০৯. চিকিৎসাবিদ্যা

চিকিৎসাবিদ্যা

মেডিকেল ভর্তি হওয়ার জন্য এ বছর কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফল দেখে ভতির্, বারোশ নম্বরের ওপর যাদের আছে, তাদেরই নেওয়া হয়েছে। দু পরীক্ষায় বারোশর কিছু বেশি ছিল আমার, ময়মনসিংহ যদিও আমার প্রথম পছন্দ, নম্বর যেহেতু তেরোশ-চৌদ্দশ নয়, পছন্দ বাতিল করে আমাকে পাঠানো হয়েছে সিলেট মেডিকেলে। মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠেন বাবা, নানা রকম দরখাসে ্ত আমার সই নেন। দাদাকে বললেন তৈরি হতে। দাদা আমাকে নিয়ে শেষরাতের ট্রেনে চড়লেন। আখাউড়া ইস্টিশনে সকালে ট্রেন থামল, এখান থেকে ট্রেন বদলে সিলেটের ট্রেনে উঠতে হবে আমাদের। ইস্টিশনে পানিঅলা, বিড়িঅলা, বাদামঅলা, ঝালমুড়িঅলা কলাঅলা পানঅলা বিস্কুটঅলার ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই, দাদা আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দেন মেয়েদের অপেক্ষা করার একখানা ঘর আছে, সেখানে। কিছু বোরখাঅলা, কিছু বোরখাহীন, কিছু ট্যাঁ ট্যাঁ, কিছু আ আ, কিছু গু, কিছু মুত, কিছু বমি, সবকিছুর মধ্যিখানে ভদ্রলোকের মেয়ে ইস্ত্রি করা জামা পাজামা, বসে থাকি। আখাউড়া ইস্টিশন থেকে ট্রেন ছাড়ছে সিলেটের, নাগারে লোক উঠছে, লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট, খালি পা, জুতো পা, টুপিমাথা, টুপিছাড়া—সুটকেস, ট্রাংক, বস্তা, ঠেলাঠেলি ভিড়। মেয়েমানুষ বলে আমাকে বসার একখানা জায়গা দেওয়া হয়েছে, মেয়ের ভাই বলে দাদাও ঠেলেঠুলে বসার একটি জায়গা করে নিলেন আমার পাশে, পরপুরুষের গায়ে যেন আমার গা না লাগে। সেকেন্ড ক্লাসে ওঠা থার্ড ক্লাস লোকগুলো সিট দখলে যায় না, মেঝেতেই পাছা পেতে বসে থাকে, কারও সামনে বস্তা, কারও সামনে খোলা দরজা গলে আসা লু হাওয়া। কোণে জড়সড় জবুথবু কটি মেয়েমানুষ, নাকে নথ, মুখে খিল। বুক পকেটে টিকিট রেখে ,সেকেন্ড ক্লাস পুরুষেরা খলবল করে কথা বলে যাচ্ছে, কান পেতে থেকেও বুঝতে পারি না একটি শব্দও।

ও দাদা কি ভাষায় কথা কয় এরা?

সিলেটি ভাষা সিলেটি ছাড়া আর কারও বাপের সাধ্য নাই যে বোঝে বলে নিরুদ্বেগে দরদাম করে এক ঠোঙা বাদাম কিনে, সঙ্গে এক চিমটি ঝালমশলা, দাদা বেশ মন দিয়ে খেতে লাগলেন। ভিড়ে গরমে চেঁচামেচিতেও আমার আনন্দ হতে থাকে নতুন একটি শহরে যাচ্ছি বলে। দাদা আমাকে জানলা থেকে দূরের একটি মাঠ দেখিয়ে বললেন ওই যে মাঠটা দেখতাছস, ওই মাঠটার ওইপারেই হইল ভারত। ইচ্ছে হয় দৌড়ে মাঠটি পেরিয়ে যাই, দেখে আসি ভারত দেখতে কেমন, ভারতের আকাশ দেখতে কেমন। ট্রেন যায় পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার জলে ভিজতে ভিজতে, চা বাগানের কিনার ধরে, অন্ধকার অন্ধকার অরণ্য ডিঙিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিই জানলার বাইরে, আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ঝুলে পড়া ডালে, পাতায়।

 

নতুন একটি শহরে পা দিয়ে খুশির ফোয়ারা ওঠে মনে। এটি ময়মনসিংহ নয়, অন্য একটি শহর, এই শহরের অন্য একটি নাম, নিজেকে বোঝাতে বারবার পড়ি দোকানের সাইনবোডর্। স্টেশন রোড, সিলেট। পুরান বাজার, সিলেট। দরগা রোড, সিলেট। এ শহরে দাদা আগে এসেছেন বলে জানেন কি করে কি করতে হয়, এখানকার রিক্সাঅলাদের ডাকতে হয় ড্রাইভার, রিক্সাঅলা বলে ডাকলে বিষম রাগ করে। একটি চৌকোনা রিক্সায় চড়ে আমরা শহরে ঢুকে পড়ি, ছোট একটি রেস্তোরাঁয় অসম্ভব ঝাল খাবার খেয়ে একটি হোটেলে শুতে যাই। জীবনে প্রথম কোনও হোটেলে রাত কাটানো আমার। দাদা বেঘোরে ঘুমোন। পাশের ঘর বা বারান্দা থেকে আসা খরখরে কথা আর হাসির শব্দে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। এক্ষুনি বুঝি লোকগুলো দরজা ভেঙে এ ঘরে ঢুকবে, এক্ষুণি বুঝি আমাকে কেটে টুকরো করবে, ছিঁড়ে খাবে, আমার সর্বনাশ করবে। দাদাকে আমি কাপাঁ গলায় নিচু স্বরে, উঁচু স্বরে, কান্না স্বরে ডেকে যাই। দাদার ঘুম ভাঙে না। এক লাফে দাদার বিছানায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগাই, ঘুমচোখে কি হইছে বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ধড়ফড় বুক নিয়ে দাদার বিছানার এক কিনারে গুটি মেরে শুয়ে থাকি, সারারাত ঘুমোতে পারি না। ভোরের আলো ঘরে এলে, ঘরের বাইরের খরখরে গলা থেমে এলে আমার ধড়ফড় থামে।

তুই রাইতে ডরাইছিলি নাকি?

হ।

আরে ধুর! এত ডরাস কেন!

সকালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে, বদলির চিঠি জমা দিয়ে আমরা ট্রেন ধরলাম, ট্রেন সারারাত ধরে অন্ধকার অরণ্য পেরোলো, আর আমার গা ছমছম করল সারারাত।

 

সিলেট থেকে ফিরে আসার পর শাদা টেট্রনের কাপড় কিনে দুটো এপ্রোন বানিয়ে দিলেন বাবা, এপ্রোন পরে কলেজে যেতে হবে। নিজের শহরের কলেজে, বাপের কলেজ, বাড়ি থেকে দুদিনের পথ পাড়ি দিয়ে নয়, গাঙ্গিনার পাড় পেরিয়ে রেললাইন পেরিয়ে পুরোনো আবাসিক ইশকুল পেরিয়ে চড়পাড়ার মোড় ছাড়িয়ে যে কলেজ, সে কলেজে। জোয়ান রিক্সাঅলা হলে পনেরো মিনিট, বুড়ো হলে পঁচিশ। সিলেটের পাট চুকিয়ে ময়মনসিংহে। আদেশ মত এপ্রোন পরে কলেজে যাই, এপ্রোনের তলে জামা পাজামা, ওড়না পরার ঝামেলা নেই, এপ্রোনের তলে ওড়না আছে কি নেই তার খোঁজ কেউ নেয় না। এই ঘটনাটি আমাকে আনন্দ দেয় বেশ। ওড়নার বাধ্যবাধকতা নেই। যে কেউ, ছেলে বা মেয়ে, যে পোশাকই পরুক না কেন, ওপরে চাপাতে হবে শাদা এপ্রোন। এপ্রোনে কোটের কলারের মত কলার আছে, পকেট আছে, কোমরে বেল্ট আছে—পরে পুলক লাগে আমার। কলেজে সব অচেনা মখু । বেশির ভাগের বাড়ি ঢাকায়, থাকে হোস্টেলে, আমি আর হাতে গোনা দএু কজন কেবল শহরের। মেয়েদের ইশকুল কলেজে পড়ে আসা মেয়ে আমি, ছেলেছোকরা দেখে অভ্যস্ত নই, আর এখানে ক্লাসে, করিডোরে, মাঠে, সিঁড়িতে বাঁকা চোখের, হাসি চোখের, তেরচা চোখের, হাঁ হয়ে থাকা চোখের সামনে নিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়, ভয় ভয় লাগে। জড়তা আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। যে কক্ষটিতে আমাদের, নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের, প্রথম নিয়ে যাওয়া হল, সে কক্ষের দরজার মাথায় শাদা কালিতে লেখা শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ। কক্ষটিতে ঢুকতেই বিশ্রি একটি গন্ধে আমার চোখ নাক কুঁচকে থাকে,নাড়ি পাক খেতে থাকে, মুখে থুতু জমতে থাকে, বমি ঠেকাতে শ্বাস বন্ধ করে রাখি, কিন্তু শ্বাসেরও তো বন্ধ হয়ে থাকার একটা সীমা আছে, সীমা ছাড়ালেই গন্ধটি ছোবল দেয় নাকে, আর নাক থেকে পেটে পিঠে পায়ে, এমনকি পায়ের আঙুলেও ছড়িয়ে পড়ে। মরা মানুষগুলো টেবিলে শোয়া, টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শাদা এপ্রোন পরা ছেলেমেয়ে, কেবল দাঁড়িয়ে নয়, রীতিমত ঝুঁকে, যেন মরা মানুষের গায়ে দোলনচাপাঁর ঘ্রাণ, শুঁকছে। মানুষগুলো একসময় হাসত, কাঁদত, কাউকে ভালবাসত, আঙুলে সুঁই ফুটলে চিৎকার করত, আর এখন এই যে কাটা হচ্ছে, ছেঁড়া হচ্ছে, বুকের মাংস সরিয়ে ভেতরের হৃদপিণ্ড তুলে আনা হচ্ছে, এতটুকু টের পাচ্ছে না। শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল মৃত্যু নামতে থাকে, ছড়িয়ে যেতে থাকে আমার সমস্ত শরীরে। একদিন সবাই আমরা এক এক করে মরে যাব, মরে এরকম অনুভূতিহীন এক একটি ববস্তু হয়ে উঠব। দল ফেলে রেখে দু্রত বেরিয়ে আসি কক্ষটি থেকে, সঙ্গে মৃত্যু আসে গায়ে গায়ে লেগে। করিডোরে হাঁটি, মৃত্যুও হাঁটে। বাইরে ইউকেলিপটাস গাছের তলায় বসি, মৃত্যুও বসে।

পুরো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের চারভাগ করে দেওয়া হল দ্বিতীয় দিন। মাথা, বুক, হাতপা, তলপেট। আমার ভাগে তলপেট পড়ল, অথবা তলপেটের ভাগে আমি। ব্যস, এখন মরা মানুষ কেটে কেটে তলপেট শেখো, তলপেটে যা যা আছে, ট্রেতে নিয়ে, সঙ্গীসহ একটি নিরিবিলি কোণ বেছে নাও,কানিংহামের বই আছে, একজন পড়বে,আরেকজন শুনবে, একজন বুঝবে, আরেকজন প্রশ্ন করবে, একজন সায় দেবে, আরেকজন আপত্তি তুলবে। সদলবলে পড়া আর যাকে দিয়ে হোক আমাকে দিয়ে হবে না। হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা স্থায়ী সঙ্গী বেছে নিয়েছে পড়ার জন্য, আমার স্থায়ী অস্থায়ী কিছুই নেই, আমি একা। বাড়ি থেকে রিক্সা করে একা আসি, ক্লাস শেষে একা বাড়ি চলে যাই, একা পড়ি। বাবা ঢাউস ঢাউস কিছু বই কিনে দিয়েছেন, বড় বড় রঙিন ছবি আছে ওতে, পাতা উল্টো যখন বইয়ের ছবি দেখি, ইয়াসমিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। পড়তে গেলে ষাট ভাগই মাথায় ঢোকে না, পনেরো ভাগ ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়, আর পঁচিশ ভাগ মাথা তো মাথা, আমার ত্রিসীমানায় ঘেষে না। গ্রে -র এনাটমি বইটি দেখে সবচেয়ে খুশি হন মা। মা এসব বইয়ের নাম আগেই জানেন, বাবা যখন ডাক্তারি পড়তেন, তিনি গুছিয়ে রাখতেন, চাইলে এগিয়ে দিতেন। বাবার আমলে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এত বিশাল ছিল না বই, আমার আমলে এসে সব আজদাহা পাথর আর গাছের গুঁড়ির আকার ধারণ করেছে। যখন বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকি, পড়ি কি না পড়ি, মা লেবুর শরবত, নয়ত মুড়িভাজা, নয়ত আদা চা রেখে যান টেবিলে, নিঃশব্দে। বাড়িতে আদর উপচে পড়ছে আমার জন্য, কলেজে যাবার আগে মা চুল আঁচড়ে দেন, ইস্ত্রি করে দেন জামা কাপড় এপ্রোন, সেন্ডেল এগিয়ে দেন পায়ের কাছে। আর কলেজে ঢুকেই আমার দশা রীতিমত করুণ হয়ে ওঠে – না বলতে পারি পড়া, না কাটতে পারি মড়া। ঢাকার মেয়েরা হোস্টেলে থেকে থেকে নিজেদের মধ্যে বন্ধু পেতে নিয়েছে, দল বেঁধে হাটেঁ, দল বেঁধে হাসে, দল বেঁধে উত্তর দেয় মাস্টারের রাশি রাশি প্রশ্নের। এমন দুর্দশায় সুজিত কুমার অপু নামের এক চশমা পরা, গাল বসা, তেলে চপচপ চুলের ছেলে আমাকে উদ্ধার করল, বলল চল একলগে পড়ি, তুমার বাসার লগে দিয়াই ত আমার বাসা। কি কও, বিকালে যামুনে! অপুর সঙ্গে পড়া শুরু হল আমার, তলপেট। প্রথম দিনই পড়তে হল যৌনাঙ্গ, কানিংহামের বইয়ে হাঁ হয়ে থাকা এক বেশরম যৌনাঙ্গ সামনে নিয়ে আমাকে বসতে হয়, অপু বিস্তারিত বর্ণনা করে যৌনাঙ্গের কোন মাংসের কোন তল দিয়ে কোন স্নায়ু কতদূর যায়, রক্তের নালিগুলো কোন পথে ভ্রমণ শেষে কোথায় পৌঁছয়। মা আমাদের জন্য চা বিস্কুট নিয়ে আসেন। বাবা রাতে ফিরে আরাম কেদারায় গা ফেলে আমাকে ডাকেন কি পড়তাছ দেখি, বইডা আন তো! বাবার সামনে কানিংহামের যৌনাঙ্গ মেলে ধরি, এই পড়ছি, এই পড়ানো হচ্ছে ক্লাসে। বাবা অপ্রতিভ হয়েও হন না, ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে দুচার কথায় যৌনাঙ্গ জ্ঞান দিয়েই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। কলেজ থেকে ফিরে প্রায় বিকেলে অপু পড়তে চলে আসে, যৌনাঙ্গের পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণণায় যেই না মাতে অপু তাকে থামিয়ে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে উঁকি দিই, আচ্ছা কলেজ থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করলে কেমন হয়! অপুর কাকা প্রণব সাহা শহরের নামকরা ছড়াকার, অপু নিজেও ছড়া লেখে, প্রস্তাব শুনে সে লাফিয়ে ওঠে। ব্যস, দলীয় পড়াশুনায় ইতি টেনে আমি নেমে পড়ি সাহিত্যচর্চায়। কলেজে টাঙানো দেখেছি কবিতা গল্প ছড়া লেখা দেয়াল পত্রিকা, আপাতত একটি দেয়াল পত্রিকাই না হয় করি! পরীক্ষা আসার আগে যেমন মন দিই পড়াশোনায়, তেমন মন দিয়ে করি কৃশানু। কিন্তু কে টাঙাবে কলেজে এটি! অপুর নিজের একটি ছড়া নিয়েছি বলে এমনই কৃতার্থ যে সে একদিন আটটার কলেজে সাড়ে সাতটায় গিয়ে দেয়ালে কৃশানু টাঙিয়ে আসে। ছাত্র ছাত্রীরা করিডোরে হাঁটতে গিয়ে পত্রিকাটির সামনে দাঁড়ায়, লেখাগুলো পড়ে—দূর থেকে দেখি। কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হয়ে গেছে, দেয়াল পত্রিকাও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবে। অপুকে বলি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করতে। ঢিমেতালে কিছু লেখা পৌঁছল হাতে; না কবিতা না ছড়া না গল্প না প্রবন্ধ – ওগুলোকেই খানিকটা মানুষ বানিয়ে, বাবার পকেট থেকে আলগোছে টাকা সরিয়ে কাগজ কলম রং তুলি কিনে বসে গেলাম অমৃত নামে আরও একটি দেয়াল পত্রিকা বানাতে। বৈঠকঘরের মেঝে জুড়ে অমৃতর কাজ করি সারারাত। আমার তখন সাতখুন মাপ, শত হলেও ডাক্তারি পড়ে মেয়ে, কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে, নাহয় থাকুক। এসব ছেলেমি একদিন কেটে যাবে।

আমার অনেক কিছু কাটে, ছেলেমি কাটে না। অপু যাচ্ছে নেত্রকোনায়,তার বাড়িতে,রেলগাড়ি করে, যেহেতু রেলগাড়ি আমাকে চুম্বকের মত টানে, কিছু হালকা বন্ধুত্ব হওয়া মেয়েদের নিয়ে অপুর সঙ্গে নেত্রকোনা যাওয়ার মতলব করি। অপু কথা দেয়, বিকেলেই ফিরে আসবে। কলেজ থেকে বাড়ির পথ বাঁয়ে রেখে ডানে ইস্টিশনের দিকে যাই, কয়লার গাড়ি কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঝিকির ঝিকির করে চলতে শুরু করে, গাড়ি যখন চলে আমার খুব আনন্দ হয়, যখনই কোথাও থামে, মন খারাপ হয়ে যায়, জানালায় গলা বাড়িয়ে ইঞ্জিনের দিকে আকুল তাকিয়ে প্রাথর্ণা করি পুনঃ ঝিকির ঝিকিরের। নেত্রকোনা নেমে অপুর বাড়িতে খেয়ে দেয়ে, শহরের নদীমাঠ ইত্যাদি দেখে যখন রেল ইস্টিশনে পৌঁছোই ময়মনসিংহের গাড়ি ধরার জন্য, গাড়ি মুহুর্মুহু আসছে, কিন্তু যাচ্ছে মোহনগঞ্জের দিকে, ময়মনসিংহের দিকে নয়। সন্ধে নেমে আসে, আকাশ থেকে অন্ধকারের পাথর পড়ে বুকে। বাড়িতে কি হচ্ছে তা অনুমান করারও দুঃসাহস হারিয়ে ফেলতে থাকি। হোস্টেলের মেয়েদের নিশ্চিন্তি দেখে আমার ইচ্ছে করে ওদের মত ভাগ্য পেতে, বাড়িছাড়া রক্তচোখছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে। শেষ অবদি গাড়ি এল। সেই গাড়ি চলে কি চলে না করে রাত দশটার দিকে পৌঁছল ময়মনসিংহ শহরে। সারা পথই আমি নানারকম উত্তর সাজিয়েছি বাড়িতে বলার জন্য, কোনও উত্তরই জুৎসুই হয় না, সারা পথই আমার মখু গলা পেটের পানি তলপেটের দিকে নামতে থাকে। আমি একা অপরাগ বলে বাকিরা এগিয়ে আসে সমস্যা সমাধানে। অপু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে, বলবে সে আমাকে এবং আরও কজনকে নেত্রকোনা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, যত দোষ অপু ঘোষ। সমাধানটি মনঃপূত হয় না। শেষে সকলকেই ধরে নিয়ে আসি অবকাশে, এক দঙ্গল মেয়েকে দেখিয়ে বাড়িতে বলি, এরাও ছিল আমার সঙ্গে। একা একটি পুরুষের সঙ্গে দূরে কোথাও ফূর্তি করতে যাওয়া নয়, এক দল মেয়ে নিয়ে পিকনিক পিকনিক ঘুরে আসা,বোধবুদ্ধিহীন রেলগাড়ির জন্যই দেরি হওয়াটি ঘটেছে, অপু ছিল সঙ্গে সেটিই সান্ত্বনা—মা বুঝে নেন। সে যাত্রা বেঁচে যাই। রক্ষে যে বাবা বাড়িতে ফেরেননি তখনও। ফিরলেও সম্ভবত খুব বিস্ফোরণ ঘটাতেন না, কারণ সে রাতে তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর মা মারা গেছেন। বাবার মা, আমার দাদি। দাদি মাঝে মাঝে বড়দাদার সঙ্গে আসতেন অবকাশে বেড়াতে। দাদি দেখতে কালো, কিন্তু সুন্দরী। নাক চোখ মখু সব ধারালো। মার ধারণা এই দাদি বাবার আপন মা নন। বাবা আর বাবার বড় বোনের আপন মা ছিলেন এই দাদির বড় বোন। বড়দাদাকে, দাদিকে, বড় ফুপুকে এই গোপন কথাটি অনেকদিন জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। আপন মা না হলেও এই মার জন্য বাবার আদর কম ছিল না। আদর বলতে শাড়ি কাপড় পাঠানো, অসখু ব্যাধিতে ওষধু পাঠানো, একেবারে শয্যাশায়ী হলে নিজে মাদারিনগর গিয়ে দেখে আসা। এবার বাবা ঠিক করলেন দাদির চল্লিশায় তিনি যাবেন গ্রামের বাড়িতে। আমাকে আর ইয়াসমিনকে চোখ নাচিয়ে বললেন, কি যাবা নাকি কান্ট্রিসাইডে? আমন্ত্রণের আভাস পেয়ে লাফিয়ে উঠি খুশিতে। আমার আর ইয়াসমিনের কখনও যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে। দাদা ছোটদা গিয়েছিলেন যুদ্ধের সময়। দাদার ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে বাবার সঙ্গে গ্রামের পথে রওনা হই ভোরবেলা। নৌকো, বাস, রিক্সা, পায়ে হাঁটা এসবের ধকলের পর বাড়ি পৌঁছি। ধকলকে ধকল মনে হয়নি। ঘরের বাইরে বের হতে পারার মত আনন্দ আর কি আছে! যে কোনও নতুন জায়গা, সে গ্রাম হোক শহর হোক, দেখতে ভাল লাগে আমার। ঢাকা শহরে যাওয়ার যে আনন্দ, নান্দাইলের মাদারিনগর গ্রামে যাওয়ার আনন্দ তার চেয়ে কম নয়। দুপুরবেলা প্রচুর লোক এল খেতে, গ্রামের গরিব লোক, বাবার গরিব আত্মীয়। সবাইকে উঠোনে বসিয়ে কলাপাতায় খাওয়া দেওয়া হল। বাবা নিজে পাতে পাতে বেড়ে দিলেন। ক্যামেরায় বাবার নানা ঢংএর ছবি তুলে রাখি। আমাদের দেখতে গ্রামের বাচ্চা কাচ্চা পুরুষমহিলা সব জড়ো হন ও বাড়িতে। শহর থেকে আসা যে কোনও প্রাণীই তাদের কাছে এক থোকা বিস্ময়!বাড়ির সবগুলো ঘর বাঁশের বেড়ায় বানানো, খড়ের ছাউনি,মাটির মেঝে। বড়দাদার বড় ঘরটির চারপাশ ঘিরে ঈমান আলী, রিয়াজউদ্দিন, আবদুল মতিনের ঘর তোলা হয়েছে। তাঁরা বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। বড়দাদার ঘরে একটি বড় সিন্দুক, সিন্দুকের ওপর বিছানা পেতে ঘুমোন তিনি। সারাদিন বসে বসে মাছ ধরার জাল বোনেন। চোখে ভাল দেখতে পান না। কিন্তু অসখু বিসুখে যে যাবেন শহরে, থাকবেন অবকাশে, তা নয়, তাঁকে টেনে হিঁচড়েও শহরে নেওয়া যায় না আজকাল। নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও তাঁর এ বয়সে যেতে ইচ্ছে করে না। বাবা দিগন্ত অবদি বিস্তৃত সবুজ ধানি জমি দেখালেন আমাদের। সব তিনি নিজে কিনেছেন। এত জমি, এত গরু, এত গোলা ভরা ধান বাড়িতে, কিন্তু কারও জীবন যাপনে চাকচিক্য নেই। পরনে মাদারিনগর বাজারের সস্তা নীল লুঙ্গি। কুঁড়েঘরের তক্তপোষে ঘুমোন, বেগুন পোড়া আর পাইন্যা ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে হুঁকো টানেন দাওয়ায় বসে, দুশ্চিন্তার সুরুজ যেন মাথার এক হাত ওপরে বসে আছে, মখু গুলো তাই তিতিবিরক্তিতে বাঁকা। বউদের পরনেও মোটা সুতির কাপড়। পনেরোকে পঁচিশ লাগে দেখতে। পঁচিশকে পঞ্চাশ। তবু গ্রামের অন্য বাড়ির চেয়ে এ বাড়ির লোকদের ভাবা হয় ধনী। ধন তাঁরা জীবন যাপনে ব্যয় করেন না, ধন জমিয়ে রেখে নতুন জমি কেনা আর এর ওর বিরুদ্ধে মামলা করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বাড়ির জন্য বাবা হলেন ভগবান। যে যতটুক যক্ষরাজ কূবের বনেছেন, বাবার টাকাতেই বনেছেন। বাবা যেভাবে আদেশ করেন, সেভাবে সকলে চলে। কার ছেলে ইশকুলে যাবে, কার মেয়ের বিয়ের পাত্র খুঁজতে হবে, সবই বাবা বলে দেন, ইশকুলে পড়ার খরচাও বাবা দেন, বিয়ের খরচাও। গ্রামের ইশকুল শেষ হলে রিয়াজউদ্দিনের ছেলেকে শহরের ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে দেন। শহরের ইশকুলে ভর্তি হওয়া মানে অবকাশের উঠোনে টিনের ঘরে ওদের জায়গা হওয়া। রিয়াজউদ্দিনের বড় ছেলে সিরাজ, যখন অবকাশে থেকে শহরের ইশকুলে পড়ত, একদিন কাঠফাটা গরমের শুনশান দুপুরে ইয়াসমিনকে, বয়স কত হবে আর, নয় কি দশ, ন্যাংটো করেছিল। রুনুখালা বেড়াতে এসে উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে টিনের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে ন্যাংটো দৃশ্যটি দেখে ফেলেন, খবর পেয়ে বাড়ি এসে সিরাজ আর ইয়াসমিনের পিঠে উঠোনে যত খড়ি ছিল ভেঙে, সিরাজকে সেদিনই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সিরাজ শহরের অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থেকে ইশকুল পাশ দিয়ে এখন কলেজে ঢুকেছে। দাদির চল্লিশায় সিরাজ এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু ঘটনার এত বছর পরও বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া দাদির মাথার কাছে একটি চারাগাছ পুঁতে বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বিকেল বিকেল শহরে ফিরে আসেন। পথে তিনি নিঃসংকোচে বর্ণনা করেন তাঁর গত জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের কথা। কোন বাড়িতে জন্ম হয়ে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন, তা আমাদের বুঝতে বলেন। বলেন আমরাও যেন ওপরের দিকে তাকাই, যেন বড় হই শিক্ষাদীক্ষায় কাজেকমের্, যেন মানুষের মত মানুষ হই। আরাম আয়েশ আলসেমিতে যেন বথৃা উড়িয়ে না দিই সময়।

এদিকে কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, জাসদ-ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ঢাকা থেকে গানের শিল্পীদের এনে চমৎকার চমৎকার নবীন বরণ অনুষ্ঠান করে আমাদের বরণ করছে। এক দল আরেক দলের চেয়ে জমকালো অনুষ্ঠান করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত এক দল খুরশিদ আলমকে নিয়ে এলো, আরেক দল ফেরদৌস ওয়াহিদকে। কেবল গানের অনুষ্ঠানই নয়, লম্বা লম্বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নেতা আনা হয়। মাহমুদুর রাহমান মান্না জাসদের অনুষ্ঠানে এসে নাগারে দুঘন্টা বক্তৃতা করেন, তন্ময় হয়ে শুনি। যে দলের যে নেতাই যে কথাই বলেন, মগ্ধু হই। এত ভাল ভাল নেতা থাকতে দেশ কেন পড়ে থাকবে জিয়াউর রহমানের মত এক সেনানায়কের হাতে, ভাবি। আবার ছাত্রদলের ভাষণ শুনে মনে হয় দেশ বুঝি ঠিকই চলছে, এর চেয়ে ভাল চলার আর কোনও ব্যবস্থা নেই। নবীন বরণ উৎসব শেষ হতে না হতেই নির্বাচনের হাওয়া লাগে কলেজে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কলেজে নানারকম মানুষ ভোট চায়, সবাইকে মাথা নেড়ে কথা দিতে হয় ভোট দেব। বাড়িতেও আসতে শুরু করে প্রার্থীরা। বাড়ি এসে বলে গেলে নাকি সে বলা পোক্ত হয়। বাড়িতে ভোটের জন্য অথবা যে কোনও কারণেই হোক, আমাকে খুঁজতে হরদম ছেলেপিলে আসছে, ব্যাপারটি সম্পণূর্ নতুন আমার জন্য। প্রথম বর্ষের ক্লাস গড়িমসি করে চলে, এই সুযোগে তৃতীয় সংখ্যা সেঁজুতি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। কলেজে যত না সময় কাটে, তার চেয়ে বেশি কাটে জমান প্রিন্টার্সে। আগের চেয়ে আরও হৃষ্টপুষ্ট এই সেঁজুতি। এ সংখ্যা সেঁজুতিতে একটি জিনিস উল্লেখযোগ্য, প্রথম পাতার সম্পাদিকা তসলিমা নাসরিন চলে গেছে ছোট অক্ষরে শেষ পাতার শেষে। সম্পাদিকার বদলে সম্পাদক। সেঁজুতি হাতে নিয়ে দাদা প্রথম থেকে শেষ অবদি পড়ে শেষে থমকে যান, বানান ভুল রইয়া গেছে। সম্পাদিকার জায়গায় সম্পাদক ছাপা হইছে। হেসে বলি, এইটা ভুল না। এইটা আমি ইচ্ছা কইরা দিছি।

কস কি? তুই কি ছেড়া নাকি?

ছেড়া হইতাম কেন?

তুই কি লিঙ্গ বিশ্বাস করস না?

করি।

পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ বইলা যে একটা ব্যাপার আছে, তা জানস?

জানি। কিন্তু সম্পাদিকা প্রকাশিকা এইসব ইকা টিকা আমি পছন্দ করি না। ছেলে মেয়ে দুইজনই সম্পাদক হইতে পারে। শব্দের মধ্যে অহেতুক কিছু লিঙ্গের আমদানি হইছে, যা আমি ব্যবহার করতে চাই না। যে মেয়ে কবিতা লেখে তারে আমি কবি কইতে চাই, মহিলাকবি না।

দাদা সেঁজুতি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মাইনষে তরে পাগল কইব।

 

ক্লাসে যাদের সঙ্গে আলাপ হয় এক দুকথার পরই বলি শতাব্দী চক্র নামে একটা সাহিত্যগোষ্ঠী করি, চল। হালকা হালকা বন্ধুত্বের মেয়েগুলোকেও বলি। বইপোকাগুলো মোটেও ভিড়তে চায়নি, আর পোকা যাদের ধারে কাছে ভেড়ে না, ওরা লাফিয়ে উঠল, ব্যস, চাঁদা তোলো, খামোকা লাফালে তো কাজের কাজ কিস্যু হবে না। ছোটখাট একটি কমিটি বানিয়ে ফেলে, এবার, আমার প্রস্তাব, কিছু একটা করা চাই। অমৃত দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঝোঁক চাপে শতাব্দী থেকে সেঁজুতির মত একটি কবিতাপত্রিকা করার। মনে কিছু উদয় হয় তো ঝাঁপিয়ে পড়ি, অবশ্য আমার সব ঝাপাঁনোই নিঃশব্দে। বাংলা শব্দ শুদ্ধ করে লিখতে জানে, এমন যাকেই পাচ্ছি, বলছি, কবিতা লেখো। কবিতা তো আসে না বাবা! আরে আসবে। জীবনই তো কবিতা! যাপন করছ, অথচ লিখছ না! যে কটি কবিতা পাওয়া গেল, কড়া সম্পাদনা করে ছোট্ট একটা কবিতাপত্রিকা বের করি, নিজেই সি কে ঘোষ রোডের লিফা প্রিন্টাসের্ গিয়ে ছেপে আনি। ছোটদার বন্ধুর ছাপাখানা এই লিফা। লিফা দাম রাখে কম, কিন্তু রাখে। পত্রিকার নাম দিই রোদ। রোদ প্রেসে যাও, প্রুফ দেখ, রোদে ভিজে বাড়ি ফেরো। রোদ হয়ে যাওয়ার পর অপুর আবদার, দুপাতা লম্বা একটি ছড়া নিয়ে এসে, শতাব্দী থেইকা একটা ছড়াপত্রিকা হইলে কিন্তু মন্দ হয় না। তাও হবে, ছড়ার কি দোষ যে বাদ থাকবে! ঝনঝন নামে ছড়াপত্রিকাও কদিনের মধ্যে হয়ে গেল। তবে অপুর ছড়াটি কেটে আধপাতা করতে হয়েছিল, অত টাকা নেই যে এক হাত লম্বা লম্বা ছড়া ঢুকিয়ে ঢাউস কোনও পত্রিকা করা যাবে, কলেজ থেকে পাওয়া বৃত্তির টাকা শতাব্দির পেছনে খরচা করি, সদস্যরা এমাসে চাঁদা দেয় তো ও মাসে বাদ থাকে। কাঁচা কবিতা পাকা-মত করে, ছেপে, পত্রিকা করার উৎসাহ তখনও ঘোচেনি, এর ওপর উথলে উঠল নতুন উচ্ছঅ!স, নাটক। ছোটদা তখন নাটকের দলের সঙ্গে অর্ধেক রাত, আর বেশি অর্ধেক দিন কাটাচ্ছেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরে নতুন নতুন নাটক করছে, ছোটদা আমাকে মহড়া দেখাতে নিয়ে যান মাঝে মধ্যে। যখন আমার মাথায় নাটকের এক পোকা থেকে লক্ষ পোকা জন্ম নিচ্ছে, পাথর্, আমার সঙ্গেই পড়ে, একদিন সিসিম ফাঁকের মত ফাঁক করল তার ট্রাংক, বেরোল সমরেশ বসুর একটি নাটক, আবতর্। কলেজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে এ নাটক হবে না, সত্যিকার নাট্যশিল্পী দরকার। পাণ্ডুলিপিটি আমি বাড়ি নিয়ে এসে ছোটদাকে বললাম এই নাটকটা থিয়েটারকে দাও করতে। তখন আমার পড়া হয়ে গেছে আবতর্, পড়তে পড়তে ছেলেচরিত্রে, মেয়ে চরিত্রে থিয়েটারের সদস্যদের কল্পনা করেছি, বিশাল একটি মঞ্চের সামনে থেকে পর্দা সরে যাচ্ছে, মঞ্চে আবছা আলো, সন্ধে হয়ে আসছের আলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে গীতা, গীতাকেই মানাবে মংলার মা চরিত্রে, ডাকছে উৎকণ্ঠায়, মংলা ও মংলা। থিয়েটার দল লুফে নিল নাটকটি, মহড়া শুরু হল। প্রায় বিকেলে মহড়ার দিন থিয়েটার-ঘরে উহু হচ্ছে না, আরেকটু পেছনে যান, মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, কারণ মংলার বাবা এখন কনফিউসড, আচ্ছা আঞ্চলিক টানটা আরও আনতে হবে কিন্তু সংলাপে, যখন বলি, নাটকের জলে আকন্ঠ ডুবে, যে কেউ ভেবে বসবে আমিই বুঝি নাটকের পরিচালক। একদিন ফরিদ আহমদ দুলাল, দলের প্রায় সব নাটকের পরিচালক, যখন বলল, পরিচালনা কিন্তু যা দেখতাছি তুমিই করতাছ, সুতরাং, কি কও, নাটকটার পরিচালকই অফিসিয়ালি হইয়া যাও।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

লজ্জায় মখু লুকিয়ে বলি, পাগল নাকি! আমার কোনও অভিজ্ঞতাই নাই নাটকের। জীবনে প্রথম।

টেলিভিশনে কিছু নাটক আর ছোটদার সঙ্গে ঝুলে ময়মনসিংহের মঞ্চে কিছু নাটক দেখে আর কিছু নাটকের বই পড়ে নাটক পরিচালনা করার বিদ্যে অর্জন হয় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার ওপর যখন সত্যি সত্যি ভার পড়ল নাটক পরিচালনার, ছোটদা পার্থকেও বললেন ডেকে আনতে। পাথর্ তুমুল উৎসাহে নেমে গেল। প্রায় রাতে ময়মনসিংহ থিয়েটারের ভাঙা বাড়িতে মহড়া চলে। গ্রামের গরিব পরিবারের গল্প। গীতা নায়িকার ভূমিকায়, নায়িকার ভূমিকায় গীতা অবশ্য মঞ্চে প্রথম নয়, এর আগেও নানারকম নাচের দল থেকে সে নকশি কাথাঁর মেয়ে, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা করেছে। নায়কের ভূমিকায় ময়মনসিংহ থিয়েটারে নতুন যোগ দেওয়া গানের ছেলে সোহানকে নেওয়া হল। মংলা চরিত্রের জন্য ছোট একটি বাচ্চা ছেলে যোগাড় করা হল। প্রচণ্ড উদ্যম এক একজনের মধ্যে, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করা মানুষগুলো পারলে দিন রাতের যে কোনও সময় এক পায়ে খাড়া মহড়া দিতে। রাতে মহড়া শেষে পাথর্ হোস্টেলে ফিরে যায়, কোনও কোনও রাত আবার অবকাশেও কাটায়। আবর্তর শো শুরু হল টাউনহলে, মঞ্চ সজ্জায় যার দায়িত্ব ছিল, চোখকাড়া মঞ্চ সাজিয়েছে সত্যিকার কুঁড়েঘর বানিয়ে, সত্যিকার মাটিতে সত্যিকার গাছ পুঁতে, সত্যিকার মাছ ধরার জাল উঠোনে, দেখে আমি অভিভূত। তিন রাত ধরে শো। টিকিট কিনে লোক এল নাটক দেখতে, তিনশ লোকের হল ধীরে ধীরে, আশ্চর্য, ভরে গেল। যেন চোখের পলকে ঘটে গেল এত বড় ব্যাপারটি। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরের নামি দল নাটকের, আর তাদের সবচেয়ে ভাল এবং সফল নাটক আবতর্। নাটকের পোস্টারে ছাপা আবর্তর দুজন পরিচালকের নাম, ঈশিতা হোসেন পাথর্ আর তসলিমা নাসরিন।

নাটক আরও দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এভাবেই চলতে পারত, কিন ্তু গীতার ডাক পড়ল ঢাকায়। টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠান হবে, রাহিজা খানম তাকে ডেকেছেন নাচতে। বুলবুল একাডেমিতে নাচের মেয়ে কম পড়েছে, ডাক ডাক গীতাকে ডাক বলে রাহিজা খানম গীতা যেখানেই থাক ডেকে নিয়ে যান। গীতা নেচে বেড়ায় ঢাকায়। টেলিভিশনে গীতার নাচ থাকলে বাড়ির সবাই বসে সে নাচ দেখি। মা আর গীতাকে নর্তকী বলে গাল দেন না। গীতার জীবনটি রহস্যে ভরা। এক্ষুনি জীবন উজাড় করে দিল, পরক্ষণেই কেড়ে নিল। মঞ্চে চমৎকার অভিনয় করে গীতা, কী জানি জীবনের মঞ্চে সে যা করছে সবই অভিনয় কি না। গীতার জীবনের অনেকটাই গীতার ট্রাংকে লুকোনো। নানারকম জিনিস ওতে, গোপন করার মত অনেক জিনিস। যখন সে বাড়ির বাইরে যায়, ট্রাংকে তালা লাগিয়ে যায়। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে কী কী আছে ট্রাংকের ভেতর। গোপন করার মত তখনও আমার কিছু নেই। সবই খোলা, সবই মেলা, ইচ্ছে করে আমারও গোপন কিছু থাক, আমার একার কিছু ছোটদার সঙ্গে গীতার প্রেম বা বিয়ে যখনও কিছু হয়নি, তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, মূলত হেনামাসির কাছে যাওয়া যে মাসিটি আমাদের পড়াতেন, তখন গীতার ট্রাংকটি দেখেছিলাম, সরু চৌকিতে, যে চৌকিতে সে শুত, তার ওপরই বালিশের কাছে রাখা। বিয়ের পর সে বাপের বাড়ি থেকে আর কিছু না আনুক, তার যক্ষের ধন ট্রাংকটি এনেছে। ট্রাংকটি একদিন তালাহীন পেয়ে দেখি ওতে রাজ্যির জিনিস, ছোটদার লেখা তিরিশ চল্লিশ পাতার চিঠি, ছোট ছোট গয়না, পয়সার থলে, আমার দৃষ্টি কাড়ে তুলো লাগানো ব্রেসিয়ারগুলো। সতেরো পার হয়েছে, কিন্তু ও জিনিসটি কখনও পরে দেখিনি। মার ব্রেসিয়ারও মা সবসময় লুকিয়ে রাখেন, শাড়ি নয়ত শায়ার আড়ালে, উঠোনের দড়িতে কখনও ব্রেসিয়ার শুকোতেও দেন না, টিনের ঘরের পেছনে, যেখানে কুকুর বেড়ালও যায় না, রোদে ফেলে শুকিয়ে আনেন, যেন সাংঘাতিক নিষিদ্ধ জিনিস এগুলো। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে, কেউ যেন না দেখে না শোনে, নিষিদ্ধ জিনিস সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে আমার, ঝেড়ে, বললাম, যা তো গাঙিনার পাড় থেইকা এইরকম একটা জিনিস কিন্যা নিয়া আয়, রিক্সা কইরা যাইবি আর আসবি। আমি ওর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম, যেন ও এলেই জিনিসটি কারও চোখে পড়ার আগে আমি আড়াল করতে পারি। সেই বিকেলে ইয়াসমিনের কিনে নিয়ে আসা ব্রেসিয়ার পরে দিব্যি চপু চাপ বসে রইলাম, নিষিদ্ধ জিনিসে আনন্দ যেমন আছে, ভয়ও আছে, চাইছিলাম না কেউ আমার আশেপাশে আসুক, বুঝুক যে আমি নতুন একটি জিনিস পরেছি আজ। কিন্তু ছোটদার সঙ্গে সখ্য তখন এমন যে, ছোটদা বাড়ি ঢুকেই হৈ চৈ করে আমাকে ডাকেন, কোনও একটি গল্পের বই আমাকে পড়তে হবে, আর তিনি খেতে খেতে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে প্রায় ঘুমোতে ঘুমোতে শুনবেন। আমি যখন জড়সড়, বারবার জামা টানছি কাঁধের দিকে, যেন কিছুতেই উঁকি না দেয় নিষিদ্ধের ফিতে, ছোটদা এসে পিঠে এক চাপড় দিয়ে বললেন কিরে কি হইছে তর, একলা একলা বইসা রইছস কেন?

পিঠের চাপড়টিই বিপদ যা ডাকার, ডাকল। ছোটদা তুমুল হেসে বললেন কি রে তুই দেখি ব্রেসিয়ার পরছস!

গলা ফাটিয়ে সারাবাড়ি জানিয়ে দিলেন, নাসরিন ব্রেসিয়ার পরছে।

পরার পর পনেরো মিনিটও যায়নি, বাড়ির সবাই জেনে গেল, আমি কি পরেছি।

টেবিলের দিকে গা ঠেসে থাকলাম, আমার মাথা ক্রমে নুয়ে আসতে থাকল বইয়ের ওপর, গোপন জিনিসটি গোপন না থাকার কষ্টে বইয়ের পাতা ভিজতে লাগল। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্রেসিয়ার পরার ইচ্ছা হইছে, আমারে কইবা না? আমি তো তোমার সাইজের কিন্যা দিতে পারতাম।

আমার মখু মাথা কান শরমে গরম হতে থাকল। ব্রেসিয়ারের ঘটনা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা বলেছিলেন, বিয়ের বছর দুই পর মা যখন প্রথম ব্রেসিয়ার পরলেন, বাবা এমন ক্ষেপেছিলেন যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠেছিলেন, খারাপ মেয়েছেলের মত ঢং এর জিনিস পর ! শখে বাঁচ না! এই জিনিসটি পরা মানে ঢং করা ফ্যাশন করা এরকমই ভাবে অনেকে। গ্রামের মেয়েরা সারাজীবন ব্রেসিয়ার কাকে বলে না জেনেই জীবন কাটিয়ে যায়। বাবা গ্রামের ছেলে, তাঁর দেখে অভ্যেস নেই কাপড়ের তলের বাড়তি কাপড়।

কলেজে একটি জিনিস আমাকে নিষিদ্ধ গন্ধমের মত টানে। সেটি কলেজ ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে আর সব ছেলেদের মত চা খেতে খেতে গল্প করতে ইচ্ছে হয় আমার। ইচ্ছে হয় যদিও, ইচ্ছেকে পণূর্ করতে অনেক সময় আমি নিজেই এর বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াই। উপকণ্ঠের সম্পাদক, আবার চমৎকার কবিতাও লেখে, হারুন রশিদ, যার কবিতার মগ্ধু পাঠক আমি, আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এসে এই ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছিল, আমার সাহস হয়নি ভেতরে যেতে, সাহস হয়নি কোনও অসহ্য সুন্দরের সামনে দাঁড়াতে। ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে থাকা আমার সামনে দিয়ে একটি মিষ্টি মুখের ছেলে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে, পেছন থেকে তাকে ডেকে থামানোর সাহসও হাত ফসকে পড়ে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। নিজের এই অপারগতাগুলো আমি ভেতরে একা একাই লালন করি। নিজেকে আমার অপদার্থ ভীরু কা-নারী ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মূলত ছেলেরাই যায় ক্যান্টিনে তা জানি, দিব্যি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নয়ত দুটো ক্লাসের মাঝের অবসরটাতে, নয়ত ক্লাস কোনও কারণে না হলে। অবসর পেলে মেয়েরা হোস্টেলে গিয়ে কিছুক্ষণ গড়িয়ে আসে, নয়ত জুটি বেঁধে নিরালায় চলে যায় মোটা বই মেলে পড়তে। মেয়েরা যায় কদাচিৎ ক্যান্টিনে, বড় ক্লাসের মেয়েরা কেবল, ছেলেবন্ধুদের নিয়ে, নয়ত দল বেঁধে। ক্যান্টিনে যাওয়ার ইচ্ছে করে আমার, ইচ্ছে করে আর সব ছেলেদের মত যখন তখন ক্যান্টিনে ঢুকে হাঁক দেব চায়ের জন্য, চা এলে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে চা খাবো, ইচ্ছের পণূর্ তা যেহেতু আমার পক্ষে ঘটানো সম্ভব হয় না, আমি সঙ্গী খুঁজতে থাকি। ক্লাসের যে মেয়েকেই সাধি, পিছলে যায়। শেষ অবদি হালিদা রাজি হল, সুন্দরী এক মেয়ে, উদাস উদাস চোখ, ঢাকার ইন্দিরা রোডে বাড়ি, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকেই দেখি জোড়া জোড়া ছেলে-চোখ আমাদের গিলছে, প্রথম বর্ষের মেয়ে হয়ে গটগট করে চলে এলাম ছেলেদের আড্ড াখানায়, আমাদের বুকের পাটা অনুমান করে ওরা খানিকটা চেঁচিয়েই কথা বলতে শুরু করল যেন ওদের প্রতিটি শব্দ আমাদের প্রতি লোমকপূ নাড়ায়। সেই শুরু। পরে, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর ক্যান্টিন আমার ঠিকানা হয়ে উঠল প্রায়। হাবিবুল্লাহরও বাড়ি ঢাকায়, আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ে, দীর্ঘদিন আমাকে আড়ে আড়ে লক্ষ করে হঠাৎ একদিন পথ আগলে বলল সে আমার বন্ধু হতে চায়। বন্ধু হতে চাও ভাল কথা, তবে বন্ধু মানে বন্ধু তুই তোকারি বন্ধু। হাবিবুল্লাহকে পরদিনই তুই বলে সম্বোধন করলাম, সে চমকাল যদিও, শতর্ মত তাকেও বলতে হল তুই। হাবিবুল্লাহ এরপর আঠার মত লেগে রইল আমার পেছনে। ক্লাসে ঢুকতে বেরোতে দেখি সে, দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়।

কী ব্যাপার তোর ক্লাস নাই?

আছে।

ক্লাসে যা।

ধৎু ভাল্লাগছে না। ক্লাস করব না।

কি করবি?

চল চা খাই গিয়া।

আমার ত ক্লাস আছে।

হাই স্যারের ক্লাস তো। ওই ক্লাস না করলেও চলবে।

কি কস!

আরে চল তো।

এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা আসছে, হাবিবুল্লাহর বন্ধুরা আসছে, এনাটমি থেকে শুরু হয়, রাজনীতিতে গিয়ে শেষ হয় আড্ডা। আমরা সদপের্ সগবের্ হেঁটে বেড়াই কলেজ চত্বর। ক্লাসের ফাঁকে অথবা অজরুরি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেখানেই আমি, সেখানেই হাবিবুল্লাহ। হাবিবুল্লাহ বাড়িতেও আসতে শুরু করল বিকেলের দিকে। বাবা বাড়ি এলে হাবিবুল্লাহ দাঁড়িয়ে স্লামালেকুম স্যার বলে। গম্ভীর মুখে বাবা ভেতরের ঘরে ঢুকে যান। ভেতরে গিয়ে মাকে প্রশ্ন করে উত্তর পান, ছেলেটি আমার বন্ধু। কলেজের শিক্ষক হয়ে বাবা এই একটি জায়গায় আটকে গেছেন, কলেজের কোনও ছাত্রকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

 

কলেজে খেলার মরশুম শুরু হয়েছে, ক্যারম আর দাবা খেলায় নাম লিখিয়ে দিব্যি খেলতে লেগে গেলাম। ক্যারমে হেরে গেলাম, জেতার কোনও কারণ ছিল না, সেই কতকাল আগে, নানিবাড়িতে খেলেছিলাম! আর দাবায়, এক তুখোড় দাবারু, গত বছরের চ্যম্পিয়ানকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শেষ অবধি জিতে যাওয়া খেলা, অধৈর্যের কারণে ছেড়ে দিয়ে রানাসর্ আপ হলাম। অধৈর্য আমার লাগে গ্যালারির ক্লাসগুলোতেও, শিক্ষকরা কী বলেন বা কী বলতে চান, তার আশি ভাগই বুঝি না। প্রস্থানচর্চা বেশ চলে এখানে, যা ইশকুল কলেজে আগে দেখিনি, প্রক্সি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, ক্লাস ভাল লাগল না তো পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম, তখন অবদি মেয়েরা পাছায় আঠা লাগিয়ে সামনের সারিতে বসে শিক্ষকদের প্রতিটি বাক্য গোগ্রাসে গেলে, দুষ্টু ছেলেরাই নাকি কেবল বেরিয়ে যায়, আমি দুষ্টুর তালিকায় পড়লাম, তবে ছেলে নই, মেয়ে। বেরিয়ে যাওয়ার এই স্বাধীনতাও বেশ উপভোগ করতে শুরু করি, মুমিনুন্নিসা কলেজ থেকে বিকেল পাঁচটার আগে গগন দারোয়ান আমাদের বেরোতে দিত না, এখানে আর যাই থাক, সেই দমবন্ধ করা খাঁচাটি নেই। ইচ্ছে হল ক্লাসে গেলাম, ইচ্ছে হল গেলাম না। এরকম নিয়ম নেই যে সকাল আটটা বা নটায় কলেজে ঢুকতেই হবে। মেডিকেলের এই ব্যাপারটি বোঝার পর আমি কখনও কখনও দুপুরে বাড়ি থেকে রওনা হই, মা অবাক হন, এই অসময়ে কই যাইতাছস?

কলেজে।

এখন আবার কলেজ কি?

ক্লাস আছে।

তর তো সকাল আটটায় কলেজ শুরু হইছে।

হ হইছে। তাতে কি! আটটার সময় যে ক্লাস ছিল করি নাই।

এখন কলেজে যাইয়া কি করবি?

দেড়টার ক্লাস করতে যাইতাছি।

যখন ইচ্ছা তখন গেলে ত হয় না।

তোমার তো দৌড় ইশকুল পর্যন,্ত এই সব বুঝবা না।

নিয়মটি আমার খুব ভাল লাগে, যখন ইচ্ছে ক্লাসে যাও, ক্লাস করতে ইচ্ছে না হলে প্রক্সি দিয়ে বেরিয়ে পড়। প্রক্সি শব্দটির চল খুব বেশি কলেজে। ক্লাস না করতে পারি, কিন্তু উপস্থিতির সংখ্যা কম থাকলে পরীক্ষায় বসা যাবে না। বন্ধুৃরা নকল উপস্থিতি দিয়ে দেয়। প্রতিটি ক্লাসে নাম ডাকার সময় ইয়েস স্যার বলে দিলেই হয়। এখন কে বলছে ইয়েস স্যার, তোফাজ্জলেরটা মোজাম্মেল বলছে কি না, তা কে তলিয়ে দেখে! মাথা নিচু করে ইয়েস স্যার বলে উপস্থিত বন্ধুর অনপুস্থিত বন্ধুকে একরকম বাঁচায়। এই উপস্থিত আবার যখন অনপুস্থিত হবে, তখন আগের সেই অনপু স্থিত উপস্থিত থেকে নতনু অনপুস্থিতকে বাঁচাবে।

সেঁজুতির চতথুর্ সংখ্যা নিয়ে পড়েছি। কলকাতা থেকে চিঠি, কবিতা,সাহিত্যপত্রিকা, বই ইত্যাদি আসে। নির্মল বসাক সময়ের খেলনা পাঠিয়েছেন, অভিজিৎ ঘোষের নিঃসঙ্গ মানুষ এসে দাঁড়ায় সামনে। তাঁদের কবিতাপত্রিকা সৈনিকের ডায়রি, ইন্দ্রাণী নিয়মিত পাচ্ছি। মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ক্ষিতিশ সাঁতরা, চিত্রভানু সরকার, শান্তি রায়, বিপ্লব ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র কুমার দেব, প্রণব মুখোপাধ্যায় কবিতা পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কবিতা পৌঁছতে থাকে হাতে। আলমগীর রেজা চৌধুরী, আহমদ আজিজ, খালিদ আহসান, জাহাঙ্গির ফিরোজ, মিনার মনসুর, মোহন রায়হান, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, রমেশ রায়, হারুন রশিদ, সাজ্জাদ হোসেন এরকম আরও অনেকের লেখা পরপর সাজিয়ে নিই। চন্দনার কবিতা হার্দিক রাইফেল নামে। আমারটির নাম দিয়েছি বুর্জোয়া কষ্টরা এসে আমার হৃদয় ধর্ষণ করছে। দুই বাংলার সাহিত্য পত্রিকা প্রতিদিন দশ বারোটি করে আসে। জমিয়ে রাখি টুকিটাকি খবরের জন্য। দশ পৃষ্ঠাই চলে যায় টুকিটাকিতে। চতুর্থ সংখ্যা সেঁজুতিতে, ছোটদাকে জানিয়ে দিই, বিজ্ঞাপন দরকার। এটি বই আকারে বের করছি, বৃহৎ কলেবরে যাকে বলে। ছোটদা পিপুলস টেইলাসর্, আর টিপটপ কনফিকশনারির দুটো বিজ্ঞাপন যোগাড় করে আনেন। বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজের জিঙ্ক লোগো দিয়ে শেষ পাতায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন ধন। বই আকারে হবে তো বোঝা গেল, কিন্তু পঈচ্ছদ করবে কে? পঈচ্ছদ করার জন্য ছোটদাকে বলি শিল্পী যোগাড় করতে। গোলপুকুর পাড়ে পোড়ামাটি-শিল্পী অলক রায়ের ভাই পুলক রায় আড্ডা দিতে আসে, তার কাছে ছোটদা খবর পান অলক রায় শহরে নেই। সুতরাং অলক রায়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই, ছোটদার হাতে আর কোনও শিল্পী নেই। অতএব আমি নিজেই একটি মেয়ের মখু এঁকে ছোটদাকে পাঠাই ব্লক করে আনতে। এরপর তো তাগাদা, কই এত দেরি হইতাছে কেন, আইনা দেও। কিছুতেই দেরি সয় না আমার। সবকিছু ইচ্ছে করে আজই করে ফেলি। এক্ষুনি। এই এক্ষুনি করে ফেলার স্বভাবটি মার মধ্যেও আছে। মা শাদা টেট্রনের কাপড় পেলেন একগজ বাড়ির ছেলেদের টুপি বানানোর জন্য, ঈদের আগে আগে। কাঁচিতে দুটো টুপির কাপড় কাটা হয়েছে, এবার তৃতীয় টুপির কাপড়টি কাটার জন্য হাতের কাছে মা আর কাঁচি পাচ্ছেন না, কাঁচি পাচ্ছেন না, আশেপাশে খুঁজলেন, এঘর ওঘর খুঁজলেন খানিক, এরপর বটি হাতে নিলেন, বটি দিয়েই কাটলেন কাপড়। ছোটদাও বলেন আমার ধৈর্য নেই। জমান প্রিন্টার্সের লোকরাও। আমার কিন্তু মনে হয় না আমার ধৈর্য কিছু কম, বরং মনে হয় মানুষগুলো বড় ঢিলে, যে কাজটি পাঁচ মিনিটে হয়ে যায়, সে কাজটি করতে পাঁচ দিন লাগায়। আমার বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না। কবিতা লিখতে গেলেও দীর্ঘক্ষণ সময় নিতে ইচ্ছে করে না। সময় নিলেই মনে হতে থাকে কবিতা আমাকে শেকলে জড়িয়ে ফেলেছে। আমার দম বন্ধ লাগে। একটি কবিতার পর নতুন একটি কবিতা শুরু করতে ভাল লাগে। কিন্তু একটি নিয়ে রাত দিন পড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ঘষা মাজাও অত পোষায় না। যা লিখেছি লিখেছি। একজনের ধৈর্য দেখেছি, সে বড়মামার শ্বশুরমশাই। বেঁটে ফর্সা ভদ্রলোক, হিমালয়ের গুহা থেকে মাত্র বেরোনো কোনও সন্ন্যাসীর মত দেখতে। তিনি স্ত্রী মারা যাবার পর বিরহ যাতনা বলে একটি কবিতা লিখেছিলেন, দিয়েছিলেন দাদার পাতা পত্রিকায় ছাপতে। তিনশ একচল্লিশটি শব্দের কবিতায় দুশ ছিয়াশিটি শব্দই ছিল হয় যুক্তাক্ষর, নয় রফলা যফলা রেফঅলা শব্দ। তিনি গোটা একটি বছর নিয়েছেন কবিতা লিখতে। দাদা পাতায় সেটি ছাপার পর দ্বিতীয় সংখ্যায় আবার একই কবিতা খানিক সংশোধন করে তিনি ছাপতে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সংখ্যায় সংশোধিত কবিতা বের হওয়ার পর তিনি তৃতীয় সংখ্যার জন্য যখন একই কবিতার তৃতীয় সংশোধনী নিয়ে দাদার কাছে সকাল বিকাল ধরনা দিতে শুরু করলেন, একসময় এমন হল যে বড়মামার শ্বশুরমশাইএর শ্রীমখু খানা কালো ফটকের কাছে দেখলেই দাদা গোসলখানায় ঘন্টাখানিকের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতেন।

ক্লাস শেষে আমি বেশির ভাগ বাড়ির দিকে না ফিরে যেতে থাকি জমান প্রিন্টার্সের দিকে। জমান প্রিন্টাসর্ রাজবাড়ির ইশকুলের উল্টোদিকে একটি য়চ্ছ সরোবরের পাশে। ছাপাখানার লাগোয়া বাড়িটি উঁচু দেয়াল ঘেরা। খুরশিদ খানের বাড়ি। খুরশিদ খানেরই ছেলে মন, ধন, জন। ধনের বড় ভাই মন দাদার পাতার আমলে ছিলেন। পরে দায়িত্ব চলে গেছে ধনের হাতে। অসম্ভব অমায়িক রসিক ভদ্রলোক ধন। ধোপদুরস্ত জামা কাপড় গায়ে। আমি ছাপাখানায় ঢুকলেই তিনি তাঁর ঘরে ডেকে আমাকে বসান। চায়ের কথা বলেন। বসিয়ে রাজ্যির গল্প করেন। খুরশিদ খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছোট ভাই, জাত মুসলিম লীগ। অথচ ধনকে দেখে মোটেও বোঝার উপায় নেই যে বংশের রাজনীতির মোটেও তিনি বাহক। এমন কোনও প্রসঙ্গ নেই, যা নিয়ে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন না। মূলত আমি শ্রোতা, ধন মাঝে মাঝেই বলেন, কি ব্যাপার আপনি সাহিত্য করেন, অথচ মখু দিয়া কোনও কথাই বার হয় না আপনার। আমি অনেক কবি লেখকের কাছেই ঘেঁষতে চাই না ওদের কথার জ্বালায়। ঠোঁটের স্মিত হাসিটুকু সম্বল করে আমি ধনের ধনচর্চা মনচর্চা জনচর্চা শ্রবণ করে সেঁজুতির যেটকুু ছাপা হয়েছে তা নিয়ে চলে আসি বাড়িতে, প্রুফ দেখে আবার পরদিন দিয়ে আসি। ছাপাখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আমার ভাব হতে থাকে। ছাপাখানায় ঢুকলে, লক্ষ করি, ওদের মুখে প্রশান্তির ছাপ।কি আপা কেমন আছেন? আমাকে প্রতিবারই জিজ্ঞেস করেন কালিঝুলিমাখা শ্রমিকেরা। ধন না থাকলেও আমাকে বসতে দিয়ে চা নিয়ে আসে আমার জন্য। কাছ থেকে শ্রমিকদের কাজকর্ম দেখি, মেশিনগুলো কি করে চালাতে হয় শিখে নিয়ে নিজের হাতে চালাই। শ্রমিকেরা আমার কাণ্ড দেখে হাসে। কালি আমার গায়েও লাগে। ছাপাখানার বিষয়টি আমার কাছে আর দুবোর্ধ ্য বলে মনে হয় না। সেঁজুতি যেদিন ছাপা হল, মস্ত প্যাকেট গুলো রিক্সায় তোলার আগে ধনকে ছাপার খরচ দিতে গেলে তিনি বললেন, আপনার মনে হয় টাকা বেশি হইয়া গেছে। যান যান। ওই কয়টা টাকা না নিলে আমি না খাইয়া মরব না। চতুথর্ সংখ্যা সেঁজুতি ছাপা হয়ে বেরোলো, পঈচ্ছদ শাদা, ভেতরে সবুজ। পঈচ্ছদের কাগজ বাড়তি যা ছিল তা দিয়ে সেঁজুতির প্যাড বানিয়ে নিয়ে আসি। কাগজের ওপরে ডানপাশে তসলিমা নাসরিন, অবকাশ, ১৮, টি এন রায় রোড, আমলাপাড়া আবাসিক এলাকা, ময়মনসিংহ। আমলাপাড়ার লেজে এখানকার কোনও বাসিন্দা আবাসিক এলাকা জুড়ে দেয় না, এটি সম্পণূর্ ই দাদার তৈরি। ঢাকার ধানমণ্ডির মত বড়লোকদের এলাকাকে আবাসিক এলাকা বলা হয়, আমলাপাড়ায় দোকান পাট নেই, লোক বসতি কেবল, এটিকে কেন আবাসিক এলাকা বলা হবে না! যুক্তি আছে বটে।

সেঁজুতি দিকে দিকে বিলি হয়ে যাওয়ার পর আবার অস্থির হই। কিছু একটা না করলে চলে কি করে। শতাব্দী চত্রে²র সদস্যদের ডেকে বলি, চল এবার একটা অনুষ্ঠান করি, নবীন বরণ অনুষ্ঠান। নতুন ছাত্র ছাত্রীরা ঢুকছে কলেজে, তাদের বরণ করব। কি হবে অনুষ্ঠানে? সব হবে, নাচ হবে, গান হবে, কবিতা হবে, নাটক হবে। কাজ ভাগ করে দেওয়া হল সদস্যদের, মঞ্চ সাজাও, মাইক ভাড়া কর, নিমনণ্ত্র পত্র ছাপাও, বিলি কর, প্রচণ্ড উৎসাহে ওরা নেমে পড়ল কাজে। অনুপম মাহমুদ টিপু বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিত, সিনেপত্রিকায় লিখত, মিষ্টি মিষ্টি হাসে, হাতের লেখাও চমৎকার, ছবি আঁকেও ভাল, নামল মঞ্চ সাজাতে। আমার সঙ্গে মুমিনুন্নিসায় পড়ত উজ্জ্বলা সাহা, গান গাওয়ার অভ্যেস আছে, ওকে ধরলাম উদ্বোধনী সঙ্গীত শোনাতে। অনুষ্ঠানের মহড়া শুরু হয়ে গেল, কেউ নাটক করছে, কেউ কবিতা, কেউ আবৃত্তি, কেউ গান। ছাত্র সংসদের সভাপতি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ছাত্র সংসদের আগে কোনও দল নবীন বরণ করতে পারবে না। আগে সংসদ করবে, তারপর অন্যরা। এমন ক্ষুদ্র একটি দলকে ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই! দুচারটে তর্কসুরে বাক্য বিনিময়ের পর শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে সংসদকে পা বাড়াতে দিই আগে। দ্বিতীয় নবীণ বরণ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শতাব্দির। অনুষ্ঠানের আমনণ্ত্র পত্র ছেপে আনি। এনাটমির অধ্যাপক হারুণ আহমেদকে বলা হল সভাপতি হতে, তিনি এক পায়ে খাড়া, তাঁরও নাকি কবিতা লেখার অভ্যেস আছে, অনুষ্ঠানে কবিতাও পড়তে চাইলেন একটি। শুনেছি নির্মলেন্দু গুণ এ শহরেই আজকাল থাকেন, নীরা লাহিড়ী, গুণের বউ, আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়েন, কলেজের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। সেওড়াতলায় আঁতিপাঁতি করে খুঁজে গুণের বাড়ি পাওয়া গেল, বর্ষার জলে ঘর ডুবে আছে, বারান্দায় একটি চেয়ারে পা তুলে বসে কানে ছোট্ট একটি রেডিও চেপে ক্রিকেট শুনছিলেন তিনি। ঘরময় জল, আমন্ত্রণপত্রখানা তাঁর হাতে ধরিয়ে, শতাব্দির অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার অনুরোধ করে চলে এলাম। নির্মলেন্দু গুণ থাকতে ঢাকা থেকে কবি আনার কোনও প্রয়োজন নেই। নাটকের জন্য ছোটদার বন্ধু ফরিদ আহমদ দুলালকে ধরলাম, তিনি কথা দিলেন একটি একক নাটক করে দেবেন অনুষ্ঠানে। অস্থির লাগছিল কী হয় কী হয়, আদৌ কোনও দর্শক আসে কি না। কিন্তু বেশ দর্শক এল, অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কেউ বলল চমৎকার, কেউ বলল কবিতা আরও কমিয়ে দিলে পারতে, নাটকটা শেষে না রেখে মাঝখানে রাখলেই হত, কেউ কেউ বিষম উত্তেজিত, শতাব্দির পরের অনুষ্ঠান কবে হচ্ছে? সে জানি না কবে, ভাসছি তখন উতল হাওয়ায়, শরতের মেঘের মত হৃদয়ের সবটা আকাশ জুড়ে উজ্জ্বলার গাওয়া আনন্দধারা বহিছে ভুবনে র সুর।

 

ঢাকা থেকে গীতা চিঠি লিখল ছোটদাকে ঢাকা যেতে। ছোটদার নাকি কোথায় চাকরির ইন্টারভিউ আছে। ছোটদা আথিবিথি দৌড়ে ঢাকা গিয়ে সাতদিন পর ফিরলেন অবকাশে। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর তাঁর চাকরি হয়ে গেছে। আমানুল্লাহ চৌধুরির অবদান এই চাকরি। তিনি বিমানের কর্তাব্যক্তিদের না ধরলে এ চাকরি হত না। ছোটদার মুখে আমানুল্লাহ চৌধুরির মত লোক হয় না ফুটতে থাকে খইএর মত। বাংলাদেশ বিমানে স্টুয়ার্ট হওয়ার ট্রেনিং নিতে তিনি ঢাকা চলে যাবেন, ওখানে বাড়ি ভাড়া নেবেন, ওখানেই থাকবেন। বিদায় অবকাশ, বিদায় বাবা মা, বিদায় ভাই বোন। বিদায় বলতে ছোটদার কণ্ঠ কাঁপে না, কিন্তু বিদায় শব্দটি শুনলে মাথা ঝিমঝিম করে আমার, বুকের ওপর দিয়ে এমন বোধ হয় যে একশ ঘোড়া দৌড়োচ্ছে, শব্দটি শুনলে একটি দৃশ্যের মধ্যে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, ধু ধু মরুভূুমি জুড়ে কোথাও কেউ নেই, কেবল একা আমি। এক গণ্ডূষ পানি পেতে চাইছি, একটি গাছের ছায়া চাইছি, একটি কোনও মানুষ দেখতে চাইছি, কিন্তু পাচ্ছি না কিছুই। কিন্তু ছোটদার মুখে হাসি লেগে থাকে। তিনি নিরলস বর্ণনা করতে থাকেন স্টুয়ার্টের মাহাত্ম্য।

বাবাকে খবর দেন মা, কামাল চাকরি পাইছে।

চাকরি আবার ও পায় কি কইরা? ও ত অশিক্ষিত। লেখাপড়া করে নাই। বাবা বললেন।

লেখাপড়া ওর কপালে নাই। ছোট বয়সে বিয়া করছে। এখন সংসার করতে চায়। চেষ্টা ত অনেক করছেন, ওর ত লেখাপড়ায় মন বইল না।

চাকরিডা কিয়ের শুনি? বাবা উৎসুক।

বিমানের ক্রু খুব নাকি ভাল চাকরি, বিদেশ টিদেশ যাইতে পারব।

হায় রে ভাগ্য আমার, বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এক ছেলেরে মেডিকেলে পড়াইতে চাইলাম, চান্স পাইল না। ইউনিভার্সিটিতে মাস্টাসর্ পড়তে গেল, মাস্টার্স পরীক্ষা না দিয়া বাড়িত ফিইরা আইল। আরেক ছেলে মেট্রিকে স্টার পাওয়া, সে লেখাপড়া ছাইড়া দিয়া অহন মানুষেরা ভাত খাওয়ানোর চাকরি লইছে, প্লেনে বইয়া মাইনষে হাগব, মুতব, বমি করবে, আমার ছেলে ওইগুলা পরিষ্কার করব। এই চাকরি করার জন্য আমি তারে পাঁচটা মাস্টার রাইখা পড়াইছি? এই চাকরি করার জন্য সে মেট্রিকে স্টার পাইছিল? ভালই, ডাক্তার রজব আলী, মানুষে জিগাস করবে, তোমার দুই ছেলে কি করে, বলতে হবে এক ছেলে ঘুইরা বেড়ায়, আরেক ছেলে উইড়া বেড়ায়।

ছোটদার সঙ্গে আমার সখ্য যখন খুব, ছোটদা বিদায় নিচ্ছেন, চন্দনাও নিয়েছিল যখন চন্দনাই ছিল আমার এক এবং অদ্বিতীয় জগত। আমিই একা পড়ে থাকি যেখানে ছিলাম, সবাই আসে আর যায়। ছোটদা কথা দেন তিনি প্রায়ই ময়মনসিংহে আসবেন, প্রায়ই আমাকে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যাবেন। ঢাকা যাওয়ার সুযোগটি হয়েছে জেনেও আমার মন কেমন করা দূর হয় না। আমি মার মত হয়ত চিৎকার করে কাঁদি না, কিন্তু কাঁদি, গোপনে গোপনে কাঁদি।ছোটদার সঙ্গে আমার এমন নিবিড় সম্পর্কের কারণ,সাহিত্য। দাদার সাহিত্যজ্ঞান রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলে সীমাবদ্ধ, সাহিত্যাঙ্গনে নাটকাঙ্গনে সঙ্গীতাঙ্গনে ছোটদার টই টই ঘোরাঘুরির কারণে বা অন্য যে কারণেই হোক ছোটদার সাহিত্যজ্ঞান বিস্তৃতি পেয়েছিল, তাই তাঁর সঙ্গই আমাকে আনন্দ দিয়েছে বেশি। থানইটের মত মোটা উপন্যাসও দুজন পড়েছি একসঙ্গে। আমি পড়েছি ছোটদা শুনেছেন, ছোটদা পড়েছেন আমি শুনেছি। আমি শ্রোতাও যেমন হারাতে যাচ্ছি, পড়ুয়াও। হারাতে যাচ্ছি ছোটদার সঙ্গে গানের নাচের নাটকের কবিতার সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। ছোটদার, লক্ষ করি, কোনও হারানোর ব্যথা নেই, বরং পাওয়ার আনন্দ। তিনি পেতে যাচ্ছেন ঢাকায় চাকরি, ভাল চাকরি, সচ্ছল সংসার,আলাদা সংসার। এতকাল অনিশ্চিতের সঙ্গে বসবাসের পর তিনি পেতে যাচ্ছেন নিটোলনিপাটনিশ্চিতি।

 

হাবিবুল্লাহর মত আরেকজন আমার পথ আটকাল একদিন, তবে বন্ধু হতে নয়, উদ্দেশ্য অন্য। কলেজ চত্বরেই, শ্যামগঞ্জীয় উচ্চারণে জানাল সে শফিকুল ইসলামের ভাই, ভাইয়ের মত সেও কবিতা লেখে, কলেজের নতুন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে, আমাকেও চাচ্ছে দাঁড়াই।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

আমি রাজনীতি করি না।

রাজনীতির কোনও প্রশ্ন নাই। তুমি সাহিত্য সদস্য পদে দাঁড়াইবা, কলেজ ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্বে থাকবা, ফাংশান টাংশান করবা, এইসব। তুমি হইলা যোগ্য। ভোট চাইতে হয় তো! আমি ওগুলা পারব না।

ভোট চাইতে হইব না তোমার। তুমি এমনিতেই জিতবা। আরে পুরা প্যানেল, চোখ বন্ধ কইরা কইয়া দিতে পারি, জিতব।

ভোট চাইতে হবে না তো?

না মোটেও না।

ঠিক আছে।

আমি চত্বর থেকেই বাড়ির উদ্দেশে রিক্সা নিই, পেছনে ঝলকাতে থাকে হেলিমের আকর্ণবিস্তৃত হাসি, কালো মুখে শাদা দাঁত।

পরদিন হাবিবুল্লাহ আমাকে খপ করে ধরল, থমথমে মুখ, কি ব্যাপার, তুই বি এন পি করস জানতাম না তো!

আমি বি এন পি করি, কে বলল?

সবাই বলতেছে।

সবাই কারা?

সবাই কারা জানস না? তুই নির্বাচন করতেছিস বি এন পি থেকে? ঠিক কি না? ওই কথা! হ্যাঁ ঠিক, কিন্তু আমি কোনও দল করি না।

বিএনপির মত খারাপ দল আর আছে কোনও! ছাত্ররা সরকারি দল করে, সুবিধা আদায়ের তালে থাকে।

কী সুবিধা?

কী আর! পরীক্ষা পাশ। হাবিবুল্লাহ এপ্রোন খুলে ঘাড়ে ঝুলিয়ে বলল, তুই আজকেই নাম কাটা, দাঁড়াবি, জাসদ থেকে দাঁড়া।

হাবিবুল্লাহ নিজে জাসদ-ছাত্রলীগ করে, হাবিবুল্লারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাহমিদ, সেও জাসদ, চশমা চোখের ভাল ছেলে, ছুটে এল, হাবিবুল্লাহকে নাকি বলেওছিল যদিও আমি কোনও দল করি না, জাসদ থেকে সাহিত্য সদস্য কেন, সাহিত্য সম্পাদক পদে দাঁড়াব কি না, যদিও নিচের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের করলে সদস্যই করা হয়, কিন্তু আমার বেলায় জাসদ উদার হবে। তাহমিদ জাসদ করা ছাত্রদের একটা তালিকা দেখাল, বলল এরা সব স্ট্যান্ড করা ছাত্র। আর বিএনপির আনিস-রফিক? চার পাঁচ বছর ধরে এক ক্লাসেই পড়ে আছে। জাসদ করা মানে তখন জাতে ওঠা। ছাত্রলীগেও দেখি এক পাল ফেল করা ছাত্রের ভিড়। ভাল ছাত্র ছাত্রীরা হয় জাসদ-ছাত্রলীগ অথবা ছাত্র ইউনিয়ন করে, নয়ত কোনও দলই করে না।

আমি সেদিনই হেলিমকে খুঁজে বের করে বলি আমার নামটা কেটে দেন, আমি নির্বাচন করব না।

কেন কি হইছে?

আমি রাজনীতির কিসু বুঝি না। ছেলেরা বলতেছে আমি নাকি বিএনপি করি।

আরে বোকা মেয়ে, জাসদের পোলাপানরা তোমার মাথাটা বিগড়াইয়া দিতাছে। বিএনপি কর না। কিন্তু বিএনপি থেকে দাঁড়াইতেছ যেহেতু বিএনপি জিতবে এইবার, দাঁড়াইতেছ কলেজের স্বাথের্, পার্টির স্বাথের্ না। সোজা কথাটা কেন বুঝতে পারতেছ না? আর যদি এখন ছাত্রলীগ বা জাসদ থেকে কনটেস্ট কর, জেতার কোনও প্রশ্ন আসে না।

আমি চপু হয়ে থাকি। গলায় স্বর ওঠে না, স্পষ্ট বুঝতে পারি, বড় একটি শক্ত না ছুঁড়ে দিলে হেলিমের মন খারাপ হবে, কারও মন খারাপ করে দিতে আমার অস্বস্তি হয় খুব। আমি হেলিম হয়ে নিজের দিকে তাকাই।

আর তাছাড়া লিফলেট ছাপা হয়ে গেছে। এখন কোনওমতেই কিসু ক্যানসেল করা সম্ভব না। স্ক্যান্ডাল হইয়া যাবে।

আমাকে আরও চুপ হয়ে যেতে হয়। রফিক চৌধুরী আর আনিসুর রহমান ছাত্রদলের বড় দুজন নেতা আমার বাড়ি গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বুঝিয়ে আসেন, আমি নির্বাচনে দাঁড়ানো মানে রাজনীতি করা নয়, কলেজের সাহিত্যসেবা করা।

নতুন নির্বাচনের মরশুম শুরু হল। সারা কলেজের দেয়ালে পোস্টার। মঞ্চে গরম গরম বক্তৃতা, ক্লাসের বেঞ্চে লিফলেটের ছড়াছড়ি, একটু পর পর বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিরা ক্লাসে করিডোরে ক্যান্টিনে দেখা করছে, হেসে কথা বলছে, ভোট চাইছে। প্রতিটি দলের প্রতিটি ভোটপ্রার্থীকেই মনে হয় ভোট দিই। ছাত্রদলের সভাপতি আনিসুর রহমান আমাকে চা খাইয়ে, এক গাল হেসে বলেন, চল নির্বাচনী প্রচারণায়।

অসম্ভব।

রফিক চৌধুরি বললেন পার্টির মেয়ে, এত লাজুক হলে চলবে!

পার্টির মেয়ে আমি! অন্যরাও বলাবলি করে। এ রইল আমার গায়ে সেঁটে। যাই হোক, নির্বাচনের দিন কলেজে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ আর জাসদের ভাল ভাল ছেলেমেয়েদের, যাদের যোগ্য মনে হয়েছে, বিভিন্ন পদে, ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরদিন খবর পেলাম, ছাত্রদল মানে আনিস রফিক পরিষদ পুরো প্যানেল জিতেছে। গতবার জিতেছিল ছাত্রলীগ, এবার ছাত্রদল। এখন কি কাজ? ঢাকায় যেতে হবে, দেশের প্রেসিডেন্টর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

নিস্প্রভ ছিলাম। ঢাকা যাওয়ার কথায় প্রাণ ফিরে পাই। দল বেঁধে ঢাকা যাওয়া হল বাসে। দল বেঁধে একই বাসে ফেরাও হবে। ঢাকা আমাকে কাপাঁয় তীব্র উত্তেজনায়। রুদ্রর সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনা। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হেলিম আমাকে ছোটদার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় রাতে। মুহম্মদপুরের আজম রোডে একতলা হলুদ বাড়িতে থাকেন ছোটদা। ফকরুল মামার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন তিনি। ফকরুল মামা ঢাকার গ্রাফিকস আর্টসে লেখাপড়া করে ছোটখাটো চাকরি করছেন। ছোটদার ঘর সংসার দেখে আমার ভালও লাগে, আবার কষ্টও হয়। কষ্ট হয় ছোটদা অবকাশ ছেড়ে অত দূরে থাকেন বলে। ভাল লাগে, ছোটদার স্বপ্ন সফল হয়েছে বলে, একটি ভাল চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন। চাকরিটি নিয়ে ছোটদার উচ্ছঅ!স খুব, এমন ভাল চাকরি নাকি আর হয় না। তিনি যখন তখন বিদেশ যেতে পারবেন, টাকাও নাকি প্রচুর। আমাকে তিনি পরদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন, ডাক্তারটি আবার ছোটদার বন্ধু ময়মনসিংহের অলি গলিতে যেমন ছোটদার বন্ধু ঢাকার অলিগলিতেও। ভীষণ কষ্ট দিয়ে আমার একটি দাঁত তুলে ফেলল বন্ধুটি।। দাঁত নিয়ে ছোটদা সবসময়ই বড় সচেতন। তিনি যখন প্রথম জ্যামিতিবক্স পেয়েছিলেন ইশকুলের বড় ক্লাসে পড়ার সময়, কাঁটা কম্পাসে ঢুকিয়ে আমার দাঁতের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা মাংস এনে দিতেন আর বলতেন, দাঁত পরিষ্কার না করলে দাঁত সব পইরা যাইব কইলাম। সেই দাঁত সচেতন ছোটদার চাপে আমার ভাল দাঁতও মনে হয় দাঁতের ডাক্তার তুলে ফেলার প্রেরণা পায়। পচা দাঁত থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল, ছোটদা নাক কুঁচকে বলেন। তুলে ফেলা দাঁতের গোড়ায় তুলো চেপে বাড়ি ফিরি। ঢাকা এসেছি অথচ রুদ্রর সঙ্গে দেখা হবে না—দাঁতের কষ্টের চেয়ে এই কষ্টটি আমাকে ভোগায় বেশি।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে ফিরে বাড়ির সবাইকে তারস্বরে জানিয়ে দিলাম, জিয়াউর রহমানের সাথে হ্যান্ডসেক কইরা আইছি, আমার হাতের হাড্ডিা ভাইঙ্গাই যাইতাছিল, এমন জোরে চাপ দিছে হাতে।

আর্মি মানুষ তো! শইলে জোর বেশি। মা বললেন।

মা সরে যান, মার নিস্পৃহ মখু টি চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকে, মার নিরুত্তাপ শব্দগুলোও। মনে মনে ভাবি জোর নিশ্চয়ই বেশি। জোর বেশি বলেই তিনি জোর খাটিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বিমান বাহিনীতে জিয়ার ওপর অসন্তোষ গোপনে গোপনে বেড়েছিল, যে কোনও সময় একটি ক্যু হতে পারে আঁচ করে হাজার হাজার বিমানবাহিনীর লোককে নির্বিচারে হত্যা করেছেন। গর্তে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসন দিয়েছেন। শাহ আজিজের মত দেশের শত্রুকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এদেশে, সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন। এখন গতর্ থেকে বেরিয়ে এসেছে সাপগুলো আবার ছোবল দেবে বলে যেভাবে দিয়েছিল একাত্তরে, যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ হয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। সংবিধানকে বাপের সম্পত্তি মনে করে নিজে হাজম হয়ে মুসলমানি ঘটিয়েছেন সংবিধানের। কোরান পড়তে গেলে যে বিসমিল্লাহির রাহমান ইররাহিম অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি বলতে হয়, তা বসিয়েছেন সংবিধানের শুরুতে। দেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষকে জুতো পেটা করলেও বুঝি এর চেয়ে বেশি অপমান করা হত না। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। জোর তো তার বেশিই। হাতটি আমি গোসলখানায় গিয়ে সাবান দিয়ে ধুই, যেন যায়, যেন একটি কালো স্পর্শ আমার হাত থেকে মুছে যায়।

রুদ্র ময়মনসিংহে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলল, তোমার মাথামুণ্ডু আমি বুঝি না, তুমি নাকি বিএনপি থেকে নির্বাচন করেছ? আমাকে আগে জানাওনি কেন?

জানাইনি।

কেন জানাওনি?

সব কথা জানাতে হবে নাকি!

জানাতে হবে না?

না।

ঠিক আছে, যা ইচ্ছে তাই কর। মান সম্মান তুমি আর রাখলে না!

 

নির্বাচনের হল্লা শেষ হতে না হতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। তলপেট থেকে আমার বুকে উত্তরণ ঘটেছে। মরা মানুষ কাটতে হচ্ছে একদিকে। আরেকদিকে ট্রেতে করে ফরমালিনে ভেজা হৃদপিণ্ডের আগাগোড়া পড়তে হচ্ছে। মরা মানুষ কেটে বাড়ি ফিরে যখন খেতে বসি, হাতে গন্ধ লেগে থাকে, আস্ত সাবান খরচ করে হাত ধুলেও হাত থেকে গন্ধ যায় না। গন্ধের সঙ্গে বসবাসের অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একদিন তো খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখি হাতের কিনারে মরা মানুষের মাংস লেগে আছে, হাত ধুতেই ভুলে গিয়েছিলাম খাবার আগে। আর পকেটে করে যেদিন হৃদপিণ্ড বাড়ি আনলাম পড়তে, বাড়ির সবাই জিনিসটি দেখল, নাক চেপে, মুখ চেপে, বিস্ফারিত চোখে। আমি দিব্যি হৃদপিণ্ডটি টেবিলের ওপর রেখে কানিংহামের বই খুলে পড়তে শুরু করলাম, ওদেরও দেখাতে থাকি এই হচ্ছে এট্রিয়াম, আর এই হচ্ছে ভেন্ট্রিকেল, এই এখান দিয়ে রক্ত আসে, ওপর থেকে নিচে, তারপর নিচ থেকে রক্ত চলে যায় ওপরে, চলে যায় সারা শরীরে। মার দু চোখে অপার আনন্দ।

এই তো মা আমার ডাক্তার হইয়া গেল, আমার আর চিন্তা কি, আমার চিকিৎসা আমার মেয়েই করবে। মা বলেন।

দাদার প্রশ্ন, এইটা পুরুষের হার্ট নাকি মেয়েমানুষের?

তা জানি না।

দেইখা ত ছোট মনে হইতাছে,মনে হয় কোনও মেয়ের হার্ট।

মেয়েদের হার্ট ছোট হয় তোমারে কে কইল!

একটু ডিফারেন্ট থাকবে না!

না, ডিফারেন্ট থাকবে না।

ইয়াসমিন হৃদপিণ্ডকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে বলে, বুবু এইটারেই কি হৃদয় কয়?

হৃদয় হয়ত কয়। কিন্তু এইটা হৃদপিণ্ড, হৃদয় না। হৃদপিণ্ডের কাজ রক্ত পাম্প করা, সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করা।

তাইলে হৃদয় কোনটা?

হৃদয় হইল মাথা। ধর আমার কাউরে ভাল লাগল, আমার স্নায়ুতন্ত্রে খবর হবে প্রথম। স্নায়ুর ঘর বাড়ি হইল মাথায়, বুকে না। বুকে যে ধ্বক শব্দ হয়, সেইটা মাথার স্নায়ুতে নড়চড় হয় বইলা।

ইয়াসমিন অবিশ্বাসী চোখে তাকায় পিণ্ডটির দিকে।

হাবিবুল্লাহর সঙ্গে জড়তা ঝেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলে,একটি সহজ এবং য়চ্ছন্দ সম্পর্কে গড়ে তুলে, ছেলে মেয়েতে যে বন্ধুত্ব হতে পারে এবং তা যে কেবল চিঠিতে নয়, তা প্রমাণ করে আমার আনন্দ হয়। অবকাশে হাবিবুল্লাহর অবাধ যাতায়াত ক্রমে চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। এই সম্পর্কটি ভবিষ্যতে স্বামী স্ত্রী পর্যন্ত গড়াবে এরকম একটি চিন্তা মাথায় এনে মা যখনই কোনও রকম স্বস্তি পেতে চান, মার অলীক কল্পনা ভেঙে দিয়ে বলি, হাবিবুল্লাহ হইল আমার বন্ধু জাস্ট বন্ধু আর কিছু না। চন্দনার সাথে আমার যেরকম বন্ধুত্ব, ঠিক সেইরকম বন্ধুত্ব, বুঝলা! আমার উত্তর মাকে খুব সুখী করে বলে মনে হয় না। হাবিবুল্লাহ দেখতে সুন্দর, নম্র ভদ্র, দুজনই আমরা ডাক্তার হতে যাচ্ছি, এর চেয়ে ভাল জুটি আর হয় না এধরনের কথা মা আমার কাছে না হলেও মিনমিন করে বাড়ির অন্যদের বলেন। আমার কানে সেসব শব্দের কণামাত্র এলে মাকে আমি ধমকে থামিয়ে দিই। আমি নিশ্চিত সম্পর্কটি কেবল নির্মল বন্ধুত্বের। হাবিবুল্লাহও নিশ্চিত। তার সঙ্গে এক রিক্সায় বসে কোথাও যেতে আসতে আমার কোনও রকম গা কাঁপে না। দাদার সঙ্গে বা ইয়াসমিনের সঙ্গে বা চন্দনার সঙ্গে রিক্সায় বসার মত। হাবিবুল্লাহ জানে যে রুদ্রর সঙ্গে একটি সম্পর্কে গড়ে উঠছে আমার, ফাঁক পেলেই রুদ্রর কবিতা তাকে শোনাই। কিন্তু আমাকে স্তম্ভিত করে হাবিবুল্লাহ একদিন সন্ধেয় বাড়িতে এসে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন শুরু করে।তুই সম্বোধন নাকি তার ভাল লাগে না! কেন ভাল লাগে না এই প্রশ্ন করে কোনও উত্তর নয়, একটি সলজ্জ হাসি জোটে। হাসিটির কোনও অনুবাদ করা আমার সম্ভব হয় না। হাসিটি আমাকে অস্বস্তি দেয়, একই সঙ্গে আতঙ্কও। সামনে থেকে উঠে যাই, শোবার ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি বিষণ্নতাকে দুহোতে জড়িয়ে। বৈঠক ঘরের সোফায় বসেই থাকে হাবিবুল্লাহ, দীর্ঘ একটি চিঠি লিখে ইয়াসমিনের হাতে দেয়। ইয়াসমিন ঘরে আলো জ্বেলে চিঠিটি আমাকে দিয়ে যায় পড়তে। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটির সারমর্ম এই, আমাদের এমন চমৎকার বন্ধুত্ব যে কোনও সময় হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যদি একটি স্থায়ী সম্পর্কে আসা যায়, তবে হারানোর প্রশ্ন ওঠে না। আর নিজেও সে ভেবে দেখেছে, নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করে দেখেছে, উত্তর একটিই আমাকে সে ভালবাসে। বন্ধুত্বের উর্ধে এই সম্পর্কটি কি আমি নিয়ে যেতে পারি না! চিঠিটি পড়ে আমি স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কুঁকড়ে যাই। অপমান আর লজ্জা আমাকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। নিজেকে ওই বেদনা থেকে টেনে নিয়ে একটি ত্রে²াধের পেছন পেছন আমি হেঁটে যাই বৈঠক ঘরে। চিঠিটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হাবিবুল্লাহর মুখের ওপর ছুঁড়ে চিৎকার করে বলি, এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বার হয়ে যা। এক্ষুণি। আমি যেন কোনওদিন তোর মখু না দেখি।

হাবিবুল্লাহ, নদ্র ভদ্র সুদর্শন, ডাক্তার হতে যাওয়া হীরের টুকরো ছেলে অনেকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর কলেজে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতে চেয়েছে সে,কোনও সুযোগ তাকে দিইনি। অনেকদিন বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছে, দরজা খুলিনি।

 

আবু হাসান শাহরিয়ার, ছড়া লিখে নাম করেছে, সেও আমার সঙ্গেই পড়ে মেডিকেলে। ওর সঙ্গে কখনও কথা হয়নি আমার। আমার এপ্রোনের পকেটে একদিন ও মরা মানুষের একখণ্ড মাংসের সঙ্গে একটি চিরকুট আমার অজান্তে ফেলে রাখে, চিরকুটে ছড়া। ভীষণ বিরক্ত আমি শাহরিয়ারের ব্যবহারে, সাহিত্যের জগতের কেউ যে এত বদ হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বদ ছেলেটি এর কদিন পরেই মরা কাটায় অতিষ্ঠ হয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ছেলে বদ হোক আর যা-ই হোক, ডাক্তারি বিদ্যা ছেড়েও যে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যায় তা আমার বিশ্বাস হয়। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, সে আমি ভাল জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়ার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন সুব্রত চাকমার কারণে পূরণ হয়নি চন্দনার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে বলে ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যখন যোগাড় করছিল, ওর মেট্রিকের মার্কসিট তোলা ছিল না বলে আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনে, যেটি সম্প্রতি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে রূপ নিয়েছে, গিয়ে মার্কসিট যোগাড় করে ওকে পাঠিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দনা এ মাসে ভর্তি না হলেও আগামী মাসে হবে এরকম যখন খবর, ওকে উপজাতির কোটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন সুব্রত চাকমা, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে। চন্দনা চট্টগ্রাম থেকে লিখছে, ওর মড়া কাটতে ভাল লাগে না। কুমিল্লায় ফেলে যাওয়া কোনও এক সুদর্শনএর কথা ও গভীর করে ভাবছে, সেই সুদর্শন চিঠি লিখেই যাচ্ছে চন্দনাকে, চন্দনাকে ছাড়া সে বাঁচবে না জাতীয় চিঠি। মড়ার গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে জীবিতর ঘ্রাণ নিতে চন্দনাও এক রাতের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম ছেড়ে কুমিল্লা চলে যায়। কুমিল্লা থেকে হঠাৎ একদিন জানায় ও বিয়ে করেছে ওই বাঁচবে নাকে। এর চেয়ে যদি খবর পেতাম, চন্দনা মরে গেছে, আমার বিশ্বাস হত। বিয়ে আর যে কাউকে করা মানায়, চন্দনাকে নয়। এর চেয়ে বড় কোনও দুঃসংবাদ পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। নিঃসঙ্গতার বিকট লোমশ হাত আমার কন্ঠ এমন সজোরে চেপে ধরে যে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। দৌড়ে ছাদে গিয়ে সকলের আড়াল করি নিজেকে। চন্দনাকে নিয়ে এক আকাশ স্বপ্ন ছিল আমার, সেই স্বপ্নের ওপর পুরো জগতটিকে দেখি ভেঙে পড়তে। ভাঙনের স্তুপে আমি শূন্য হাতে একা দাঁড়িয়ে আছি, একা, এত একা যে হঠাৎ নিজের কোনও অস্তিত্ব আমি অনুভব করি না, মাথার ওপর অন্ধকার আর শিশির ঝরে পড়ে ঝপু ঝপু করে, তারপরও না। মাস গেলে চন্দনার বাবা ডাক্তার সুব্রত চাকমার একটি চিঠি আসে আমার কাছে, আমাকেই লিখেছেন তিনি। চন্দনা তাঁকে যে অপমান করেছে, তার প্রতিশোধ তিনি যে করেই হোক নেবেন। চন্দনাকে এ পৃথিবীতে বাঁচতে দিতে তাঁর অন্তত কোনও ইচ্ছে নেই। আমি দুদিন ভয়ে কাঠ হয়ে থেকে সুব্রত চাকমাকে লিখি চন্দনাকে যেন তিনি ক্ষমা করেন, ও ভুল করেছে এ স্বীকার করেই বলি, নিশ্চয়ই একদিন বুঝতে পারবে নিজের ভুল। সুব্রত চাকমা আমার চিঠির কোনও উত্তর দেন না। কিন্তু আবারও মাস গেলে তাঁর একটি চিঠি পাই, তিনি আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন রাঙামাটিতে, চন্দনার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। নিজের মেয়ের শ্রাদ্ধ করছেন তিনি। জাতচ্যুত মেয়েকে তিনি মেয়ে বলে স্বীকার করেন না, বৌদ্ধ মেয়ে পালিয়ে গিয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে, এই মেয়ে মরে গেছে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। সুব্রত চাকমার এই ভয়াবহ সিদ্ধান্ত শুনে চন্দনার জন্য আমার বড় মায়া হতে থাকে। ইচ্ছে করে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে সেই সুদর্শন দুর্বৃত্তের কবল থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসি। মন বলে চন্দনা ভাল নেই। কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে। আমারও ভাল লাগে না সারাদিন লাশের গন্ধ আর ফরমালিনে ঝাঁজের মধ্যে মোটা মোটা বইয়ে ঝুঁকে থাকতে। কলেজে খারাপ ছাত্রী হিসেবে আমার নাম ছড়াতে দেরি হয় না।

বিপর্যস্ত আমি কলেজে যাই, আসি। একদিন কলেজের অধ্যক্ষ ফর্সা লম্বা হাসি মখু মোফাখখারুল ইসলাম আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে মুখের হাসিটি গিলে চোখের জ্যোতিটি নিভিয়ে খাম খুলে একটি টাইপ করা চিঠি হাতে নেন। চিঠিটি আমি চিনি। এ চিঠির একটি কপি আমি কদিন আগে পেয়েছি।

তুমি তো ডাক্তার রজব আলীর মেয়ে, তাই না?

আমার কণ্ঠে কোনও স্বর ওঠে না। মাথা নাড়ি।

আমার স্বর না ওঠা কণ্ঠের দিকে, আমার ভয়-লজ্জার নতচোখে তাকিয়ে মোফাখখারুল ইসলাম তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব কর্কশ করা যায় করে বলেন, তোমার ভাই এর নাম কি নোমান?

আমি মাথা নাড়ি।

আরেক ভাইএর নাম কি কামাল?

এবারও মাথা নাড়ি।

কামালের বউএর নাম কি গীতা?

এবারও মাথা।

তোমার ছোট বোনের নাম ইয়াসমিন?

মাথা।

মাথা মোফাখখারুলও নাড়েন। এর অর্থ হাতে ধরে রাখা চিঠিটির সত্যতা তিনি যাচাই করতে পেরেছেন। চিঠিটি, মোফাখখারুল ইসলাম জানেন না, যে আমি আগেই পড়েছি। আবদুর রহমান চিশতি নামের মাথা খারাপ একটি লোক আমাকে নিজেই এই চিঠির কপি পাঠিয়েছে। লোকটি দিস্তা দিস্তা চিঠি পাঠাতো আমাকে। শখের পত্রমিতা হয়েছিল কদিনের জন্য। ওসব দিস্তা দিস্তা পাতার চিঠিতে রূপকথা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বাণিজ্যনীতি সম্পর্কে কঠিন কঠিন রচনা থাকত। বেশির ভাগই আমার পড়া হত না। সেই লোক হঠাৎ একদিন প্রেম নিবেদন করে বসার পর আমি চিঠি লেখা বন্ধ করে দিই। তারপরই এই হুমকি। আমি যদি সাড়া না দিই, তবে আমার ক্ষতি করবে সে এভাবে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে সরাসরি চিঠি লিখে জানাবে যে আমার বংশের সকলের চরিত্র থেকে দগুর্ ন্ধ বেরোয়। আমার বাবা শুয়েছে গীতার সঙ্গে, আমার বোন শুয়ে বেড়ায় এদিক ওদিক। আমি তো আছিই। আমি তো শুয়েছিই চিশতির সঙ্গে, কেবল তার সঙ্গে নয়, তার সব বন্ধর সঙ্গেও। আমার দুভাইএরও একই অবস্থা। মেয়ে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। শোয়। ইত্যাদি। কেবল শোয়াশোয়ির গল্প। মোফাখখারুল ইসলাম, আমি অনুমান করি, বিশ্বাস করছেন চিঠিটির প্রতিটি শব্দ।

বড় একটি শ্বাস ছেড়ে বলি, এটি একটি উড়ো চিঠি। এ চিঠির কথা আমি জানি। চিশতি নামের এক লোক এই চিঠি লিখেছে। লোকটিকে প্রস্তাবে আমি রাজি হইনি বলে শোধ নিয়েছে।

মাননীয় অধ্যক্ষের সারা মুখে বিদ্রূপ ঝলসাচ্ছে। ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি।

তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে কর তাই না? প্রশ্ন করেন।

আমি উত্তর দিই না।

তুমি কি মনে কর আমি কিছু বুঝি না?

আমি নিরুত্তর।

তোমার মত বাজে মেয়েকে আমি এই কলেজে রাখব না। টিসি দিয়ে দেব। শিগগিরি।

এবার আমি আমূল কেঁপে উঠি। সামনে দুলে ওঠে অধ্যক্ষের ঘর, অধ্যক্ষ, চিঠি। আমার সরল সত্য অধ্যক্ষ মেনে নেননি। মেনে নিয়েছেন একটি উড়ো চিঠি, যে চিঠিতে চিঠির লেখকের কোনও নাম নেই, কারও কোনও স্বাক্ষর নেই। যে চিঠির লেখককে অধ্যক্ষ চেনেন না, চেনেননা লোকটির কথাই তাঁর কাছে সত্য, চেনেন মেয়েটির কথা সত্য নয়। অধ্যক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে লক্ষ করি কারও সঙ্গে আমি কথা বলতে পারছি না, আমি আড়াল করতে পারছি না চোখের সজল যনণ্ত্রা। বাকি কোনও ক্লাস না করে সোজা বাড়ি ফিরি। শুয়ে থাকি দেয়ালের দিকে মখু করে বিছানায়। ইয়াসমিন এলে পুরো ঘটনা বলি। মোফাখখারুল ইসলামের মেয়ে শারমিন ইয়াসমিনের ক্লাসে পড়ে বিদ্যাময়ী ইশকুলে। খুব সহজ শারমিনের কাছ থেকে ওদের পরিবারের সবার নাম যোগাড় করা। এরপর খুব সহজ একটি চিঠি লেখা। খুব সহজ চরিত্রে কালিমা লেপা। খুব সহজ চিঠিটি ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া। এতে অন্তত উড়ো চিঠি কাকে বলে, এই শিক্ষাটি তিনি পাবেন। শিক্ষাটি দিতে কেবল হাত নয়, মন নিশপিশ করে। কিন্তু নাম যোগাড় হওয়ার পর চিঠিটি লিখতে গিয়েও আমি লিখি না। আমার রুচি হয় না লিখতে। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়.. বলে লিখতে যাওয়া চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলি।

কলেজে যাই যদিও, ক্লাসে মন বসে না। করিডোরে হাঁটতে গেলে মোফাখখারুল ইসলাম সামনে পড়লে যেন সামনে কোনও মানুষ পড়েনি, যেন ফাঁকা, এভাবে হেঁটে যাই। সাধারণত সামনে কোনও শিক্ষক পড়লে হাত তুলে সালাম দিতে হয়। নিয়মটি আমার কোনওদিনই ভাল লাগে না। আমি এমনিতেও ব্যাপারটি এড়িয়ে চলি। এড়িয়ে চলি বলে অভদ্র বলে আমার দুর্নাম রটে। সেই দুর্নামকেও পরোয়া করি না বলে আমি আপাদমস্তক একটি হাস্যকর বস্তু হিসেবে পরিচিত হই। পরীক্ষায় পাশ করতে হলে সালাম ছাড়া নাকি গতি নেই, এরকম ফিসফিস শুনি। ফিসফিস থেকে আমার নাক কান মখু মন সব সরিয়ে রাখি। জরুরি ক্লাস যা আছে করেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যাই। বইয়ের দোকান থেকে রাজনীতি সমাজ সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ের বই কিনে বাড়ি ফিরতে থাকি। বিকেলে ইয়াসমিনকে নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেতে থাকি, পাবলিক লাইব্রেরিতে ভাল ভাল আলোচনা অনুষ্ঠানে যাই। কিছু না কিছু থাকে প্রায়ই। আর কোথাও যাবার না থাকলে পদ্মরাগমণির বাড়ি গিয়ে কবিতা নিয়ে গল্প করি, নয়ত নাটকঘরলেনে ইশকুলের বান্ধবী মাহবুবার বাড়িতে উঠোনের রোদে শীতল পাটিতে বসে চা মুড়ি খেতে খেতে সহজ সরল জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলি, নয়ত নানিবাড়িতে রেললাইনের ওপারে সেই কতকাল আগে ফেলে আসা ছোট্ট চড়ুই ছানা, ছেঁড়া ঘুড়ি, নীল বেলুন, পানা পুকুর, পুঁতির মালার নিভৃত জগত থেকে ঘুরে আসি। মা বলেন, এইযে দুইটা মেয়ে এইরকম একলা একলা বাইরে যাস, মাইনষে কি কইব?

যা ইচ্ছা তাই কউক।

তগোর সাহস বেশি বাইড়া গেছে।

দোষ ত কিছু করতাছি না।

তর বাপ যদি জানে। ঠ্যাং ভাইঙা বাড়িত বওয়াইয়া রাখব।

ভাঙুক। বলে আমি মার সামনে থেকে সরে যাই। মার এই ঘ্যানঘ্যানে বড় বিরক্তি ধরে আমার।

 

চন্দনা আর আগের মত ঘন ঘন চিঠি লেখে না। যা লেখে তা শ্বশুর বাড়ির গল্প। আগের মত চন্দনা আর স্বপ্নের কথা বলে না। আর কবিতাও লেখে না। অনেক বদলে গেছে ও।

হালকা হালকা বন্ধুত্ব হওয়া ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আসে বেড়াতে, আড্ডা দিতে, খেতে। ঢাকায় বাড়িঘর ফেলে পারিবারিক পরিবেশ থেকে দূরে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করা এরা স্বাদ পেতে চায় কোথাও ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের, মায়ের হাতের রান্নার মত রান্নার। এদের সঙ্গে সময় উড়তে থাকে আমার।

আবারও কবিতায় পায় আমাকে। সেঁজুতি ছাপার নেশা দপদপ করে জ্বলে। অগুনতি সাহিত্য পত্রিকা, কবিতার খাতা আর সেঁজুতির পাণ্ডুলিপির ওপর বাবা একদিন বস্তা উপুড় করে এক শরীর হাড়গোড় ঢেলে বললেন যা দেখতাছি, দশ বছরেও তর মেডিকেল পাশ হইব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *