অবসর
পরীক্ষার পর আমার আনন্দ আর ধরে না। অখণ্ড অবসর জুড়ে এখন আমি যা মন চায় করে বেড়াব, সিনেমা দেখে, গল্পের বই পড়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, পদ্য লিখে। কিন্তু বাবা হুকুম জারি করলেন কোনও সিনেমা পত্রিকা পড়া চলবে না, সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ছবিঅলা বাজে সব পত্রিকা এ বাড়িতে নিষিদ্ধ। প্ ড়তে যদি হয়ই তবে ভাল পত্রিকা পড়তে হবে। যে পত্রিকা পড়লে জ্ঞান বাড়ে। তো কি নাম সেই জ্ঞানদায়িনী ভাল পত্রিকাটির? আমি উৎসুক জানতে, আমার তখন কোনও কিছুতে নাক সিঁটকোনো নেই। পড়তে দিলে গোটা বিশ্ব পড়ে ফেলতে পারি। বাবার পছন্দের পত্রিকাটির নাম বেগম। বেগম আসতে লাগল বাড়িতে নিয়মিত। পত্রিকাটির আগাগোড়া পড়ে ফেলি একদিন, কি করে কি রান্না করতে হয়, কি করে চুল বাঁধতে হয়, কি করে সবজি-বাগান অথবা ফুলের বাগান করতে হয়, কি করে ঘর গোছাতে হয়, শিশুর যত্ন, স্বামীর যত্ন ইত্যাদিই বা কি করে,এসব। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রায় একই জিনিস বেগমে, অর্ধেকের বেশি পড়া হল না। তৃতীয় সপ্তাহে অর্ধেকের চেয়েও কম। বেগম যে একেবারে না ছোঁয়া রয়ে গেল এরপর তা নয়, বরং বেগমের ওপর ঝুঁকে থাকা আগের চেয়ে বেশি বাড়ল, হাতে হাতে যেতে যেতে বেগমের কাগজ ছিঁড়ে যেতে লাগল। বেগমকে জনপ্রিয় করার কারণটি দাদা, হকারের হাতে বেগম দেখলে দাদাই প্রথম ছোঁ মেরে তুলে নেন। এরপরই ঝুঁকে থাকা, নিজে ঝুঁকবেন, বাড়ির সবাইকে ঝোঁকাবেন। পাঁচ ছটি কালো মাথা বেগমের ওপর ঝুঁকে রইল পুরো দুপুর এমনও হয়েছে, এরপর বাকি মাথাগুলো সরে গেলেও দাদার মাথাটি থেকে যায়, অলস বিকেলে, এমনকি রাতেও, সবাই ঘুমিয়ে গেলে। দাদা ঝুঁকে থাকেন এক ঝাঁক মেয়ের ছবিতে। বেগমে যারাই লেখে, গল্প কবিতা অথবা প্রাণী ও উদ্ভিদের যত্ন পদ্ধতি, তাদের ছবি ছাপা হয় এক পাতায়। এক সঙ্গে কুড়ি পঁচিশটি মেয়ের ছবি দেখতে পাওয়া যা তা কথা নয়, বেগম দাদাকে যত আনন্দ দেয়, তত আর কাউকে দেয় না। তিনি প্রতি সপ্তাহে বেগম থেকে মেয়ে পছন্দ করেন, আবার পরের সপ্তাহে সে মেয়ে বাতিল করে অন্য মেয়ে পছন্দ করেন। আসলে পরের সপ্তাহে বেগম এলে আবার নতুন কাউকে আগে যাকে পছন্দ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি পছন্দ হয়ে গিয়ে গোল বাধাঁয়। কোনটিকে যে তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন নিশ্চিত না হয়ে আবার পরের সপ্তাহের বেগমের জন্য অপেক্ষা করেন, আরও ভাল যদি জোটে। দিলশাদ নুর নামের এক সুন্দরী মেয়েকে তিনি একবার পছন্দ করলেন কিন্তু তার কবিতায় সেই যে গেছে সে আর ফিরছে না, ফিরে এলে আমি তার বুকে মাথা রেখে ঘুমোবো.. লাইনটি পড়ে দাদা ঠোঁট উল্টো বললেন নাহ এরে বিয়া করা যাবে না।
কেন যাবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
দেখলি না কোন বেডার লাইগা ও অপেক্ষা করতাছে!
আরে এইটা তো কবিতা।
কবিতা হোক তাতে কি হইছে!
কবিতায় যদি তুমি লেখ যে আকাশে উড়তাছ, তাইলে কি সত্যিই আকাশে উড়তাছ? আকাশে সত্যিকার না উড়ি, মনে মনে তো উড়ি। কবিতায় তো মনের কথা লেখা হয়। দাদা বাতিল করে দিলেন পছন্দ হওয়া দিলশাদকেও। দাদা যখন কাউকে বাতিল করেন, দাদাকে খুব বিমর্ষ দেখতে লাগে। যেন এইমাত্র হাতের মুঠো থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ পাখিটি উড়ে গেল। অবশ্য সুলতানার বেলায় দাদার তেমন মনে হয়নি। দাদার পত্রমিতা সুলতানা দাদাকে একটি শাড়ি পরা মোড়ায় বসা ছবি পাঠিয়েছিল, সেই ছবি নিয়ে দাদা অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটাবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন। নতুন কাপড় চোপড় বানালেন, নতুন সগু ন্ধী কিনলেন, জুতোও কিনলেন একজোড়া। সকালে আড়াই ঘন্টা সময় খর্চা করে গোসল করে নতুন জামা কাপড় পরে, শিশির অর্ধেক সগু ন্ধী গায়ে ঢেলে তিনি ঢাকায় রওনা হয়ে গেলেন। রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দেখি জিভে কামড় দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন দাদা। সকলে ঘিরে ধরি, কি হয়েছে, হয়েছেটা কি? দাদা তখনও জিভ থেকে দাঁত সরাননি, যখন সরিয়েছেন, একটি কথাই হাঁফ ছেড়ে বলেছেন, বড় বাঁচাডা বাঁচলাম।
কেন?
পৃথিবীর মধ্যে যদি কোনও কুৎসিত কিছু থাইকা থাকে, তাইলে ওই বেডি।
কও কি? ছবিতে ত সুন্দরই লাগতাছিল।
উফ। তরা যদি দেখতি বেডিরে। কাইল্যা পচা। পুইট্যা। বুইড়া। হাসলে উচা উচা দাঁতগুলা রাক্ষসের লাহান বাইর হইয়া পড়ে। পাতিলের তলার লাহান কালা মাড়ি। জীবনে কোনওদিন পেত্নী দেখি নাই, আজকে দেইখা আইলাম।
কেন, চুল ত দেখলাম কত লম্বা। পাছা ছাড়াইয়া যায়!
চুল। চুল দিয়া আমি কি করাম। চুল ধইয়া পানি খাইয়াম?
একটু থেমে বললেন, মনে হয় নকল চুল লাগাইয়া ফটো তুলছে। সামনের উঁচা একটা দাঁতও নকল।
দাদা সুলতানার জন্য রঙিন কাগজে মুড়ে কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো সেভাবেই ফেরত এনেছেন। সারাদিনের না খাওয়া দাদা হাপুস হুপুস করে খেয়ে পথের ধুলো কালি ধুয়ে দীর্ঘ ঘুম ঘুমোলেন।
সুলতানার স্বপ্ন দূর করে দিয়ে দাদা পরদিন থেকে বেগমে মন দিলেন। বেগম দিতে আসা হকারকে বলে দিই চিত্রালী পূর্বাণী আর বিচিত্রা দিতে। বলি বটে, কিন্তু এখন আর ইশকুল নেই যে রিক্সাভাড়া থেকে দুআনা চারআনা জমিয়ে রাখব, কাগজও বাড়তি নেই যে শিশিবোতলকাগজঅলার কাছে বিক্রি করে বেশ কটি আধুলি উপার্জন করব। পত্রিকা পড়ার জন্য মন আকুলিবিকুলি করে কিন্তু পত্রিকা কেনার টাকা যোগাড় করব কোত্থেকে! লোকে যেমন আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আমি করি দাদার ওপর। দাদার করুণার উদ্রেক সবসময় হয় না, দাদা আল্লাহতায়ালার মত দয়াশীল দানশীল হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না বরং হাড়কিপ্টে বলে তাঁর নাম আছে। রিক্সাভাড়া যেখানে দুটাকা, তিনি আজও সেখানে হাতে আট আনা দিয়ে রিক্সাঅলাকে ধমকে বিদেয় করেন। রিক্সাঅলার সঙ্গে তারস্বরে দাদার চিৎকার বাড়ির লোক তো বটেই, পাড়ার লোকও শোনে। এতে কোনওরকম ভ্রূক্ষেপ দাদা করেন না, তাঁর ভাষ্য এই তো কয়দিন আগেই আট আনা দিয়া আইছি।
কয়দিন আগে মানে? মা বলেন, সে ত পাঁচ বছর আগে।
পাঁচ বছরকে দাদার কয়দিন আগেই মনে হয়।
হাতে পয়সা থাকলে রিক্সাঅলাকে দুটাকার জায়গায় চারটাকা দেন মা, রিক্সাঅলা যদি অভাবের কথা কোনওদিন বর্ণনা করে পথে, তবে কেবল টাকাই নয়, বাড়ি পৌঁছে খাটের তলে ডাঁই করে রাখা ঝুনা নারকেলের একটি বেছে রিক্সাঅলার হাতে দিয়ে বলেন, পুলাপান নিয়া খাইও। মার এসব আচরণ দেখে দাদা বলেন, মা হইল নানার ডুপ্লিকেট। হাতে যা থাকে সব মাইনষেরে দিয়া দেয়।
দাদা মোটেও মার চরিত্র পাননি। দাদার মন সবসময় বলে পৃথিবীর সবাই তাঁকে ঠকাচ্ছে, তাই তিনি ছলে বলে কৌশলে সবাইকে ঠকাতে চেষ্টা করেন। দোকানে গিয়ে দর কষাকষি করার অভ্যেস দাদার। সকলেই দামাদামি করে, কিন্তু দাদার তুলনা হয় না। দাদার সঙ্গে দোকানে গেলে আমাকে কম লজ্জায় পড়তে হয় না। দোকানি যদি চায় পঞ্চাশ, লোকে তিরিশ টাকায় দিবেন? বা চল্লিশে হইব? জিজ্ঞেস করে। পঞ্চাশ টাকা দাম শুনে দাদা বলেন, তিন টাকায় দিবেন? দোকানি হাঁ হয়ে থাকে। কোথায় পঞ্চাশ আর কোথায় তিন! দাদা সেই তিন থেকে সোয়া তিন সাড়ে তিন করে ওপরে ওঠেন। দোকানি শেষ অবদি কুড়ি বা একুশে রাজি হয়। রাজি হয় বটে, তবে বলে দেয় কাস্টমার অনেক দেখছি ভাই, আপনের মত দেহি নাই। ঠগাইয়া গেলেন। লাভ ত হইলই না, আসল দামডাই উঠল না।
দাদার ওপর ভরসা করি বটে, কিন্তু দাদার কৃপণতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ছোটদার পথ অনুসরণ করা ছাড়া আমার আর উপায় থাকে না। দাদা একবার গোসলখানায় ঢুকলে যেহেতু ছোট বড় মাঝারি সব সেরে আসতে ঘন্টাখানিক সময় নেন, ঘরের আলনায় ঝুলে থাকা তাঁর প্যাণ্টের পকেটে কাঁপা একটি হাত ঢোকে আমার। দাদার পকেটে হাত ঢুকিয়েই হাতেখড়ি হয় এ বিদ্যের, তখন বাবার পকেটেও হাত যায়। কেবল হাত নয়, বুকও কাঁপে, হাতে পাঁচ টাকা দশ টাকার বেশি ওঠে না যদিও, কিন্তু শরমে মাথা নত করতে হয়, স্বস্তি জোটে না। এ বিদ্যে পরে ইয়াসমিনকেও আক্রান্ত করে।
ছোটদার ওপর দাদার রাগ দিন দিন বাড়ে। বাইরে যাওয়ার আগে দাদা তাঁর ঘরে ওষুধের বাক্স ঢুকিয়ে তালা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু ঘরে তালা তো আর দিবানিশি দেওয়া চলে না। দাদা বাড়ি থাকলে ঘরের দরজা খোলাই থাকে। দাদা বাড়িতে আছেন, কিন্তু নিজের ঘরে নেই, এরকম কোনও সময় দেখলেই ছোটদা আমাদের পাঠান ওঘর থেকে ওষধু তুলে নিয়ে আসতে। ওষুধ হাতে করে নিয়ে আসতে গেলে বিপদ হতে পারে বলে দরজার তল দিয়ে পাচার করার উপদেশ দেন। দাদার আর ছোটদার ঘরে যে সবুজ কাঠের দরজা, তার তলে ওষুধের বোতল না হলেও ট্যাবলেট ক্যাপসুল পার হওয়ার মত ফাঁক আছে। ছোটদার একনিষ্ঠ বাহিনী আমি আর ইয়াসমিন প্রচণ্ড দুঃসাহস নিয়ে এই অপকর্ম করে যাই। এই খবরটি দাদার জানা হয়ে যায় একদিন। তিনি কাঠের দোকান থেকে মাপ মত একটি কাঠ এনে দরজার ফাঁক বন্ধ করে দেন। এরপরও যে ওষধু পাচারে কিছু ভাটা পড়ে, তা নয়। ঢিলে জামার আড়ালে করে ক্যাপসুল ট্যাবলেট তো বটেই, ওষুধের বোতল আনার কাজেও আমরা ব্যবহৃত হতে থাকি। বিত্তবানের বিরুদ্ধে বিত্তহীনের লড়াই, সভ্য ভাষায় বলা যায়। এত কিছুর পরও ছোটদার সঙ্গে সাপে নেউলে সম্পর্কে গড়ে তোলা দাদার পক্ষে সম্ভব হয় না, হয় না দাদার হাড় ফোটানো ব্যারামের কারণে। দাদার এই হাড় ফোটানো ব্যারামটি দাদাকে অদ্ভুত আনন্দ দান করে। হাড়ে হাড়ে ঘষর্ণ লেগে যে শব্দ হয়, সেটি তাঁর কর্ণকুহরে সংগীত মছূর্ নার সৃষ্টি করে। দাদা প্রতিদিনই তাঁর শরীরের যত হাড় আছে, তা ফোটান। আঙুলের হাড়ের প্রতিটি সন্ধিস্থল তিনি ঊর্ধ্বে নিম্নে ডানে বামে যত দিকে সম্ভব টেনে শব্দ তোলেন। পায়ের সবগুলো আঙুল নিয়েও একই কাণ্ড করেন। এরপর মেরুদণ্ডের সবগুলো হাড় তার ফোটানো চাই। এক হাত থুতনিতে আরেক হাত মাথায়, এবার হেঁচকা টান মেরে মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে নাও, এরপর বামে, ঘাড়ের হাড়গুলো ফুটে গেল। দাদা নিজে একাই পারেন এ কাজটি করতে, কিন্তু ছোটদার সহযোগিতায় জিনিসটি ভাল হয়। ছোটদাকে হাতের কাছে পেলে দাদা বিছানায় বা মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। শুয়েই কাতরকণ্ঠে দে না কামাল দে, একটু টাইন্যা দে বলে ছোটদাকে ডাকতে থাকেন, ছোটদার পা ধরতে বলা হলে পা-ও ধরবেন এমন। ছোটদা দাদার মেরুদণ্ডের ওপরের চামড়া শক্ত করে ধরে ওপরের দিকে হেঁচকা টানেন, ফোটে। ঘাড়ের নিচ থেকে শুরু করে ফোটাতে ফোটাতে একেবারে নিতম্বের কাছের শেষ হাড়টি অবদি ফোটান। দাদার মেরুদণ্ড ফোটানো শেষ করে ছোটদা একইরকম উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, দাদা একইভাবে ছোটদার পিঠের সবগুলো হাড় ফুটিয়ে দেন। ছোটদাকে বর্জন করার সংকল্পে অটল থাকার অভিপ্রায়ে দাদা একদিন আমাকে বলেছিলেন পিঠের হাড় ফোটাতে। আমার হাতে সেই জাদু নেই, গায়ে যত শক্তি আছে, সবটুকু খাটিয়ে দাদার চামড়া ঊর্ধমুখি টেনেও একটি হাড়কেও নড়াতে পারি না।যাহ ছেড়ি, তুই পারস না, কামালরে ডাক দে। অগত্যা কামাল এসে দাদার হাড় ফোটানোর ব্যারামে ওষধু ঢালেন। কেবল নিজের নয়, অন্যদের হাড়ের ওপরও দাদা ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাড় না ফুটিয়ে অন্যরা কি করে জীবন যাপন করছে তিনি ভেবে পান না। দাদা একবার অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে আমার হাত পায়ের কুড়ি আঙুল ফুটিয়ে দেওয়ার পর আমার ঘাড় খামচে ধরেন, ঘাড়ের হাড় ফোটাবেন। ডান দিকে ঘাড়টিকে যখন হেঁচকা টান দিলেন, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে দাদার হাত থেকে দৌড়ে পালালাম। তিনি আমার পেছনে দৌড়োচ্ছিলেন বলতে বলতে যে ঘাড়ের আরেকদিকটা না ফোটালে আমার ব্যথা বাড়বে। আরেক দিকটায় দাদাকে আর কিছুতেই হাত দিতে দিই নি। হাড় ফোটানো ছাড়াও দাদার আরও একটি রোগ আছে, রোগটির নাম বায়ুরোগ। পায়ুদেশ হইতে বায়ু নিষ্কাষণ। সেটি এমনই ভয়াবহ যে অন্যদের হাসির খোরাক না হয়ে বরং বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মা বলেন, নোমানের পেটটা আইজও ভাল হইল না,জন্মের পর থেইকাই ওর পেটের গণ্ডগোল। দাদার ঘরে ঢুকতে হলে পা বাড়ানোর আগে আমার নাক বাড়াতে হয়, ভেতরে ঢোকা উচিত হবে কি হবে না তা বুঝতে। বায়ুর বিড়ম্বনা কম নয়। বাড়িতে যদি আড্ডা হচ্ছে কোনও, যেই জমছে আড্ডা তখনই দুর্গন্ধ জনিত কারণে দাদা ছাড়া বাকি সবাইকে নাক মখু চেপে উঠে আসতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে দাদা পড়ছেন, মন দিয়ে শুনছি, তখনই এই একটি কারণে আমার প্রস্থান ঘটে, দাদা বই হাতে একা বসে থাকেন। দাদার চেয়ে বড়দাদা কম যান না। বড়দাদা একবার দাদার এই বায়ু নিষ্কাষণ দেখে বলেছিলেন, চল লাগি। দাদা ঘর ফাটান তো বড়দাদা বাড়ি ফাটান। শব্দে গন্ধে আমরা সাত হাত দূরে ছিটকে পড়েছি। একসময় দাদার পেটে বায়ুর অভাব, জোর খাটিয়েও তাঁর পক্ষে কোনও শব্দ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। বড়দাদা দিব্যি শব্দের রাজা হয়ে বসে আছেন। জেতার জন্য দাদা এমনই মরিয়া হয়ে উঠলেন যে সারা শরীর সঙ্কুচিত করে মৃদু হলেও একটি শব্দ তৈরি করতে চাইছেন, বড়দাদা বললেন, বেশি কুত দিস না, হাইগ্যা দিবি। কিছু একটা অশোভন ঘটেছিল নিশ্চয়ই তা না হলে দাদা রণে ভঙ্গ দিয়ে সেদিন গোসলখানার দিকে দৌড়োবেন কেন!
দাদার বদঅভ্যেসগুলো বাদ দিলে মানুষ হিসেবে দাদা মন্দ নন, আমার তাই মনে হয়। তাঁর কপৃ ণতার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে হঠাৎ কিছু কিছু খসে পড়ে। তাও তো পড়ে। কিন্তু বাবার কৃপণতায় কোনও ফাঁক নেই, কিছু খসে পড়ার উপায় নেই। দাদা এবার লান্ডির মাল নয়, আমার আর ইয়াসমিনের জন্য ঈদের জামা বানাতে শার্টিনের কাপড় কিনে আনেন। ওগুলো দিয়ে মা যখন আমাদের জন্য জামা বানাতে থাকেন, দাদার একটিই অনুরোধ, শীলা যেই ডিজাইনে জামা বানাইয়া দিছিল, ঠিক ওই ডিজাইনে জামা বানাইয়া দেন। মা তাই করেন। শীলার বানানো জামার মত গলায় ঢেউ খেলানো ডিজাইন দিয়ে দেন মা। একেবারে ঠিক শীলার ডিজাইন মত বানিয়ে দিলেও দাদার মনে হয় না ঠিক হয়েছে, তাঁর ধারণা শীলার বানানো আরও ভাল। দাদা জিভে চুক চুক শব্দ করে বলেন, হইছে কিন্তু ঠিক শীলার মত হয় নাই। শার্টিনের কাপড় আরও বেঁচে যাওয়ার পর দাদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আমি চন্দনাকে বাকি কাপড়টি দিয়ে আসি, ও যেন ওটি দিয়ে জামা বানায়। চন্দনার বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় দাদা বলেন, তর কি গারো চাকমা মগ মুড়ং হাজং ছাড়া নরমাল কোনও বান্ধবী নাই?
নরমাল মানে? চন্দনা কি এবনারমাল নাকি?
এবনরমালই ত।
চন্দনার চেয়ে নরমাল আর কেউ নাই।
চন্দনাডা বালাই ছিল। নাকটা খাড়া হইলেই বিয়া কইরা ফালা যাইত। কিন্তু.. কিন্তু কি?
চাকমা ত!
চাকমা হইছে তাই কি হইছে?
আরে দূর ! শেষ পর্যন্ত চাকমা বিয়া করাম নাকি? মাইনষে কি কইব!
মাইনষের কথা ত পরে, তুমি কি কইরা মনে করলা তুমি চাইলেই চন্দনা তোমারে বিয়া করব?
দাদা হো হো করে হেসে উঠলেন, যেন আমি মজার কোনও কৌতুক বলেছি।
আমার মত যোগ্য ছেলে ও কি সারাজীবনে পাইব নাকি?
হা!চন্দনার ঠেকা পড়ছে তোমারে বিয়া করবার!
অনেকক্ষণ চপু করে থেকে দাদা বলেন, তর বান্ধবী দিলরুবাডা সুন্দর ছিল। সুন্দরী মেয়েরা থাকে না। ইষ্কুলে পড়ার সময়ই ওদের বিয়া হইয়া যায়। আইএ বিএ এমএ পড়ে যে মেয়েরা, সব হইল বিয়া না হওয়া অসুন্দরীগুলা।
মন ভাল থাকলে দাদা কেবল ঈদেই নয়, ঈদ ছাড়াও জিনিসপত্র কিনে দেন আমাকে আর ইয়াসমিনকে। একবার দুবোনের জন্য গলায় পরার পাথরের হার কিনে আনলেন। সেই হার পরিয়ে চিত্ররূপা ছবিঘরে নিয়ে দুবোনকে দুপাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললেন ঠোঁট ভিজিয়ে হেসে। দুর্গাবাড়ি রোডে চিত্ররূপা ছবিঘর, দাদা বেলা নেই অবেলা নেই ওই ছবিঘরে গিয়েই চিত্তরঞ্জন দাসকে বলেন, দাদা, বাধাঁনো যায়, এমন ছবি তুইলা দেন তো। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দাদার বন্ধুত্ব ভাল। বহু বছর ধরে নানা ঢংএর ছবি তুলছেন তিনি দাদার। নকল টেলিফোনের রিসিভার কানে লাগিয়ে; পিরিচ থেকে কাঁটা চামচে নকল মিষ্টি তুলে কারো দিকে বাড়িয়ে আছেন মিষ্টি মিষ্টি হাসি মুখে; পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন, পাশে বড় ফুলদানি; কখনও আবার বাঘ সিংহের মূর্তির মাথায় হাত দিয়ে, পেছনের পর্দায় নকল সমুদ্র বা পাহাড়ের ছবি। দাদাকে পাঞ্জাবি পাজামা পরিয়ে, শাল পরিয়ে, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরিয়ে, হাতে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা ধরিয়ে বেতের চেয়ারে বসিয়ে আঁতেল বানিয়েও তুলেছেন ছবি। চিত্তরঞ্জন দাস তাঁর পছন্দ মত আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন, দাদার ডানপাশে আমাকে রেখে আমার কাঁধে দাদার একটি হাত রাখেন, ইয়াসমিনের কাঁধে দাদার আরেকটি হাত, আমার আর ইয়াসমিনের হাতগুলো কোথায় রাখতে হবে, মখু কোনদিকে ফেরাতে হবে, মুখে কতটুকু হাসি আনতে হবে, হাসিটি কেমন হবে দাঁত বের করে নাকি মুচকি—সব বলে দেন। আমাদের মুখের ওপর কড়া আলো জ্বলে ওঠে। তিনি লম্বা পা লাগানো ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখেন কেমন দেখাচ্ছে, কোথাও কোনও ত্রুটি আছে কি না পরীক্ষা করে এগিয়ে এসে দু আঙুলে আমাদের চিবুক ধরে সরিয়ে দেন ডানে বা বামে সামান্য, কপালে বাড়তি চুল পড়ে থাকলে তাও আলতো করে সরিয়ে দেন। কড়া আলোর তলে তখন ঘেমে নেয়ে মুখে একটি নকল হাসি ধরে রাখতে রাখতে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি জাতীয় একটি আকুলতা আমার চোখে। হাসিটি ধরে রাখতেই হবে, চিত্তরঞ্জন দাস পই পই করে বলে দিয়েছেন। ক্যামেরায় চোখ রেখে আবার জামার হাতাটা বা ঝুলটা টেনে দিতে বা গলার কাছে বুকের কাছে ভাঁজ হয়ে থাকলে সেই ভাঁজ সরিয়ে দিতে তিনি ক্যামেরা ছেড়ে আসেন। এই করে একটি ছবি তুলতে আধঘন্টার চেয়েও বেশি খরচা হয়, কিন্তু খরচা করেও ছবি যা ওঠে, তা অন্য সব ছবিঘরের চেয়েও দাদা বলেন বেস্ট। দাদা তাঁর ভাল ছবিগুলো বাধাঁই করে ঘরে সাজিয়ে রাখেন। নিজের ছবিগুলোকে কাছ থেকে দূর থেকে ডান বাম সব কোণ থেকে দেখেন আর বলেন, ক, মেয়েরা পাগল হইব না কেন! চেহারাটা দেখছস! দাদার রূপ আছে সে আমরা সবাই স্বীকার করি, কিন্তু প্যান্ট শার্ট খুলে লুঙ্গি পরলেই তাঁর বেজায় কৎু সিত স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়। দাদার ডান বাহুতে বড় একটি কালো দাগ আছে, তিনি অবশ্য বলেন ছোটবেলায় তাঁর বাহুর ওপর দিয়ে একটি অজগর সাপ হেঁটে গিয়েছিল, চিহ্ন রেখে গেছে। অনেকদিন ওই জন্মদাগটিকে অজগরের দাগ ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। জন্মদাগ বড় ব্যাপার নয়, এরকম সবারই কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু লুঙ্গি পরেই তিনি যখন চুলকোনো শুরু করেন পা ফাঁক করে দুউরুর মধ্যিখানে, তখন দেখে মনে হয় না দাদা আদৌ কোনও সুদর্শন পুরুষ। এরপরও যে কাণ্ড করেন, সেটি দেখলে কেবল বমির উদ্রেক নয়, রীতিমত পেটে যা কিছু আছে সত্যিকার বেরিয়ে আসে। গায়ের ময়লা হাতে ডলে তুলে কালো গুলি বানিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে তিনি শুঁকে দেখেন। দাঁতের ফাঁকে বাঁধা মাংস এনেও গুলি বানিয়ে শোঁকেন।
মা বলেন, নোমান তুই এইগুলা শুংগস কেন?
আমরাও অনুযোগ করি। মাঝে মাঝে আবার আমাদের তিনি গুলি বানানো ময়লাগুলো শুঁকতে বলেন। একবার তো আমি হজমের ওষুধ চাওয়াতে বেশ গম্ভীর মুখে তিনটে গুলি আমাকে দিলেন খেতে। বড়ির মত দেখতে, আমি দিব্যি গুলি খেতে যাচ্ছিল!ম, ইয়াসমিন হা হা করে ছুটে এসে বলল ওইগুলা দাদার ছাতা। আমাকে দৌড়োতে হয়েছে গোসলখানায় বমি করতে।
দাদা চাকরি করেন, মাস গেলে ভাল টাকা বেতন পান। সুটেড বুটেড হয়ে কোম্পানীর সভায় যান। কোম্পানীর সুযোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে আবার পুরষস্কারও অর্জন করেন। দাদা যত বড়ই হন, বদঅভ্যেসগুলো থেকেই যায়। আঙুল ফুলে কলাগাছটির দিকে আমরা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমাদের কিছু ছোটখাট আশা তিনি চাহিবামাত্র না হলেও একদিন না একদিন পুরণ করেন। ছাদ থেকে দেখা প্রায় বিকেলে একটি শাদা শার্ট খয়েরি প্যান্ট পরা ছেলের জন্য যখন মন কেমন কেমন করতে শুরু করল, মনে হল ঠিক ওরকম শাদা শার্ট আর খয়েরি প্যান্ট আমিও পরি না কেন! শখ মেটাতে বাবা তো কখনও এগিয়ে আসেন না, আসেন দাদা। দাদাকে ধরে শাদা টেট্রনের কাপড় কেনা হল, প্যান্ট বানানোর খয়েরি রংএর কাপড়ও। আমার ইচ্ছে শুনে দাদা বললেন, প্যান্ট না, এই কাপড় দিয়া পায়জামা বানা। দাদা যখন আমাকে নিয়ে গাঙ্গিনার পাড়ের মোড়ে দরজির দোকানে গেলেন, আমি বললাম প্যান্ট, দাদা বললেন পায়জামা। মেয়েরা প্যান্ট পরে নাকি? প্যান্ট পরে ছেলেরা।
মেয়েরা পরলে অসুবিধা কি?
অসুবিধা আছে। মাইনষে চাক্কাইব।
চাক্কাইব কেন? এইডা কি দোষের কিছু!
হ, দোষের।
দোষের হলেও দাদা আমার শখের ওপর দয়াপরবশ হয়ে দরজিকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা প্যাণ্টের মত কিছু কি বানাইয়া দেওয়া যায়?
দরজি সহাস্যে বললেন, মেয়েদের প্যান্ট বানাইয়া দেওয়া যাবে।
মেয়েদের প্যান্ট আবার কি রকম?
পকেট থাকবে না, তলপেটের ওপর ফাড়া থাকবে না, ফাড়া থাকবে বাঁ দিকে, বাঁদিকে চেইন,বেল্ট লাগানোর জন্য যে হুক থাকে তা থাকবে না, এ হচ্ছে মেয়েদের প্যান্ট। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল বলে সেটিই আমাকে লুফে নিতে হয়। জামার কাপড়টি দিয়ে যেহেতু শার্ট বানানোর প্রস্তাব করা অসম্ভব, তাই জামাই বানাতে হয়,কিন্তু একটি ছোট্ট আবদার জানাই, জামার হাতা যেন অন্তত শার্টের হাতার মত হয়, ভেতর দিকে নয়, বাইরের দিকে ভাঁজ। দরজি মাপ নিলেন লম্বা দাগকাটা ফিতেয়, জামার মাপ নেওয়ার সময় দরজির হাত বারবার আমার বুক ছুঁয়ে গেল। অস্বস্তি আমাকে সঙ্কুচিত করে রাখে। কিন্তু আমাকে ভেবে নিতে হয়, মাপ নেওয়ার সময় এ না হলে সম্ভবত হয় না। মেয়েদের প্যান্ট আর জামা যেদিন তৈরি হয়ে এল, আমি খুশিতে আটখানা নই, আট দ্বিগুণে ষোলখানা। কিন্তু পরার পরেই হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটল। বাবা আমাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, গা খিঁচিয়ে বললেন,এইডা কি পরছস?
আমি বললাম, প্যান্ট।
প্যান্ট পরছস কেন তুই?
কোনও উত্তর নেই।
বেডাইনের পোশাক পরছস কেন? লজ্জা নাই? এক্ষুণি খোল। আরেকদিন যদি দেখি এইসব পরতে, শরীলের কোনও চামড়া বাদ থাকবে না এমন পিটাবো।
আমাকে প্যান্ট খুলে পায়জামা পরতে হল। এরপর ওই প্যান্ট যে পরিনি তা নয়, পরেছি তবে বাবা মাইল খানিক দূরত্বের মধ্যে নেই জেনেই তবে পরেছি।
দাদার উপহার বই আর জামা কাপড় আর গয়নাগাটির সীমা ছাড়িয়ে এরপর রংএ যায়। ছবি আঁকার রং নয়, মুখে মাখার রং। আমার জন্য একটি মেক আপ বাক্স কিনে আনলেন তিনি, এটির জন্য কোনও অনুরোধ আমার ছিল না, দাদা নিজের ইচ্ছেতেই কিনেছেন। এই বাক্স সম্পর্কে আমার কোনওরকম অভিজ্ঞতাই নেই, কি করে কি মাখতে হয় তা আমি জানি না। তখন ছোটদা হলেন সহায়। চেয়ারে আমাকে মূর্তির মত বসিয়ে আমার মুখে চোখে, চোখের পাতায়, গালে, চিবুকে, ঠোঁটে রং মাখিয়ে দিলেন। ইয়াসমিনকেও দিলেন। রংএর বাক্সটিকে ম্যাজিক বাক্সের মত মনে হতে লাগল আমার, কি চমৎকার মুখের চেহারা পাল্টো দিচ্ছে, নিজেকে মনে হচ্ছে কবরী, ববিতা, শাবানার মত সিনেমার নায়িকা। বাড়িতে চন্দনা বেড়াতে এল, ওকেও বসিয়ে মুখে রং মাখানো হল। চন্দনার গালে বাক্সের গোলাপি পাউডার তুলিতে করে ছোটদা যখন বুলোচ্ছিলেন, মা বললেন, চন্দনা তো শাদাই, ওর কি আর পাউডার লাগে?
দাদা আমাকে আর ইয়াসমিনকেই যে কেবল দেন তা নয়, মাকেও দেন। মা মলিন শাড়ির ছেঁড়া ছিদ্র আড়াল করে পরেন যেন কারও চোখে না পড়ে, চোখে যদি পড়েও কারওর, চোখ এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে কেউ চমকে ওঠে না বরং মা একটি নতুন শাড়ি পরলেই সবার চোখে পড়ে। একটি ভাল শাড়ি পরলেই, বাহ শাড়িডা ত সুন্দর, কই পাইছ, কে দিল! এসব মন্তে ব্যর ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ আমার বা ইয়াসমিনের চোখে পড়ে, যদিও চোখ ব্লাউজহীন সায়াহীন শাড়িতেও মাকে দেখেছে, ছেঁড়া শাড়ি এমন কোনও দুর্ঘটনা নয় মার জন্য, তবু দাদার কাছে শাড়ি চাও যদি বলি, মা বলেন, নোমান আর কত দিব? তোদেরে দিতাছে। যেই মানুষটার দেওয়ার কথা, সে ত আরামে আছে। নিজের দায়িত্বের কথা ভুইলা গেছে। কারও জন্য কিছু কিনার চিন্তা নাই। মা চান দাদা নয়, বাবা যেন মাকে কিছু দেন। মাকে ভাবছেন, মার জন্য করছেন বাবা, সামান্য কিছু হলেও, তিল পরিমাণ হলেও, দেখতে মা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করেন। বাবা কারও অপেক্ষার দিকে ফিরে তাকান না, বিশেষ করে মার। আমাদের বরাদ্দ যে ঈদের জামা, সেটি দিতেও আজকাল বাবা খুব একটা আগ্রহী নন। দাদার কাছ থেকে আমরা পাচ্ছি, তা অবশ্য তিনি জানেন। নিজে তো দেবেন না, দাদা যেন আমাদের আশকারা কম দেন, আবার বেশি পেলে আমরা যে উচ্ছন্নে যাব, সে কথাটি দাদাকে ডেকে ধমকে স্মরণ করিয়ে দেন।
একথা দাদার খুব স্মরণে আছে বলে মনে হয় না। কারণ ধমক খাওয়ার পরদিনই দাদা আমাকে বলেন, কি রে পিকনিকে যাইবি? ঘর থেকে বেরোনোর সুযোগের জন্য ওত পেতে থাকা আমি লাফিয়ে উঠি। এরকম একটি প্রস্তাব পেয়ে আমার দুপুরের ঘুম রাতের ঘুম সব উবে গেল।
এই পিকনিক ময়মনসিংহের মধপুুর জঙ্গলে নয়, রাজধানী ঢাকায়। দাদার সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার সুযোগ এবার। ঢাকার সাভারে পিকনিক করতে যাচ্ছে ফাইসন্স কোম্পানীর লোকেরা। আত্মীয় স্বজন নিয়ে যেতে পারে। দাদার বউ নেই। দুটো বোন আছে, এক ভাই আছে। বাবা মা আছেন। বাবা মাকে নেওয়া চলে না, তাঁরা পিকনিকের জন্য বেমানান। ছোটদা পিকনিকের জন্য বড় হয়ে যায়। ইয়াসমিন ছোট হয়ে যায়। একেবারে খাপে খাপে মিলে যাই আমি। সুতরাং জামা কাপড় বাছাই কর। বাছাই করার কিছু অবশ্য ছিল না আমার, ইশকুলের ইউনিফর্মের বাইরে হাতে গোনা যা আছে তাই ধুয়ে ইস্ত্রি করে তৈরি নিই। ইস্ত্রি বলতে লোহার একটি হাতলঅলা পাত, চুলোর ওপর ওটি রেখে পাতের তলা গরম হলে পুরু করে গামছা ভাঁজ করে হাতল ধরে উঠিয়ে নিয়ে কাপড়ে ঘসে নিই। জামা কাপড় নিই, আর নিই দাদার দেওয়া সেই রঙের বাক্স। ট্রেনে চড়ে ঢাকা যাওয়া, এর চেয়ে আনন্দ আর কী আছে জীবনে! সমস্ত পথ জানালায় মখু রেখে গরম হাওয়া আর ধুলো খেতে খেতে গাছপালা নদীনালা ধানক্ষেত পাটক্ষেত দালানকোঠা বাজার হাট দেখতে দেখতে ঢাকা পৌঁছি। ঢাকায় উঠতে হয় বড়মামার বাড়িতে, বড় মামার বাড়ি আর লালমাটিয়ায় নয়, বাড়ি ধানমণ্ডিতে। নিজে জায়গা কিনে ছোট ছোট ঘর তুলেছেন। ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা। বড় মামার বাড়িতে জায়গার অভাবে দাদা রাত কাটাতে গেলেন আপিসের এক বড়কর্তার বাড়ি। আমাকে শুতে হয়েছে ঝুনু খালা আর বড় মামার ছেলে মেয়ের সঙ্গে এক চৌকিতে আড়াআড়ি চাপাচাপি গাদাগাদি করে। সকালে দাদা এলেন নিতে আমাকে। ইস্ত্রি করা জামা পরে মুখে রং মাখছি যখন শুভ্রা আর শিপ্রা বড় মামার মেয়েদুটি ভূত দেখার মত দেখছিল আমাকে। কাউকে ওরা মুখে রং মাখতে এর আগে দেখেনি। ঝুনু খালা আমাকে আড়াল করছিলেন বার বার ওদের থেকে, বলছিলেন, বড়দের সাজতে হয়, তোমাদের এখনও বয়স হয় নাই সাজার, সর। ঝুনু খালা বড় মামী থেকেও যথাসম্ভব আমাকে আড়াল করলেন। তাঁর ভয়, মুখের এসব রং দেখলে বড় মামী বড় মামাকে জ্বালিয়ে খাবেন এমন একটি রংএর বাক্স কিনে দেওয়ার জন্য। বাসে চড়ে সাভারে গিয়ে বড় এক মাঠের মধ্যে পিকনিকের বড় বড় হাঁড়িকুঁড়ি থাল বাসন সব নামানো হল। রান্না হল, খাওয়া হল, খেলা হল, নিয়াজ মোহাম্মদ নামের এক গায়ককে ভাড়া করে এনে গান গাওয়ানো হল। বাইরের লোকের সঙ্গে দাদা তাঁর চিরাচরিত স্বরচিত শুদ্ধ বাংলা চালিয়ে গেলেন র কে ড় বলে বলে। দাদার এই হয়, ঢাকার কারও সঙ্গে, যাঁরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন, কথা বলতে গিয়ে ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতা বিসর্জন দেওয়ার জন্য এমনই সতর্ক থাকার চেষ্টা করেন যে র-র উচ্চারণ হয়ে যায় ড়, আমাড় ফাদাড় তো ডাক্তাড়, চেম্বাড়ে ড়োগি দেখছিলেন,তখনই তাড়া গেল, তাড়পড় যাড়া যাড়া আসছিল, তাদেড় সাথে আমাড় সড়াসড়ি কথা হয়েছে। পিকনিকে দাদা তাঁর কোম্পানীর বড় বড় লোকদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমাড় ছোট বোন নাসড়িন, এইবার মেটড়িক দিল বলে। আর পরিচয়ের পর কথা না বলে গুড়ি মেরে বসে থাকা আমাকে দেখে দাদা হেসে বলেন, কি ড়ে শড়ম পাওয়াড় কি আছে! এদিকে আয়। আমাড় স্যাড়, স্যাড়ড়ে সালাম দে। সাভার থেকে শহরে ফিরে এসে দাদা নাক কুঁচকে কেবল একটিই মন্তব্য করলেন, রংডা বেশি মাখাইয়া ফেলছস মুখে। আমাকে নাকি সংএর মত লাগছিল।
ঝুনু খালা ইডেন কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন বাংলায়। আমাকে তিনি পিকনিকএর পরদিন নিয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। যতক্ষণ ছিলাম ওখানে, হাঁ হয়ে দেখেছি সব। রুনুখালার একটি ক্লাস ছিল, ওতেও নিয়ে গেলেন। ক্লাসে ছাত্ররা বসেছে ডান সারিতে, ছাত্রীরা বাঁ দিকে। আমি মেয়েদের ইশকুলে পড়া মেয়ে, আমার জন্য এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। ক্লাসে পড়াতে এলেন নীলিমা ইব্রাহিম। আমি নাম শুনেছি তাঁর, লেখাও পড়েছি। নীলিমা ইব্রাহিম লক্ষ করেননি ক্লাসে অল্প বয়সের একটি মেয়ে বসে আছে জড়সড়। কি পড়িয়েছেন তিনি তার ক-ও বুঝতে না পেরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঝুনু খালার কানে কানে আমার ইচ্ছের কথা বড় হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়ব বলি। বলি কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার পরিবেশটি দেখে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে এখানেই এরকম একটি ধারণা জন্মায় আমার। কোনও একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে দাদার সঙ্গে ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহ ফিরে আসি। ফিরে চন্দনার কাছে নিখুঁত বর্ণনা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে মেয়েরা পাশাপাশি হাঁটছে, হাসছে,কথা বলছে,গান গাইছে কেউ তাদের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে না, চোখ টিপছে না, মন্দ কথা বলছে না, ঢিল ছুঁড়ছে না। মাঠের ঘাসে বসে আছে ছেলে মেয়ে গোল হয়ে, আড্ডা দিচ্ছে। কোনওরকম নির্দিষ্ট পোশাক নেই কারও জন্য। যার যা খুশি পরে এসেছে, লাল জামা সবুজ জামা, কেউ আবার শাড়ি। এ যেন স্বপ্নের জগত।স্বপ্ন চন্দনার চোখের পুকুরেও সাঁতার কাটে। নিজের ভাই ছাড়া, বাবা ছাড়া, আর কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া কারও সঙ্গে আমাদের মেশা হয়নি। বাইরের জগতটি আমাদের জন্য বিশাল এক জগত। বাইরের পুরুষ আমাদের কাছে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর। গল্প উপন্যাস পড়া সিনেমা দেখা আমার আর চন্দনার মনে যদি কোনও পুরুষের স্বপ্ন থাকে, সে সুদর্শন সপুুরুষের স্বপ্ন। গল্প উপন্যাস পড়ার খেসারতও দিতে হয় আমাকে কম নয়। বাড়িতে চিত্রালী দিতে আসা হকারকে দাদা যেদিন এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে চিত্রালী পূর্বাণী ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন জানালা দিয়ে, যেদিন বললেন, এখন থেকে এইসব আজাইরা পত্রিকা পড়া বন্ধ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি। বেরোই, কোথায় যাব তা না জেনেই বেরোই। হাতে কোনও টাকা নেই যে রিক্সা নিয়ে নানিবাড়ি চলে যেতে পারব। কপর্দকহীন কত গল্প উপন্যাসের সিনেমার নায়িকারা তো বেরোয়, রাস্তায় খানিকটা হাঁটলেই কোনও নির্জন সমুদ্র তীর বা গভীর অরণ্য বা উদাস নিরিবিলি পাহাড় জুটে যায়। কোনও অঘটন ঘটে না,বরং চমৎকার চমৎকার ঘটনা ঘটে। নায়িকা হয়ত নায়কের দেখা পেল, অথবা বিশাল ধনী এক উদার লোক নায়িকাকে পালিতা-কন্যা বানিয়ে ফেলল। অথবা নায়িকা একা একা নদী বা সমুদ্রের ধারে হাঁটল, ফুলে ছেয়ে থাকা বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ফুলগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলল, উড়ে আসা কোনও পাখির সঙ্গেও বলল, রঙিন প্রজাপতির পেছনে দৌড়োলো, একসময় গাছে হেলান দিয়ে সুখের অথবা দুঃখের একটি গান গাইল। অথবা অঘটন ঘটলেও অঘটন থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে সাহসী কোনও মানুষ সারাজীবনের ভাই বা বন্ধু হয়ে গেল। গল্প উপন্যাস পড়া সিনেমা দেখা মেয়ে বুকের ভেতর ভয় এবং নির্ভয় দুটো জিনিস পুষে হাঁটতে থাকে। নদীর ধারে পুরুষের থাবা আছে জেনেও সে নদীর ধারের দিকেই হাঁটে, পার্কের দিকে। বাগান অলা একটি জায়গার দিকে, লোকে যার নাম দিয়েছে লেডিস পাকর্, সেদিকে। বিকেলে নারী পুরুষ শিশু যেহেতু বেশি কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই শহরে এখানেই আসে, বেঞ্চে বসে বাদাম চানাচুর খায়, খেয়ে হাওয়ায় হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরে যায়। আমি যখন নির্জনতার স্বপ্ন নিয়ে ভরদুপুরে পার্কে পৌঁছে গাছের ছায়ায় একটি একাকি বেঞ্চে বসে সামনে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ব্রহ্মপুত্রের জলের শরীরে ছোট ছোট ঢেউ দেখি, গাছের টপু টাপ পতন দেখি জলে, ইচ্ছে করে বসে থাকি এভাবে, চেয়ে থাকি নিসর্গের এই সৌন্দর্যের দিকে, যতক্ষণ ইচ্ছে। কিন্তু গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকতে পারে, আমি পারি না। একটি দুটি করে লুঙ্গি পরা ছেলে জমতে থাকে আমার চারপাশে। আমার চোখ নদীর দিকে। দুটো নৌকো যাচ্ছে, বালুর নৌকো, নৌকোর দিকে। নৌকোর মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে গেয়ে বৈঠা বাইছে, বৈঠার ছন্দময় গতির দিকে। মাঝির দিকে। চোখ যায় নদীর ওই পারে, কি চমৎকার কাশফুলে ছেয়ে আছে! এসবে মগ্ন হওয়ার কোনও সুযোগ ছেলের দল আমাকে দেয় না। আমার চারপাশের নৈঃশব্দ আর নির্জনতার বুক ছুরিতে চিরে ছিঁড়ে একজন আরেকজনকে বলে, ছেড়ির বুনি উঠছে নাহি?
আরেকজন সামনে এসে খিলখিল হেসে বলে, হ উঠছে।
কেমনে জানস উঠছে? ধইরা দেখছস?
ছেলের দল সজোরে হেসে ওঠে।
বওয়াইব নি?
চায় কত?
কতা ত কয় না।
কতা কয় না কেন? বোবা নাকি?
ভয়ে আমার গা হাতপা কাঁপে। গলা শুকিয়ে যেতে থাকে। এরা যদি এখন বুকে থাপ্পড় দেয়, সেই একবার এক ছেলে এই ব্রহ্মপুত্রের পারেই যেরকম দিয়েছিল। অন্য এক বেঞ্চে সরে গিয়ে বসি। দেখে ছেলের দলে উচ্ছঅ!স বাড়ে। হৈ হৈ করে সেই বেঞ্চের কাছে ভিড় জমায়।
এই তর নাম কি? বাড়ি কই?
এই ছেড়ি তর বাপ আছে?
কারও কোনও প্রশ্নের উত্তর দিই না। একটি লুঙ্গি পরা আমার দিকে ঢিল ছোঁড়ে, ঢিলটি পিঠে এসে লাগে। আরেকটি ছেলে কাছে এসে তার পা দিয়ে আমার পায়ে খোঁচা দেয়। পেছন থেকে আরেকজন দেয় খোঁচা, পিঠে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়া উদ্ভট কোনও জীব, সবাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছে কি রকম আচরণ করি আমি। ঢিলের আর খোঁচার কোনও উত্তর না দিয়ে আমি আবার ব্রহ্মপুত্রের ছলাৎ ছলাৎ জলে। মনের দড়িতে একটি আশাকে বেঁধে রাখি শক্ত করে, কোনও উত্তর না দিলে কিংবা পাল্টা কোনও ঢিল না ছুঁড়লে এরা ধীরে ধীরে চলে যাবে। আশা ক্রমশ দড়ি থেকে মুক্ত হতে থাকে। আশা তার হাত পা খুলে আকাশে উড়াল দিতে থাকে। আমার ব্যাকুল চোখ খুঁজে ফেরে কোনও ভদ্র দেখতে লোককে, যে আমাকে উদ্ধার করতে পারে এই হিংস্র ছেলের দল থেকে। না কেউ ঢুকছে না পাকের্। ভদ্রলোকেরা সব ওই পারে বেড়াতে গেছে। এই পারে কেউ নেই।নেই কেউ। একা আমি আর এরা। দূরের মাঝিও দেখছে না কি করে আমাকে শকুনের মত ঘিরে ধরেছে কটি বর্বর ছেলে। এরা বয়সে আমার ছোট, অনুমান করি। বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি করতে নেই, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আর এরা নির্ভাবনায় বেয়াদবি করে যাচ্ছে! বেয়াদবি এবার আর খোঁচায় নয়,পিঠে একটি ধাক্কা এসে পড়ে। ধাক্কাটি আমাকে চকিতে পেছন ফিরিয়ে চিৎকার করে বলায়,আমি এইখানে বইসা রইছি, তোদের কি হইছে তাতে? ভাগ।
হা হা হি হি শুরু হয় ছেলের পালে।
কতা ফুটছে মুহে। কতা জানে রে কতা জানে ..
একজন লুঙ্গি তুলে নাচতে শুরু করে আমার সামনে। দেখে আরেকজন আসে নাচে যোগ দিতে। বাকিরা হাসছে, হাততালি দিচ্ছে। একজন আসে আমার বুকের দিকে দুটো কিলবিলে থাবা বাড়িয়ে। দুহাতে সেই থাবা সরিয়ে দিই। থাবা আবার এগোয়। ফোপাঁতে থাকি। ফোপাঁনো থেকে গোঙানো। আমার জামা ধরে টানছে দুটি ছেলে। চোখ বড় করছে, দাঁত দেখাচ্ছে, জিভ দেখাচ্ছে। খেলছে আমাকে নিয়ে। মজা করছে। এখন জামাটি আমার টেনে খুলে নিতে পারলেই হয়। জামাই বা শুধু কেন, এখন পাজামাটিও টেনে খুলতে পারলে হয়! এই শুনশান পার্কে কেউ দেখবে না কি হচ্ছে এদিকে। হঠাৎ দুজন লোককে পার্কের ভেতরে ঢুকতে দেখে প্রাণ ফিরে পাই। জটলার দিকে প্যান্ট শার্ট পরা লোকদুটো এগোচ্ছে, ভদ্রলোক দুটো এগোচ্ছে। দেখে পিছু হটে ছেলেগুলো। লুঙ্গি তোলা নাচও থামে। লোকদুটো আমাকে এই নৃশংস দৃশ্য থেকে উদ্ধার করবে আশায় আমি এগোতে থাকি ওদের দিকে। কিন্তু লোকদুটোর একজন আমাকে নয়, ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করে, কি হইছে কি?
ছেড়ি একলা বইয়া রইছে পার্কে।
একলা?
লোকদুটোর আরেকজন গম্ভীর মুখে বলে,একলা কি করতে আইছে?
তা ই তো জিগাইতাছি। কয় না।
কয় না কেন, কয় না কেন?
লোকদুটো সামনে দাঁড়ায় আমার। মুখে নয়, বুকে তাকায়। খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে, এরা আমাকে উদ্ধারের জন্য নয়। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে, পালাও। কোথাও কোন দিকে পালাবো বুঝে উঠতে পারি না। বুঝে উঠতে না পারা আমার দিকে একজন দাঁত মেলে হাত মেলে এগিয়ে আসে, দেখে আরেকজন পাখি উড়িয়ে হাসে। নদীর জল কাঁপিয়ে হাসে। আমার মনে হতে থাকে এরা আমাকে ছিঁড়ে ফেলবে। খেয়ে ফেলবে। খুবলে খাবে। চিবিয়ে খাবে। বিকেলের আলো নিভে আসছে। ডিমের কুসুমের মত সূর্য ব্রহ্মপুত্রের জলে রং ছড়াতে ছড়াতে ডুবে যাচ্ছে। হা হা হাসির লোকটি তার প্যাণ্টের চেইন একবার নিচের দিকে একবার ওপরের দিকে নামায় ওঠায়। ওঠায় নামায়। আমি চোখ বুজে দুহাতে বুক ঢেকে হাঁটু ভেঙে দু হাঁটুতে মাথা চেপে বসে পড়ি। কণ্ডুুলি পাকাতে পাকাতে ছোট্ট একটি পুঁটলির মত হয়ে থাকি। ঢিল পড়তে থাকে সারা শরীরে। আমার শরীর দিয়ে আমি আড়াল করে রাখি আমাকে। টের পাই লোকদুটো ছেলের দলের হাতে আমাকে সঁপে দিয়ে চলে গেছে। এরা এখন যা খুশি করার ছাড়পত্র পেয়ে গেছে। কণ্ডুুলির মধ্য থেকে আমি হঠাৎ চিৎকার করে উঠি ভয়ে। আমার চিৎকারে ছেলের দল গলা ফাটিয়ে হাসে। হঠাৎ কুণ্ডুলি থেকে উঠে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়োতে থাকি সার্কিট হাউজের মাঠের দিকে। পেছন পেছন হাসতে হাসতে ছেলেগুলো। আমি কথা বলতে পারি, চিৎকার করতে পারি, দৌড়োতে পারি সবই এদের কাছে মজার বিষয়। চিড়িয়াখানায় বানরকে নিজে হাতে কলা খেতে দেখলে লোকে হাসে, মজা পায়। বানরের লাফানো দৌড়োনো ঝুলে থাকা সব কিছু দেখতেই মজা। নিজেকে আমার কোনও মানুষ মনে হয় না, মনে হয় কোনও লোক হাসবার জন্তু। ছেলেরা লুঙ্গি তুলে নুনু দেখিয়ে দিব্যি আমার সামনে নেচে গেছে, আমাকে ঢিল ছুঁড়েছে, খুঁচিয়েছে, হাত বাড়িয়েছে, একটওু ভাবেনি আমি এদের মন্দ বলব, কি শায়েস্তা করব কোনও একদিন মওকা মত পেলে। না কোনওকিছুকে এরা মোটেও পরোয়া করছে না। আমি আমার গন্তব্য না জেনে দৌড়োই। পার্কের আশেপাশে কিছু লোককে দেখি হাঁটছে, কিন্তু কারও দিকে আমার যেতে ইচ্ছে করে না, কাউকে বিশ্বাস হয় না আমার। এই উদভ্রান্ত দিকভ্রান্ত আমার দিকে, ঊর্ধশ্বাসের দিকে, এই উদ্ভট দৃশ্যটির দিকে হেঁটে আসতে থাকে শাদা শার্ট খয়েরি প্যান্ট। অথৈ জলে সাঁতার না জানা মেয়ের হাতে খড়কুটো। এই সেই শাদা শার্ট খয়েরি প্যান্ট, যাকে ছাদ থেকে বিকেলে দেখি, যাকে দেখার জন্য প্রায়ই ছাদে উঠি। শাদা শার্ট আমাকে থামিয়ে হুস হুস করে ছেলের পাল বিদেয় করে কাছে এসে মধুর হেসে বলে, এইখানে কখন আসছিলা?
আমি কোনও কথা বলি না। শাদা শার্ট শব্দে শব্দে হাঁটে, পেছন পেছন নিঃশব্দে আমি। হাপাঁতে হাপাঁতে আমি।
দৌড়াইতাছিলা কেন? ছেলেগুলা কিছু করছে তোমারে?
কোনও কথা নেই।
কিছু বলছে তোমারে?
এবারও কথা নেই।
ছেলেরা যা করেছে, যা বলেছে জানাতে আমার লজ্জা হয়। যেন ছেলেদের কীর্তিকাণ্ডের সমস্ত দায় আমার, লজ্জা আমার। ছেলেরা অন্যায় করেছে, যেন আমারই দোষে করেছে।
ঈশান চক্রবতীর্ রোডের কাছে এসে শাদা শার্ট বলে বাসায় যাইবা তো?
আমি দুপাশে মাথা নাড়ি।
তাইলে কই যাইবা?
আবারও দুপাশে মাথাটি নড়ে। কোথাও না অথবা জানি না জাতীয় উত্তর।
শাদা শার্টের পেছন পেছন দিব্যি আমি তাদের বাড়িতে গেলাম, ঠিক তাদের বাড়িতে নয়, তাদের বাড়িঅলার বাড়িতে, ঠিক বাড়িতেও নয়, বাড়ির ছাদে। ছাদে বসে হাওয়া খাচ্ছিল শাদা শার্টের বড় ভাই আর তার বন্ধু। আমরা ছাদে পৌঁছোলে ভাই বন্ধু দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায়।
কি খাইবা?
আমি মাথা নাড়ি, কিছু খাব না।
মাথা নাড়া ছাড়া শাদা শার্টের কোনও প্রশ্নের উত্তরে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা হয় না আমার। শাদা শার্ট তার ছোট ভাইকে ছাদ থেকে গলা ছেড়ে ডেকে নিচে পয়সা ফেলে একটা সেভেন আপ নিয়ে আসার আদেশ দেয়। ছোট ভাই সেভেন আপ আনতে গেল দৌড়ে, এদিকে ছাদের অন্ধকারে শাদা শার্ট আমাকে সিনেমায় রাজ্জাক যেমন কবরীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তেমন করে জড়িয়ে ধরতে চায়। এরকম আলিঙ্গনের আহবান এলে আমারও আবেশে বুকে মিশে যাওয়ার কথা। কিন্তু লক্ষ করি গা কাঠের মত শক্ত হয়ে আছে আমার। কাঠ ছিটকে সরে দাঁড়ায়। সেভেন আপ আসে, একলা বসে থাকে, আমার ছোঁয়া হয় না। অবকাশের ছাদ থেকে গোলপুকুর পাড় থেকে হেঁটে এসে সের পুকুর পাড়ের মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শাদা শার্টকে দেখে মনে হত বোধহয় এর প্রেমে পড়ে গেছি। বুক যে ধুকপুক করেনি তা নয়। কিন্তু রাজ্জাকের মত ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটি এত কৃত্রিম লেগেছে যে অস্থি মজ্জায় বুঝেছি আমি চাইলেই কবরী হতে পারি না, চাইলেই ববিতা হতে পারি না, গল্প উপন্যাস আর সিনেমার মত জীবনের সবকিছু নয়। হলে ওই আলিঙ্গনটি আমার ভাল লাগত। হলে আমি প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ওই ছেলের পালকে আর ওই প্যান্ট শার্ট পরা অসভ্য লোকদুটোর চাপার দাঁত তুলে নিতে পারতাম। পারিনি।
সেই দুপুরে বেরিয়েছি, এখন অন্ধকার হয়ে গেছে, বাড়িতে কি শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে তা কল্পনা করার শক্তি আমার নেই। সেই বাড়িতে, শাদা শার্ট বলে, চল দিয়া আসি তোমারে। কোথাও যাবার নেই বলে ছাদ থেকে নেমে মরিয়ম ইশকুল ডানে, সুধীর দাসের মূর্তির দোকান বাঁয়ে রেখে গোলপুকরু পাড়ের চৌরাস্তা পেরিয়ে আমাকে বাড়ির দিকে নিস্তেজ হাঁটতে হয়। হতাশা আর আতঙ্ক সম্বল করে শাদা শার্টের পেছন পেছন অবকাশের কালো ফটক অবদি আসি। এরপর প্রাণহীন একটি জড়বস্তুর মত ভেতরে ঢুকি। বাড়ির লোকেরা আমার দিকে এমন চোখে তাকায় যেন কেউ চেনে না আমাকে। আমার নাম ধাম পরিচয় কেউ জানে না। আমি কেন এসেছি, কোত্থেকে এসেছি, কারও জানা নেই। এরপর চোখ খানিকটা ধাতস্থ করে কই ছিলি এতক্ষণ, কার কাছে গেছিলি, তর মনে কি আছে ক, অত সাহস কই পাইলি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের সামনে আমি নির্বাক নিস্পন্দ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি। আমি আমার জীবন যৌবন কোথাও বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরেছি অনুমান করেই সম্ভবত দাদা আর মা দাঁড়িয়ে থাকা নির্বাক নিস্পন্দ আমার ওপর কিল ঘুসি লাথি, নিশ্চল আমার ওপর চড় থাপড় নির্বিকারে নির্বিচারে চালিয়ে যান। অবসন্ন শরীর পেতে সব বরণ করি। আপাতত ওই ছেলেছোকড়াদের আক্রমণ, শাদা শার্টের অস্বাভাবিক আলিঙ্গন থেকে বাঁচা গেল বটে, কিন্তু দাদা আর মার অনাচার থেকে বাঁচা সম্ভব হয় না। আমার বিবমিষা বাড়তে থাকে সব কিছুর কারণে।
ছাদে দাঁড়ালে আমার চেয়ে বয়সে ছোট এক ছেলে তাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে লুঙ্গি উঁচু করে তার নুনু দেখায়। আমাকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। ছাদের রেলিং থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। অন্য কিছু দেখতে চায় এই চোখ, সুন্দর কিছু শোভন কিছু বিকেলের এই ছাদে ওঠা, স্যাতসেঁতে ঘর থেকে বেরিয়ে আলো হাওয়া খাওয়া, আপন মনে জগত দেখা, এ বড় আনন্দের সময় আমার। খোলা জগত আমার কাছে তো ওটুকুই। স্বাধীনতা আমার ওখানেই। দুপুরের গা পোড়া গরমকে বিকেলের শীতল শান্ত হাওয়া যখন বিদেয় দিতে থাকে, তখনই সময় খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে হাওয়ার সেই স্নিগ্ধতা গা ভরে নেওয়ার। কেবল গা ভরে নয়, আমি প্রাণ ভরেও নিই। এই ছাদেও আমি নিরাপদ নই ভেবে কুঁকড়ে যেতে থাকি, যেন আমিই দোষী, যেন আমারই দোষে ভাল মানুষ ছেলেটি লুঙ্গি তুলেছে। তন্ন তন্ন করে নিজের দোষ খুঁজতে থাকি।নিজের এই অস্তিত্ব আমাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমি নিজের জন্যই নিজের কাছে লজ্জিত হই। লজ্জিত হই যখন কালো ফটকের উল্টোদিকে স্বপনদের বাড়ির ডান পাশের মুসলমানের বাড়ির বারান্দায় লুঙ্গি গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে থাকা কৎু সিত দেখতে ছেলে জগলু পাড়ার আবদুল বারীর বউকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় আমাদের বাড়িতে। মৃত্যুঞ্জয় ইশকুলের মাস্টার কৃকলাশ আবদুল বারীর বেলুন-বেলুন মেচেতা-গালি বউ আমাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে আসেন, মার সঙ্গে শাদামাটা ঘরসংসার রান্নাবান্নার গাল গল্প করে চলে যান। তাঁর মুখে বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে আমার গা কাঁপে ভয়ে, গা জ্বলে রাগে। মা অবশ্য গা জ্বলা কথা কিছু বলেন না তাঁকে। অপ্রসন্ন মুখে মখু মলিন করে বলেন, মেয়ের বাবা মেয়েরে আরও লেখাপড়া করাইব। এহনই বিয়ার কথা শুনলে খুব রাগ হইব। আবদুল বারীর বউ মার ওই কথা শোনার পরও আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ব্লাউজের ভেতর থেকে একটি দলামোচা চিঠি আমার হাতটি টেনে হাতের ভেতর গুঁজে দিয়ে আথিবিথি বেরিয়ে যান। চিঠিটি গোসলখানায় নিয়ে খুলে পড়ি। তোমাকে ভালবাসি জাতীয় কথায় দুপাতা ঠাসা। চিঠিটি, আমাকে লেখা কোনও চিঠি এই প্রথম, কুটি কুটি করে ছিঁড়ে পায়খানার গু মুতের মধ্যে ফেলে দিই। ফেলে দিয়ে, কাউকে না জানিয়ে চিঠির কথা, বসে থাকি একা, সবার আড়ালে।
বাবা আমার বেড়ে উঠতে থাকা শরীর দেখে মার কাছ থেকে একটি ওড়না সংগ্রহ করে আমার দুকাঁধে ফেলে বললেন, এইভাবে পইরা থাকবা, তাইলে সুন্দর লাগবে। বাবার এই কথায় এত তীব্র অপমান আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে যে বেড়ে ওঠা বুকের লজ্জায় সারারাত আমি বালিশে মখু গুঁজে কাঁদি। বুক ঢেকে রাখার এই বাড়তি কাপড়টি পরতে আমার লজ্জা হয়, কারণ এটিই আমার মনে হয় প্রমাণ করে যে এটির আড়ালে কিছু আছে, কিছু নরম কিছু শরম কিছু না বলতে পারা কিছু তাই ঢাকতে হয়, কারণ যা আছে তা বড় অশ্লীল, বড় লাগামছাড়া বেড়ে ওঠা, ওসব যেন দৃশ্যমান না হয়। ওড়না যেন না পরতে হয়, শরীরের কোনও অশ্লীলতা যেন প্রকাশিত না হয় আমি কুঁজো হয়ে হাঁটি। কুঁজো হওয়াই অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। মা পিঠে কিল দিয়ে বলেন সোজা হইয়া হাঁট, ওড়না পইরা ল। ওড়না পরলে সোজা হইয়া হাঁটবি, এমন যে গুঁজা হইয়া হাঁটস, পিঠের হাড্ডি পরে আর সোজা হইব না। তারপরও ইচ্ছে করে না সোজা হতে, বুক ঢাকতে ওড়নায়। জিনিসটিকে বেঢপ একটি জিনিস বলে মনে হতে থাকে। ওড়না পরি বা না পরি, মানুষ জানে যে আমি বড় হয়ে গেছি। মেট্রিক দেওয়া মেয়েদের, বিয়ে কি, বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে যায়, মা বলেন। শুনে একটি ধারালো কাঁটা বিঁধে থাকে বুকে। বুক ধড়ফড় করে। আমার বড় হতে ইচ্ছে করে না। বিয়ে ব্যাপারটি আমার কাছে কেবল ভয়ের আর যন্ত্রণার নয়, বড় অশ্লীলও মনে হয়। সে অন্য কারও বেলায় হলে হোক, আমার বেলায় যেন কখনও না হয়। ছুঁড়ে ফেলে দিই বাবার পরিয়ে দেওয়া ওড়না। আমি বড় হয়ে গেছি, এ ব্যাপারটি কাউকে বোঝাতে আমার ভয় হয়।
পরীক্ষার পর ইশকুলের বই থেকে নিস্তার পাবো,এরকম একটি স্বপ্ন ছিল। ঢাকার পিকনিক থেকে ফিরে এলে বাবা আমার স্বপ্ন গুড়িসুদ্ধ উপড়ে নিয়ে বলেছেন পুরোনো বইগুলোই আবার আগাগোড়া পড়তে, প্রতিটি কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হবে, খুব কঠিন সেই পরীক্ষা, না পাশ করলে আমার কপাল থেকে পড়াশোনার পাট জন্মের মত চুকে যাবে, সারাজীবন অশিক্ষিত খেতাব নিয়ে আমাকে দুঃসহ জীবন পার করতে হবে। অতঃপর সেই একই বই সামনে নিয়ে আমাকে বসে থাকতে হয়। পড়া থেকে উঠে কি করতে হবে তাও বাবা জানেন, অবসর বিনোদনের জন্য তো তিনি দিয়েই রেখেছেন বেগম।
মেট্রিকের ফল যেদিন বেরিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ দাস দুপুরের দিকে অবকাশে ছুটে এসে উল্লাসে জয়ধ্বনি করলেন। আমি প্রথম বিভাগে পাশ করেছি। খবরটি শুনে যখন আমি বাড়িময় খুশিতে লাফাচ্ছি, বাবা এলেন, হাতে পরীক্ষার ফলের কাগজ। তিনি আমাকে কাছে ডেকে মা মা বলে জড়িয়ে ধরবেন, খাঁচা ভরে রসগোল্লা, মালাইকারি,কালোজাম, চমচম এনে বাড়ির সবাইকে খাওয়াবেন,এ ব্যাপারে আমি অনেকটাই নিশ্চিত। যখন আমাকে ডাকলেন, খুশিতে উপচে ওঠা মখু টি নিয়ে কাছে গেলাম। বাবার আলিঙ্গনের অপেক্ষায় যখন আমার শরীর প্রস্তুত, বাবার হষোগচ্ছঅ!স উপলব্ধি করতে যখন আমার মন প্রস্তুত, গালে শক্ত এক চড় কষিয়ে বললেন, থার্ড ডিভিশন পা্ইছস, লজ্জা করে না?
থার্ড ডিভিশন? স্তম্ভিত মখু বাবাকে শুধরে দেয়, আমি তো ফার্স্ট ডিভিশন পাইছি।
বাবা এবার আমার মুখে মাথায় ক্রমাগত চড়ের বন্যা বইয়ে দিতে দিতে বলেন, স্টার পাইছস? পাস নাই। কয়ডা লেটার পাইছস? লেটার না পাইয়া ফার্ষ্ট ডিভিশন পাওয়া মানে হইল টাইন্যা টুইন্যা পাশ করা,টাইন্যা টুইন্যা পাশ করা মানে থার্ড ডিভিশন পাওয়া। আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন থেকে মোট তিনজন প্রথম বিভাগে পাশ করেছে, কেউই তারকাখচিত নয়। কারও লেটার জোটেনি। তা না হোক, বিদ্যাময়ী ইশকুল থেইকা তো পাইছে, জিলা ইশকুল থেইকা তো পাইছে! বাবা আমাকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে পড়ার টেবিলের কাছে ধাক্কা দিয়ে ফেললেন। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, যারা স্টার পাইছে, তারা ভাত খাইছে,তুই খাস নাই? মাস্টার রাইখা তরে আমি পড়াইছি, থার্ড ডিভিশন পাওয়ার লাইগা নাকি, হারামজাদি। সামনে একটি বই খুলে আমি স্থির বসে থাকি, বইয়ের অক্ষরে টপটপ পড়তে থাকে নোনা জল।
অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি বেড়ালের মত শব্দহীন হেঁটে হেঁটে ইঁদুরের বিষ খুঁজতে থাকি। আমার এই বেড়ে ওঠা শরীর, আমার এই উদ্ভট অস্তিত্ব, আমার এই অপদার্থ মস্তিষ্ক সব কিছুই আমাকে এমন একরত্তি করে তোলে যে ক্ষুদ্র হতে হতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ইচ্ছে করে অদৃশ্য হয়ে যেতে। ইঁদুরের কোনও বিষ জোটে না, যা জোটে তা ঘরের কোণে ধুলো পড়া একটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ।