তা তা থৈ থৈ
অবকাশে ছোটদার সস্ত্রীক প্রবেশ আমার পরীক্ষার আগেই ঘটেছে। ঘটেছে মার কারণে। পুত্রশোকে যখন তিনি যারপরনাই কাতর,বাবার কাছে আবেদন নিবেদন করে ব্যথর্ হয়ে অতঃপর নিজেই হাশেমমামাকে পাঠিয়ে ছোটদা আর তাঁর বউকে ইসলামপুরের কোন এক গ্রামের কোনও এক কুড়েঘর থেকে শহরে আনলেন। কিন্তু শহরে এসে পৌঁছোনোর মানে এই নয় যে ওরা অবকাশে ঢোকার কোনওরকম অনুমতি পাবে। বাবা সোজা বলে দিলেন, কস্মিনকালেও যেন অবকাশমুখো না হয় ওরা। নানিকে বলে কয়ে নানির উঠোনে কুয়োতলার পাশে একটি ঘর, যে ঘরটি এককালে আমাদের খাবার ঘর ছিল, পয়পরিষ্কার করে একটি চৌকি পেতে দেওয়া হল ওদের থাকার জন্য। ছোটদা বউ নিয়ে ওখানে থাকতে শুরু করার পর বাবার আদেশে নানির বাড়ি বেড়াতে যাওয়া অন্তত আমার আর ইয়াসমিনের জন্য বন্ধ হয়। মা কিন্তু নিয়মিত ছোটদার সংসারে যেতে লাগলেন। মা তো আর খালি হাতে যান না, পুত্রধনের জন্য চাল ডাল আনাজপাতি অবকাশ থেকে যা যোগাড় করতে পারেন নিয়ে যান। বাবা যখন বাড়ি থাকেন না, ছোটদা ঢুঁ মারেন অবকাশে। ঢুঁ অবশ্য অহেতুক মারেন না, প্রয়োজন হলেই। বাবার নিষ্ঠুরতার কথা মা ভাবেন আর বলেন, এই মানুষটা মানুষ নাকি পাথর? মার অক্লান্ত সাধ্য সাধনার পর বাবাকে খানিক নরম করে মা একদিন অন্তত এইটুকু রাজি করালেন যে ছোটদা বউ নিয়ে অবকাশে ঢুকবেন কিন্তু কোণের একটি ছোট ঘরে ওরা বাস করবেন,সারা বাড়িতে অবাধ পদচারণার কোনও অধিকার ওদের থাকবে না। বিয়ে যখন করেইছো, বউ যখন আর ছাড়বেই না মনস্থ করেছো, যদিও এ বয়সে বিয়ে করার কোনও যুক্তি নেই, পেটালে গাধাও মানুষ হয়, তুমি হওনি—এখন দেখ লেখাপড়া শেষ করে ভবিষ্যতে ডাল ভাতের যোগাড় করার ব্যবস্থা করতে পারো কি না, এরকম ভেবেই বাবার রাজি হওয়া। মা ওঁদের জন্য দাদার ঘরের পেছনে একটি ছোট ঘর যে ঘরে মা নিজে থাকতেন গুছিয়ে দিলেন, কাপড় চোপড় রাখার একটি আলনা দাদার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দরজাটি বন্ধ করে দরজার সামনে রাখলেন। ছোটদার পুরোনো খাটটি দাদার ঘর থেকে এনে ছোটঘরে পাতা হল। ছোটদা বললেন আয়নার টেবিলটি তাঁর ঘরে যে করেই হোক নিতে হবে। মার বিয়ের সময় খাট পালঙ্ক ইত্যাদির সঙ্গে নানা এই টেবিলটি মাকে উপহার দিয়েছিলেন। কাঠের ফুল পাতার নকশাঅলা বহিরাবরণ, অন্তস্তলের আয়নাটি সামনে পেছনে দোল খায় নাড়লে, দুপাশে ছোট দুটো তাক, দুটো ড্রয়ার—সিংহি সিংহি এই চারপেয়ে টেবিলটি বাবার ঘর থেকে নিজে টেনে ছোটঘরে দিয়ে এলেন মা। আঁচলে মুছে দিলেন আয়নায় জমা ধুলো। গীতা টেবিলের সামনে বসে ঘন্টা খরচ করে সেজে ছোটদার সঙ্গে প্রায় বিকেলে বাইরে যান। ওঁদের বাইরে যাওয়ার দিকে আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকি। এরকম আমিও যদি যেতে পারতাম!
যদিও বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছোটদা আর তাঁর বউএর মখু দর্শন তিনি করবেন না, কিন্তু ওরা অবকাশে পাকাপাকি বসত শুরু করার ঠিক দুদিন পর সকালে গোসল সেরে সার্টপ্যাণ্টজুতোটাই পরে, সর্ষের তেলে চোবানো মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে বৈঠকঘরে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন, বসে ডাকলেন আমাকে। বাবা ডাকছেন, এর অর্থ বাড়ির যেখানেই থাকো না তুমি, যে কাজই কর না, পড়ি কি মরি ছুটে আসতেই হবে। বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ওই দুইটারে ডাক। ওই দুইটা কোন দুইটা? এই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল আমার, করিনি। বাবা যেহেতু আদেশ দিয়েছেন, আমাকে বুঝে নিতে হবে ওই দুইটা বাড়ির কোন দুইটা। কারণ এ আমার, কেবল আমার কেন, বাড়ির সবারই জানতে হবে বাড়ির কোন দুইটা কে এ সময় বাবা ডাকতে পারেন। ছোটদার ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে বললাম, যাও, ডাক পড়ছে, একজনের না কিন্তু, দুইজনের। ছোটদার মখু মুহূর্তে বিবণর্ হয়ে উঠল, ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে লুঙ্গির গিঁট বাধঁতে বাধঁতে।
গীতাকে ,গীতা বিমূঢ় বসা বিছানায়, সঙ্গে আসার অনুরোধ করতে করতে একবার দরজার কাছে, আবার ফিরে বিছানার ধারে, হাঁটছিলেন। “নাসরিন”—বিকট শব্দে দ্বিতীয় ডাকটি এল বৈঠক ঘর থেকে, এর অর্থ হল ওই দুইটার এত দেরি হচ্ছে কেন! অবশেষে, দুজন যখন বড় হিম্মতের সঙ্গে নিজেদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সাক্ষাৎ হুতাশনের সামনে দাঁড় করালো, দরজার ফাঁকে চোখ কান নাক সব পেতে থাকলাম। গীতা উবু হয়ে বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করল। হিন্দু মেয়ের কদমবুসি, প্রণামের মতই, গীতার জন্য নতুন কিছু নয়। বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করে, যদিও পরিষ্কারই ছিল গলা, এমন কোনও জমা কফ ছিল না গলায়, বললেন ছোটদার দিকে যতটা সম্ভব চোখ রঙিন করা সম্ভব,করে, জীবন কিরম বুঝতাছ? বিয়া করছ,লেখাপড়া চাঙ্গে উঠছে, গঞ্জে গিয়া সংসার করছ, একশ টাকা মাস চাকরি করছ, কী চাকরিডা করছ শুনি? কুলিগিরি। ঠিক না? কুলিগিরি ছাড়া তুমার ওই বিদ্যায় আর কি পাইবা! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছ। তাতে কার কি ক্ষতি হইছে? আমার কিছু হইছে? আমার কিচ্ছু হয় নাই। হইছে তুমার। পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে, তুমি বুঝ নাই। পাগলের কাছে গিয়া দেখ তার টাকা যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না। তার খাবার যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না।
বাবা খানিক থেমে, বুঝি না অপেক্ষা করে কি না মূর্তিমান দুইটার মখু থেকে নিদেনপক্ষে কোনও শব্দের, বলেন, আনন্দমোহনে ভর্তি হইয়া আয়, ইন্টারমিডিয়েটে তো থার্ড ডিভিশন পাইছস, চান্স তো পাইবি না কিছুতেই, তবু দেখ চেষ্টা কইরা। যাওয়ার সময় আমার চেম্বার থেইকা টাকা লইয়া যা। বাবা এবার গীতার দিকে চোখ নাক দাঁত সব কুঞ্চিত করে বলেন, কি ভাইবা এই কাজটা করছ? নিজের ভবিষ্যতের কথা তুমিও ভাব নাই? গীতার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না যেহেতু মেঝের দিকে চোখ, চুলের ডালি দৃশ্যমান নয় যেহেতু আঁচলে আবৃত মাথা, ঠোঁট এমনিতেই গীতার ছোট, ছোট মুখের ছোট ঠোঁট আরও ছোট হয়ে আছে। এবারও খানিক থেমে, কফ নেই তবু ঝেড়ে,বাবা বলেন গীতা, আমার মেয়ে দুইটার লেখাপড়া আছে, ওদের সাথে আড্ডা দিতে যেন না দেখি। কথা বুঝছ? গীতা মাথা নাড়ে, বুঝেছে সে। বাবা সশব্দে উঠে আমার ঘরের লাগোয়া ওদের দরজাটি সশব্দে বন্ধ করে ভেতর বারান্দার দিকের দরজা সশব্দে খুলে যাওয়া আসা এ দরজা দিয়েই করার আদেশ দিয়ে সশব্দেই বেরিয়ে গেলেন। আদেশ মানা ছাড়া আর উপায় নেই ছোটদার। তিনি বাংলা অনাসের্ আনন্দমোহনে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা তাঁর বাংলায় ভর্তি হওয়ার ঘটনাটি শুনে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে সাতদিন কাটালেন আর বলে বেড়ালেন বাংলায় পইড়া কয়ডা বেডা মানুষ হইছে? বাংলা বিশারদেরা বড়জোর বুদ্ধি কইরা গরুর গাড়ি চালাইতে পারে, আর কিছু না। ওই বলাটুকুই, অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়া বাবা ছোটদাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বিজ্ঞানের কোনও বিষয়ে ভর্তি করিয়ে আনেন না। ছোটদা নিরাপদে তাঁর বিবাহিত জীবন কাটাতে থাকেন অবকাশে। মাঝে মাঝে হাতে একটি খাতা আর পকেটে একটি ঝরনা কলম ঢুকিয়ে কলেজে যান, বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফেরেন।
বাবার কড়া নিষেধের পরও গীতার সঙ্গে আমার আর ইয়াসমিনের সখ্য বেড়ে ওঠে। বড়রা বাড়িতে কেউ না থাকলে সাধারণত আমিই হতাম দুষ্টের শিরোমণি লংকার রাজা। মাঠে খেলতে নামা, ছাদে উঠে বিশ্ব দেখা, বিশ্ব বলতে রাস্তার বারো রকম লোক আর প্রতিবেশিদের ঘরবাড়িউঠোন, তুলসীতলা, সন্ধেধপূ , মন্দিরা বাজিয়ে কীর্তন গাওয়া, ভাড়া করা ব্যান্ড পার্টির সামনে এক প্যাঁচে রঙিন শাড়ি পরে কাঁসার লোটা হাতে মিছিল করে ব্রহ্মপুত্রের দিকে যাওয়া, গঙ্গার জল মনে করে ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা জল দিয়ে বাড়ির পবিত্র উৎসব সারা দেখা, নয়ত অপাঠ্য পড়া। গীতা আমার রাজত্ব এক তুড়িতে দখল করে আমাকে ছাড়িয়ে মাড়িয়ে তরতর করে উঠে যায় কাঁঠাল গাছে, ডালে বসে কাঁঠালের মুচি খায়, আমি নিচ থেকে বাঁশের কঞ্চির আগায় কাপড়ের পুঁটলিতে নুন আর লংকাগুঁড়ো বেঁধে ওর নাগালে দিই। আতা গাছে লাফিয়ে ওঠে। বেল গাছেও। সবরি গাছে উঠতে পারবা? পারমু না মানে? শাড়ি পরেই সবরি গাছ বেয়ে একেবারে মগডালে গিয়ে বসে, নাগালের পেয়ারাগুলো মগডালে বসেই খায়। পাড়ার লোক রাস্তা থেকে গাছে ওঠা বাড়ির নতুন বউকে দেখে। গীতার দস্যিপনা আমাদের হাঁ করা মগ্ধু তা দেয়। আমরা ওর পেছনে লেজের মত লেগে থাকি। গাছে চড়ার কোনও বিদ্যে আমার ছিল না, গীতার কাছে হাতেখড়ি হয়। গীতার কাছে হাতেখড়ি হয় আরও অনেক কিছুর। হাতেখড়ি, পায়েখড়ি, বুকেখড়ি, পেটেখড়ি, পিঠেখড়ি—খড়ির শেষ নেই। উঠোনের খড়িগুলো গীতার প্রেরণায় ছুঁড়ে আর ছিঁড়েই ফুরোতে লাগল। বৃষ্টি হলে আমাদের পুরোনো অভ্যেস, উঠোনে মাঠে দৌড়ে দৌড়ে বৃষ্টিতে ভেজা, সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে ভিজে ভিজে রাজ্যির নাচ নাচা। গীতা বৃষ্টিতে দৌড়ে আর নেচে তুষ্ট হয় না, কাকভেজা হয়ে চৌচালা টিনের ঘরের মাথায় উঠে বসে থাকে। আমি বারান্দায় বসে দেখছিলাম যেদিন পড়ল ও, কালো ফটকের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে পড়ল তো পড়ল একেবারে ভাঙা ইট ফেলা উঠোনে, ভেজা চাল থেকে পা পিছলে, বোঁটা ছিঁড়ে যাওয়া পাকা চাল কুমড়োর মত গড়িয়ে। ইয়াসমিন চালের মাথায়,গীতার পড়ে যাওয়া দেখে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে না পারা আমি বড় ঘরের বারান্দায়, ফ্যাকাসে মুখে ভিজে চপু সে থাকা শাড়ি গায়ে উঠোনে বসে থাকা গীতা আর এর মধ্যে মা এসে ভিজে বোরখা খুলে বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে খোয়ার ওপর বসে থাকা বাড়ির বউকে দেখে অবাক, আফরোজা তুমি ওইখানে কি কর! গীতা বলল, না মা কিছু করি না, ইয়াসমিন চালে উঠছে তো, এইখানে বইসা বইসা ওরে দেখতাছি।
ইয়াসমিন চালে উঠছে?
হ ওইযে দেখেন বইসা রইছে। কত কইলাম উইঠ না, পইড়া যাইবা, শুনল না। ইয়াসমিন মার ধমক খেয়ে নেমে আসে চালের চুড়ো থেকে আর ভাজা মাছটি উল্টো খেতে না জানা, অত উঁচু চাল থেকে পড়ে হাড় না ভাঙা, সামান্য আঁচড় না লাগা গীতা গোসলখানায় যায় শাড়ি পাল্টাতে। মা খিচুড়ি রেঁধে গীতার পাতে ঢেলে দুপুরবেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়ে দুইটারে তুমি দেইখা রাখতাছ বইলা আমি নিশ্চিন্তে একটু নওমহল গিয়া কোরান হাদিস শুনতে পারি। গীতা বলল, মা আপনে কোনও চিন্তা কইরেন না, আমি এদেরে ঠিক দেইখা রাখতাছি, খেয়াল রাখি কোনও দুষ্টামি যেন না করে। গীতার পাতে দুটোর জায়গায় তিনটে মাংসের টুকরো দিলেন মা, পাতের কিনারে আমের আচার। গীতা খেতে খেতে বলল, মাংসটা দারুন রানছেন মা। আর আচার যে কেমনে এত ভাল বানান আপনে! মা আরও মাংস, আরও আচার ওর পাতে ঢেলে বিষম উৎসাহে বলে যান, তুমারে আচার বানানোটা শিখাইয়া দিব। একেবারে সোজা, আমটা ফালি ফালি কইরা কাইটা বয়মের মধ্যে সরিষার তেল, কিছু রসুনের কোয়া, আর কিছু শুকনা মরিচ দিয়া ডুবাইয়া রাখবা। মাঝে মাঝে রোদ্রে দিবা বয়াম। গীতা বিস্ফারিত চোখ করে বলে তাই নাকি! যে কোনও কিছুতেই গীতা আকাশ থেকে পড়ে। ছোটদার বাচপুানকা দোস্ত খোকন এলেন ঢাকা থেকে, বৈঠক ঘরে বসে আছেন, খবরটি দিলে চোখ কপালে তুলে বলল সে, খোকনভাই আইছে? কখন? কেমনে? হায় হায় কামাল তো নাই। খোকন এমন আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে যে গীতার বিস্ময়ের সীমা নেই, অথচ বৈঠকঘরে গিয়ে মিষ্টি হেসে খোকনকে বলল আরে আপনের জন্যই তো অপেক্ষা করতেছিলাম, কামাল বলে গেছে আপনেরে বসতে, এই তো কাছেই গেছে,এখনি ফিরবে। গীতাকে দুধের বাচ্চার মত দেখতেও লাগে, শুনতেও লাগে। কালো মখু টিতে বড় বড় চোখ, এই চোখকে কেউ কেউ বলবে পটল চেরা চোখ, মাথায় অতিঘন চুলের বোঝা, টিয়ার ঠোঁটের মত ধারালো নাক, আফ্রোদিতির ঠোঁটের মত ঠোঁট, অত দূর না গিয়ে লংকা চেরা ঠোঁটই বা নয় কেন, ইঁদুরের দাঁতের মত দাঁত, সারসের গলার মত সরু গলা। ছোট ছোট হাত, ছোট ছোট পা, ছোট শরীর। কালো মেয়েকে লোকে সুন্দরী বলে না, কিন্তু গীতাকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী বলে আমাদের মনে হতে থাকে।
পাড়ায় পুজোর ঢাকের বাজনা শুরু হয়ে গেলে দুধের বাচ্চাকে ফিসফিস করে বলি,আজকে দূর্গা পুজা। আকাশ থেকে পড়ে গীতা, তাই নাকি? জানি না তো! জিভে চুকচুক শব্দ করে ওর জন্য দুঃখ করি, মুসলমানের ঘরে বিয়ে হওয়াতে ওর আর পুজোর আনন্দ করা হচ্ছে না। আমরা যেমন বারো মাসের তেরো পুজোতেই পাড়ার মণ্ডপ দেখে বেড়াতে পারি, অষ্টমি আর রথের মেলায় চিনির খেলনা আর বিন্নি ধানের খই কিনতে পারি—হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়াতে গীতার পক্ষে এসব আর সম্ভব হবে না জেনে দুঃখ আমাদের শেষ হয় না, ছোটদা ছুটে আসেন বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল গীতা, তাড়াতাড়ি শাড়িটা পইরা ফালাও।
কোন শাড়িটা? গীতা অবাক হয়ে বলে।
কালকে যে কিইন্যা আনলাম, সেইটা।
কালকে কিইন্যা আনলা? কোনটা?
আরে তোমার পূজার শাড়ি!
পূজার শাড়ি মানে? এইসব কি বল!
আমার উপস্থিতি আড়চোখে লক্ষ্য করে ছোটদা অপ্রস্তুত হেসে বলেন, ওই যে একটা নীল শাড়ি আছে না, তুমার মা যে দিছিল, সেইটা পর।
সেইটা বল। সেইটা না বইলা কেন বল যে তুমি কিন্যা আনছ? তোমার কি টাকা পয়সা আছে নাকি যে কিনবা! এক পয়সার মুরদ নাই আবার বড় বড় কথা!
তাড়াতাড়ি কর। দেরি হইয়া গেল।
কিসের দেরি? কই যাইবা?
বাবুয়ার বাসায় আমাদের দাওয়াত আছে, ভুইলা গেছ?
গীতাকে নীলাম্বরি পরী সাজিয়ে নিয়ে ছোটদা বেরোন। এরকম প্রায়ই বেরোন। পুরোনো বন্ধুর বাড়ি, চিপাচস-সদস্যদের বাড়ি, গোলপুকুর পাড়ে আড্ডা দিতে গিয়ে নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধুদের বাড়ি,কেবল বাড়ি বাড়ি ঘুরেই সময় কাটান তা নয়, নানান অনুষ্ঠানেও আনন্দ করে আসেন, গানের অনুষ্ঠান, নাচের অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা, পারলে যাত্রাও বাদ দেন না। দেখে আমার চোখজিভ সব সচল সজল। ছোটদা নিজের গিটারখানা বিক্রি করে দিয়েছেন, শহরের ভাল গিটারবাজিয়ে হিসেবে যে নাম ছিল, সে নাম যে তুলোর মত হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে, সে দিকে তিনি বড় একটা ফিরে তাকান না। বউ নিয়ে তিনি বাপের হোটেলে থাকছেন খাচ্ছেন, কিন্তু থাকা খাওয়ার বাইরে আরও একটি জীবন আছে, সেই জীবনের জন্য হন্যে হয়ে একটি চাকরির খোঁজ করেন তিনি।
পুজোর পর ইশকুল থেকে ফিরে আমাকে গোপনে একটি খবর দেয় ইয়াসমিন, তার ইস্কুলের এক বান্ধবী দেখেছে পুজোর দিন পিওনপাড়ায় গীতার বাড়িতে সন্ধেবেলা ঢুকছে গীতা, পেছনে ছোটদা। ছোটদাকে ঘটনা জানালে তিনি আমাকে সাবধান করে দেন যেন কাক পক্ষী না জানে এই খবর। কাক পক্ষী জানে নি। কাক পক্ষী এও জানে না যে বাবা গোসলখানায় ঢুকলে প্রায়ই সকালে বেড়াল-পায়ে বাবার ঘরে ঢুকে যেন ও ঘরে কিছু একটা ফেলে এসেছেন ফেরত আনতে যাচ্ছেন অথবা বাবার সঙ্গে এক্ষুণি তাঁর জরুরি বৈঠক আছে এমন ত্রস্ত অথচ শান্ত ভাব মুখে, আলনায় ঝুলে থাকা প্যাণ্টের পকেট থেকে আলগোছে তুলে নিয়ে আসেন দশ টাকা হলে দশ টাকা, কুড়ি টাকা হলে কুড়ি টাকা, পঞ্চাশে হাত দিতেও হাত কাঁপে না ছোটদার। মা দেখেন এসব, দেখেও না দেখার ভান করেন। ছোটদার বুকের পাটা দেখে ভয়ে বুক কাঁপে আমার। ধরা পড়লে ঘটনা কি দাঁড়াবে তা অনুমান করতে যে সাহস প্রয়োজন হয়, তা আমার বা ইয়াসমিনের কারওরই নেই।
গেছো গীতা কেবল গাছেই নয়, গাছের তলেও লাফায়। নাচ শেখাবে বলে পড়ার টেবিল থেকে আমাকে আর ইয়াসমিনকে উঠিয়ে নিয়ে সারা বাড়িতে তা তা থৈ থৈ করে বেড়ায়। আমি আর ইয়াসমিন খুব অচিরে বড় নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠছি এই বিশ্বাস আমার বা ইয়াসমিনের না থাকলেও গীতার আছে। বাবার বাড়ি আসার শব্দ পেলে নাচ রেখে দৌড়ে পড়ি কি মরি পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি, বাবার গায়ে হাওয়া লাগে ছুটোছুটির। প্রায় রাতেই ঘুমোতে যাবার আগে আমাকে ডাকেন, ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেন, খাওয়া দাওয়া হইছে?
দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিই, হইছে।
পড়ালেখা হইছে?
হইছে।
খেলাধুলা হইছে?
প্রায় ঠোঁটের কাছে হইছে শব্দটি এসে যাচ্ছিল, গিলে অন্য এক শব্দজোড়া ব্যবহার করি, হয় নাই।
আড্ডা মারা হইছে?
হয় নাই।
বাবা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বলেন, কেন হয় নাই?
শব্দজোড়া দূরে থাক, কোনও শব্দই তখন আমার মুখে নেই।
কেন হয় নাই আড্ডা মারা? বাড়িতে তো এখন সঙ্গী সাথীর অভাব নাই।
আমি দরজার পর্দা আঙুলে পেঁচাতে থাকি।
বাবা বলেন আড্ডা মারা তো ভাল, পড়ালেখা করতে হয় না, পরীক্ষায় পাশ করতে হয় না। দেখ না তোমার ছোটদা, কত সুন্দর জীবন তার! লেখাপড়ার মত বাজে কাজ তার আর করতে হয় না।
আঙুল থেকে দরজার পর্দা ছাড়াতে থাকি।
কাল সকালে যখন আমি বাইরে যাব, তখন তুমি গপ্প মারতে বসবা, বুঝলা! আমি বাড়ি ফিরা পর্যন্ত গপ্প মারতেই থাকবা, বুঝলা কি কইলাম?
সাধারণত বাবা যখন কিছু বোঝান, মাথা নেড়ে বলতে হয় বুঝলাম। কিন্তু এখন বুঝলাম বলাটা যে বিপজ্জনক সে বেশ বুঝি।
বাবার ভয় গীতার সঙ্গে সখ্য পেতে এই বুঝি আমাদের লেখাপড়ার বারোটা বাজল। আমার ঘরের লাগায়ো ছোটদার ঘরের দরজায় তিনি তালা লাগিয়ে দিয়েছেন, যাওয়া আসা ওরা বারান্দার দরজা দিয়ে করছে কিন্তু ছোটদার দোস্ত খোকন যে রাতে থেকে গেলেন বাড়িতে, শুলেন ছোটদার বিছানায়, অগত্যা গীতাকে শুতে হল আমার বিছানায়, এক রাতের ব্যাপার এ আর এমন কি, এমন কি আমাদের কাছে হলেও বাবার কাছে নয়, তিনি গভীর রাতে পানি খেতে উঠে এ ঘর ও ঘর পায়চারি করতে গিয়ে গীতাকে আমার বিছানায় আবিষ্কার করে চিবিয়ে চেঁচিয়ে হুংকারে গর্জনে নিঝুম রাতকে গনগনে দুপুর বানিয়ে ছাড়লেন। ছোটদা আর খোকনের সঙ্গে এক বিছানায় বাকি রাত কাটাতে হল গীতার। বাবা গীতাকে আমাদের আশপাশ থেকে দূর দূর করে তাড়ালেও তার প্রতি আমাদের আকর্ষণ দূর হয় না, বরং বাড়ে। তার মুখে হাসি ফোটাতে পড়াশোনা মাচায় তুলে তার সেবায় সদা সর্বদা নিয়োজিত থাকি। জুতো চাইলে জুতো এগিয়ে দিই, চিরুনি চাইলে চিরুনি,পানি চাইলে পানি, গীতা পানির গেলাস ভেঙে ফেললে মাকে বলি আমার হাত লেগে গেলাস ভেঙেছে। গীতাকে আরও দোষ থেকে মুক্ত করি, বিকেলবেলা আমাদের ছাদে ডেকে নিয়ে বিজয়দিবসের মোমবাতি জ্বেলে রেলিংএ, রেলিংএর ওপর দিব্যি সার্কাসের মেয়ের মত হেঁটে যায়, একটু হেলে পড়লেই পড়ে গিয়ে মাথা নিশ্চিত থেতলে যাবে জেনেও সে হাঁটে, আমাদেরও উসকানি দেয় হাঁটতে। রেলিংএ লম্বা হয়ে শুয়ে ব্লাউজের ভেতর হাত দিয়ে এক শলা সিগারেট আর একটি ম্যাচবাক্স বের করে আমাদের অবাক করে দিয়ে সিগারেটে আগুন জ্বেলে টান দেয়, রাস্তার মানুষেরা হাঁ হয়ে দেখে এসব। গীতা বলে, দেখুক, আমার কী! আমার ইচ্ছা আমি সিগারেট খাইয়াম। কার কী কওয়ার আছে! এ বাড়িতে কেউ সিগারেট ফোঁকে না, কোনও পুরুষ আত্মীয়কেই আমি সিগারেট ফুঁকতে দেখিনি, সেখানে মেয়ে হয়ে রাস্তার আর পাড়ার লোককে দেখিয়ে বাড়ির নতুন বউ ছাদের রেলিংএ শুয়ে সিগারেট ফুঁকবে, বাবার কানে গেলে সর্বনাশ তো হবেই, সর্বনাশের সীমাছাড়া রূপটির কথা ভেবে আমার হিম হয়ে আসে শরীর। গীতা বলে, আরে কিচ্ছু হইব না, টান দেও ত! আমার কাপাঁ কণ্ঠ, বাবা জানলে মাইরা ফেলব! গীতা পরোয়া করে না বাবা জানলে কী হবে না হবে সেসবকে। কি করে সিগারেটে টান দিতে হয় শিখিয়ে দেয়। মখু গহ্বরে ধোঁয়া ঢুকিয়েই ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিই নীলাকাশ ঢেকে দেওয়া ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের দিকে। হিম শরীরে অল্প অল্প করে পুলকি উষ্ণতা। অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করি নিষিদ্ধ জিনিসে। সিগারেট কোত্থেকা পাইছ? গীতা বলে,পাইছি। পাইছি, এর বেশি কিছু সে বলে না,ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখে শুধু সিগারেটের আর রহস্যের ধোঁয়ায় গীতাকে দেবী দুর্গার মত মনে হয়। ছাদ থেকে নেমে কুলকুচা করে ধোঁয়ার গন্ধ দূর করে ধোয়া মুখে কুলপু এটেঁ বসে থাকি। সংসারের এসব ছোট ছোট ঘটনাদুর্ঘটনায় গীতাকেই যে শুধু বাঁচিয়ে দিই, তা নয়, ছোটদাকেও বাঁচাই। ছোটদা অভাবের তাড়নায় আনন্দমোহন কলেজের দিকে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দুশ টাকা বেতনে সাপ্তাহিক বাংলার দপর্ণ পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ নিয়েছেন, এতেও তাঁর অভাব ঘোচে না। প্রতিদিনই নাকি সুরে খাকি স্বরে বলতে থাকেন দে না পাঁচটা টাকা দে না, পাঁচ টাকা নাই, তাইলে চারটাকা দে, চারটাকা তো নাই, ঠিক আছে তিন টাকাই দে। তিন টাকা না হলে দুটাকাই। দুটাকা না হলে একটাকা। তাও না হলে আটআনা, চারআনাও ছোটদা ছাড়েন না। চিলের ছোঁ দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দাদার ওষুধের বাক্স থেকেও গোপনে ওষধু সরিয়ে নিয়ে যান ছোটদা। আমরা তা জেনেও, পেটের ভেতর গুঁড়োক্রিমির মত লালন করি ঘটনা। দাদা সকালে গোসলখানায় যান, দাদার গোসলখানায় যাওয়া মানে পেচ্ছাব পায়খানা দাড়িকামানো গোসল সব সেরে আসতে ঘন্টা পার হওয়া, নিশ্চিন্তে দাদার পকেট থেকে তখন আলগোছে টাকা তুলে নেন ছোটদা। বাবার পকেট থেকে টাকা নিতে গেলে বড় একটি ঝুঁকি নেওয়া হয়, কারণ বাবা এত দ্রুত গোসল সারেন যে হুট করে কখন বেরিয়ে আসবেন ঠিক নেই, আর গোসলখানার দরজার মুখেই বাবার ঘর। সে তুলনায় দাদার ঘর অনেকটাই দূরে, বারান্দা পেরোও, দুটো ঘর পেরোও তারপর। ছোটদার প্রয়োজন কিছুতে ফুরোয় না। বেলগাছের তল দিয়ে বেলের গাছপাতা মাটিপাতাও যেন না জানতে পারে এমন নিঃশব্দে হেঁটে পাঞ্জাবি বা ঢিলে শার্টের তলে নয়ত বড় ঠোঙায় নয়ত বাজারের থলেয় ওষুধ নিয়ে সনপ্তর্ ণে কালো ফটক খুলে বেরিয়ে যান ছোটদা। প্রথম প্রথম বলতেন ওষধু তাঁর নিজের দরকার, তাঁর শরীরে অসুখের সীমা নেই। কিন্তু বাড়ির বাইরে ওষধু নেওয়া দেখে যখন প্রশ্ন করি, কই নিয়া যাও ওষুধ? ছোটদার উদাসীন উত্তর বন্ধু বান্ধবরা চায়। ভিটামিন চায়।
ভিটামিনে বেশিদিন পড়ে থাকেন না ছোটদা। কাশির ওষধু , জ্বরের ওষুধ, এমনকি কঠিন কঠিন রোগের কঠিন কঠিন ওষধু সরাতে শুরু করলেন। কেন? বন্ধুরা চাইছে। কেন? বন্ধুরা ওষুধ চাইছে, কারও কাশি কারও জ্বর কারও পেটের ব্যারাম, কারও আলসার। কিন্তু বন্ধুদের কি অসখু লেগেই থাকে বছরভর!
আমার কি একটা দুইটা বন্ধু নাকি!
তা ঠিক, ছোটদার বন্ধুর সীমা নেই। বাড়িতে ছোটদার খোঁজে সাংবাদিক বন্ধু কবি বন্ধু নাট্যকার বন্ধু, চিপাচস বন্ধু ছাত্র, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, বেকার—নানা রকম বন্ধু আসেন। গোঁড়ালি থেকে মাথা, মাথা থেকেও চার পাঁচ হাত উঁচু বয়সের বন্ধু ওঁদের পর্দার আড়াল থেকে দেখি, দেখি আর ইচ্ছে করে ছোটদার মত আমিও ওঁদের সঙ্গে আড্ডা দিই। আমার সে সাহস শক্তি সুযোগ কোনওটাই যে নেই, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই অবশ্য।
তোমার বন্ধুদের এত অসখু হয়। দেখলে ত মনে হয় দিব্যি সুস্থ।
খালি কি বন্ধুদেরই। বন্ধুর বাবার অসুখ, মার অসখু । ওদের কি কম আত্মীয় স্বজন !
কি কর ছোটদা ওষুধ নিয়া, সত্যি কইরা কও তো! একদিন বলি।
ছোটদা রহস্যের রসে ঠোঁট ডুবিয়ে হাসেন।
কেন, কি হইছে?
কিছু হয় নাই। কিন্তু আগে কি কর কও, নাইলে দাদার কাছে কিন্তু কইয়া দিয়াম। আমার হুমকিতে কাজ হয়। ছোটদা বলেন বেচি রে বেচি।
ছোটদার কথায় কাজ হয়, আমি গলে যাই মায়ায়। নিজেই দাদার বাক্স থেকে দামি ওষধু দএু কটি সরিয়ে ছোটদার হাতে দিই, ইয়াসমিনও দেয়। দাদা বাড়ি থেকে যেই না বেরোন, ছোটদা সঙ্গে সঙ্গে ও ঘরে ঢুকে ওষধু তো আছেই, টাকা পয়সা দাদা কোথাও ভুলে রেখে গেলেন কি না খোঁজেন, শেষে আলনা থেকে একটি শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরোন। দাদার অগুনতি শার্ট, টের পান না। হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গেলে কালো ফটকের মুখে বা রাস্তায়, দাদা মখু কালো করে বলেন কী রে কামাল আমার শার্ট পরছস কেন? ছোটদা বলেন,পরছিলাম,খুইলা থইয়ামনে, চিন্তা কইর না।
একদিন,আইচ্ছা আমার টেট্রনের নীল শার্টটা কইরে? প্যাণ্টের ওপর গেঞ্জি গায়ে মোজা পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বোকা বোকা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে থাকেন দাদা।
কী জানি, মা ধুইতে নিছে বোধহয়!
আরে না, ওইটা ধোয়া ইস্ত্রি করা ছিল।
তাইলে জানিনা।
শাদা শার্টটাই বা কই! পকেটে যে শীলা ফুলের কাজ কইরা দিছিল!
সেইটা না তুমি কালকে পরলা!
আরে না, কালকে ত আমি লাল শার্ট পরছি।
মারে জিগাস কর, আমি জানি না।
দাদা মাকে জিজ্ঞেস করেন, মাও জানেন না।
ক্যাঁটকেঁটে লাল কুচরিমুচরি একটি শার্ট পরে মন খারাপ করে বাইরে চলে যান দাদা। তাঁর ব্যস্ততা অনেক, ফাইসন্স কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভ তিনি, আজ টাঙ্গাইল যাচ্ছেন, পরশু নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে ফিরেই আবার জামালপুর। দাদার ফর্সা মুখ রোদে ঘুরে ঘুরে কালো হয়ে যেতে থাকে। দাদার জন্যও আমার মায়া হয়।
ছোটদাকে বলি, ওষধু বেইচা অনেক টাকা পাও, তাইলে আমার থেইকা আর দুই তিন টাকা নেও কেন!
কি যে কস! বেশি টাকা পাই না তো! এইগুলা তো স্যাম্পল,ডাক্তারদেরে দেওয়ার জন্য, দেখস না লেখা আছে বিক্রয়ের জন্য নহে! যা দাম, তার অর্ধেকের চেয়ে কম দাম দেয় দোকানদাররা। ছোটদা বুঝিয়ে বলেন।
ওষুধের থলে হাতে করে প্রায়ই বেলগাছের তল দিয়ে ছোটদার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মাও লক্ষ্য করেন, বাবাকে কোমল কণ্ঠে বলেন, কামালরে একটা ভাল চাকরি টাকরির ব্যবস্থা কইরা দেওয়া যায় না!
বাবারও কোমল কণ্ঠ, হ,দিতে পারি। কুলিগিরি করার একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি।
এইসব কি কন!
কেন? কুলিগিরি তো ভাল চাকরি। কুলিগিরি কইরা মাইনষে থাকতাছে না? ও করুক। কুলিদের তো লেখাপড়া না করলেও চলে। বস্তাডা মাথায় উঠাইয়া হাঁটলেই হয়, ফিজিক্স জানতে হয় না, কেমেস্ট্রি জানতে হয় না।
কোমল থেকে দৌড়ে কণ্ঠ রোষের দিকে যাচ্ছে, লক্ষ করে সরে যান মা।
গীতা নতুন নতুন শাড়ি পরে বাইরে যাচ্ছে ছোটদার সঙ্গে, নতুন নতুন সাজার জিনিস ওর। মা আড়ে আড়ে এসব দেখে ছোটদাকে বলেন তা কামাল, তর ত একটা ভাল প্যান্ট নাই, শাটর্ও নাই, নোমানের শাটর্গু লা পরস, তুই নিজের লাইগা শার্ট প্যান্ট কিনতেও ত পারস! ঘরের মধ্যে ছিঁড়া লঙ্গি পইরা থাকস। নিজেরে শাতাস ক্যা?
টাকা আছে নাকি কিনব? ছোটদা মলিন মখু করে বলেন।
টাকা নাই কেন? চাকরি করস না?
যে টাকা পাই চাকরি কইরা, রিক্সাভাড়াও হয় না।
বউএর লাইগা ত ঠিকই কিন্যা আনস।
গীতার লাইগা? গীতারে ত আমি কিচ্ছু দিতে পারি না। ওর যা আছে, ওর নিজের। ওর মা দিছে।
শুন বাবা কামাল। তোমার কাছে আমরা কিছু চাই না। তুমি তোমার বউরে কিন্যা দিবা তা ত ভাল কথা। বউরে তুমি দিবা না তো কে দিব! আমার কথা হইল, নিজেরেও তুমি কিছু দিও। তোমার একজোড়া ভাল সেন্ডেল নাই। সেন্ডেল কিনো।
পইসা দেন, কিনি। ছোটদা বলেন।
অনেকক্ষণ নৈঃশব্দের পুকুরে একা একা সাঁতার কেটে পাড়ে ওঠেন মা।
আমার টাকা থাকলে তো তোমারে দিতামই। আমারে টাকা পয়সা কে দেয়! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বলতে বলতে,লেখাপড়া যদি করতে পারতাম, তাইলে তো একটা চাকরি করতে পারতাম। আমার কি কারও ওপর নির্ভর করতে হইত!
এরপর দু সপ্তাহ ধরে বাবার কাছে হাত পেতে পেতে টাকা নিয়ে মা ছোটদার জন্য একটি লুঙ্গি, দুটি শার্ট আর একজোড়া বাটার সেন্ডেল কিনে আনলেন। ছোটদার অভাব তবু শেষ হয় না। তিনি সকাল বিকাল ওষধু সরাতে থাকেন।
আচ্ছা শরাফ আইছিল এর মধ্যে? দাদা দুই ভুরুর মাঝখানে ঢেউ তুলে জিজ্ঞেস করেন।
কি জানি জানি না।
নিশ্চয় আইছিল।
কেমনে বুঝলা আইছিল?
আমার ওষুধ আমি গুইনা কম পাইতাছি।
শরাফ মামা নিছে নাকি?
ও একটা আস্তা চোর। ও নিছে নিশ্চয়।
শুনে চৌচির কণ্ঠে মা বলেন,দেখ নোমান, না জাইনা না শুইনা মাইনষেরে হুদাই দোষ দিস না। শরাফ এই বাড়িতে আজকে তিনমাস ধইরা আসেনা। আর ওরে যে চোর কস, ও কি চুরি করছে তর?
আরে জানেন না মা, ও আমার কাছ থেইকা পঞ্চাশ টাকা কর্জ নিছিল, কইল পরদিনই নাকি দিয়া দিব। পাঁচমাস হইয়া গেল, দেওনের নামগন্ধ নাই।
মা অন্য ঘরে চলে যান। অন্য ঘরে একা বসে থাকেন। অন্য ঘরের জানালা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসে, মা সেই হু হু হাওয়ার সঙ্গে মনে মনে কী কথা বলেন কে জানে। মার কষ্টের কথা আমরা কেউ বুঝি না, দাদার সঙ্গে তাল দিয়ে বলি শরাফমামা আসলেই একটা চোর, সেইদিন সে আইল, আমি তারে ঘরে রাইখা একটু বাইরে গেলাম, ফির্যা আইসা দেখি আমার স্বর্ণের দুলটা নাই, রাখছিলাম টেবিলের উপরে।
তাইলে তর ওই দুল শরাফই নিছে। দাদা নিশ্চিন্ত।
দাদা অবশ্য তাঁর ওষধু থেকে থেকে নেই হয়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ধার করেন পরে। ছোটদার ঘরে কখনও কোনও কারণে গেলে আলনাতেও চোখ পড়ে তাঁর। নিজের ছ সাতটা শার্ট ছোটদার আলনা থেকে তুলে নিয়ে বেরোন ঘর থেকে, বারান্দায় বেরিয়ে মাকে দেখিয়ে বলেন কামালের ঘর সিজ কইরা এইগুলা পাইলাম।
এসব দেখে গীতা ছোটদাকে বলে, মইরা যাইতে পারো না? এই জীবন নিয়া বাঁইচা থাকার তোমার কি দরকার! নিজের মুরাদ থাকলে শার্ট কিন্যা লও। না পারলে ল্যাংটা থাকো। শুনে ছোটদা কালো মাড়ি বের করে হাসেন। গীতা চাপা স্বরে বলে, হাসো? লজ্জা শরম কিছু কি তোমার আছে? বাড়ির সবাই তোমারে অপমান করতাছে, তাতেও তোমার শিক্ষা হয় না! আমারে কেন এই নরকের মধ্যে আইন্যা ফেলছ?
গীতার মেজাজমজির্ বাড়ির কারও সাধ্য নেই বোঝে। এই নেচে বেড়াচ্ছে, হেসে বেড়াচ্ছে, এই আবার মখু গোমড়া করে বসে আছে। কখনও কখনও দরজার ছিটকিনি এঁটে সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। খাবার সময় হলে মা বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকেন ও আফরোজা, আফরোজা! উঠ। খাইবা না? না খাইলে শরীর খারাপ হইব। উঠ আফরোজা, খাইয়া লও। গীতা মিত্র ওরফে আফরোজা কামাল মখু বিষ করে অনেক ডাকার পর উঠে খেয়ে দেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। অনেকদিন পর মা তাঁর দেরিতে দুধ ছাড়া, দেরিতে কথা বলা, প্রায়-তোতলা প্রায়-কোলের ছেলেকে কাছে পেয়েছেন, ছেলে আর ছেলে-বউএর খাবার নিজে হাতে রেধেঁ বেড়ে ঘরে আনেন, ঘরেই ওদের, প্রায়-মুখে তুলে খাওয়ান। আধেক হিন্দু আধেক মুসলমান বউটির মন ভাল করার জন্য মা আদাজল খেয়ে লাগেন যেহেতু বউটির মন ভাল থাকলেই ছোটদার মন ভাল থাকে। অথবা গীতার মন পেতেই মা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন যেহেতু বাড়ির আর কারও মন পাওয়া দুরূহ ব্যাপার, অথবা বাবার হম্বিতম্বিতে অনভ্যস্ত গীতাকে মা আদরে আহলাদে সহনীয় করাতে চান এ বাড়ি। বাড়ি ফিরে ছোটদা, কোনওদিকে না ফিরে, সোজা ছোট ঘরটিতে ঢুকে যান। ভেজানো দরজা ঠেলে হঠাৎ ঢুকলেই দেখি গীতা দেয়ালের দিকে মখু করে শুয়ে আছে, ছোটদা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর ধ্যানমগ্ন ঋষির মত জপ করছেন, গীতা গীতা গীতা ও গীতা।
ছোটদার হাতে লিস্টি পড়তে থাকে, গীতার ব্লাউজ লাগবে, শাড়ি লাগবে, লিপস্টিক লাগবে, রুজ পাউডার লাগবে। শুকনো মখু ছোটদার আরও শুকনো লাগে, শুকিয়ে ঠোঁটের চামড়া ফেটে যেতে থাকে। বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে কথা কোনও প্রয়োজন ছাড়া বলেন না। অন্যমন।
ছোটদার চাকরি করার খবর পেয়ে বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—নিজের কপাল নিজে খাইলে কার কী বলার থাকে। না,কারও কিছু বলার থাকে না। ছোটদা নিজের কপাল রীতিমত চিবিয়ে খাবার ব্যবস্থা করলেন। সাংবাদিক হয়ে গেছেন, হাতে একটি ডায়রি নিয়ে সকালে বেরিয়ে যান, দুপুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার বেরোন, সন্ধেয় ফেরেন বউ এর জন্য কোনওদিন শাড়ি, কোনওদিন ব্লাউজ, কোনওদিন রুজপাউডারলিপস্টিক নিয়ে। ছোটদা বাড়ি এলেই মা রান্নাঘরে চলে যান খাবার আনতে। যেদিন ফিরতে ছোটদার বিকেল হল, টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন মা, ছোটদা ঘর থেকে শুকনো মুখে বেরিয়ে খেতে আসেন,না একলা নয়, গীতার কোমর জড়িয়ে টেনে আনছেন সঙ্গে খেতে। গীতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলছে, আমার আবার খাওয়া কি! আমার না খাইলেও চলবে। অথচ গীতা আমাদের সঙ্গে খেয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিল, কিন্তু মুখ এমন শুকনো যে ছোটদা ধারণা করেন তাঁর সুন্দরী বউখানা না খেয়ে কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। গীতা খাবে না বলে ছোটদাও খাবেন না। মা বললেন ও যখন কইতাছে, ওর সাথে আরেকবার খাও আফরোজা।
না। না। আমি খাব না।
ছোটদা গীতাকে টেনে এনে কাছে বসিয়ে ভাত তরকারি মেখে গীতার মুখে তুলে দেন। গীতা মুখে ভাত নিয়ে নাক কপাল কুঁচকে রাখে, যেন বিষ দেওয়া হয়েছে মুখে। মুখের বিষ মুখেই রেখে দেয় সে, চিবোয় না, গেলে না। ছোটদা গীতার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন সোনা আমার, মানিক আমার, অল্প একটু খাও। তুমি না খাইলে আমি খাব না।
গীতা বিষ গিলল না, ছোটদাও খেলেন না। উঠে গেলেন। মা রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে উঠলেন খাবার ঘরে, হাতে বাটি, বাটিতে মাংস,কী রে আমি আরও তরকারি লইয়া আইলাম তুই উঠলি কেন? খাইয়া ল। সারাদিন খাস নাই, কামাল!
ছোটদা মখু ছোট করে বললেন না মা, আমি খাইছি বাইরে।
মা উদাস বসে থাকেন খাবার টেবিলে সামনে ছোটদার না খাওয়া ভাত তরকারি নিয়ে।
মার চোখের পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ।
ছোটদাকে উঠোনের রোদে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে গা মেজে এই সেদিন গোসল করিয়ে দিতেন মা। এখন ছোটদা নিজেই নিজের গোসল সারেন। মা প্রায়ই বলেন কি রে তর গোড়ালিতে এত ময়লা জমছে কেন, মাজস না নাকি? ছোটদার চুল সরিয়ে কানের পেছন, ঘাড়ে, গলায় আঙুল ডলে মা বলেন, কড় পইড়া গেছে। মা নাক কুঁচকে উঠোনে থুতু ফেলেন। ছোটদা না গোড়ালির দিকে, না মার দিকে ফিরে তাকান। তিনি তাকিয়ে থাকেন গীতার দিকে। গীতার মখু টি বিষণ্ন লাগছে কেন! গীতার মখু টি কিছুক্ষণ আগে বিষণ্ন ছিল না, গীতা ইয়াসমিনের সঙ্গে লুডু খেলছিল আর ডিমের পুডিং খাচ্ছিল। অনেকদিন নাকি পুডিং খায়নি ও, অনুযোগ করাতে মা সাততাড়াতাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। পুডিংএর পর চেয়েছিল খেঁজুরের গুড় দিয়ে বানানো পায়েশ খেতে, মা তাও দিয়েছেন। দিয়ে মা ফুঁকনি ফুঁকে খড়ি নেই শুকনো পাতায় রান্না করেছেন, খেতে দিয়েছেন টেবিলে, ছোটদা গীতাকে কোলের ওপর বসিয়ে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছেন, চুমু খাচ্ছেন আর বলছেন মনডা বেজার কেন, কি হইছে? গীতা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কোনও উত্তর দেয় না। ছোটদা বাড়ি এলেই গীতার হাসি মখু টি হঠাৎ কান্না কান্না হয়ে থাকে। মখু টি এমন যেন সারাদিন খায়নি, জল অবদি পান করেনি, যেন বাড়ির মানুষগুলো গীতাকে সারাদিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন ছোটদা, গীতার শুকনো মখু ভেজা করতে, কান্না কান্না মুখে হাসি ফোটাতে দিন রাত উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন গীতায়। মা লক্ষ করেন। আমরাও। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গোপনে। গল্প উপন্যাস বা সিনেমা থিয়েটারের প্রেম কাহিনীর চেয়ে আমাদের বাড়িতে ঘটতে থাকা প্রেম কাহিনীতে আমরা বিভোর হয়ে থাকি। চোখের সামনে কাউকে কি এ যাবৎ দেখেছি এক বাড়ি মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরতে, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে! না।
আমি আর ইয়াসমিন গীতাকে বিস্ময় চোখে দেখি। গীতা ইস্ত্রি করা শাড়ি ভাঁজ খুলে খুলে পরে, উঁচু জুতো পরে, লিপস্টিক লাগায় ঠোঁটে, কপালে টিপ পরে, সগু ন্ধি লাক্স সাবান নিয়ে গোসলখানায় যায়। ওর সব কিছুই অন্যরকম। আমাদের চুল প্রথম বাংলা সাবান দিয়ে ধুয়ে পরে গোসলের সাবান দিয়ে ধুই। ছোটবেলা থেকেই মা এভাবে ধুতে শিখিয়েছেন। চুলের ময়লা দূর করতে গোসলের সাবান খরচ করলে সাবান ফুরিয়ে যাবে বলেই এই কপৃ ণতা। কারণ বাবা বাংলা সাবানই বেশি বাড়িতে পাঠান, গোসলের সগু ন্ধি সাবান কদাচিৎ। মাকে চারদিকে কাপর্ণ ্য করতেই হয়। বাবার ধন তো, মা বলেন, এক সংসারের জন্য নয়, গ্রামে তাঁর বাবা মা ভাই বোনের সংসার আছে, শহরে তাঁর দ্বিতীয় বউ এর সংসার। মাকে দু রকম খাবারও রাধঁ তে হয়। বাড়ির সবার জন্য এক রকম, মা আর কাজের মানুষগুলোর জন্য আরেকরকম। সেই আরেকরকমে বাসি ডাল, শুটকির তরকারি আর নিরামিষ ছাড়া অন্য কিছু যদি জোটে সে কাঁচকি মাছ নয়ত টেংরা-পুঁটির ঝোল। মাছ মাংস রান্না হলে সে আমাদের জন্যই থাকে। আমাদের মানে বাবা, ভাই বোন আর নতুন আসা গীতা। গীতাকে আগে থেকেই চিনি, এ নতুন গীতা নয় কিন্তু কামালের বউরূপে আসা গীতাকে অবকাশে অন্যরকম দেখতে লাগে। বাবার সামনে মাথায় কাপড় দেওয়া, মার সামনে মাথার কাপড় ফেলে দেওয়া, আমাদের সামনে ধেই ধেই করে নেচে বেড়ানো, ছোটদার সামনে গাল ফুলোনো গীতার সব ব্যাপারে আমার আর ইয়াসমিনের বেড়ালি কৌতুহল। স্বামী স্ত্রীর জীবন চোখের সামনে যা সবচেয়ে বেশি দেখা আমাদের,তা বাবা মার। বাবা মার সম্পর্কে তেল নুন চাল ডালের হিশেবের মধ্যে বাঁধা, এক সঙ্গে দুজনকে আমি কোনওদিনই ঘনিষ্ঠ দেখিনি,মধুর কোনও বাক্যালাপও ঘটতে দেখিনি, একসঙ্গে কোথাও দুজন বেড়াতে যান নি, এক ঘরেও এখন ঘুমোন না, এক বিছানায় তো নয়ই। মার ছোট ঘরটি ছোটদা আর গীতার জন্য গুছিয়ে দেওয়ার পর মা উদ্বাস্তুর মত থাকেন, কোনওদিন আমার ঘরে, কোনওদিন বৈঠকঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে। বাবা হচ্ছেন বাড়ির কর্তা, বাবা যেভাবে আদেশ করবেন, সংসার সেভাবে চালাতে হবে মাকে, এরকমই নিয়ম। এই নিয়মে অভ্যস্ত আমাদের সামনে এক দম্পতিকে আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, স্ত্রী সেবায় সদা সর্বদা সজাগ স্বামী। অন্যরকম বৈকি। মার নজরে পড়ে ঘটনা, আমাদেরও পড়ে। আমাদের কৌতূহল বাড়ে, আমার আর ইয়াসমিনের। মার কমে। মা অচিরে টের পান মার কোলের ছেলে মার তোতলা ছেলে মার কোল ছাড়া হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ছোটদার জগত জুড়ে জীবন জুড়ে এখন গীতা। গীতাকে সুখী করতে যা কিছু করতে হয় করবেন। মা বাবা ভাই বোনের মূল্য তাঁর কাছে আর নেই। মা উদাস বসে থাকেন একা বারান্দায়, থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কামাল যে কহন বাসাত আসে, কহন যায়, কিছুই টের পাই না। আমারে আর মা মা কইরা ডাকে না, ডাইকা কয় না মা যাই, মা আইছি।
গীতা হঠাৎ একদিন ঢাকা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গীতার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর হাত আমাদের তো নেই-ই, ছোটদারও নেই। বাক্স পেটরা নিয়ে সে যেদিন অবকাশ ছেড়ে যাচ্ছে, কালো ফটক ধরে আমরা করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। ঢাকায় আমানুল্লাহ চৌধুরির বাড়িতে যাচ্ছে গীতা। আমানুল্লাহ চৌধুরির বাপের বাড়ি ময়মনসিংহে, গীতার বাড়ির কাছেই, সেই সূত্রে চেনা। চৌধুরির বউ রাহিজা খানম নাচের ইশকুল খুলেছে, সেই ইশকুলে নাচ শিখবে গীতা। রাহিজা সুযোগ দিলে গীতা বড় নৃত্যশিল্পী হতে পারবে। নাচের অনেক মেয়েই চৌধুরির বাড়িতে থাকে, চৌধুরির বাচ্চা কাচ্চাদের দেখে রাখে। গীতাও তাই করবে। বউকে ঢাকায় রেখে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন ছোটদা। পরের সপ্তাহে বাবা ছোটদার হাতে টাকা দিয়ে ঢাকা পাঠালেন আবার, গীতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর আদেশ। গীতাকে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে ছোটদা ফেরেন। নিজের বাংলায় অনাসর্ পড়া গোল্লায় গেলেও গীতাকে বিদূষী বানাবেন, এই স্বপ্ন ছোটদার। ছোটদার কাজ এখানে নিজের ভবিষ্যত তৈরি করা, ভাল চাকরি জোটানো টাকা পয়সা যতটা পারেন কামিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া। বাড়িতে যতক্ষণ তিনি থাকেন, বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে বসে লম্বা লম্বা চিঠি লেখেন, বিয়ের আগে যেমন লিখতেন, সেই সব বত্রিশ পৃষ্ঠা চিঠির মত চিঠি। ওদিক থেকে চিঠি আসে, ছোট চিঠি, চিঠির সঙ্গে লিষ্টি আসে। লিস্টি পকেটে নিয়ে ছোটদা বেরিয়ে যান, জিনিসপত্র কিনে কাগজে মুড়ে বাড়ি নিয়ে এসে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বড় বড় প্যাকেট করেন ঢাকা পাঠাতে। মা দেখেন, আড়ালে চোখের জল মোছেন। এই যে কামাল টাকা কামাইতাছে, বউরে কত কিছু জিনিস কিন্যা দিতাছে, কোনোদিন তো কইল না মার হাতে কিছু টাকা দিই। পাঁচটা টাকাও ত সাধে নাই কোনওদিন। মার এই হাহাকার কাউকে স্পর্শ করে না। মা একাই ছিলেন, আরও একা হতে থাকেন। অন্ধকারে বারান্দায় বসে থাকা মার হাতের তসবিহর গোটা স্থির হয়ে থাকে।
গোটা শহরে ছোটদার বন্ধু। বাড়িতে ছোটদার খোঁজে এলে ছোটদা সাধারণত ওদের নিয়ে বাইরে চলে যান। কখনও সখনও ছোটদা বাইরের বারান্দা-ঘরে বন্ধু নিয়ে বসেন। মাকে বলেন চা দিতে। মা চা বানিয়ে জরির মার হাতে পাঠিয়ে দেন। ঘরে সবসময় চায়ের সরঞ্জাম থাকে না। চিনি বা দধু না থাকলে এম এ কাহহারের বাড়ি পাঠিয়ে এক কাপ চিনি বা দুধ ধার করে আনা হয়। এম এ কাহহারের মত ধনীর বাড়ি থেকেও লোক আসে মাঝে মাঝেই চিনি বা দধু ধার করতে। এক কাপ চিনি বা দধু ধারের ব্যাপারটি আমাদের কাছে ডালভাত। চায়ের সংগে দুটো টোস্ট বিস্কুট নয়ত নাবিস্কো বিস্কুট দিতে হয়, বাড়িতে বিস্কুট সবসময় থাকে না, তখন শুধু চা তেই আপ্যায়ন সারতে হয়। এক রাতে, বলা যায় গভীর রাতে, প্রায় সাড়ে বারোটায় ছোটদার এক বন্ধু যখন দরজার কড়া নাড়ল, ছোটদা তখন কেবল শুতে যাচ্ছেন। বাবা নেই বাড়িতে,বাড়ির আর সবাই ঘুমিয়ে। আমার ঘুম ভেঙে যায় দরজার শব্দে। বৈঠকঘরের পর্দা সরিয়ে দেখি হরিণ হরিণ চোখের মিষ্টি মিষ্টি হাসির এক ছেলের নিভাঁজ নিটোল মুখে চাঁদের আলো চুমু খাচ্ছে। আমার ওই উঁকি দেওয়া মুখের অর্ধেকখানি দেখেই ছেলেটি বলল, নাসরিন না! কত বড় হয়ে গেছ তুমি! ছেলেটির দীপ্ত চোখ আমার মখু থেকে সরে না। আমি সংকোচে নত করি চোখ।
আমাকে মনে নাই তোমার? আমি জুবায়ের।
আমি কোনও উত্তর দিই না। জুবায়ের জিজ্ঞেস করে, তুমি গান পছন্দ কর? মৃদু কণ্ঠে বলি হ্যাঁ করি। দাঁড়িয়েই ছিলাম, ছোটদা বললেন, যা ভেতরে যা, মারে চা দিতে ক ত দুই কাপ। মা ঘুমিয়ে ছিলেন, ঠেলে উঠিয়ে বলি, ছোটদার বন্ধু আইছে, দুই কাপ চা দেও। মা পাশ ফিরে বলেন, জরির মারে ক। জরির মা মেঝেতে কুকুর কুণ্ডুলি, জাগিয়ে বলি, দুই কাপ চা কর। জরির মা ঘুমচোখে রান্নাঘরে গিয়ে শুকনো কাঁঠাল পাতা চুলোয় গুঁজে আগুন ধরিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে দেয়। পানি গরম হল বটে, কিন্তু চা পাতা কই, চিনি কই, দধু ই বা কই! মা জানেন কই। মাকে আবার ডাকি, উইঠ্যা চা বানাইয়া দেও। পানি গরম হইয়া গেছে।
মা আবারও পাশ ফিরে শুলেন, এত রাইতে আমারে জ্বালাইস না। আমার শইলডা বালা না।
মা উঠলেন না। জিজ্ঞেস করলেন বাবা ফিরেছেন কি না। ফেরেনি বলাতে বললেন ওই মাগীর বাড়িত রাইত কাডাইতাছে। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকি। চমৎকার গলায় গান গাইছে জুবায়ের। নৈঃশব্দের সুতোয় ভর করে গানের সুর ভেসে আসছে ঘরে, সে সুর ঘুমন্ত কাউকে জাগায় না, আর জেগে থাকা আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ইচ্ছে করে পুরো রাত গান শুনি, জুবায়েরের পাশে ঘন হয়ে বসে পূর্ণিমায় ভিজে ভিজে তন্ময় হয়ে শুনি, জগত সংসার ভুলে শুনি। রাত দুটোর দিকে আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে গানটি গেয়ে জুবায়ের চলে গেল।
পরদিন ছোটদা বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে রইলেন চপু চাপ।
কি এই অসময়ে শুইছ কেন?
ভাল্লাগতাছে না।
কি হইছে?
কালকে যে জুবায়ের আইছিল, আমার বন্ধু অনেক বছর পরে তার সাথে দেখা।
ছেলেডা খুব সুন্দর দেখতে। গানও ত সুন্দর গায়।
আজকে ভোরে জুবায়ের আত্মহত্যা করছে।
বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা কি জানি কি সারা গায়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। জুবায়েরের সঙ্গে যে মেয়েটির প্রেম ছিল, সে মেয়েকে মেয়ের বাবা ধরে বেঁধে অন্য এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ছোটদা খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন। কাল রাতে জুবায়ের ওই মেয়ে সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি। বলেছে, এত চমৎকার পূর্ণিমায় তার ইচ্ছে করেনি একা একা ঘরে বসে থাকতে, তাই বেরিয়েছে সে, তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে। জুবায়ের যখন গান গাইছিল, ছোটদা পাশে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। জুবায়ের আরও গান গাইতে চাইছিল, কিন্তু ছোটদাই জুবায়েরকে বলেছেন চলে যেতে, কারণ বিছানায় তাঁর তখন না গেলেই নয়। প্রেমের সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্কে বড় নিবিড়। ছোটদাও তাঁর বিয়ের আগে বিষ খেয়েছিলেন। চটজলদি হাসপাতালে নিয়ে পেটে নল ঢুকিয়ে বিষ বের করে নেওয়া হয়েছিল বলে বেঁচেছেন।
এরপর বেশ কয়েকটি রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। কেবলই মনে হয়েছে রাত ফুঁড়ে একটি গান ভেসে আসছে, আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভূলিতে।