সেঁজুতি
আমাকে হঠাৎ একা করে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর চন্দনা চলে গেল। চন্দনা তো আর গেল না, ওকে ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন ওর বাবা ডাক্তার সুব্রত চাকমা, পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি, চন্দনাকে জন্ম দেবার পর দু দুটো ছেলে-বাচ্চার জন্ম দিয়ে স্বামীর আশা পূরণ করেছিলেন যে মলিনা সেই মলিনার মলিন স্বামী; কুমিল্লায়। কুমিল্লা যাওয়ার আগে দাদা আমাকে আর চন্দনাকে নিয়ে ঢাকা বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট তুলতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে যাওয়া বিকেলে ফেরা। মতিঝিলে টাই টুং চিনে রেস্তোরাঁয় দুপুরে আমাদের খাওয়াতে নিয়ে দাদা বললেন, কি চন্দনা, তোমরা চোখ কান খোলা রাখো না কেন?
কেন,কি দেখি নাই কি শুনি নাই?
একটা সুন্দরী মেয়ে দেখবা না আমার জন্য? কলেজে দুইটা বছর পড়লা!
আমরা ছেলেদের দিকে তাকাইয়াই সময় পাই না। মেয়েদের দিকে কখন তাকাবো! চন্দনা হেসে ফেলে। অনাত্মীয় পুরুষদের মধ্যে চন্দনা আমার দাদাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি য়চ্ছন্দ। চাকমা রাজা দেবাশীষের কথা মনে করে চুক চুক দুঃখ করে দাদা বলেন, যে ভুলটা তুমি করছ, পরে কিন্তু এর জন্য পস্তাইবা। একটা রাজারে পাত্তা দিলা না!
চন্দনা জোরে হেসে ওঠে।
দাদার দুঃখ শেষ হয় না। আমরা রাঙামাটিতে গেলে রাজার বাড়ির অতিথি হইয়া থাকতে পারতাম! এই সুযোগটা নষ্ট কইরা দিলা।
চন্দনা আবারও হাসে।
না জানি তোমার কপালে কোন ফকির আছে!
রাঙামাটির গল্প বলতে গিয়ে দেবাশীষের চেয়ে ও বেশি বলে চেরাগ আলীর কথা। রাঙামাটিতে এক দারোগা আছে, দারোগার নাম চেরাগ আলী, চেরাগ আলী বলেন, তিনি দিনেও জ্বলেন রাতেও জ্বলেন। চন্দনা খানিকপর গম্ভীর হয়ে বলে, তবে চেরাগ আলী ইদানিং কিছু কম জ্বলেন, কারণ তাঁর চাকরিটি চলে গেছে। যদিও অল্প সময় ঢাকায়, তবওু চন্দনা আর আমি ময়মনসিংহের চেনা পরিবেশ থেকে দূরে যেতে পেরে সুখের দোলনায় দুলি। কুমিল্লা যাওয়ার আগে বলেছিলাম চন্দনাকে, যাইস না, তুই গেলে বাঁচবাম কেমনে? চন্দনারও একই প্রশ্ন ছিল, আমাদের প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই কারও কাছে। সুব্রত চাকমাকে চন্দনা এমনও বলেছে সে ময়মনসিংহ ছেড়ে যাবে না, এখানে আমার সঙ্গে অবকাশে থেকে লেখাপড়া করবে।তিনি রাজি হননি। চন্দনার আধবোজা চোখ লাল হয়ে ছিল যাবার দিন। আমার কানে কানে বলেছে, দেখিস আমি পলাইয়া একদিন চইলা আইয়াম তর কাছে। আমরা দুইজন সারাজীবন একসাথে থাকবাম। কুমিল্লা থেকে দিনে দুটি তিনটি করে চিঠি লিখছে চন্দনা। লম্বা লম্বা চিঠি। প্রতিদিনের প্রতিটি ঘটনা, দুর্ঘটনা। প্রতিদিনের মন কেমন করা। প্রতিদিনের নিঃসঙ্গতা। প্রতিদিনের হাহাকার। বাড়ির কাছে কৃষ্ণচুড়া ফুটে লাল হয়ে আছে, গাছটির দিকে যখনই তাকায় ও, আমাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে ফেলে যাওয়া জীবনের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কুঁড়ি, প্রতিটি ফুল। জীবনটি ওর আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। চন্দনার এই যাওয়াকে আমার যাওয়া বলে মনে হয় না। মনে হয় আবার ফিরে আসার জন্য গেছে সে। এ যাওয়া সারাজীবনের মত চলে যাওয়া নয়। আমাদের আবার দেখা হবে, আমরা আবার দুলব আনন্দ দোলনায়। আবার সেই নৌকোর গলুইয়ে বসে আমি আকাশের রং দেখব, আর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে চন্দনা বৈঠা বেয়ে চলে যাবে বহু দূরে, সীমানা পেরিয়ে। এমন একটি জগতে যেখানে কোনও পাপ নেই, পঙ্কিলতা নেই, হিংসা নেই, ঘণৃা নেই, নিষ্ঠুরতা নির্মমতা নেই, যেখানে কোনও অন্যায় নেই, বৈষম্য নেই,যেখানে কোনও রোগ নেই, শোক নেই, মৃত্যু নেই। যেখানে শুভ্রতার ঘ্রাণ নিতে নিতে সুন্দরের সঙ্গে বাস করব আমরা, ভালবাসা আমাদের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও যাবে না। চন্দনা ভাল না লাগায় ভগু তে ভগু তে লেখে আমার ভাল লাগছে না, আমি যেন জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধে। ভাল লাগা ভালবাসা এসব শব্দগুলো সব পুরোনো মনে হচ্ছে। আমি তোকে বোঝাতে পারছি না। কেবল মনে হচ্ছে আমি যেন আমাতে নেই। আজ সারাদিন মন খারাপ, সামান্য আঘাত লেগে মেহগিনি পাতাগুলো যখন ঝিরঝির ফুলের মত প্রশান্তির মত ঝরে পড়ে তখন ইচ্ছে করে কোনও জিনস জ্যাকেটের পিঠে মাথা রেখে হোন্ডায় চড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই। আমি জানি, কি নির্মম ভাবে জানি অথচ বলিনি কারও কাছে এসব আমার জন্য কেবল অলীক স্বপ্ন মাত্র। আমাকে আঘাত কর তুই, চোখে জল না থাকলে আমি ভাল থাকি না তো, কিছুতেই না, আসলে আমার কি হয়েছে আমি তোকে বলতে পারব না, তাহলে জেনে যাবে, সবাই জেনে যাবে। আমি কেবল ছটফট করছি, আকুল হয়ে মরছি অথচ কি জানিস পুরো ব্যাপারটা তুই জানবি না, নেভার, তুই আমার এত আপন, এত ঘনিষ্ঠ, হৃদয়ের এত কাছে থাকিস তুই, তবু বলা হবে না। হায়রে মন। এই মনটাই আমার শত্রু। সব যখন ঠিকঠাক চলে, ঠিক সে মুহূর্তেই আমি বদলে যাই। মন নামক এই পদার্থটি বিট্রে করে বসে আমার সঙ্গে। আমি ভাল নেই, একদম না, চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, একধরনের ঈর্ষায় হিংসেয় আমি ছিন্নভিন্ন হই অবিরত, অথচ বোঝাতে পারি না। বুঝতেও পারি না এই ঈর্ষা কার বিরুদ্ধে, এই দ্বন্দ ্ব কেন। তবে কি আমি আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চাই? আমি কি আমাকে আর ভালবাসি না? কি জানি .. যদি কোনও এক নীল চোখের গ্রীক যুবক, যদি কোনও এপোলো আমাকে ভালবাসার কথা বলত ..! আমার ভেতর সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। আমি আর কোনওকিছুতে আনন্দ পাই না। মনে পড়ে আসামী হাজিরের সদানন্দ কি এক অব্যক্ত যনণ্ত্রায় আর্তনাদ করত, মনে কর তেমন কোনও অব্যক্ত যন্ত্রণায় আমি আর্তনাদ করছি। এই একঘেয়ে জীবন আর ভাল লাগে না। তুই আমাকে মনোহর উত্তরণে নিয়ে যেতে পারবি? মন কাঁদে, তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার, তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে মন মনরে আমার। বুঝতে পারিস কি বললাম? বুঝিস না? আমি তোকে কাছে পেতে চাইছি। আমি কেবল তোকেই চাই, কতকাল দেখিনি তোকে। এই সংসার এই মায়ার বন্ধন ছেড়ে চল ঘুরে বেড়াই বাউলের একতারা নিয়ে, তুই হবি বৈষ্ণব আমি বৈষ্ণবি, টুং টাং শব্দ তুলে আমরা গাইব দুজনেই, পাখি ছটফটাইয়া মরে, শিকল ছিঁড়িতে না পারে, খাঁচা ভাঙিতে না পারে, পাখি ছটফটাইয়া মরে। অথবা চোক্ষেরই নাম আরশিনগর, একদিন ক্ষইয়া যাবে, পোড়া চোখে যা দেখিলাম তাই রইয়া যাবে।
চন্দনাকে দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লেখা ছাড়া ছাদে, ঘরের কোণে, বারান্দায়, মাঠের ঘাসে, ভোরের শিউলিতলায়, সেগুন গাছের ছায়ায় বসে একটি জিনিসই তখন হয়, কবিতা লেখা। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে কবিতা পত্রিকা আসে আমার ঠিকানায়। পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চল থেকেও আসে কবিতার ছোট কাগজ। এগুলো এক ধরনের শেকলের মত, একটি থেকে আরেকটি, আরেকটি থেকে আরেকটি করে করে ব্যাপ্ত হতে থাকে। ছোট কবিতা পত্রিকায়, ঢাকার সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও পাঠাই কবিতা। কোথাও না কোথাও ছাপা হতে থাকে কিছু না কিছু একদিন আমার ভাবনার পুকুরে ঢিল পড়ে, কোত্থেকে পড়ে, কি করে পড়ে কিছু না জেনে আমি পুকুর পাড়ে নিস্পন্দ বসে থাকি। পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ ক্রমে বড় হতে হতে পায়ে আছড়ে পড়ে, আমার শরীর ভিজতে থাকে জলে। আমি তবু নিস্পন্দ বসে থাকি। নিস্পন্দ আমাকে দেখতে লাগে, ভেতরে আমার উঁকি দিচ্ছে একটি ইচ্ছের অঙ্কুর। আমি তো চেষ্টা করলে নিজেই একটি কবিতা পত্রিকা বের করতে পারি। পারি না কি? পারি। মন বলে পারি। ডলি পালের বাড়ি থেকে ভেসে আসা উলুধ্বনির শব্দ আমাকে সচকিত করে। দশদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কী নাম দেব পত্রিকার? কী দেব নাম? আমাকে দুদিন কিংবা তিনদিন ভাবতে হয় না। মন বলে, সেঁজুতি! হ্যাঁ সেঁজুতিই। সন্ধ্যাপ্রদীপ। চন্দনার কাছে চাওয়ামাত্র কবিতা পাঠিয়ে দেয়, ইশকুল শেষ হওয়ার পরও বাংলার শিক্ষিকা সুরাইয়া বেগম আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, তাঁকে দিয়ে নতুন একটি কবিতা লিখিয়ে নিই আর ছোটদাকে বলে শহরের কিছু কবির কবিতা আনিয়ে শখের বশে সুখের ঘোরে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলি সেঁজুতির, কিছু টুকরো খবর শেষের পাতায়, সাহিত্যের সাহিত্যিকের, সাহিত্যের কোন ছোট পত্রিকা কোত্থেকে কারা বের করেছে, কেমন হয়েছে ভাল না মন্দ, মন্দ হলে কেন ভাল হলে তাই বা কেন, এসব। দাদা বললেন আমার একটা কবিতা ছাপা। তাঁর কবিতার খাতা থেকে সবচেয়ে ভাল কবিতাটি নিই। আমার খবরটাও লেইখা দে। লেইখা দে পাতা পত্রিকার সম্পাদক ফয়জুল কবীর নোমানএর প্রথম কবিতার বই পারাপার শিগরি বেরোচ্ছে। তাও লিখে দিই। দাদা খুশি। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাজানোর সময় হয়ে এল, কে টাকা দেবে, কে প্রেসে যাবে, কে ছেপে আনবে সেঁজুতি! পারাপার নামে দাদা কোনও বই লেখা শুরুই করেননি, তবু তাঁর অনুরোধে খবরটি দেবার কারণেই সম্ভবত তিনি বললেন ঠিক আছে যা, আমি তর এই সেঁজুতি ছাপার খরচ দিয়াম নে। প্রেসের সবাইরে তো আমি চিনি, পাতা পত্রিকা ছাপানোর কারণে। দাদার কানের কাছে পিনপিন করে বেজেই চলল আমার গানা ও দাদা, ও দাদা, তুমি তো কইছ ছাপাইয়া দিবা, দেও।
ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধর।
ধৈর্য আর কত ধরাম?
আরও ধৈর্য ধর। আরও।
কতদিন?
আরও কিছুদিন।
ধৈর্য ধরা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। দিন দিন অস্থির হতে থাকি। শেষ অবদি ছোটদার হাতে পাণ্ডুলিপি দিই। ছোটবাজারের একটি ছাপাখানায় সেঁজুতি দিয়ে আসার পর ছোটদার লেজে লেগে থাকি, কবে ছাপা হবে? ছাপার দেরি আছে। কত দেরি? সামনের মাসে ছাপা হইব। উফ এত দেরি! প্রেসের কি আর কাজ নাই নাকি?
আমারে একদিন নিয়া যাইবা ছাপাখানায়? তুই যাইতি কেন? আমিই ছাপাইয়া নিয়া আসব।
ছাপাখানায় যাওয়ার ইচ্ছেজ্ঞটর গলা ধরে দাদা ধাক্কা দেন, প্রেসে যাইবি কেন?
কেমনে ছাপায় দেখতে ইচ্ছা করতাছে।
মেয়েরা প্রেসে যায় না।
কেন যায় না?
যায় না।
কোনও কারণ আছে?
মেয়েদের প্রেসে যাইতে হয় না।
কেন হয় না? গেলে কি হয়?
অসুবিধা হয়।
কি অসুবিধা? মাইনষে চাক্কাইব?
চাক্কাইব না হয়ত, কিন্তু হাসব।
হাসব কেন? হাসির কি আছে? আমি সম্পাদনা করতাছি পত্রিকা, আমি কেন প্রেসে যাব না?
সম্পাদনা ঘরে বইয়া করা যায়। পুরুষমানুষের মত প্রেসে দৌড়ানোর দরকার নাই। দাদা আমার উৎসাহ নিবৃত্ত করতে পারেন না। ছোটদার সঙ্গে প্রেসে আমি যাই যে করেই হোক যাই। কালো কালো কাত করা ঘরকাটা বড় টেবিল মত, তার সামনে বসে লোকেরা এক একটি ঘর থেকে এক একটি ক্ষুদ্র বণর্ নিয়ে লোহার পাতে রাখছে। তুমি লিখতে গিয়ে, ত এর ঘর থেকে ত তুলে,ুর ঘর থেকেু তারপর একটি িনিয়ে তার পাশে ম বসাচ্ছে। এক তুমিতেই চারবার হাত বাড়াতে হয়। কি করে লোকেরা জানে কোন ঘরে ত আছে, কোন ঘরে ম, কি করে হাতগুলো এত দ্রুত সঞ্চালিত হয়! ইচ্ছে করে সারাদিন বসে প্রেসের কাজ দেখি, দেখি কি করে অক্ষর জুড়ে শব্দ বানায় ওরা। ছাপার মেশিনটি ঘড়ঘড় শব্দে ছেপে যাচ্ছে বিড়ির কাগজ, আগরবাতির কাগজ, মলমের কৌটোর কাগজ,বিয়ের কাডর্, রাজনৈতিক পোস্টার। সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের মালিক হরে কৃষ্ণ সাহা অন্যরকম কিছুর স্বাদ পেয়ে অন্যরকম হাসি হাসলেন। ছেপে দেবেন শীঘ্র বললেন। প্রতি ফর্মা দুশ টাকা। কেবল দুশ টাকাই কি! আছে কাগজ কেনার টাকা। বাড়ি ফিরে শিশিবোতলকাগজঅলার কাছে বাড়িতে আস্ত অনাস্ত যত কাগজ আছে, পুরোনো চিত্রালী পূর্বাণী রোদে শুকিয়ে উই ঝেড়ে, পুরোনো রোববার সন্ধানী বিচিত্রার মায়া কাটিয়ে বিক্রি করে টাকা জমা করি। মার আঁচলের খুঁট থেকেও কিছু অর্জন হয়। এদিক ওদিক থেকে আরও কিছু যক্ষের ধন মুঠো করে ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে হরে কৃষ্ণ সাহার ছাপাখানার পাশেই কাগজের দোকান থেকে পছন্দ করে কাগজ কিনে দিয়ে আসি ছাপাখানায়। এরপর বাড়িতে ছোটদা প্রুফ নিয়ে এসে প্রুফ কি করে দেখতে হয় শিখিয়ে দেন। নিজে তিনি পত্রিকায় কাজ করেন, জানেন। ছাপার টাকার জন্য দাদার ওপর ভরসা করি, একবারে টাকা পাওয়া না গেলেও কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা মেলে।
যেদিন হলুদ রঙের পাঁচশ সেঁজুতি ছাপা হয়ে বাড়িতে এল, সেঁজুতির রূপ রস গন্ধ সব গ্রহণ করার পর বিছানায় বসে সেজুঁতির পাতা ভাঁজ করে করে পিন আটকে আলাদা করে রাখছিলাম, বাবার বাড়ি ঢোকার শব্দ শুনে চালান করে দিই সব খাটের নিচে। খাটের নিচেও চোখ যায় বাবার। বাবার চোখ, ইয়াসমিন বলে, শকুনের। কারও সাধ্য নেই কিছু লুকিয়ে রাখে। বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, তা তিনি বেশির ভাগ সময় বাড়ি না থেকেও জানেন। কে যে কখন বাবার দূত হয়ে কাজ করে, অসম্ভব অনুমান করা। মাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ওইসব, লেখাপড়া রাইখা করে কি মেয়ে?
মা নিস্পৃহ কণ্ঠে বলেন, কি জানি কি কবিতার পত্রিকা ছাপাইছে।
কবিতার পত্রিকা আবার কি?
কবিতা লেখে। পত্রিকা ছাপায়।
কবিতার পত্রিকা দিয়া কি হইব? তারে না কইছি লেখাপড়া করতে? মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করাইব কেডা ওরে? কবিতা দিয়া পাশ হইব?
মার ওপর ধকল যায়।
টাকা পাইল কই? বাবার কৌতূহল উপচে ওঠে।
মা নীরস মুখে বলেন, নোমান দিছে।
নোমান দিছে কেন?
চাইছে। দিছে।
চাইলেই দিতে হইব নাকি?
ছোট বোন শখ করছে তাই দিছে।
নোমানের লাভ কি?
লাভ কি সবাই খুঁজে? ভাল লাগে বইলা কবিতা লেখে। নোমানও তো কবিতার পত্রিকা ছাপত। এহন নাসরিন ধরছে।
আমি যে দিনরাইত খাইটা আইনা তাদেরে খাওয়াই, তা কি এইসব আজে বাজে কাজ কইরা সময় নষ্ট করার লাইগা?
মা বলেন,আমারে জিগান কেন? মেয়েরে গিয়া জিগান।
বাবা আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসেন না। দাদাকে ধরেন, ওরে যে উস্কাইতাছস, ও পাগল হইছে বইলা কি তুইও পাগল হইছস?
দাদা মিনমিন করেন, ওরে তো উস্কাই নাই আমি।
টাকা দিছস কেন?
বেশি দেই নাই ত।
দিছস ত। তুই টাকা না দিলে এইগুলা কি করতে পারত ও?
দাদা গবের্ ফুলে বলেন, না।
কবিতা লেইখা কি হয় জীবনে? কিছু হয়?
না।
তাইলে লেখে কেন?
এমনি।
কবিতা ভাত দেয়?
দাদা মাথা নাড়েন, ভাত দেয় না।
কাপড় দেয়?
দেয় না।
১০৪
বাড়ি দেয়?
না।
ইলেকট্রিসিটি দেয়?
না।
দাদা নতমুখে নরম স্বরে উত্তর দিতে থাকেন।
শহরে ঘুইরা ঘুইরা মাইনষের জীবন ত দেখছস। কেউ কি আছে কবিতা লেইখা বাড়ি বানাইছে?
না।
কোনও ভদ্রলোকে ফালতু কাজে সময় নষ্ট করে?
না।
পাগল ছাড়া আর কেউ কি কবিতা লেখে?
দাদা এবার আর কোনও উত্তর দেন না। বাবা আরও দুবার প্রশ্নটি করে দাদাকে ওভাবেই নিরুত্তর রেখে জুতোর মচমচ শব্দ তুলে বেরিয়ে যান।
বাবা মুখে তালা দিয়েছেন। বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলবেন, আমার সঙ্গে নয়। বাবা কথা না বলা মানে টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ করা। আমার এখন কলেজও নেই যে কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়ার দরকার হবে, একরকম স্বস্তিই পাই বাবার রক্তচোখ আর দাঁত কটমট আর গালিগালাজ আর পড়তে বসার আদেশের সামনে পড়তে হবে না বলে। বাবার স্বভাবই এমন, হঠাৎ হঠাৎ কথা বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এভাবেই চলতে থাকে। বাড়িতে এক কাজের মানুষ ছাড়া আর সবার সঙ্গেই তিনি দফায় দফায় কথা বন্ধ করেছেন। যখন কথা বলা ফের শুরু হয়, তিনি নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করেন বলে হয়। মুখের তালা তিনি যখন ইচ্ছে খোলেন যখন ইচ্ছে লাগান, চাবি তাঁর বুক পকেটে। অনেক সময় এমনও হয় যে বাবা কার সঙ্গে কি কারণে কথা বন্ধ করেছেন, সে কারণ খুঁজে পাওয়া আমাদের সবার জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।এবার আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণটি হল সেঁজুতি। মুখে তালা দেওয়ার সপ্তাহ পার না হতেই আমার উদ্দেশে তিনি পত্র পাঠাতে শুরু করলেন। মখু বুজেই তিনি মুখের শব্দগুলো পত্রাকারে, সাধুকে চলিতের সঙ্গে গুলে পাঠাতে লাগলেন। পত্রবাহক আরোগ্যবিতানের কর্মচারি সালাম। সালামকে মা সালামের পুরো নাম ধরেই ডাকেন। সালাম হল আল্লাহর নিরানব্বইটি নামের একটি নাম। সরাসরি আল্লাহর নামে কাউকে ডাকতে হয় না, আবদুস বা আবদুল জুড়ে দিলে নামের অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর গোলাম। যেহেতু মানুষ মাত্রই আল্লাহর গোলাম, মা তাই সালামকে আবদুস সালাম অর্থাৎ আল্লার গোলাম বলেই ডাকেন। কুদ্দুস নামে মার এক পাড়াতুতো ভাই আছে, সবাই ওকে কুদ্দুস ডাকে, মা ডাকেন আবদুল কুদ্দুস। আবদুস সালাম আমার হাতে পত্র দিয়ে যাওয়ার পর মা আমাকে পড়ে শোনাতে বলেন প্রতিটি পত্রই। আমি জোরে পড়ি, কেবল মা নন, বাড়ির আর সবাই শোনে। দশ বারো পৃষ্ঠার পত্র, পিতার আদেশ নিষেধ মানার ফজিলত বর্ণনা করে পত্রের শুরু, চরম হতাশা আর হাহাকার দিয়ে পত্র শেষ, মাঝখানে নীতিবাক্যের নহর। শেষ বাক্যটি যথারীতি ইতি তোমার হতভাগ্য পিতা। পত্র আমি পড়ি ঠিকই, তবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য বইয়ের ওপর উপুড় হয়ে থাকার কোনও চেষ্টাই করি না। করি না কারণ ইচ্ছে করে না। বাবা যে লেখাপড়ার কথা বলেন, সেটা না হলেও অন্য ধরণের লেখা আর পড়ায় আমি দিবস রজনী কাটাতে থাকি।
কবিদের ঠিকানায় আর বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের ঠিকানায় সেঁজুতি পাঠাবার কিছুদিন পর থেকেই প্রচুর চিঠি আসতে থাকে, চিঠির সঙ্গে কবিতা। কবিতা পড়, শুদ্ধ কর, পরের সংখ্যায় ছাপার জন্য তুলে রাখো। সেঁজুতিকে করেছি ষৈনমাসিক। কিন্তু ইচ্ছে করে কালই ছেপে ফেলি। দীর্ঘ তিনটে মাসের অপেক্ষা সহ্য হয় না। চিঠি আসে এত, বাবা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলেন,যত্র তত্র পত্রমিতালি কি ও বন্ধ করে নাই এখনো? যত্র তত্র পত্রমিতালি বন্ধ হয় বটে, যত্র তত্র কবিতা লেখা বন্ধ হয় না, ও চলে। বারান্দার টেবিলে পড়ে থাকা একটি সেঁজুতি তিনি একদিন আলগোছে সরিয়ে নেন। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়েন সেঁজুতির সবগুলো কবিতা। পড়া হলে সেটি পকেটে নিয়েই বাইরে যান। কি হতে যাচ্ছে ঘটনা তা আঁচ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। রাতে তিনি মাকে নিজের ঘরে ডেকে পাশে বসিয়ে সেঁজুতি থেকে একটি কবিতা শুনিয়ে বলেন, দেখ এইখানে কবি বলতাছে কাগজ হইল মাটি, কলম হইল কোদাল, আর কবিতা লেখা হইল নিজের কবর খোঁড়া। ঠিক কইছে না? কবিরা নিজেরা খোঁড়ে নিজের কবর, এই কথা তো এক কবিই কইল।
পত্রের কোনও প্রত্যুত্তর বাবা পান না। তিনি মখু কালো করে বাড়ি ফেরেন, মখু কালো করেই বেরিয়ে যান। আমার লম্বা ফর্সা কোঁকড়া চুলের উত্তম কুমার-বাবা-র পেটে কত ধমক,কত খিস্তি জমা হয়ে আছে, ছিটকে বেরোতে চায়, কিন্তু তিনি ওসব নীতি-চাপা দিয়ে রাখেন। নৈঃশব্দ তাঁর অনেক নীতির এক নীতি কি না! পত্রাঘাতে আমি হেলে পড়ছি না বলে তিনি যে কাজটি করেন এরপর, সেটি অভিনব। তাঁর ঘরের দরজায় একটি কাগজ সেঁটে তিনি লিখেছেন,
আমি আর সহিতে পারছি না এত অন্যায়,
এই কি ছিল আমার কপালে হায়!
ছেলেমেয়েরা গেছে উচ্ছন্নে,
কাঁদিয়া মরি আমি মনে মনে।
লেখাটি পড়ে বাবার ঘরের লাল নীল জানালার লাল কাচে ভাতের আঠায় একটি কাগজ সেঁটে দিয়ে আসি, কাগজে লেখা,
কী আবার অন্যায় করলাম হঠাৎ
আমার তো কাটে দিন আর রাত
অবকাশে বসে, যাই না কোথাও,
বাড়াই না দরজার বাইরে এক পা ও।
বাবা বাড়ি ফিরলে আমি গুটিয়ে রাখি নিজেকে ঘরের ভেতর। প্রতিক্রিয়ার জন্য কান পেতে রেখেও কোনও লাভ হয়নি। বাবা নিঃশব্দে এসে নিঃশব্দে চলে গেছেন। চলে যাওয়ার পর জানালার কাগজের অবস্থাটি দেখতে গিয়ে দেখি ওই কাগজের পাশে আরেকটি কাগজ সাঁটা, ওতে লেখা
বাইরে না গেলেই কি সাধু হওয়া যায়!
এই লোক ঠিকই খবর পায়!
অবকাশে কি কি হয়।
শখ করে করা হচ্ছে জীবনের ক্ষয়।
নাই কোনও ভয়
যত্রতত্র পত্রমিতালি করে কেউ হয়না বড়,
লেখাপড়া না করলে জীবনের খুঁটি হয় নড়বড়।
বাবার লেখা পড়ে আবার কাগজে বড় বড় করে লিখি, লেখার সময় আমার মাথার পাশ থেকে ইয়াসমিনের মাথাটি কিছুতে সরে না।
তা তো জানি, তাকি আর জানি না !
তবে একটা জিনিস আমি মানি না
যে, কিলিয়ে কাউকে মানুষ করা যায়।
বাবারা কি এতে খুব সখু পায়,
কন্যারা যখন কেঁদে বুক ভাসায়!
বাবা সন্ধের মধ্যেই ফিরে এলেন, এসেই ঘরে ঢুকে ঘন্টা খানিক কারুকে ডাকাডাকি না করে কাটিয়ে, বেরিয়ে মার কাছে এক গেলাস পানি চেয়ে খেয়ে, বাড়িতে আনাজপাতি কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করে চলে গেলেন। ঘরে কেঁচো হয়ে বসে ছিলাম। বুক ধড়ফড় করে, এই খোলা পদ্যের গোলা শেষ অবদি কতটা বিস্ফোরক হবে কে জানে! বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁচো কেটে বের করি কিংশুক।
বাবা লিখে গেছেন, এবার জানালার বেগুনি কাচে।
মরমে গিয়া আঘাত করিল আত্মজার ক্রন্দন
পিতাই শুধু বোঝে কন্যার সহিত কতখানি তার আত্মার বন্ধন।
পিতা আজ আছে, কাল যাবে মরে
তাইতো কন্যাকে সে দিতে চায় ভরে
শিক্ষা দীক্ষা আর দেখাইতে চায় সত্যের পথ
যে পথে চললে সকলে ভাল বলে, এই তো পিতার মত।
এই কথোপকথন আমাকে ভীষণ উৎসাহিত করে। বাড়ির সবাই এসে জানালার কাচে সাঁটা পদ্য পড়ে যায়। দাদার দেওয়া লাল ডায়রিতে কবিতা লেখা বাদ দিয়ে জানালায় সাঁটা এই পদ্য পদ্য খেলায় আমি মেতে উঠি।
রবীন্দ্রনাথ পড়ে কি কোনও সত্য যায় না পাওয়া?
কাজী নজরুলকে কার সাধ্য আছে করে হাওয়া!
আর সুকান্ত সে তো দুর্দান্ত।
কবিতা মানে কি মিথ্যের পথ?
যদি হয়, তবে এই দিচ্ছি নাকে খত
ওপথ মাড়াবো না,
কারো দুঃখ বাড়াবো না।
আমি অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র প্রাণী,
কেবল এইটুকু জানি
আমার কোনও তৃষ্ণা নেই মণি মুক্তা মালার,
একটু শুধু তাগিদ আছে সন্ধ্যাদীপ জ্বালার।
এক জানালা শেষ হলে আরেক জানালায় সাঁটা হচ্ছে। এটি পড়ে মা বললেন, আমি তুচ্ছ ক্ষুদ্র প্রাণীডা কাইট্টা দে।
কাইট্টা দিলে কি দিয়া মিলাবো?
লেইখা দে, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান প্রাণী।
কাটা হয় না, কারণ বাবার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। বাবা আজকাল ঘন ঘন বাড়িতে ঢুঁ মারেন। পেচ্ছাব পায়খানা তো আছেই, এক গেলাস পানি খেতেও নতুন বাজার থেকে আমলাপাড়া পাড়ি দেন। উদ্দেশ্য অবশ্য কবিতা। কখনও এমন হয়েছে তিনি লিখে যাওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই খামোকা ফিরে এলেন বাড়ি। ঘরের জানালা দরজায় নতুন কিছু সাঁটা হয়েছে কি না দেখে যান। কারণ ছাড়াই আমার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখেন আছি কি না। চোখাচোখি হয় না, ও জিনিসটি তিনিও এড়িয়ে চলেন, আমিও। কথা বন্ধের কালে দৃষ্টিও সংযত করার নিয়ম, এ নিয়ম বাবারই শেখানো।
রবিবাবু কবিতা লিখেছেন নির্ভাবনায় জমিদারদেরই এইসব মানায়। ছাত্রজীবনে কবিতা কি শোভা পায়? এই হতভাগা বড় কষ্টে সংসার চালায় এত কষ্টের ফল কি সে পায়? পিতার কথা কি তারা এতটুকু ভাবে? আমি তো দেখি না কোনো সম্মান হাবে ভাবে। কত বলি হইতে মানুষের মত মানুষ তবওু দেখি না তাহাদের কোনও হুঁশ। সময় গেলে সময় নাহি আসে পিতা মরে গেলে কেউ আর নাই পাশে। ছাত্রজীবনে অবসর বলে কিছু নাই এই কথা আমি বারবার বলি, আবারও বলে যাই হেলাফেলা করিলে জীবনটি হবে নষ্ট দেখে আর কেউ নয়, পিতাই পাইবে কষ্ট।
বাবা এই পদ্যটি লিখতে সময় নিয়েছেন বেশ। সালামকে খুঁচিয়ে খবর জোটে, বাবা কাগজ কলম নিয়ে আজকাল আরোগ্য বিতানে বসে মাথা চুলকোন। রোগী বসে থাকে অপেক্ষা-ঘরে। তিনি চুলকোচ্ছেন, লিখছেন, ফেলছেন, আবার নতুন করে লিখছেন। পরে বেরিয়ে এসে রোগীদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে তিনি বাড়ি থেকে ঘুরে যান। ঘুরে যাওয়া মানে জানালায় পদ্য সেঁটে যাওয়া।
এ পদ্যটি পড়ে মা বলেন, হুঃ! এই সংসার চালাইতে কষ্ট হয় নাকি কোনও? সাতদিনে একদিন বাজার করে। হেই বেডির বাড়িত ত প্রত্যেকদিন মাছ মাংস যায়। টাকা ত আর কম কামায় না। তোদেরে কি দেয়? শখের একটা জিনিস দিছে কোনওদিন?
মার প্রেরণায় লিখি কি হয় এমন খরচ সংসারে! কাটাই তো অনেকটা অনাহারে। ঈদ এলে জামা পাই, সব ঈদেও জোটে না মনে কত কথা জমা, মুখে কিছু ফোটে না। চারিদিকে মেয়েরা কথা বলে চুটিয়ে আমরাই এ বাড়িতে ভয়ে থাকি গুটিয়ে। মনে তবু আশা থাকে লুকিয়ে, বাবার আদর পেলে ভুলগুলো চুকিয়ে বড় হব এত বড় আকাশ নাগাল পাবো দিগন্তের ওইপারে একদিন হারাবো।
পদ্যটি পড়ে মা বলেন হারানোর কথা লেখছস কেন? দাদা শব্দ করে পড়ে বলেন, সুন্দর হইছে। বাবা এরপর আর কিছু লেখেন না। পদ্যের জীবন আর সত্যিকার জীবনে যে অনেক পার্থক্য তা একদিন বাবার নাসরিন ডাকের চিৎকারে অনুভূত হয়। বাবার সামনে আগের সেই নতমখু নতচোখ দাঁড়াই। তিনি আগের মতই দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, কি করা হইতাছে?
আমি নিরুত্তর।
সারাদিন আড্ডা মাইরা জীবন চলবে?
নিরুত্তর।
কোনও মেডিকেলে তর মত গাধার পক্ষে যে পাশ করা সম্ভব না, এইডা বুঝা যাইতাছে না?
নিরুত্তর।
কবিতা লেখস? কবিতা কি একলা তুইই লেখতে পারস? সবাই লেখতে পারে। কামের ছেড়ি মালেকারে জিজ্ঞাসা কর, সেও পারবে লেখতে।
গাধা থেকে শব্দ বেরোয়, মালেকা তো লিখতে জানে না।
না জানুক, মুখে ত কইতে পারব। লালন ফকির মুখে মুখে কবিতা বলে নাই? হাছন রাজা বলে নাই?
নিরুত্তর।
আমি শেষ ওয়ারনিং দিয়া দিলাম, মেডিকেলে ভর্তি হইতে না পারলে বাড়িত তর ভাত বন্ধ। খবর রাখছ কবে ঢাকা ইউনির্ভাসিটির ভর্তি পরীক্ষা শুরু হইব?
নিরুত্তর।
আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা সামনের মাসে। ঢাকায় গিয়া পরীক্ষা দিতে হইব। এক্ষুনি অঙ্ক করতে ব। পরীক্ষায় পাশ না করলে কপালে কি আছে তা নিজে বুঝতে চেষ্টা কর।
বাবার উপদেশবাণী নীরবে হজম করে আমি নতমস্তকে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে অঙ্ক নয়, আনন্দ উৎসব শুরু করি। ঢাকা যাওয়ার আনন্দ।
ঝিককির ঝিককির ময়মনসিং, ঢাকা যাইতে কত্তদিন ! ঢাকা যাইতে কত্তদিন, ঝিককির ঝিককির ময়মনসিং। ঢাকা যাইতে সাতদিন, ঝিককির ঝিককির ময়মনসিং!
আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিতে তিনি নিজ মুখে বলেছেন, এর চেয়ে বেশি আমি আর কি চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হওয়ার কথা বললে তিনি হয়ত ঢাকা যাওয়ার এই সুযোগ থেকেও আমাকে বঞ্চিত করবেন। আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পাঠাতে বাবা রাজি হতেন না যদি না এম এ কাহহারের পুত্রধন ফরহাদের মুখে শুনতেন আর্কিটেকচার ভাল সাবজেক্ট। ফরহাদ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বষের্ দীর্ঘ বছর বসে আছেন, পরীক্ষা এলেই তাঁর খুব বমি আর পাতলা পায়খানা শুরু হয়। প্রতি বছর পরীক্ষার আগে আগে ডাক্তার এসে ওষধু দিয়ে যান। পরীক্ষা দেওয়া হয় তাঁর, কিন্তু পাশ হয় না কখনও। না হলেও তাঁর কথার তো মূল্য আছে। স্থাপত্যশিল্প ভাল বিষয়, কেবল ভাল বিষয় নয়, ফরহাদ জোর দিয়ে বলেছেন, ডাক্তারির চেয়ে ভাল। যুক্তি দেখিয়েছেন, ডাক্তার মেয়েকে এক ডাক্তার ছেলে ছাড়া আর কেউ বিয়ে করে না, মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার মুশকিল হল এই। ফরহাদ যে যুক্তিই দিন না কেন, কোনও যুক্তি বাবার কাছে টেকে না, বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করেন না ডাক্তারির চেয়ে ভাল বিষয় পৃথিবীতে আর কিছু আছে, সে মেয়ের জন্য হোক কি ছেলের জন্য হোক, কী কুকুর বেড়াল কীটপতঙ্গের জন্যই হোক। হাত পা নেড়ে ফরহাদ দাদাকে বলে গেছেন, আরে মিয়া ঘরে বইসা কাজ করা যায়, বাইরেও যাইতে হয় না। একটা বড়লোকের বাড়ির ডিজাইন কইরা দিবা, ধর একটা গভমেণ্টের বিল্ডিং অথবা ধর নতুন সংসদ ভবনের ডিজাইন, কইরা দিলা, কোটি টাকা ঘরে বইয়া পাইয়া গেলা, সারা বছর আর তোমার কিছু না করলেও চলে। আর্কিটেকচার ভাল সাবজেক্ট এ কথা ছোটদাও বলেন। আরে আমগোর রফিক ওইখানে পড়তাছে না! রফিক পড়ছে বলেই সাবজেক্টটি ভাল,রফিক না পড়লে সাবজেক্টটি এত ভাল নাও হতে পারত। বন্ধু আর্কিটেকচারে পড়ছে বলে ছোটদা কালো-মাড়ি-হাসিটি এমন প্রসারিত করে রাখেন যে মনে হয় বিষয়টির স্বরেঅ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সব তাঁর নখদর্পণে। ভর্তি হওয়ার আগে সাতদিন ক্লাস করতে হয়। ক্লাস নেয় শেষ বর্ষের ছাত্ররা। তাঁর বন্ধুটি আমাকে ইভেন ফ্রি কোচিংও দিতে পারে। যে জিনিসটি স্থাপত্যশিল্পে ভর্তি হওয়ার জন্য এখন জরুরি করা, তা অঙ্ক। আমার টেবিলের ওপর সপ্তূ হয়ে আছে লিটল ম্যাগাজিন। অঙ্ক বইয়ের খোঁজ পাওয়া যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তা বুঝি। অঙ্কের খাতাগুলোও বাড়িতে আর আছে বলে মনে হয় না। সেরদরে বিক্রি করে সেঁজুতির কাগজ কিনতে চলে গেছে।
আমি যে খুব শীঘ্র স্থাপত্যশিল্পী হতে যাচ্ছি, সে কথা চন্দনাকে জানাই। চন্দনা ভর্তি পরীক্ষা দেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করবে। ঢাকায় আমরা একসঙ্গে থাকব, শেকল ছিঁড়ে দুটো মুক্ত পাখি হাওয়ায় উড়ে বেড়াবো, দুচোখে জীবন দেখব, দুপায়ে দৌড়ে যাবো, ক্রমশ উঁচুতে আরও উঁচুতে কি আছে না-দেখা, দেখব; স্বপ্নের সিঁড়ি আমাদের পায়ের নাগালে এসে যাচ্ছে। আমাদের ডানায় এসে ভর করছে ঝাঁক ঝাঁক আনন্দ।
সেঁজুতির দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য চন্দনা তারুণ্য এ্যাক মোহন নদী নামে কবিতাটি পাঠিয়েছে।
আমার চারপাশে অমিত তারণ্যে খেলা করে কয়েকজন সুদর্শন তরুণ ঝড় ওঠে দ্রৌপদীর বুকে উন্মত্ত সজীবতায় অবিরাম ওরা হয় লুন্ঠিত, হৃতসর্বস্ব..।
জানালায় বসে কেবল কৃষ্ণচূড়াই নয়, কেবল মেহগিনি পাতার ঝরে যাওয়া নয়, চন্দনা তরুণ সুদর্শনদেরও দেখছে। এক সুদর্শনের সঙ্গে কিছু ভেবে কিছু না ভেবে দেখা করেও এসেছে। অনপুুঙ্খ বর্ণনা করেছে সেই দেখা হওয়া, সেই চোখে চাওয়া, সেই বুকের মধ্যে কেমন কেমন করা। হাত স্পর্শ করতে চেয়েছিল সুদশর্ন টি, চন্দনা আলগোছে সরিয়ে নিয়েছে নিজের হাত। ওর কেবল ভাল লেগেছে চোখে চাওয়াটুকুই, ওটুকুই ওকে বাকি দিন রাত্তির অদ্ভুত আবেশে জড়িয়ে রাখে। প্রেমের মত সুন্দর কিছু আমার মনে হয় জগতে আর নেই। প্রেমের গল্প আমি তন্ময় হয়ে শুনি। কল্পনায় এক রাজকুমার উড়ে আসে পঙ্খীরাজে করে। আমার এখন ভালবাসার সময়, আমি এখন ইচ্ছে করলেই ভালবাসার প্লাবন বইয়ে দিতে পারি..। নিজেও এমন কবিতা লিখতে থাকি।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, ঢাকার এক উদীয়মান কবি, সেজুঁতির জন্য কবিতা পাঠিয়েছে। বাঁজে থেকে চন্দ্রবিন্দু তুলে তার তামাটে রাখাল তুই কবিতাটি পরের সংখ্যায় ছাপার জন্য রাখি।
বারবার বাঁশি তো বাজে না, বাঁশি শুধু একবারই বাজে। তামাটে রাখাল তোর বাঁশিটি বাজে না কেন! বাজে তোর নিঃসঙ্গতা, বাজে তনু ব্যথিত খোয়াব গহন সুরের মত বাজে তোর দিবস রজনী- তবু কেন বাঁশিটি বাজে না।
কবিতার সঙ্গে চিঠি পাঠিয়েছে রুদ্র, লাল কালিতে লেখা চিঠি। সেঁজুতির সম্পাদিকার সঙ্গে সে পরিচিত হতে চায় এবং তাকে তুমি সম্বোধন করতে চায় কারণ আপনি সম্বোধনটি তার বড় অপছন্দ। সেঁজুতির রং হলুদ কেন প্রশ্ন করেছে। সন্ধেদীপের শিখাটি হলুদ, তাই হলুদ, সোজা উত্তর। পরের চিঠিতে অবলীলায় তুমি সম্বোধন করে সে, যেন সে কত আপন আমার! চিঠিতে মানুষকে আপন করে নেওয়া আমার স্বভাবের অনগ্তর্ ত, আমি বিস্মিত হই না।
সেঁজুতির জন্য কবিতা কেবল দুই বাংলার শহর নগর গ্রাম গঞ্জ অলি গলি আনাচ কানাচ থেকে আসছে। কলকাতা থেকে অভিজিৎ ঘোষ, নির্মল বসাক, চৈতালী চট্টে াপাধ্যায়, জীবন সরকার এরকম অনেকে কবিতা পাঠাচ্ছেন। নাম দেখে নয়, কবিতা দেখে কবিতা ছাপি। কবিতা ভাল হলে সে নতুন কবি হোক, অজ পাড়া গাঁয়ে তার বাস হোক, পরোয়া করি না। লক্ষ করি, শব্দের বানানে পরিবর্তন চলছে চারদিকে। মুখের ভাষাকে লেখার ভাষায় আনা হচ্ছে। চন্দনা এক লিখতে এ্যাক লিখেছে। আমিও কোরেছিলাম, বোলেছিলাম, দ্যাখা হয়েছে, এ্যাকা লাগছে এরকম লিখছি। নির্মল বসাক কবিতায় প্রায়ই কোনও দাঁড়ি কমা ব্যবহার করেন না। রুদ্র শব্দ থেকে ণ তুলে দিচ্ছে এটি থাকার কোনও কারণ নেই বলে। ঊ, ঈ, ী, ,ূ কেও আর জরুরি মনে করছে না। নতুন একটি যতিচিহ্নের উদ্ভাবন করেছে, ইংরেজি ফুলস্টপের মত একটি শুধু বিন্দু এই যতিতে, কমাতে যতক্ষণ থামা হয়, তার চেয়ে কম থামতে হবে। রুদ্র যখন প্রাণ লিখতে প্রান লেখে, কারণ লিখতে কারণ লেখে, দেখতে অচেনা লাগে শব্দ। তবু সেঁজুতিতে যে কোনও পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছি। ভাষা তো স্থবির কোনও জলাশয় নয় যে থেমে থাকবে! সেজুঁতির টুকিটাকি বিভাগে লিটল ম্যাগাজিনের খবর দিই, ঠিকানাও, যে পড়বে সেঁজুতি সে আরও কুড়ি পঁচিশটি লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। কেবল লিটল ম্যাগাজিনের খবর নয়, কোথায় কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, কে কেমন লিখছেন, কার কি বই বেরোচ্ছে, এসব খবরও সংগ্রহ করে দিতে থাকি। সেঁজুতির ঘোষণা, একজন নির্ভেজাল কবিতাপ্রেমিক মাত্রই সেঁজুতির অধিকারী। সেঁজুতির উজ্জ্বল আলোয় ঘুচে যাবে কাব্য জগতের সকল কালো। সেঁজুতি সর্বদা সত্য ও সুন্দর। সেঁজুতির বিনিময় মূল্য চাট্টে সিকি মাত্র। কিন্তু চাট্টে সিকির বিনিময়ে যে কেউ সেঁজুতি কিনছে তা নয়। বিজ্ঞাপনহীন পত্রিকা নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে বের করে যারাই কবিতা লেখে বা কবিতা পত্রিকা বের করে তাদের কাছে পাঠাচ্ছি। পাঠাতেও গাঁটের পয়সা কম খরচা হয় না। কবিতা পড়ুন, কবিতা পত্রিকা কিনুন, কবিতার বই কিনুন সাধারণের কাছে এই অনুরোধ জানাচ্ছি সেঁজুতির মাধ্যমে। পুরো জগতটিকে কবিতার জগত না বানিয়ে আমার স্বস্তি নেই। আমাকে সত্যি সত্যি কবিতায় পেয়েছে। কবিতা আমার রাত্রিদিনের সঙ্গী।
বাড়িতে কেউ নেই, চন্দন ও ফুল হাতে আমি আমি কবিতার পুজোয় বসেছি,
অভিমানে সারাটা দিন নিষ্কর্মার মত বসে থাকি অহেতুক,
দরোজায় দাঁড়িয়ে কৃতঘ্ন শব্দেরা চোখ টিপে সহাস্যে অপমান করে
দুধেল জ্যোৎস্নায় ওত পেতে বসে থাকে নিন্দুক ও সমালোচকের দল
টানা গদ্যে লেখা অভিজিতের দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত থেকে বহুদূরে ভাসতে থাকি সময়ের স্রোতে।
রুদ্র সদ্য ছাপা হওয়া তার প্রথম কবিতার বই উপদ্রুত উপকূল পাঠিয়েছে। বইয়ের কবিতাগুলো সশব্দে পড়ি, সঙ্গে ইয়াসমিনকেও ডেকে আনি পড়তে। অবকাশের বাতাসে রুদ্রর কবিতার শব্দ। কবিতার গন্ধ। আমাদের মুখে কবিতা। মনে কবিতা।
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিল
জীণর্ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।
রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
রুদ্রর কবিতা আমাকে শোয়া থেকে বসিয়ে দেয়। দাঁড় করিয়ে দেয়। বারান্দায় অস্থির হাঁটায়। এমন সত্য কথন, এমন দৃঢ এবং বলিষ্ঠ বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট না করে পারে না। রুদ্রর কবিতা সজোরে পড়ার মত, আবৃত্তি করার মত একঘর লোকের সামনে,খোলা মাঠে, জনসভায়। কবিতা আবৃত্তি করা নিতান্তই নতুন নয় আমার জন্য, দাদার ছোটবেলায় মা শিখিয়েছেন দাদাকে, আর আমার বড়বেলায় দাদার কাছে তালিম পেয়েছি আমি, আর আমি শেখাতে শুরু করি ইয়াসমিনকে। ইয়াসমিন ইশকুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়, কেবল ইশকুলের নয়, ময়মনসিংহ জেলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব চলছিল, সেই উৎসবের আবৃত্তিতে নাম লিখিয়ে আসে। ঠিক ঠিক একদিন গিয়ে আবৃত্তি করে তিন তিনটি পুরষস্কার পেয়ে গেল, ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের হাত থেকে ঢাউস ঢাউস রবীন্দ্ররচনাবলী, গীতবিতান, নজরুলের সঞ্চিতা, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা নিয়ে বাড়ি ফিরল। গীতবিতান খুলে একা একাই ও গান গাইতে শুরু করে। ওর গানে চমৎকার সুর ওঠে, সুর শুনে বার বার বলি, তর একটা হারমোনিয়াম থাকলে ভাল হইত। বাড়িতে কোনও বাদ্যযন ্ত্র নেই। দাদার বেহালা ভেঙে পড়ে আছে, ছোটদা নিজের গিটার বিক্রি করে গীতাকে শাড়ি কিনে দিয়েছেন। বাবা গান বাজনা পছন্দ করেন না, বাবার কাছে ইয়াসমিনের জন্য হারমোনিয়াম কেনার কথা বলা মানে গালে দুটো চড় খাওয়ার ব্যবস্থা করা। গান গাওয়ার স্বপ্ন ইয়াসমিনকে আপাতত হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে হয়। তারচেয়ে কবিতা পড়, কবিতা পড়তে কোনও যন্ত্রের দরকার হয় না।
মাথায় যখন সেঁজুতি, মনে যখন কবিতা তখন আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য দাদা আমাকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটদার বন্ধু রফিকের হোস্টেল-রুমে নিয়ে যান ভর্তি পরীক্ষায় কি প্রশ্ন আসে, কি রকম কি তার সামান্য হলেও যদি তিনি আভাস দেন। রফিক মলিন হেসে বলেন, কালকে পরীক্ষা, আজকে কি আর দেখাবো! তবু আমাকে বসিয়ে কাগজ পেন্সিল দিয়ে একটানে একটি সরলরেখা আঁকতে বললেন, একটানে বৃত্ত। আঁকার পর বললেন,এই ঘরটার ছবি আঁকো। তাও আঁকার পর বললেন হাত তো ভালই। ওই হাত ভাল নিয়ে পরদিন পরীক্ষা দিতে বসে ছবিগুলো, যা আঁকতে বলা হয়েছে, একেঁ দিই। কিন্তু দশটি অঙ্কের একটি করাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। হবে কেন, অঙ্ক নিয়ে তো বসিনি, বসেছি কবিতা নিয়ে। দুঘন্টা পরীক্ষা, কিন্তু একঘন্টা পর পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দাদাকে নিস্প্রাণ কণ্ঠে বলে দিই, আমার পাশ হবে না। কদিন পর,আশ্চর্য, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আপিসঘরের পাশে মৌখিক পরীক্ষায় যাবার জন্য টাঙানো নামের তালিকায় আমার নামটি আছে খবর পাই। মৌখিক পরীক্ষা দিতে ঢাকা যেতে হবে, আমাদের সুটকেস গোছানো সারা। কিন্তু আমাদের যাত্রাভঙ্গ করে বাবা বললেন, ঢাকা যাওয়ার দরকার নাই।
কেন, ঢাকা যাওয়ার দরকার নাই কেন? ঢাকা না গেলে তো মৌখিক পরীক্ষা দেওয়া হবে না,না দেওয়া হলে আর্কিটেকচারে আমার ভর্তি হওয়া হবে না! বাবার অনড় অটল মূর্তিটির সামনে এক পাহাড় প্রশ্ন নিয়ে আমি স্তম্ভিত বসে থাকি।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, আর্কিটেকচারে পড়তে হইব না।
আমার স্বপ্নের স্থাপত্য হুড়মুড় করে আচমকা ভেঙে পড়ে। হৃদয় জুড়ে ভাঙন নিয়ে একা উদাস বসে থাকি।
আর্কিটেকচারে পড়তে হইব না কারণ মেডিকেলে পড়তে হইব আমাকে। আমার নাম উঠেছে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়াদের তালিকায়।
ভালো লাগায় ভরে মন, সুন্দর!