১৪. সুরতহাল রিপোর্ট

সুরতহাল রিপোর্ট

তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়ে যায় আমার। এই বষের্ বিষয়গুলো তেমন কঠিন কিছু নয়। ফার্মাকোলজি আর জুরিসপ্রুডেন্স। তবে পাশাপাশি সার্জারি মেডিসিন গায়নোকলজির ক্লাসও হচ্ছে, কেবল ক্লাস নয়, হাতে ধরে শেখা, টিপে টুপে চেপে চুপে শেখা, ঘাঁটাঘাঁটি করে শেখা। বর্হিবিভাগেও রোগী পড়তে যেতে হচ্ছে। চক্ষু কণর্ নাসিকা দন্ত যৌন চর্ম ইত্যাদি নানা বিভাগে কেবল ঢুঁ নয়, ওখানেও ঘাঁটাঘাঁটি। একা থিওরেটিক্যাল নলেজ এ কচু হবে, প্র্যাকটিক্যাল নলেজই হল আসল। মেডিকেল কলেজের ল্যাবরটরি হচ্ছে হাসপাতাল, এই ল্যাবরটরির জিনিসগুলো হচ্ছে মানুষ,শবব্যবচ্ছেদ কক্ষের মরা-মানুষ নয়, জীবিত মানুষ। তোমার আমার মত মানুষ। সারি বেধে বিছানায় শুয়ে থাকা, বিছানা না পেলে মেঝেয় শুয়ে থাকা মানুষ, ককাতে থাকা, কাতরাতে থাকা,গোঙাতে থাকা চেঁচাতে থাকা, ঝিম মেরে থাকা, হাতে স্যালাইন পায়ে স্যালাইন মুখে অক্সিজেনের নল মাথার কাছটা উঁচু করে রাখা বিছানায় চোখ উল্টো পড়ে থাকা মানুষ। এদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, কি কষ্ট, কবে থেকে কষ্ট, কি রকম সেই কষ্টের চেহারা, ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়, কখন শুরু হয়,কোথায় কখন শেষ হয়, আগে এরকম কোনও কষ্ট উদয় হয়েছে কি না, এই কষ্ট ছাড়া আর কোনও কষ্ট আছে কি না কোথাও, আত্মীয় স্বজনের কারও এই কষ্ট আছে কি না, কখনও ছিল কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ইত্যাদি তথ্য নথিবদ্ধ করার পর আমাকে খালি চোখে দেখতে হবে কষ্টের জায়গাটি দেখতে কেমন, হাত দিতে হবে জায়গাটিতে, হাত দেওয়ারও নিয়ম আছে, সবগুলো আঙুলের মাথা দিয়ে চেপে চেপে এক কোণ থেকে আরেক কোণে যেতে হবে,অনুভব করতে হবে ঠিক কি রকম এই কষ্টের জিনিসটি, একটি গোলআলুর মত নাকি একটি তরমুজের মত এর আকৃতি, আমাকে অনুভব করতে হবে আশে পাশে নড়ছে কি না নাকি জগদ্দল পাথরের মত স্থির হয়ে আছে জিনিসটি, হাতে চাপ দেওয়ার সময় আমার এক চোখ থাকা চাই পেটের দিকে, আরেক চোখ রোগীর চোখে, দেখতে হবে রোগী চোখ কুঁচকোচ্ছে কি না ব্যথায়, কি থেকে এই গোলআলু বা তরমুজের উৎপত্তি হল তা বুঝতে আমাকে পেটের সর্বত্র দেখতে হবে যে জিনিসগুলো আছে পেটে তা ঠিক ঠিক আছে কি না, ডানদিকে চেপে চেপে লিভার, পেটের দু কিনারে কিডনি। এরপর বাঁ হাত পেটের ওপর রেখে পেটের আগাপাস্তলা দেখতে হবে ডান আঙুলে সেই হাতের ওপর টোকা মেরে, কি রকম শব্দ আসছে, এ কি জলের শব্দ, না কি মনে হচ্ছে কোনও কাঠের ওপর বা পাথরের ওপর টোকা দিচ্ছি। এরপর পকেট থেকে স্টেথোসকোপ বের করে কানে শুনতে হবে কি রকম শব্দ আসছে, পেটের নালি থেকে ভুরুৎ ভুরুৎ শব্দ আসা মানে নালির কাজ নালি করে যাচ্ছে, শব্দ না আসা মানে কোথাও বাধা পড়েছে চলাচল, কোথায় বাধা পড়েছে, তাহলে কি এই রোগটির নাম ইনটেসটিনাল অবস্ট্রাকশান! গোলআলুর মত যে পিণ্ডটি সেটি কি নালি পেঁচিয়ে জড়ো হয়ে যাওয়া কিছু তা যদি না হয় নালির ভেতর কি মল জমে পিণ্ড তৈরি করেছে, নাকি কৃমি! কেবল এটুকু করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে ডায়াগনোসিস লিখে দিলে হবে না। রোগীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে হবে। স্নায়ুতন ্ত্র ঠিক ঠিক আছে কি না, রোগীর ভেতরের সমস্ত প্রত্যঙ্গ এবং প্রণালি ঠিক কি না, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস সব ঠিক ঠিক চলছে কি না সব। আঙুলে যনণ্ত্রা নিয়ে কোনও রোগী এলেও মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে হবে। সার্জারি বর্হি িবভাগে সার্জারি ক্লাস করতে প্রথমদিন ঢুকেই দেখি লুঙ্গি খোলা এক লোক বিছানায় শুয়ে আছে। বর্হিবিভাগের ডাক্তার লোকের নিম্নাঙ্গর অসখু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দেবেন। অসখু টির নাম হাইড্রাসিল। পুরুষাঙ্গের নিচের থলেতে জল জমে কুমড়োর মত ফুলে উঠেছে। ডাক্তারের উপদেশ হচ্ছে ফুলে ওঠা জিনিসটিতে তাকিয়ে থাকো। আমার চোখ বার বার সরে আসে কুমড়ো থেকে। সরে আসে বলেই সম্ভবত তিনি আমাকেই ডাকেন জিনিসটি হাতে ধরে পরীক্ষা করতে, ডাক্তারের জিজ্ঞাসা কনসিসটিনসি দেখ। আমি এক পা যাই তো দু পা পেছোই। কিন্তু উপায় নেই গোলাম হোসেন! তোমাকে স্পর্শ করতেই হবে জিনিসটি। দুহাতে ধরে চেপে চুপে আমাকে বলতে হচ্ছে থলেটি নরম নাকি শক্ত বোধ হচ্ছে। এরপর হাত রেখে হাতের পিঠে টোকা দিয়ে ঢুপ্পুস ঢপ্পুুস শব্দ শুনে বলে দিচ্ছি ভেতরে জল আছে। লোকটি, বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে এদিক ওদিক সরিয়ে নিচ্ছিল শরীর। একটি মেয়ে তার গোপনাঙ্গ ঘাটাছে, লোকটির জন্য ঘটনাটি অস্বস্তিকর বটে। কিন্তু লোকটিকে গা পেতে দিতেই হয়। ডাক্তার অথবা হতে-যাওয়া-ডাক্তারদের কাছে লজ্জার কিছু নেই। চর্ম ও যৌনবিভাগের বর্হিবিভাগে রোগীদেরও লজ্জা ভেঙ্গে জীবনের গোপন কাহিনী আর কারও কাছে না বলুক আমাদের কাছে বলতে হয়। যৌনবিভাগের ডাক্তার শিখিয়ে দিচ্ছেন রোগীর পেট থেকে কি করে কথা বের করতে হয়। পুরুষাঙ্গে ঘা নিয়ে রোগি এল, ডাক্তারের প্রশ্ন কি, বাইরের মেয়েমানুষের সাথে মেলামেশা করেন নাকি? রোগী প্রথম বলবে না। কোনওদিন না। মেলামেশা যা করার সে তার বউএর সঙ্গে করে, আর বউ যদি তার না থাকে তবে তো কোনওরকম মেলামেশার প্রশ্ন ওঠে না। এরপর সত্য কথা না বললে যে চিকিৎসা হবে না সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিলে লোক অনেকক্ষণ সময় নেয়, মাথা চুলকোয়, ঠোঁটে একটি না হাসি না কান্না ঝুলিয়ে বড় একটি শ্বাস নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে যে সে মেলামেশা করে অর্থাৎ গণিকাসঙ্গমে অভ্যস্ত সে। ডাক্তার বলেন, লিখে দাও হিস্ট্রি অব এক্সপোজার আছে। রক্তের ভিডিআরএল করতে পাঠিয়ে দাও। লিখে দিলে লোক কাগজ হাতে নিয়ে চলে যায়। পরীক্ষার ফল নিয়ে আসার পর ওষধু লেখা হবে। যৌন বহির্বিভাগে বসে মেলামেশা শব্দটি আমাদের রপ্ত করতে হয়। এসব রোগী আমরা দূর থেকে দেখি, ছুঁতে নেই, নোংরা সংক্রামক জিনিস কখনো ছুঁতে নেই, তাই রোগীর হাওয়াও যেন শরীরে না লাগে এমন দূরে নিরাপদে দাঁড়াতে হয় আমাদের। ডাক্তার রোগীর শরীর স্পর্শ করার প্রয়োজন মনে করলে হাতে গ্লাবস পরে নেন। সিফিলিস গনোরিয়ার রোগীরা দেখতে কৎু সিত, দাঁতাল, চোখে শেয়ালের চাউনি, দেখেই বলে দেওয়া যায় যে লোকের পুরুষাঙ্গের ঘাটি সিফিলিসের ঘা। ঘরে বউ আছে এমন লোক এসে যখন চিকিৎসা নিয়ে যায়, ডাক্তার বলে দেন, বউকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়ে যেতে। তারা কথা দেয়, কিন্তু বেশিরভাগ রোগিই বউ নিয়ে দ্বিতীয়বার আসে না। তারা কথা দেয় কসম কেটে বলে জীবনে আর গণিকাসঙ্গমে যাবে না। কিন্তু এক রোগী আবারও আসে আবার সিফিলিসের ঘা নিয়ে। ঘরের নিরীহ বউদের কথা ভেবে এইসব দাঁতাল গুলোর ওপর আমার রাগ হয়। ডাক্তারকে একবার বলেও ফেলেছিলাম, এদেরকে জেলে পাঠানো যায় না? নিশ্চয়ই বউগুলো চিকিৎসাহীন থেকে থেকে নিউরোসিফিলিস বাধাঁচ্ছে। কে শোনে আমার কথা, ডাক্তারের কাজ ডাক্তারি করা। সিফিলিসের ঘা নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ মেয়ে-রোগিও আসে। রোগ এসেছে স্বামীর কাছ থেকে। মেয়ের তো বটেই, কোলের বাচ্চার রক্ত পরীক্ষা করেও দেখা যায় ভিডিআরএল পজেটিভ। এই রোগীদের চিকিৎসা যখন দিই, সঙ্গে একটি উপদেশও জোর গলায় দিই, বদমাইশ স্বামীর সঙ্গে আপনি আর থাইকেন না। আপনের স্বামী আপনের সর্বনাশ করছে, স্বামীরে আপনি তালাক দেন। এরা আমার উপদেশ কতটা মানে তা আমার জানা হয় না, কিন্তু উপদেশটি না দিয়ে আমি পারি না।

জুরিসপ্রুডেনন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মানুষটি বাবা।তিনি ক্লাস নেন আমাদের। সকালে ক্লাস থাকলে প্রায়ই বাবা আর আমি এক রিক্সা করেই কলেজে যাই। নাম ডাকার সময় আর সবার মত বাবাকে আমিও ইয়েস স্যার বলি। আমার শিক্ষক-পিতা চমৎকার পড়ান। বাবার যে সহকারি অধ্যাপক আছেন, তিনি পড়াতে এলে অবশ্য ছাত্রছাত্রীসংখ্যা ক্লাসে থাকে হাতে গোনা। বাবাকে খুব সহজ সরল হাসিখুশি শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে ছাত্রছাত্রীরা। কেউ কেউ অবশ্য বলে খুব কড়া। পরীক্ষার সময় বলা হয়, বাবা ইন্টারনাল হিসেবে খুব ভাল, নিজের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশ করাবার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু এক্সটারনাল হিসেবে নাকি বাবা রজব আলী থাকেন না, গজব আলী হয়ে ওঠেন। বাবা রজব আলীর চেয়ে শিক্ষক রজব আলীকে আমার ভাল লাগে বেশি। বাবা প্রথম দিনই একটা কথা বললেন ক্লাসে, বললেন, পচা শামুকে পা কাটার মত লজ্জা আর নেই, জানো তো! ফরেনসিক মেডিসিনে ফেল করা মানে, পচা শামুকে পা কাটা। কাটো কাটো ইজ্জত থাকে এমন কিছুতে কাটো। সার্জারিতে ফেল কর, মেডিসিনে ফেল কর, কঠিন সাবজেক্ট, ঠিক আছে, ফেল করা মানায়। কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিনে, মাথায় এক ছটাক ঘিলু থাকলে কেউ ফেল করে না। শিক্ষক রজব আলীর ঘরে গেলে তিনি আমাকে নির্মল একটি হাসি সহ স্বাগত জানান, বেল টিপে বেয়ারা ডেকে চা আনতে বলেন আমার জন্য। কি ক্লাস হল, কোন শিক্ষক কি পড়ালো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। আমারও চিকিৎসাবিদ্যার নানা বিষয়ে অজস্র প্রশ্ন থাকে, করি। এই বয়সেও বাবার বই পড়ার শখ মেটেনি, তিনি এনাটমি থেকে শুরু করেন মেডিসিন সার্জারি সব বইই কাছে রাখেন, সময় পেলেই পড়েন। চিকিৎসাবিদ্যার এমন কোনও বিষয় নেই যে তিনি গড়গড় করে উত্তর দিতে না পারেন। শিক্ষক বাবা পরিশ্রমী, নিষ্ঠ, শিষ্ট, মিষ্ট,বিনত, বিনম্র। শিক্ষক বাবার জন্য আমার গর্ব হয়। পোস্ট মর্টেম দেখার জন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের যেতে হয় সূর্যকান্ত হাসপাতালের লাশকাটা এলাকায়। ওখানে ডোম লাশ কাটে, আর পাশে দাঁড়িয়ে বাবা লাশের শরীরের ভেতর বাহিরের কি কি পরীক্ষা করতে হয়, কি করে খুঁজতে হয় মৃত্যুর কারণ, ছাত্রছাত্রীদের বলে দেন। আমরা নাকে রুমাল চেপে পচে ফুলে ওঠা লাশ দেখি, বাবা আর ডোমের জন্য কোনও রুমাল দরকার হয় না। ডোম দেখলে আমার খলিলুল্লাহর কথা মনে পড়ে। খলিলুল্লাহ এরকমই ডোম ছিল, লাশ কেটে লাশের কলজে খেত সে, খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর মায়েরা ভূতের ভয় দেখানোর বদলে খলিলুল্লাহর ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে শুরু করেছে। ক্লাসের মেয়েরা যখন বলে,রজবআলী স্যার এত ভাল! আমার পুলক লাগে। পুলক লাগে যখন বাবার সঙ্গে কলেজ চত্বরে দেখা হয়, দুজনে মধুর বাক্য বিনিময় করি। অবকাশের হিংস্র বাঘ কলেজে এসে মাটির মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকে, পচা শামুকের বিদ্যা বিতরণ করেন তিনি। বিদ্যা আর কি! খুনোখুনির কারবার, কী ধরণের অস ্ত্র আছে, কোন অস্ত্রে কেমন ধার, কোন দায়ে কেমন কোপ, কোন বুলেটে কেমন ক্ষত, কোনটি আত্মহত্যা, কোনটি খুন, কোনটি দুর্ঘটনা, এসব। একবার পঁচিশ বছরের এক মেয়ের দেহের পোস্ট মর্টেম দেখাচ্ছেন বাবা, খুন কি আত্মহত্যা, তা বের করতে হবে। ঘচঘচ করে দশ পনেরোদিনের মড়ার বুক চিরে ফেলল ডোম, বাবা অমন বমি আসা গন্ধের সামনে মড়ার ওপর ঝুঁকে, সামনে পেছনে ঘুরিয়ে, পরীক্ষা করে বলে দিলেন খুন করা হয়েছে। কী করে খুন? খুব সোজা। মাথায় কোপ, বাবা কোপের চিহ্ন দেখালেন। নিজের মাথার পেছনদিকে দায়ের কোপ দিতে পারে না কেউ, সুতরাং কোনও কারণেই এটি আত্মহত্যা নয়। আরেকটি মেয়েকেও, বলা হয়েছিল, গলায় দড়ি বেঁধে আমগাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে, বাবা হাতে পায়ে পেটে বুকে নখের আঁচড় দেখে বললেন একে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের লিখতে হয় এসবের সুরতহাল রিপোর্ট। ক্রমে পচা শামুকে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাবা ্‌আমার এই উৎসাহে মোটেও ঘি ঢালেন না, বলেন, যেইডা কাজে লাগব সেইটা পড়, সার্জারি মেডিসিন পড়, গায়নোকলজি পড়। আমার মন পড়ে থাকে মেয়েদুটোয়, কে কোপ বসালো ওই পঁচিশ বছর বয়সী মেয়েটির মাথায়, কে-ই বা নিরীহ গ্রামের কিশোরীটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে! দরজায় বিভাগীয় প্রধান লেখা বাবার ঘরটিতে ঢুকে মাঝে মধ্যে দেখি অল্প বয়সী মেয়েরা বসে আছে। বাবা এক এক করে পর্দার আড়ালে নিয়ে ওদের দেখছেন। মেয়েরা চলে গেলে মেয়েরা কেন এসেছিল, কী পরীক্ষা করতে জিজ্ঞেস করলে, বাবা বলেন রেপ কেইস। বাবা আগের চেয়ে অনেক সহজ আমার কাছে। খুব সহজে তিনি শরীর এবং যৌনতা বিষয়ে আমার সঙ্গে ডাক্তারি ভাষায় কথা বলেন, অবশ্য ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে। আমার জানতে ইচ্ছে হয় কে ওই মেয়েদের ধষর্ণ করেছে, এসবের উত্তর তিনি দেন না। কারণ এসব মামলার বিষয়, ডাক্তারির বিষয় নয়।

 

বাবা প্রায়ই মামলার সাক্ষী হতে আদালতে যান। প্রায়ই বাবাকে খুঁজতে অচেনা অচেনা লোক আসে বাড়িতে। এরা কারা? মা বলেন,তর বাবা সাক্ষী দেয় তো। পোস্ট মর্টেমের ব্যাপারে আসে।

আমার উৎসাহ তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। পোস্ট মর্টেমের ব্যাপারে লোকেরা বাবার কাছে আসবে কেন, বাবার সঙ্গে বারান্দার ঘরে বসে নিচু স্বরে কথা কি বলে ওরা, জানতে ইচ্ছে হয়। লক্ষ করি বাড়িতে নানা রকম জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে অচেনা অচেনা লোকেরা। বাবা এক দুপুরে বাড়ি নেই, একটি লুঙ্গি পরা, মোচঅলা লোক এসে বলল, ডাক্তার সাইব আছে?

নাই।

আইচ্ছা, আমার পুকুরের মাছ চাইরটা রাখেন। বলে চারটে বড় রুই মাছ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক অচেনা লোকটি চলে গেল।

আমি খুশিতে বাগ বাগ চারটে রুই মাছ নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘর, মা ধর, এক বেটা মাছ দিয়া গেল।

কে দিল, চিনস?

না।

রাখলি কেন?

বাহ দিল যে।

দিলেই রাখবি?

কেন কি হইছে? মাঝে মাঝে বাবার রোগীরা ত দিয়া যায়।

আর মাছ টাছ রাখবি না। শত সাধলেও না।

মার মখু থমথম করে। মাছগুলো থেকে দুহাত দূরে সরে বলেন,এইসব মাছ খাওয়া অন্যায়।

অন্যায় কেন?

পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পাল্টাইতে তর বাবার কাছে তদবির করতে আসে এইসব লোক।

আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় শতরকম ভাবনা।

কোন দল আসে? যারা অন্যায় করে, না যারা নির্দোষ?

তা জানি না।

মা কি কোনও কথা লুকিয়ে রাখছেন পেটে! মার তো লুকোনোর পেট না মোটে।

যারা নির্দোষ, তারা খুশি হইয়া কিছু দিলে ত ক্ষতি নাই, মা শ্লথবেশে শ্লথ পায়ে কলপারের দিকে যেতে যেতে শ্লেষকণ্ঠে বলেন, দুই দলই আসে।

বাবা কি মিথ্যা রিপোর্ট দেন?

তা আমি কি কইরা জানব? আমি কি কোটের্ যাই দেখতে?

মাছ শেষ পর্যন্ত রাধাঁ হয়েছে। মা ওসব ছুঁয়েও দেখেননি। বাবা খেতে বসে,পাতে মাছের বড় বড় টুকরো নিয়ে বললেন, মাছ কোথেকা পাইলা?

মা বললেন ,এক লোক আইসা দিয়া গেছে।

শুনে কেশে পরিষ্কার গলা আরও পরিষ্কার করে বাবা বলেন, মাছটায় ধইন্যা পাতা না দিলে স্বাদ হইত বেশি।

আমি তখনও ভাবছি, আত্মহত্যার পক্ষের লোকগুলো কি ঘুষ দিয়ে বাবাকে খুন বাদ দিয়ে আত্মহত্যা লিখে দিতে বলে? বাবা কি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘুষ খান। আমার কিছুতে বিশ্বাস হয় না, বাবা এমন অসৎ হতে পারেন।

কিন্তু শরাফ মামা যেদিন মার পরনে ছেঁড়া শাড়ি দেখে বললেন, এত ফকিরনির মত থাকো বড়বু। আর এইদিকে দুলাভাই ত হেভি টাকা কামাইতাছে। দেখলাম এক লোক টাকার বুন্দা দিয়া গেল। পোর্স্ট মর্টেম করে ত! এখন ত টাকার পাহাড় হইয়া গেছে। আর তোমারে একখান শাড়ি কিইন্যা দেয় না!

আমি বললাম, পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট মিথ্যা লেখা যায় না শরাফ মামা, হুদাই বাবারে দোষ দিও না।

শরাফ মামা কাষ্ঠহাসি ছড়িয়ে বললেন, আরে ঘুষ দিয়া ডাক্তারেরা এই চাকরি লয়, পোস্ট মর্টেম করা মানে কোটিপতি হইয়া যাওয়া। ডাক্তারের কলমের ডগায় মাইনষের জীবন মরণ।

টাকাটা দেয় কেডা?

টাকা দেয় দুই দলই। মামলায় ফাঁসছে যে, মামলা করছে যে। দুলাভাই নান্দাইল ত পুরাডাই কিনা ফেলল।

বাবার ওপর আমার ঘণৃা জন্মাতে থাকে। যে লোকটি একশ একটা মনীষীদের বাক্য আওড়ান সারাদিন, আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য হেন কাজ নেই যে না করছেন, আর তিনি বাদি বিবাদি দু পক্ষ থেকে টাকা নিয়ে আদালতে যাচ্ছেন!

দাদকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি জানো কিছু ?

দাদা বলে দিলেন, আজে বাজে কথায় কান দিস না। বাবা ঘুষ খায় না।

জানো কি কইরা ঘুষ খায় না? ওইদিন যে মাছ দিয়া গেল, মাছ ত ঘুষ ছিল।

কোন মাছ?

কোন মাছ জানো না? রুই মাছ। খাইলা ত মজা কইরা।

আহ খুব স্বাদ ছিল মাছটা। আসলে মাছটা ভুনা করলে ভাল হইত আরও।

বাবার ঘুষ খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারটি আমার কাছে রহস্য থেকে যায়। এত কাছের মানুষ, এক বাড়িতে জীবন যাপন, অথচ বাবাকে আমার সবচেয়ে বেশি দূরের মানুষ মনে হয়। আসলে বাবার কিছুই আমার জানা হয় না। জানি বা জেনেছি বলে মাঝে মাঝে ভুল করি। বাবা কখন কাকে কাছে টানবেন, কখন দূরে সরাবেন, আমি কেন, বাড়ির কেউ জানে না, মাও না। মা হয়ত কখনও কুঁচি কেটে শাড়ি পরে পানের রসে ঠোঁট লাল করে মিষ্টি মিষ্টি হেসে বাবার সামনে গেলেন, বাবা ধমকে মাকে সরিয়ে দিলেন। এমন অনেক হয়েছে, যে বাবার কাপড় চোপড় ধুয়ে, আলনায় ভাঁজ করে রাখলেন মা, সারাদিন ধরে ঘর ধুয়ে মুছে, বন্ধ দরজা জানালা খুলে আলো বাতাস ঢুকিয়ে, দেয়ালের কোণ থেকে খাট সরিয়ে জানালার কাছে রাখলেন, ধোয়া চাদর বিছিয়ে দিলেন বিছানায়, দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন বাবার, বাবা আসবেন, দেখবেন, ভাল লাগবে। বাবা বাড়ি ফিরে, ঘরের অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলেন, আমার ঘর নষ্ট করছে কে? টেনে খাটখানা সরিয়ে আগের জায়গায় রাখেন। খটাশ খটাশ করে জানালাগুলো বন্ধ করে দেন। বিছানার চাদর একটানে সরিয়ে দেন।

আমার ঘর আমি যেমনে রাখি, ঠিক তেমন ভাবেই যেন থাকে।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দেখে। মার কিছুই বাবার পছন্দ হয় না।

কখনও হয়ত তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে মা একে গাল দিচ্ছেন, ওকে গাল দিচ্ছেন। বাবা নরম গলায় ডাকলেন, ঈদুন আসো তো, কথা শুইনা যাও। ঈদুনের তখন কারও কথা শুনতে ভাল লাগছে না। বাবা আরও নরম গলায় ডাকেন ঈদুন ঈদুন।

বাবা আচমকা অসময়ে বাড়ি ঢুকে দেখলেন, আমি লেখাপড়া করছি, আর ইয়াসমিন ধুলোয় খেলছে। ইয়াসমিন তটস্থ হয়ে রইল, আমি দিব্যি নিশ্চিন্ত যে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবেন। কিন্তু বাবা আমাকেই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন খালি বইয়ের দিকে গাধার মত চাইয়া থাকলে হইব না, মাথায় যেন ঢুকে যা পড়তাছস। আর ইয়াসমিনকে বলে গেলেন, লিচু খাইবা মা? তোমার জন্য এক্ষুনি লিচু পাঠাইয়া দিতাছি।

রহস্যে ঘেরা বাবা দূরেই থেকে যান, তাঁকে আমার চেনা হয় না, বোঝা হয় না। বাবার বিয়ের ব্যাপারটিও রহস্যময়। মা বলেন, লোকে বলে বাবা বিয়ে করেছেন রাজিয়া বেগমকে। বাবা কিন্তু কখনও রাজিয়া বেগমকে বাড়ি এনে বলেননি, এই আমার বউ। আর কখনও বাড়ি ছাড়া বাবা অন্য কোথাও রাতও কাটাননি, যখন ময়মনসিংহে থাকেন। কী করে বুঝি!

মাকে বলেছিলাম, মা এই যে কও বাবা বিয়া করছে, কই বাবা তো ওই রাজিয়া বেগমের বাড়িতে কখনও থাকে না।

রাইতে এই বাড়িতে থাকে, কারণ তর বাবা না থাকলে এই বাড়িতে চুরি হয়। যতবারই এই বাড়িতে চুরি হইছে, তর বাবা ছিল না বাড়িত। চোর খেদানোর লাইগা তর বাবা রাইতে বাড়িত ফিরে।

তাইলে রাজিয়া বেগমের বাড়িতে চোর খেদায় কে?

মা হেসে বলেন ওই বেটিরে দেখলে চোর নিজেই ডরাইব!

বাবার রহস্য যতই দেখি, ততই ইচ্ছে করে তাঁর ঘরের মতই অন্ধকার তাঁর রহস্যের চাদরখানা সরাই। মার ছোটখাট দুঃখগুলো, সখু গুলো এত চেনা, মার ঠোঁটের হাসি, বিরক্তি, এসবের কারণ এত স্পষ্ট, মা যেন পড়ে ফেলা বই, লিখে ফেলা খাতা। মা আমাকে কৌতূুহলি করে না, করে বাবা। মার ভালবাসা না চাইলেই পাওয়া যায়, বাবার ভালবাসা পেতে সাধনার প্রয়োজন। এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায় না যে পাবই। জীবন নিয়ে অনেকটা জুয়ো খেলার মত। মার অঢেল ভালবাসা চোখে পড়ে না, বাবার দু মুহূর্তের নরম সুরের ডাক সারাদিনের জন্য মন ভাল করে দেয়।

মা বলেন মেয়েদের একটু বাবার দিকে টান বেশিই থাকে।

আমি জিজ্ঞেস করি, তাহলে কি ছেলেদের মায়ের দিকে বেশি?

মার মুখে আজকাল উত্তর নেই এর।

ছোটদা এ বাড়িতে বউ নিয়ে বেড়াতে এলে, বউ নিয়েই ঘরে শুয়ে থাকেন, অথবা বেরিয়ে যান একসঙ্গে। মার বড় শখ, ছোটদাকে পাশে বসিয়ে গল্প করেন, ছোটদার সময় নেই। বিয়ে করার পর দাদারও সময় হয় না।

বাবা যে বিষয়গুলোয় মন দেওয়ার জন্য বলেছেন, সে বিষয়গুলোর ক্লাস হয় রাতেও, হাসপাতালে। আমাকে প্রতি সন্ধেবেলা তিনি দিয়ে আসেন, আবার নিয়েও আসেন। রোগী বসে থাকে চেম্বারে, সেসব ফেলেই তিনি চলে আসেন এই কাজটি করতে। রহস্যে মোড়া বাবার ভালবাসা আমি টের পাই। তিনি আমাকে বলেন, আমি তাঁর স্বপ্ন পুরণ করছি, আমিই তাঁর মান সম্মান রাখছি, আমিই তাকে পিতা হিসেবে গৌরব দিচ্ছি। শুনে মন থেকে ঘুষের কারণে বাবার জন্য জন্মানো ঘৃণার পিণ্ডটি হৃদয় ফসকে পড়ে যায় ধুলোর রাস্তায়। আমার কষ্ট হতে থাকে বাবার জন্য। কষ্ট হতে থাকে কারণ একদিন তাঁকে বলতে হবে যে কাউকে না জানিয়ে আমি এক দাড়িঅলা লোককে বিয়ে করেছি, লোকটি লম্বায় আমার চেয়ে খাটো, লোকটি সাধারণ এমএও পাশ করেনি, কবিতা লেখা লোকটির পেশা, যে পেশায় মাসে দুশ টাকাও লোকটির আয় হয় না। কোন আবর্জনার স্তূপে ছুঁড়ে দেব বাবার মান সম্মান, বাবার গৌরব! আমি যত মনোযোগী হই লেখাপড়ায়, বাবার স্বপ্নের গোড়ায় তা জল সারের মত হয়ে চারা লকলক করে বড় হয়, বৃক্ষ হয়। যত বেশি বৃক্ষ হয়, তত আমার ভয় হয় যে নিজ হাতে এই বৃক্ষটি আমাকে উপড়ে ফেলতে হবে একদিন! দাদা বা ছোটদা কেউ বাবাকে সুখী করতে পারেনি। এক আমিই আছি সুখী করার। কিন্তু সুখের মাথায় পেছন থেকে যেদিন আমাকে কোপ বসাতে হবে! স্বস্তির গলা ফাঁস লাগিয়ে যেদিন ঝুলিয়ে রাখতে হবে! কি করে এই কাজটি আমি করব! নিজের ওপর বড় রাগ হয় আমার। বাবা যত আমাকে ভালবাসেন, তত নিজের ওপর ভালবাসা আমার উবে যেতে থাকে! বাবা আমাকে সারাপথ, মেডিসিনের লিভার সিরোসিস আজ যদি পড়ানো হয়, সেটি নিয়ে এমন চমৎকার বলতে থাকেন যে রিক্সায় বসে বাবার কাছ থেকে শুনে আমার যা শেখা হয়, সে শেখা বইপড়ে বা অধ্যাপকদের বড় বড় লেকচার শুনে হয় না। বাবার দোষগুলো আমি ছুঁড়ে দিতে থাকি গাঢ় অন্ধকারের দিকে যেন কেউ দেখতে না পায়। বাবাকে আমি বাবা বলে ডাকি না, তুমি বা আপনি কোনও সম্বোধনই করি না। তবু বাবাকেই মনে হতে থাকে আমার সবচেয়ে আপন। সম্বোধন না করার এই রোগটি বড় অদ্ভুত আমার। নানা নানি বড় মামা ফজলিখালা রুনখুালা রুনুখালা হাশেমমামা ফখরুল মামা কাউকে আমি কোনও সম্বোধন করি না। সবার সঙ্গেই কথা বলি, বলি ভাববাচ্যে। ভাববাচ্যে কথা বললে অনেক সময় কথা খোলসা করে বলা হয় না, সম্ভব নয়। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ভাববাচ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, পারিনি। বড় হয়ে অনেকদিন ভেবেছি, কেন আমি ওঁদের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলি, কি কারণে! যখন ছোট ছিলাম, ওঁরা কি আমাকে ধমক দিতেন বা চড় কষাতেন, বা আড়ালে নিয়ে গিয়ে কান মলে দিতেন যে অভিমান করে কিছু ডাকিনি, আর না ডাকতে ডাকতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে না ডাকা! বড় হয়ে চাইলেও আর ডাক ফিরিয়ে আনতে পারিনি! মাকে দাদাকে ছোটদাকে সম্বোধন করি, তুমি বলি। বাবাকে চিরকালই দূরের মানুষ বলে মনে হত, বাবাকে সম্বোধন করি নি। কিন্তু নানিবাড়িতে বেড়ে ওঠা মেয়ে আমি, শরাফ মামাকে, ফেলু মামাকে ছটকুকে সম্বোধন করি, তুমি বলি। বাকিরা যাঁরা কাছে ছিলেন, তাদের কেন সম্বোধন করা হয়নি আমার, কাছে থাকলেও ওঁদের খুব দূরের মনে হত কি!

যে বিষয়গুলোকে জরুরি বলে বাবা আমাকে মন দিয়ে পড়তে বলেছেন, সেগুলোর জন্য সামনে আরও বছর পড়ে আছে বলে আমি রুদ্রে মন দিই। রুদ্র একটি নিষিদ্ধ ঘটনা আমার জীবনে, গভীর গোপন নিভৃত আনন্দ। রুদ্রর প্রতি আকর্ষণ এত তীব্র যে রুদ্রর চিঠি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখের রিনরিন সুর বাজে প্রাণে, সেদিন আমি সারাদিন ভাল থাকি। ফিরে চাই স্বণর্গ ্রাম, রুদ্রর দ্বিতীয় বই, মুহম্মদ নুরুল হুদার দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বই। দ্রাবিড় থেকে আরও কয়েকটি বই বের হয়েছে। রুদ্রর সঙ্গে মুহম্মদ নুরুল হুদার সম্পর্কে বেশ ভাল, ভাল বলেই রুদ্র এখন হল ছেড়ে বাসাবোতে নূরুল হুদার বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আগে ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে তার এক বন্ধুর বাড়ি, সেটি ছেড়ে উঠেছিল ফজলুল হক হলে, হল থেকে এখন ঘরে। সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িটি কেন ছেড়েছিল! ছাড়তে হয়েছিল কাজী রোজির কারণে। কাজী রোজি কবি সিকান্দর আবু জাফরের বউ, রুদ্রকে নাকি বিরক্ত করত। রুদ্রর মত প্রতিভাবান তরুণের সঙ্গে ওই মধ্যবয়সী কাজী রোজি আগ্রহী ছিলেন হয়ত, কিন্তু তাই বলে রুদ্রর বাড়ি ছাড়তে হবে কেন? ব্যাপারটি বুঝিনি।

রুদ্রর এই বইটি তার আগের বইটির চেয়ে আকারে ছোট, বইয়ের পঈμচ্ছদে একটি হাত, হাতের তলায় গাছের শেকড়। ভেতরে নিউজপ্রিণ্টে ছাপা কবিতা। দেখতে বইটি দরিদ্র, কিন্তু ভেতরে কবিতাগুলো ঘুমের মানুষকে সজাগ করে দেয়। গ্রন্থসত্তে ্ব আমার নামটি। দেখে পুলক লাগে। গ্রন্থসত্ত ্ব ব্যাপারটির আসলে কোনও মানে নেই, এ দেশে যে কোনও লেখকই গ্রন্থসত্ত্বের জায়গায় প্রিয় একটি নাম বসিয়ে দেয়, এর মানে এই নয় যে প্রকাশক কখনও সেই গ্রন্থসত্তের মানুষকে বই বিক্রির টাকা দিয়ে আসবে। যাই হোক, আমার পুলক লাগে। রুদ্রর কবিতাগুলো উচ্চয়রে বাড়িতে পড়ি, ইচ্ছে হয় মঞ্চে উঠে তার কবিতাগুলো পড়ি, একশ মানুষ শুনুক। একশ মানুষ শিখুক প্রতিবাদের ভাষা। ময়মনসিংহের বিভিন্ন কবিতা অনুষ্ঠানে আমাকে প্রায়ই কবিতা পড়ার জন্য ডাকা হয়, মাঝে মাঝে গিয়ে কবিতা পড়ে আসি। রুদ্রর কখনও শোনা হয়নি আমার কবিতা পড়া, রুদ্রর পড়া আমি শুনেছি, ময়মনসিংহের একুশে ফেব্রুয়ারির এক অনুষ্ঠানে। চমৎকার আবৃত্তি করে রুদ্র। অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে এসে রুদ্র বলে, সবচেয়ে ভাল পড়েছি। আমার ভাল লাগে শুনে। বইটি ছাপা হওয়ার পর সে পুঁথি পড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকেরা যেভাবে সুর করে পুঁথি পড়ে, সেভাবে পড়ার জন্য সে লিখেছেও রাস্তার কবিতা। রুদ্র দরিদ্র বঞ্চিত নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষদের নিয়ে কবিতা লেখে, শাসকের বিরুদ্ধে শোষনের বিরুদ্ধে কবিতা। শ্রমজীবি মানুষের জন্য কবিতা। আমাকে উদ্বুদ্ধ করে রুদ্রর বোধ।

মনে করো তুমি যাচ্ছে!, তুমি একা ..
তোমার হাতে আঙুলের মত শিকড়, যেন তা আঙুল
তোমার হাড়ে সঙ্গীতের মত ধ্বনি, যেন তা মজ্জা,
তোমার ত্বকে অনার্যের শোভা মসণৃ আর তামাটে
তুমি যাচ্ছে!, মনে করো তুমি দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে!।
তোমার পিতার হত্যাকারী একজন আর্য
তোমার ভাইকে হত্যা করেছে একজন মোঘল
একজন ইংরেজ তোমার সর্বস্ব লুট করেছেড্ড
তুমি যাচ্ছে!, তুমি একা, তুমি দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে!।
তোমার দক্ষিণে শবযাত্রা, তোমার উত্তরে মৃত্যুচিহ্ন,
তোমার পেছনে পরাজয় আর গ্লানি—তোমার সামনে?
তুমি যাচ্ছে!, না না তুমি একা নও, তুমি আর ইতিহাসড্ড
মনে করো তাম্রলিপ্তি থেকে নৌবহর ছাড়ছে তোমার,
মনে করো ঘরে ঘরে তাঁতকল, আর তার নির্মাণের শব্দ
শুনতে শুনতে তুমি যাচ্ছে! ভাটির এলাকা মহুয়ার দেশে,
মনে করো পালাগানের আসর, মনে করো সেই শ্যামল রমণী
তোমার বুকের কাছে নতচোখ, থরো থরো রক্তিম অধর—
তুমি যাচ্ছে!, দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে! তুমি……।

বইটি আগাগোড়া পড়ি, একবার দুবার নয়, বার বার। ইয়াসমিনের গানের গলা যেমন ভাল, আবৃত্তিও করতে পারে ভাল। হাড়েরও ঘরখানি কবিতাটি আমার সঙ্গে ইয়াসমিনও আবৃত্তি করে।

বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
জাতির তরুণ রক্তে পুষেছে নিবীর্যের সাপ,
উদোম জীবন উল্টো রয়েছে মাঠে কাছিমের মত।
কোনো কথা নেই—কেউ বলে না, কোনো কথা নেই—কেউ চলে না,
কোনো কথা নেই—কেউ টলে না, কোনো কথা নেই—কেউ জ্বলে না—
কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।
যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা,
ভালোবাসাহীন, বুক ঘৃণাহীন, ভয়াবহ ঋণ
ঘাড়ে চাপানো—শুধু হাপাঁনো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়—
জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জ্বলে না।
লোহু ঝরাবে, সব হারাবে—জাল ছিঁড়বে না য়ড়যন্ত্রের?
বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে—জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার
দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাতে ঝলসায়
রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে,তখতের
নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়-যদি জান যায়
যাক ক্ষতি নেই, ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার,
দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।

সমতার দিনের জন্যও আমার ভেতরেও স্বপ্ন জন্মে। রুদ্র শেখ মুজিবর রহমান কর্ণেল তাহের আর সিরাজ শিকদারকে উৎসগর্ করেছিল ওর প্রথম বইটি, হাড়েরও ঘরখানি কবিতায় লিখেছে হাজার সিরাজ মরে, হাজার মুজিব মরে, হাজার তাহের মরে, বেঁচে থাকে চাটুকার, পা চাটা কুকুর, বেঁচে থাকে ঘুণপোকা, বেঁচে থাকে সাপ। যদিও মুজিব তাহের আর সিরাজ শিকদার এক দলের লোক নন, মুজিবের সঙ্গে সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদারের বিরোধ ছিল, তিনি খুনও হয়েছেন, বলা হয় মুজিবের ষড়যনে,্ত্র কিন্তু একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে, রুদ্র যে কোনও মৃত্যুর বিরুদ্ধে, ঝড়ে বন্যায় ক্ষধুায় মন্বন্তরে পুষ্টিহীনতা জুলুমে জখমে দিতে তো হচ্ছেই প্রাণ, আর কত! এবার জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক, জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সততা আসুক।

অনেকদিন সেঁজুতি ছাপিনি। পড়া আর পরীক্ষার চাপে সম্ভব হয়নি। আবার উদ্যোগ নিই ছাপার। আবার রক্তে বান ডাকে। রুদ্র মানুষের মানচিত্র নামে সিরিজ কবিতা লিখে যাচ্ছে। ও থেকে কিছু নিয়ে আর নিজের কবিতা কিছু, কেবল দুজনের কবিতা দিয়ে সেঁজুতি। আগের সেঁজুতি, সেঁজুতির কাগজপত্র, লিটলম্যাগাজিনগুলো কোথায় কোন তলে পড়ে আছে, খবর নেই। টুকরো খবরের কিচ্ছু এবার আর থাকবে না, কারণ অনেক দূরে চলে এসেছি সেই জগত থেকে। কোথায় কে কোন লিটল ম্যাগ ছাপছে, কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার কি লেখা বেরোলো, কোথায় কবিতা অনুষ্ঠানে কি আলোচনা হল, এসব এখন আমার আর জানা নেই। লিটল ম্যাগ আন্দোলন থেকে চিকিৎসাবিদ্যা আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। বাংলা ১৩৮৮র হেমন্তে দীর্ঘ দুবছর পর সেঁজুতি। বই আকারে নয়, আগের সেই জমাখরচের লম্বা খাতার আকারে, এর কারণ, হাতে অত টাকা নেই। এবার আর দাদা কোনও টাকা খরচ করছেন না। প্রশ্নই ওঠে না। লুকিয়ে আমাকে লেখা রুদ্রর প্রেমের চিঠি পড়ে রুদ্র এই নামটি তিনি আর সহ্য করতে পারেন না। পারেন না যে তার একটি প্রমাণও দেখিয়েছেন, আমার ঘরে ঢুকে আমার লাল ডায়রিটি, যেটি তিনি দিয়েছিলেন আমাকে কবিতা লিখতে, সেটি এবং আরও কবিতার খাতাপত্র ছুঁড়ে একদিন ফেলে দিলেন বৃষ্টি পড়ে কাদা হয়ে থাকা উঠোনে। প্রতিবাদ করতে গেলে এমন জোরে চড় কষিয়েছেন গালে যে গাল লাল হয়ে ছিল দুদিন। সুতরাং গাঁটের পয়সা খরচ কর। গাঁটে পয়সা এসেছে মেডিকেল কলেজ থেকে বৃত্তির টাকা পেয়ে। ইন্টারমিডিয়েটে ভাল ফলের কারণে এই বৃত্তি। কলেজে কোনও বেতন দেওয়ার দরকার হয় না, তার ওপর টাকাও জোটে। এই বৃত্তির টাকা কখন পাচ্ছি, টাকা দিয়েই বা কি করব, সে কথা বাবাকে জানাই না। মেট্রিকের ভাল ফলের কারণে ইন্টারমিডিয়েটে যে বুত্তি জুটেছিল, তাও বাবার হাতে লক্ষ্মী মেয়ের মত দিতে হয়েছে। এবার আর নয়। ঘটে বুদ্ধি এসেছে বলেই এখন বাড়ির সবার সামনে বৃত্তির টাকা পাওয়ার খবরটি ফলাও করে বলি, কেবল বাবার সামনে নয়। টাকা হাতে পেয়ে সেঁজুতি প্রেসে দিই। সি কে ঘোষ রোডের ছোটদার এক বন্ধুর প্রেস লিফা প্রিন্টাসের্ দিই। খালেককে বলে কয়ে পিপুলস টেইলার্সের একটি বিজ্ঞাপন আদায় করি। বিজ্ঞাপনের টাকা পেতে পিপুলসে যেতে রিক্সাভাড়া খরচ হতে থাকে, খালেকের দেখা পাওয়া যায় না। সেঁজুতিকে ভুলে থাকার স্পর্ধা করেছিলাম, আসলে তা ছিল নিজের ইচ্ছের সঙ্গে প্রতারণা করা। আর্থিক দৈন্যতায় কুষ্ঠরোগির মত কুঁকড়ে না থেকে প্রচণ্ড দাপটে প্রতিষ্ঠা করছি অনন্ত সুন্দর। বিক্ষোভের ভাষা না শিখে, দুমুঠোয় প্রতিবাদের শ্লোগান না তুলে যে কবি ভীরু কচ্ছপের মত নিজেকে আমূল গুটিয়ে নিয়ে সস্তা আবেগের মদ গিলে কবিতায় মাতলামি করে, আমি সেই স্বার্থলোভি সুবিধাভোগীকে আস্তাকুঁড় দেখিয়ে দেব, সেঁজুতি নয়। যে কবিতায় সাহসী উচ্চারণে লেখা শ্রমজীবী মানুষের জীবন যাপন, আমার নিদ্রার স্নায়ুতে লক্ষাধিক ঘণু ঢেলে প্রচণ্ড ক্ষধুায় গ্যাস্ট্রিক আলসার নিয়েও সংশোধন করব সেই কবিতার প্রুফ। দম্ভ আছে, তা ঠিক। আমার কবিতা, নিজেই লক্ষ করি বদলে গেছে অনেক, রুদ্রর অনুকরণ নয়, রুদ্রর কবিতার প্রখর প্রভাব। পরানের গপ্প নামে নিজের কয়েকটি কবিতা আছে এ সংখ্যায়, কবিতাগুলোয় শ্রমজীবি মানুষের ক্রন্দন, দরিদ্রের হাহাকার আর ধনী শোষকের বিরুদ্ধে তীব্র ঘণৃা থিকথিক করছে। রুদ্রর কটি মানুষের মানচিত্র আছে, আছে তার চৌকিদার।

বনের হরিণ নয়, বাঘ নয়, এত রাতে চৌকিদার চলে।
হোই কে যায়, কে যায়? গঞ্জের বাতাস ফেরে হিম নিরুত্তর,
কে যায়? কে যাবে আর!দশমির অন্ধকার একা একা যায়—
একা একা চৌকিদার আধাঁরের বাঁকে বাঁকে নিজেকে তাড়ায়।
নিজেকেই প্রশ্ন করে কে যায়? কী নাম তোর? কোথায় থাকিস?
কী তুই পাহারা দিবি, জীবনের কতটুকু আগলাবি তুই!
ছিঁচকে সিঁদেল চোর, আর যেই চোর থাকে দিনের আলোয়?
আর যেই চোর থাকে দেহের ভেতর, শরীরের অন্ধকারে?
রাতের আধাঁরে খুঁজে তারে তুই পাবি, চৌকিদার পাবি তারে?
যে চোর পাহারা দেয়, পাহারার নামে করে ভয়ানক চুরি,
চুরি করে মানুষের ঘিল.ু মাংশ.রক্ত.হাড়.বুকের বাসনা,
তারে পাবি, যে তোর জীবন থেকে চুরি করে পূর্ণিমার রাত?
যে তোর জীবন থেকে চুরি করে রৌদ্রময় দিনের খোয়াব,
যে তোর শিশুর স্বাস্থ্য ,দধু ভাত, চুরি করে বোনের সিঁদুর,
তারে পাবি, যে তোর গতর থেকে খুলে নেয় মানব-শরীর?
কিসের পাহারা তবে,কেন তবে রাতভর রাতকে তাড়ানো?
অন্ধকার পৃথিবীতে শুধু কিছু তারা জ্বলে দূরের নক্ষত্র
ঝিঁঝি ডাকে, পাটের পচানি থেকে গন্ধ আনে রাতের বাতাস।
নোতুন কবর খুঁড়ে শেয়ালেরা বের করে আধপচা লাশ
হোই কে যায়, কে যায়…পৃথিবীর অন্ধকারে চৌকিদার চলে।

জীবন এভাবেই যাচ্ছিল, কিছুটা রুদ্রে কিছুটা হাসপাতালে,বইপত্রে, রোগিতে কিছুটা অবকাশের কোলাহলে আর বিষণ্নতায়। এমন সময় একটি খবর আমাকে চমকে দেয়, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছেন চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর কমান্ডার অফিসার মেজর জেনারেল মঞ্জুর। সম্পূর্ণই একটি ব্যথর্ উদ্যোগ। মঞ্জুরের পক্ষে জিয়াকে হত্যা ছাড়া আর কিছু করা অর্জন হয় না। ঢাকা না হয়ে চট্টগ্রাম বলেই হয় না। জিয়া নিজে খাল কেটে কুমির এনেছিলেন প্রচুর, মঞ্জুর নিতান্তই একটি বাচ্চা কুমির। কামড় দিয়েছেন ঠিকই, তবে কিছু দুধের দাঁত ছিল বলে কামড় তেমন লাগেনি। তা না হলে মঞ্জুরই সে রাতে কিছু একটা হয়ে যেতে পারতেন, সামরিক আইন জারি করে দেশের হর্তাকর্তা। কিবস্তু তা না হয়ে ঘটনা ঘটল অন্যরকম, উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতির ভার গ্রহণ করতে হয়। গ্রহণ করা আর দেশ চালানো এক নয়, বুড়োকে সামনে বসিয়ে পেছনে বন্দুকঅলা জোয়ানেরা চালাচ্ছেন দেশ। দেশ কি আর চলছে!দেশ ভাসছে রক্তে। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা স্বাধীনতার গায়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, স্বাধীনতার শরীরে কেবল মৃত্যুর গন্ধ। বাবাকে যদি জিয়াউর রহমানের সুরতহাল রিপোর্ট দিতে হত, তিনি বুলেট কটি গায়ে, হিশেব নিতেন। কি ধরনের বন্দুকের কি ধরনের গুলিতে কতটা দূর থেকে কতবার গুলি ছোঁড়া হয়েছে বলতে পারতেন। বাবা নিজের মন্তব্যে লিখতেন, ইহা সুইসাইড নহে, ইহা হোমিসাইড। যদি এই দেশটির সুরতহাল রিপোর্ট লিখতে বলা হয়, তবেও তো এরকম হোমিসাইড জাতীয় কিছু লেখা যায়। লেখা যায় আততায়ীরা দেশটির বক্ষ লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ছে, ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে দেশটির পাঁজর। পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গেছে, মাংস ছিদ্র হয়ে গুলি ঢুকে গেছে ভেতরে, হৃদপিণ্ড থেমে আছে। থেমে আছে অনেক অনেকদিন।

এর পর খুব বেশিদিন সময় নেয়নি নেপথ্যের সেনাঅধিনায়কের চেহারামোবারক প্রদর্শন করতে। আরেকটি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ক্যু। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়ে গেল। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদের যাত্রা শুরু হল। এক সেনা আরেক সেনার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গী সাথীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়ে গেল। জিয়া যেমন জাতীয়তাবাদি দল তৈরি করে হ্যাঁ না ভোটের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধ করেছিলেন, এরশাদও তেমন। এরশাদও একইরকম নিজের একটি দল গঠন করে রাজনীতিতে নেমে বৈধ করে নিলেন নিজের অবৈধ আগমন। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! সমাজতন ্ত্র না থাক,তাই বলে কি যৎসামান্য গণতনও্ত্র দেশটির ভাগ্যে নেই! দেশের জন্য মায়া হয় আমার, দুশ্চিন্তা বাড়ে। যেসব রাজনৈতিক নেতা এক দল থেকে আরেক দলে নাম লেখায়, তারা, ক্ষমতায় যেই আসে, তার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। চরিত্রহীন ছাড়া এদের অন্য কিছু মনে হয় না আমার। একটি বিশ্বাস আমার ভেতর দিন দিন ঘনীভূত হয়, রাজনৈতিক নেতাদের এমন দুর্বল চরিত্রের কারণে সামরিক বাহিনীর স্পর্ধা হয় বন্দুকের নলের মুখে দেশের দখল নিতে।

রাজনীতি ভাবনা, কাব্য ভাবনা সব ভাবনা দূর করে আমাকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হয়। এ পরীক্ষায়, যেহেতু আমি পরীক্ষা দেব, বাবা পরীক্ষক হতে পারবেন না। পরীক্ষক হিসেবে তিনি অন্য কলেজে চলে গেলেন, এ কলেজে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে আসা নতুন অধ্যাপক আবদুল্লাহ, যাঁর ক্লাসে ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই প্রক্সি মেরে কেটে পড়ে, সহকারি অধ্যাপককে নিয়ে ইন্টারনাল পরীক্ষক হিসেবে রইলেন। আমার ক্লাসের বন্ধুরা হায় হায় করছে খবর শুনে, আমাকে দেখেই বলছে, ধৎু , তোমার কারণে রজব আলী স্যাররে আমরা পাচ্ছি না। রজব আলী স্যার ইন্টারনাল হিসেবে ভাল, নিজের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশ করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, এ কথা কলেজের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু নিয়ম তো পাল্টানো যাবে না, পুত্র-কন্যা পরীক্ষাথীর্ হলে পিতা বা মাতা পরীক্ষক হতে পারেন না। অসন্তুষ্ট ছাত্রছাত্রীরা কড়া এক্সটারনাল আর মেন্দামারা ইন্টারনাল এর সামনে মৌখিক দিল ভয়ে কেঁপে কেঁপে। কারওরই তখন মনে হয়নি বিষয়টি নিতান্তই গৌণ, পচা শামুক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *