হৃদয়ের একূল ওকূল
কাগজে সই নিয়ে যাবার মাস দুই পর রুদ্র চিঠি লেখে, বউ সম্বোধন করে। সম্বোধনটি পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেমন অদ্ভুত আর অচেনা এই ডাকটি। আমি তবে কারও বউ! ওই সইটি তবে কি সত্যি সত্যি বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছে! অবিশ্বাস্য একটি কাণ্ড। নিজের বিয়ে, কোনওদিন কল্পনাও করিনি ওভাবে হবে, হবে যে কোনওদিন, সে বিশ্বাসই ছিল না। জানুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে কাগজে সই করলাম, আর কাগজটি উকিলের কাছে দিয়ে আসার পর উকিল তাঁর নিজের সই আর সীল বসালেন উনত্রিশ তারিখে। শাদামাটা চিঠিতে রুদ্র জানিয়েছে, উনত্রিশ তারিখটি আমাদের বিয়ের তারিখ। উনত্রিশ তারিখে আমি কি করছিলাম, ভাবি, সারাদিন কি একবারও রুদ্রর কথা ভেবেছি? না ভাবিনি, সময় পাইনি, মরা মানুষ কেটেছি, ছোটখাট একটি পরীক্ষা ছিল, প্রচুর পড়তে হয়েছে, পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে আর দিনের মতই টেলিভিশন দেখেছি, ভাই বোনের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছি, আর দিনের মতই কবিতা পড়েছি, গান শুনেছি, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছি। রুদ্রর চিঠি পেয়ে যতই আমি নিজেকে বলি, দেখ তুই এখন আর অবিবাহিত নস, রীতিমত এক লোকের বউ। বিয়ে করলে তো বউই হতে হয়। এরকমই তো নিয়ম, তুই চাস বা না চাস কাগজের ওই সইটিই তোর বিয়ে ঘটিয়েছে, ওই বলাই সার, ব্যাপারটিকে আমার বোধ ও বিশ্বাসের অনগ্তর্ ত করতে পারি না। আমি সত্যি করে অনুভব করতে পারি না যে আমি আর আগের আমি নই, আমি এখন নানি,মা, ফজলিখালা,রুনখুালার মত বিবাহিতা। চন্দনাও বিবাহিতা। বিয়ের পর চন্দনা লিখেছে আমি এখন ভয়শূন্য এক মানুষ। জীবন বাজি রেখে স্বপ্নের হাত ছুঁয়েছি। আমি খুব গভীর করে স্বপ্ন দেখতে জানি এখন। জীবন তো আমার একটাই। আমি ভুল করিনি। আমি এখন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি রক্তগোলাপ। বিবাহিতা চন্দনার আবেগ চাইলেও আমার ভেতর সঞ্চারিত হচ্ছে না। আমার বোধের সীমানায় নেই পুরুষের স্পর্শ নারীর শরীরে কিরকম কাপঁ ন তোলে, আর সেই কাপঁ ন কি রকম তৃষ্ণা জাগায়। কলেজে পুরুষ বন্ধু যা আছে, তা কেবলই বন্ধু। চন্দনা যেমন। কোনও পুরুষকে আজও আমার চুমু খাওয়া হয়নি। কারও জন্য শরীরে কোনও তৃষ্ণা অনুভব করি না। তৃষ্ণা বলে যে একটি জিনিস আছে তা আমার নেহাতই জলের বা চায়ের বা খুব গরমে লেবুর শরবতের।
বউ সম্বোধন করে লেখা রুদ্রর দ্বিতীয় চিঠিটি বাবার হাতে পড়ে। ডাকপিয়ন বাড়িতে চিঠি দিয়ে গেছে, আর পড়বি পড় মালির ঘাড়ে, বাবার হাতে। বাবার যেহেতু অন্যের চিঠি খুলে পড়ার প্রচণ্ড শখ, তিনি পড়েন। তার মেয়েকে কেউ বউ বলে ডাকছে, তিনি তা খালি চোখে, চশমা চোখে সব চোখেই দেখেন। ঘরময় পায়চারি শুরু হয় বাবার, আমার পড়ার টেবিলের বইখাতা তছনছ করেন আরও তথ্য পেতে। ঘন ঘন তিনি চশমা খুলতে থাকেন, চেয়ারে বসতে থাকেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে থাকেন, একসময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, রোগী দেখায় মন বসে না, আবার বাড়ি ফেরেন। এবার মাকে ডাকেন। যখনই ছেলে মেয়ে সংক্রান্ত কোনও দুর্ভাবনা, তখনই বাবা মার খোঁজ করেন, অথবা বাড়িতে অতিথি আসবে, তখনই মার খোঁজ, কই গেলা ঈদুন, এদিকে আসো তো! বাবা হিশেব দেন, কজন আসবে, কতজনের জন্য রান্না করতে হবে, এমনকি কি কি রাধঁ তে হবে তাও। মা মন দিয়ে শোনেন সব। শোনেন কারণ মার এসময় নিজেকে খুব মূল্যবান মানুষ বলে মনে হয়। এ সংসারে তাঁর যে প্রয়োজন আছে, তা উপলব্ধি করেন মা এবং বিচিত্র এক আনন্দ মাকে লেপ্টে থাকে মার ঘামের মত। এবার ডাকার পর হন্তদন্ত হয়ে মা সামনে দাঁড়ালে বাবা বলেন, নাসরিনরে বউ ডাকে কেডা জানো নাকি? কার এত সাহস ওরে বউ ডাকে?
কি জানি, আমি ত এইসব কিছু জানি না।
কোনও ছেলের সাথে জড়াইল নাকি?
এইরকম তো কিছু দেখি নাই। হাবিবুল্লাহরে ত বাড়ি থেইকা ভাগাইল। তেমন কোনও ছেলেও ত বাড়িত আসে না। কারও সাথে জড়াইছে বইলা মনে হয় না।
না জড়াইলে বউ নামে চিঠি তারে কোন বেডায় লেখে?
তা তো জানি না।
খবর তো কিছু রাখো না। কি কর সারাদিন বাড়িতে? মেয়ে কি করতাছে না করতাছে, তার খবর যদি না রাখতে পারো, তাইলে কি লাভ? আমি বাউণ্ডারি ওয়াল উঁচা করলাম। বাইরের কোনও ছেলেপিলে মেয়েদেরে যেন না দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা করলাম। এখন কোথাকার কোন ছেলে ওরে বউ কইয়া ডাকে!
চিঠি লেখে তা জানি। পত্রিকা ছাপায়। এদিকে ওদিকে চিঠি লিখতে হয় কয়।
এই চিঠি কোনও পত্রিকার চিঠি না। এইটা অন্যরকম চিঠি।
আমি বাড়ি ফিরি কলেজ থেকে। মা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসেন অন্যদিন। সেদিন তিনি মোটেও নড়েন না।
কি, ভাত কই?
ভাত পাতিলে। মা বলেন।
আমেনাও নড়ে কি নড়ে না চলে কি চলে না। অসম্ভব শথ্ল গতিতে ভাত বেড়ে নিয়ে আসে। সঙ্গে ডাল।
কি!ডাল দিয়া ভাত দিলা যে! মাছ মাংস নাই।
প্রত্যেকদিন মাছ মাংস লাগব না। মার রুক্ষ কণ্ঠ।
মাছ মাংস ছাড়া আবার ভাত খাওয়া যায় নাকি?
আমি দুমুঠো খেয়ে থালা ঠেলে উঠে চেঁচাই, পানি কই?
মা বলেন, পানি কলে।
পানি কলে সে তো আমিই জানি, কিন্তু দিতে হবে তো।
কে দেবে আমাকে পানি! গজগজ শুরু করলে গজেন্দ্রগামিনী আমেনাই একসময় কল থেকে গেলাসে পানি ভরে নিয়ে আসে। বাড়ি থমথম। অনুমান করি কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে তা বোঝাবার জন্য মা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেন না। বিছানায় টান টান হয়ে একটি বই হাতে নিয়ে যখন শুয়েছি, গম্ভীর মুখে কাছে এসে গম্ভীর মুখেই জিজ্ঞেস করেন, রুদ্র কেডা?
রুদ্র?
হ রুদ্র।
কেন?
সে তরে বউ ডাকে কেন?
বুকের মধ্যে ঠাণ্ডা জলের গেলাস উপুড় হয়ে পড়ে। বোঁ বোঁ পাখার তলে আমি ঘেমে উঠি। দিনের ঝলমল আলো চোখের সামনে অমাবস্যার রাতের মত লাগে। কী কস না কেন, রুদ্র কেডা?
আমার আর বলার দরকার নেই রুদ্র কে! আমার শুধু জানার দরকার, চিঠি মার হাতে পড়েছে না অন্য কারও হাতে। বাবার হাতে হলে জীবনের এখানে এ মুহূর্তে সমাপ্তি। ডাল ভাত তো জুটেছে আজ, কাল কিছুই হয়ত জুটবে না। খানিকটা নরম হলে মা নিজেই বলেন, চিঠি বাবার হাতে পড়েছে। এটি জানার পর নিষ্প্রাণ শরীরটি নিচ্ছিত নিরালায় ফেলে ফেলে রাখি, বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে অপ্রকৃতিস্থের মত উঠে রুদ্রকে লিখি যেন বউ সম্বোধন করে আর একটি চিঠিও সে না লেখে। রুদ্রকে চিঠি আমার এভাবেই লিখতে হয়, বাড়িতে কেউ না থাকলে, অথবা সবাই ঘুমিয়ে গেলে। তা না হলে যে কেউ লেখাটির ওপর ঝুঁকে পড়বে, যে কারও এ বাড়িতে অধিকার আছে দেখার আমি কি লিখছি, আড়াল করতে চাইলে আগ্রহ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
প্রতিদিন সকালে বাবা বেরিয়ে যাবার আগে আমার আর ইয়াসমিনের চাইতে হয় ইশকুল কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়ার টাকা। বাবা গুনে টাকা দিয়ে যান। পরদিন সকাল হয়, বাবার গোসল সারার শব্দ হয়, জুতোর মচমচও শুনি, বাবার নাস্তা খাওয়ার এমনকি পানি গেলার শব্দও পাই, কিন্তু ধড়ে প্রাণ নিয়ে সামনে গিয়ে অন্যদিনের মত নতমুখে দাঁড়িয়ে রিক্সাভাড়ার টাকা চাওয়ার মত কলজের জোর আমার থাকে না। নিজের অস্তিত্বটিই এক বড় বোঝা আমার কাছে। আমি যদি এক তুড়িতে হাওয়ায় হাওয়া হয়ে যেতে পারতাম। আমাকে যদি কেউ দেখতে না পেত! টেলিভিশনে ইনভিজবল ম্যান সিরিজটি দেখে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমি হাড়ে মাংসে অনুভব করি। বাবার কাছ থেকে নিরুদ্বেগে টাকা চেয়ে নিয়ে এসেছে ইয়াসমিন। নিরুদ্যম আমি ঘরের ভেতর দমবন্ধমখু বন্ধ পেটেরতলপেটেরচাপ সব বন্ধ করে বসে থাকি, বাবার মুখোমুখি হতে যেন আমাকে না হয়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে যেন বাড়ির প্রত্যেকে শোনে, মাকে বলেন,ওর লেখাপড়া বন্ধ। ওরে আর কলেজে যাইতে হইব না। সব বন্ধ। ওর খাওয়া দাওয়া বন্ধ কইরা দাও। ভাত দিবা না!
বাবা চলে গেলেন। আমি দশটা অবদি ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা করে রুদ্রর কোনও চিঠি নেই নিশ্চিত হয়ে মার তোশকের তল থেকে টাকা নিয়ে কলেজে যাই। আটটা থেকে কলেজে ক্লাস শুরু হয়। এভাবে ফাঁকি দিলে ভবিষ্যতের বারোটা কেন, তেরোটা বেজে যাবে তা অনুমান করি। পরদিনও একই অবস্থা। ভেবেছিলাম, দিন গেলে বাবা নরম হবেন!নরমের কোনও লক্ষণ নেই। দাদার কাছে হাত পেতে রিক্সাভাড়ার টাকা নিয়ে পরদিন যেতে হয় কলেজে। বাবা নির্বিকার। আমি যে বাড়িতে একটি প্রাণী, তা একেবারে তিনি ভুলে গেছেন। মা উঠতে বসতে ধমকাচ্ছেন আমাকে। মাকে বাবা যা-ই বুঝিয়ে গেছেন, মা তা-ই বুঝেছেন। মা এরকমই, যে যা বোঝায়, তাই বোঝেন, নির্বিবাদে মেনে নেন যে কোনও মানুষের যে কোনও যুক্তি। কেউ যদি বলে এসে, জানো কচু গাছ থেকে পড়ে একজন মারা গেল, মা বললেন আহা, মইরা গেল! মা সবাইকে বলবেনও, জানো কচু গাছ থেকে পইড়া পাড়ার এক লোক একেবারে মইরাই গেল! মা একটুও ভাববেন না যে কচু গাছ থেকে পড়ে কেউ মরে না, আর কচু গাছে কেউ উঠতেও পারে না। মা পৃথিবীর সব লোককে বিশ্বাস করেন, সব লোকের সব কথাকেও করেন।
রুদ্র বউ সম্বোধন বন্ধ করেছে। কিন্তু চিঠি বেহাত হয়ে যাচ্ছে, বুঝি। চিঠি কেবল বাবা সরিয়ে নিচ্ছেন না, দাদাও সরাচ্ছেন। মাও। শেষ অবদি ডালিয়ার শরণাপন্ন হতে হয় আমাকে, খুলনার মেয়ে ডালিয়া, মোটা মোটা বইয়ে সারাদিন ডুবে থাকা ডালিয়া, তোমার হোস্টেলের ঠিকানায় কি আমার চিঠি আসতে পারে ডালিয়া? কাতরোক্তি শুনে খুব পারে বলে দিল। কবিতা লেখার অভ্যেস আছে তার, যেচে শতাব্দী চত্রে²র সদস্যও হয়েছে, তা না হলে এ কাজটি করতে এক কথায় রাজি হত কি না কে জানে, হয়ত সাত রকম প্রশ্ন করত। রুদ্র আবার মাস চার পর ময়মনসিংহে আসে, কলেজ ক্যান্টিনে বসে থাকা রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাই ডালিয়াকে নিয়ে। আসলে যখনই যাই, বেশির ভাগ সময়ই কাউকে না কাউকে নিয়েই যাই, হয় হালিদা, নয় মদিরা, নয় ডালিয়া। একা রুদ্রর মুখোমুখি বসে থেকে আমার কোনও কথা বলা হয় না। কেবল মুখোমুখিই বসে থাকা হয়। অনেকদিন সে বলেছে, একা আসতে পারো না? আমি যে পারি না, সে কথাও বলা হয় না তাকে। কেউ থাকলে সেই কেউএর সঙ্গে কলকল কথা বলে আমার একরকম বোঝানো হয় যে আমি যে কথা বলতে পারি না তা নয়, পারি, আমার শব্দসম্ভার নেহাত মন্দ নয়। অবশ্য শব্দ যা উচ্চাজ্ঞরত হয় তা বেশির ভাগই ডাক্তারিবিদ্যা সম্পর্কিত। রুদ্রকে তখন নীরব শ্রোতা হতে হয়। ফাঁক পেয়ে রুদ্র আমাকে বলে, এবার বিষয়টি জানাও তোমার বাবাকে। আমি সশব্দে হেসে উঠি, এ সত্যিই একটি হাস্যকর প্রস্তাব তার। পাঁচ বছর অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও রকম উপায় নেই। ডাক্তার হওয়ার পর যদি বাবাকে কিছু জানানো সম্ভব, জানাবো, তার আগে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। রুদ্র মন খারাপ করে বসে থাকে। সে বারবারই আমাকে বোঝাতে চায় যে প্রথম বাবা মা একটু রাগ করবেনই, পরে ঠিক হয়ে যাবে। পরে যে কিছুতেই কিছু ঠিক হবে না, সে আমি রুদ্রকে বোঝাতে চেষ্টা করি। মাঝখান থেকে, বলি যে, আমার ডাক্তারি পড়াই জন্মের মত বন্ধ হবে। রুদ্র মখু শুকনো করে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝিয়ে চিঠি লিখি, পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, ভেবো না। রুদ্র লেখে, পাঁচটা বছর আসলেই খুব বেশিদিন নয়। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ বছর আমার জন্য অনেক অনেক দিন, অনেক বছর। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। তোমার সব কিছুই আমি বুঝি, তবু বলছি। সব কিছু বুঝতে পেরেও বলছি। তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা কর। মানসিক পীড়ন কেন? আমার কালো অতীতের দিকে তাকালে বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে, আমার এই পীড়ন কেন। তোমাকে আমি বোঝাতে পারছি না। তুমি জানো না, আমার কোনও বন্ধু নেই। অনেক শুভাকাংখি, অনুরাগী, স্বজনেরা আছে, তারা কেউ আমাকে বুঝতে পারে না। আমার এখন তোমাকে প্রয়োজন, শুধু তোমাকে। অবলম্বনহীন হৃদয়কে আমি বেশিদিন ভাল রাখতে পারব না। রুদ্রর কোনও কালো অতীতের কথা আমি জানি না। কালো অতীত বলতে ঠিক কি বোঝাতে চায় সে তা আমার বোঝা হয় না। আমি এর অর্থ করি, অযথা ঘুরে বেড়ানো, লেখাপড়া না করা, পরীক্ষা না দেওয়া। রুদ্রকে আমি আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা, আমার স্বপ্নের কথা জানাতে থাকি। রুদ্র লেখে, তোমার স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্ন একদম মেলে না। যেখানে তোমার স্বপ্ন খুব শুভ্র, কমনীয় ফুলের মত সেখানে আমি একেবারেই ইটপাথর। জীবনকে আমি অত্যন্ত নির্মম চোখে দেখি। এতটা নির্মমতা হয়ত ভাল নয় তবু কেন জানি এরোমই আমার হয়। এক কাজ করলে কেমন হয়, স্মৃুতি বন্টনের মত শুভ্রতা আর শ্যামলিমার স্বপ্ন তোমার হোক, আমার হোক গ্লানি আর নির্মমতার স্বপ্ন। ভাল মন্দ মিলিয়েই তো জীবন। আমরা এইভাবে ভাগাভাগি করে নেব কেমন! আমার বোঝা হয় না মানুষ কি করে স্বপ্ন দেখতে পারে অসুন্দরের। অসুন্দরের সঙ্গে তো আমার নিত্য বসবাস, তাই স্বপ্ন দেখি সুন্দরের। রুদ্রকে যে করেই হোক পরীক্ষা দিতে বলি, এমএ পাশ হলে ভবিষ্যতে হয়ত রুদ্রর কথা কখনও কোনওদিন বাড়িতে উচ্চারণ করা যাবে, কিন্তু রুদ্র বলে বোধহয় কোথাও একটা ভুল থেকে যাচ্ছে, একটা ফাঁকি, খুব সূক্ষ্ম যার ফাটল, না বোঝার তীক্ষ্ম আর মিহি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। এই সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে একদিন লক্ষিন্দরের বাসরে যে ভাবে কালনাগিনী ঢুকেছিল, ঠিক সেভাবেই অবিশ্বাসের সাপ ঢুকবে, ঢুকবে না পাওয়ার আক্ষেপ আর ব্যথর্ আকাঙক্ষার ক্লান্তি। আমাদের সতর্কে হওয়া উচিত, আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। কৈশোর শেষ হবার সাথে সাথেই আমি খুব ধীরে ধীরে আমার জীবন যাপন, আমার বিশ্বাস পরিবর্তন করছি একটি বিশেষ লক্ষে। একাডেমিক ক্যারিয়ার বলতে যা বোঝায়, তা প্রায় সম্পূর্ণই ধ্বংস করে ফেলেছি। হ্যাঁ অনেকটা ইচ্ছে করেই। আমাদের এই সমাজ, এই জীবনের অনেক অন্ধকার, অনেক আলো, অনেক ঘৃণা অনেক অবিশ্বাস, প্রতারণা, আর অনেক বিশ্বাস আর ভালবাসা আমি দেখেছি। হয়ত সারা জীবন এইভাবে পুড়ে পুড়ে দেখব। দেখব দুরারোগ্য অসুখের জীবাণু দেহে নিয়ে কতটা তার যন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা। আমার ঘরের উঠোনে হয়ত কোনওদিন রজনীগন্ধা ফুটবে না। হয়ত আমার টেবিলের ফুলদানির পরিবর্তে থাকবে একটা মস্ত বড় মাটির অ্যাশট্রে। হয়ত আমার প্রিয় সঞ্চয় হবে একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার হেলমেট। কিংবা একটা মানুষের খুলি। কোথাও নিশ্চয়ই কোনও ভুল হচ্ছে, এত ফুল, এত পাখি আর এত সুখের স্বপ্ন তো আমি দেখি না। তুমি কেন দেখ? আমি তো দুটি পরিশ্রমী আর কর্মব্যস্ত মানুষের স্বপ্ন দেখি। দিনে রাতে খুব কমই অবসর তাদের।
বাড়িতে রুদ্রর চিঠি না আসতে থাকায় কোনও এক মাথা-পাগল কবি কোনও এক ভুল আবেগে আমাকে কোনও একদিন বউ বলে সম্বোধন করেছিল, বেটার দুঃসাহস এখন কমেছে ভেবে সকলে শান্ত হন, ঘটনা চাপা পড়ে। চাপা পড়ার আরও একটি কারণ হল, বউ বলে সত্যি সত্যি কেউ আমাকে ডাকতে পারে, সত্যি সত্যি আমি কারও বউ হতে পারি এ কল্পনা করা এ বাড়ির কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর আমি সময়মত কলেজ থেকে ফিরছি, কোথাও কোনও সন্দেহজনক বিলম্ব হচ্ছে না, এনাটমি ফিজিওলজি বইয়ের ওপর মখু গোঁজা থাকে বেশির ভাগ সময়, বাবা মা দাদার তিনজোড়া ভুরুর কঞ্চু ন বন্ধ হয়। বাবা তাঁর রাগটি কলের জলে গুলে ফেলেন, কারণ সামনে পরীক্ষা আমার। পরীক্ষার নাম ফার্স্ট প্রফেশনাল, সংক্ষেপে ফার্স্ট প্রফ। তিনটে পরীক্ষা হয় মেডিকেলে, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তৃতীয় বষের্ ওঠার পরীক্ষাকে বলা হয় ফার্স্ট প্রফ, তৃতীয় থেকে চতুথর্ বষের্ ওঠারটি সেকেন্ড প্রফ, আর চতথুর্ থেকে পঞ্চম বষের্ উঠতে হয় থার্ড প্রফ দিয়ে। পঞ্চম বর্ষের যে পরীক্ষা, সেটি ফাইনাল। ফাইনালের পর ডাক্তার। একবছর প্রশিক্ষণ। তারপর চাকরি। প্রশিক্ষণের সময় ভাতা দেওয়া হয়, মন্দ ভাতা নয়। চাকরি করলে বেতনও মন্দ নয়, তবে বদলির চাকরি, সরকারি ইচ্ছেয় বদলি হতে হবে, এখানে নিজের ইচ্ছে বলে কিছু থাকে না। অবশ্য মামা চাচা থাকলে থাকে। মামা চাচা বলতে, লোক থাকলে, মন্ত্রণালয়ে নিজেদের আত্মীয় লোক, অথবা বিএমএতে খাতিরের লোক। ফার্স্ট প্রফ পরীক্ষায় আমার পাশ হবে বলে আমার মনে হয় না। এতকাল গৃহশিক্ষকেরা আমাকে পড়া গিলিয়ে দিয়ে গেছেন, মেডিকেলে কোনও গৃহশিক্ষক নেই, থাকার কোনও নিয়ম নেই, আমাকে গেলাবার কেউ নেই, নিজেকে গিলতেই হয় যা কিছু য়েচ্ছা গলাধঃকরণে অভ্যেস কম আমার, তাই উদ্বেগ আমাকে মাথার উকুনের মত কামড়ায়। তার ওপর বইয়ের ভাষা ইংরেজি, কোনও দেবনাথ পণ্ডিত নেই যে বলবেন এরে ইংরেজি মিডিয়ামে না দিয়া বাংলা মিডিয়ামে দিয়া দেন, এর দ্বারা ইংরেজি পোষাবে না। বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যার কোনও বই নেই। ইংরেজিতে লেখাপড়া ছাড়া গতি নেই কোনও।কিন্তু বাঁচা যে এ ইংরেজি সাহিত্য নয়। ইংরেজি লিখতে গিয়ে বা বলতে গিয়ে ব্যাকরণ কি বানান ভুল হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথায় কি আছে, কি কাজ তাদের, অনপুুঙ্খ জানা চাই। এতে কোনওরকম ক্ষমা নেই। এসবের বর্ণনা ইংরেজিতে লিখতে বা বলতে গিয়ে ব্যাকরণের কথা কেউ ভাবেও না। একটি জিনিস মনে উদয় হয় আমার, ফরাসি দেশ বা জার্মানি বা স্পেন বা ইতালি বা রাশিয়া, যেসব দেশের ভাষা ইংরেজি নয়, সেসব দেশে তাদের নিজেদের ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিখছে ছাত্রছাত্রীরা, তবে এ দেশে কেন বাংলায় বই হয় না? অন্য একটি ভাষায় কোনও বিদ্যা অর্জন করার চেয়ে নিজের মাতৃভাষায় বিদ্যা অর্জন করলে সে বিদ্যা রপ্ত হয় ভাল বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমার বিশ্বাসের তোয়াক্কা কেউ করে না। একটি ভিনদেশি ভাষার ওপর নির্ভর করে সকলে এই বিশেষ বিদ্যাটি অর্জন করে। পড়াশোনার চাপে আমার যাবতীয় আউটবই, সেজুঁতির নতুন পাণ্ডুলিপি বা প্রতি সপ্তাহের না পড়া রোববার সন্ধানী বিচিত্রা কোথায় কোন তলে পড়ে থাকে, তার খোঁজ রাখার সময়ও আমার জোটে না। বই পড়ে মখু স্থ করে যখন প্রশ্নের বড় বড় উত্তর লিখছি খাতায়, দেখে বাবা বললেন রিটেনে কেউ ফেল করে না,করে ভাইবায়। বাইরে থেকে এক্সটারনাল এক্সামিনার আইব, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবি না তো ফেল। আমার গভীর বিশ্বাস, পরীক্ষায় আমার পাশ হবে না। লিখতে দিলে হয়ত কায়ক্লেশে কিছু একটা কিছু দাঁড় করানো যায়, অবশ্য বানিয়ে লেখার ব্যাপারটি এখানে একদমই নেই, যদি প্রশ্ন করা হয় প্যানক্রিয়াসের পজিশন কি? এ সম্ভব নয় লেখা শরতের আকাশের তুলো তুলো মেঘ থেকে একটুকরো মেঘ দুহাতের মুঠোয় নিয়ে দেখলে যেমন দেখায়, প্যানক্রিয়াস তেমন দেখতে। এটি শরীরের কোথায় যে কী করে লুকিয়ে থাকে! একে না খুঁজে পাওয়া যায়, না একে ভুলে থাকা যায়। অগ্নাশয় নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে ক্ষুদ্রান্ত্রের পাশে, প্লীহার তলে, হৃদপিণ্ড থেকেও খুব দূরে নয়, বুঝি হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ ওকেও আলোড়িত করে। এর শরীরের দুরকম কোষ থেকে জল প্রপাতের মত বয়ে যায় দুরকম নির্যাস…. ,হবে না, লিখলে জিরো, লিখতে হবে প্যানক্রিয়াস ইজ এন ইলোংগেটেড অরগান, লোকেটেড এক্রস দ্যা ব্যাক অব দা এবডোমেন, বিহাইন্ড দা স্টমাক, দ্যা রাইট সাইড অব দ্যা অরগান লাইস ইন দ্যা কাভর্ অব ডিওডেনাম, লেফট সাইড এক্সটেন্ডস স্লাইটটি আপওয়ার্ডস বিহাইন্ড দ্যা স্পলীন, ইট ইজ মেইড আপ অফ টু টাইপস অব টিস্যুস, এক্সোক্রাইন এন্ড এন্ডোক্রাইন। রস বলে এখানে কোনও ব্যপার থাকতে নেই, যত বেশি কাঠখোট্টা, যত বেশি টু দ্যা পয়েন্ট, তত বেশি নম্বর, আর নম্বরের পরোয়া না করলে, ভাল কসাই হওয়া যাবে হয়ত, ভাল ডাক্তার নয়। অধ্যাপকদের সঙ্গে তেরিমেরি করলে জীবনেও পাশ হবে না, ওঁদের দেখলে, সে ক্লাসে করিডোরে, রাস্তায় বাজারে যেখানেই হোক, আসসালামু আলায়কুম বলতে হবে। এই আসসালামু আলায়কুম টি আমার একেবারেই আসে না, কদমবুসি যেমন আসে না। আরবি ভাষায় শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া আর কি উপায় নেই! বাংলায় তো জানানো সম্ভব, কী কেমন আছেন, ভাল তো! অথবা নমস্কার। নমস্কার শব্দটি বাঙালি হিন্দুদের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেছে, কোনও শব্দ কি হয় না যে শব্দের কোনও ধর্ম নেই? নাহ! হয় না। যাকেই জিজ্ঞেস করি, বলে, আর কোনও উপায়ই নেই। আমি অসহায় বসে থাকি। আমার ওটুকুই হয়, স্মিত হাসি, এটিই সম্ভাষণ, এটিই শুভেচ্ছা। এ দিয়ে পরীক্ষায় পাশ নাকি হয় না। আরেকটি উপায় বের করি, করিডোরে অধ্যাপকরা হাঁটলে এমন ভাব করে পাশ কাটি, যেন বাইরে তাকিয়ে আছি, অথবা মাটির দিকে, অথবা অন্যমন আমার, অথবা হাতের বইটির দিকে দেখছি, যেন অধ্যাপক নামক বিরাট মানুষটিকে দেখিনি, দেখলে তো কপালে হাত ঠুকে আসসালামু আলায়কুম স্যার বলতামই। বাড়িতে ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর অস্বস্তি লাগে না আসসালামু আলায়কুম বলতে? ইয়াসমিন নিঃসংকোচে না বলল, ওর লাগে না। আমার লাগে কেন! মাকে জিজ্ঞেস করলাম এই আসসালামু আলায়কুমের মানেটা কি? মা বললেন আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কোত্থেকে বর্ষিত হবে? আকাশ থেকে? মা খানিক ভেবে বললেন আল্লাহ বষর্ণ করবেন। তাহলে তো আকাশ থেকেই, আল্লাহ যেহেতু আকাশেই থাকেন। মা আপত্তি করতে পারলেন না আমার আকাশ বিষয়ক ধারণার। খানিক বাদে মা বললেন, আকাশ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে মোক্ষম উত্তরটি মার মনে পড়ল, বললেন আল্লাহ কি শুধু আকাশেই থাকেন! আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। আল্লাহ বিষয়ে কথা বলতে গেলে মা সাধারণত বইয়ের ভাষা ব্যবহার করেন, কঠিন কঠিন শব্দ, আল্লাহ প্রসঙ্গে না হলে মা সর্বত্র শব্দটি না বলে সব জায়গায় বলতেন, আর বিরাজমান না ব্যবহার করে আছেন বলতেন। আল্লাহ ব্যাপারটি মার কাছেও সম্ভবত কঠিন একটি ব্যাপার। আকাশ থেকে জল ছাড়া সখু বা শান্তি কখনও বর্ষিত হতে আমি দেখিনি। সুতরাং আরবি বাক্যটির যে সরাসরি কোনও বাংলা অনুবাদ চালিয়ে দেব, তাতেও মন সায় দেয় না! সালাম ঠোকার অভ্যেস নেই বলে বেয়াদব, উদাসীন, অভদ্র এসব খেতাব পেয়ে গেছি ইতিমধ্যে।
রাত জেগে পড়তে হয়, পরীক্ষা, বাবা বলেন, নাকের ডগায়। কড়া রোদে দাঁড়ালেও নাকের ডগায় এক বিন্দু ঘাম জমে না আমার, এমন নিঝর্ঞ্ঝাট ঝটু ঝামেলাহীন নাকটিকে পরীক্ষার বোঝা এসে প্রায় থেতলে দিচ্ছে। পরীক্ষা কাছে এলে বাবা তাঁর আগের রূপটি ধারণ করেন, উপদেশের ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন বলতে বলতে যে মেডিকেলের পড়া দিন রাইত চব্বিশ ঘন্টা না পড়লে হয় না। রাত জাইগা পড়, চোখে ঘুম আসলে, চোখে সরিষার তেল ঢালো। যত পরীক্ষা এগোয়, তত আমার ঘুম বাড়ে, ভয়ের সঙ্গে ঘুমও বাড়ে। বাবা সাত সকালে উঠে ঘরের পাখা বন্ধ করে বাতি জ্বেলে দেন, গরমে আর আলোয় ঘুম ভেঙে যায়। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বিছানা ছাড়তে হয়। এক রাতে চোখে ঢালার জন্য এক শিশি সর্ষের তেল কিনে এনে আমার টেবিলে রেখে গেলেন বাবা। কী করতে হবে তেল?
যখনই ঘুম পাইব, চোখে ঢালবা, ঘুম বাপ বাপ কইরা পলাইব!
বাবার আড়ালে আমি সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে লাগলাম দিব্যি, আর রাত দশটার আগেই ঘুমের রাজ্যে ঢুকে ঘুমপরীদের সঙ্গে বিস্তর গল্প করে বেড়াচ্ছি। বাবা ফিরে এসে চিৎকার করে বাড়ি জাগান, আরে পরীক্ষার আর তিনদিনও বাকি নাই আর তিনি কি না নাকে তেল দিয়া ঘুমাচ্ছেন! বাবার সম্ভবত ধারণা, চোখে দেওয়ার বদলে বাবার আনা তেল আমি ভুল করে নাকে ঢেলেছি। চোখে আমার ঠিকই সর্ষের তেল ঢেলে রাত জাগতে হয়েছে, ঠিকই এনাটমি আর ফিজিওলজির আগা থেকে মাথা জানতে হয়েছে পড়ে পড়ে। রাত জাগলে বাবা পাশে এসে বসেন আমার। বাবা বসেন, সঙ্গ দেন। যেন আমি ভূতের ভয়ে চোরের ভয়ে নিঃসঙ্গতার ভয়ে আবার মশারির তলে না ঢুকি। মা ফ্লাস্ক ভরে চা দিয়ে যান টেবিলে, আর আমার থেতলে যাওয়া নাকের সামনে তখন ্আমি কারুকে দেখি না, অধ্যাপকদের রক্তচোখ ছাড়া।
লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেল, এবার মৌখিক। বাবা বললেন তোমার হারুন স্যাররে একবার বাসায় দাওয়াত করতে হবে। বাবার উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট, খাতির। খাতিরে যদি মৌখিক পাশ হয়। হারুন আহমেদ সপরিবার আমাদের বাড়ি এলেন, মা সারাদিন রান্না করলেন, শিক্ষিত লোক বাড়িতে এলে মার সামনে যাবার রীতি নেই, রান্নাঘর থেকে তিনি বাসন পত্রে খাবার সাজিয়ে দিলেন, আমি দাদা আর ইয়াসমিন সেগুলো নিয়ে বৈঠক ঘরে খাবার টেবিলে রাখলাম। হারুন আহমেদ খেলেন গল্প করলেন, গল্প পুরোটাই কবিতা নিয়ে। তিনি কবিতা লেখেন, আমি যদি তাঁর কবিতা কোথাও ছেপে দিতে পারি ভাল হয়। তিনি নিয়েও এসেছেন সঙ্গে দিস্তা দিস্তা কবিতা, একবার চোখ বুলিয়ে আমি অনুমান করি কবিতাগুলো মম জীবনে তব আগমন ঘটার পর অবশেষে কোনও আঁধারে করিবে প্রস্থান। হারুন আহমেদ বাবার ছাত্র ছিলেন। বাবার ছাত্ররা অনেকে অধ্যাপক হয়ে গেছেন। বাবা এখনও পুরো অধ্যাপক হননি, সহযোগীতেই পড়ে আছেন, কিভাবে হব, তোমাদের জন্য পয়সা কামাই করতে করতে তো বড় কোনও পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই, তা না হইলে ছাত্র তো খারাপ ছিলাম না। তা ঠিক বাবা ছাত্র ভাল ছিলেন, মেডিকেলে পড়তে এসে এমন হয়েছে যে তাঁর বই কেনার পয়সা নেই, এক ছাত্রের সঙ্গে বাবা তখন এক চুক্তিতে এলেন, রাত দশটার পর, ছেলেটি যখন ঘুমিয়ে যাবে, বই ধার নেবেন তিনি, তাই করতেন, ধার করা বই সারারাত পড়ে, সকালে সেই বই ফেরত দিতেন ছেলেকে, রাত জাগা বাবা সকালে ক্লাস করতে যেতেন।ওভাবে পড়ে, রাত জেগে, ধার করা বইয়ে, বাবা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতেন মেডিকেলে। যেমন পেতেন চণ্ডিপাশা হাইইশকুলে।
বাবার মত মেধা আমার নেই। মৌখিক পরীক্ষায় হারুন আহমেদ আমাকে ইচ্ছে করলেই কঠিন প্রশ্ন করতে পারেন, খাতিরে করেননি। অন্য কলেজ থেকে যে পরীক্ষকরা এসেছিলেন, তাঁরা কঠিন প্রশ্নের দিকে গেলে হারুন আহমেদ কায়দা করে উত্তর ঠিক কোনদিকে যাবে বা যেতে পারে এরকম একটি ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন। টেবিলে রাখা হাড়গুলো অন্য পরীক্ষক ছুঁতে যাওয়ার আগেই হারুন আহমেদ আমার দিকে ঠেলে দিয়েছেন ফিমার নামের সহজ হাড়টি। এটি হাতে নিয়ে কোন অংশের কি নাম, কোন জায়গায় কোন পেশি এসে লেগেছে, কোন পেশিতে কোন নালি রক্ত সরবরাহ করছে, স্নায়ুই বা কোত্থেকে এসে কি করে কোথায় যাচ্ছে, এসব রকমারি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ফিজিওলজি পরীক্ষাতেও খাতির জোটে, এই কলেজেরই সহযোগী অধ্যাপকের কন্যাটিকে জটিলতার মধ্যে নিয়ে নাস্তানাবুদ না করাটিই খাতির। প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায় সকলেই জানে, এখানে ভাগ্যই বড় কথা, কারও ভাগ্যে জটিল প্রশ্ন, কারও ভাগ্যে পড়ে অজটিল। জটিলতা অজটিলতা অনেকটা নির্ভর করে পরীক্ষকদের মন মেজাজের ওপর। পরীক্ষকরা যখন দুপুরের খাওয়ার পর চা খেতে খেতে চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করেন, সহজ প্রশ্ন করেন। যাই হোক, খানিকটা বিদ্যায়, খানিকটা খাতিরে আমি ফার্স্ট প্রফ পাশ করি।
ছোটদা ময়মনসিংহে ছুটিছাটায় চলে আসেন বউ নিয়ে। ঈদ আর পুজোর ছুটিতেই আসেন বেশি। বারো মাসে তেরো পুজো লেগে আছে, সব পুজোয় ছুটি না পেলে ছুটি নিয়ে তবে আসেন। গীতা ঈদের উৎসবে আছে, পুজোর উৎসবেও। এ বাড়িতে ঈদ পুজোর উৎসবের চেয়ে বড় উৎসব ছোটদার অবকাশ-আগমন উৎসব। বাড়িতে সত্যিকার উৎসব শুরু হয় ছোটদা এলে। মা ছুটে যান রান্নাঘরে, ছেলের জন্য পোলাও কোর্মা রাধঁ তে, রেঁধে বেড়ে ছেলে আর ছেলের বউকে সামনে বসিয়ে খাওয়ান। পেট পুরে খাচ্ছে কি না তার ওপর কড়া নজর মার। ছোটদার পাতে বড় মাংস তুলে দেন, গীতার পাতেও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছোটদাকে বলেন, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া কর তো বাবা! কত কষ্ট না জানি হইতাছে চাকরি করতে!
আরে না মা কি যে কন, আরামের চাকরি। ভাল বেতন পাই। এইতো ডমেস্টিক ফ্লাইট শেষ হইল, এখন ইন্টারন্যাশনাল শুরু করছি।
মা ডমেস্টিক ইন্টারন্যাশনালের প্যাঁচ বোঝেন না। মাটির পৃথিবী ছেড়ে অতদূর আকাশের ওপর কারও কি কষ্ট না হয়ে পারে, বিরুই চালের ভাত খেতে ইচ্ছে করল পাবে না, টাটকা শাক সবজি, তাও না। না পারবে ভাল করে শুতে, না হাঁটতে, পায়ের তলায় মাটিই যদি না থাকে, তবে সে হাঁটা আর কেমন হাঁটা!
আরব দেশে গেছিলাম মা। মক্কায় গিয়া কাবা শরিফ দেইখা আইছি।
আরব দেশে যাওয়া এত যে সহজ মা ধারণা করতে পারেন না।
উফ এত গরম। অবশ্য গাড়িতে এসি থাকলে অসুবিধা নাই।
ছোটদা আরব দেশ নিয়ে আর যা যা বলেন, মা স্থবির বসে থেকে শোনেন। মার কল্পনার আরবের সঙ্গে ছোটদার বর্ণিত আরব যে একেবারেই মেলে না, মার ম্রিয়মান মখু টি দেখলেই স্পষ্ট হয়। ছোটদা আরোগ্য বিতানে বাবার সঙ্গে দেখা করে শহরে ঘুরতে বেরোন, হাতে গোনা দু একজন পুরোনো বন্ধুকে খোঁজেন। বিকেলে গীতাকে নিয়ে বেরিয়ে যান, অনুমান করি এখন পিয়নপাড়ায় গীতার বাপের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে। বাড়িতে এখন সবাই জানে যে গীতা পুজোতে পিয়ন পাড়ায় তার বাপের বাড়ি যায়, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। না করলেও কখনও সে ফলাও করে জানায় না যে সে বাপের বাড়ি যাচ্ছে।
ছোটদার দুনিয়া দেখা হতে থাকে, আর ছোটদাকে ঘিরে দুনিয়ার গল্প শোনাও হতে থাকে আমাদের।
আমস্টারডাম শহর থেইকা সমুদ্র অনেক উপরে।
কও কি? শহরটা তাইলে পানির নিচে ডুইবা যায় না?
বাধঁ দেওয়া আছে। ডুবে না।
আর লন্ডন?
লন্ডন ত বিশাল বড়।
ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখছ?
হ, দেখছি।
পিকাডেলি সার্কাসএ গেছিলা?
হ।
প্যারিস গেছ?
হ।
আইফেল টাওয়ার দেখছ?
দেখছি।
ছোটদাকে আইফেল টাওয়ারের মত উঁচু মনে হয়। এত কাছ ঘেঁষে বসে আছি, অথচ ছোটদাকে অনেক দূরের মনে হয়, হাত বাড়ালে যাঁর নাগাল পাওয়া যায় না। সকাল বিকাল দিবি রে, দিবি রে দুইডা টাকা দিবি? বলে হাত পাতার করুণ মুখের ছোটদাকে বেশি আপন মনে হত, এখন ছোটদার ব্যস্ততা বিষম, এখন টাকা পয়সাও অনেক। বাড়ি এসেই বলেন, আজকে নয়ত কালকেই চইলা যাইতে হবে, ফ্লাইট আছে। ছোটদার সঙ্গে অলস দুপুরে এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে, মাথার কাছে পা, পায়ের কাছে মাথা, রাজনীতি, সাহিত্য.. গোল্লায় গেছে।—ছোটদা, ময়মনসিংহে আসলা, তোমার নাটকের দলটার সাথে দেখা করছ?
আরে না, সময় কই?
নজরুল, রুহুল, মিলু শফিক এদের সাথে দেখা করছ?
সময় কই!
বাংলার দর্পণে গেছিলা? মঞ্জু ভাইদের সাথে দেখা করব না।
সময় থাকলে তো যাইতেই পারতাম।
প্রথম প্রথম যখন ময়মনসিংহে আসতেন, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা তাঁর ফুরোতো না, আগের মত আড্ডায় বসে যেতেন। এখন সময় নেই সময় নেই। কোনও কারণে তিনি যদি গোলপুকুর পাড়ের দিকে যান, আড্ডার পুরোনো বন্ধুরা ছোটদাকে দেখেই হৈ চৈ করে ডাকেন। ওরা আছে ওদের মতই, ওরা এখনও আড্ডা দেয়, কেবল ছোটদাই নেই। ছোটদার মুখে এখন বিদেশি সিগারেট, একসময় তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে দিশি স্টার সিগারেট চেয়ে খেতেন।
কি রে কামাল, এই সিগারেটের নাম কি রে?
কার্টিয়ে।
বাহ বাহ কামাল এখন ফিল্টার অলা সিগারেট খায়! দে না খাইয়া দেখি তর বিদেশি সিগারেট।
ছোটদাকে পুরো গোলপুকুর পাড় চোখ গোল করে দেখে। ছোটদা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দেন বন্ধুদের। বাড়ি ফেরার পর অবশ্য মখু ধুয়ে সিগারেটের গন্ধ আগে দূর করে নেন ছোটদা। বাবা মার সামনে তিনি সিগারেট খান না, সিগারেট যে খান তার প্রমাণও রাখেন না। ছোটদার পায়ে বিদেশি জুতো, গায়ে নতুন শার্ট প্যান্ট, তাঁর নিজের। টুডাইল্যা বন্ধুদের কাছ থেকে ছোটদার দূরত্ব বাড়তে থাকে, কেবল তিনি আরও কাছে আসতে থাকেন গীতার। সুন্দরী মেয়ে গীতা, কালো মেয়ে গীতা, ফর্সা হতে থাকা গীতা, যার টিকলো নাক টিকলোই আছে, যার পাতলা ঠোঁট পাতলাই, এখন চায়ে যে চিনি নেয় না, মাংস থেকে আলগোছে চর্বি সরিয়ে রাখে।
ছোট ঈদে ছোটদা আমাদের জন্য নানারকম উপহার আনেন। দুবাই থেকে একটি লিপস্টিক, একটি শ্যাম্পু। দুটো সাবান। কলকাতা থেকে আমার আর ইয়াসমিনের জন্য থ্রিপিস, রং মিলিয়ে তো বটেই ছিট মিলিয়ে জামা পাজামা ওড়না। মার জন্য জায়নামাজ, তসবিহ। বাবা ছুঁয়েও দেখেন না তাঁর জন্য আনা কিছু বাবার জন্য একজোড়া চকচকে জুতো এনে বললেন,মেইড ইন ইতালি। ইতালির জুতো হলে কি হবে,বাবা স্পষ্ট বলে দিলেন, তাঁর জুতোর দরকার নেই। জুতোর দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে দাদা বললেন, একেবারে আমার পায়ের মাপের জুতা। জুতোজোড়া দাদার জুটল। মার জন্য একখানা টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি গীতাই তুলে দেয় হাতে,মা ধরেন আপনের লাইগা ঈদের শাড়ি আনলাম। আমাদের উপহারও আমাদের হাতে দেয় গীতা, যেন সে নিজের কামানো টাকা দিয়ে আমাদের জন্য কিনে এনেছে এসব। আসলে ছোটদাই গীতাকে দিতে বলেন সবার হাতে, গীতা তুমি কি কি আনছ কার লাইগা, দিয়া দেও। ছোটদা বললেই যে গীতা বাক্স খুলবে তা নয়, তার যখন ইচ্ছে হবে,তখন খুলবে। ইচ্ছে না হলে বন্ধ বাক্সই ফেরত নেবে ঢাকায়।
গীতার পরনে চমৎকার চমৎকার শাড়ি, গা ভর্তি চাক্কা সোনার গয়না, সব গয়না, ছোটদা বলেন, সৌদি আরব থেকে কেনা। গীতার জৌলুস বাড়ছে, ছোটদারও। সন্ধে হলেই পুরোনো পুরোনো বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছেন বলে গীতাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোন তিনি। ইয়াসমিন বলে, আসলে পিয়নপাড়ায় যায়, তার আত্মীয়ের লাইগা নানান জিনিসপাতি নিয়া যাইতাছে।
মা বলেন, আমার ছেলে সুখে থাকলেই হইল।
খানিক থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন মায়ের সখু বইলা একটা কথা আছে না, কামাল যদি নিজের হাতে শাড়িডা আমারে দিত, ভাল লাগত। কামালই কিনে, কিন্তু বউএর হাত দিয়া দেওয়ায়।
ছোটদাকে সুখী সুখী লাগে দেখতে। দেখে আমাদেরও সখু হয়। আমি আমার বিছানা ছেড়ে দিই ছোটদা আর গীতাকে। অনেক রাত অবদি সেই বিছানায় আমাদের তাস খেলার হৈ হৈ চলে। স্পেডট্রাম খেলায় আমি আর ইয়াসমিন এক দল, ছোটদা আর গীতা আরেক দল। মা মধ্যরাতে আমাদের খেলার ভেতর ঢুকে বলেন, বাবা কামাল, তুমি তো রাত্রে ভাল কইরা খাও নাই, এখন একটু ভাত মাংস আনি, খাইয়া লও।
পাগল হইছেন। পারলে চা দেন।
মা দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকেন, ওই অত রাতে চা বানাতে।
আমি গলা তুলে বলি, মা আমার জন্যও এক কাপ।
ইয়াসমিন বলে আমার জন্যও।
আমরা আদা চা খেতে খেতে তাসের আনন্দে ডুবে থাকি। মা ছেঁড়া মশারির তলে, গায়ে বসা মশা দুহাতে তাড়াতে তাড়াতে ভাবেন,কাল সকালে উঠেই পরোটা মাংস করতে হবে সকালের নাস্তা, কামালটা পরোটা মাংস খাইতে খুব ভালবাসে।
যেহেতু সবে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, ছোটদার সঙ্গে ঢাকা যাব, ঢাকা যাব বায়না ধরে ঢাকায় আসি বেড়াতে। এখন আর মুহম্মদপুরের বাড়িতে থাকেন না তিনি। সেগুন বাগিচায় রাহাত খানের বাড়ির ওপরতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। গীতার মুখে আগে যেমন চৌধুরি বাড়ির গল্প শোনা যেত, এখন তেমন আর শোনা যায় না। এখন রাহাত খান আর নীনা মামির গল্প। ছেলেমেয়ে অপু তপু কান্তা শুভ্রর গল্প। মুহম্মদপুরের বাড়িতে যখন ছিলেন তখন নাচের লোক গানের লোক সবার সঙ্গে ওঠাবসার ব্যস্ততা ছিল তার, ওদের কথাও ইদানিং আর বলেন না। ফকরুল মামার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ছোটদা,দুজনে অর্ধেক অর্ধেক ভাড়া দিতেন। তিনি ওড়াওড়ি করলে গীতাকে বাড়িতে একা থাকতে হবে না, ফকরুল মামা রইলেন, একজন পুরুষমানুষ রইল আর কী! মাস তিন পর গীতা জানিয়ে দিল, সে একাই থাকতে পারে, একাই একশ সে। ফকরুল মামাকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে হল। গীতা আরও জানাল, সে নিজেও চাকরি করবে। তারও চাকরি হল। তেমন বড় চাকরি নয়, বিমান অফিসের রিসেপশনিস্ট। ওই কাজেই সে প্রতিদিন সেজেগুজে যেতে থাকে। এখনও করছে সেই একই চাকরি। গীতা আমাকে বিমান আপিসে নিয়ে যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা খামোকা বসিয়ে রাখে। তার এই ভাই সেই ভাইএর সঙ্গে তার ননদকে পরিচয় করিয়ে দেয়। খামোকা বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না, রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করি। ময়মনসিংহ থেকেই তাকে চিঠি লিখে দিয়েছি সকাল এগারোটায় যেন সে থাকে রোকেয়া হলের সামনে। আমাকে নিয়ে গীতা এখানে যাবে, ওখানে যাবে এরকম পরিকল্পনা করতে নিলেই আমি ক্ষমা চেয়ে ঝুনু খালার সঙ্গে জরুরি দেখা করতে যাচ্ছি বলে একটি রিক্সা নিই।
কহন আইবি?
এইত কিছুক্ষণ পরেই।
বলি কারণ রুদ্রর সঙ্গে দেখা না হলে তো আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরতেই হবে। দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পণূর্ ভাগ্য। ঢাকায় সে আদৌ আছে কি না, নাকি হুট করে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে কে জানে।
কিছুক্ষণ কতক্ষণ?
আধ ঘন্টা। বড়জোর এক ঘন্টা।
অফিসে আইয়া পড়িস। আমি আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়া নিব।
সময়ের দেড়ঘন্টা দেরি করে গিয়েও দেখি রুদ্র অপেক্ষা করছে। আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালো রুদ্র। হুডতোলা রিক্সায় রুদ্রর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে আমার এত ভাল লাগে! চাই সময় যেন না ফুরোয়। কিন্তু ফুরিয়ে যায় সময়। রুদ্র আমাকে তার দুটো বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে নিয়ে চা বিস্কুট খেতে খেতে গল্প করে এসেছে। এক ঘন্টার জায়গায় চারঘন্টা হয়ে যায়। গীতার অফিস ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে হয় আমাকে। আমাকে গীতার সামনে দাঁড়াতে হয় না, কারণ সে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি রাতে একা শুয়ে থাকি, আমাকে কেউ খেতেও ডাকে না, আমার সঙ্গে কেউ গল্প করতেও আসে না। গীতার বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে দুবার ডেকেছি, দরজা খোলেনি। পরদিনও আমাকে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে বেরোতে হয়। গীতাকে আমার বেরোবার কথা জানাতে গেলে পরদিনও শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করে, কই যাবি? ঝুনু খালা আজও যেতে বলেছেন, বলি। মিথ্যে বলতে আমার ইচ্ছে হয় না, কিন্তু তার অভিভাবকীয় আচরণে আমার গলা শুকিয়ে আসে, বলতে বাধ্য হই। পরদিনও জিজ্ঞেস করে, কালকে তো দেখা করলি, আজকে আবার কী!
আজকে ইউনিভার্সিটির রেজিস্টার বিল্ডিং এ আমার রেজাল্ট পাওয়া যাবে। যাইতে হবে।
আমি ত তরে নিয়া যাইতে পারি ওইখানে।
রুনুখালার পরিচিত মানুষ আছে, সে অফিস থেইকা রেজাল্ট দেখার ব্যবস্থা করতে পারবে।
মানুষ কি আমার নাই?
এত কইরা বইলা দিছে। আমার যাইতেই হইব। আমার জন্য ত অপেক্ষা করতাছে। পরদিনও গীতা জিজ্ঞেস করে—কহন আইবি। পরদিনও আমি বলি, দেরি হবে না, আজকে তাড়াতাড়ি চইলা আসব। গীতা আজ ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে, আমাকে নিয়ে সে বেড়াবে। সুতরাং যেতে চাচ্ছি, ঠিক আছে, কিন্তু দুপুরের আগেই যেন ফিরি। রুদ্র আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে-লাইব্রেরির বারান্দায়,আমি পৌঁছতেই আমাকে রিক্সায় তুলে বাসাবোয় তার ঘরে নিয়ে যায়। শাদামাটা ঘরটিতে একটি বিছানা পাতা। বসে আপন মনে ঘরটির জিনিসপত্র আর বইখাতা দেখি। রুদ্র পাশে বসে আমাকে নিবিড় করে ধরে চুমু খায় ঠোঁটে। ঠোঁট থেকে চুমু বুকের দিকে নামে, তার শরীরের ভার দিয়ে আমাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়,বুক থেকে আরও নিচের দিকে নামতে থাকে তার ঠোঁট, তার শরীরের তলে পড়ে হাঁসফাঁস করি, যেই না আমার পাজামার ফিতেয় তার হাত পড়ে, ছিটকে সরে যাই। তাকে ঠেলে সরিয়ে আমি লাফিয়ে নামি বিছানা থেকে। ভয় আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে ফেলে। বলি, এখন যাবো। ঠোঁট জোড়া ভারি ঠেকছিল, আয়নায় নিজের চেহারা চিনতে পারি না, ফুলে ঢোল হয়ে আছে ঠোঁট। রুদ্র উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে, কোনও কথা বলেনা। অনেকক্ষণ ওভাবেই শুয়ে থাকে, জিজ্ঞেস করি, ঠোঁটের ফোলা আড়াল করে, কি হয়েছে, ওভাবে তার শুয়ে থাকার কারণ কি? বার বার বলি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমার যেতে হবে। ওভাবেই অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে রুদ্র গোসলখানায় চলে যায়। ওখানে মেলা সময় ব্যয় করে ফিরে বলে, শুয়ে ছিলাম কারণ তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল।
ব্যথা? কেন?
রুদ্র কোনও উত্তর দেয়নি। দরদ ফোটে আমার গলায়, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া না করলে এসিডিটি হয়। নিয়মিত খাওয়া উচিত। বেশি ঝাল খাওয়া উচিত না। স্টমাক যদি এম্পটি থাকে, তবে যে এসিড সিত্রে²শান হয়, তা কোনও ফুড না পেয়ে স্টমাককেই খেতে থাকে। এ কারণে এক সময় আলসার হয়ে যায় পেটে। পেপটিক আলসার বলে একে। এন্টাসিড খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
রাখো তোমার ডাক্তারি বিদ্যা, চল।
রুদ্র আমাকে নিয়ে বেরোয়। তার কোনও এক বন্ধুর বাড়ি যাবে।
অসম্ভব, আমাকে এখন সেগুন বাগিচা যেতে হবে।
এক্ষুনি যাওয়ার কি হল?
যেতে হবে। বৌদি কাল রাগ করেছে দেরিতে ফিরেছি বলে। আজ আমাকে নিয়ে সে বাইরে যাবে।
রুষ্ট রুদ্র বিকেলের দিকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় সেগুন বাগিচায়। বাড়ি ফেরার পর গীতার সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখি সে মখু ফিরেয়ে নিচ্ছে। বৈঠকঘরে বসে থাকি একা। আমার সঙ্গে কোনও কথা বলে না গীতা। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ছোটদা ভিসিআরএ একটি হিন্দি ছবি চালিয়ে গীতা গীতা বলে ডেকে যান, গীতা আসে না। ছোটদা শেষ অবদি ছবি দেখা বন্ধ করে গীতার মাথার কাছে বসে গীতার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ও গীতা ও গীতা গীতা গীতা জপ করে যান। আমার সঙ্গে গীতার এমন আচরণ আমি আগে দেখিনি কখনও। ছোটদা গীতাকে খেতে ডাকেন খাবার টেবিলে, গীতা আসে না। গীতা আসেনি বলে ছোটদাও না খেয়ে থাকেন। এ বাড়িতে আমার উপস্থিতিই আমার মনে হতে থাকে, অশোভন। অপমান আমাকে মিশিয়ে ফেলে মেঝের ধুলোয়। না পারি রুদ্রকে ফেরাতে, না পারি প্রিয় স্বজনদের। দুটোতে প্রচণ্ড বিরোধ, আমি কোনদিকে যাই। পরদিন ভোরবেলা ছোটদাকে বলি আমি চলে যাবো ময়মনসিংহে। ছোটদা বলেন আরও কয়টা দিন থাক। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলি, আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। ছোটদা মখু শুকনো করে আমাকে ট্রেনে পৌঁছে দিয়ে আসেন ময়মনসিংহ। একাই যেতে পারব বলেছিলাম, তিনি তবু নিজে এসেছেন। সারাটা পথ জানালায় মখু রেখে রুদ্রকে ভেবেছি। রুদ্র নিশ্চয়ই তার বাসাবোর ঘরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য, অপেক্ষা করতে করতে যখন দেখবে যে আমি আসছি না, তখন নিশ্চয়ই কষ্ট হবে খুব ওর। রুদ্রর কষ্টের কথা ভেবে আমার এত কষ্ট হতে থাকে যে চোখ ভিজতে থাকে, বারে বারেই ভিজতে থাকে। বাড়ি ফিরে রুদ্রকে লিখি আমার চলে আসতে বাধ্য হওয়ার কথা। লিখি চলে আসা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।
রুদ্র লেখে, তোমার কিছুই করার ছিল না—এটাই তোমার দোষ। কেন তোমার কিছু করার থাকে না? কেন তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য থাকে না? কেন তুমি বার বার ভুলে যাও যে তুমি একজনের খুব কাছের মানুষ? কেন ভুলে যাও যে আর একটি জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়ানো রয়েছে। তুমি কেন ভুলে যাও যে তুমি একজনের স্ত্রী? কামাল থাকতে অনুরোধ করেছিল। বাড়ি থেকেও আরও বহুদিন থাকার অনুমতি ছিল, এর পরেও কী করে বিশ্বাস করি যে বাধ্য হয়েই তোমাকে যেতে হয়েছে? কী করে আমাকে বিশ্বাস করতে বলো তোমার কোনও দোষ নেই? তুমি কি এখনো শিশু রয়েছো যে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও মূল্য থাকবে না? আজ এই সামান্য থাকার ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তুমি প্রতিষ্ঠা করতে পারো না! অনিচ্ছার তোয়াককা না করে তোমাকে যদি আবার বিয়ে দিতে চায়, তখনও কি তুমি লিখবে আমার কোনও দোষ নেই! আশ্চর্য! কেন তোমার ইচ্ছা তুমি প্রকাশ করতে পারো না? প্রতিষ্ঠা করতে পারো না? আমার রাগ করা বা না করায় তোমার তেমন কিছু আসে যায় না। সেদিন সারাটা দুপুর ধরে তুমি তা প্রকাশ করেছো। এতোখানি কাছে আসার পরও তুমি এখনো বোকার মত দুজনের সম্পর্কের মধ্যে হার জিতের কথা ভাবো। কবে তোমার ম্যাচিউরিটি আসবে? স্বামীর অধিকার আমি কখনো জোর করে আদায় করতে চাইনি, এখনো চাই না। আর চাই না বোলেই আমি সব সময় তোমাকে সুযোগ দিয়েছি নিজে থেকে তোমার দায়িত্বটুকু বুঝে নেবার জন্যে। কতো ভাবে বুঝিয়েছি। কিন্তু তুমি ভাবো স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মানে পরাজিত হওয়া। আর দশটা দম্পতির দিকে তাকিয়ে দেখ তো? আমি তো কখনো তোমাকে সেরকম ভাবে চাইনি। তোমাকে আমি সম্পণূর্ মুক্ত মানুষ হিসেবে চেয়েছি। সামাজিক শৃঙ্খল আর পুরুষের দাসত্বের উধের্ তোমাকে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু তাই বলে তুমি তোমার দায়িত্ব নেবে না কেন? বিয়ের পর আট মাস কেটে গেল এখনো তোমার সঙ্কোচ কাটে না। এখনো তুমি যুক্তিহীন জেদ করে নষ্ট করো স্বাভাবিক জীবন। বিয়ের দিনটির কথা সারা জীবনেও আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব হবে না।
জীবনের সহজাত কিছু নিয়ম আছে, কিছু শৃঙ্খলা আছে। তাকে কখনোই অস্বীকার করা চলে না। তোমার সমস্যা আমি বুঝি। খুব পষ্ট করে বুঝি। তোমাকে এতখানি বোধহয় কেউই বোঝে না। আর বুঝি বলেই আমি প্রথম থেকেই খুব যুক্তিসংগত ভাবে তোমাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। যেটা আমি ভাল জানি বা বুঝেছি, চেষ্টা করেছি তোমাকেও তা বোঝাতে। না হলে ২৬/১ এর পর আমাদের সম্পর্ক শেষ হতে বাধ্য ছিল। তোমার সেন্টিমেন্টগুলো আমি বুঝি বলেই তার অমর্যাদা করি না। কিন্তু সেই সেন্টিমেন্ট যদি আমাকে অমর্যাদা করে? যাতে না করে সে দায়িত্বটি তোমার। কখনো ভাবিনি এসব নিয়েও লিখতে হবে। সব সময় চেয়েছি তুমি বুঝে নেবে। আর বুঝতে শিখলে যুক্তিহীন ভাবে কিছু আর করবে না।
যদি তুমি শুধু আমার ভালোবাসার মানুষ হতে, যদি বউ না হতে, তবে হয়তো তোমার এই চলে যাওয়াটা আমার এতখানি লাগত না। তখন শুধু বুকে বাজত, কিন্তু এখন আত্মসম্মানেও বাজে।
নিজের সাথে এমন প্রতারণা করো কেন? নিজের ইচ্ছার সাথে কেউ প্রতারণা করে? রুদ্রর চিঠি পড়ে আমার এত মন খারাপ হয়ে যায়। এত মন খারাপ যে লিখি আমাকে যদি তোমার এতই অপছন্দ, আমার যুক্তিহীন কার্যকলাপ যদি তোমার আত্মসম্মানে এতই বাধে, তবে আর দ্বিধা করছ কেন? পছন্দসই মেয়ের অভাব তো নেই! তারা নিশ্চয়ই আমার মত বাজে ধরণের সেন্টিমেন্ট নিয়ে চলে না, যুক্তিহীন জেদ করে নষ্ট করেনা স্বাভাবিক জীবন, জীবনের সহজাত নিয়মকে, শৃঙ্খলাকে কখনই অস্বীকার করে না, তারা নিশ্চয়ই বোকার মত হারজিতের কথা ভাবে না, স্ত্রীর দায়িত্ব তারা সুন্দর নিয়ে নেবে, বিয়ের আট মাস হবার বহু আগেই তাদের সঙ্কোচ কাটবে। তাদের কাউকে পছন্দ করে ফেলো। তোমার সুখের ব্যাপারে আমার আপত্তি থাকবে না। ছোটবেলা থেকে আমি খুব বেশি একটা সুখে মানুষ হইনি—যে কোনও দুঃখকে আমি সহজে গ্রহণ করতে শিখেছি। তোমার সুখের জন্য তোমার নতুন জীবন বেছে নেবার ঘটনা শুনলে আমি অবাক হব না। আমি তোমার সুখের পথে কোনওদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। এই অসহ্য জীবন থেকে তুমি যদি মুক্তি পেতে চাও, নিয়ে নাও। আমার বলার কিছু নেই। আমি তোমাকে কোনওদিন দোষ দেব না। আমার অক্ষমতাটুকু আমার থাকবে। আমার একাকীত্ব আমার থাকবে। জীবন আর ক দিনের! দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যাবে, দুম করে একদিন মরে যাবো। এতদিনে আমি বুঝে গেছি কোনও পুরুষকে তৃপ্তি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। দাম্পত্যজীবনকে সুখী করার ক্ষমতা আমার সত্যিই নেই। আমি একটা আপাদমস্তক অহেতুক মানুষ। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কোনওদিন ভাবিনি এরকম চিঠি তোমাকে লিখব। কিন্তু মূর্খের মত জীবনে আমি সুখের প্রত্যাশা করেছিলাম, যতসব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছিলাম, বাস্তবতা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, জীবনের সীমানা এত বিশাল নয়, বরং শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে কিছু একটা পেতে হলে হারাতে হয় লক্ষগুণ। অথচ নিবোর্ধ আমি হারাতে না চেয়েই পেতে চেয়েছিলাম। তাইতো হেরে গেলাম নিজেই। তাইতো বিয়ের পর বছর না পেরোতেই আমাকে লিখতে হয় এমন কষ্টের চিঠি। আমার অক্ষমতার জন্য আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমার উদারতার কথা কোনওদিন ভুলব না।
আমার চিঠি পেয়ে রুদ্র লেখে, তোমার সমস্ত অক্ষমতা নিয়েই তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। প্রায় তিন বছর ধরে আমি তিল তিল করে আমার জীবনে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি তাকে তুমি নষ্ট করতে পারো না। আমার শৃঙ্খলা আর স্থিরতা এখন তোমাতে। যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট করেছো—এই সব পাগলামি আর চলবে না। আমি তোমার সুখের পথে কোনওদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না, এই কথাটি আরও সহস্রবার নিজেকে শোনাও। যখনি তুমি আমাকে এই কথাটি বলো, ঠিক তখনই তুমি আমার জীবনে সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াও। দ্বিতীয়বার এই কথাটি আমাকে তুমি শোনাবে না। তোমার জীবনটির সম্পণূর্ দায়িত্ব আমার। তার ভাল মন্দ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এই কথাটি ভুলে যাও কেন? আর শোনো শখ করে আর কখনই আমাকে কষ্ট দিও না। আমি খুব ভাল নেই, আর এই ভাল না থাকা তোমার কারণে। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু অমল এক আনন্দ আমাকে ঘিরে থাকে সারাদিন। আমি বুঝি, খুব ভাল করে বুঝি, রুদ্রকে আমি ভালবাসি। রুদ্র তার বাসাবোর ঘরে আমাকে চুমু খেতে খেতে হয়ত আরও অন্য কিছু করতে চেয়েছিল, সেই অন্য কিছুর একটি ভয় আমাকে আমূল কাপাঁয়। রুদ্রকে আমি বোঝাতে পারি না এসবের কিছু।