ফুলশয্যা
পুকুর দেখেছি, নদী দেখেছি, সমুদ্র দেখা হয়নি কোনওদিন। বউ নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা করে আসার পর দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদা গো সমুদ্র দেখতে কেমন! দাদা একটি কথাই বলেছেন,না গেলে বুঝবি না। সমুদ্র কেমন সে কথা কখনও বইলা বুঝানো যায় না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়া উপলব্ধি করতে হয় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দাদার উড়োজাহাজ নিয়ে। উড়োজাহাজে প্রথম চড়েছেন তিনি। ছোটদা উড়োজাহাজের গল্প করলে দাদা এতকাল তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। নয়নের সেই তৃষ্ণা দাদার ঘুচেছে এখন। আমার অবশ্য কিছুই ঘোচেনি। উড়োজাহাজের চেয়ে সমুদ্র দেখার উৎসাহটিই আমার বেশি।
সমুদ্রপাড়ে তোলা দাদা আর হাসিনার ছবি দেখে, সমুদ্র না দেখেই লিখে ফেলি সমুদ্র নিয়ে তিনটে কবিতা। না দেখা সমুদ্র যখন আমার হৃদয় জুড়ে, তখনই চল চল সমুদ্র দেখবে চল, কাপড় চোপড় গোছাও রব। চতথুর্ বষের্ এই একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে, এক ক্লাস ছাত্রছাত্রী নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষকরা দূরে কোথাও চলে যান, দূর বলতে দেশের মাথা থেকে লেজে যাওয়া, লেজের কাছে থই থই করছে রূপোলি জল, সেই জলে ডোবো, ভাসো। অবশ্য বলা হয় জলীয় আবহাওয়া দেখাতে নিচ্ছেন, আসলে এ অনেকটা হাওয়া বদলের মত, রোগীদের যেমন হাওয়া বদলের দরকার হয়, হবু ডাক্তারদেরও হয়। দিনরাত হাসপাতালের পুঁজ-গন্ধময় হাওয়া থেকে খানিকটা নিস্তার পাওয়া হয়।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে কক্সবাজার। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল, হইচইই বটে, এমন তো কখনও ঘটে না, আত্মীয় কাউকে না নিয়ে দূরের কোনও শহরে চলে যাওয়া। মা বার বার জিজ্ঞেস করলেন মাস্টাররা থাকবে তো! দুঘন্টার পথ ঢাকা, ঠিক আছে মানায়, ঢাকায় আত্মীয়ও আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তো আমার মামাও থাকে না কাকাও না। মামা কাকার সীমানার বাইরে বলেই সম্ভবত পেখম মেলে একশ ময়ূর নাচে হৃদয়ে। বাবা দরাজ হসে ্ত দিয়েছেন টাকা, হাইজিন ট্যুরের চাঁদা তো আছেই, বাড়তি টাকাও। ট্রেনে চড়ে দলের ঢাকা যাত্রা হয়। সেগুনবাগিচা ছেড়ে ছোটদা এখন নয়াপল্টনে বাড়ি ভাড়া করেছেন। নয়াপল্টনে একরাত থেকে পরদিন কমলাপুর রেলইষ্টিশনে পৌঁছতে হবে সকাল আটটায়। রাতে গীতার কাছে শাড়ি চাইতেই আলমারি খুলে বিছানায় লাল নীল সবুজ হলুদ কাতান সিল্ক এমনকি মসলিন বিছিয়ে দিল পছন্দ করে নিতে একটি নয়, যত খুশি। বোতাম টিপলে আলো জ্বলে এমন একটি ক্যামেরাও মিলল। আর কি চাই! আশাতীত পাওয়া আমার।
পরদিন ট্রেনে চড়ে কখনও হৈ হল্লায় মেতে, কখনও জানালায় উদাস চোখ মেলে পৌঁছই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বনের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে সারি সারি রাবার গাছের বাগান পার হয়ে কক্সবাজার যখন পৌঁছই, উত্তেজনা তুঙ্গে। একটি শব্দ, ভীষণ এক শব্দ, অন্যরকম, মাটি কাঁপানো, জল কাপাঁনো, শব্দটির দিকেই বাস যেতে থাকে। ঠিক কোত্থেকে শব্দটি আসছে বুঝতে আমি চারদিক খুঁজি। বাসের জানালা থেকে কিছুতেই চোখ সরে না। দূরে একটি শাদা কিছু একবার উঠছে একবার নামছে। সাফিনাজ, হালকা হালকা বন্ধুত্ব অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হওয়া একজন, জানালায় ঝুঁকে বলল,ওইটাই কি সমুদ্র নাকি! কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে আমি, ইচ্ছে করে, বাস থেকে নেমে দৌড়ে যাই দেখতে ,যদি ওটাই সমুদ্র হয়, কিন্তু কে দেবে আমাকে ছুটে যেতে! আগে মোটেলে নামো, তারপর। মোটেলে দুজনের জায়গায় চারজনকে ঢোকানো হল এক ঘরে। বরাদ্দ ঘরে সুটকেস নামিয়ে রেখে আগে দৌড়ে যাই ওই শব্দের দিকে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। আগে আমি সমুদ্র দেখব তারপর অন্য কিছু সাফিনাজ পরিপাটি মেয়ে, খাওয়ার সময় খাওয়া পড়ার সময় পড়া ঘুমের সময় ঘুমের মেয়ে। ওকে যেতে হয় আমার উত্তেজনাকে সঙ্গ দিতে। সেই তীব্র র্গজনের দিকে হেঁটে নয়, দৌড়ে যাই। যখন পৌঁছই, বিস্ময় আর মগ্ধু তা আমাকে স্থবির করে রাখে, আমাকে নিস্পন্দ করে রাখে,আমাকে বিবশ করে রাখে। একটি শব্দ আমি আর উচ্চারণ করতে পারি না। এত বিশাল কিছু এত অদ্ভুত সুন্দর কিছু এত আশ্চর্য হৃদয়রঞ্জন কিছু আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। নানিবাড়ির ছোট্ট পুকুরের ধারে বড় হয়েছি, শহরের তিনকোনা পুকুর ছিল নানিবাড়ির পুকুরের চেয়ে দ্বিগুন, সেটি দেখতে যেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল কয়েকটি বছর, বড় হয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ জলের ধারা দেখেই মনে হয়েছে এর চেয়ে বিশাল কিছু বুঝি পৃথিবীতে নেই। আমার কল্পনায় ছিল সমুদ্র। সেই সমুদ্র এই সমুদ্রের সৌন্দর্যের ধারে কাছে আসতে পারে না। আমার অবাধ কল্পনা এত বিশাল কিছু এত আশ্চর্য সুন্দর কিছু এত কূল কিনারাহীন কিছু আমাকে দিতে পারেনি। আমি লক্ষ করি না আমার চোখ যে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। সূর্য ডুবছে সমুদ্রে। আমি তন্ময় হয়ে শব্দ শুনি সমুদ্রের, ভেজা চোখে সূর্যের ডুবে যেতে থাকা রূপ দেখি। সূর্যাস্ত আমি আগেও দেখেছি অনেক, এমন রূপ দেখিনি আগে। আমাকে বিহ্বল করে রাখে, বিমগ্ধু করে রাখে, বিমূঢ় করে রাখে প্রকৃতির এই অনিঃশেষ সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে দল বেঁধে আসতে থাকে ছেলেমেয়েরা, সূর্যাস্তের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এই সুন্দর থেকে কোথাও আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাত নেমে এলে সাফিনাজ আমাকে টেনে নিয়ে যায় মোটেলে, রাতের সৈকত নাকি নিরাপদ নয়। মেয়েরা সব চলে যায় মোটেলে, ছেলেরা পূর্ণিমা দেখবে বলে থেকে যায় অনেক রাত অবদি সৈকতে। আমার বড় ছেলে হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সারারাত সমুদ্র আর চাঁদের জলে ভিজি। মোটেলের ঘরের বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসে বসে একা একা সমুদ্রের ডাক শুনি। আয় আয় আয় বলে ডাকছে আমাকে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে সূর্যোদয় দেখব বলে দৌড়ে যাই সমুদ্রের দিকে। পরনে লাল একটি শাড়ি আমার। খালি পা। খোলা চুল। সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে নেয়। উঠি উঠি সূর্য আমার শরীরের জলের ফোঁটায় চুমু খায়। ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে আসে, ওদেরও বলি ঢেউএর সঙ্গে খেলা করতে। ওইতো ফেনিয়ে ওঠে শরীর ভাসিয়ে নেয় জোয়ারের ঢেউ, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে নেশা বলি, তীব্র তৃষ্ণা বলি। হৃদয় ভাসিয়ে নেয়, জীবন ভাসিয়ে নেয় মোহন ঘাতক, আয় আয় ডাকে আয়, সর্বনাশ তবু ডাকে আয় আয় আয়, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে সখু বলি, স্বপ্ন বলে ডাকি। সারাদিন সমুদ্রের জলে খেলা করি। আমাকে নেশায় পায়, ভালাবাসায় পায়। বিকেলে ঝুপড়ি দোকানে দারুচিনি চা পান করতে করতে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করি। নোনাজলে ঠোঁট রেখে উপচে পড়েছে দেখি আকাশে পূর্ণিমা, শরীরে উল্লাস নাচে,কাঁচা অঘ্রাণের ঘ্রাণ তুফান নামায়। ঘুম আয় ঘুম আয় হৃদয়ে সমুদ্র ডাকে আয় আয় আয়, শিয়রে সোনার কাঠি রাজকন্যা ঘুম যায় যাদুর পালঙ্ক।
সমুদ্র থেকে আমাদের নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। হালিদা, সাফিনাজ, শিপ্রা আর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঘুরে ফিরি সবুজ টিলার নিচে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নীল জলের ফয়েজ লেকের ধারে। ঘাসে বসে বালিহাঁসের পাখনা মেলে ওড়া দেখি। সব কিছুই আমার এত ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে রুদ্রর না থাকা আমাকে একটু একটু বিষণ্ন করতে থাকে। রুদ্র এলে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটা যেত এই লেকের জল, এই পাহাড় এই সবুজের অপরূপ রূপে হৃদয়ে ভেজাতে ভেজাতে। ময়মনসিংহ ছাড়ার আগেই রুদ্রকে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম খবর জানিয়ে যে আমি সমুদ্রপাড়ে যাচ্ছি, যেন যায় সে ওখানে। কক্সবাজার থেকে কবে ফিরব চট্টগ্রাম, কোথায় থাকব, আবার চট্টগ্রাম থেকেই বা কবে ফিরে যাবো ঢাকায়, সবই জানিয়েছিলাম। এমন চমৎকার সময় আমার জীবনে আর আসেনি আগে, যে করেই হোক যেন সে যায়। মিঠেখালিতে বসে আছে সে অনেকদিন, মিঠিখালি থেকে রুদ্র যত কথাই দেয় যে বেরোবে এক বা দু সপ্তাহ পর, দুমাস তিনমাস কেটে যায়, তার বেরোনো হয় না। গ্রামটিতে একটি শেকল আছে, যখনই সে যায়, শেকলে জড়িয়ে যায়, সে চাক বা না চাক।
যেদিন আমরা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে যাবো ঢাকায় তার আগের রাতে রুদ্র এসেছে। সাইফুল,রুদ্রর ছোটভাই, ছাত্রীনিবাসে আসে, রুদ্রকে সঙ্গে করে। সাইফুল চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রথম বষের্ সবে ভর্তি হয়েছে। সাইফুলকে প্রথম দেখি সে রাতে। ছোটখাটো হাসিখুশি ছেলে। রুদ্রর চোখের মত ডাগর চোখ ওর। পরিচ্ছত পরিপাটি ছেলে। ছেলেটি চমৎকার, কথা বলে এমন করে যেন আমাকে এক যগু ধরে চেনে। ওর সঙ্গে আমি সহজে সহজ হই। সে রাতে তিনজন রিক্সা করে বেরিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, রুদ্রর লাল হয়ে থাকা চোখ, বড় হয়ে যাওয়া চুল,দাড়িতে দৃষ্টি বারবার হোঁচট খায়। সাতদিন স্নান করেনি, ঘুমোয়নি, যেন এইমাত্র কোনও গুহা থেকে উঠে এসেছে। সাতটি দিন কেটে গেল আমি ময়মনসিংহের বাইরে কেন সে আগে আসেনি, কেন ফিরে যাবার আগের দিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এল, আমরা দুজন কি সুন্দর খেলা করতে পারতাম সমুদ্রের জল নিয়ে, ঢেউ নিয়ে, পাশাপাশি বসে দেখতে পারতাম সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমায় গভীর রাত অব্দি বালুতে পা ছড়িয়ে বসে দেখতে পারতাম জলের ওপর চাঁদের আলোর সাঁতার কাটা। বাবার রক্তচক্ষুহীন ঢিঁ ঢিঁ পড়ার ভয়হীন এই চট্টগ্রাম শহরটিতে রিক্সার হুড ফেলে আমি নিশ্চিন্তে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। অভিমান আমাকে ধোঁয়ায় ঢাকতে থাকে। ধোঁয়া সরিয়ে রুদ্রর ভারি কণ্ঠস্বর আমাকে স্পর্শ করে, চট্টগ্রাম থেকে কাল আমাকে ঢাকা নয়, যেতে হবে মোংলা। যদিও নতুন কোনও শহর দেখার ইচ্ছে আমার প্রচণ্ড, কিন্তু মোংলা যাওয়ার প্রস্তাবটি শুনে না বলে দিই। না বলি কারণ দল থেকে মাস্টারেরা আমাকে বেরোতে দেবেন না। হয় না, ঢাকায় আরও ট্যুর আছে, সেরে, দলের সঙ্গে ফিরতে হবে ময়মনসিংহে। রুদ্র চোখ কুঁচকে ঠোঁট কুঁচকে রাখে এই না বলায়। সাইফুল বলে, আরে যাও না বৌদি একটু ঘুরে আসো মোংলায়। সাইফুলের বৌদি ডাকে আমার চেতন হয় যে আমি কারও বৌদি, কারও বৌদি মানে আমি কারও বউ। রাতে ছাত্রীনিবাসে সাফিনাজের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, ভাবনার একটি রশি বেয়ে বন্ধ ঘর থেকে ছাদের ওপর উঠি, ছাদ থেকে আরও ওপরে শূন্যে, দুহাত মেলে দিই ভাসতে থাকি, কী আনন্দ কী আনন্দ! আর কবে পাবো এমন ছুটি!এর চেয়ে সুযোগ কি আমার জীবনে আসবে আর, হারিয়ে যাওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করি কেন! পরদিন রুদ্রকে নিয়ে ট্রেনে উঠে ঢোক গিলতে গিলতে দুজন শিক্ষকের মধ্যে সাদাসিধেটিকে বলি, যে আমাকে আজই খুলনা যেতে হচ্ছে, খুলনা থেকে কালই ঢাকায় ফিরব, ঢাকার ট্যুর এ থাকবো। কিন্তু শিক্ষক সাদাসিধে হোক আর যাই হোক, তিনি আমাকে যেতে যেবেন কেন, এতগুলো হবু ডাক্তাদের ভালয় ভালয় ভ্রমণ করিয়ে ভালয় ভালয় ফেরত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, তিনি সুষ্ঠু ভাবেই পালন করবেন।
কার সঙ্গে যাবে?
কার সঙ্গে যাব? এর সহজ উত্তর, দাড়িঅলা লোকটিকে দেখিয়ে বলে দেওয়া, ওর সঙ্গে। এরপরই তো প্রশ্ন উঠবে ও কে, ও কি। তাও না হয় দেওয়া গেল, ও রুদ্র, ও কবি। এর পরের প্রশ্নটি, তিনি খুব সাদাসিধে বলেই করা স্বাভাবিক, ও তোমার কি হয়?
আমার অপ্রফুল্লবদনটি দেখে আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো শওকত আর মদিরা, দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছে, ওরা জানে দলছুট হওয়ার আনন্দ। শওকত কানে কানে বলে, আগে বল তুমি বিয়ে করেছ কি না, স্যারকে বলতে হবে হাজবেণ্ডের সাথে যাচ্ছে, তা না হইলে ছাড়বে না।
না, এ কথাটি বলা যাবে না, এই স্যার গিয়ে আমার বাবা-স্যারের কানে কথাটি দিলে সব্বনাশ হবে। শওকত হেসে, আমার বলব কি বলব না ভঙ্গির দিকে, তাকিয়ে, বলে, স্যাররে বইলা দিই জিনিসটা গোপন যেন কাউকে না জানায়!
যদি জানায়?
আরে তুমি ঢাকায় দুইদিন পর চইলা আসো, দলের সাথে পরে ময়মনসিংহে ফিরো, অসুবিধা কি!
শওকত আমার খুলনা যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে। এ যে অবৈধ পুরুষ নিয়ে ভেগে যাওয়ার কোনও ব্যাপার নয়,রীতিমত বৈধ পুরুষের সঙ্গে হাওয়া হওয়া, তা সে ইঙ্গিতে শিক্ষক-কাম-পাহারাদারকে বুঝিয়ে আমাকে পার করে। আমি রুদ্রর সঙ্গে পথে নেমে পড়ি। পথ থেকে ট্রেনে করে খুলনা, খুলনা থেকে লঞ্চে মোংলা। দলছুট হওয়ার পর বড় একা লাগে আমার। দলের সঙ্গে উচ্ছঅ!স ছিল, হঠাৎ যেন মিইয়ে গেল সব। হঠাৎ যেন একটি সম্পর্কের বন্ধন এসে আমাকে জড়ালো। আমাকে একটি র্কতব্যের কুয়োয় টপু করে ব্যাঙের মত ফেলে দিল।
রূপসা নদীর ওপর দিয়ে লঞ্চ চলছে মোংলায়। নতুন একটি নদী দেখছি, নতুন নতুন মানুষ দেখছি। আমার ভাল লাগতে শুরু করে। লঞ্চে উঠে রুদ্র বলল শাড়িটা পাল্টো নাও। শাড়ি পাল্টাবো কেন? এই তো বেশ।
শাদা একটি সুতির শাড়ি পরনে আমার। শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকলেও সমুদ্র যাত্রায় মেয়েরা সব শাড়ি পরেছে, শাড়ি পরার এই সুযোগ পেয়ে আমারও আহলাদ কম নয়।
যা বলছি কর।
কেন, এই শাড়িতে কি খারাপ লাগছে দেখতে?
হ্যাঁ লাগছে। পাল্টাও। শিগরি কর, ঘাট এসে গেল।
খুব কি দরকার শাড়ি পাল্টানোর?
হ্যাঁ খুবই দরকার।
রুদ্র কেবল কবিতা নয়, শাড়ি নিয়েও ভাবে। সুতি শাড়ি ও মানে না। কাতান পরতে হবে।
কাতান পরতে ইচ্ছে করছে না।
কেন ইচ্ছে করবে না?
করছে না।
কি আশ্চর্য!
কোনওটা তো ইস্ত্রি নেই।
না থাক, তবু পর।
কাতান পরতে হবে। সবুজ বা নীল হলে চলবে না। লাল পরতে হবে।সমুদ্রে ভিজে সব শাড়ি দলামোচা হয়ে আছে। দলামোচা থেকেই একটি পরতে হল।লাল। দুপুরবেলা ঘাটে পৌঁছে দেখি এক বিরান বন্দর। কটি খালি সাম্পান বাধাঁ ঘাটে। কেমন গ্রাম গ্রাম,আবার ঠিক গ্রামও নয়। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। টানা বস্তি পেরিয়ে রুদ্র একটি দোতলা বাড়ির সামনে রিক্সা থামিয়ে বলল, এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথায় ঘোমটা দাও তো!
আমি চমকে উঠি রুদ্রর কথায়।
মাথায় ঘোমটা? কেন?
আরে দাও না।
আমি কখনও এসব দিই না।
দাও না জানি, এখন দাও।
কেন?
বুঝতে পারছ না কেন, তুমি তো এ বাড়ির বউ!
শুনে গা কাঁপে। অনেকটা আনন্দ, অনেকটা শরম, অনেকটা ভয় মিশিয়ে আমি তখন ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কী করব। রুদ্র বলল, সালাম করতে হবে কিন্তু পা ছুঁয়ে।
না।
কেন?
আমি কখনও ওসব করি না।
করতে হবে।
আমার দ্বারা হবে না। অসম্ভব।
তুমি বুঝতে পারছ না কেন! সালাম না করলে খারাপ দেখায়।
কেন খারাপ দেখাবে?
দেখায়।
দেখায় কেন? কী মানে আছে পা ছোঁয়ার?
বড়দের করতে হয়। বুঝতে পারছ না কেন! আর তুমি তো এ বাড়ির বউ।
খারাপ দেখাক। আমি পারব না এসব।
ইস কি জ্বালা!
পা না ছুঁয়ে মুখে সালাম বললে হবে না?
না, হবে না।
আনন্দ উবে গিয়ে এক শরীর অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে। এই পা ছোঁয়ার ব্যাপারটি আমি পারি না। ঈদ এলে নতুন কাপড় জামা পরার পর মা এখনও বলেন, যাও তোমার বাবারে সালাম কইরা আসো।
দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা যত ঠেলেন, কাঠ তত ভারি পাথর-মত হয়ে ওঠে। ঈদের সময় মুরব্বিদেরে সালাম করতে হয়। এই করতে হয় ব্যাপারটি আমি বুঝি, কিন্তু কেন করতে হয় তা ঠিক বুঝি না। তোমাকে বড় বলে মানি, শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি, তা কেন পা ছুঁয়ে বোঝাতে হবে আমাকে! আর কোনও উপায় কি নেই বোঝাবার! আমি অবাক তাকিয়ে থাকি রুদ্রর দিকে, ধর্ম না মানা, রীতি নীতির তোয়াক্কা না করা রুদ্রও পা ছোঁয়ার ব্যাপারটিকে কেমন সায় দিচ্ছে! এত দূরে একটি বিরান বন্দরে এনে রুদ্র যেন আমার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিল তার মা বাবার পায়ের দিকে। আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, এই বন্দরে চেনা কেউ নেই এক রুদ্র ছাড়া, অথচ এই রুদ্রকেই বড় অচেনা লাগে। মাথা আমার আঁচলে ঢাকা, পিঠে রুদ্রর খোঁচা, এক খোঁচা, দুই খোঁচা,তিন খোঁচার পর আমি তার মার পায়ের দিকে নত হই। ঠিক জানিও না সালাম জিনিসটি কি করে করে। পায়ে হাত ছুঁইয়ে হাতদুটো বুকে নিতে হয়, নাকি কপালে নাকি ঠোঁটে ধাধাঁ লাগে। পা ছুঁইয়ে সংশয়ের ভারে আমার হাত হাতের জায়গায়ই থাকে। এক দঙ্গল ভাই বোন রুদ্রর, এক এক করে এল পরিচিত হতে। ভিড়ের মধ্যে আরও একা লাগে আমার। যেন আমি অদ্ভুত এক জীব এসেছি মানুষের ভিড়ে। বীথি, রুদ্রর ছোটবোন, বলল কী দাদা, তোমার বউ কি বোবা নাকি কথা কচ্ছে না কেন! কি কথা বলব ঠিক বুঝে পাই না। বুঝে পাই না কি কথা বলা উচিত আমার। আমি গুটিয়ে থাকি।
রুদ্রর বাবা, রুদ্রর চেয়েও লম্বায় খাটো, পাশে দাঁড়ালে তিনি আমার কাধঁ সমান হবেন, মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা, বাড়িতে ঢোকেন। রুদ্রকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি তো ডাক্তার তাই না!
হ্যাঁ।
তাহলে এই পোশাক যে!
ধর্ম বিশ্বাসী।
ডাক্তার হয়ে ধর্ম বিশ্বাস করেন!
আমি অবাক তাকিয়ে রই। বারান্দায় পিঁড়িতে বসে বদনির তোলা পানিতে অযু করেন তিনি। রুদ্রর মা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন অযুতে ভেজা হাত মখু মুছতে, ঘরে জায়নামাজ বিছানো, তিনি নামাজ পরবেন। নামাজ শেষ হলে রুদ্র আমাকে নিয়ে যাবে তার বাবার সামনে। বুক ঢিপঢিপ করে। বাবা জিনিসটিই আমার মনে হতে থাকে বড় ভয়ের। রুদ্র অস্থির পায়চারি সেরে আমাকে নিয়ে ঢোকে নামাজ সেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে তসবিহ জপতে থাকা তার বাবার কাছে। আমি শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাচ্ছি।
আব্বা, এই আমার বউ! বলে আমাকে বলল, যাও আব্বাকে সালাম কর। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উপুড় হই। তিনি দাড়িতে আঙুল বুলোতে বুলোতে বলেন, বস।
তোমার বাবা মার শরীর ভাল?
আমার বাবা মাকে তিনি চেনেন না, তাঁদের শরীর ভাল কি না ভাল নয় তা জানতে চাচ্ছেন কেন আমি বুঝতে পারি না। মুহূর্তে বাবা মার মখু মনে ভেসে ওঠে। হাইজিন ট্যুরে যাওয়া মেয়ে তাঁদের কোথায় এখন, যদি জানেন, তবে তাঁদের ভাল থাকা কোথায় যে উবে যাবে!
কোন ইয়ারে পড় তুমি।
ফোথর্ ইয়ার।
ও। ডাক্তার হতি তো বেশি দেরি নেই। তোমাদের বাড়ি তো ময়মনসিংহে!
হ্যাঁ ময়মনসিংহে।
এ কি ঢাকার উত্তরে না দক্ষিণে।
উত্তরে।
তা মোংলায় থাকবে কিছুদিন তো!
রুদ্র বলে, হ্যাঁ থাকবে।
তা শহিদুল্লাহ, ওকে নিয়ে মিঠেখালি যাবে কি?
দেখি।
মিঠেখালি ঘুরি আসো।
খাওয়া দাওয়া হইছে?
না।
যাও খাওয়া দাওয়া করি বিশ্রাম নাওগে যাও, অনেকদূর জানির্ করে এসেছো।
রুদ্র আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। নতুন চুনকাম হয়েছে। দোতলা নতুন করা হচ্ছে, এখনও কাজ শেষ হয়নি। এই দোতলা করার ব্যাপারটি রুদ্র বলে,যা তা, হুড়মুড় করে ওপরের ঘরগুলো একদিন ভেঙে পড়বে, কারণ মাটির তত গভীরে যায়নি বাড়ির শেকড়। শুনে ইট কাঠ লোহার সঙ্গে চুন সুরকির মত আমিও ভেঙে পড়ি। দোতলার একটি ঘর রুদ্র আর আমার জন্য গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে, মোংলা এলে রুদ্র এ ঘরটিতেই থাকে। একটি মাঝারি খাট, একটি টেবিল, টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার ঘরে। শাদা দেয়াল চারদিকে, একটি শুধু জানালা। তাকালে কিছু গোলপাতার গাছ আর একটি দোতলা বাড়ির পশ্চাতদেশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।
বিকেলে রুদ্র বেরিয়ে যায়,একা। আমি সঙ্গে যেতে চাইলে বলেছে এই বন্দরে বাড়ির বউএর এভাবে বেরোনো ঠিক নয়। তবে কি আমি মোংলা বন্দরটি, এই নতুন জায়গাটি দেখব না? না,দেখার কিছু নেই এখানে, শ্রমিকদের বস্তি ছাড়া আর কিছু নেই। শ্রমিকদের বস্তিই দেখব। না। শ্রমিকেরা আমাকে হাঁ হয়ে দেখবে, গিলে খাবে। তার চেয়ে রুদ্রর ভাই বোনদের সঙ্গে আমি যেন গল্প করি। কিন্তু ওদের সঙ্গেই বা কি গল্প করব! কাউকে আমি চিনি না। আমার বড় একা লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সামনে জল আর জল। উঠোন পেরোলেই নদী। বীথিকে বলি, আমি ওই নদীটি দেখতে দেখতে যাবো। নদী? ও দেখার কিছু নেই। ও তো কেবল জল! জলই দেখব। জল দেখে কি করবে, বীথি হাসে। জলের কাছে গেলে আমাকে বলে, নোংরা জল, জলে হাত দিও না, পা ভিজিও না। জলহীন হাঁস আমি, হাওয়ায় সাঁতার কাটি। ডাঙাই আমার ঠিকানা, ডাঙায় আমার বসতবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। হাতের কাছে পায়ের কাছে অগাধ অফুরন্ত জল, যেদিকে চোখ যায় জল, থৈ থৈ জল অথচ বাড়িটিতে জলের অভাব। বাইরে থেকে একটি ছেলে দু তিন বালতি নদীর জল দিয়ে যায় প্রতিদিন, ও দিয়ে রান্না করা, পায়খানা পেচ্ছাব করা, গোসল করা, সবই সারতে হয়। গা লবণ লবণ লাগবে, চুল আঠা আঠা লাগবে, করার কিছু নেই, জলের অভাব, জলের তীরে বাস করে জলের এমন অভাব দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। পান করার জলও আসে বাইরে থেকে। ওরা বলে মিষ্টি জল, যদিও এক ফোঁটা মিঠে নয় স্বাদ, খরচা করতে হবে বুঝে, কেবল যদি তেষ্টায় ছাতি ফাটতে থাকে। মিষ্টি জল এ বন্দরে মেলে না, খুলনা শহর থেকে এখানে নৗকো করে জল আসে, এ দিয়েই তেষ্টা মেটাতে হয় বন্দরের সবার। বীথি বলে খুলনা থেকে পানি তো এই সেদিন থেকে আসে, এর আগে তো খাতি হত বিষ্টির পানি।
বৃষ্টির পানি?
মিঠেখালিতে তো ওই খাই আমরা। বড় বড় কলসি পেতে রাখি উঠোনে, ওতে বিষ্টির পানি জমি থাকে, ওই খাই।
ও পানি খাওয়া যায়?
যাবে না কেন?
বীথি জলপানির প্রসঙ্গ থেকে আলটপকা সরে গিয়ে বলে, আচ্ছা বৌদি তুমি কি গয়নাগাটি কিছু আননি? বাড়ির বউ, লোকে কি বলবে বল! কাল বিকেলে লোকজন আসবে, সীমুর জন্মদিন। আমি কিছু গয়না দিয়ে যাবনি, ও পরে রেখো।
সন্ধে শেষ হয়ে রাত নেমে আসে। বার বার ঘড়ি দেখি,ছটফট করি।
তোমার দাদা এখনো ফিরছে না!
ফিরবেনি, অত ভেবো না। পুরুষমানুষ, বাইরে বন্ধুবান্ধব থাকি, যাতি হয়।
তাই বলে এত রাত করবে?
ফিরবে ফিরবে। বউ আছে ঘরে, যত রাত হোক ফিরবে। বীথি হাসে। হাসিতে মুক্তো ঝরে।
অনেক রাত করে রুদ্র ফেরে। যখন শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে নিচ্ছে, বিছানাটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার বুক কাঁপে, খুব বৈধভাবে এ বিছানায় আমাদের শুতে হবে দুজনকে, শোবার দিন শেষ অবদি এলই আমাদের। একটি রাত কাটানোর জন্য রুদ্র সেই যে কবে থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেই রাত কাটানোর রাত তবে এলই। যেন আমরা দাম্পত্য জীবনে কতকালের অভ্যস্ত মানুষ, চল শুয়ে পড়ি, বলে সে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ে।
কই এসো।
আসছি।
আসছি, বুকের কাঁপন খানিক থামুক, আসছি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, এক গেলাস জল খেয়ে এই আসছি। অস্থির হয়ো না, আমি আসছি। না এসে আমার উপায় কি!
কি ব্যাপার বসে আছো কেন? সারারাত ওখানেই কাটাবে নাকি?
আমাকে যেতে হয় বিছানায়, শরীর যেতে থাকে দেয়ালের দিকে। দেয়াল সাঁটা শরীর টেনে রুদ্র তার বুকের কাছে নিয়ে আসে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন ছুটে যেতে না পারি। ছুটে আর কোথায় যাব আমি! আমার তো যাওয়ার আর জায়গা নেই। রুদ্রর কাছে আসব বলেই তো নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে শতবার করে বুঝিয়েছি রুদ্র তোমার স্বামী, স্বামীর সঙ্গে রাত কাটানোর এই সুযোগ তুমি নষ্ট করো না, তুমি বাইশ বছরের তরুণী এখন, ছোট্ট খুকি নও, আর সবাই যদি স্বামীর সঙ্গে শুতে পারে, তুমি পারবে না কেন! নিষিদ্ধ জিনিসটির স্বাদ পেতে আমারও ইচ্ছে করে গোপনে গোপনে। রুদ্র আমাকে সম্পণূর্ করে পেতে চাইছে। আমি প্রাণ মন তাকে কবেই দিয়ে বসে আছি, কেবল শরীর গুটিয়ে থাকে শামুকের মত। সমস্ত লজ্জা আর ভয় ভাঙার সময় কি আমার আসেনি! আজ যদি আমার গুটিয়ে থাকা শরীরকে খুলে না দিই, যদি আজ আমি শেকল ছিঁড়ে শরীরটিকে মুক্ত না করি, আজ যদি আমার ভালবাসার মানুষকে বঞ্চিত করি, এ আমার নিজেকেই বঞ্চিত করা হবে। রুদ্র কোনও অন্যায় দাবি করেনি। স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা অন্যায় নয়। একদিন না একদিন তো আমাকে দিতেই হবে যেটুকুৃ বাকি আছে দিতে, তবে আজ নয় কেন! রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। চুমু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, বাতি জ্বলছে। এর অর্থ বাতি নেবাতে হবে। বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে তুমি এবার যা ইচ্ছে কর, আমি বারণ করব না। রুদ্র বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে আমার বোজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, চিবুকের ভাঁজ ভিজিয়ে দেয়। ব্লাউজের বোতাম খুলে মখু ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, এত জোর-চাপ মুঠোয় যেন সে গলিয়ে এদের জল বানাবে, রূপসার ঘোলা জলের মত জল। রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে, আমি চাই না তবু আমার হাত আমার অজান্তে চলে যায় সে হাত থামাতে। আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দেয় রুদ্র। আমি চাই না, তবু আমার হাত চলে যায় তাকে শরীর থেকে নামাতে। এরপর সেই একই পদ্ধতি, দুপায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা। চোখ বুজে আছি শক্ত করে। যেন চোখ না খোলে, যেন চোখের সামনে আমি লজ্জায় মরে যেতে হয় এমন কোনও দৃশ্য না দেখি। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকি, সজোরে যুক্ত করে রাখি ঠোঁটজোড়া, যেন কোনও শব্দ আমার মুখ ফুটে না বেরোয়। এরপর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। রুদ্র আমার চিৎকারের মুখে দুহাত চেপে বলে, আরেকটু সহ্য করলেই হয়ে যাবে, এইতো হয়ে এল। লক্ষ্মীটি আরেকটু সহ্য কর। আরেকটু। রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে সে তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথরখানি সরাতে। থরথর করে কাপঁ ছে আমার উরু, উরু থেকে কাপঁ ন সঞ্চারিত হয় সারা শরীর। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। রুদ্র ঘেমে উঠেছে কিন্তু হাল ছাড়ছে না। পথে কোনও বাধা সে মানবে কেন, যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, সামনে সোনার খনি, ওই খনি তার হাতের মুঠোয় চাই। নিজেই নিজের মখু দুহাতে চেপে রেখেছি। হাত ফুঁড়ে যেই না বেরিয়ে চায় কিছু রুদ্র শাড়ির আঁচল গুজে দেয় মুখে, যেন এই রাতের একটি কণাও আমার চিৎকারে না ভেঙে পড়ে। না কিছুই ঘটছে না, আমি কোনও যনণ্ত্রা পাচ্ছি না, এই যে নিম্নাঙ্গ, এ আমার নয়, এ আমার শরীরের কোনও অংশ নয়। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে থাকা এ কোনও অবশ হয়ে থাকা শরীর। ধরা যাক আমাকে পেথিডিন দেওয়া হয়েছে। রক্তে থায়োপেনটাল সোডিয়াম ঢুকিয়ে আমাকে অচেতন করা হয়েছে। শরীরের সমস্ত কষ্ট আমার উবে গেছে। মাথার ওপর সিলিংপাখা বনবন করে ঘুরছে, আমার অচেতন শরীর তবু ঘেমে উঠছে। শাড়ির আঁচল, হাত, ঠোঁট দাঁতের কামড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। রুদ্র বাধা বিঘ্ন যা কিছু ছিল সব সরিয়ে সোনার খনির দিকে আমার ভেতর বাহির চুরমার করে ঢুকে যায়।
রুদ্র নেমে যায় ওপর থেকে। একদিকে দেয়াল আরেকদিকে রুদ্র, আমার শক্তি নেই কোনও দিকে একবিন্দু নিজেকে সরাই। স্থির হয়ে আছি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখছি যেন আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরলে আমি টের পাই আমি কোনও পোস্ট অপারেটিভ রুমেও নই, আমি রূপসা নদীর ঘোলা জলে শুয়ে আছি। আমার শরীর ভাসছে জলের ওপর। চারদিকে কেউ নেই, একা আমি। এত একা কোনওদিন বোধ করিনি। যেন আমার কেউ নেই, কোনওকালে ছিল না। আমার বাবা নেই, মা নেই। আমার কোনও ভাই বোন নেই। আমার কোনও বন্ধু নেই, কোনও প্রেমিক নেই, কোনও স্বামী নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই কোথাও যাওয়ার। আমি রূপসার জলের ওপর ভেলার মত ভেসে কোথাও যাচ্ছি আমি জানি না। যখন শক্তি জোটে নিজেকে তোলার, তুলে আমি নামতে যাই বিছানা থেকে, পথ জুড়ে পাহাড়ের মত একটি বাধা, সেটি রুদ্র। বলি, যেতে দাও। এই প্রথম আমি রুদ্রকে সম্বোধন করি। রুদ্র পথ ছেড়ে দিলে আমি নেমে পেচ্ছাবখানা খুঁজতে থাকি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে। নিম্নাঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাঁসের মত হাঁটতে থাকি জলহীন ডাঙার অন্ধকারে। পেচ্ছাবখানায় পেচ্ছাব নয়, রক্ত বয়ে যায়, রূপসার জলের দিকে যায়। আর্তনাদের শক্তি আমার নেই। গোঙাতে থাকি অসহ্য যনণ্ত্রায়।
পরদিন রুদ্র যখন বেরিয়ে যায় আমাকে ফেলে, আমার আবারও একা লাগতে থাকে। আমি ঠিক বুঝে পাই না কি র্কতব্য আমার। শ্বশুরের পা টেপা, শাশুড়ির উকুন বাছা, তেষ্টা পেলে পানিটা এগিয়া দেওয়া, গোসলের সময় গামছাটা, নামাজের সময় জায়নামাজটা! আমাকে কি ঘোমটা মাথায় রান্নাঘরে ঢুকতে হবে রান্না করতে, যেহেতু এ বাড়ির বউ আমি! আমাকে কি রান্নাঘরের পিড়িতে বসে পেঁয়াজটা রসুনটা অন্তত কেটে দিতে হবে! হাঁসের মত হেঁটে রান্নাঘরে ঢুকি। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর, মাটির মেঝেয় মাটির চুলো, চুলোর আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে, যেন আলাউদ্দিনের প্রদীপ থেকে ওঠা ধোঁয়া, ইচ্ছে করে এক্ষুনি ধোঁয়া থেকে দৈত্য বেরিয়ে আমাকে বলে দিক, কি করা উচিত আমার, ভাত তরকারি রান্না করব, নাকি রুদ্রর ভাইবোনদের ইশকুলের পড়া দেখিয়ে দেব, বলে দিক বাড়ির মানুষগুলো আমি কি করলে খুশি হবে, বলে দিক কি করলে বলবে বউটি বড় লক্ষ্মী, বড় ভাল। দৈত্যের দেখা পেতে আমি ধোঁয়ার দিকে এগোই। রান্নাঘরে যেই না মাথা গলিয়ে দিই, বীথি বলে, এখানে ঢুকছো কেন? ধোঁয়ায় টিকতে পারবে না।
কি করছ তোমরা দেখি।
দৈত্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে বলি, আমি কি কিছু করব!
বীথি হাসে, রুদ্রর আর সব ভাই বোনেরাও হাসে। আমার অস্বস্তি হতে থাকে। আমাকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় বসতে হবে, কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, বললে কি কথা বলতে হবে এসব আমি জানি না। আমার একা লাগে। আমি চাই দ্রুত রাত নেমে আসুক, তখন আমি জানি, আমাকে কি করতে হবে, তখন আমাকে শুতে হবে, ঘুমোতে হবে।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে বীথি বলে, তুমি গোসল করে নাও! পরে পানি ফুরিয়ে যাবে। এখন কি করতে হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গোসলখানায় ঢুকে দেখি দরজা আছে, কিন্তু দরজায় কোনও ছিটকিনি নেই। সংকোচে বেরিয়ে আসি। দেখে বীথি হাসতে হাসতে বলে, নিশ্চিন্ত মনে গোসল করে নাও তো, কেউ ঢুকবে না। আমার গোসল হয়, কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে হয় না।
বারবার খসে যেতে থাকা আঁচলটি বারবার মাথায় তুলে দিতে দিতে, আঁচলের কোণ টেনে আঁচলকে মাথা থেকে খসতে না দিয়ে, নিশ্চিন্ত হয়ে, শুয়ে থাকা শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রুগ্ন কণ্ঠে তাঁর ন ছেলেমেয়ের মধ্যে বাড়িতে উপস্থিত সাতজনের একজনকে, এই তর বৌদিরে বসতে দে বলে আপাতত আমাকে তাঁর চক্ষুর সামনে থেকে সাদরে বিদেয় করে চক্ষু বন্ধ করেন। শাশুড়ির ঘরের পাশে একটি ঘরে আমকে বসতে বলা হয়, বিছানার এক কোণে বসি। বউ কথা বলে না, বউএর দেমাগ বেশি এরকম কথা যেন কেউ না বলে, তাই হাতের কাছে যাকে পাই ছোট ছোট ভাই বোন, নাম জিজ্ঞেস করি, কোন ইশকুলে কোন ক্লাসে পড়ে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়ে বসে থাকি চুপ হয়ে, আর কোনও প্রশ্ন পাই না করার, ওরাও কোনও প্রশ্ন করে না। ভাইবোনগুলো আশ্চর্যরকম শান্ত, কোনও চিৎকার চেঁচামেচি নেই বাড়িতে। এতগুলো ভাইবোন থাকলে অবকাশ সারাদিন মাছের বাজার হয়ে থাকত। নদী থেকে তপ্ত হাওয়া আসে ঘরগুলোয়। কেমন হু হু করে। আমার একা লাগে। বিকেলে বীথি আমাকে সোনার গয়না দেয় পরতে। সোনার গয়না না পরলে সংসারে মান থাকে না, তাই মান বাঁচাতে বীথির দেওয়া ভারি গয়না পরে বসে থাকতে হয়, নিজেকে কিম্ভুত লাগে দেখতে। আসলে কানে গলায় হাতে এত অলংকার আমাকে মানায় না। আমার সয়ও না এসব। মাত ৃ জুয়েলাসের্ হালখাতার নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে কানের লম্বা লম্বা দুল কিনে দিয়েছিলেন বাবা, সবই হারিয়েছে। আমি অনেকক্ষণ পরে রাখতে পারি না কানে কিছু সে সোনা হোক রূপো হোক, কান চুলকোয়। আঙুলে কিছু পরলে আঙুল চুলকোয়, খুলে রাখি এখানে সেখানে, ব্যস অদৃশ্য হতে সময় নেয় না। মা আক্ষেপ করেন, স্বর্ণের গয়নার দিকে ওর একদম নজর নাই। কই যে খুইলা রাখে জানেও না। অতিথিরা চলে গেলে বীথির গয়না খুলে রাখি, নিজেকে এক জড়ববস্তু বলে মনে হয়, যেন পুতুল আমি, আমাকে শাড়ি পরানো হচ্ছে, গয়না পরানো হচ্ছে, আর আমার মুখে কোনও রা নেই, উঠতে বললে উঠছি, বসতে বললে বসছি আর হ্যাঁ শুতে বললেও শুচ্ছি।
এই রাতেও রুদ্র বাড়ি ফিরে আমাকে লক্ষীটি একটু সহজ হও, এত শক্ত করে রেখো না, একটু নরম করো শরীর বলে বলে প্রশস্ত করা পথে প্রবেশ করে। অন্ধকার ঘরটি চোখ বুজে থেকে আরও অন্ধকার করে আমি যখন রুদ্রর দেওয়া যন্ত্রণা শরীর পেতে নিচ্ছি, নিচ্ছি—হঠাৎ সারা শরীরে এক তীব্র ভাল লাগা মাথা থেকে পা অবদি বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে যায়। আমি সেই বিদ্যুৎ-চমকে রুদ্রর পিঠ খামচে ধরি দশ নখে। হাপাঁতে থাকি, হাপাঁতে হাপাঁতে বলি, কি হল!
কি হল তার কিছু বলে না রুদ্র। আমার সোনা আমার মানিক আমার লক্ষ্মী বউ বলতে বলতে সে আমার ওপর এলিয়ে পড়ে। রাতে একবার নয়, বহুবার সে আমাকে তীব্র সুখ দেয়। এই সুখে যন্ত্রণার স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। আমি সুখে, শীর্ষসুখে কাতরাতে থাকি। কাতরানো আমি একসময় লক্ষ করি রুদ্র আমার পাশে নেই। অনেকক্ষণ সে আমার পাশে নেই।
কোথায় তুমি!
অন্ধকারে লাল একটুকরো আগুন জ্বলছে। আগুনটি নড়ছে।
শোবে না?
আসছি।
লাল আগুন নিবে যায়, সিগারেট শেষ হয়ে যায় খাওয়া, রুদ্র তবু শুতে আসে না। আমার আবেশে অবশ তনু চাইছে তাকে নিবিড় করে কাছে, একটি হাত ফেলে রাখি তার বালিশে, এলে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো বাকি রাত, তার শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমোবো। আবারও ডাকি, কই গেলে!
ডেটলের গন্ধ ঘরে।
কি ব্যাপার ডেটলের গন্ধ কেন!
ডেটল লাগাচ্ছি আমি। অন্ধকার থেকে রুদ্রর কন্ঠ।
কেন, কি হয়েছে?
শরীরে চুলকোনি হয়েছে।
তা হলে বুঝি ডেটল লাগাতে হয়!
মলমও দিচ্ছি।
কি মলম?
জানি না।
আলোটা জ্বালো তো, দেখি কোথাও চুলকোচ্ছে, কি মলম লাগাচ্ছে! দেখি। রুদ্র আলো জ্বেলে আসছি বলে মলম নিয়ে চলে গেল পেচ্ছাবখানায়। আলোর নিচে আলথুালু শাড়ি গুছিয়ে বসে থাকি অপেক্ষায়। রুদ্র এলে হাত পা দেখি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি, কোনও স্ক্যাবিসের চিহ্ন নেই।
কোথায় চুলকোচ্ছে?
রুদ্র কথা না বলে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ে। পাশে শুয়ে, তার বুকের ওপর একটি হাত রেখে বলি, স্ক্যাবিস তো দেখছি না।
আছে।
কোথায়?
হয়েছে ওই জায়গায়।
ওই জায়গা কোন জায়গা?
পেনিসে হয়েছে।
কোথায়?
পেনিসে।
ডেটল দিচ্ছ কেন?
ডেটল দেওয়া ভাল তো।
কোনও ডাক্তার বলেছে দিতে?
না।
মলম দিয়েছে কে? কোনও ডাক্তার?
না। নিজে কিনেছি।
এই মলম কি কাজে দেবে?
জানি না।
তাহলে দিচ্ছ কেন! পারমেথ্রিন মলম লাগাতে হয় স্ক্যাবিস হলে। খুব চুলকোয় কি?
হ্যাঁ চুলকোয়। আবার গোটা হয়েছে।
ছোট?
অত ছোট না।
বড় হওয়ার তো কথা নয়। বড় হবে কেন?
বড়ই।
ডাক্তারি উৎসাহে উঠে বসে, আলো জ্বেলে, বলি, দেখি তো কিরকম!
রুদ্র নিচের দিকে নামাতে থাকে লুঙ্গি। লোমশ শরীর আরও লোমশ হয়ে আসছে নিচে, লোমশ হতে হতে একটি শীতল পুরুষাঙ্গ। পুরুষাঙ্গের গোড়ায় একটি লাল ফুল। এই বাসরশয্যায় আমার প্রথম রাত্রিযাপনে কেউ কোনও ফুল বিছিয়ে দেয়নি। না গোলাপ,না গাঁদা, না জবা, না জুঁই। রুদ্রর পুরুষাঙ্গের ফুলটিই আমাকে ফুলশয্যা দেয়। কিন্তু এরকম পুরুষাঙ্গ আমি অনেক দেখেছি। পুরুষাঙ্গের এই ঘা খুব চেনা ঘা। হাসপাতালে, যৌনরোগ-বহির্বিভাগে পুরুষ-রোগীরা লুঙ্গি নিচের দিকে নামিয়ে ঠিক এমন ঘা ই দেখায়, যে ঘাগুলোকে যৌনরোগের ডাক্তার সিফিলিসের ঘা বলে চিহ্নিত করেন, যে ঘাগুলো নিরাপদ দূরত্ব থেকে অনেক দেখেছি। রুদ্রর ঘা যদিও সিফিলিসের ঘা এর মত দেখতে, কিন্তু একটি ঘা অন্য একটি ঘা এর মত দেখতে তো হতে পারে! নিশ্চয়ই অনেক নিরীহ ঘা আছে, দেখতে অন্য কুৎসিত ঘা এর মত। নিশ্চয়ই আছে, মন বলে, আছে।
কবে হয়েছে এটি?
এই তো দশ বারোদিন আগে।
রক্ত বেরোয়?
না।
রুদ্রর আর যে রোগই হোক, সিফিলিস হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমি অন্য অন্য রোগের কথা ভাবতে থাকি। এ কি একজিমা নাকি সোরিওসিস! নাকি পিনাইল প্যাপিউলস! নাকি রেইটারস সিনড্রাম! নাকি পেমফিগাস!
পেইন আছে?
রুদ্র মাথা নাড়ে। নেই।
এই নেইটিই অন্য সব সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। সিফিলিসের ঘাএ কোনও ব্যথা থাকে না।
পেইন কি একটওু নেই?
ভাবছে রুদ্র। ভাবো রুদ্র, আরও ভাবো, আরও একটু ভাবলে তুমি নিশ্চয়ই মনে করতে পারবে যে তোমার ব্যথা আছে।
রুদ্র মাথা নাড়ে আবারও। নেই।
আচ্ছা তুমি কি কোনও অচেনা লোকের কোনও নোংরা বিছানায় শুয়েছো? তোয়ালে ব্যবহার করেছো কারও!
মাথা নাড়ে এবারও। না।
রাজিয়া বেগম নামের এক লেখিকা চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য সিলেটের চা বাগানে তিন মাস ছিলেন। এরকম কি হতে পারে রুদ্র কোনও কবিতা লিখতে, বা কোনও গল্প, কোনও গল্পের প্রয়োজনে কোনও গণিকালয়ে গেছে, সেখানে কিছু ব্যবহার করেছে, তোয়ালে বা কিছু। পেচ্ছাবখানায় কিছু ছুঁয়েছে, ওসব জায়গা থেকে হাতে এসে লেগেছে সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনেমা পেলিডাম। যদিও জানি ওভাবে সিফিলিস ছড়ায় না, তবু জিজ্ঞেস করি, যদি ছড়ায়! যদি কোনও না কোনও ভাবে কোনও ফাঁক ফোকড় দিয়ে প্রবেশ করে!
তুমি কি কোনও কারণে প্রস্টিটিউশানে গিয়েছো। ধর লেখালেখির কারণে বা কিছু?
কেন, না তো!
কক্ষনো যাওনি?
নাহ।
আমি খুঁজছি আরও আরও কারণ, এরকম দেখতে ঘা এর অন্য কারণ। খুঁজছি। খুঁজছি। রুদ্রর তো এই প্রথম কারও সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক, আমার যেমন। এমনই তো হওয়ার কথা। ভালবাসার নিয়মই তো এমন। যাকে ভালবাসি, তার জন্য শরীর খানা তোলা থাকে। শরীরের গোপন গভীর সখু গুলো তোলা থাকে। রুদ্রর ঘা-টির দিকে তাকিয়ে থাকি। তবে কেন এই ঘা? এই ঘা তো আর কোনও ঘা এর মত লাগছে না! হারপেস সিম−প্লক্স, বা জেনিটাল ওয়ার্টস যদি হয়, সেও তো সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ! ধরা যাক এটি সিফিলিস, কিন্তু সিফিলিস রুদ্রর শরীরে কোন পথে ঢুকবে! সে যদি কোনওদিন কোনও গণিকালয়ে না যায়! গভীর ভাবনায় মগ্ন আমি। ঘা-টিকে ছুঁয়ে দেখি, ডান থেকে দেখি, বাঁ থেকে দেখি। ঘা এর আকার আকৃতি দেখি। রং দেখি।
একেবারে সিফিলিসের ঘা এর মত দেখতে। চোখ বলে, মন বলতে চায় না। কিন্তু সিফিলিস হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তবে কি হতে পারে এটি! দু ভুরুর মাঝখানে ভাঁজ পড়ে আমার।
আচ্ছা, তোমার কি কোথাও কোনও মেয়ের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্কে হয়েছে।
আবোল তাবোল কি বলছ তুমি!
রুদ্র লুঙ্গি ওপরে তুলে নেয়। ঘা ঢেকে যায়।
শুয়ে পড় তো। অনেক রাত হয়েছে।
রাত হোক, আমার নিদ্রা উবে গেছে। এই ঘাটির কারণ জানার জন্য আমি উদগ্রীব। কোনও রকম মেলামেশা ছাড়া এমন একটি ঘা কেন হতে যাবে!
তোমার বাবাকে দেখিয়েছো?
না।
দু সপ্তাহ ধরে এটি, কোনও ডাক্তারের কাছে গেলে না কেন?
যাইনি।
পরীক্ষা না করে মলম লাগালে ঘা তো যাবে না।
রুদ্র তার দাড়ি চুলকোতে থাকে। কিছু নিয়ে খুব ভাবলে সে এই করে।
আমি হঠাৎ বলি, জানো, প্রস্টিটিউটদের সঙ্গে রিলেশান হলে এরকম ঘা হয়। তুমি নিশ্চয়ই কোনও প্রস্টিটিউটের কাছে যাওনি! প্রশ্ন করি।
না। রুদ্রর বরফ-কন্ঠ।
সত্যিই তো তুমি যাওনি? এই প্রথম তো আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক, তাই না!
রুদ্রর মখু টি হঠাৎ বদলে যায়। কালো ভুরু দুটো জড়ো হতে থাকে। যেন তার যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরে কোথাও। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে আমার চোখে। চেষ্টা করেও আমি পড়তে পারি না তার চোখের ভাষা।
অনেকক্ষণ নীরব বসে থাকি দুজন। হঠাৎ রুদ্র বলে, আসলে কি জানো, আমি পাড়ায় গিয়েছি।
পাড়া মানে?
বেশ্যাপাড়া।
গিয়েছো? কেন?
যে কারণে লোকেরা যায়।
কি কারণে?
রুদ্র কথা বলে না। আমার মাথাটি কি ঝিমঝিম করছে? বুকের মধ্যে কি হুড়মুড় করে একটি শ্বাসকষ্ট ঢুকে গেল? শব্দগুলো আগের চেয়ে ধীরে উচ্চাজ্ঞরত। স্বরটি ভাঙছে, কাপঁছে।
কোনও প্রস্টিটিউটের সঙ্গে শুয়েছো?
কথা বলছে না। তার চোখদুটো পাথর হয়ে আছে।
বল, বলছো না কেন, বল।
আমার দুচোখে আকুলতা, বল না, তুমি না বল রুদ্র। না বল। একটি না শব্দের আশায় আমি মোহগ্রস্তের মত বসে থাকি।
হ্যাঁ। রুদ্র বলে।
কি, সেক্সুয়াল রিলেশান হয়েছে?
নিজের স্বরকে আমি চিনতে পারি না, যেন এ আমার কণ্ঠস্বর নয়, অন্য কারও। যেন একটি যন্ত্রে বোতাম টিপে দেওয়া হয়েছে, যন্ত্রটি কথা বলছে।
হ্যাঁ।
আলো জ্বলছে ঘরে, অথচ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আমার চোখের সামনে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। অনেকক্ষণ আমি কোনও নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আমার সামনে এ কি কোনও যৌনরোগী, নাকি এ রুদ্র! আমার প্রেমিক, আমার স্বামী! আমার বিশ্বাস হয় না এ রুদ্র, বিশ্বাস হয় নার এর সঙ্গে আমার বছর বছর ধরে প্রেম।
গিয়েছো কবে?
এই তো দু সপ্তাহ আগে।
একবারই গিয়েছো?
হ্যাঁ।
আর কোনওদিন যাওনি?
না।
তোমার ঘা তো দু সপ্তাহ থেকে!
হ্যাঁ।
যেদিন সম্পর্কে হয়েছে, সেদিনই তো ঘা হয় না। হতে কিছু সময় নেয়। মনে করে দেখো একবারের বেশি আরও গিয়েছো কি না।
রুদ্র আমার চোখের দিকে অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে বলে, আরও গিয়েছি।
নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে আমি রুদ্রর জীবনে প্রথম মেয়ে নই! অনেকক্ষণ ওভাবেই নিস্পন্দ বসে থাকি।
আমাকে তো কখনও বলনি এসব?
বলিনি।
কেন বলনি?
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে জানি না কি দেখে সে, কোনও উত্তর দেয় না।
বেশ্যপাড়া, তাই না? কোথায় সেটা?
বানিশান্তায়।
বানিশান্তা কোথায়?
এই বন্দরেই।
কেন যাও? তুমি না আমাকে ভালবাস?
ভাল তো বাসিই।
ভালবাসলে অন্য কাউকে ছুঁয়েছো কি করে? আমাকে এতদিন তুমি মিথ্যে কথা বলেছ, বলেছ তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে স্পর্শ করনি কোনওদিন। জানো, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব কিছু।
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রুদ্র অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে, যেভাবে আমার সঙ্গে সে শুয়েছে। যেভাবে আমার মুখে বুকে চুমু খেয়েছে সেভাবে আর কাউকে খেয়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রুদ্র আর কারও গভীরে প্রবেশ করেছে এমন। মনে হতে থাকে মাঝসমুদ্রে আমার তরীটি ডুবে গেছে। আমি ডুবে যাচ্ছি, যতদূর চোখ যায়, কেউ নেই, কিছু নেই। আমি একা, আমি ডুবছি। আমার আকাশ ভেঙে পড়েছে, আমার জগতটি খণ্ড খণ্ড হয়ে ছিটকে পড়েছে, ছিটকে পড়া টুকরোগুলো গড়াতে গড়াতে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। কূলকিনারাহীন উত্তাল সমুদ্রে খড়কুটো নেই, আমি ডুবছি। আমি যেন আমি নই, অন্য কেউ। সেই অন্য কেউএর জন্য আমার কষ্ট হতে থাকে। কষ্টটি আমার স্নায়ুতন্ত্রে্র পাক খেয়ে খেয়ে নামতে থাকে বুকে। বুকের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত পাথর এসে যেন চাপ দিচ্ছে। কোনও শব্দ উচ্চারণ করার সামথর্ আমার নেই। আমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে হু হু করে কাঁদি, সারারাত কাঁদি। চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে আমার বালিশ, শাড়ি, বিছানার চাদর। রুদ্রর হাত ধরে পা ধরে আমি কাঁদি, বল বল যে তুমি মিথ্যে কথা বলেছো। বল যে তুমি কারও কাছে যাওনি। কারও সঙ্গে শোওনি। বল বল।
পাথরের মত স্তব্ধতা রুদ্রর। ফ্যাকাসে মুখে সে আমার কান্না দেখে সারারাত।
কান্না দেখে সে সকাল, দুপুর, বিকেল। না খাওয়া না নাওয়া আমার কান্না দেখে সে সারাদিন। নিজে সে নায়, খায়। নিজে সে আর দিনের মত যাপন করে দিন। ঘুমোতে চাই, সব ভুলে ঘুমোতে চাই। কিন্তু ঘুম তো আসছে না। ঘুমের ওষধু চাইলে তার বাবার ডাক্তারখানা থেকে রুদ্র দু পাতা সিডাক্সিন এনে দেয়। খুঁজে দু পাতা পেয়েছে, দু পাতাই দিয়েছে। দু পাতার কুড়িটি বড়ি থেকে একটি বড়ি শুধু তুলে নেব। একটি বড়ি শুধু খাব, এরপর মোট কুড়িদিন যেন বড়ি খেয়ে ঘুমোতে পারি। কিন্তু বড়ি যখন রুদ্রর আড়ালে আমি কুড়িটিই একবারে খেয়ে নিই, সেদিনই, সেই বিকেলে, আমি দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেব না ভুলিতের কোনও সুর আমার ভেতর ছিল না, চাচ্ছিল!ম দূরে চলে যেতে, আমাকে রুদ্র ভুলে যাক, কখনও আর মনে না করুক আমি নামে কেউ ছিল তার জীবনে। নিজের এই অস্তিত্বকে আমার আর মোটেও মনে হচ্ছিল না আমি বহন করতে পারব, মনে হচ্ছিল না যে আমার জীবনের কোনও মূল্য আর আছে। মনে হচ্ছিল না তীব্র এই কষ্টগুলো নিয়ে তীব্র এই অপমানগুলো নিয়ে আমি আর একটি মুহূতর্ও বাচঁ তে পারব বেশি। কাঙিক্ষত মৃত্যুর দিকে আমি যখন দৌড়ে যাচ্ছি, আমাকে পেছন থেকে খামচে থামাল কেউ। যখন ফিরিয়ে আনা হল ওই পথ থেকে দেখি শক্ত নল আমার নাকে, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রর ডাক্তার বাবা। বিষ বের হল শরীর থেকে, কিন্তু মন থেকে একফোঁটা বিষ বের হয়নি, মন মরতে থাকে। আমার চোখের সামনে মৃত্যুযনণ্ত্রায় কাতরাতে থাকে মন। সারারাত মৃত মনকে পাশে নিয়ে নির্ঘুম কাটাই।
ভোরের আলো ফুটলে বলি, আমি এক্ষুনি যাব।
রুদ্র তৈরি হয়। একবারও বলে না, আরও দুদিন থাকো বা কিছু। বাড়ির সবাই অবাক,কী ব্যাপার, হঠাৎ চলে যাচ্ছ যে।
রুদ্র ওদের বলে, ওর যেতে হবে। কেন যেতে হবে, তা কিছু বলে না। নাস্তা খেতে বলে ওরা, আমি না বলি।
লঞ্চের ভেতরে পেচ্ছাবের ঝাঁজালো আর মাছের আঁশটে গন্ধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ভোঁ শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার গা গুলোয়, সারারাত জেগে থেকে কেঁদে ভোরের হাওয়া নিতে গিয়ে বমি করে ভাসাই লঞ্চের বারান্দা। রুদ্র লোকের ভিড়ে বসে পেছনে ঘাড় ফেলে ঘুমোচ্ছে, হাঁ হয়ে আছে মখু । এই লোকটিকে আমার চেনা কেউ বলে মনে হয় না। মনে হয় না এই মানুষটি আমার কেউ হয়।
লম্বা লঞ্চ যাত্রা, ততোধিক লম্বা রেল যাত্রা নিঃশব্দে ফুরোয়। রেল যাত্রা ফুরোলো নিঃশব্দে। সব জেনেও মৃত মনকে বারবার বলেছি, ও আসলে অন্য রোগ। অন্য ঘা।
যৌনাঙ্গে তো কত রকম ঘা হতে পারে। আমি কি আর সব জানি, এখনও ডাক্তার হওয়ার ঢের বাকি আমার। পরীক্ষা করে একবার দেখি না কেন ঘা- টি! হয়ত এমনও হতে পারে, এটি নতুন একরকম ভাইরাস রোগ। এমনও হতে পারে, রুদ্র আমার সঙ্গে মজা করছে বলে যে সে বেশ্যালয়ে গেছে, একাধিকবার গেছে। সে নিশ্চয় আমাকে একদিন চমকে দেবে বলে, যে সব মিথ্যে ছিল, যা সে বলেছে। আমাকে পরীক্ষা করেছে সে, কতটুকু তাকে বিশ্বাস করি, তার পরীক্ষা। রাত কাটিয়েছে, যেরকম রাত আমার সঙ্গে কাটাতে সে বার বার চেয়েছে।
ঢাকায় নেমে দেখি ঢাকা মখু থুবড়ে পড়ে আছে অন্ধকারের পায়ে। শহরটি এত প্রিয় আমার, এত প্রাণবন্ত শহরটিকে মনে হয় নিস্তেজ। রাতে মুহম্মদপুরে রুদ্রর ভাড়া বাড়িটিতে যাই।একটি পড়ো পড়ো তিনতলা বাড়ি, বাড়িটির দোতলায় রুদ্রর দুটো ঘর, একটি ঝুল বারান্দা, ঘরের বাইরে ছোট্ট একটি রান্নাঘর, আর করিডোর পেরিয়ে একটি মলমূুত্রগোসলের জায়গা, সেটি বাড়িঅলাও ব্যবহার করে, রুদ্রও। খুব বেশিদিন হয়নি সে এটি ভাড়া নিয়েছে। দুটো ঘরের একটি শোবার, একটি পড়ার। পড়ার ঘরে টেবিল চেয়ার আর বই রাখার একটি তাক, বইয়ে উপচে পড়ছে তাকটি। জায়গা নেই বলে বই মেঝেয়, ছড়িয়ে নয়, গোছানো। শোবার ঘরের বিছানাটিও গোছানো। রুদ্র খুব গোছানো মানুষ। বিছানা টেবিল আমার এরকম গোছানো হয় না। তাই নিজের জীবনটিকে বড় এলোমেলো বলি। রুদ্রও নিজেকে বলে এলোমেলো, গুছিয়েই যদি সে রাখে তবে কেন এলোমেলো? তবে কি তার নিয়নণ্ত্র হীন জীবনটিকে বোঝাতে সে এলোমেলো শব্দটি ব্যবহার করে! দুই জীবনে একটি শব্দের অ−র্থর কী ভীষণ পার্থক্য! আমাকে ঘরে রেখে রুদ্র বেরিয়ে যায় দুজনের জন্য খাবার কিনে নিয়ে আসতে। আমি মেঝেয় শুয়ে তাকের কিছু বই উল্টো দেখি। মোটা মোটা দুটো কবিতার খাতা তাকটির নিচে সাজানো। পাতা উল্টো যাই, এত কবিতা সে জীবনে লিখেছে! সবই গভীর প্রেমের কবিতা। কাউকে খুব সাংঘাতিক ভাবে ভালবাসতো রুদ্র। কে সে যাকে বলছে আমার গান আমার সকল কবিতা তোমার জন্যই লেখা। রুদ্র খাবার নিয়ে ফিরে এলে জিজ্ঞেস করি, কে এই রমণী যাকে জীবন উৎসর্গ করেছো?
করেছিলাম।
কে সে?
খুব কি জানার দরকার?
বলই না শুনি।
নেলি।
লালবাগে বসে কবিতাগুলো লেখা।
লালবাগে মামার বাড়ি। ওখানে ছিলাম। নেলি হচ্ছে আমার মামির বোন। ও বাড়িতেই থাকত।
মামির বোন হলে তো তোমার খালা হয়।
হ্যাঁ খালা হয়।
খালার সঙ্গে প্রেম করতে?
রুদ্র মাথা নাড়ে, করত। বয়সে যে তার চেয়ে অনেক বড় তার খালা সে কথাও বলে।
কেবল কি প্রেমই করতে? নাকি আরও কিছু?
আরও কিছু।
মানে শুয়েছো তোমার খালার সঙ্গে?
হ্যাঁ।
ও বাড়িতে যখন ছিলে, তখন তো ইশকুলে পড়তে। ওই ইশকুলে পড়ার সময়ই শুয়েছো?
হ্যাঁ, রুদ্র সেই ইশকুলে পড়ার সময়ই জীবনের সব সেরে নিয়েছে। ছোটবেলাতেই সঙ্গম শিখেছে।
উপদ্রুত উপকূলে পেছনে হলুদ বাড়ি পঞ্চাশ লালবাগ, নিবেদিত বকুল বেদনা নামের ওসব তাহলে নেলিকে নিয়ে লেখা?
হ্যাঁ।
আমি হেসে বলি, জানো, ওই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, ভাবলে এখন হাসি পায়।
তা তোমার প্রেমিকা নেলি এখন কোথায়?
এক মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তালাক হয়ে গেছে। এখন লালবাগে আছে।
যাও না ওর কাছে? গিয়ে রাত কাটাও না ওর সঙ্গে? তোমার খালার সঙ্গে?
বাজে কথা বোলো না।
বাজে কথা বুঝি?
বাজে কথাই তো।
রুদ্রর চোখের ভেতর লাল রক্তের রেখা, সবুজাভ দাগ, চোখে এসব কি জিজ্ঞেস করাতে রুদ্র একবার বলেছিল, শ্যাওলা জমেছে। শ্যাওলা জমা চোখ রুদ্র আমার চোখে ফেলে রেখে অনেকক্ষণ, বলে,ও প্রস্তাব দিয়েছিল, রাজি হইনি।
কেন? তোমার তো কারও সঙ্গে এই সম্পর্কে যেতে কোনও বাধা নেই! রাজি হবে না কেন?
ওর সঙ্গে তো হৃদয়ের কোনও সম্পর্কে নেই, সম্পর্কে তোমার সঙ্গে।
বাহ, বেশ ভাল নীতি তোমার। যার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক মানে যাকে ভালবাসো তার সঙ্গেই শোও শুধু হাসতে হাসতে বলি, তাহলে বেশ্যাদের কি কর? ভালবেসে ওদের সঙ্গে শুতে যাও?
রুদ্র কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে যায়। দুটো কাপে পানি নিয়ে আসে। চল খেয়ে নি। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়া দেয়।
তোমার খালাকে বিয়ে করলে না কেন? অবশ্য এখনো করতে পারো। শান্ত স্বর আমার।
অতীতের কথা টানছো কেন?
অতীত! কেবল তোমার অতীতেই ওসব ছিল। বর্তমানে তুমি শুদ্ধতম মানুষ, তাই না?
কোনও উত্তর দেয় না রুদ্র। খেতে খেতে আমি তাকে দেখি। এত চেনা তার খাওয়ার, তার হাত ধোওয়ার, মখু মোছার, এত চেনা তার সিগারেটে আগুন ধরাবার, সিগারেট ফোঁকার ভঙ্গি!
রুদ্র প্রসঙ্গ পাল্টায় কবিতা পড়ে। চৌদ্দই ফেব্রুয়ারিতে সরকারি আদেশে পুলিশ ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল ছাত্র মিছিলে। ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়েছে অগুনতি মানুষ। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাড়ছে, আর সরকারি আদেশে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ নিরীহ মানুষের বুক লক্ষ করে।
আমি তোমাকে আর ঘণৃা করতে চাই না,
আমি থুতু দিতে চাই জলপাই বাহিনীর মুখেযা
রা শিশু একাডেমি, নীলক্ষেত রক্তে ভিজিয়েছে,
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে গুলিবিদ্ধ লাশ,
বুটের তলায় পিষে যারা খুন করেছে মানুষ,
আজ সেই জলপাই বাহিনীর রক্ত নিতে চাই। ..
রুদ্র একটির পর একটি কবিতা পড়ছে। ভারি কণ্ঠে, স্পষ্ট উচ্চারণে।
একদা অরণ্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রাণী হত্যা করে
আমরা অরণ্য জীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি,
আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো নির্মূল করে
আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো,
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো। শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।
মেঝেয় আধশোয়া হয়ে কবিতা শুনতে শুনতে আমি ভুলে যেতে থাকি মোংলা বন্দরে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা। যেন চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি আমি ঢাকায় এসেছি, রুদ্রকে সেই আগের মত আমি ভালবাসি, তার জীবনের কুৎসিত নোংরা চেহারাটি আমার দেখা হয়নি। আমি মগ্ধু তাকিয়ে থাকি, বিলীন হতে থাকি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে, সচেতন শব্দাবলীতে, মনে হতে থাকে রুদ্র আমার কেবলই এক বন্ধু আমার প্রেমিক নয়, স্বামী নয়। কবিতার খাতাটি পাশে রেখে রুদ্র জানালায় স্থির তাকিয়ে বলে আমার একটা খুব স্বপ্নের কথা তোমাকে বলি। আমি মিছিলে মরতে চাই গুলি খেয়ে। চোখদুটোয় দু ফোঁটা স্বপ্ন, চোখদুটো তার রাতের আকাশের দুটো তারা। মৃত্যু নিয়ে কাউকে এমন স্বপ্ন দেখতে দেখিনি আগে। মিছিলে মরতে রুদ্র কেন চায়! তাকে নিয়ে যেন মিছিল হয়, আন্দোলন জমে ওঠে, যেন সে অমর হয়ে থাকে! মৃত্যু ভাবনাটি আমাকে স্পর্শ করতে থাকে, সেই স্পর্শ সরিয়ে রুদ্র আমাকে চুমু খায়। চুমু খেতে খেতে আমার শরীর সে একটু একটু করে অবশ করতে থাকে। অবশ হতে থাকি, ভুলে যেতে থাকি আমি কে আমি কোত্থেকে, আমার সঙ্গে রুদ্রর সম্পর্ক, যেন আমি নই, এ অন্য কেউ, রুদ্রর প্রেমিকা, যে প্রেমিকাকে নিয়ে সে অনেক কবিতা লিখেছে। সেই প্রেমিকাকে সে আদর করছে, প্রেমিকা শরীর ভরে রুদ্রর আদর নিচ্ছে। রুদ্র তার বুকের কাপড় খুলে নিচ্ছে। সমস্ত শরীর দিয়ে ভালবাসছে তার সমস্ত শরীর। তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদছে তার প্রতি অঙ্গ। এক শরীর হারিয়ে যাচ্ছে আরেক শরীরে। সুখে, তীব্র সুখে প্রেমিকা জড়িয়ে ধরছে প্রেমিকের শরীর। যখন সব থেমে যায়, যখন চেতন ফেরে, প্রেমিকা হাঁসের মত হেঁটে যৌনাঙ্গে যন্ত্রণা নিয়ে পেচ্ছাব করতে যায়। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরতে থাকে পথে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পেচ্ছাবখানায়। তখন সে আর প্রেমিকা নয় রুদ্রর। তখন সে আমি, রুদ্রর বউ আমি। এ কি হল! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কি করে আমি রুদ্রর সঙ্গে মিলিত হয়েছি আবার, আবার কেন আমি তাকে আমার শরীর স্পর্শ করতে দিয়েছি? সে তো এই দাবি রাখে না। তার সঙ্গে ওই রাতের পরই কি আমার সম্পর্কে শেষ হয়নি? শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে জেনেও কেন আমি একটি অসখু তার শরীর থেকে আবার নিয়েছি। কেন এই ভুল। কেন আবার পাপের সঙ্গে নিজেকে জড়ানো! কেন আবার রোগের জীবাণু নিজের শরীরে নিয়ে নিজেকে অসুস্থ করা! ছি ছি! নিজেকে আমি কি একটওু ভালবাসি না। সাধ করে কেউ অসুস্থ হতে চায়! একটি নোংরা রোগ নিতে চায় নিজের রক্তে! নাকি ওই যৌনসুখ এমনই সুখ যে আমি এর গায়ে লেগে থাকা সংক্রামক অসখু টির কথা ভুলে যাচ্ছি! জানি না। আমি কিছুই জানি না! নিজের ওপর রাগ হয়, ঘণৃা হয়। আবার এও মনে হয়, রোগের জীবাণু তো ঢুকেই গেছে আমার রক্তে!শুদ্ধতা তো গেছেই শরীর থেকে, তাহলে আর কিসের প্রতিরোধ! যে জীবাণু আমার রক্তে নেচে বেড়াচ্ছে সেই প্রথম মিলনের রাত থেকে সেই জীবাণু দ্বিতীয় বার গ্রহণ করতে আর ক্ষতি কি! রুদ্র আমাকে তো নষ্ট করেছে, আমার আর নতুন করে নষ্ট হতে বাধা কোথায়! নিজেকে একটি নষ্ট পচা কীটের মত মনে হয়, নর্দমাতেও আমার স্থান হওয়া উচিত নয়। আমি আর আগের আমি নই। আগের আমার মৃত্যু হয়েছে। এ আমি নতুন আমি। এ আমি নষ্ট আমি। এ আমি রুদ্রর মতই পথভ্রষ্ট, রুদ্রর মতই নিয়নণ্ত্র হীন। বোধহীন। নিজের লাগাম খসে গেছে নিজেরই হাত থেকে। এখন আমাকে নিয়ে যে কেউ যা খুশি করতে পারে। নিজেকে বেশ্যার মত মনে হয়। বেশ্যার রোগ শরীরে। আমি বেশ্যাই তো। আর কি! সারা রাত দীর্ঘশ্বাসের এপাশ ফিরি, দীর্ঘশ্বাসের ওপাশ ফিরি। পরদিন ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য বেরোই ছোট্ট গুমোট ঘরটি থেকে, ভোরের শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া আমার শরীরের ক্লান্তি তুলে নেয় এক নিমেষেই। রুদ্র পেছনে দৌড়ে আসে, সেও যাবে আমার সঙ্গে ময়মনসিংহে।
তুমি কেন যাবে? পথে যদি বিপদ হয় রক্ষা করতে? কারণ তুমি আমার খুব মঙ্গল কামনা করো, তাই না? আমার শরীরে যেন কারও আঘাত না লাগে, আমার দিকে চোখ তুলে যেন কোনও পুরুষ না চায়, সে কারণে, তাই তো!
রুদ্র কথা বলে না।
ঠিক আছে চল। আমার জন্য নয়। তোমার জন্য চল ময়মনসিংহে। ওখানে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেব।
মহাখালির বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস দুঘন্টা সময় নেয় ময়মনসিংহে পৌঁছতে। বাসের পুরো পথ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনি না নিজের। পৃথিবীতে আর যেন কোনও শব্দ নেই। পাশে বসে রুদ্র নিঃশব্দে ঘুমোয়। ঘুমের রুদ্রর মখু হাঁ হয়ে থাকে। কি করে মানুষটির ঘুম আসে, এমন নিশ্চিন্তি সে কোত্থেকে পায় আমি বুঝে পাই না। ময়মনসিংহে নেমে রুদ্র কোথাও যায়, কোনও হোটেলে। আমি অবকাশে ফিরি। মা দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, আহারে আমার মেয়েটা কতদিন ঘরছাড়া ছিল। ইয়াসমিন বুবু আইছে বুবু আইছে বলে ছুটে আসে। ইয়াসমিনের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কোলে সুহৃদ। আমি লুকোতে চেষ্টা করি চোখের জল, পারি না। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদি। গলা ছেড়ে কাঁদি। ইচ্ছে হয় মেঝেয় লুটিয়ে কাঁদি। বাবা বলেন, সমুদ্র কেমন দেখলা মা? আমারই সমুদ্র দেখা হয় নাই এখনও, আমার মেয়ে সমুদ্র দেইখা ফেলল। মা দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে, তাড়াতাড়ি ভাল কিছু রান্না বসাতে। সুফি হেসে বলে,ইস কতদিন পরে আইলাইন! মা বাপ ছাড়া কেমন লাগছে এত দূরে! মামি ত নিত্যিদিন কয়, আমার মেয়েডা না জানি কি করতাছে! সুহৃদকে ইয়াসমিনের কোলে তুলে দিয়ে দৌড়ে গোসলখানায় যাই, আমার এক্ষুনি পেচ্ছাব না করলে নয়। গোসলখানায় বসে মুখে পানি ঢালি যেন চোখের জল পানির স্রোতের সঙ্গে চলে যায়। বদনি বদনি পানি ঢালি, বালতির পানি ফুরিয়ে যায়, চোখের জল ফুরোয় না। আমি প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজের চিৎকার থামাতে পারি, চোখের জলকে পারি না। তার চেয়ে এরকম যদি হত, আমি বাড়ি ঢুকলেই বাবা আমাকে গাল দিতেন, গালে দুটো চড় কষিয়ে বলতেন, আইজকা সকালে তো হাইজিন ট্যুরের দল ময়মনসিংহ পৌঁচেছে, তর দেরি হইল কেন হারামজাদি? মা যদি বলতেন, সমুদ্রের নাম কইয়া আসলে কই গেছিলি ক তো! ওই যে যেই বেডা তরে বউ কইয়া চিঠি লেকছিল, হেই বেডার সাথে কাডইিয়া আইছস না তো। ইয়াসমিন যদি কাছে না আসত, আমার বাড়ি ফেরায় না ফেরায় ওর যদি কিছু না যায় আসত, সুহৃদকে কোলে নিতে চাইলে সুহৃদ যদি মখু ফিরিয়ে নিত, আমার ভাল লাগত। আমি ভালবাসা পেতে চাই না কারও কাছ থেকে আর। ঘণৃা করুক আমাকে সবাই। প্রচণ্ড ঘণৃা করুক।
পরদিন কলেজে গিয়ে কোনও ক্লাস না করে রুদ্রকে ক্যান্টিন থেকে উঠিয়ে নিয়ে চড়পাড়ার রাস্তায় সারি সারি ওষুধের দোকান, ডাক্তারের চেম্বার আর ল্যাবরটরির পাশ দিয়ে হাঁটি। কোথায় যাব, কোন ডাক্তারের কাছে? যে কোনও ডাক্তারই আমাকে চেনে, নামে চেনে, মুখে চেনে, নয়ত বাবার মেয়ে হিসেবে চেনা। যে কোনও ডাক্তারই অবাক হবে আমি একটি সিফিলিস রোগিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে, বার বার প্রশ্ন করবে কে এই রোগি? কি হয় আমার? ভাবি কোনও ডাক্তারের না গিয়ে রক্ত পরীক্ষাই করে নেওয়া ভাল। ভেবে কোনও ডাক্তারের চেম্বারে নয়, রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢুকি একটি প্যাথলজি ল্যাবএ। এক চৌকোনা চোয়ালের কালো লোক, চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, অনুমান করি টেকনিশিয়ান, বলি এর ভিডিআরএল টেস্ট করতে হবে। বলার সময় কণ্ঠ কাঁপে আমার। লোকটি তীক্ষ্ম চোখে আমাকে দেখে। চোখের প্রশ্ন লোক কি হয় আপনার? আমি চোখ নামিয়ে ফেলি, যেন পড়িনি কোনও প্রশ্ন। চোখের তীক্ষ্মতা দেখিনি। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা চেনা রোগি নিয়ে এমন কি রাস্তায় পড়ে থেকে কাতরাতে থাকা রোগীদের দয়া করে তো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এরকমই হয়ত কিছু। হাসপাতালের করিডোরে এক লোক হাঁটছিল, আমার সাহায্য চাইল তার রোগের চিকিৎসার জন্য। আমার অবসর ছিল বলে, ঠিক এক্ষুনি কোনও ক্লাস ছিল না বলে, লোকটিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। মুখের ভাবে যে রকম কারণই দিই না কেন লোকটির ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি খেলতে থাকে, বুঝি যে এই লোক আমাদের দুজনকে আগে অনেক দেখেছে, এই লোক খুব ভাল করে চেনে আমাকে, রুদ্র আমার স্বামী এ কথা না জানলেও জানে রুদ্র আমার প্রেমিক।
রুদ্রর রক্ত পরীক্ষার ফল হাতে এল। ভিডিআরএল পজিটিভ।
কাগজটির দিকে তাকিয়ে, যে এক চিলতে আশাকে লালন করেছিলাম, শক্ত পায়ে কেউ মাড়িয়ে গেল। হাহাকার ছাড়া কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সারা জীবনের জন্য ওই আমার সম্বল।
রক্ত পরীক্ষা হল মেডিকেল কলেজের আঙিনায়। চৌকোনা লোকটি হাসপাতালে যেতে আসতে আমাকে ফিরে ফিরে দেখে। এ লোক কি তাবৎ ডাক্তারদের কাছে বলে বেড়াচ্ছে যে আমার সঙ্গে একটি দাড়িঅলা লোক ঘোরে, লোকটির সিফিলিস হয়েছে! বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আর কিসের সতর্কতা আমার! ওই আঙিনাতেই বিকেলে যৌনবিশেষজ্ঞের চেম্বারে ঢুকি প্যাথলজির কাগজটি হাতে নিয়ে। পেছনে রুদ্র। বিশেষজ্ঞ চোখ কুঁচকে কাগজের দিকে, রুদ্রর দিকে, আমার দিকে ঘন ঘন তাকিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, এ কি তোমার চেনা রোগি?
হ্যাঁ স্যার। শান্ত কন্ঠ।
ও।
বিশেষজ্ঞের ভাবনার ভেতরে নেই এই রোগী আমার কোনও আত্মীয় হতে পারে। কোনও উদ্ভট কল্পনাও যদি এই বিশেষজ্ঞ করেন, তার ত্রিসীমানার মধ্যে নেই এই রোগী আমার প্রেমিক হতে পারে, অথবা আমার স্বামী। তাই রোগী তোমার কি হয় জিজ্ঞেস না করে জানতে চেয়েছেন এ আমার চেনা রোগী কি না। চেনাই তো। রুদ্র আমার সেই কতকালের চেনা। ফের কোনও বাক্যালাপের সুযোগ না দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোই। বাইরে এসে ফুসফুস ভরে মুক্ত হাওয়ার ঘ্রাণ নিয়ে শান্ত গলায় বলি, এবার? সবই তো হল। যাও, ঢাকায় গিয়ে পেনিসিলিন ইনজেকশন নাও। কোনও এক ফার্মেসিতে গিয়ে বল, কমপাউন্ডার পুশ করে দেবে।
আর তুমি?
আর আমি?
হ্যাঁ তুমি।
আমি কি?
তুমি কি করবে?
আমি আর কি করব, লেখাপড়া করব, ডাক্তার হব, রোগির চিকিৎসা করব।
সম্পর্ক?
কিসের সম্পর্ক? কার সঙ্গে?
আমার সঙ্গে।
আমি হেসে উঠি।
তোমার সঙ্গে এখনও কি সম্পর্কে আমার ফুরোয়নি রুদ্র?
রুদ্র অনেকক্ষণ চপু করে থেকে ভাঙা গলায় বলে, ক্ষমা করতে পার না?
ক্ষমা? ক্ষমা তো আমি তোমাকে করেছিই। নিজের মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে এই জন্ম-চেনা শহরে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। তোমাকে তো ওই মোংলা বন্দরেই পারতাম, পারতাম না ত্যাগ করতে?
পারতে।
রুদ্রর চোখে সেই চিরকেলে ধূসরতা।
আমার জীবনে আর আছে কি বল। এত বছর প্রেম করে, বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে প্রথম মিলন, দীর্ঘ বছর অপেক্ষার পর সেই দিনটি এল। বিষম সুখের সময় আমার, বিষম আনন্দের। তাই না? সমস্ত ভয় লজ্জা দূর করে নিজের সমস্তটুকু দিয়েছি তোমাকে, যে সমস্তটুকু চাইতে তুমি। সম্পণূর্ করে আমাকে চাইতে। পেলে তো! এখন তো তোমার সাধ মিটেছে, তাই না! আমার বিয়েতে তো আমি কোনও লাল বেনারসি পরিনি, গয়না পরিনি, বিয়েতে তো কোনও বাদ্য বাজেনি, অতিথি আসেনি, কেবল তুমি আর আমি উদযাপন করেছি। আমি তোমাকে উপহার দিয়েছি আমার সমস্ত ভালবাসা, সমস্ত বিশ্বাস, তুমি আমাকে উপহার দিয়েছো একটি রোগ। আমার বিয়ের উপহার তোমার কাছ থেকে তো এটিই। কি বল?
তোমারও তো ইনজেকশন নিতে হবে। ঢাকায় চল।
আমাকে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। অনেক ভেবেছো। এবার অন্য কিছু নিয়ে ভাবো। নিজের জীবন নিয়ে ভাবো। পারোতো রোগ বালাই থেকে দূরে থেকো।
তুমি আমাকে ত্যাগ করছ?
নিস্পৃহ কণ্ঠ আমার।
হ্যাঁ ত্যাগ করছি। ভেব না তোমার সিফিলিস হয়েছে বলে আমি তোমাকে ত্যাগ করছি। নেহাত দুভার্গা বলে তোমার রোগটি হয়েছে, তুমি বেশ্যাবাড়ি যাও, ওদের সঙ্গে থাকো, নাও হতে পারত এই রোগ তোমার। সবার হয় না। আমি তোমাকে ত্যাগ করছি, তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ বলে।
রুদ্রর চোখ ছলছল করে।
আমার জায়গায় হলে তুমি কি করতে রুদ্র?
সত্যিই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ?
সত্যিই।
একবার ভাল হবার সুযোগ দেবে না?
আমি মলিন হাসি। নিঃস্ব, রিক্ত, সব হারানো মানুষ আমি। আমি সুযোগ দেবার কে! আমি কি কোনও মানুষ। নিজের ওপরই লজ্জা হয়, নিজেকেই ঘৃণা হয়। রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে চরপাড়ার রাস্তায়, একা। আমি চলে আসি, আমার একবারও ইচ্ছে হয় না পেছনে তাকাতে। একবারও ইচ্ছে হয় না রুদ্রকে বলি আবার এসো, চিঠি লিখো। ইচ্ছে হয় না আমার। আমি জানি এই শেষ দেখা আমার তার সঙ্গে। আর হয়ত কোনওদিন দেখা হবে, হঠাৎ কখনও ঢাকার রাস্তায়, কখনও কোনদিন কোনও বইমেলায়। রুদ্রকে আমার স্বামী বলে তো নয়ই, কোনও প্রেমিক বলেও মনে হয় না। মনে হয় এক চেনা লোক। চেনা লোকটি কবিতা লেখে। চেনা লোকটির অসখু হয়েছে বলে, যেহেতু আমার হাতের কাছে চিকিৎসার সৃুযোগ আছে, করুণা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। চেনা লোকটি তার চেনা জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার চেনা জায়গায়। চেনা লোকটিকে নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন নেই। চেনা লোকটি আর কোনওদিন আসবে না আমার কাছে, আমার জীবনে, আমার শরীরে, আমার মনে। আর কোনও প্রেমের চিঠি নয়। আর কোনও শোয়াশোয়ি নয়। আর কোনও সংসার নয়। কোনও বন্ধন নয়। বন্ধন ছিন্ন করতে কোনও একদিন কোনও একটি কাগজে সই করে দেব। চেনা লোকটি ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে উঠবে। চেনা লোকটির কবিতাই শুধু চেনা থেকে যাবে। আর কিছু নয়। চেনা লোকটির কবিতা হয়ত পড়ব, ধূসর ধূসর কিছু স্মৃতি হয়ত আমাকে মুহূর্তের জন্য আনমনা করবে। কেবল এই। এর বেশি নয় কিছু আর।