতই আছে, খালি এই দু সপ্তাহ হইল এই সমস্যা হইতাছে।

শুন, হাইপোথ্যালামাস নামে একটা জিনিস আছে, সেইটা ব্রেইন এর থার্ড ভেন্ট্রিক্যালের লোয়ার পাটের্ থাকে। এই হাইপোথ্যালামাসের সঙ্গে পিটিউটারি গ্ল্যান্ডের কানেকশান আছে। বাদ দেও, তোমারে সংক্ষেপে বলি, গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন হাইপোথ্যালামাস থেইকা আইসা পিটিউটারি গ্ল্যান্ডরে স্টিমুলেট কইরা লিউটিনাইজিং হরমোন আর ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন সিত্রে²ট করাচ্ছে। লিউটিনাইজিং হরমোন আবার টেসটিসের লেইডিগ সেলকে স্টিমুলেট করে টেস্টোস্টেরন রিলিজ করাচ্ছে। ওদিকে ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন সেমিনিফেরাস টিবিউলসের সেলকে স্টিমুলেট করছে। এইভাবে স্পার্ম ডেভেলপ হচ্ছে। এসবের কোনও ফাংশানে যদি এবনরমালিটি দেখা দেয় তাইলে সেক্সুয়াল ডিসফাংশান হবে।

ডিসফাংশানের কিছু নাই। সব ফাংশান ঠিক আছে।

ঠিক থাকলে অসুবিধা কোথায়?

মিলনের সময় যে ফিলিংস, সেইটা পাইতাছি। কিন্তু একটা তৃপ্তি আসে একসময়, সেইটা আসতাছে না।

পার্থক্যটা কি?

মিলনের সময় একটা সুখ পাই। আর ওইটার সময় আরেক রকম। মিলন হওয়া আর ওইটা পাওয়া এক না।

তোমার পার্টনারও কি পায় না, যা পাওয়ার কথা বলতাছ?

আরে সে তো পায়ই।

সে পাইলে তুমি পাইবা না কেন?

তার পাওয়া আর আমার পাওয়া এক না।

এক হবে না কেন? জিনিসটা তো দুইজনের ব্যাপার।

এক না তো বললাম।

এইটা কোনও কথা হইল, এক হবে না কেন? ইরেকশান হইতাছে, এইদিকে ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান ঠিক আছে। তার মানে হরমোনের একটিভিটিসগুলা ঠিক আছে। প্রিম্যাচুয়র ইজাকুলেশনও হয় না। তাইলে তো আমি কোনও সমস্যা দেখতাছি না।

আছে সমস্যা। কোথাও নিশ্চয় কোনও সমস্যা আছে। তা না হইলে আমি ওইটা পাইতাছি না কেন?

আবারও বই ঘেঁটে নতুন কিছু উদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।

হাসিনা আশা ছেড়ে দিয়ে বলে, আমাকে গাইনির ডাক্তারের কাছে নিয়া চল।

হাসিনাকে গায়নোকলোজির অধ্যাপক, চরপাড়ায় নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখেন, আনোয়ারুল আজিমের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তারের সঙ্গে সে একা কথা বলে অনেকক্ষণ। বেরিয়ে আসে সমাধান-পাওয়া-হাসি মুখে নিয়ে।

জিজ্ঞেস করি, কি বলল ডাক্তার?

হাসিনা হাসল, দেঁতো হাসি সারা মুখে, রহস্যের এক পুকুর জলে টুপ করে ডুব দিয়ে বলল, তুমি বুঝবা না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *