১৫. কাগজের বউ

কাগজের বউ

ডালিয়া জাহানের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসতে থাকে নিয়মিত। কখনও মোংলা বা মিঠেখালি থেকে, কখনও ঢাকা থেকে। রুদ্রর চিঠি হাতে নিয়ে টের পাই বুকের মধ্যে কেমন করা।চঠি যেদিন পাই, এক অমল আনন্দ আমাকে সারাদিন ঘিরে থাকে।

তুমিহীন একটি মুহূতর্ এখন যে কত দুঃসহ তা তোমাকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। তোমাকে ছাড়া আমার দিনগুলো যে কি রকম বিশৃঙ্খল আর কি রকম অসংযত তুমি তো তা বুঝতেই চাও না। জানি, অনেক সমস্যা আছে, এ মুহূর্তে তোমাকে কাছে পেতে গেলে হাজার হাজার সমস্যা জেঁকে বসবে। পরেও কিন্তু এ সমস্যাগুলো আমাদের নিস্তার দেবে না। কাজেই যে সমস্যাকে একদিন না একদিন মোকাবেলা করতে হবে তাকে এখনই সামনে নিয়ে আসা উচিত। লুকোচুরি করে তো আর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্যেই দাদার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। আমরা বিয়ে করেছি এটা জানাতে চেয়েছিলাম, তুমি শুনলে না। আমার দিন আর রাত্রিগুলোকে অসংযম আর অনিয়মের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তুমি খুব সুখে আছো। তোমার এই উদাসীন ভাল থাকা আমাকে ভীষণ ঈর্ষাকাতর করে তোলে। আমি পারি না। আমি কোনোভাবেই নিজেকে বাধ্য রাখতে পারি না।

আকাশে মেঘের মত প্রতিদিন স্বপ্ন জমে বৃষ্টি হয় না। তুমিহীন দিন যায়, রাত্রি যায়। তোমার স্পর্শহীন এই ঊষর প্রান্তর…। কতদিন তোমাকে দেখি না! কতদিন তোমার আনতচোখদুটিকে আদর করি না! ভীষণ কুয়াশাচ্ছত তোমার চোখ, ভীষণ মেঘলা আর ভীষণ সুদূরের। কবে আমি ওই কুয়াশা পার হয়ে তোমাকে ছোঁবো! কবে আমি ওই মেঘের মানে বুঝতে পারব! অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রতীক্ষা আর ফুরোয় না। প্রিয় স্পর্শ নেই, দিনগুলো প্রাণহীন! প্রিয় স্পর্শ নেই, রাত্রিগুলো কি শীতল আর ক্লান্তিময়! এই শীতল আধাঁরে তুমি রোদের উত্তাপ নিয়ে কবে আসবে? আজ মন ভাল নেই, নির্জন আর সেই খুব শান্ত কষ্টগুলো সারাদিন আজ আমার বুকের ভেতরে জমে উঠেছে। কোনও ভাষায় আমি এই কষ্টগুলো বোঝাতে পারি না। মেঘলা আকাশের মত ভারি, শীতল আর কি শান্ত এই কষ্ট আমার!আজ আমার মন ভাল নেই। আজ খুব শীতল কষ্ট।

রুদ্রর কষ্টগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু আমার পক্ষে তার ইচ্ছেকে পণূর্ তা দেওয়া সম্ভব হয় না। রুদ্র স্বামীর দাবি নিয়ে বলে, বাড়িতে বল যে বিয়ে করেছি, নিজে বলতে না পারো কাউকে দিয়ে বলাও। এও যে সম্ভব নয়, তা আমি বারবার বলি। কোনও কাউকে দিয়ে এ কথাটি উচ্চারণ করানো যাবে না, যে, আমি এক চালচুলোহীন কবি কে বিয়ে করে বসে আছি। রুদ্রর ধারণা বিয়ের কথা বাড়িতে জানালে বাবা আমাদের আড়ম্বর করে বিয়ে দেবেন, তারপর আমি রুদ্রর সঙ্গে সংসার করতে চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে অথবা রুদ্রই এ বাড়িতে জামাই আদরে থাকবে অথবা বাড়ি থেকে যদি আমাকে তাড়িয়েও দেয় তবে আমি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাব, ছুটিছাটায় রুদ্রর কাছে ঢাকায় যাব অথবা এই কলেজ থেকে বদলি হয়ে অন্য কলেজে, যেন তার সঙ্গে সংসারও করতে পারি, কলেজেও যেতে পারি এমন অথবা অন্য কিছু অথবা লেখাপড়া ছেড়েই দেওয়া। সংসার করার জন্য রুদ্র উন্মাদ হলেও আমি হই না। রুদ্রই জীবনে একটি বড় অনিশ্চিতি, এরপর আরও একটি অনিশ্চিতিকে স্বাগত জানাতে আমার একবিন্দু সাহস হয় না।

রুদ্র ময়মনসিংহে আসে দেখা করতে। যেদিন আসার কথা থাকে আসতে পারে না। আমি দীর্ঘক্ষণ প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। কথা দেওয়া তারিখে সে যে সবসময় আসতে পারে, তা নয়। তবে যে করেই হোক, সে তারিখে না হোক, কাছাকাছি অন্য একটি তারিখ বেছে চলে আসে। কলেজ ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না তাছাড়া কলেজ ক্যান্টিন কলেজের ছাত্রছাত্রীর জন্য, ক্যান্টিনে রুদ্রর উপস্থিতি লোকে প্রথম প্রথম আড়চোখে দেখত, এখন বড় বড় চোখ করে দেখে। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর জমে ওঠাটিও খুব ভাল চোখে দেখা হয় না। আসাদ আর আনোয়ারকে মেডিকেলের খারাপ ছাত্র তো বটেই গুণ্ডা ছাত্র বলে মনে করা হয়, মেডিকেলে ঘটা যে কোনও খারাপ কাজের জন্য ওদের দায়ি করা হয়। ওরা মদ খায় বলেও গুঞ্জন আছে। রুদ্রকে কলেজের ক্যান্টিনে দেখে একদিন কথা বলতে এল আসাদ, দুজন নাকি একই কলেজে লেখাপড়া করেছে, একই ক্লাসে। ব্যস, হয়ে গেল। জমে গেল। ত্রাস দুটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ছাত্রছাত্রীরা, এক পথে ওদের আসতে দেখলে, বিশেষ করে ছাত্রীরা, অন্য পথ ধরে। কিন্তু ত্রাসদুটি আমাকে রুদ্রর সঙ্গে জমে ওঠার পর খাতির করে, কি নাসরিন কেমন আছো বলে এগিয়ে আসে দুজনই। আমারও হেসে বলতে হয় ভাল। ধীরে ধীরে একটি জিনিস আমি উপলব্ধি করি, ওরা আমার জন্য ত্রাস নয়, আর যার জন্যই হোক। রুদ্র না থাকলেও ওদের সঙ্গে বসে ক্যান্টিনে চা খেয়েছি, আসাদের হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বা আনোয়ারের কপালে কাটা দাগ হয়ত থাকে, কিন্তু কখনও মনে হয়নি ওরা খারাপ লোক, বরং অনেকের চেয়ে অনেক আন্তরিক আর সৎ মনে হয় ওদের। মাঝে মাঝেই ওরা বুক ফুলিয়ে বলে কেউ তোমারে ডিসটার্ব করে কিনা জানাইও, নাকের হাড্ডি ভাইঙ্গা দেওয়ার জন্য আমরা রেডি আছি। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর আড্ডা দেওয়া অন্য ছাত্রদের চোখ আরও বড় করে। দুপুরবেলা চা সিঙ্গারা খেয়ে আমাদের দুপুরের পেট কামড়ে ধরা ক্ষিধেও মরে না, একসময় উঠতেই হয়। কলেজে আসা যাওয়ার পথে সি কে ঘোষ রোডের প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনটি আবিস্কার করে ওতেই আজকাল দেখা করি রুদ্রর সঙ্গে। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে যে হলুদ রঙের বিরানি পাওয়া যায়, তা রীতিমত বিখ্যাত। রামপ্রসাদ বাবু মারা যাওয়ার পর তার ফটো টাঙিয়ে ফটোর ওপর মালা ঝুলিয়ে বাবুর ছেলে হরিপ্রসাদ নিজেই এখন সেই বিখ্যাত বিরানিটি রাঁধে। দুপুরে গিজগিজ ভিড়ের মধ্যে খাওয়া হয়, খেয়ে দেয়ে সব চলে যায়, আমরা বসে থাকি, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে। প্রেস ক্লাবের কর্মচারি আমাদের আড়ে আড়ে দেখে, দেখে যে আমরা যাচ্ছি না, একটু পর পর চা খেয়ে খেয়েও থেকে যেতে চাইছি। কোথাও কোনও নির্জন ঘরের ব্যবস্থা আমি করে রাখি না বলে রুদ্র অনুযোগ করে, মখু গোমড়া করে বসে থাকে। কর্মচারিরা ক্রমাগত আমাদের ইঙ্গিত করে উঠে যেতে, চেয়ারগুলোকে শব্দ করে করে টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখে, ওতেও যখন কাজ হয় না, মুখেই বলে দেয় ক্যান্টিন বন্ধ এখন। আমাদের ক্যান্টিন থেকে বেরোতে হয়, কিন্তু যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। একটু নির্জনতা খুঁজে বেড়াই সারা শহরে, জোটে না। অবশেষে মেডিকেল কলেজ চত্বর বিকেলে যখন নির্জন হয়ে আসে, বসি দুজন। দশ বছর বয়সী একটি পঙ্গু ছেলে পাশের বস্তি থেকে প্রায়ই হাঁটুতে হেঁটে এসে আমার পাশে বসে থাকে, ওর সঙ্গে কথা বলতে যত সহজ বোধ করি, রুদ্রর সঙ্গে নয়। ছেলেটির নাম দুলাল, বাবা নেই, মা আছে, অভাবের সংসার, নিজে ভিক্ষে করে সংসার চালায়, দুলালকে দু তিন টাকা যা থাকে পকেটে, দিই। জীবনের নানা রকম কথা রুদ্রর সঙ্গে বলি। চন্দনার কথা, চন্দনা ঢাকা এসেছে, স্বামীর বোনের বাড়ি উঠেছে, রুদ্রকে দেখা করতে বলি চন্দনার সঙ্গে, কেমন আছে ও, দেখে আসতে বলি, যদি দেখা করতে যায়, তবে তো কিছু আমি হাতে দিতে পারি, কি দিতে পারি, আমার ভাণ্ডারে যে একটি দামি জিনিস আছে, সেটিই দিই, দাদা তাঁর বিয়ের সময় যে হলুদ কাতান শাড়িটি দিয়েছিলেন, সেটি। চন্দনার জন্য মন কেমন করা, বিয়ের পর দাদার বদলে যাওয়া, ছোটদার না থাকার কারণে আমার একা হয়ে যাওয়া, পড়াশোনা ভাল না হওয়া ইত্যাদি কথা মৃদু স্বরে একটু একটু করে রুদ্রকে বলি। রুদ্র বার বার আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টানে, চুমু খেতে চায়। বার বার তার হাত যায় বুকে। যে কোনও সময় যে কেউ দেখবে বলে রুদ্রর হাত সরিয়ে দিই। তাছাড়া নিজের লজ্জাটিও একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুজনের জন্য কোনও নির্জন ঘরের ব্যবস্থা করতে পারি না বলে সে অভিমান করে বসে থাকে, কথা না বলে। ইচ্ছে করে রুদ্রর ঠোঁটদুটো স্পর্শ করি আঙুলে, চোখের ওপর আলতো আঙুল রাখি। ইচ্ছে করে রুদ্রর উষ্ণ হাত ধরে হেঁটে বেড়াই খালি পায়ে। সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে আমার বড় ভাল লাগে। ঘাসের ডগার স্পর্শ আর শিশিরের শীতলতা পেতে চায় পা। আমার সম্বোধনহীন আড়ষ্টতা, বিয়ের পরও এ রকম শুকনো দেখা হওয়ায় রুদ্র মন খারাপ করে ঢাকা ফিরে যায়। প্রতিদিন যেন চিঠি লিখি, বার বার অবশ্য বলে যায়। যেন লিখি রাত দশটার পর, ঠিক সে সময় সে আমাকে ভাববে, ভাববে যে আমি তাকে লিখছি, তাকে মনে করছি। রুদ্র চলে যাওয়ার পর আমি বাড়ি ফিরে লম্বা ঘুম দিই, পড়ে পড়ে আমার এমন ঘুমোনো দেখলে ইয়াসমিন সন্দেহ করে যে রুদ্র এসেছিল। ছোটদা ময়মনসিংহ ছাড়ার পর ইয়াসমিন ধীরে ধীরে আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে বাড়িতে। ওর সঙ্গে সখ্য আমার খুব, চুলোচুলিও কম নয়। আমার চেয়ে গায়ের শক্তি ওর বেশি থাকায় আমাকে বরাবরই রণে ভঙ্গ দিতে হয়। ইয়াসমিনকে আমি পেটের সব কথা বলি, অথচ রুদ্রর যত কাছে আসছি, তত আমি নিভৃত হয়ে উঠছি। রুদ্রর জন্য বাড়তে থাকা আমার বেয়াড়া আবেগের কথা ইয়াসমিনকে বলতেও সঙ্কোচ হয়। বাৎসায়নের একটি ইংরেজি পকেট বই রুদ্র আমাকে পড়তে দিয়ে গেছে, বইটি পড়া তো হয়ই না, বরং কোথায় লুকোনো যায়, কোথায় লুকোলে ইয়াসমিনের চোখে পড়ার আশঙ্কা নেই, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার ঘোড়া লাগাম ছিঁড়ে ছুটতে থাকে। বইটি নিজের কাছে রাখার বরাদ্দ সময় ফুরিয়ে যায় বইটি লুকোতে লুকোতেই।

 

তুমি ব্যস্ত মানুষ। তোমাকে প্রতিদিন লিখতে বলবো, এমন সাহস আমার নেই। এই কথা বলে রোজ আমাকে লেখার হাত থেকে নিস্তার চাইছো! সেটি হচ্ছে না। যতো ব্যস্তই থাকি না কেন, রোজ তোমাকে লেখার মত সময় আমার আছে। কাছে থাকলে রাতে যেটুকু সময় আমি তোমাকে দিতে পারতাম, চিঠি লিখতে তার চেয়ে অনেক কম সময় নেয়। যেহেতু তুমি কাছে নেই, কাজেই আমি রোজই তোমাকে লিখতে পারি, এবং লিখব। তোমার অত রাতটা কোথায়? সাড়ে দশ কি রাত? সে তো সন্ধ্যা। এইটুকু রাত্রি জাগার অভ্যেস এখন থেকে না করলে পরে বিপদে পড়বে তো! একেবারে নির্ঘুম প্লাবনের রাত তো আসবে, সেই সব জলোচ্ছঅ!সের রাতে কি করবে? চন্দনাকে আমি একটি বণর্ও মিথ্যে লিখিনি, বরং অনেক কম করে বলেছি। কেন, আমি কথা না বল্লে কথা বলা যায় না? আমি মখু না তুল্লেও তুমি মখু তুলতে পারো না? সম্পর্কের সবটুকু দায়িত্বই কি আমার? ভাগাভাগি তো সবকিছুর আধাআধি করা হয়েছে। এখানে কেন তবে পুরোটা আমার হবে? তুমি গাল ফুলিয়ে রাখো, চোখ রাঙিয়ে রাখো, আমি আমার আদরের হাত সঙ্কুচিত করি। প্রশ্নই আসে না। তোমার আদরের হাত কি কখনো প্রসারিত থাকে? যে হাত প্রসারিত নয় তার আর সংকোচন কি? কেন, আমি তোমার অভিমান ভাঙাই না? তুমি না ডাকলেও আমি কাছে যাই না? তুমি কথা না কইলে আমি কথা কইনা? তুমি মুখ না তুল্লেও কি আমি আদরের ছোঁয়ায় তোমার মখু তুলি না? তোমার নিরুত্তাপ চোখ জোড়াকে আদরে ভেজাই না? তাহলে তুমি পারো না কেন? আজো আমি অভিমানের ভাষা বুঝতে পারি না। যে বুঝেও সবকিছু না বোঝার ভান করে পৃথিবীর কোন শক্তি আছে তাকে বোঝায়! আজ আশ্বিনের আট। পরিচয়ের আজ তিন বছর চার দিন। কি রকম মনে হয় জানো? মনে হয় হাজার বছর ধরে আমি তোমাকে চিনি। হাজার বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। কখন কি ভাবে দেখা হয়েছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে এক রোদে পোড়া মন একখানি শ্যামল করতল পটে কোনও কথাহীন নিঃশব্দে এসে লিখেছিলো একখানি কথা—আমি। যেন আমরা অনন্ত সময় ধরে পরস্পরকে খুঁজে ফিরছিলাম। একদিন দেখা হল। আর প্রথম দেখায় আমরা চিনে ফেল্লাম একজন আরেকজনকে। কোনো ভূমিকার প্রয়োজন হল না। দুজনেই মিলিয়ে নিলাম ভেতরে যে ছবি ছিলো তার সাথে। হ্যাঁ এই তো সে। যাকে বেদনার রঙ দিয়ে এঁকেছি। হৃদয়ের রক্ত দিয়ে লিখেছি যার নাম। নিভৃত কষ্ট আর নির্জন স্বপ্ন দিয়ে যাকে নির্মাণ করেছি এই তো সে। কোনো কথাহীন তাই এসে আমরা পরষ্পরের করতলে একটি কথা লিখলাম, আমি। অর্থাৎ আমি সেই যাকে তুমি নির্মাণ করেছো নিজের ভেতর।

নির্জন একটি ঘর, যেটি ময়মনসিংহে পাওয়া সম্ভব হয় না, তা যে ঢাকায় আছে তা রুদ্র বার বার বলে। আমাকে ঢাকায় যেতে বলে। কিন্তু ঢাকা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি করে! একা একা ট্রেনে উঠে হয়ত ঢাকা যাওয়া সম্ভব হবে আমার, কিন্তু যেতে কে দেবে? শেষ অবদি ছোটদা ময়মনসিংহে এলে আমি গোঁ ধরি ঢাকা যাবো। ঢাকা কেন? ঢাকা থেকে সার্টিফিকেট আনতে হবে ফ্রার্স্ট প্রফ পরীক্ষার। ছোটদার সঙ্গে ঢাকা যাওয়া হয়, গিয়েই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে ইশকুলের এক পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই। বেরিয়ে সোজা রুদ্রর বাসাবোর ঘরে টোকা, ওরকমই কথা ছিল। রুদ্রর খুশির প্রকাশ নেই। আনন্দে লাফিয়ে ওঠা, কষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলা এসব রুদ্রকে দিয়ে হয় না। আপাদমস্তক একটি কাঠ। যা হচ্ছে যা ঘটছে ভেতরে। কাগজে তার প্রকাশ হয়। রুদ্র অবশ্য একই কথা বলে আমার সম্পকের্, আমি নাকি চিঠিতেই সহজসুন্দরস্বাভাবিক, সামনে নই। সামনে ওই একই, মরা কাঠ। রুদ্র আমাকে একটি শাড়ি দিল পরতে, শাদার ওপর ছোট ছোট ফুল পাতা প্রিন্ট শাড়ি, সঙ্গে সায়া ব্লাউজ, শাড়ি পরে বাইরে যেতে হবে। এ শাড়িটি রুদ্রর বোন বীথি পছন্দ করেছে। রুদ্র নিজে পছন্দ করে কখনও শাড়ি কেনেনি আমার জন্য, এর আগে সবুজ একটি সুতি শাড়ি কিনেছিল, সেটি কিনতেও সে তার বান্ধবী মুক্তিকে সঙ্গে নিয়েছে পছন্দ করতে। রুদ্রর জন্মদিনে আমি যা কিছু উপহার দিই, নিজে পছন্দ করে কিনি। কোন রঙের শার্টের সঙ্গে কোন রঙের প্যান্ট ভাল মানাবে, তা নিজেই বিচার করি। রুদ্র যখন অন্যকে আমার জন্য শাড়ি পছন্দ করতে বলে, আমার গায়ের রঙের কথা বলে, শ্যামলা রঙের মেয়েকে কোন রঙের শাড়ি ভাল মানাবে!মেয়েদের শাড়ি নাকি মেয়েরাই ভাল বোঝে। শাড়ির কথা জানাতে হয়েছে বলেই কি না জানি না রুদ্র বীথিকে জানিয়েছে আমাদের বিয়ের কথা, এমনকি মুক্তিকেও। সে রাতে আমাকে শাড়ি পরিয়ে একটি চিনে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সে। ওখানে রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসে বাসাবো। মুহম্মদ নূরুল হুদাকে সে আমাদের বিয়ের কথা জানিয়েছে, জানাতে হয়েছে, যেন রাতে ও বাড়িতে আমার থাকা অশোভন না দেখায়। আমার কাছ থেকে এ অবদি কেউ বিয়ের কথা জানেনি। রুদ্র জানাতে শুরু করেছে। এর আগেও দএু কজন বন্ধুকে সে জানিয়েছে। এই জানানোয় আমার উদ্বেগ হয় জেনেও জানিয়েছে। এ রাতটি রুদ্রর সঙ্গে থাকতে হবে। থাকতে হবেই। কিন্তু আমার তো যেতে হবে। যেতে হবে, ছোটদাকে বলে এসেছি ঘন্টাখানিক পর ফিরবো। গুল্লি মারো ছোটদা, তুমি আমার বউ, সেটিই তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। কিন্তু এ পরিচয়ই নিয়ে, যে জীবন যাপন করছি আমি, তা করতে পারব না। বেশ পারবে। তবে কি আমি বাড়িতে বলব রুনুখালার ঘরে ছিলাম, যদি না ফিরি আজ রাতে! সে নিয়ে ভেবো না, আমি রুনুখালাকে বলে দেবক্ষণ ম্যানেজ করে নিতে। কিন্তু রুনুখালা কি মানবেন? মানবেন না কেন, তাকে জানিয়ে দেব যে বিয়ে করেছি। অসম্ভব। তোমার অসম্ভব নিয়ে পড়ে থাকো তুমি, আমি যা করার করব। আজ রাত রুদ্রর সঙ্গে কাটাতে হবে এ রুদ্রর আবদার অনুরোধ দাবি আদেশ সবই। রুদ্র বলে, আজ রাতে আমি তোমাকে সম্পণূর্ করে চাই। সম্পণূর্ মানে? সম্পণূর্ মানে সম্পণূ র্। কোনও বাকি রাখা নেই। এর অর্থ অনুমান করে আমার ভেতরে কোথাও কেঁপে ওঠে, সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত আমার কোথাওএর কাপঁ নটি শরীরে ছড়াতে থাকে। দিন যত রাতের দিকে এগোয়, তত শ্বাস দ্রুত হয়। নিজেকে বোঝাই, আমি তো কোনও অন্যায় করছি না, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে বৈধ ভাবে রাত কাটাবো, আমার বয়সী হয়ে হাসিনা যদি এ কাজটি পারে আমি কেন পারব না! আমার ক্লাসের মেয়ে মদিরা ক্লাসেরই এক ছেলে শওকতকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে, অনেকে বলে লুকিয়ে নাকি মদিরা শওকতের হোস্টেলের ঘরে যায়, রাত কাটায়। ও যদি পারে, আমি কি এমন কচি খুকি রয়ে গেছি যে পারব না!

শেষ অবদি রাত এলো। বৈঠক ঘরে হুদা আর তাঁর বউ সাহানার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রুদ্র বউ বলে। হুদার ছোট্ট মেয়েটি অবাক তাকিয়ে থাকে বউ নামক আমার দিকে। অনেক রাত না হলেও রুদ্র বলে, শুয়ে পড়ার সময় হয়েছে। শুয়ে পড়তে রুদ্র তার ঘরটিতে আমাকে নিয়ে যায়। শার্ট প্যান্ট খুলে কেবল একটি লুঙ্গি পরে বাতি নিবিয়ে চেয়ারে পাথর হয়ে বসে থাকা আমাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। নিজেকে বারবার বলি, তুই বিয়ে করেছিস, বিয়ে করলে স্বামীর সঙ্গে শুতে হয় বোকা মেয়ে। শুতে হয়!এরকম প্রতিটি মেয়েই শোয়। লজ্জা ঝেড়ে ফেল। আমি প্রাণপণে লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে থাকি। জানালা দিয়ে আলো আসছে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের, ভাবতে চাইছি এ চাঁদের আলো। রুদ্রকে আমি ভালবাসি, সে আমার স্বামী। আমার স্বামীর সঙ্গে আমার আমি প্রথম রাত কাটাবো। আজকের রাতে আমার যেন কোনওরকম আড়ষ্টতা না থাকে। আড়ষ্টতা না থাকার কথা নিজেকে সেই সকাল থেকে যদিও বলছি, তবওু রুদ্রকে রুদ্র বলা তুমি বলা আমার পক্ষে সারাদিনেও সম্ভব হয়নি। রুদ্রর দিকে পিঠ দিয়ে আমি এক কোণে জড়সড় পড়ে থাকি হাত পা গুটিয়ে। সেই গুটোনো আমাকে রুদ্র কাছে টানে। আমি নই, আমার শরীর রুদ্রর সেই আলিঙ্গনে জবুথবু পড়ে থাকে, বুকের ওপর আড়াআড়ি করে শক্ত হয়ে থাকা আমারই দুটি হাত, আমি সরিয়ে নিতে পারি না। ও থাকে। ওই হাতদুটিকে রুদ্র তার গায়ের শক্তি দিয়ে সরায়। আমি চাই না আমার ভেতরে কোনও কাঁপন, কিন্তু চাইলেও আমি থামতে পারি না ভেতরের কাঁপন, থামাতে পারি না সেই কাপঁ ন থেকে সঞ্চারিত সমস্ত শরীরের কাঁপন। ঠোঁটে গাঢ চুমু খায় রুদ্র। ঠোঁটজোড়া, আমি অনুভব করি ফুলে উঠছে, ভারি হয়ে উঠছে, আমি চাই না কিন্তু আমার হাত দুটো রুদ্রকে ঠেলে সরাতে চায়। ব্লাউজটির বোতাম খুলতে থাকে রুদ্র এক হাতে, অন্য হাতে শক্ত করে ধরে রাখে সরিয়ে দিতে চাওয়া আমার হাত। বোতাম খোলা ব্লাউজের ভেতরে রুদ্র মখু ডুবিয়ে দেয়, ভিজে জিভ ভেজাতে থাকে আমার স্তনজোড়া, চর্বচোষ্যলেহ্য স্তনজোড়া। আমি আলথুালু শাড়িতে রুদ্রর বন্ধনের ভেতর তড়পাচ্ছি। রুদ্র নিজের দুটো পা দিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে আমার পা দুটো। আমার এক পা যত বেশি আরেক পার ঘনিষ্ট হতে চায়, ততই রুদ্র তার সমস্ত শক্তি খাটায় পা দুটোর ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিরুদ্ধে। পা দুটো তোমার স্বামী যেমন করে বলেছে, তেমন করে রাখো মেয়ে, রাখতে হয়, এ নিয়ম, রুদ্র যা করছে সব জেনে বুঝেই করছে, এই করে স্বামীরা, এই করতে হয়, নিজেকে বলি। বলে আমি শরীরের ভেতর থেকে আপনাতেই উঠে আসা প্রতিরোধের শক্তিকে সমস্ত শক্তিবলে নিস্তেজ করি, যেন আমি অবশ পড়ে থাকতে পারি। তাই করি, সজোরে চক্ষুদুটো বুজে, দুহাতে বোজা চক্ষুদুটো ঢেকে, যেন এ আমি নই, এ আমার শরীর নয়, যেন আমি ঘুমিয়ে আছি বাড়িতে আমার ঘরে, আর এখানে যা কিছু ঘটছে, যে অশ্লীল কাণ্ড ঘটছে, এ কাণ্ডের সঙ্গে আমি মোটেও জড়িত নই, আমার শরীরের ওপর জীবনের ওপর কিছু ঘটছে না, এ অন্য কেউ, এ অন্য কারও শরীর, ভাবি। এরপর রুদ্র আমার পুরো শরীরের ওপর উঠে আসে, এবার শুধু চক্ষুবন্ধ নয়, এবার আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অবশ শরীরের দু পাও ঘনিষ্ঠ হতে চায়। আমার দুপাকে রুদ্র তার দু পা য়ের বাধঁ দিয়ে উরুসন্ধিস্থলে বাড়তি কিছু দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে, আমি শ্বাস বন্ধ অবস্থায় চাপটিকে স্বামীর সৃষ্ট স্বাভাবিক চাপ বলে ভাবতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার ভাবনা ছিঁড়ে গিয়ে একটি আর্তচিৎকার আমি না চাইতেও আমার কন্ঠ থেকে বেরোয়। রুদ্র আমার মখু চেপে ধরে দু হাতে। চেপে ধরে, কিন্তু নিম্নচাপটি ওদিকে থেকে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় আমি গোঙাতে থাকি, উর্ধচাপ নিম্নচাপ সমস্ত চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা আমার লোপ পায়। রুদ্রর লৌহশরীরটি আমার শরীরে শত ভালবেসেও শত যুক্তিতেও প্রবেশ করতে পারে না। সারারাত ধরে রুদ্র ক্রমাগত যুক্তিমত স্বাভাবিক নিয়ম শৃঙ্খলামত প্রবেশের চেষ্টা করে গেছে, প্রতিবারই আমার না বোঝাতে পারা যন্ত্রণা ও মাগো ও বাবাগো বলে রাতকে জাগিয়ে তুলেছে। প্রতিবারই রুদ্র আমার চিৎকারের ওপর ঢেলেছে আরও চাপ। সেই চাপ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে চিৎকার। একটি ভয়াবহ রাত শেষ হলে ক্লিষ্ট ক্লান্ত মানুষটি শাড়ি পাল্টো সালোয়ার কামিজ পরে নিয়ে বলি, আমি যাই। আমার নতমখু , আমার নতচোখ, আমার পরাজিত অক্ষম শরীরকে আমি দূরে সরিয়ে নিতে চাই। রাতের কণ্ঠুা, লজ্জা,ভয় আর ঘণৃা আমাকে সকালেও আঁকড়ে থাকে। একই সঙ্গে অপরাধবোধ। রুদ্রকে রুদ্র বলে মনে হয়, স্বামী বলে মনে হয় না। সেগুন বাগিচায় যাওয়ার পথে কেবল বলে, রাতে ওই নাটকটা না করলেই পারতে। সারাপথ আর কোনও কথা বলে না। আমিও না। আমি নিশ্চপু বসে ভাবি রাতটির কথা, এর চেয়ে যদি সারারাত আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিতে পারতাম, এর চেয়ে যদি কবিতা পড়ে পড়ে, শুধু দএু কটি খুনসুটি, দুএকটি নির্ভেজাল চুমুতে আমাদের সময় কাটত!

সেই সকালে সেগুন বাগিচায় ফিরে ছোটদাকে কাঁপা কণ্ঠে বলি, রোকেয়া হলে রুনুখালার রুমে ছিলাম।

রুনুখালা তো এখন আর হলে থাকে না। ছোটদা বলেন।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে থাকেন। এ ছোটদা জানেন।

কালকে ছিল।

রুম এখনো ছাড়ে নাই নাকি?

না।

হুম। তর বান্ধবীর সাথে না দেখা করতে গেছিলি? দেখা হইছিল?

হ।

কি নাম?

নাদিরা।

নাদিরা? ও ওইযে রামকৃষ্ণমিশন রোডের মেয়েটা না?

হ।

তুই না একদিন কইলি ও জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হইছে।

কালকে আসমার সাথে দেখা করতে আইছিল রোকেয়া হলে। থাইকা গেছে।

আসমা কুনডা? হাশিমুদ্দিনের মেয়েডা না?

হ।

ও কি ঢাকা ইনিভার্সিটিতে পড়ে?

হ।

তর না সার্টিফিকেট তোলার কথা!

হ। তুলাম।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে কম্পমান কণ্ঠটিকে বিশ্রাম দিতে ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে দুঃস্বপ্নের মত রাতটির কথা ভাবি। গত রাতটির কথা। রুদ্র বলেছে আমি নাটক করেছি। ও কি নাটক ছিল! অভিমান আমাকে নিঃশব্দে কাঁদাতে থাকে। সারা শরীরে যনণ্ত্রা, যেন এইমাত্র বাঘের গুহা থেকে ফিরেছি। হাঁটতে গেলে যন্ত্রনা হচ্ছে উরুসন্ধিতে। পেচ্ছাব করতে গিয়ে দেখি যন্ত্রণার এক ফোঁটা দু ফোঁটা পেচ্ছাব। বকু যেন বুক নয়, দুমণ পাথর, চুমুর লাল দাগগুলো টনটন করছে, আঙুল ছোঁয়ানো যায় না। একটি রাত কাটানোর কথা রুদ্র সেই কাগজে সই করার পর থেকে বলছে। সই করার আগেও সে কম কামড় দিতে আসেনি, ঝাঁপিয়ে পড়েছে চুমু খেতে, বুকে হাত দিতে, নিজেকে ছাড়িয়ে বাঁচিয়ে নিয়েছি। ধস্তাধস্তি আঁচ করে মাসুদের বাড়ি থেকে না বলে দেওয়া হয়েছে। সেটি না হওয়াতে অভিমান আর রাগ দুটোই সে কম দেখায়নি আমার সঙ্গে। রাতের মূল্য রুদ্রর কাছে এত বেশি কেন, বোঝা হয়নি আমার। আমি তাকে অনেক বলেছি, জীবনের সমস্ত রাত তো পরেই আছে সামনে, অপেক্ষা করি চল। অপেক্ষার যে কষ্ট, সে কষ্ট তো একরকম সখু দেয়। না রুদ্র অপেক্ষা করবে না। অপেক্ষায় কোনও সখু নেই, সে বলে। আমি যত বলি, চল ভালবাসি, রুদ্র বলে চল শুই, শুতে যাই। রুদ্র হাভাতের মত খাই খাই করছে। আজই তার চাই। এক্ষুনি চাই। এক্ষুনি না হলে তার আর চলছে না। ময়মনসিংহে যখন যায়, নির্জন একটি ঘর পেতে উন্মাদ হয়ে ওঠে। আমার পক্ষে নির্জন ঘর পাওয়া সম্ভব নয় জেনেও ঘর আমি কেন পাইনি এ নিয়ে অভিমান করে, কেবল অভিমান নয়, রাগ। একটি রাত তার কাটানোই চাই। একটি রাত তো শেষ অবদি কাটানোই হল, দুঃস্বপ্নের একটি রাত। আমি এমন করে নিজের জীবনকে ভাবিনি কখনও। আমারও তো অভিমান হয়, আমারও তো রাগ হতে পারে। রুদ্রকে ইচ্ছে করে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু ফেলতে গেলে দেখি হাত দুটো অচল হয়ে আছে আমার। যেন পঙ্গু আমি। কেবল ওই কাগজটির কাছে হার মেনেছি, আমার ওই সইটির কাছে, যেহেতু ওই কাগজে সইএর নাম বিয়ে! নাকি রুদ্রকে আমি ভালবাসি! ভাবি। ভাবনা আমাকে ছেড়ে কোথাও এক পা যায় না। ছোটদাকে বলা মিথ্যেটি নিয়েও ভাবি। ছোটদা তো ভাবতে পারেন এরকম যে ঝুনু খালার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার সেই ইশকুলের বান্ধবীর সঙ্গে অনেকদিন পর আমার গল্প করা গড়িয়ে গড়িয়ে মধ্যরাত ছুঁলে, অগত্যা রুনুখালার পুরোনো ঘরটিতে আমি বাকিরাতটুকু শেষ করেছি ঘুমিয়ে। ছোটদা কি রকম ভেবেছেন কে জানে, তবে আমাকে আগলে রেখে আর কোনও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে একা বেরোতে না দিয়ে, রেজিস্টার বিল্ডিংএ আমাকে নিজে নিয়ে গিয়ে সার্টিফিকেট তুলিয়ে, দুদিন পর আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসেন ময়মনসিংহে।

রুদ্র পরে বলেছে, আমি তাকে সম্পর্ণ বিশ্বাস করি না। আমার এখনও সংশয় মনে। আমি আহত হয়েছি শুনে। বলেছি তাকে বিশ্বাস করি বলেই, তাকে আমি সম্পণূর্ বিশ্বাস করি বলেই ভালবাসি, ভালবাসতে হলে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মধ্যে একসুতো ফাঁক থাকলে ভাল লাগা হয়ত হয়, ভালবাসা হয় না। রুদ্র লিখেছে, আমি কি এতটাই হতভাগ্য যে আমাকে সব কিছুই জোর করে নিতে হবে? সব কিছু আদায় করে নিতে হবে? জোর করে যতটুকু নেওয়া যায়, যতটুকু নেওয়া শোভন, আমি তা নিয়েছি। আমার আর যা একান্ত পাওয়ার, যা আমার নিভৃততম পাওয়া, যদি কোনোদিন নাও পাই, তবু আমি তা জোর করে নেবো না, আদায় করে নেবো না। বিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়ে আমি কখনোই প্রশ্ন তুলি না। সম্পণূর্ বিশ্বাস বলতে আমি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছি, সেটা বুঝতে না পারার তো কোনো কারণ নেই।

এই ঘটনার প্রায় দেড়বছর পর রুদ্র লেখে, বউসোনা, এবার কি হয়েছে জানো? শাড়ি পরা তোমাকে দেখে প্রথম মনে হল আজ যেন প্রথম তোমাকে দেখছি। যেন তুমি অন্য কেউ, যেন এক অন্য মানুষ, এক নোতুন মানুষ। গত দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন রকম ভালো লাগা পেয়েছি কিন্তু এ যেন তার সব কিছু থেকে আলাদা। একেবারে আলাদা এক ভালো লাগা। মনে হলো যেন আমাদের এইবারই ভালবাসার শুরু। যেন এতোদিন শুধু মহড়া হয়েছে। আজ একেবারে মঞ্চে।

দেড় বছরে দুমাস কি তিন মাস অন্তর অন্তর একবার এসেছে রুদ্র ময়মনসিংহে। সম্বোধন করি না বলে রাগ করে আমাকে সম্বোধন হীন চিঠি লিখেছে বেশ কয়েক মাস। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে আমাদের সময় কেটেছে। ক্যান্টিন থেকে যখন উঠতে হয়েছে, এদিক ওদিক কোথাও বসে কথা বলার জন্য আগের মতই জায়গা খুঁজেছি। বরাবরের মতই জায়গা খুঁজে পাওয়া আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়েছে। রুদ্রর অনুরোধে একদিন শাড়ি পরে দেখা করতে যাই। শাড়ি আমি ভাল পরতে জানি না, ইয়াসমিনের সাহায্য নিয়ে মার একটি শাড়ি পরে বান্ধবীর জন্মদিনে যাচ্ছি বলে বেরোই। সে দিনটিতে খানিকটা নির্জনতার সুযোগে দুটো তিনটে চুমু খাবার, বুকে হাত দেবার সুযোগ রুদ্র পেয়েছিল, ফিরে গিয়ে লিখেছে ওই চিঠি।

মনে মনে হাসছো, না?

আসলেই, সত্যি মনে হলো এতোদিনে আমাদের ভালবাসার শুরু। যেন এতোদিন আমরা শুধু পরস্পরকে ছুঁয়ে ছিলাম, আজ যেন আমরা পরষ্পরের শরীরের উত্তাপ পাচ্ছি। বুঝতে পারছি পরষ্পরের হৃদপিণ্ডের ধ্বনি। আজ মনে হচ্ছে কোনোবারই বুঝি এতোটা মন ভরেনি। তুমি একটু একটু করে সহজ হচ্ছে!, স্পষ্ট হয়ে উঠছো। আমি যেন এক অচেনা পৃথিবীকে চিনতে পারছি। আমি তো এতোদিন ধরে তোমার এই সহজ হয়ে ওঠার প্রতীক্ষায় ছিলাম। তুমি আরো, আরো বেশি সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তুমি আরো বেশি উ−ন্মাচিত হয়ে উঠবে। আমাদের মতো এতো সুন্দর আর কারো ভালোবাসার ঘর হবে না—-তুমি দেখে নিও। এবার একটু আদর করো না লক্ষ্মী। না. না. মখু টা ঘুরিও না।তাকাও, আমার চোখের দিকে তাকাও। এতো লজ্জার কি আছে। আমি তো তোমার সেই কতোদিনের চেনা। এই চোখ, এই ভুরু, এই কপাল, এই মখু , এই শরীর তুমি কতোবার ছুঁয়েছো। কতোবার আমরা আমাদের আলাদা কোরে চিনতে পারিনি। তবে? তবে এতো লজ্জা পাচ্ছে! কেন? ঠোঁটটা ছোঁয়াও। কই—ছোঁয়াও।

একটু একটু কোরে বশ করছি নিজেকে। এরোম কোরে আমায় যদি একটু ভালোবাসা দাও, দেখো আমি ঠিক তোমার মনের মতো হয়ে উঠবো। অথবা তুমি ঠিক আমার মনের মতো। আসলে ভালোবাসা মানে বোধহয় দুটি মনকে একটি মন বানিয়ে ফেলা। ইচ্ছে করছে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার কোরে সবাইকে ডেকে বলি—তোমরা শোনো, আমি আমার ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি, আমরা একটি হৃদয় হতে পেরেছি।

লক্ষ্মী থেকো, সোনা আমার। ভালো থেকো প্রাণ। আদর আদর আদর। তোমার রুদ্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *