উতল হাওয়া
কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহের নতুন ইশকুলে ভর্তি হয়ে যেদিন প্রথম এল ও ক্লাস করতে, সেদিনই ওর সঙ্গে আমার কথা হল, চোখে চোখে। ওর প্রায় বুজে থাকা চোখ দুটো একই সঙ্গে এত কথা বলল সেই প্রথম দিনই, প্রথম দিন ও অবশ্য ওর মামাতো নাকি কাকাতো নাকি ফুপাতো বোন সীমা দেওয়ানের গা ঘেঁসে ছিল, দ্বিতীয় দিনও তাই, আমার বেঞ্চে বসল তৃতীয় দিন আর ওদিনের পর আমার বেঞ্চ ছাড়া কারও বেঞ্চে ও বসেনি। চন্দনার গায়ের রং না-লেখা কাগজের মত শাদা, নাক যেন ইটে থেতলে দেওয়া হয়েছে এমন, আধেক চোখ আড়াল করা চোখের পাতায়, বাকি আধেকের দ্যুতি আমারই অলক্ষ্যে আমার হৃদয় আলোকিত করে। ওর বিনুনিবিহীন দীঘল ঘন চুল বন্ধন মুক্ত হলেই পিঠে বর্ষার জলের মত উপচে পড়ে আর আশরীর ভিজে গোপনে গোপনে স্নিগ্ধ হতে থাকি আমি। দিলরুবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার পাশের জায়গাটি কারও জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, আমার বুঝে ওঠার আগেই চন্দনা আমার পাশে নির্দিষ্ট হয়ে গেল। প্রতিদিন চন্দনার শব্দ গন্ধ বণর্ আর প্রতিদিনই দিলরুবার না থাকা দুটোই আমার পাশে বসে থাকে আমারই ছায়ার মত। কেবল চন্দনাই তখন ক্লাসে নতুন ভর্তি হওয়া মেয়ে ছিল না, বিদ্যাময়ী থেকে দলে দলে মেয়ে আসছে, আমার সেই যুদ্ধংদেহি বন্ধুরাই। কিন্তু কেউ আমার কপালের চন্দন-তিলকে একতিল কালি ছোঁয়াতে পারেনি। একটি তরঙ্গও তুলতে পারেনি সেই চন্দন-সুবাসে, যেখানে অহর্নিশি আমার আকণ্ঠ অবগাহন।
শহরের এক কোণে নির্জন এলাকায় আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন দাঁড়িয়ে আছে বটে, গুটিকয় হাতে গোনা মেয়ে আছে বটে এখানে, কিন্তু মেট্রিকে বিদ্যাময়ীর মেয়েদের চেয়ে ভাল ফল করেছে এই ইশকুলের মেয়েরা, কেবল তাই নয় গড়ে প্রথম বিভাগ বেশি জুটেছে অন্য যে কোনও মেয়েদের ইশকুলের চেয়ে এই ইশকুলে, তাই ঘাড় ধরে আমার বাবা যেমন ঠেলে দিয়েছিলেন যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে সবে পা দিয়েছি, অন্যদের বাবাও সপ্তম অষ্টমে যদি সম্ভব না হয়েছে, নবম দশমে পড়া কন্যাদের একই রকম করে এই ইশকুলে ঠেলেছেন। নির্জনতা এই ইশকুলের অনেকটাই তখন কেটেছে। সবচেয়ে বড় শ্রেণীর ছাত্রী বলে তখন বিষম এক আনন্দ হয়। বই খাতার মলাটের ওপর মোটা কলমে নিজের নাম যত না বড় করে লিখি, তার চেয়ে বড় করে লিখি দশম শ্রেণী।
চন্দনার উতল হাওয়ায় উড়ছি যখন, সামনে বিকট দজ্জালের মত রাম দা হাতে মেট্রিক পরীক্ষা, চৌকাঠ পেরিয়ে প্রায় অন্দরমহলে ঢুকছে এমন, বাড়িতে বাবা মুহুর্মুহু উপদেশ বষর্ণ করছেন যেন মুখস্থ ঠোঁটস্থ এবং অনঃ্ত স্থ করে ফেলি সবকটি বইএর সবকটি পৃষ্ঠার সবকটি অক্ষর। কালো কালো অক্ষর ছাড়া আমার জগত জুড়ে আর কিছু যেন না থাকে। বাবার উপদেশ পালন করার ইচ্ছে বাবা বাড়ি থেকে বেরোলে বা তাঁর নাক ডাকার শব্দ শুনলেই উবে যায় আমার। ইশকুলে যাবার পথে এক ক্লাস ওপরে পড়া এডওয়ার্ড ইশকুলের ছেলেগুলো ইস্ত্রি করা জামা গায়ে, চোখের কোণে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি নিয়ে ত্রিভঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে সারাদিন আমার মনে লাল নীল সবুজ হলুদ যত রকম রং আছে জগতে, লেগে থাকে। ইশকুলে পৌঁছে পড়ালেখার চেয়ে বেশি সেঁটে থাকি নাটকঘর লেন থেকে হেঁটে আসা মাহবুবার কাছে খবর নিতে ছেলেগুলোর নাম, কে কোন পাড়ায় থাকে, কার মনে কী খেলে এসব। মাহবুবা তার ভাইদের কাছ থেকে যে তথ্য পায় তাই পাচার করে, যে তথ্য পায়নি তাও অনুমান করে বলে। চন্দনা মুঠো খুলতেই আষাঢ়ে বৃষ্টির মত ঝরে প্রেমের চিঠি, দিনে ও চার পাঁচটে করে চিঠি পেতে শুরু করেছে। পাবে না কেন! পণ্ডিতপাড়ার আঠারো থেকে আঠাশ বছর বয়সের ছেলেরা অনিদ্রা রোগে ভগু ছে ওকে দেখে অবদি। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে মমতা বানুকে নিয়ে প্রতিদিন গুঞ্জন, বাঘমারা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ইমতিয়াজ তরফদার নাকি মমতার প্রেমের জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে বসেছিল। কারও সাতে নেই পাঁচে নেই নাক উঁচু বুক উঁচু ভাল ছাত্রী আসমা আহমেদেরও জিলা ইশকুলের কোনও এক ভাল ছাত্রর সঙ্গে নাকি কোথায় দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। সারার দিকে ইশকুল ঘেঁসা বাড়ির ছেলে জাহাঙ্গীর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সারার নাকি ছেলেটিকে মন্দ লাগে না। পপির সঙ্গে নাদিরা ক্লাসের ফাঁকে ফিসফিস কথা বলে, আশরাফুনন্নেসা নামের ঠোঁটকাটা মেয়ে তাই দেখে অনুমান করে পপির ভাই বাকির প্রেমে পড়েছে নাদিরা। শিক্ষক শিক্ষিকা কে কার ঘরে উঁকি দিলেন, কার কথায় কে হেসে গড়িয়ে পড়লেন, কার চোখের তারায় কার জন্য কী ছিল—টুকরো টুকরো গল্প বাতাসের পাখা মেলে আমাদের কানেও পৌঁছোয়। চন্দনা এসব উড়ো খবর নিয়ে মাতে, আমিও। ও আবার নিজের দু-একটি খুচরো প্রেম নিয়েও থাকে মেতে। ক্লাসে বসেই পাতার পর পাতা প্রেমের পদ্য লিখে ফেলে হয়ত কারও উদাস দুচোখের কথা মনে করে, সেদিন সকালেই দেখা কারও চোখ। রাস্তায় দেখা লৎু ফর নামের চশমা চোখের ছেলেটির জন্য আমারও কেমন কেমন যেন লাগে। ইশকুলে যেতে আসতে ছুঁড়ে দেয়া ওর দুটো তিনটে চিরকুট পেয়ে রাতের ঘুম উবে যায়। চোখ যে মনের কথা বলে ইতি লৎু ফর লেখা একটি চিরকুট আমার পদার্থবিজ্ঞান বইএর ভেতর থেকে পড়বি পড় মালির ঘাড়ে না হয়ে বাবার পায়ের কাছে উড়ে গিয়ে যেদিন পড়ল, বাবা পরদিন থেকে আমার ইশকুল যাতায়াতে পাহারা বসালেন, বড়দাদার দায়িত্ব পড়ল আমাকে সকাল বেলায় ইশকুলে দিয়ে যাওয়ার আর ছুটির পর বাড়ি ফেরত নিয়ে যাওয়ার। ছুটি হলে ইশকুলের গেটের কাছ থেকে মেয়েরা রিক্সা নিয়ে বাড়ি চলে যায়, কেউ যায় হেঁটে, দএু কজনকে নেবার জন্য পিঠকুঁজো ফক্সওয়াগন গাড়ি আসে, সব চলে গেলে এমনকি মমতা বানুও(ওকে দিতে এবং নিতে চিরকালই ওর রণরঙ্গিণী মা আসেন), আমার দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যতক্ষণ না লম্বা শাদা দাড়ি মুখে সবুজ লুঙ্গি পরে কালো রাবারের জুতো পায়ে বুড়ো দাদা উদয় হচ্ছেন। ইশকুল ছুটির পর গেটের কাছে ওভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকাও অশান্তির, আর যদি বড়দাদা আগেভাগেই উপস্থিত হন তবে সবার চোখের সামনে তাঁর সঙ্গে রিক্সায় উঠতে গিয়েও আমার অস্বস্তির শেষ থাকে না কারণ তখন আমি নিশ্চিত বড়দাদার মাথার টুপি মুখের দাড়ি রাবারের জুতো পরনের লুঙ্গির দিকে তাকিয়ে সকলেই ঠোঁট টিপে হাসছে আর মনে মনে অনুমান করছে কত বড় গেঁয়ো ভুতের বংশের মেয়ে আমি। আমার সাধ্য বা সাহস কোনওটাই নেই মিথ্যেচার করার যে দাড়িঅলা লোকটি আদপেই আমার কেউ হয় না। তিনি যে বড়ই নিকটাত্মীয়, সে কথাও মখু ফুটে কাউকে বলা হয় না। অনেকদিন চিরকূটের গন্ধ না পেয়ে পাহারা তুলে দেন বাবা। পাহারা তুলতে হয় বড়দাদার শস্যভরা ক্ষেত গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধানের টানে, আপন কুঁড়েঘরে, মাদারিনগর গ্রামে ফেরার সময় হয় বলেও। গ্রাম ছেড়ে শহরে দীর্ঘদিন কাটালে বড়দাদার মাথায় গোলমাল শুরু হয়। প্রতিদিনই তাঁর জায়নামাজ হাতে নিয়ে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতেই হয় পশ্চিম কোন দিকে। আমাকে যতবারই তিনি জিজ্ঞেস করেছেন আমি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব সব দিককেই পশ্চিম বলে দেখিয়ে দিয়েছি কেবল পশ্চিম দিক ছাড়া আর তিনি দিব্যি জায়নামাজ পেতে সেদিকে ফিরেই দু হাতের দু বুড়ো আঙুলে দু কানের দুলতি ছুঁয়ে আল্লাহু আকবর বলে নামাজ শুরু করেছেন।
বড়দাদা সঙ্গে থাকলে তাঁর আপাদমস্তকের লজ্জায় আমাকে ঘাড় নুয়ে বসে থাকতে হত, সেই ঘাড় সোজা করার সুযোগ হল, রিক্সায় বসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দিকেও লুকিয়ে তাকানোর। লুৎফরের সঙ্গে নীল প্যান্ট শাদা শার্ট পরা নতুন একটি নাদুসনুদুস ছেলেকে দেখে ছেলেটির জন্যও হঠাৎ একদিন মন কেমন করতে লাগল। এক পলকের দেখাতেই মন কেমন করে, প্রেমের অতল জলে ডুবে মরছি বলে মনে হতে থাকে, মনে হতে থাকে বাড়ি ফিরে নাদুসনুদুস আমার কথা ভাবছে, পরদিন সকাল দশটায় ইশকুলে যাবার পথে আমাকে এক পলক দেখবে বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে সে। রাস্তায় দাঁড়ায় সে পরদিন, দেখে মনে হয় পৃথিবীতে এই নাদুসনুদুসের চেয়ে সুদর্শন আর কেউ নেই, মনে হয় কি আশ্চর্য ভাবে আমার পুরোটা জীবনই নাদুসনুদুসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, মনে হতে থাকে ওর ঠোঁটের হাসি চোখের হাসি প্রতিদিন না দেখতে পেলে আমার এই জীবনটিই ব্যথর্। এসব এক পলকের প্রেম থেকে, যেগুলোকে মনে হত না হলে নির্ঘাত মারা পড়ব, একদিন হঠাৎই মন অন্যদিকে ফেরে, সে লাইব্রেরির বইয়ে। যত বই আছে তাকে, নিমেষে পড়ে ফেলার আকুলতা হাঁমুখো হাঙরের মত এগোয়। নাগালের বইগুলো পড়া হয়ে গেলে নাগালের বাইরের বই পায়ের আঙুলে ভর করে দাঁড়িয়ে বা মই বেয়ে উঠে ওপরের তাক থেকে পেড়ে এনে আমি আর চন্দনা গোগ্রাসে পড়ি; বাড়িতে পাঠ্য বইয়ের তলে, বালিশের তলে, তোশকের তলে সেসব বই অথচ পরীক্ষা সামনে। গৃহশিক্ষক শামসুল হুদা পদার্থবিজ্ঞান রসায়নবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান অঙ্কবিজ্ঞান ইত্যাদি সাত রকম বিজ্ঞান যখন পড়ান, প্রায় বিকেলেই তাঁর চড় থাপড় খাওয়া আমার নৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। তা হোক, শামসুল হুদা আমাকে বিজ্ঞান-জ্ঞান বিতরণ করে চা বিস্কুট খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই আবার সেই তোশকের বালিশের তলের অপাঠ্যে ঝুঁকে পড়ি। আমার চেয়ে চার কাঠি এগিয়ে থাকে চন্দনা। বই আমি দুটি শেষ করলে ও করে সাতটি। ওর সঙ্গে বইপড়া-দৌড়ে আমি বরাবরই পেছনে। বইপোকা মমতাও চন্দনার সঙ্গে পেড়ে উঠত না, আমার বিশ্বাস। লাইব্রেরির বইগুলোকে ইশকুলের মেয়েরা বলে আউটবই। আউটবই শব্দটির মানে কি, একবার জানতে চেয়েছিলাম, উত্তর ছিল সিলেবাসের বাইরে যে বই, সে বই আউটবই। আউটবই পড়া মেয়েদের শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ভাল ছাত্রীরা খুব ভাল চোখে দেখে না। আউটবই যারা পড়ে, তারা ক্লাসের পড়ায় মন দেয় না, মন তাদের থাকে উড়ু উড়ু মোদ্দা কথা তারা মেয়ে ভাল নয়, পরীক্ষায় গোল্লা জাতীয় জিনিস পায়, এরকম একটি ধারণাই চালু ইশকুলে। এই ধারণাটি কেন, তা আমার বোঝা হয় না। আমি আউটবই পড়েও পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারি, তা প্রমাণ করার পরও ধারণাটি ঘোচে না। ওই পড়ার নেশাতে অন্যরকম একটি জগত তৈরি হয় আমার আর চন্দনার। শিক্ষক শিক্ষিকার বা ক্লাসের মেয়েদের ব্যক্তিগত কোনও প্রেম বিরহের খবর বাতাসের সঙ্গে বা বাতাসের আগে আমাদের কানে আসে না, মাঝপথে কোথাও থমকে থাকে। আমাদের বাতাস তখন ভারি পার্বতীর কান্নায়, রাজলক্ষ্মীর নগ্ন পদধ্বনিতে, চারুলতার নিঃসঙ্গতায়, বিমলার দ্বিধায়।
বাতাস যে সবসময় ভারি হয়েই থাকে তা নয়, মাঝে মধ্যে অমল হাসিতে আবার অমলিন হয়ে ওঠে, আবার ফুরফুরে। আমাদের লাইব্রেরিয়ান সাইদুজ্জামানের ঠোঁটে তেমন একটি অমল হাসি খেলে প্রায়ই। মাঝে মাঝে আমাদের ইসলামিয়াত পড়ান তিনি, এই একটি বিষয়ের জন্য ইশকুলে কোনও শিক্ষক নেই, যে শিক্ষকের যখনই অবসর থাকে, ইসলামিয়াত পড়াতে ক্লাসে আসেন। ইসলামিয়াত ক্লাসে সাইদুজ্জামানের হাসি নিখাদ আকর্ণবিস্তৃত। তাঁর হাসির মূল্য আছে, কারণ এ ক্লাসটি অন্য যে কোনও ক্লাসের চেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণী পাল বাংলা পড়াতে এসে ঠোঁটে মোনালিসার হাসি ঝুলিয়ে রাখেন, সাহিত্যের রস আস্বাদনের সময় ওরকম একটি হাসির প্রয়োজন আছে। সুরাইয়া বেগমও তাঁর উঁচু উঁচু দাঁতের হাসিতে রজনীগন্ধার সুগন্ধ ছড়ান। হাসিতে কি সুগন্ধ ছড়ায়? চন্দনা বলে, ছড়ায়। অংকের শিক্ষক বাংলার পাঁচের মত মখু করে ক্লাসে আসেন, ক্লাস থেকে বেরোন, সে মানায়। সাইদুজ্জামানের হাসির প্রশ্রয়ে ইসলামিয়াত ক্লাসে বসে আকাশের দিকে অন্যমন তাকিয়ে থাকলেও বা খাতা ভরে পদ্য লিখলেও বা পেচ্ছাব পায়খানা করতে গিয়ে বা জল খেতে গিয়ে পাঁচ মিনিটের জায়গায় আধঘন্টা কাটিয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না। সাইদুজ্জামান ইসলামিয়াত পড়ানো রেখে গল্প করে সময় কাটান বেশি,তাঁর গল্পগুলো নেহাত নিরস নয়, তবে বারবারই তিনি বলেন বিষয় হিসেবে ইসলামিয়াত একেবারে ফেলনা নয়, ফেলনা নয় কারণ এটিতে নম্বর ওঠে, সূরা ফাতিহা ঠিকঠাক লিখে দিতে পারলে বা আসমানি কিতাবের চারটে নাম বলতে পারলেই দশে দশ। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নে নম্বর যদি কম পাওয়া যায়, প্রথম বিভাগে পাশ করার ভরসা হল ইসলামিয়াত, খাটাখাটনি ছাড়াই নম্বর। ক্লাসের মুসলমান মেয়েদের জন্য ইসলামিয়াত পাঠ্য, হিন্দুদের জন্য সনাতন ধর্ম শিক্ষা, সারা ইশকুলে হিন্দু ধর্ম পড়াবারও কোনও শিক্ষক নেই, কল্যাণী পাল হিন্দু বলে তাঁকে প্রায়ই ওই ক্লাসে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়, ছাত্রীদের তিনি বলেন, খামোকা ধর্মের পেছনে সময় নষ্ট না করে অঙ্ক বিজ্ঞান নিয়ে থাকো, ওতে কাজ হবে। হিন্দু মেয়েরা ধর্ম ক্লাসে বিরাট এক ছুটি পেয়ে যায়, অঙ্ক বিজ্ঞানের পেছনেও সময় নষ্ট না করে মাঠে খেলতে চলে যায়, নয়ত আড্ডা পেটায় খালি ক্লাস-ঘরে। চন্দনা যেহেতু বৌদ্ধ, ওরও বেরিয়ে যাওয়ার কথা ক্লাস থেকে, হিন্দু ধর্মের শিক্ষকই নেই, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক থাকার তো কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ও ঠায় বসেই থাকে ইসলামিয়াত ক্লাসে, গল্পের বইয়ে ডুবে, নয়ত কবিতায়। আমি ওর পাশে বসে না দিতে পারি মন ইসলামিয়াতে, না পারি সাইদুজ্জামানের নাকের ডগায় নীহাররঞ্জন গুপ্ত খুলতে। অতঃপর আঁকিবুকি কর, ছড়া লেখ।
সাইদুজ্জামান কামান দাগান,
ধর্মের ঘোড়া স্কন্ধে চাপান
হাবিজাবি কন যেখানে যা পান
কাশি তো আছেই, আবার হাপাঁন
মাথায় একটি টুপিও লাগান
কোরান হাদিস মানেন নাকি মানার ভান?
সাইদুজ্জামানকে তুলোধুনো করে আমারই পরে দুঃখ লেগেছে, রীতিমত শার্টপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক, কোনও টুপি তার চাঁদি স্পর্শ করেনি, তাঁকে কেন এই হেনস্থা! আসলে এ সাইদুজ্জামান বলে কথা নয়, যে কাউকে নিয়েই এমন হতে পারে, টেংরা মাছের মত দেখতে কাউকে বিশাল হাঁমখু বোয়ালও নির্বিঘ্নে বানানো চলে। বিশেষ করে চন্দনার আশকারা পেলে। বাংলার শিক্ষক সুরাইয়া বেগম হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছেন, পেছনে চন্দনা আর আমি দুটো পিপঁ ড়ের মত, চন্দনা ফিসফিসিয়ে বলছে—ওলো সুরাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, মখু ঘুরাইয়া
আমি যোগ করছি—আর কত হাঁটো, বেলা তো গেল
কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দনা শেষ করে, যেতে যেতে গেল ফুরাইয়া।
আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনের শিক্ষকমণ্ডলী যে ছোটখাট ব্যাপার নয় তা জেনেও আমাদের ছড়া কাটা, যদিও প্রকাশ্যে কিছুই নয় সবই নিভৃতে-নির্জনে-নিরালায়, থেমে থাকে না। অন্য ইশকুলে বি এ পাশ নেবে, আবাসিকে ঢুকতে হলে হতে হবে এম এ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে যা হতে হয়। এই বিদ্যায়তনের শিক্ষক শিক্ষিকা কেউ এ শহরের নয়, দূর দূর শহর থেকে আসা, বেশির ভাগই ঢাকা থেকে। শিক্ষককুলের বাড়িঘর সবই ইশকুলের ভেতর। এক একজন শিক্ষকের জন্য এক একটি বাড়ি, বাড়ির সামনে মাঠ, পেছনে বাগান। যখন এ ইশকুলটি বানানো হয়, তখন কেবল শিক্ষককুলের জন্যই আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না, ছাত্রীকুলের জন্যও ছিল। বাধ্যতামূলক আবাসিকতা। প্রায় ক্যাডেট কলেজের মত করে এই ইশকুলটির আগপাস্তলা গড়ার স্বপ্ন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে, তাই এই শহরেই তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে রাবেয়া মেমোরিয়াল নামে এই আবাসিক ইশকুলটি তিনি বানাতে শুরু করেছিলেন প্রায় একশ একর জমির ওপর, হাওড় বিল সব ভরে। তারপর তো পাকিস্তান গেল, গভর্নর গেল, একাত্তরে বোমারু বিমান শহরে চক্কর খেয়ে রাবেয়া মেমোরিয়ালের একাকি দাঁড়িয়ে থাকা আধখেঁচড়া ইশকুল-দালানে বোমা ফেলে অনেকখানি ধসিয়ে ফেলল। যুদ্ধের পর ধস সরিয়ে অবশিষ্ট দালানটুকু সারাই করে চুনকাম করে রাবেয়া মেমোরিয়াল নাম তুলে দিয়ে আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন বসিয়ে এটি চালু করা হল,ওই একই নকশায় বলা যায়, আবাসিকের নকশা, কিন্তু শিক্ষককুল দ্বারা আবাসিক ব্যবস্থা সম্ভব হলেও ছাত্রীকুল দ্বারা হল না। একটি নতুন দেশের পক্ষে অত বিশাল আয়োজনে সবকিছু করা সম্ভব হয়নি, তবু যা হয়েছে তাই বা কম কিসে! ছাত্রীদের ইশকুলের সীমানায় বাধ্যতামূলক করা হল না, ছাত্রীনিবাস পড়ে রইল মাঠের এক কোণে ভুতুড়ে নির্জনতায়। কেবল প্রধান শিক্ষিকা ওবায়দা সাদের বাড়ির নিচতলায় খুলনা রাজশাহি থেকে আসা কিছু মেয়ের থাকার ব্যবস্থা হল। তবু এই ইশকুল শহরের নামি ইশকুল, দামি ইশকুল। বাছাই করে ভাল শিক্ষক শিক্ষিকাদেরই কেবল চাকরি দেওয়া হয়েছে। বাছাই করে ভাল ছাত্রীদেরই কেবল ভর্তি করা হয়েছে। অন্য ইশকুলগুলোর চেয়ে এই ইশকুলের ঢংঢাং তাই অনেকটাই আলাদা। এই ইশকুলে ছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া হয়, অন্য ইশকুলে এমন ব্যবস্থা নেই। বৃত্তির জন্য অন্য ইশকুলে বোর্ডের পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। এই ইশকুলের অডিটোরিয়াম যেমন দেখার মত, অনুষ্ঠানও হয় দেখার মত। এ তো আর অন্য ইশকুল-অডিটোরিয়ামের মত মুরগির খোপ জাতীয় কিছু নয়, বড় কোনও সিনেমাহল বলা চলে। বোতাম টিপলেই ভারি মখমলের পর্দা মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশে সরে যায়। মঞ্চও চক্রাকারে ঘোরে। দর্শকের আসন নিচ থেকে ওপরে চলে গেছে। নাটক, নৃত্যনাট্য, সঙ্গীতানুষ্ঠান যা হয় এই মঞ্চে তা অন্য ইশকুলের সাধ্য নেই হওয়ানোর। প্রতি মাসে না হলেও দুমাস অন্তর অন্তর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, বারোই দিবস তেরই দিবস পালন তো আছেই। এমনিতেও চাপাচাপি করলে ডাকসাইটে শিক্ষক শিক্ষিকারা খোলস থেকে বেরিয়ে গান গেয়ে ওঠেন অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠে। বোমা ফেলার দরকার হয় না, পরিমাণ মত সুড়সুড়ি ফেললেই কবিতা বেরিয়ে আসে অনেকের পেট থেকে, এমন কি অংকের শিক্ষকের পেট থেকেও। অনুষ্ঠানাদি ছাড়া যে একেবারে নীরস সময় কাটে তা নয়, সুরাইয়া বেগম বাংলা পদ্য পড়াতে এসে প্রায়ই নিজের লেখা পদ্য শোনান। সুরাইয়া বেগমের মন কাদার মত নরম হলেও জিন্নাতুন নাহার শক্ত পাথর-মত। তিনি পড়ান ইংরেজি। ইংরেজির শিক্ষকদের কোনওকালেও আসলে আমার ভাল লাগেনি। বিষয়টি যেমন কঠিন, বিষয়ের শিক্ষকগুলোও তেমন। আমার ভাল লাগে বাংলা, চন্দনারও বাংলা। ওই সময় একদিন অন্যদিনের মতই ইশকুলে পৌঁছে সকাল বেলা মাঠে ক্লাস অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে উঠবস করে আর ডানে বামে পেছনে সামনে মাথা থেকে পা অবদি নেড়ে চেড়ে অর্থাৎ দৈনন্দিন ব্যায়াম সেরে সোজা হও আরামে দাঁড়াও পবের্ আদেশ অনুযায়ী আরামে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকার সামনে সমস্বরে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গেয়ে লাইন করে ক্লাসঘরে ঢোকার পর যে সংবাদটি প্রধান শিক্ষিকা নিজে এসে আমাদের দিয়ে যান, সে হল লেখক কাজী মোতাহার হোসেন এখন আমাদের ইশকুলে, তাঁর সঙ্গে ইচ্ছে করলে আমরা দেখা করতে পারি। উত্তেজনায় বুক কাঁপে। কাজী মোতাহার হোসেন আমাদের প্রধান শিক্ষিকার বাবা। তিনি লেখেন ভাল, খেলেনও ভাল, মাথা ভালদের যা হয়—সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী। অনেকগুলো গুণী সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনি, এই ওবায়দা সাদ ছাড়া বাকি সবাই স্বনামধন্য, ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন নামি লেখক, মেয়ে সানজিদা খাতুন-ফাহমিদা খাতুন দুজনই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী। আমি আর চন্দনা বিখ্যাত সন্তানদের বিখ্যাত বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবশ্য বিষম এক ফাপঁরে পড়ি। প্রথম কিছুক্ষণ উঁকি দিয়ে দরজায়, আলতো করে দরজা সরিয়ে পঁচাশিভাগ ভয়ে পনেরোভাগ নির্ভয়ে তাঁর ঘরখানায় উপস্থিত হতেই তিনি শাদা দাড়ি দুলিয়ে হাসলেন, কৌতূহলে চোখদুটো উজ্জ্বল, তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত করি আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বাক্যটি বড় ব্রীড়িত বিনম্রস্বরে বলে। শুনে তিনি মধুর হাসলেন, হেসে টেবিলে একটি রেডিও ছিল সেটি বেজায় শব্দ করে চালিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ রেডিও চলল, আমি আর চন্দনা নিজেদের মধ্যে বিস্মিত দৃষ্টি বিনিময় করছি, তিনি শুভ্রকেশ শুভ্রশ্মশ্রু শুভ্রহাস্য অধরে, রেডিওতে কান পেতে আছেন। আমরা আবারও জানালাম কেন এসেছি, তিনি এবার মাথা নাড়লেন, অথার্ৎ তখন না হলেও এখন বুঝতে পেরেছেন আমরা কেন এসেছি। মাথা নেড়েই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে, কেবল ঘর থেকে নয়, বাড়ি থেকে, হন হন করে হেঁটে সোজা ইশকুলের দিকে। পেছন পেছন গিয়ে দেখি ওমা তিনি তাঁর কন্যার কাছে গিয়ে বলছেন, তুমি আমাকে ডেকে পাঠালে যে! ওবায়দা সাদ তাজ্জব, তিনি মোটেও ডেকে পাঠাননি পিতৃদেবকে। ঘটনা কি? পিতৃদেব কানে খাটো। কানে খাটোর সঙ্গে আমরা কি করে কথোপকথন চালাবো তবে ওবায়দা সাদ এর কোনও মীমাংসা করতে পারলেন না। অতঃপর মান্যগণ্য প্রণম্য নমস্য সৌম্যদর্শনের আপাদমস্তকের দিকে নীরবে শ্রদ্ধা ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর রইল না। বুদ্ধি হওয়ার পর কোনও জলজ্যান্ত লেখককে চোখের সামনে এই আমার প্রথম দেখা। মার কাছে শুনেছি, যখন ছ মাস বয়স আমার, রাহাত খান, বাবার এক লেখকবন্ধু আমাদের বাড়ি আসতেন, আমাকে কোলে নিয়ে দোলাতেন, দোলাতে দোলাতে নিজের বানানো গান গাইতেন। মার ইশকুলের বান্ধবী ফরিদা আখতারের উদ্দেশে ছিল সে সব গান, আমার স্বপ্নে দেখা ফকিরকন্যা থাকে সে এক পচা ডোবার ধারে, কিস্তি নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে আমি দেখে এলেম তারে ..। রাহাত খান নাসিরাবাদ কলেজের মাস্টার ছিলেন। ডাক্তারে আর মাস্টারে খাতির হইল কেমনে? জিজ্ঞেস করলে মা উত্তর দিয়েছেন, দুইজনে এক মুক্তারনির প্রেমে পড়ছিল, সেই মুক্তারনি, মুক্তারের সুন্দরী বউ, যার বাড়িতে জায়গির থাইকা লেখাপড়া করছিল তর বাপ! ফরিদা আখতারের প্রেমেও নাকি বাবা পড়েছেন। মুখে বসন্তের দাগঅলা ফর্সা উঁচালম্বা ফরিদা আবার আমার শিক্ষিকা ছিলেন ছোটবেলার সেই রাজবাড়ি ইশকুলে। ফরিদা লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রী ছিল, আমি ছিলাম ফার্স্ট বেঞ্চের, আমার চেয়ে কত খারাপ ছাত্রী ছিল ফরিদা, সেই ফরিদা এখন ইশকুলে পড়ায় আর আমি চুলায় খড়ি ঠেলি। এই হইল আমার কপাল! মার কপাল নিয়ে আর যে কেউ ভাবুক, বাবা ভাবেন না। মা ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করবেন, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবেন, চোর ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব থেকে বাড়ি সামলাবেন, এই মহান দায়িত্ব যাঁর হাতে, তাঁর আবার কপালের কথা ভাবার অবকাশ আছে নাকি!
রাহাত খানের গল্প শুনতে আমি যত আগ্রহী, মা তত নন। বই পড়া মেয়ের কাছে লেখক মানে বিশাল কিছু না ছুঁতে পারা আকাশ। যাঁরা বই লেখেন, তাঁরা যে আর সবার মত মানুষ, তাঁরা যে আর মানুষের মত পেচ্ছাব পায়খানা করেন, তাঁদের নাকেও যে মাঝে মধ্যে সর্দি জমে, ছিৎ করলে থিকথিকে মোটা হলদে সর্দিও যে তাঁদের নাকের ফুটো দিয়ে কখনও বেরোতে পারে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। সিনেমার লোকদের বেলাতেও আমার একই বিশ্বাস। তাঁরা সুন্দর-শোভন জীবন যাপন করেন, ঝলমলে জগতে বাস করেন, ঝকঝকে গাড়িতে চড়েন, চোখ ঝলসানো জামা কাপড় পরেন, রাজা বাদশাহর মত তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আপেল আঙুর খান, তুলো-নরম বিছানায় ঘুমোন, গা থেকে ঘামের গন্ধ তো দূরের কথা, গায়ের গন্ধও নয়, বেরোয় গোলাপের সুঘ্রাণ, কখনও কোনও কাজে একবিন্দু ভুল করেন না, মিথ্যে বলেন না, কাউকে কষ্ট দেন না। অতিমানব যাকে বলে। বইয়ের যেমন পোকা আমি, সিনেমারও। চন্দনারও একই হাল। দাদাকে অনুরোধ আবদার করে সিনেমায় যেতে রাজি করিয়ে যাওয়ার পথে চন্দনাকেও উঠিয়ে নিই। হুজ্জত হাঙ্গামা করে মাঝে সাঝে সিনেমা দেখাবার ব্যবস্থা দাদা করেন বটে, কিন্তু ঘরে বসে সিনেমা পত্রিকার দেখা পাওয়া ছোটদার কারণেই আমার প্রথম হয়। ছোটদা পড়াশোনায় মন না বসা টই টই করে শহর ঘুরে বেড়ানো সাত কাজের কাজি অকাল-বিবাহিত তরুণ, প্রতি সপ্তাহে দুপুরের পর হাতে করে চিত্রালী নিয়ে আসেন বাড়িতে অবসরে তাঁর চিত্ত বিনোদনের তাগিদে। ছোটদার বিত্ত নেই কিন্তু চিত্ত আছে। ছোটদার চিত্তের বিনোদন সাঙ্গ হলেই আমার ঔৎসুক্য লম্ফ দিয়ে ওঠে। কি আছে লেখা ওই ছবিঅলা কাগজে? কোথাও কোনও মুদ্রিত অমুদ্রিত শব্দ দেখামাত্র পড়ে ফেলা মেয়ে আমি। ইশকুলে যাওয়ার পথে ছেলেছোকড়া না থাকলে সহস্রবার পড়া সাইনবোর্ড আবারও নতুন করে পড়তে পড়তে যাই। বাদাম কিনে বাদাম খেতে খেতে বাদামের ঠোঙার লেখা পড়ে ফেলি। তেঁতুলের আচার কিনলেও সে আচার চেটে খেয়ে আচারের তেলের তলে আবছা লেখাও উদ্ধার করে ছাড়ি। এমন যে পড়ুয়া, সে কেন চিত্রালী বলে চিত্ত বিনোদনের কাগজটি ফেলে রাখবে!ছোটদার সেই চিত্রালীতে চোখ বুলোতে বুলোতে অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায় চোখ বুলোনো। অভ্যেস গড়াতে গড়াতে নেশায় গিয়ে নামে। অথবা ওঠে কে জানে! ছোটদা যদি চিত্রালী কেনায় অনিয়ম করেন, তবে আর কী! ইশকুলের রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে চিত্রালী কেনো, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবদি পড়ে ফেলো যা লেখা, নায়ক নায়িকার বাড়ির গাড়ির হাঁড়ির, প্রেমপ্রণয়বিরহের খবর সব নখদর্পণে নিয়ে রাতে ঘুমোতে যাও, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখো কোনও এক নায়কের সঙ্গে ঝিকমিক জ্যোৎস্নায় ঝিলমিল করা ঝিলের ধারে ঝিরঝিরে হাওয়ায় তোমার দেখা হচ্ছে, সেই নায়ক তোমার উদ্দেশে নেচে নেচে গান গাইছে, গাছপালাআকাশবাতাসঝিলেরজলচাঁদেরআলো সবকিছুকে সাক্ষী রেখে বলছে যে তোমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। শুক্রবার চিত্রালী হাতে না পেলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না, মা অন্তত তাই বলেন। হজম নিয়ে আমি মোটেও উদ্বিগ্ন নই, তবে ভাত খাচ্ছি, চিত্রালী এল বাড়িতে, ব্যস ভাতের থালা ঠেলে উঠে গেলাম নয়ত এক হাত চিত্রালীতে, আরেক হাত ভাতে, ভাতের হাত অচল হতে থাকে, চিত্রালীর হাত সচল। চিত্রালী আমার ক্ষিধে কেন বাপ মা ভুলিয়ে দেওয়ার মত শক্তি রাখে। এমন শুরু হয়েছে চিত্রালীর পাঠকের পাতায় আমার একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর। এমনি একটি লেখা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্নরকণ্ঠী সাবিনা কেন অবহেলিত, সাবিনার কণ্ঠে মাধুর্য, রুনার কণ্ঠ কর্কশ ইত্যাদি। ওই আমার প্রথম কিছু ছাপা হওয়া কোনও পত্রিকায়। লেখা পাঠানোর আগে ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি চিত্রালীতে লেখা পাঠাই, তবে কি ছাপবে ওরা! ছোটদা দুব্বোকা বলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলেছেন যে চিত্রালীতে দিনে পাঁচ হাজার চিঠি পৌঁছয়, পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার বিরানব্বইটি চিঠি ওরা পড়া তো দূরের কথা, খোলেই না, ছুঁড়ে দেয় ময়লা ফেলার বাক্সে, আমি যদি কোনও চিঠি পাঠাই তা সোজা ওই ময়লার বাক্সেই যাবে। ছোটদা যদিও ঝাড়বাতি এক ফৎু কারে নিবিয়ে আমার আশার ঘরে হতাশার বস্তা বস্তা বালু ঢেলে দিয়েছেন, তবু আমি গোপনে লেখাটি পাঠিয়েছিলাম চিত্রালীর ঠিকানায়, ভাগ্য পরীক্ষা করা অনেকটা। দিব্যি পরের সপ্তাহে ছাপা হয়ে গেল, লেখাটির পাশে সাবিনা ইয়াসমিন আর রুনা লায়লার ছবি বসিয়ে। বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেল, হিপ হিপ হুররের তোড়ে ভাসতে থাকি। আমার নামখানি পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে, অবিশ্বাস্য কাণ্ড বটে। ছোটদা কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে থেকে তোতলালেন, বাহ ত-তর লে-লেখা ছাপা হইয়া গে-গেল! যেন আমি সাংঘাতিক অসম্ভব কিছু সম্ভব করে ফেলেছি! আমার ঠোঁটে সারাক্ষণই রাজ্য জয় করার হাসি মিছরির গায়ের লাল পিপঁড়ের মত লেগে থাকে। বাবাকে বাদ দিয়ে পত্রিকাটি সবার চোখের সামনে একাধিকবার উঁচু করি, এমনকি জরির মার চোখের সামনেও। জরির মা অবাক হয়ে পত্রিকাটির দিকে তাকিয়ে বলে, এইডারে ত ঠোঙ্গার কাগজের মতই দেহা যায়। অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর আরও একটি ঘটনা ঘটে, এটিও অবিশ্বাস্য। পরের সপ্তাহে দেখি আমার লেখার প্রশংসা করে এবং আপত্তি জানিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা চিত্রালীতে ছাপা হয়েছে। আমার উৎসাহ তখন ভাত ফোটার মত টগবগ করে ফোটে। এরপর পাঠকের পাতায় তো বটেই চিঠিপত্র বিভাগেও লেখা পাঠানো শুরু করি। চিত্রালীর ধাঁচে শরীর সাজিয়ে পূর্বাণী নামের নতুন একটি পত্রিকা উঁকি দিচ্ছে শিল্প-সাহিত্য-বিনোদনের জগতে। পূর্বাণীকে হেলা করব, এমন হৃদয়হীন আমি নই। চিত্রালী পূর্বাণী, এ দুটো পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে আমার না হলেই নয়। চিত্রালী বা পূর্বাণীতে আমার লেখা থাকলে ঠোঁটে চিকন হাসি ঝুলিয়ে ছোটদা প্রতি সপ্তাহে বলেন হ হইছে ছাপা, আর না থাকলে কি রে তর লেখা ত ছাপল না! চন্দনাকে এই জগতটিতে টেনে নামাতে হয় না, আড়ম্বর দেখে ও নিজেই নামে। আমি যত না লিখি, আমাকে নিয়ে লোকে তার চেয়ে বেশি লেখে। রীতিমত আসরের অন্যতম একজন হয়ে উঠি। চিত্রালীতে চিঠির উত্তর যিনি দেন, যাঁকে সবাই উত্তরদা বলে ডাকে, রসের কলসে চুবিয়ে তাঁর উত্তর তোলেন। লিখতে লিখতে সেই কোনওদিন দেখা না হওয়া উত্তরদাকে আমার আপন দাদার মত মনে হতে থাকে। ইয়াসমিনের সঙ্গে পেনসিল নিয়ে ছোটখাট একটি চুলোচুলির যুদ্ধ হয়ে গেল, সবার আগে উত্তরদাকে চিঠি লিখে জানাই আজ আমার মন ভাল নেই। মনে ফুর্তি হলেও তাঁকে জানানো চাই সবার আগে। গোলপুকুর পাড়ের আড্ডা থেকে ছোটদা একটি বাক্য তুলে একদিন অবকাশে বিতরণ করলেন কুড়িটা বসন্ত পার হয়ে গেল, কোনও কোকিল তো দূরের কথা, একটা কাকও ডাকল না। বাক্যটি লুফে নিয়ে উত্তরদাকে জানিয়ে দিই, ঘটনা এই। তিনি এমনই মর্মাহত শুনে যে ঢাকা শহরের সবগুলো কাককে ময়মনসিংহের দিকে ধাওয়া করলেন, যেন কা কা রব তুলে আমার বসন্তকে সার্থক করে এবং তিনি এবং তাঁর শহরবাসি কাকের যন্ত্রণা থেকে এই জনমের মত মুক্তি পান। ধুত্তোরি, আমি কি এমনই বুড়ি যে কুড়ি হব! ও তো মজা করতে! কেবলই মজা করার জন্য সে আসর নয়, যথেষ্ট গুরুগম্ভীর কথাবার্তাও হয়। লোকের সত্যিকার মান অভিমান, দুঃখ শোক, প্রেম বিরহ, কূটকচাল এমনকি সংসারের ঝুটঝামেলারও মীমাংসা হয় পত্রিকার পাতায়। পাঠকসংখ্যা এত ব্যাপক যে তখন দেশের প্রতিটি শহরে চিপাচস নামে চিত্রালী পাঠকপাঠিকা সমিতি খোলা শুরু হল। ময়মনসিংহে চিপাচসের কণর্ধার বনে বসলেন স্বয়ং ছোটদা। হতেই হবে, লেখক না হলেও পাঠক তো তিনি। পড়াশোনা লাটে উঠেছে, কাজ নেই কম্ম নেই, তাঁর পক্ষেই সম্ভব চিপাচস নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা পড়ে থাকা। চিপাচসের একটি সভাও একদিন হয়ে গেল টাউন হলের মাঠে। ঘন সবুজ মাঠের বটবৃক্ষ ছায়ায় বিকেলের সভাসমিতি জমে ওঠে বেশ। এক বটতলায় চিপাচস গড়ে তোলা হচ্ছে, অন্য বটতলায় ধাড়ি ধাড়ি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসেছে পুরোনো কচি কাঁচার মেলা। কাঁচারা এদ্দিনে পেকে লাল, কিন্তু কাঁচা নামটি খোয়াতে নারাজ। ইত্তেফাক পত্রিকার রোকনুজ্জামান খান যাঁকে কচি কাঁচারা দাদাভাই বলে ডাকে, পত্রিকায় কচিকাঁচার আসরও যেমন খুলেছেন, কচিকাঁচাদের সংগঠনও গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন শহরে। সংস্থা সমিতি সংগঠন পরিষদ এসবের কমতি নেই ময়মনসিংহ শহরটিতে। ছোটদার কাছেই খবর জোটে শহরের এখানে ওখানে নানা রকম আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে, সাহিত্য সভা হচ্ছে, নাচ গান নাটক হচ্ছে। শুনে ইচ্ছের জিভে লোল জমে। চিপাচসের সভা থেকে ফিরলে ছোটদাকে পই পই করে জিজ্ঞেস করি, কে কে এসেছিল, দেখতে কেমন? কেউ কি কিছু বলল, কি বলল? ছোটদা এক এক করে নাম বলেন, এক এক করে পরিচয়। এর ওর বলা দুএকটি শব্দ বা বাক্য উপরোধে ঢেঁকি গিলতে গিলতে শোনান। ময়মনসিংহের পদ্মরাগ মণি, চিত্রালীর আসরে নজর কাড়া মেয়ে, সগৌরবে চিপাচসের সভায় উপস্থিত থাকলেও আমার আর চন্দনার পক্ষে সম্ভব হয়নি পুরুষমানুষের ভিড়ভাট্টায় ছায়া সুনিবিড় শান্তির মাঠটির শীতল ঘাসে পা ফেলার অনুমতি পাওয়া। পুরুষ- আত্মীয় আর পুরুষ-শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের আড্ডায় বা সভায় আমাদের অবাধ যাতায়াতের কোনও সুযোগ নেই, যতই আমরা যাওয়ার জন্য গোঁ ধরি না কেন।
চিত্রালীতে লেখা ছাপা হওয়ার পর থেকে আমার নামে অবকাশের ঠিকানায় বেশ কয়েকটি চিঠি আসে, পত্রমিতালির আবেদন দেশের বিভিন্ন শহর থেকে। এমন কখনও ঘটেনি, ডাকে কোনও চিঠি আমার জন্য আসেনি আত্মীয় স্বজনের বাইরের কারও, কোনও অচেনা কারও। চিঠি পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত আমি। পত্রমিতালি ব্যাপারটি অভিনব একটি ব্যাপার, কেবল চিঠিতে দূরের মানুষদের চেনা, চিনতে চিনতে বন্ধ-ু মত আত্মীয়মত হয়ে যাওয়া। ঢাকা থেকে জুয়েল, সিলেট থেকে সাব্বির, চট্টগ্রাম থেকে শান্তন-ু – পত্রমিতা হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিই। মেয়েরা ছেলেরা চমৎকার বন্ধু হতে পারে এই বিশ্বাসটি আমার মনে একটু একটু করে বাসা বাধঁ তে থাকে। আত্মীয়তার বাইরে সম্পর্কের যে ব্যাপারটি আমি দেখেছি, তা প্রেম, ছোটদা আর দাদার জীবনে হয়েছে, রুনুখালা রুনুখালার জীবনেও। প্রেমের উদ্দেশ্য একটিই, বিয়ে। দাদার পক্ষে শীলাকে সম্ভব হয়নি, ছোটদা সম্ভব করে ছেড়েছেন। এর বাইরে ছেলে মেয়েতে কোনও রকম সম্পর্ক আমি আমার চেনা কারও মধ্যে দেখিনি। নাটক উপন্যাসে থাকে, সিনেমার গল্পে থাকে। আমি যে জগতে বাস করি, সে জগতে এর কোনও স্থান নেই। কিন্তু আমার কাছে আসা চিঠিগুলোই এই প্রথম অন্যরকম কিছু ঘটিয়ে ফেলে। পর পুরুষের চিঠি কিন্তু কোনও প্রেমের চিঠি নয়, কারও সঙ্গে আমার কোনও বিয়ের কথা হচ্ছে না, কিন্তু চিঠি। ডাকে আসা পত্রমিতাদের চিঠি বাড়িতে অনেকটা দল বেঁধে পড়া হয়। ডাকপিয়ন যার হাতে চিঠি দিয়ে যায়, সে ই পড়ে প্রথম। তারপর যার চিঠি তাকে দিতে গিয়ে চিঠির কথাগুলোও বলে দেয়, যে দেয়। জুয়েলের একটি চিঠি এল, ইয়াসমিন খামখোলা চিঠিটি আমার হাতে দিতে দিতে বলল, জুয়েল জানতে চাইছে তোমার কার গান পছন্দ, হেমন্তর না কি মান্না দের। সাব্বির পাতার পর পাতা ধর্মের কথা লেখে, ছোট ছোট ধমর্পু স্তিকাও উপহার পাঠায়, তার চিঠি এল তো ছোটদা আমার পড়ার আগে সে চিঠি পড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেন, যা পড়, মুন্সি বেডার চিডি পড়। চিঠি ব্যাপারটি যে ব্যক্তিগত, তা আমার তখনও বোঝা হয়নি। পত্রমিতালির ব্যাপারটি চন্দনাকে সংক্রামিত করেছে পরে, দাদাকেও। দাদা ঢাকার এক মেয়ে সুলতানার সঙ্গে পত্রমিতালি শুরু করলেন হঠাৎ। অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা সুলতানার। চিঠি এলে দাদা আমাদের সবাইকে ডেকে সুলতানার হাতের লেখা দেখান। কেবল দেখান না, আমাদের সামনে বসিয়ে চিঠি পড়ে শোনান। পড়ে চিঠির উপর হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, মেয়েডা নিশ্চয়ই দেখতে খুব সুন্দরী। দাদার বিশ্বাস যার হাতের লেখা এত সুন্দর, যার চিঠির ভাষা এমন কাব্যময়, সে প্যারাগন অব বিউটি না হয়েই যায় না।
চন্দনা চিত্রালী আর পূর্বাণীর বাইরে আরও একটি পত্রিকা পড়তে শুরু করেছে, বিচিত্রা। বিচিত্রার পাঠকের পাতায় ওর একটি লেখাও ছাপা হয়েছে। পুলিশবাহিনীতে মহিলা নেওয়ার খবর শুনে চন্দনা মহিলা পুলিশের পোশাকের একটি প্রস্তাব দিয়েছে, বোরখা, বোরখার তলে থাকলে ধমর্ও থাকল আর চোর ছ্যাঁচড়ের কাজ কর্ম চোখের ফুটো দিয়ে দেখাও গেল, পথচারি কারও পুলিশ বলে সন্দেহও হবে না। বিচিত্রা আবার ওর লেখাটির সঙ্গে এক বোরখাওয়ালির কার্টুন এঁকে দিয়েছে। ইশকুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া থেকে চার আনা ছ আনা বাঁচিয়ে চিত্রালী পূর্বাণী কিনি, বিচিত্রা কেনার পয়সা জোটানো সবসময় সম্ভব হয় না। দাদার কাছে হাত পেতে রাখি। পাতা হাত দেখতে দাদার আনন্দ হয়, কদাচিৎ ফেলেন ওতে কিছু ও দিয়েই নেশাখোরের মত বিচিত্রা কিনে নিই। কিনে নেওয়া মানে ইয়াসমিনকে নয়ত জরির মাকে কালো ফটকের কাছে দাঁড় করিয়ে অথবা নিজেই দাঁড়িয়ে হকার দেখলেই ডেকে কেনা। হকার না এলে ইয়াসমিনকে গাঙ্গিনারপাড় মোড়ে পাঠিয়ে কিনে আনি। ডাঙ্গর হয়েছি বলে রাস্তায় একা হাঁটা আমার বারণ। ইয়াসমিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা এখনও জারি হয়নি, তাই দুঃসময়ে ওরই ওপর ভরসা করতে হয় আমার। পত্রিকা কেনার খরচই তো শুধু নয়, পত্রিকার জন্য লেখা আর পত্রমিতাদের চিঠির উত্তর পাঠাতেও খরচা আছে। ছোটদার হাতে চিঠি দিলে ডাকটিকিটের পয়সাও গুনে গুনে দিতে হয়। দাদার মেজাজ বিগড়ে থাকলে অগত্যা শিশিবোতলকাগজ। অবকাশের গা ঘেঁসে তিনটি রাস্তা চলে গেছে তিন দিকে, একটি গোলপুকুরপাড়ের দিকে, আরেকটি দগুর্াবাড়ির দিকে, আরেকটি গেছে সেরপুকুর পাড়ের দিকে। এই তিন রাস্তায় সকাল থেকে শুরু করে সারাদিনই সুর করে ফেরিঅলা হেঁকে যায়। শাড়িকাপড়অলা, বাদামঅলা, চানাচুরঅলা, আচারঅলা, চুরিফিতাঅলা, আইসক্রিমঅলা, হাওয়াই মিঠাইঅলা, শাকসবজিঅলা, ঘিঅলা, মুরগিঅলা, কবুতরঅলা, হাঁসঅলা, কটকটিঅলা, মুড়িঅলা, শিশিবোতলকাগজঅলা। শিশি-বোতল-কাগজ ডাকটি শুনলেই হাতের কাছে যে ই থাকে পাঠাই দৌড়ে ধরতে ব্যাটাকে। ব্যাটার মাথায় থাকে বড় ঝাঁকা। মাথা থেকে ঝাঁকা নামানোর আগে দরাদরি চলে, কত? পত্রিকা তিন টাকা সের, বইখাতা দুইটাকা। কি কন তিন টাকা! চাইর টাকা কইরা নিলে কন। চাইর টাকা বেশি হইয়া যায়, সাড়ে তিন টাকাই দিয়েন। পাল্লা পাত্থর ঠিক আছে? দেইখা লইয়েন। ঝাঁকা নামিয়ে শিশিবোতলকাগজঅলা বারান্দায় বসলে শোবার ঘরের খাটের তলে রাখা পুরোনো পত্রিকা মায়া কাটিয়ে নিয়ে এসে সামনে দিই। খুঁজে খুঁজে পুরোনো বইখাতাও নিয়ে আসি। বিক্রি করে দশ পনেরো টাকা হয়। দশপনেরোটাকাই নিজেকে রাজা বাদশাহ মনে করার শক্তি যোগায়। ছোটদাও বিক্রি করেন পত্রিকা, মাও করেন পুরোনো শিশিবোতল জমিয়ে রেখে, উঠোন ঝাঁট দিতে গিয়ে পাওয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরোও ধুলো ঝেড়ে জমা করে রেখে। ভাঙা শিশি আর ছেঁড়া কাগজ থেকে যে দপু য়সা আয় করেন মা, তা তোশকের তলে রাখেন, অথবা আঁচলের কোণায় বেঁধে যা আমার ছোটদার আর ইয়াসমিনের বিষম হাহাকার থামাতে কোনও এক সময় কাজে লাগে। চন্দনাকে দারিদ্র এমন কষাঘাত করে না, পণ্ডিতপাড়ার একটি সবুজ টিনের ভাড়া বাড়িতে থেকেও চন্দনা দিব্যি পত্রিকার টাকা জুটিয়ে নেয় প্রতি সপ্তাহে। চন্দনা পুরুষভরা টাউনহল প্রাঙ্গনে না যেতে পারুক, কিন্তু বিস্ময়কর কাণ্ডও হঠাৎ হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলতে পারে, খুব ভোরবেলা কাকপক্ষী জাগার আগে ও একদিন চলে এল অবকাশে ছোট ভাই সাজুর সাইকেল চালিয়ে। চন্দনাকে দেখে আমার হৃদয়ে খুশি উথলে ওঠে। বাড়ির সবাই হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে হাঁ হয়ে চন্দনার দিকে তাকিয়ে রইল। কত বড় দুঃসাহসী হলে মেয়ে হয়ে সাইকেল নিয়ে শহরের রাস্তায় বের হতে পারে, সে ভোর হোক কি শুনশান মধ্যরাত হোক—তা অনুমান করে সবাই বিমূঢ় বিস্মিত। চন্দনাকে ভেতরঘরে বসিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে চালের রুটি আর মাংস গরম করে এনে মা ওকে পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন। নাকে মুখে গুঁজে চন্দনাকে অবশ্য দৌড়োতে হল, রাস্তায় লোক বের হওয়ার আগেই বাড়ি পোঁছতে হবে ওকে। চন্দনা যখন সাইকেলে চড়ে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় চুল উড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, কালো ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে আমি মুগ্ধ তাকিয়ে ছিলাম। পৃথিবীতে ওই দৃশ্যের চেয়ে চমৎকার আর কোনও দৃশ্য আমার দেখা হয়নি। যেন সাইকেলে চুল উড়িয়ে চলে যাওয়া মেয়েটি চন্দনা নয়, আমি। আমার ইচ্ছে করে চন্দনার মত সাহসে ভর করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে সাইকেলে।
এমন যখন মন, তখন প্রায় বিকেলের পাট চুকিয়ে প্রতি বিকেলে শামসুল হুদা আসেন আমাকে পড়াতে। হুদার মুখটি কালো ফটকের ধারে কাছে দেখলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়। চমৎকার বিকেল জুড়ে এখন অঙ্ক কর, পদার্থ বিদ্যা ঘাঁটো, রসায়নের পুকুরে হাবুডুবু খাও। ইয়াসমিনকে পড়াতে যখন রবীন্দ্রনাথ দাস আসেন, আমার একরকম আনন্দই হয়। রবীন্দ্রনাথ ইয়াসমিনকে পড়ান পনেরো মিনিট, গল্প করেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। গল্প একা ইয়াসমিনের সঙ্গে করেন না, আমার সঙ্গেও। টাঙ্গাইলের কালিগঞ্জ গ্রামে তাঁর কন্যা কৃষ্ণা বড় হচ্ছে, পুত্র গৌতম বড় হচ্ছে। তিনি ময়মনসিংহ শহরের ছোট বাজারে থাকা খাওয়ার বিনিময়ে নির্মল বসাকের ছেলে গোবিন্দ বসাককে পড়ান। নিজে তিনি শহরতলির এক প্রাইমারি ইশকুলের প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকের চাকরি করে শহরে টিউশনি করে কালে ভদ্রে তিনি সময় পান দেশের বাড়ি যেতে। ওই কালে ভদ্রেই তিনি খরচার টাকা দিয়ে আসেন বাড়িতে, পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন থেকেও আসেন। যতদিন শহরে থাকেন, স্ত্রী পুত্র কন্যার কথাই নিরবধি ভাবেন। আমাদের পাশে বসিয়ে প্রতিদিনই পুত্র কন্যার গল্প করেন, শুনতে শুনতে আমাদের জানা হয়ে যায় কৃষ্ণা দেখতে কেমন, কৃষ্ণা কি খেতে, কি করতে, কি পরতে পছন্দ করে। গৌতম ফুটবল পছন্দ করে নাকি ক্রিকেট, পরীক্ষায় কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে, সব। অবশ্য হঠাৎ বাবা বাড়ি ঢুকলে আমি সরে আসি, রবীন্দ্রনাথ দাসও সচকিত হয়ে বইয়ে মাথা গোঁজেন। ইয়াসমিনের মাথার ঘিলুর পরিমাণ বাবা যখন জানতে চান, দাস মশাই সহাস্য বদনে যা বলেন তা হল, ঘিলু সাধারণের চেয়ে অধিক, তবে পড়াশোনায় মনোযোগটিই সাধারণের চেয়ে স্বল্প। বাবা বলেন, মারবেন। না মারলে ঠিক হবে না। বাবা নিজের হাতে তোশকের তল থেকে এনে দাসমশাইএর হাতে সন্ধি বেত দিয়ে যান। আমার গৃহশিক্ষককেও হাতের কাছে পেলে বলেন, আমাকে যেন পিটিয়ে লম্বা করেন। বাবার এই মত, না পেটালে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। বাবার উপযর্পু রি অনুরোধের কারণে সম্ভবত শামসুল হুদা আমার পিঠে শক্ত শক্ত চড় কষাতে দ্বিধা করেন না। শামসুল হুদা শিক্ষক হিসেবে ভাল, বিদ্যাময়ী ইশকুলের অংকের শিক্ষক তিনি। বাড়িতে আমাকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ান। বাকি বিষয়গুলোর জন্য বিদ্যাময়ীর দুই শিক্ষক জ্ঞানেন্দ্রমোহন বিশ্বাস আর প্রদীপ কুমার পালকে রাখা হয়েছে। প্রদীপ কুমার পালের বাঁ হাতে পাঁচটির জায়গায় ছ টি আঙুল। তাঁর সামনে বসে পড়তে গেলে বইখাতা থেকে বারবারই আমার চোখ চলে যায় ওই বাড়তি আঙুলটিতে। তিনি আবার কবিতা লেখেন, প্রতিদিনই পড়া শেষে আমার একটি কবিতা শোনো বলে শার্টের বুক পকেট থেকে কবিতা লেখা কাগজ বের করে পড়ে কবিতা কেমন লাগল না লাগল জিজ্ঞেস না করে হঠাৎ উঠে চলে যান। গৃহশিক্ষক হিসেবে জ্ঞানেন্দ্রমোহন অবকাশে টিকে গেলেও প্রদীপ কুমার টেকেন না। যে শিক্ষক আমাকে যথেষ্ট কিল চড় ঘুসি লাগাচ্ছেন না, সেই শিক্ষক, বাবার ধারণা, শিক্ষক হিসেবে ভাল নন। শিক্ষক নিয়োগ করতে বাবার যেমন অল্প সময় লাগে, শিক্ষক বিদেয় করতেও। পঞ্চম শ্রেণীতে তিন বিষয়ে লাল দাগ পাওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠা যখন সম্ভব হয়নি ইয়াসমিনের, বাবা নিজে ওকে পড়াতে শুরু করেন। ইয়াসমিন ইশকুল থেকে ফিরে আরোগ্য বিতানে চলে যায় বই খাতা নিয়ে। ওখানে বসেই ও দেখে বেতন আনতে বাবার কাছে গৃহশিক্ষকদের ধর্না দেওয়া। বাবা ওঁদের দুতিনঘন্টা খামোকা বসিয়ে রেখে কুড়ি টাকা পঁচিশ টাকা হাতে দেন। মাসের বেতন পঞ্চাশ টাকা, সেটি বাবার কাছ থেকে কোনও গৃহশিক্ষকের পক্ষেই একবারে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবসময় তিন চার মাসের টাকা বাকি রাখতে পছন্দ করেন বাবা। শুনে আমার লজ্জা হয় খুব, আমি আমার লজ্জা নিয়ে নুয়ে থাকি। বাবার বরাবরই বড় উন্নত শির, তিলার্ধ লজ্জারও তাকত নেই তাঁর তকতকে তল্লাট তিলমাত্র তছনছ করে। তিনি প্রায়ই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছেন, পরীক্ষায় পাঁচটি লেটার নিয়ে তারকাখচিত নম্বর না পেয়ে পাশ না করলে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। সারা জীবন আমাকে রাস্তায় রাস্তায় ফুটো থালা হাতে নিয়ে ভিক্ষে করতে হবে।
মেট্রিক পরীক্ষা হাতের নাগালে তো বটেই, একেবারে নাকের ডগায় যখন এসে বসে, আমার আর উপায় থাকে না স্থির হওয়া ছাড়া। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টা আমি পড়ার টেবিলে। হঠাৎই আমি বাড়ির বহুমূল্যবান মানুষ হয়ে উঠি। হাঁটতে গেলে সবাই সরে দাঁড়িয়ে জায়গা দেয়, পেচ্ছাব পায়খানায় গেলে মা নিজে বদনি ভরে পানি রেখে আসেন। গোসল করার আগেও বালতিতে পানি তোলার কথা বলতে হয় না, তোলাই থাকে। রাত জেগে পড়া তৈরি করতে হচ্ছে, ভাল ভাল খাবার রান্না হচ্ছে আমার জন্য। মা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। ফল মূল নিয়ে একটু পর পর বাড়ি আসছেন বাবা, পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে পিন পতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে দিন রাত। বাড়ির লোকেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে, যেন কোনও শব্দ আমার মগ্নতা নষ্ট না করে। পাড়ায় পুজোর গান শুরু হলে বাবা নিজে গিয়ে পুজো কমিটির চেয়ারম্যানকে বলে আসেন, গান যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে, মেয়ের মেট্রিক পরীক্ষা। মেট্রিক পরীক্ষার মূল্য বুঝে দিলীপ ভৌমিকও পুজোর গান বন্ধ করে দেন। নিতান্তই বাজাতে হলে উল্টোদিকে মাইক ঘুরিয়ে বাজান। আমার টেবিলে খোলা বই খোলা খাতার পাশে খোলা বিস্কুটের কৌটো, পড়তে পড়তে ক্ষিধে লাগলেই যেন খাই। মা গরম দধু দিয়ে যান দুবেলা, বলেন, দধু খেলে ব্রেন ভাল থাকে, পড়া মনে থাকে। এ বাড়ির একটি মেয়ে মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে, এর চেয়ে বড় খবর, এর চেয়ে জরুরি খবর কিছু নেই আর। দিন যত কাছে আসে তত মনে হয় আজরাইল আসছে জান কবচ করতে। আমার বুক কাঁপে। গা হাত পা কাঁপে। রাত দুটো তিনটেয় আমাকে ঘুম থেকে তুলে বাবা বলেন, চোক্ষে পানি দিয়া পড়তে বস। আমি চোখে পানি ছিটিয়ে বসি। বাবা বলেন,পানিতে কাম না হইলে সরিষার তেল দেও।
প্রথম দিন বাংলা পরীক্ষা, বাংলার জন্য আমার কোনওরকম ভয় হয়নি কখনও আগে, কিন্তু পরীক্ষার দিন মনে হতে থাকে আমার পাশ হবে না। মা প্রতিদিন সকালে ডিম ভাজা খেতে দেন, বলেন ডিম খাওয়া ভাল। কিন্তু পরীক্ষার দিন ডিম খাওয়া চলবে না, ডিম খেলে ডিম জোটে পরীক্ষায়, সুতরাং সাবধান। কলাও চলবে না। কচওু না। পরীক্ষায় কলা পাওয়া কচু পাওয়া রসগোল্লা পাওয়ার মতই। যদিও কলা কচু রসগোল্লা আমার প্রিয় খাবার, কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন এগুলো আমাকে পরিত্যাগ করতেই হয়। আমার পরীক্ষা, অথচ বাবা ছটফট করেন আমার চেয়ে বেশি, আগের রাতে ঘুমোননি একফোঁটা। দেখে মনে হয়, বাবারই আজ পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। বারবার জানতে চাইছেন বইএর আগাগোড়া আমি মখু স্ত করেছি কি না। বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে রাধাসুন্দরী ইশকুল। আমি পথ চিনি, কিন্তু আমাকে একা যেতে দেওয়া হবে না। বাবা আমাকে রাধাসুন্দরীতে নিজে নিয়ে যাবেন রিক্সা দিয়ে, পরীক্ষা শেষ হলে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন। সকালে মা যখন চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন আমার, বাবাই তখন সেটি দিলেন মার হাতে,কাগজটি। কাগজটি ভাঁজ করে সুতো দিয়ে বেঁধে আমার চুলে লাগিয়ে দিতে হবে। কাগজে আরবিতে কিছু লেখা, লেখাটি মাথার ওপর থাকলে বাবাকে কে একজন বলেছেন পড়া মনে থাকে। আমি যেন কিছু ভুলে না যাই পরীক্ষার খাতায় লিখতে গিয়ে, তাই এই কাগজ, কাগজে পড়া মনে থাকার দোয়া। আমি ছিটকে সরে যাই, পড়া ভুলে যাওয়ার কোনও রোগ আমার নেই যে চুলে দোয়া দরুদ লাগিয়ে আমাকে পরীক্ষায় বসতে হবে! মা প্রতিদিনই আমার মাথায় ঠাণ্ডা নারকেল তেল দিচ্ছেন মাথা ঠাণ্ডা থাকার জন্য। সেই তেলে-মাথার তেলে-চুলে দুটো কলাবেণী করে দেন মা, এখন সুতো বাঁধা কাগজটি কেবল চুলের সঙ্গে গিঁট দিয়ে দিলেই হয়। লজ্জায় চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে আমার, তবু বাবা আমাকে ধরে বেঁধে কাগজের পুঁটলিটি আমার চুলে লাগিয়ে দিলেন। দেখে ছোটদা হেসেই বাঁচেন না, ফিকফিক ফিকফিক। ইয়াসমিনও ফিকফিক। ছোটদা বললেন, তর তো মেট্রিক পাশ করা হইব না, তাবিজের গুণে যদি পাশ করস।
হাতে একটি দুটি নয়, চারটে নতুন ঝরনা কলম দিলেন বাবা, আর নতুন একটি পেলিকেন কালির বোতল। লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে কালি ভরে যেন লিখি। পরীক্ষার্থীর মন মেজাজ বুঝে সবাই চলছিল, পরীক্ষার্থী হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে না, কিন্তু তাবিজের ব্যাপারে আমার কোনও না খাটেনি। সেই তাবিজ তেলে মাথায় খলসে মাছের মত ভেসে ওঠে। চন্দনাও রাধাসুন্দরী ইশকুলে পরীক্ষা দিয়েছে। শেষ ঘন্টা পড়ার পর বারান্দায় বেরোতেই দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে, ওর খাতা জমা দেওয়া আগেই হয়ে গেছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে ভাল না মন্দ কিছুই না জিজ্ঞেস করে ও জানায়, বিচিত্রায় ওর একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এরপরই চক্ষু চড়কগাছ, কি রে মাথায় এইডা কি বানছস?
ধরণী দ্বিধা হও, এ উচ্চারণ জীবনে দ্বিতীয়বারের মত করেছি, ধরণী দ্বিধা হয়নি।
পাশ করলে এমনি পাশ করাম, তাবিজের কারণে পাশ করতাম না। বাড়ি ফিরে চুলের তাবিজ একটানে খুলে ফেলে দিয়ে বলি।
মা বললেন, পড়াডা মনে থাকব।
পড়া আমার এমনি মনে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলি। ভেতরে ফোপাঁনো কান্না।
বাবা ধমকে বলেন, এইডা মাথায় আছে বইলা মনে থাকে, নাইলে থাকত না।
আমি অবাক তাকাই, দোয়া দরুদ তাবিজ কবজে বিশ্বাস করা লোকটিকে আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার বাবা।
প্রতিটি পরীক্ষার দিন আমার মাথায় ওই তাবিজ লাগিয়ে দেওয়া হয়, আমার কোনও বাধাই টেকে না। মাথা ভরা লজ্জা নিয়ে আমাকে মাথা নত করে প্রতিদিনই যেতে হয় রাধাসুন্দরী ইশকুলে। প্রতিদিনই আমাকে সতর্কে থাকতে হয়, মাথার লজ্জাটি আবার দাঁত কপাটি মেলে প্রকাশিত না হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই বারবার মাথায় হাত দিয়ে লজ্জাটি চুলের আড়ালে ঢাকতে হয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে তো বটেই উত্তরপত্র থেকেও বারবার মন মাথায় গিয়ে ওঠে। মাথা আমার জন্য বিশাল একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মাথার লজ্জায় আমি মাথা নত করে পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরি। ইচ্ছে করলে খুলে ফেলে দিতে পারি, কিন্তু আবার ভয়ও হয়, যদি সত্যিই স্মৃতিশক্তি লোপ পায় আমার! যদি পাঁচ আর সাত যোগ করলে যে বারো হয়, এই সহজ জিনিসটি ভুলে যাই অঙ্ক পরীক্ষার দিন! যদি ইংরেজি পরীক্ষার দিন গরুর রচনা লিখতে গিয়ে প্রথম বাক্যটিই আর মনে না করতে পারি, দ্যা কাউ ইজ এ ডমেস্টিক অ্যানিম্যাল !