বদলে যাচ্ছে
অবকাশের চেহারাটি খুব পাল্টো গেছে। ইয়াসমিন মেট্রিক পাশ করেছে। পাশ করেছে প্রথম বিভাগে। রসায়নে একটি লেটার আছে তার। এই লেটারের কারণে ইয়াসমিন আমার চেয়ে বেটার ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে সংসারে। বাবা,ওকেও, স্বপ্ন দেখেন ডাক্তারি পড়াবেন। ওর আনন্দমোহনে ভর্তি হওয়ায় বাবা আপত্তি করেননি। ইয়াসমিন হঠাৎ করে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। আগের ছোট্ট বাচ্চাজ্ঞট নেই আর। আমরা দুবোন কোথাও গেলে, অনেকে, যারা ইয়াসমিনকে চেনে না, ভাবে যে ও আমার বড় বোন, গায়ে গতরে আমার চেয়ে বেশি বেড়ে উঠেছে বলেই। আমি যে বয়সে ওড়না পরতে শুরু করেছি, অবশ্য ঘরে নয়, বাইরে, ইয়াসমিনকে তার আগেই পরতে হয়েছে। বুকের বেঢপ বেড়ে ওঠার কারণে ও কুঁজো হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে আমার মতই, ওড়না না পরার মাশুল এভাবেই দিতে হয় কি না। মা ওর কুঁজো পিঠেও কিল দিয়ে বলেন, সোজা হ। ওড়না পইরা আয়, তবু সোজা হইয়া হাঁট। বড় হইছে মেয়ে ওড়না পরতে শরম কেন? বয়সে না হয় বড় লাগে আমার চেয়ে ওকে, দুজনের মধ্যে দেখতে কে সুন্দর এই প্রশ্ন উঠলে, আমার দিকে পাল্লা ভারি হয়। ইয়াসমিন নিজের চেহারা, বয়সের চেয়ে বেশি বয়স দেখতে লাগা শরীরটি নিয়ে ভোগে মনে মনে। অথচ চোখের তুলনা করলে ও যদি হরিণ হয়, আমি হাতি,ওর ঘন কালো চুলের সামনে আমার চুল নিতান্তই ফিনফিনে, কিন্তু ছোট নাক, ছোট চিবুক, পুরু ঠোঁট নিয়ে ইয়াসমিনের খুঁতখুঁতুনির শেষ নেই। ওর ভেতরে গোপনে গোপনে একটি ঈর্ষার জন্ম হয়। আমার কোনও ঈর্ষা হয় না, বরং ওকে বাইরের সকল প্রলোভন থেকে, ভুল থেকে মিথ্যে থেকে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। আমি কিছুতেই চাই না আমি যে দুঃখ বাবাকে দেব, সেরকম কোনও দুঃখ ইয়াসমিনও দিক। আমার চোখের ওপর একটি স্বপ্নের প্রজাপতি এসে বসে, বলে, ইয়াসমিন মেডিকেল কলেজে পড়বে, আমি যত বড় ডাক্তার হব, তার চেয়ে বড় হবে ইয়াসমিন। ডাক্তারি পাশ করে হাবিবুল্লাহর মত কোনও সুদর্শন ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করবে। এতে যদি আমার দেওয়া দুঃখ খানিক লাঘব হয় বাবা মার। ইয়াসমিনের ঈর্ষা আমাকে ব্যথিত করে। লক্ষ করি ও দূরে সরছে। আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকা ইয়াসমিন এখন দাদার বউএর গায়ে গায়ে বেশি লেগে থাকে। কলেজে যায় আসে, বাকিটা সময় দাদার বউএর সঙ্গে হাস্যরসের ঢলে সাঁতার কাটে। যদি ওর পড়াশোনার খবর নিতে যাই, ও এমন চোখ করে তাকায় আমার দিকে যেন আমি ওর সবচেয়ে বড় শত্রু। ছোটদা নেই অবকাশে। সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আমার মেতে থাকা নেই। ছোটদা যেহেতু লেখাপড়া না করা, অকালে বিয়ে করা, টইটই করে ঘুরে বেড়ানো বখাটে ছেলে ছিলেন, তার সঙ্গে, নাচ গান কবিতা নাটকের অনূষ্ঠানে বাবাকে লুকিয়ে মাকে নিমরাজি করিয়ে আমার আর যাওয়া হয় না। ছোটদাও এখন পাল্টো গেছেন। তাঁকে এখন এ বাড়িতে বড় পিঁড়িটি দেওয়া হয়, টুডাইল্যা নামটি তাঁর ঘুচেছে, তিনি আর খবর রাখেন না শহরে কোথায় কি হচ্ছে, কোথায় নাটক, কোথায় নাচ গান। দাদা আছেন, তবে থেকেও নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বদলে গেছেন দাদা। তিনি আর সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে মাথা ঘামান না। সেঁজুতির প্রসঙ্গ এলে তিনি আর বলেন না, যা আমি ছাপাইয়া দিয়াম নে। সংসারের অন্য কারও কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না। গান শোনা, ছবি তোলা, নিজের সুটবুট কেনা, দামি সগু ন্ধি মাখা এসব ব্যাপারেও তাঁর আগ্রহ নেই আর। তিনি বউএর জন্য শাড়ি গয়না কেনায় ব্যস্ত। প্রায়ই শাড়ি কিনে নিয়ে আসেন, আমাদের দেখান শাড়ি কেমন হয়েছে, আমরা বলি খুব ভাল শাড়ি, খুব মানাবে বউকে। বউএর আত্মীয়ের বাড়িতে নিমনণ্ত্র খেতে ব্যস্ত দাদা। বাড়িতে অতিথি এখন বেশির ভাগই হাসিনার বোন, বোনজামাই, ভাই, ভাইবউ ইত্যাদি। আত্মীয়ের মধ্যে কে ভাল, কে মন্দ, কে বেশি কথা বলে, কে কম, কে দেখতে সুন্দর, কে নয়, কার কত ধন আছে, কার কত দারিদ্র এসব নিয়ে আলোচনা করতে তিনি পছন্দ করেন বেশি। বাঁশের কঞ্চির মত শরীর হাসিনার। মা প্রতিদিন ভাল ভাল রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছেন। হাসিনা দাদার সঙ্গে প্রায় বিকেলে বেড়াতে যায়, বাকিটা সময় মুখে কাঁচা হলুদ মেখে দুপুরবেলা বারান্দায় বসে থাকে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে, পাঁচ ছ বেলা খায়, আর ঘুমোয়। তবু সে একটি নতুন জিনিস বাড়িতে, আমাদের উৎসাহ কমে না। বিশেষ করে ইয়াসমিনের। ইয়াসমিন হাসিনার সঙ্গে লেপ্টে থাকে, এমনকি হাসিনার ব্লাউজ খুলে স্তন মুঠোয় নিয়ে মায়ের দুদু খাওয়া বাচ্চার মত শুয়ে থাকে। দেখে লজ্জায় সরে গিয়ে আমি দূর থেকে বলি হাসিনাকে, তোমার শরম করে না? সে বলে, বিয়া হইয়া গেলে আবার শরম থাকে নাকি? মারও তো বিয়ে হয়ে গেছে। মা কখনও স্তন উদোম করে রাখেন না। গীতাও কোনওদিন রাখেনি। গীতার অবশ্য স্তন জিনিসটি কম, ব্রেসিয়ারে তুলো ভরে পরতে হয় তাকে। হাসিনা যেহেতু ভাল শাড়ি পরতেও জানে না, ভাল সাজতেও জানে না, বেড়াতে যাওয়ার আগে ইয়াসমিন হাসিনাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়, গীতার শাড়ি পরা দেখে দেখে এই জিনিসটি ভাল শিখেছে ও। হাসিনার মুখ সাজিয়ে দেয়, এও গীতার কাছ থেকে ওর শেখা। হাসিনাকে প্রথম প্রথম আমি হাসিনা বলেই ডাকতাম, কিন্তু এতে সে খুশি হয়নি, বৌদি ডাকার আদেশ দেয়। ইয়াসমিন দিব্যি বৌদি ডাকে। বৌদিকে নিয়ে সে বৌদির বোনের বাড়ি ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যায়। বৌদি শাড়ি কিনতে যাবে, ইয়াসমিন সঙ্গে যাবে পছন্দ করে দিতে। বৌদি জুতো কিনবে, ইয়াসমিন বাজারের সবচেয়ে ভাল জুতোটি দাদাকে বলবে কিনে দিতে। আমার পক্ষে সম্ভব হয় না কলেজের চেনা একটি মেয়েকে বৌদি ডাকার। হাসিনা ডাকে আপত্তি তোলার পর এই হয় আমার, আমার হাসিনা ডাকটিও বন্ধ হয়ে যায়, এই শোনো, এই দাদার বউ শুনে যাও, এভাবে কাজ চালাই। হাসিনা নামটি দাদার খুব অপছন্দ, তিনি হাসিনা মমতাজ থেকে হাসিনা বাদ দিয়ে, মমতাজ থেকে মম নিয়ে, মমকে মুমু বানিয়ে হাসিনাকে মুমু বলে ডাকেন। দাদা এখন আর মার জন্য বা আমার আর ইয়াসমিনের জন্য কোনও জিনিস কেনার কথা ভাবেন না। ঈদ এলে হাসিনার জন্য বাজারের সবচেয়ে দামি শাড়িটি কিনে আনেন। মাকে একটি শাড়ি দেবার পুনঃ পুনঃ অনুরোধে তিনি চক্ষুলজ্জার খাতিরে ঈদের আগের রাতে মার জন্য হয়ত একটি সস্তা সুতির শাড়ি কিনে আনেন। মা টের পান, এই দেওয়ায় আগের সেই ভালবাসা নেই। আমরাও টের পাই। আমাদের, আমাকে আর ইয়াসমিনকে যে তিনি চক্ষুলজ্জার খাতিরেও কিছু দিচ্ছেন না এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন বা অনুযোগ আমরা করি না। কারণ এরকমই নিয়ম বলে ভাবি যে দাদার এখন বউ হয়েছে দাদা বউকেই সব দেবেন। বউকে সুখী দেখলে আমাদের ভাল লাগে। বউএর মুখে হাসি ফুটলে দাদার মুখে হাসি ফোটে। দাদার পকেট থেকে আমাদের আর টাকা নেওয়া হয় না, ছোটদা চলে যাওয়ার পর আমি আর ইয়াসমিনই সে কাজ নিজ দায়িত্বে অনেকদিন চালিয়েছি, ঘরে এখন বউএর পাহারা আছে। দাদার হাত থেকে দপু য়সা খসলে সে পয়সা বাড়ির অন্য কারও জন্য খসতে দিতে রাজি নয় হাসিনা। দাদার টাকাকে দাদার জিনিসপত্রকে হাসিনা তার নিজের টাকা, নিজের জিনিসপত্র বলে মনে করে। আমাদের কাচের বাসনপত্র থেকে সে দাদার কেনা কাচের বাসনপত্র আলাদা করে সরিয়ে নিতে নিতে বলেছে, আমারগুলা তুইলা রাখতে হবে। এইগুলা যেন ইউজ না হয়। দাদার কেনা ফ্রিজে আনুর মা পানির বোতল রাখতে যায়, যেমন আগে রাখত, এখন আনুর মাকে থামিয়ে হাসিনা বলে আমার ফ্রিজে হাত দিতে হইলে আমারে আগে জিগাস কইরা নিবা। ফ্রিজটি নিজ হাতে মুছতে মুছতে সে বলে, আসলে ফ্রিজ একজনের হ্যান্ডেল করা উচিত, এত লোক ফ্রিজে হাত দিলে আমার এই ফ্রিজটা কয়দিন পরেই নষ্ট হইয়া যাইব। হাসিনার এই আমার শব্দটি শুনে মনে হয় আমরা যেন এ বাড়িতে দুটো দল, এক দলে আমরা, আমি বাবা মা ইয়াসমিন, অন্য দলে দাদা আর হাসিনা। রিয়াজউদ্দিনের ছেলে জয়নাল টিনের ঘরে থাকে, ইশকুলে পড়ছে শহরে। জয়নালকে দেখলে হাসিনা বলে, এই ছেড়া এক গ্লাস পানি দে তো অথবা এই ছেড়া দৌড়াইয়া একটা রিক্সা লইয়া আয়, যা। জয়নাল পানি নিয়ে দেয়। দৌড়ে রিক্সা ডেকে আনে। হাসিনা শাড়ি পরছে, আশেপাশেই ছিল জয়নাল,এই ছেড়া জুতাডা মুইছা দে তো। জয়নাল হাসিনার পায়ের কাছে বসে ছেঁড়া ত্যানায় তার জুতো মুছে দেয়। মা একদিন বললেন, জয়নালরে এইভাবে কইও না বৌমা। জয়নাল ত বাড়ির কাজের ছেলে না, নোমানের আপন চাচাতো ভাই লাগে। হাসিনা খসখসে গলায় বলে, ছেড়ারে কইতাম না তো কারে কইতাম? বেডি যে একটা আছে, ও তো পাকঘরেই পইড়া থাহে। ডাইকা পাওয়া যায় না।
আনুর মা তো সারাদিন কাম করে।
সারাদিন কি কাম করে যে এই দিকে আমার কাম করার সময় কেউ পায় না!
আনুর মার কাছে চাও কি চাইবা। সে কি না করছে যে করব না কাম?
এরপর হাসিনা অর্জুনখিলা থেকে তার জুতো মোছা, তার জন্য গোসলের পানি তোলা, গোসলে যাওয়ার আগে তার তোয়ালে আর সাবান গোসলখানায় রেখে আসার জন্য, শুয়ে থাকলে তার মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার জন্য ফুলেরা নামের একটি মেয়ে নিয়ে এল। এক বাড়িতে এক চুলোয় সবার জন্য খাবার রান্না হলেও ধীরে ধীরে দুটো সংসার গড়ে উঠছে। হাসিনার গলার স্বর, আমরা সবাই লক্ষ করি খসখসেই কেবল নয়, উঁচওু । এ বাড়িতে বাবার গলাই এমন উঁচুতে ওঠার স্পর্ধা রাখে।
হাসিনার এরকম ঘরে বসে থাকা সইতে না পেরে বাবা তাকে শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন। বইপত্র খাতা কলম যা দরকার কিনে দিয়েছেন, টেবিল সাজিয়ে দিয়েছেন ঘরে। বিয়ের পর আর লেখাপড়ার ঝামেলা নেই বলে দিব্যি ছিল হাসিনা। দাদারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাবার আপত্তি। তিনি হাসিনাকে নিজের কন্যাদের যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন, নিজের পুত্রবধূকেও দেন। মনীষীদের বাণীর বষর্ণ এবার হাসিনার ওপর, যেন সে বাবার আরেক মেয়ে, তবে একটি সুবিধে তার, বাবার চড় থাপড়, সন্ধিবেত আর চাবুকের চেহারা তাকে দেখতে হয় না। মাও আমাদের যেমন যত্ন করে খাওয়ান, তার চেয়ে অধিক যত্ন করে হাসিনাকে খাওয়ান, হাসিনার এখানেও সুবিধে যে, মা মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক দেন গালাগাল দেন, তা হাসিনাকে দেন না। বাড়ির মানুষগুলো হাসিনার সেবায় নিয়োজিত, সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত দাদা। মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করতে বউ নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন। রেলগাড়িতে নয়, উড়োজাহাজে। সমুদ্রের পাড়ে বড় হোটেলে ছিলেন, নরম বিছানায় শুয়েছেন, হোটেলের লোকেরা তিনবেলা খাবার দিয়ে গেছে ঘরে। হাসিনা সুখে আছে, বুঝি। এত সুখের কথা সে বিয়ের আগে কল্পনা করেছিল বলে মনে হয় না।
জীবন বদলে যাচ্ছে, একসময় রান্নাঘরে চুলোর পাড়ে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতাম, পিঁড়ি থেকে পরে শোবার ঘরের মেঝেয় শীতল পাটিতে বসে, পরে খাবার ঘরে শাদামাটা চেয়ার টেবিলে, ধীরে ধীরে টেবিল বড় হল, মসৃণ হল আরও, চেয়ারের মাথা মানুষের মাথা পেরিয়ে ওপরে উঠল। বেতের সোফা সরে কাঠের সোফা এল। হারিকেন থেকে বিদ্যুৎ বাতি এল। হাতপাখা থেকে বৈদ্যুতিক পাখা।টিনের থালা থেকে চিনেমাটির থালা এল। মেঝেয় কয়লা গুঁড়ো করে সেই গুঁড়ো আঙুলে তুলে দাঁত মাজতাম—এরপর নিমের ডাল দিয়ে, ডালের মাথাটা দাঁতে কামড়ে নরম করে নিয়ে—এরপর এল টুথপেস্ট, তিব্বত কোম্পানি থেকে কোলগেট। ঋতুর রক্ত শুষে নেওয়ার জন্য পুরোনো শাড়ির টুকরো বা ত্যানাতুনোর বদলে বাজার থেকে কিনে তুলোর প্যাড ব্যবহার করি। কোরবানির ঈদের সময় আস্ত একটি গরু জবাই করা হল, এর মাংস রাখা হবে কোথায়, বড় বড় পাতিলে ওসব হলুদ আর লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হত, এরপর রান্না করতে হলে সেদ্ধ মাংস তেলে মশলায় নেড়ে রান্না হত, আর অনেকটাই চলে যেত রোদে শুকিয়ে শুটকি করায়। মাংসের টুকরোগুলোর মাঝখানে ফুটো করে দড়ির ভেতর ঢুকিয়ে রোদে টাঙিয়ে দেওয়া হত। সন্ধের আগে আগে রোদে শুকোনো কাপড় যেমন করে তোলা হয়, রোদে শুকোনো মাংসও তেমন তোলা হত। পরদিন সকালে আবার রোদে দেওয়া। ফ্রিজ আসার পর নিয়মগুলো পাল্টো গেছে। এখন আর হলুদ লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হয় না মাংস, শুটকি করাও হয় না খুব, মাংসগুলো ঢুকে যায় রেফ্রিজারেটরের হিমায়িত চেম্বারে। নানারকম যন ্ত্র এসেছে বাড়িতে, রেডিওই ছিল ভরসা, এখন টেলিভিশন, শাদা কালো থেকে রঙিন। আগে কেবল শোনা ছিল, এখন দেখা আর শোনা দুটোই। নাটক সিনেমা দেখার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয় না, ঘরে বসেই দেখা যায়। নাচ গানও বোতাম টিপলেই। বড় বড় ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখার জন্য কোনও মাঠে দৌড়োতে হয় না, সেও বোতাম টিপলেই। ছবি তোলার জন্য কোনও ছবিঘরে যেতে হয় না আর, কেনা ক্যামেরা দিয়েই যত চাই যে ভঙ্গিমায়, তোলা যায়। জীবন অনেক পাল্টো গেছে। অনেক কিছুই আর আগের মত নয়। এভাবেই একটু একটু করে জীবন পাল্টো যাচ্ছে, সামনে এসে পেছনের দিকে খুব একটা তাকাই না, যেন ফেলে আসা জীবন ভুলে যাবার জীবন। একটি জিনিস কেবল সেই আগের মত রয়ে গেছে, বাড়িতে তিনবেলা ভাত রান্না হত, এখনও হয়। মাটির চুলোয় উঠোনের মাটিতে ঝরে পড়া ডাল পাতা জড়ো করে আগুন ধরাও, আগুন বার বার নিভে যাবে, যতবার নিভবে, ততবার ফুঁকনিতে ফুঁ, চোখ ভেসে যাবে ধোঁয়ায়, চুল ভেসে যাবে ধোঁয়ায়, মা নিজে গোটাটাই ভেসে যাবেন ধোঁয়ায়, আগুন জ্বললে ধোঁয়া উড়ে যাবে, ধোঁয়া উড়ে গেলে দেখতে পাবো মাকে, গালে কালি, হাতে কালি, কপালে কালি। কালিময় বিচ্ছিজ্ঞর মাকে দেখে আমার বা বাড়ির কারো কোনও অবাক লাগবে না, কারণ মা এমনই, মাকে এমনই দেখে এসেছে সবাই। চুলোর পাড়ে কালিঝুলি মাখা মা রান্না করবেন, ক্ষিধে লাগার আগেই মা ভাত বেড়ে দেবেন প্রত্যেকের থালায়। মা তো এ কারণেই। জীবন পাল্টো যাচ্ছে কিন্তু মার মাটির চুলো পাল্টাচ্ছে না, চুলোর পাড়ে বসে শুকনো পাতায় আগুন ধরিয়ে ফুঁকনি ফুঁকে চুলো ধরাতে মাকে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি, এর কোনও পরিবর্তন নেই।
গীতার বাচ্চা হওয়ার তারিখ পড়েছে, ছোটদা জানিয়ে দিলেন, মা যেন সময়মত ঢাকা চলে যান। মা ঢাকা চলে গেলেন বাসে করে, সঙ্গে নিয়ে গেলেন ছোট ছোট কাথাঁ, ছোট পাতলা কাপড়ের জামা। চামেলিবাগে ডাক্তার টি এ চৌধুরির ক্লিনিকে সতেরোই জুন গীতা নয় পাউন্ড ওজনের একটি ছেলের জন্ম দেয়। ক্লিনিক থেকে ফিরে সে হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে, আর দাগ দূর করার মলম মাখতে থাকে পেটে। মা রেঁধে বেড়ে গীতাকে খাওয়ান, গীতার স্নানের জল গরম করে দেন,ম্যাজম্যাজ করা গা মালিশ করে দেন, বাচ্চাকে গীতার কোলে বসিয়ে মিনতি করেন, বাচ্চারে নিজের বুকের দধু খাওয়াইতে চেষ্টা কর আফরোজা। মায়ের দধু টা বাচ্চার জন্য বড় উপকারি। গীতা আগেও চেষ্টা করেছে, তার বুক থেকে বাচ্চার জন্য কোনও উপকারি দুগ্ধ নির্গত হয় না। এসব তো আছেই, প্রচণ্ড উদ্যমে বাচ্চাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো, কাথাঁ বদলানোর কাজ করে যান মা। গীতার মা মাসি, বোন ভাই এসে বাচ্চা দেখতে এসে সপ্তাহ খানিক কাটিয়ে যায়। কড়া লাল সিঁদুর পরা, হাতে শাখা পরা গীতার মার সঙ্গে মা হেসে কথা বলেন, নিজেকে বোঝান, হিন্দু হোক তাতে কি, বাচ্চার তো সে নানি। তারও ত হক আছে বাচ্চা দেখার। মা একাই বাচ্চার যত্ন, বাচ্চার মার যত্ন, বাচ্চার দিদিমা, মামা মাসির যত্ন করে যান। তিনমাস অবদি এই চলল, তিন মাস পর ছেলেকে ছেলের বাবা মার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে মা বলেন, এইবার তোমাদের ছেলেরে তোমরা পালো, আমি ময়মনসিংহে যাই। মা ব্যাগে যখন কাপড় গোছাচ্ছেন, গীতা আড়মোড়া ভেঙে তার দীর্ঘ বিশ্রাম সেরে উঠে ঘোষণা করল, সে চাকরি করতে যাবে আবার, ঘরে বসে থাকতে তার ভাল লাগছে না।
তাইলে বাচ্চা দেখবে কে?
গীতা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে,আমি কি জানি! তোমার বাচ্চা তুমি জানো!
ছোটদা মখু চুন করে ঘরে বসে রইলেন। গীতা যদি চাকরি করতে চলে যায়, বাচ্চা তবে কার কাছে থাকবে?
কাজের লোক রাইখা লও। বাচ্চা রাখুক। গীতার নিরাসক্ত স্বর।
ছোটদা গীতার শিয়রের কাছে বসে গীতার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গীতা ও গীতা গীতা গীতা করে গেলেন সারা দুপুর, এরপর গীতার কানের কাছে মখু এনে অনেকক্ষণ ফিসফিস করলেন, মুখটি ঘুরিয়ে ঠোঁটে চুমু খাবার চেষ্টা করে গেলেন অনেকক্ষণ। বিকেলে গীতা শাড়ি পরল, ছোটদার সঙ্গে বাইরে বেরোল। ফেরত এল মার জন্য একটি শাড়ি নিয়ে। মার হাতে শাড়িটি দিয়ে বলল, অনেক খাটছেন ছেলের জন্য, এই নেন শাড়ি।
ছোটদা বললেন, শাড়িটা গীতা পছন্দ কইরা কিনছে। টাঙ্গাইলের বেস্ট শাড়ি।
মা শাড়ি হাতে নিয়ে, হ খুব ভাল শাড়ি বলে শাড়ি বিছানার ওপর রেখে কপালের উস্কোখুস্কো চুল সরিয়ে বললেন,বাবা কামাল, আমারে কালকে কি একটু বাসে তুইলা দিতে পারবা?
কই যাইবেন?
ময়মনসিং।
ময়মনসিং যে যাইবেন, বাচ্চা কার কাছে থাকব? গীতা ত অফিসে যাবে কালকে থেইকা।
ক্লান্তিতে নুয়ে আসা মা ভাঙা কণ্ঠে বলেন, আমি ত অনেকদিন থাকলাম। এইবার যাই।
তাইলে বাচ্চারে আপনে নিয়া যান মা। ময়মনসিংহে নিয়া যান।
মা চমকে ওঠেন প্রস্তাব শুনে। এ কি করে হয়। এ কদিনের মামলা! কদিনের তা ছোটদা বলেন না, গীতাও বলে না। গীতার সাফ কথা, চাকরি সে যে করেই হোক করবে, বাচ্চার জন্য চাকরি বাদ দেবে না। এখন, মা যদি এ বাড়িতে থেকে বাচ্চা লালন পালন করেন, তো ভাল, নয়ত ময়মনসিংহে নিয়ে করুন।
পরদিন মা বাচ্চা কোলে নিয়ে ময়মনসিংহে এলেন। গীতার হাঁড়িমুখে হাসি ফোটে। মা যখন অবকাশে এলেন বাচ্চা নিয়ে, মার রাতজাগা ক্লান্ত মুখের দিকে কারও নজর পড়েনি, নজর পড়েছে নজরফোঁটা লাগানো চমৎকার দেখতে বাচ্চাজ্ঞটর দিকে। অবকাশে এত ছোট শিশু কখনও জীবন যাপন করেনি, আমি আর ইয়াসমিন ঝাঁপিয়ে পড়ি বাচ্চাকে কোলে নিতে। ওকে ছোঁয়া সহজ কথা নয়, গোসল করে পরিষ্কার জামা গায়ে দিয়ে তবেই কোলে নেওয়া যাবে। এ বাচ্চা আমাদের মত ধুলো কাদায় বড় হওয়ার কপাল নিয়ে আসেনি, এর ব্যবহারের সমস্ত জিনিস, এখনও খেলার বয়স না হলেও, আগাম খেলনা, বিদেশ থেকে তো আনা বটেই, ছোটদা নাকের পাটা বুকের পাটা যত পাটা আছে ফুলিয়ে আরও বলেন, জনসন বেবি লোশন আর পাউডার লন্ডনের মাদার কেয়ার থাইকা আনি, দধু আনি সিঙ্গাপুর থাইকা, কাপড় চোপড় আনি দুবাই থেইকা।
বাচ্চার থাকার জায়গা হল বাবার ঘরে, বাবার বিছানায়। বাবা ঘরের কিনারে অন্য একটি খাট পেতে নিলেন নিজের জন্য। ঘরের বন্ধ জানালা খুলে দেওয়া হল, বাবার গায়ে প্রয়োজন না হলেও বাচ্চার গায়ে আলো বাতাস লাগার প্রয়োজন আছে। বাবার ঘরটি ধুয়ে মুছে ঝকঝক করে ঘরে টেবিল পেতে বাচ্চার খাবার সরঞ্জাম সাজিয়ে নিলেন মা, কমলার রস করার যন্ত্র, ভাত শাক সবজি মাছ মাংস মিহি করার যন্ত্র, বিদেশি দুধের কৌটো, বিদেশ আরও নানারকম গুঁড়ো খাবারের কৌটো, বিদেশি ফিডার, বিদেশি বাটি, চামচ। বাচ্চার খেলনা আর কাপড় চোপড় চলে গেল আলমারিতে। বাচ্চার জন্য প্রতিদিন মুরগির বাচ্চার সপু লাগবে,বাবা বারোটি মুরগির বাচ্চা কিনে পাঠিয়ে দিলেন। প্রথম নাতির জন্য বাবা দাতা হরিশচন্দ্র হয়ে উঠলেন।
দাদার আদরের মুমু চোখ বড় বড় করে বাচ্চার বিদেশি জিনিস দেখে। বিদেশি জিনিসে মার কোনও আগ্রহ নেই। কতদূর গেলে ঠিক বিদেশ যাওয়া হয়, মার কোনও ধারণা নেই, বিদেশ খুব সাংঘাতিক কিছু হবে হয়ত, সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে যেতে হয়, কিন্তু বিদেশি সিল্কের জামা দূরে সরিয়ে দেশি সুতির জামা বাচ্চাকে পরান মা, গরমের দেশে সুতির মত আরাম আর কি আছে! সেরেলাক্স, ফেরেলাক্স ইত্যাদি নানারকম বিদেশি গুঁড়ো খাবার সরিয়ে নিজের হাতে তিনি টাটকা টমেটো, গাজর, পুই শাক পালং শাক নরম করে বাচ্চাকে খাওয়ান। প্যাকেটের ফলের রস ফেলে দিয়ে বাজারের টাটকা ফল থেকে নিজের হাতে রস করে খাওয়াতে লাগলেন। গুঁড়ো দুধে মার বিশ্বাস বাচ্চার পেট খারাপ হয়, ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গিয়ে নিজে তিনি ভাগীরথীর মাকে বলে আসেন, তাঁর নাতির জন্য এখন থেকে প্রতিদিন খাঁটি গরুর দধু লাগবে। ভাগীরথীর মা পরদিন থেকে প্রতিদিন আধ সের করে দধু দিয়ে যায়। বাড়িতে বাচ্চাজ্ঞট রাজার বাচ্চার মত বড় হতে থাকে। মার ঘুম হারাম, বাবারও অনেকটা। আমি আর ইয়াসমিন ঘুম হারাম না করলেও বাচ্চা নিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে থাকি। বেশ তো চলছে, কিন্তু বাচ্চার নামের তো দরকার আছে, মণিটা সোনাটা বাবুটা এসব ডাকলে কি চলবে! বাবা আকিকার আয়োজন করলেন। আমরা যে যার বন্ধু বান্ধবকে নেমন্তন্ন করলাম, ছোটদা আর গীতাকেও নেমন্তন্ন করা হল। আকিকার দিন বিশাল এক ষাঁড় জবাই হল, বাবুচির্ আনা হল, বেল গাছের তলে বিশাল গতর্ করে, বড় বড় পাতিলে পোলাও মাংস রান্না চড়ানো হল। মহা আড়ম্বরে আকিকা অনুষ্ঠান হল। বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে নাম পড়লেন বাচ্চার।
ডাক নাম হল সুহৃদ, আর আসল নাম আলিমুল রেজা।
কি? আলিমুল রেজা? ইয়াসমিন আর আমি পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। আমার ঠোঁট নাক ভুরু সব বেঁকে থাকে।
আলিমুল রেজা আবার কি? এইটা কোনও নাম হইল? আজকাল আরবি নাম কেউ রাখে?
বাবা কঠিন স্বরে বললেন, রাখে।
সুন্দর একটি বাংলা নাম রাখব ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল হৃদয় রাখব, হৃদয় সমুদ্র। আমার ইচ্ছের কোনও মূল্য নাম রাখার মত বড় ক্ষেত্রে নেই। মা বললেন, কোন এক পীরের কাছ থেইকা আলিমুল রেজা নামডা আনছে।
কোন পীর?
রাজিয়া বেগমের পীর। তর মাথার তাবিজও ওই বেডির কাছ থেইকা আনছিল।
মাস দুই পর ছোটদা গীতাকে নিয়ে এলেন সুহৃদকে দেখতে। সুহৃদের জন্য একগাদা বিদেশি জিনিসপাতি রেখে ক্যামেরায় সুহৃদকে কোলে নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন কায়দার ছবি তুলে নিয়ে বিকেলেই চলে গেলেন ঢাকায়। অবশ্য পিয়নপাড়া হয়ে গেলেন। সুহৃদ মার কোলে কাখে বড় হচ্ছে। মার রাত দিন ব্যস্ততা। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। শাড়ি আলথুালু চুল না আঁচড়ানো। সুহৃদের কাজের জন্য নার্গিস নামের এক মেয়েকে রাখা হয়েছে, নার্গিস সুহৃদের থাল বাটি ধোয়, খাবার জল ফুটোয়, সুহৃদের কাথাঁ কাপড় কাচে, তবু মার এক ফোঁটা বিশ্রাম নেই। সুহৃদ মার য−ত্ন আদরে মোটা তাজা হতে থাকে। ক্যালেন্ডারের গ্লাক্সো কোম্পানীর বাচ্চাদের থেকেও সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে ও। মা মা ডাকার আগে শেখে দা দা, দা দু। বাড়িতে সুহৃদের আদর হাসিনা আড়চোখে দেখে। দাদাও। বড় আদরে বড় হতে থাকলেও সুহৃদের একটি অসখু দেখা দেয়। পেচ্ছাব করার সময় ও চিৎকার করে কাঁদে। ডাক্তার দেখে বললেন, অপারেশন করতে হবে। সুহৃদকে নিয়ে আমি আর বাবা হাসপাতালে যাই। বাড়িতে মা গলা ছেড়ে কাঁদছেন দুশ্চিন্তায়। অপারেশন থিয়েটার ফেটে যায় সুহৃদের চিৎকারে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমারও চোখ ভেঙে জল নামে। পরের মাসে ছোটদা আর গীতা এলে সুহৃদের কষ্টের কথা শুনে দুজনের চোখই ভিজে থাকবে সারাক্ষণ, ভাবি। কিন্তু এলে, যেই না বিস্তারিত বর্ণনা করতে নিই কি করে এইটুকুন একটি বাচ্চা যনণ্ত্রায় ছটফট করেছে, ছোটদা মাঝপথে আমাকে থামিয়ে বলেন, মুসলমানি হইয়া গেছে ভালাই হইছে। এটুকুই, একটি আহা শব্দ শোনার সৌভাগ্য আমার হয় না। ভারি গলায় বলি, এইডা মুসলমানি না, ফাইমসিস হইলে এই অপারেশন করতে হয়।
চল তাস খেলি গা। ছোটদা এক হাতে আমাকে, আরেক হাতে গীতাকে ধরে শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন।
তাস যখন খেলছি এ ঘরে, ও ঘরে মা সুহৃদকে ঘুম পাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ঘুম আসেনা ওর, ছটফট করে, গায়ে জ্বর আসছে ওর। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন মা, জ্বর আসছে খবর পেয়ে আমি আর ইয়াসমিন দৌড়ে খেলা থেকে উঠে যাই। বাবাকে খবর পাঠানো হয়, বাবা এসে সুহৃদের জ্বর দেখেন। দ্রুত চলে যান ফার্মেসি থেকে ওষধু আনতে। ছোটদা আর গীতাকে বলি, সুহৃদের গা জ্বরে পুইড়া যাইতাছে। গীতা কপাল কুঁচকে বলে, জ্বর হইল কেন? বাসি কিছু খাওয়াইছিল নাকি?
বাসি? পাগল হইছ? মা দুধের বোতল ফুটানো পানিতে সাতবার ধইয়া নেয়।
চোখ কপালে তুলে গীতা বলে, সাতবার ধইয়া নেয়? যেন সাতবার যে কোনও জিনিস ধোয়া যায়, তা সে এই প্রথম শুনল। মা তাই করেন, মার ভয়, কখন আবার পেটের অসখু , জ্বরজ্বারি হয়ে যায়। সুহৃদের খুব অল্প কিছুতেই কিছু হয়ে যায়।
যাও, সুহৃদের কাছে যাও না একটু। যাও, দেইখা আসো। বলি গীতাকে। সে অগত্যা তাস ফেলে সুহৃদের কাছে বসতে যায়। কিন্তু বসার দুমিনিট পর শুয়ে পড়ে, শুয়েই ঘুম। শেষ অবধি অন্য বিছানায় এসে তাকে ঘুমোতে হল। মা সারারাত জেগে রইলেন জ্বর হওয়া সুহৃদকে নিয়ে।
সুহৃদ অবকাশে তিন মাস যাপনের পর হাসিনাকে হাসপাতালে যেতে হল। তার বাচ্চা হবে। দাদার বন্ধুরা ডাক্তার, বাবার বন্ধুরা অধ্যাপক, মহা সুবিধে হাসপাতালে, বাচ্চা হয়ে যাবার পর, ইঁদুরের মত ছোট্ট ছেলেটির জন্য হাসপাতালের কেবিনে সব ডাক্তারদের মিষ্টিমখু নয় কেবল, বিরানি-মখু করালেন দাদা। আমি ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে বিরানি খেয়ে এলাম। ইদুঁরটি নিয়ে অবকাশে ফেরা হল। সুহৃদের যেমন যত্ন হয়, ঠিক তেমন য−ত্নর আয়োজন করল হাসিনা তার নিজের বাচ্চার জন্য। অর্জুনখিলা থেকে বাচ্চার জন্য একটি কাজের মেয়ে নিয়ে আসা হল, নতুন মেয়ে নতুন বাচ্চাকে কোলে রাখে, নতুন বাচ্চার কাথাঁ কাপড় কাচে। বাড়িতে কাজের মানুষ এখন চারজন। নার্গিস আর ঝর্ণা, সুহৃদ আর নতুন বাচ্চা শুভর জন্য। বড়দের কাজ করার জন্য, রান্নাবান্নার, কাপড়চোপড় ধোবার, ঘর দোর পরিষ্কারের জন্য আনুর মা আর সুফি। আরেক জন ফুলেরা, অর্জুনখিলা থেকে আনা, হাসিনার ব্যক্তিগত কাজকর্ম করার জন্য। বাবা একদিন বাড়ির মানুষের মাথা গুনতে বসেন। গুনে বলেন, এতগুলা মানুষের খাওন একজনের যোগাড় করতে হয়! লোক বিদায় কর।
কারে বিদায় করতে কয় তোমার বাবা? ঝর্ণারে নাকি? হাসিনা কটাক্ষ করে।
দাদা বলেন, ঝর্নার কথা কয় নাই।
ঝর্নারে আনার আগে তো বাবা মাথা গুনে নাই!
বাবা মাথা প্রায়ই গোনে।
নার্গিস আসার পর গুনছিল?
তাও তো কথা! গুনে তো নাই।
দুনিয়াডা একটু বুঝার চেষ্টা কর।
দুনিয়া কি আমি বুঝি না নাকি?
না, মোটেও বুঝো না। বুঝলে তুমি মখু ফুইটা কিছু কইতে পারতা। সুহৃদই তাদের একমাত্র নাতি না। সুহৃদের জন্য যা করা হয়, তার কয়ভাগ শুভর জন্য করা হয়? হিশাব আছে।
দাদা চপু হয়ে থাকেন। সম্ভবত দুনিয়া বোঝার চেষ্টা করেন।
খসখসে কণ্ঠটি উঁচুতে ওঠে।
যাও,বাচ্চার পাউডার লাগবে, পাউডার নিয়া আস।
কি কও মুমু পাউডার না কালকে আনলাম!
বাজে পাউডার। মুখ খসখস করে। জনসন আনো।
জনসন বেবি পাউডার বাজারে যা পাওয়া যায়, তা নকল। ময়দা ঢুকাইয়া রাখে কৌটায়। তিব্বত পাউডারই ভাল।
আরে কি আশ্চর্য, দেশি জিনিস ব্যবহার করব নাকি শুভর জন্য? তোমার কি মাথা খারাপ? আরেকটা বাচ্চার যত্ন ত চোক্ষের সামনেই দেখতাছ? কোনও দেশি জিনিস ব্যবহার হইতাছে ওই ঘরে?
কামালের মত বিদেশ গেলে না হয় বিদেশি জিনিস আনতে পারতাম। সেদিন পয়জন সেন্ট কিনলাম, মেইড ইন ফ্রান্স, শালার বোতলের মধ্যে নুরানি আতর ভইরা রাখছে। এই যে ফেরিওলারা খালি শিশি বোতল কিনতে আসে, ওরা কি করে জানো, শিশি বোতল গুলা নিয়া না বেইচা দেয় জিঞ্জিরায়, জিঞ্জিরায় সব তো দুই নম্বর মাল জানো তো!
অর্ধেক খরচ হওয়া জনসন পাউডারের একটি কৌটো হাসিনার দিয়ে মা বললেন আমার চাইর পুলাপান বড় হইছে দেশি পাউডারে, শইলের চামড়া দেইখা পাড়ার মানুষে কইছে, কী মাখ যে চামড়া এত সুন্দর?
হাসিনা পাউডারের কৌটো নেয় না। অর্ধেক ছাড়া পুরো নেই, মা কথা দেন পরের বার ছোটদা এলে তিনি শুভর জন্য বিদেশি পাউডার আনতে বলবেনই। পাউডারের ঘটনার দিনই ইয়াসমিন কলেজ থেকে ফিরে হাতের কাছে ঝর্ণাকে পেয়ে বলল, এক গ্লাস পানি দে তো ঝর্ণা।
ঝর্ণা এদিক ওদিক হাঁটে, কিন্তু পানি দেয় না।
কী রে পানি আনলি না?
আমি বাচ্চার কামের লাইগা। অন্য কাম করতে না করছে মামী। আপনেগো নার্গিস আছে, নার্গিসরে কন।
বড়দের কাজ করার দুজনের জায়গায় এখন একজন কেবল। এ বাবার লোক কমানোর আওয়াজে কমেনি, আনুর মা য়েচ্ছায় হাওয়া হয়েছে, এরকম হাওয়া হওয়া খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। একজন হাওয়া হলে, আরেকজন উদয় হয়। এখন নার্গিসকে ছোটর কাজ শেষ করে এসে বড়র কাজে নামতে হয়। ভর সন্ধেয় ঘর মুছছে নার্গিস, তেরো বছর বয়স, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ, ত্বক শুকিয়ে কাঠ,গা থেকে বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। ঘর মোছা রেখে বোঁটকা গন্ধ দৌড়ে গিয়ে কল চেপে গেলাসে পানি ভরে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেয়। বোঁটকা গন্ধ ফিরে আসে ঘরে।
কি রে নার্গিস গোসল করস না নাকি?
করি তো।
খাওয়া গোসলের কথা জিজেস করলে ও শরমে মাথা নামিয়ে রাখে।
কি রে, খাইছস নার্গিস?
এই তো ঘরগুলা মুইছা গিয়াই খাইয়াম।
সন্ধ্যা হইয়া গেল, তর দুপুরের খাওয়া এখনও হয় নাই?
খিদা লাগে নাই তর? জিজ্ঞেস করি।
না খিদা লাগে নাই। খাইছি ত!
কখন খাইছস?
সকালে নাস্তা খাইছি তো।
প্রতিদিন কি সন্ধ্যার পর দুপুরের খাবার খাস?
না না। কী যে কন আপা। কাপড় ধোয়া হইছে তো। একটু দেরি হইয়া গেছে আজকে।
চোখে আমার করুণাধারা, মনে কণ্টকীর বেড়ে ওঠা।
চুলোয় পাশে দধু জ্বাল দিতে থাকা গরমে ঘামতে থাকা মাকে আমার রোষানলে আরও তপ্ত করি।
তুমি কি নার্গিসরে গোসল করার, খাওয়ার সময়ও দেও না নাকি?
মা ফুঁসে উঠলেন, ও কখন খায়, কখন গোসল করে, এইসব খবর তুই জানস নাকি! ছেড়িডা এত ধীর গতির, একটা বোতল ধুইতেই দশ মিনিট লাগায়। নিজেই কইছে ঘর মুইছা পরে খাইব।
সে সন্ধেয় নার্গিসের আর খাওয়া হয় নি। খেতে খেতে রাত বারোটা। মেয়েটির জন্য আমার বড় মায়া হতে থাকে। পরদিন সকালে রান্নাঘরে রুটি বেলছে। আমার চা চাই এর হাঁক শুনে, চা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর মুখে মুখে চেয়ে চমকে উঠি, সারা মুখে লাল ফুসকুড়ি।
কি রে তর কি হইছে, বসন্ত নাকি?
না, কিছু হয় নাই তো!
মুখে কিসের দাগ এত!
না কিছু না। নার্গিস হেসে হাতে মুখ ঢাকে।
ওর হাত সরিয়ে নিয়ে মুখের দাগগুলো দেখি। কয়েকশ ফুসকুড়ি মুখে, বীভৎস দেখাচ্ছে মখু টি। ফুসকুড়ি হাতেও আছে। পায়েও।
তর ত বসন্ত হইছে।
না, বসন্ত হইব কেন? কি যে কন আপা। মশার দুএকটা কামড়।
মশায় এইভাবে কামড়াইছে?
সুহৃদের গুমুতের কাথাঁ নার্গিসের হাতে দিতে এসেছেন মা, কলপারে নিয়ে ধুতে হবে, রুটি বেলবে সুফি।
নার্গিসরে একটা মশারি দিতে পারো না নাকি মা? ওর তো মুখের অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ!
মশারি আছে তো। লাগায় না কেন? মার নিরুদ্বেগ স্বর।
মশারি লাগাই তো। ওই দুইএকটা ছিদ্র দিয়া মশা আসে। এমন কিছু না। নার্গিস তার গাল আড়াল করে রাখে দু হাত বোঝাই কাপড়ে।
ছিঁড়া মশারি শিলাই কইরা লইতে কইছি, ছেড়িডা আইলসার আইলসা। মা বলেন।
সেই রাতে মেঝেতে একটি ছেঁড়া কাথাঁ বিছিয়ে নার্গিস যখন শুয়েছে, রাত তখন অনেক। আমি ওকে টেনে তুলে বললাম, যা মশারি লাগাইয়া শ। ঘুমচোখে ও রান্নাঘরের খোপ থেকে মশারি নিয়ে এল। নার্গিস ছেঁড়া মশারিটিই টাঙাতে থাকে, এক ফিতে এক চেয়ারে, আরেক ফিতে এক ছিটকিনিতে। মশারিটিতে আমি গুনে দেখি, আটানব্বইটি ছিদ্র। ওই শত-ছিদ্র মশারি ব্যবহার করা না করা সমান কথা।
নার্গিসের মুখে আরও নতুন ফুসকুড়ি। পরদিনও আমি মশারি নিয়ে পড়ি।
মা, সুহৃদকে পায়ের ওপর শুইয়ে দধু খাওয়াচ্ছিলেন, কাছে গিয়ে সুহৃদের গালে আদর করে দিতে দিতে মাকে বলি, মা ওই ছেঁড়া মশারি ছাড়া আর কোনও মশারি নাই নাকি? নার্গিসের মুখটা দেখছ?
আর কোনও মশারি থাকলে কি আমি দেই না নাকি? তর বাপে কি কিছু কিনে? ছিঁড়া ছিঁড়া মশারি তো শিলাই কইরা চালাইতাছি। আমি যদি কই কামের মানুষের লাইগা মশারি লাগব, আমারে উল্ডা যা তা কথা কইব। সুহৃদের বিছানার লাইগা নতুন মশারি কিনছে। আমার ত নাইলে থাকতে হইত ছিঁড়া মশারি দিয়াই।
কও তাইলে যে আমার বিছানায় একটা মশারি লাগব, তারপর নতুনটা আমি লাগাইয়া আমারটা কাজের মানুষদের দিয়া দিই। সুফিরেও ত মশা কামড়ায়।
তর বাপেরে চিনস না! কিছুতেই কিছু কিনব না। টাকা পয়সা তো সব পাঠাইয়া দেয়। কাইলও রিয়াজউদ্দিন আইসা টাকা লইয়া গেছে।
সুহৃদ হঠাৎ ওয়াক করে উঠল, বমি।
মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে মার। পেটে কিচ্ছু থাকে না ছেলেটার, যা খাওয়াই তাই বমি কইরা ভাসাইয়া দেয়।
মা দুধের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নার্গিস সপু এনে নরম গলায় বলল, খালা, সপু টা কি এখন খাওয়াইবেন?
ফালাইয়া দে সপু । খাওয়াইয়া লাভ কি, সবই তো ভাসাইব।
জানি, মা যাই বলুন না কেন, নতুন উদ্যমে আবার সপু বা দধু খাওয়াতে শুরু করবেন, আবারও বমি করে ভাসাবে, আবারও খাওয়াবেন। মার অতি যত্নে ছেলেটি নাদুসনুদুস হচ্ছে।
ছোটদা গীতাকে নিয়ে যেদিন নাদুস নুদুসকে দেখতে এসে শহরে ঘুরে পিয়নপাড়া হয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ফুরফুরে মন নিয়ে বলেন, কালকে চইলা যাইতে হইব, পরশুদিন ফ্লাইট আছে।
আইসাই যে যাই যাই করস, মা বলেন সুহৃদরে তো একটু কোলেও নিলি না।
কোলেই আসে না, কি আদর করাম!
মা, বাবা, আমার আর ইয়াসমিনের কোল ছাড়া আর কারও কোল সুহৃদের ভাল লাগে না। ওর নিজের বাবা মা এলে মুখ ফিরিয়ে রাখে। এতে ছোটদার আপত্তি না থাকলেও গীতার আপত্তি।
আমার পেটের ছেলে হইয়া আমার দিকে ফিরে না?
মা হেসে বলেন আমাদেরে দেখে তো চোখের সামনে, তাই। তুমি আরও ঘন ঘন আসবা, তাইলেই চিনব তোমারে।
সকালে ছোটদার নাস্তার জন্য ঘি এ ভাজা পরোটা আর খাসির মাংস করতে মা রান্নাঘরে ছোটেন।ছোটদারা বাড়ি এলে সখুাদ্যের আয়োজন হয়। যে ছোটদাকে বাবা ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন, সেই ছোটদাকে এখন কাছে বসিয়ে বাবা আমার, ছেলে আমার বলে আদর করে কাছে বসান। যে ছোটদা চুরি করে দাদার জামা পরতেন, সেই ছোটদার পরনের জামা দেখে দাদার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বাহ! শার্টটা তো সুন্দর! আমার লাইগা এইরকম একটা শার্ট আইনা দিস তো! যে ছোটদা আমার কাছে এক টাকা দু টাকা ভিক্ষে চাইতেন, সেই ছোটদা বলেন, কী রে তর সেঁজুতির খবর কি!
খবর আর কী! ছাপানোর টাকা নাই।
দে তর পাণ্ডুলিপি দে। ঢাকা থেইকা ছাপাইয়া আইনা দিই।
সেই ছোটদা সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলেন ঢাকায়, ছাপতে। পাণ্ডুলিপি তৈরিই ছিল। এ সেঁজুতিতে রুদ্রর কবিতা তো আছেই, এখন যৌবন যার ,যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এর নিভৃত নির্জন কবি হেলাল হাফিজের আর পশ্চিমবঙ্গের কিছু কবির কবিতা। রুদ্রর এক বন্ধু মইনুল আহসান সাবের, নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছে, চমৎকার গল্প লেখে, ওর একটি গল্প আর নিজের একটি গল্পও, এই প্রথম সেঁজুতিতে আমার গল্প, আর আনন্দমোহন কলেজের বাংলার অধ্যাপক শরফউদ্দিন আহমেদের কবিতার একাল সেকাল নিয়ে একটি প্রবন্ধ। এবার নিজে পঈচ্ছদ করিনি। শিল্পী দিয়ে করা। ছোটদার হাতে পাণ্ডুলিপি দেওয়ার আগে তড়িঘড়ি সম্পাদকীয় লিখে দিই, একেবারে নিরুৎসাহ ছিলাম। সত্য ও সুন্দরের এমন আকাল পড়েছে দেশে, সৃষ্টিশীল কিছু একটা করতে এক পা এগোলে দু পা পেছোতে হয়। আমার বাবা বলেন সেঁজুতি করে করে আমি নাকি আমার ভবিষ্যতের বারোটা বাজাচ্ছি। মা দুঃখ করে বলেন, মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেল। একেবারে নিরৎু সাহ ছিলাম, একজন বাড়িয়ে দিল সহযোগিতার হাত। আমার শৈশব আর কৈশোরের ভালবাসা। গোপনে গোপনে যার লেখা থেকে আমার কবিতার প্রেরণা। তার হাতে আমার শ্রম আর সাধনার ধন সেঁজুতি তুলে দিলাম আর আমার পরম বিশ্বাসটুকু দিলাম।
পরম বিশ্বাসের মর্যাদা ছোটদা রেখেছেন। দিব্যি সেঁজুতি ছেপে আনলেন। অবশ্য সে ঘরে আসতে আসতে তিন মাস পেরোলো। ছোটদা বললেন, ওই দাড়িঅলা বেডার কবিতা বাদ দিছি।
রুদ্রর কবিতাহীন সেঁজুতিটি দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। প্রথম কাজ রুদ্রর ঠিকানায় দশ কপি পাঠিয়ে দেওয়া। পেয়ে সে জানাল, আরও পঁচিশ কপি পাঠাতে। পঁচিশ কপির পর আরও চাইল। ময়মনসিংহেও সেঁজুতি বিলি হল। স্টেশন রোডের পত্রপত্রিকার দোকানে বিক্রি করতে দিলে বেশ বিক্রিও হল। সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে আবারও মন চায়। কিন্তু সময় কোথায়। লেখাপড়ার চাপ বাড়ছে। বাবা বললেন, এখন থেইকা যদি ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি না নেস, তাইলে আর পাশ করা হইব না। বাবা কথা ভুল বলেন না। প্রতিবছর শেষ পরীক্ষায় আটকে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। দুবারে গতি হচ্ছে না,এমন কি চারবারেও না। আমার এক ক্লাস ওপরের ছাত্র রাজিবকে বাবা বলেছেন আমাকে যেন তিনি তাঁর নোটখাতাগুলো পড়তে দেন। রাজিব মেডিকেলের সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলে, শিক্ষকদের আদরের ধন। এক কথায় চিকিৎসাবিদ্যার যে কথা বলা যায়, একশ কথায় তার নাড়ি নক্ষত্র তুলে ধরে লেখা খাতার সপ্তূ দিয়ে গেলেন আমাকে। নাড়ি নক্ষত্রে ঝুঁকে আমার বেলা ফুরোতে লাগল।
নানা আসছেন প্রায়ই দুপুরে। বারান্দার চেয়ারে বসে তিনি উঠোনের রোদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে থাকেন যতক্ষণ না মা এসে বারান্দার বা উঠোনের রোদে পিড়ি পেতে বসিয়ে নানার ফর্সা শরীরটিকে মেজে গোসল করাতে ডাকেন। মার নাভিশ্বাস ওঠে সংসার সুহৃদ সামলাতে। তারপরও নানা এলে নানাকে রোদে বসিয়ে শরীর মেজে গোসল করিয়ে বাবার একটি ধোয়া লুঙ্গি পরিয়ে শুইয়ে রাখেন। নানা বাচ্চা ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠলে মা ভাত এনে দেবেন খেতে, ভাতের পর পায়েস। নানার পায়েস খাওয়ার মধ্যে বাবা চলে আসেন। মা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, বাজান তো এই বাড়িতে আসেই না, আসলেও তো কিছু খায় না। কত কইয়া একটু পায়েস খাইতে দিলাম।
বাবা ঠাণ্ডা গলায় বলেন, তোমার বাপেরে যে পায়েস খাওয়াইতাছ, তার ত ডায়বেটিস!
একটু খাইলে কিμছু হইব না। বাজান মিষ্টি খাইতে পছন্দ করে।
আমি নাড়ি নক্ষত্রে। নাড়ি নক্ষত্র থেকে উঠে যেই না মার শরবতের কিনারা করতে পেশাবখানায় যাচ্ছি, দেখি মা দরজা ধরে বসে আছেন।
কি? রক্ত গেছে পাইলসের।
হ।
মা ওই রক্ত যাওয়া শরীরেই উঠে সুহৃদের দুধের বোতল ফুটোনো পানিতে ধুতে শুরু করেন। বোতলে দুধ ভরে, সুহৃদকে ফুটফুটে এক রাজকুমারের গল্প বলতে বলতে দধু খাওয়াবেন মা। দুধ খাওয়ানো শেষ হলে বনবাসী এক রাজকুমারীর গান শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়াবেন। সে রাতে বাবা ফিরলে বলবেন, পাইলসের কোনও চিকিৎসা নাই? রক্ত যা আছে শইলে, সব তো গেল গা!
বাবা উত্তর দেবেন না। একবার আমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে যাবেন নাড়িনক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি নাকি কবিতা লিখছি নাকি প্রেমপত্র!
মা কাতরকণ্ঠে বলতে থাকবেন, আমার তো একটু দুধ খাওয়া দরকার। একটা কলা অন্তত দিনে। একটা ডিম। এইভাবে রক্ত গেলে শইলে তো আর কিছু থাকব না। আমার জন্য এক পোয়া কইরা দধু দিতে কই ভাগীর মারে?
বাবা এসবের উত্তর দেবেন না।
সুহৃদ হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। চারপাশে রাজ্যির খেলনা নিয়ে খেলতে শিখেছে। সুহৃদের প্রতিটি উত্তরণে আমার আর ইয়াসমিনের আনন্দ উপচে ওঠে। আমরা কাড়াকাড়ি করি ওকে কোলে নিতে। ওকে নিয়ে বেড়াতে। ওকে দোলাতে। সুহৃদকে কোলে নিয়ে বারান্দার দোলনায় দোলাচ্ছি।
দাদা বারান্দায় বসে গলা ছেড়ে গান গাইছেন, হাড়ের ঘরখানি চামড়ার ছাউনি বান্ধে বান্ধে জোড়া। টাঙ্গাইলের রাস্তায় এক ভিখিরিকে গানটি গাইতে দেখে শিখেছেন। হাসিনা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খেঁকিয়ে ওঠে, গান গাইলে চলব! শুভর মুরগি নিয়া আস।
দাদা গান থামিয়ে বলেন, মুরগি নাই?
না নাই। শুভর মুরগি নাই।
একদিন মুরগি না খাইলে কিছু হইব না মুমু।
হাসিনার গলা চড়ে, দাঁড়কাকের কর্কশতা গলায়, কিছু হইব না মানে! বাড়িত ত আরেকটা বাচ্চা আছে, কেমনে ফু পাইড়া পালা হইতাছে দেখতাছ না! তুমার বাচ্চার বেলায় এত অবহেলা কেন! নাতি কি একটাই নাকি? শুভ কি নাতি না?
মুরগি নাই কও কেন? ওই তো উঠানে মুরগি হাঁটতাছে।
হাসিনার চোখ থেকে আগুনের ফুলকি ওঠে।
বাচ্চা-মুরগি নাই।
ওই যে দেখ মুমু খাঁচার মধ্যে বাচ্চা মুরগি। জবো করতে কও।
ওইগুলা সুহৃদের, ভাল কইরাই ত জানো। তুমার ছেলের জন্য তো আর বাবা মুরগি কিন্যা রাখে নাই।
মা শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে নাক গলান, বৌমা এই সব কি কও, সবসময় না তোমার শ্বশুর দুই বাচ্চার জন্য মুরগি কিনতাছে। সবসময় না দুইটা মুরগির সপু হইতাছে। সুহৃদের একটা, শুভর একটা। তোমার শ্বশুর তো দুই বাচ্চার জন্যই দধু ডিম সব কিনতাছে। শুভ সুহৃদ দুই জনই ত নাতি।
দুই জনই ত নাতি। তা ত জানি। কিন্তু এক নাতির দিকেই ত সবার নজর। শুভর দিকে কে ফিরা চায়! হাসিনা কড়মড়িয়ে ওঠে।
ফির্যা চায় না মানে! কি যে উল্ডা পাল্ডা কথা কইতাছ। সুহৃদের বাবা মা কাছে নাই। তাই ওরে দেখতে হয়।শুভ ত তার বাপ মার সাথেই আছে।
হাসিনা ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টো, আমি পারভিন আপার বাসায় যাইতাছি, মা শুভরে দেইখা রাইখেন ত।
বলে গটগট করে পেছনে না ফিরে চলে যায়। মা তখন এক হাতে সুহৃদকে, আরেক হাতে শুভকে সামলাচ্ছেন।
দাদা বাকি গানটুকু গাইছেন।
হাসিনা প্রায়ই তার নকলে ফুপাতো বোন আসলে আপন বোন পারভিনের বাড়িতে যায়। কুসুমের বাড়িতেও যায়। কুসুম নিজের স্বামী, রেলওয়ে ইস্কুলের হেডমাস্টারকে ছেড়ে করিম নামের এক বিবাহিত ছেলেমেয়েঅলা লোককে বিয়ে করেছে। করিম দেখতে অনেকটা তরমুজের মত, গোলগোল। কুসুমও। গোলগাল তরমুজ দাদার বিয়ের পর প্রায়ই এ বাড়ি বেড়াতে এসে বলে যাইও, তোমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াইয়া আইস। করিম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি একধরনের দেখাশোনার কাজ করে। একধরনের, কারণ না সে বোটানিস্ট, না মালি। বেড়াতে গিয়ে একদিন নানারকম ফুলের চারা নিয়ে এসে বাড়ির মাঠে মাটি কেটে পুঁতে দিয়েছি, হাজারি গোলাপ ফুটছে, তরতর করে বাড়ছে চেরি, এমন যে ছাদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাগানের শখ আমার হঠাৎ হঠাৎ হয়। একবার টিনের ঘরের কিনার ঘেঁষা বাগানে ধনে পাতা লাগালাম, প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে মাটিতে আঙুল বুলিয়ে হতাশ হয়ে যেতাম, এত দেরি করে যে এরা বড় হয়! গোলাপ গাছ লাগিয়ে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় একবার দেখে আসি ফুল ফুটেছে কি না, সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, গোলাপের কোনও চিহ্ন নেই, ব্যস উৎসাহ নিবে গেল। আর সব আগাছার মত গোলাপ গাছও বড় হতে লাগল, কলেজ থেকে একদিন ফিরে হঠাৎ চমকে উঠি দেখে ফুটে থাকা লাল গোলাপ। চেয়ে পাওয়ায় যত সখু , তার চেয়ে বেশি বুঝি না চেয়ে পাওয়ায়!
হাসিনা ফিরে এলে, বিকেলে, শুভকে তার মার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সুহৃদকে সাজিয়ে গুজিয়ে মা নিয়ে গেলেন নানি বাড়ি, অনেক দিন ও বাড়ি যান না তিনি। বারান্দার গা ঘেঁষেই আমার ঘর, বারান্দার যে কোনও ফিসফিসও কানে আসে আমার, ইয়াসমিন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে যখন বলছে, কি রে শুভর গুঅলা পটটা সকাল থেইকা বারান্দায় পইড়া রইছে, সরায় না কেন কেউ!
হাসিনা বারান্দার চেয়ারে পা তুলে বসেছিল, বলল,তুমি সরাও না কেন?
কী কইলা?
কইলাম তুমি সরাও না কেন? দেখতাছই যহন যে পটটা পইড়া রইছে।
আমি সরাইতাম কেন?
সুহৃদের পট সরাও না?
সরাই।
তাইলে শুভর পট সরাইতে পারবা না কেন?
শুভর পট সরাইতাম ক্যা?
কেন শুভর পট সরাইতে পারো না?
পারি না।
পারি না কইলেই হইব নাকি? পারতে হইব।
পারতে হইব না।
পারতে হইবই।
পারতে হইবই কেন? শুভর কাজের ছেড়ি আছে না? ঝর্ণা কি করে?
সুহৃদের তো নার্গিস আছে। তাইলে তরাও ত সুহৃদের পট সরাস। তরা ত সুহৃদের চাকর।
হ চাকর। সুহৃদের চাকর হইছি ভালা হইছে।
শুভরও চাকর হইবি।
কেন হইতাম?
হইতে হইব।
তুই কইলেই হইতে হইব?
হ। আমি কইলেই হইতে হইব।
কি কইলি?
যা কইলাম, কইলাম।
আবার ক।
সুহৃদের গু খাইতে পারস, শুভর গু ও খাইতে হইব।
ইয়াসমিন এবার লাখি মেরে শুভর পটটিকে ফেলল উঠোনে।হাসিনা উড়ে এসে ইয়াসমিনের চুল টেনে বলল, যা পট তুইলা আন। ইয়াসমিনও হেঁচকা টান দিয়ে হাসিনার চুলে বলল, তুই আন।
আমি শব্দ শুনে নাড়ি নক্ষত্র থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে এই চুলোচুলি দেখেই শরীর গলিয়ে ইয়াসমিনকে ছাড়িয়ে আনতে গেলাম। তিন জনে ধস্তাধস্তি। এর মধ্যে কোত্থেকে উড়ে এসে স্যুটেড বুটেড দাদা ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার আর ইয়াসমিনের ওপর, ইয়াসমিনের চুল শক্ত মুঠিতে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে ফেললেন উঠোনের মাঝখানে যেখানে শুভর পট উল্টো পড়ে আছে। হাসিনা দৌড়ে গিয়ে পড়ে থাকা ইয়াসমিনের মখু বুক খামচে পিঠে ধড়াম ধড়াম কিল বসাতে শুরু করেছে। ইয়াসমিন খোয়ার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেয়ে চাইছে হাসিনাকে ওই পটের ওপর ফেলতে। হাসিনা দুহাতে ওর মখু ঠেসে ধরে পটের ওপর, মখু সরিয়ে ইয়াসমিন খামচি দিয়ে ধরে হাসিনার পা, টেনে ফেলতে চায়, পারে না। দাদা এবার লাথি বসালেন ইয়াসমিনের ঘাড়ে। ক্রমাগত। লাথি ঘাড়ে পিঠে নিতম্বে, উঁরুতে। ইয়াসমিন হাত ছুটে যায় হাসিনার পা থেকে। লাথি খেয়ে কুণ্ডুলি পাকাতে থাকা ইয়াসমিনের মুখের ওপর হাসিনা উপুড় করে ধরে পট। ওর মুখে লেপ্টে থাকে শুভর গু। এই নৃশংস কাণ্ড দেখে আমি হাঁ হয়ে আছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এ আমাদের দাদা! এর মধ্যে আরোগ্য বিতান থেকে শুভর জন্য আলাদা করে বাবার পাঠিয়ে দেওয়া দশটি মুরগি হাতে সালাম দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়, হতবাক সালাম উঠোনের নৃশংস দৃশ্যটি দেখে। দেখল। আমার পক্ষে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব হয় না আর, ইয়াসমিনকে ছাড়িয়ে আনতে ছুটে যাই, পারি না, আমার পিঠেও কিল পড়ে, আমার চৃুলেও শক্ত টান পড়ে। ইয়াসমিনের সারা শরীরে তখন দাদা আর হাসিনার শক্ত শক্ত লাথি। ইয়াসমিন কাঁদে না। ওর চোয়াল শক্ত হতে থাকে। আমি অসহায় বসে থাকি ইয়াসমিনের পাশে। আমাদের দুজনের গা ধুলোয় গড়াতে থাকে।
এই ঘটনার পর দাদা আর হাসিনার সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই।
মা বাড়ি এলে সব শুনে এ ঘর ও ঘর হাঁটেন, খামোকা হাঁটেন, বলতে বলতে, এর শইলডা হিংসায় ভরা। সুহৃদরে সহ্য করতে পারে না। কবে যেন বিষ খাওয়াইয়া ছেড়াডারে মাইরা ফেলব।
বাবা ঘটনা শুনে কোনও রা করলেন না।
বাবার চপু হয়ে থাকায় মা চেঁচিয়ে বলেন,মেয়ে দুইডারে যে ছেলে তার বউরে নিয়া মাইরা শেষ কইরা রাখল, সব শুইনাও কোনও কিছু করতাছেন না! ইয়াসমিন তো শইল নড়াইতে পারে না, হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙা থইছে মাইরা! আমি সুহৃদরে দিয়া দেই কামালের কাছে। এ হইল ওগোর শত্রু। ছেড়াডারে এই বাড়িতে পালা হইতাছে, এইডাই ওগোর সহ্য হয় না। আপনে থাকেন আপনার ছেলে আর ছেলের বউরে নিয়া। আমি কোথাও যাই গা। কী ছেলে জন্ম দিছিলাম রে খোদা, আপন বইনদেরে মারে, তাও আবার বউরে নিয়া।
বাবার নৈঃশব্দের মধ্যেও মা চেঁচান, নাসরিন ইয়াসমিন, তরা ছেলে দেখ, বিয়া টিয়া কইরা এই বাড়ি থেইকা তাড়াতাড়ি যা। বাপেও তার ছেলেরে আশকারা দিব তোদেরে মাইরা লুলা বানাইতে।
মার এসব কথার উত্তর কেউ দেয় না।
এর সাতদিন পর, গুমোট বাড়িটিতে দাদা জানিয়ে দিলেন যে তিনি বদলি হয়েছেন বগুড়ায়। বাবা দাদাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, বগুড়ায় কেন?
আমি কি জানি! কোম্পানী বদলি করল। দাদার উদাস উত্তর।
বগুড়া কোনও একটা জায়গা হইল যাওয়ার? বগুড়ায় কি আছে?
মহাস্থান গড় আছে।
মহাস্থানগড় দিয়া তুমি কি করবা?
বগুড়ার দই তো ভাল।
তা কি দই এর লোভে যাইতাছ নাকি?
বদলি হইছি বইলা যাইতাছি।
বাড়িঘর ফালাইয়া দূর দেশে কই থাকবা, কী খাইবা!
দাদা উঠে যান, বাবা বসেই থাকেন। মা তাড়া দেন, ভাত বাড়া আছে, খাইয়া লন।
বাবার সে রাতে আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। তিনি দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে থাকেন।
দাদার বদলি হওয়াতে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হয়েছে এ বাড়িতে, সে হল হাসিনা। হাসিনা গুনে গুনে কাচের বাসন, চামচ এসব বাক্সে ভরল। কালো ফটকের সামনে চেয়ার পেতে বসে পা নাড়তে নাড়তে, বাড়িতে যত আসবাব ছিল দাদার, হিশেব করে ট্রাকে তুলল। টেলিভিশনটিও।
দাদারা চলে যাবার পর ঘরগুলো হঠাৎ ন্যাংটো হয়ে গেল। এক কোণে পড়ে আছে রং ওঠা পুরোনো বেতের সোফা আর কয়েকটি ছালওঠা চেয়ার, দেয়ালে চৌকোনা দাগ, আর কটি বাঁকা তারকাঁটা।
প্রায়ই লক্ষ করি বারান্দায় একলা বসে থাকেন মা, সন্ধের দিকে। হু হু বাতাসের নাকি মার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে ঘরে, ঠিক বুঝি না। সন্ধেয় বাতি জ্বলে ঘরে ঘরে, মা বসেই থাকেন একা অন্ধকারে, মার হাতে তসবিহটি ঝুলে থাকে, নড়ে। ঘর ছেড়ে জড়ত্ব ঝেড়ে উঠোনে নেমে কোনও কারণ ছাড়া হাঁটতে থাকি এক সন্ধেয়।
মা, বাইরে বইসা রইছ কেন? ঘরে যাও।
মা শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলেন, নোমানডা রাগ কইরা বাড়ি থেইকা চইলা গেল! ঘরের ছেলে যদি ঘরে না থাকে তাইলে কি ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে!
নোমান নোমান কর কেন? আমরা আছি না? নাকি আমরা কেউ হই না তোমার!
মেয়েরা তো বিয়া হইলে পরের বাড়ি চইলা যায়।
আমি তেতো গলায় বলি, তোমার ছেলেরাই তো পরের বাড়ি গেছে গা। মেয়েরাই রইছে।
মেয়েরা আইজ আছে, কাইল নাই। মা বলেন।
তোমার ছেলেরা তো আইজও নাই। কাইল তো নাই ই।
মা চপু হয়ে যান।
বারান্দার কাপড় শুকোনোর দড়িতে দুহাত রেখে সামনে পেছনে দুলতে দুলতে উঠোনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলি, এত যে ছেলে ছেলে কর, দুইটা ছেলেই তো দূরে সইরা গেল।
হ সব গেল গা। এখন বউই তাদের কাছে আপন। বাপ মা ভাই বোন কিছু না। মা মিহি গলায় বলেন।
আমি ভেতরে ঢুকে যাই। শীতল নিস্তব্ধতা জুড়ে বসে থাকি। ইয়াসমিন পড়ে পড়ে ঘুমোয় কেবল। আনন্দমোহনে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু বাড়িতে বই পত্তরের কোনও খোঁজ নেই। দেবনাথ পণ্ডিতকে বাড়ি এসে ইয়াসমিনকে পড়াতে বলেছিলেন বাবা, তিনি রাজি হননি। রাজি হননি কারণ ছাত্রছাত্রীসংখ্যা এত বেশি তাঁর যে একা কারও জন্য তাঁর সময় দেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র তিনি গ্রুপে পড়াতে পারবেন। ইয়াসমিন দেবনাথ পণ্ডিতের বাড়িতে গ্রুপে পড়তে যায়, ফিরে এসে খাতা বই ছুঁড়ে দিয়ে বলে, কি পড়ায় কিচ্ছু বুঝি না! বাড়িতে বই নিয়ে বসার নাম গন্ধ নেই। নিথর বাড়িটিকে চমকে দিয়ে আমি চেঁচাই, ইয়াসমিন পড়তে ব। ইয়াসমিন পাশ ফেরে শোয়। আবারও চেঁচাই, ওঠ, পড়তে ব। ইয়াসমিন চেঁচিয়ে থামায় আমার চেঁচানো। ওর কি করতে হবে না হবে, ও নিজে ভাল বোঝে, কারও পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই। আমাকেও ও দূরে সরিয়ে রাখে। আমার সঙ্গী হয় একটি শাদা বেড়াল। একটি শাদা বেড়াল আমার সঙ্গী।শাদা একটি বেড়াল আমার সঙ্গী। সঙ্গী শাদা বেড়াল। বেড়ালই ভাল। মানুষের চেয়ে সহস্রগুণ ভাল। বেড়ালটিকে আমি বুকে জড়িয়ে বসে থাকি। এ বাড়িতে নর্দমার ফাঁক গলে অথবা পাঁচিল পেরিয়ে বেড়াল আসে, বেড়ালেরা তক্কে তক্কে থাকে সুযোগ বুঝে রান্নাঘরে ঢুকে পাতিলে মখু দেয়। যে বেড়ালই আসে, মা তাড়িয়ে দেন। সব বেড়াল নাকি চোরা বিলাই। তাড়ালে চলে যায়, আবার আসে। এই শাদা বেড়ালটি যখন এসেছিল, একেও তাড়ানো হয়েছিল, কালো ফটকের ওপারে নর্দমায় ফেলে আসা হয়েছে, বেড়ালটি পরিষ্কার হয়ে এ বাড়িতে চলে এসেছে আবার। শেষে বেড়ালটিকে নিয়ে নতুনবাজারের কাঁচাবাজারের জটলায় ফেলে আসা হল, পরদিন দেখি উঠোনের রোদে বেড়ালটি শুয়ে আছে। এবার বাবার আদেশ, একে বস্তায় পুরে নদীর ওপারে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। তাই করা হল। সালাম একটি বস্তায় বেড়ালটিকে পুরে বস্তার মখু দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নৌকো ভাড়া করে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গিয়ে কাঁটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এল। বাড়িতে সকলে জানে, বেড়াল আর ফিরবে না, কোনও কারণ নেই ফেরার। সাতদিন পার হয়েছে, বেড়ালের কথা ভুলেই গেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ দেখি বেড়ালটি বিকেলবেলা কালো ফটকের সামনে সজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে, আমি আয় আয় বলে ডাকতেই দৌড়ে ও চলে এল আমার কাছে। রান্নাঘরে নিয়ে পাতিলের তলায় যেটুকু ভাত ছিল দিই। হাভাতের মত খেয়ে বেড়ালটি আমার পেছন পেছন, যেখানেই যাই, যেতে লাগল। সেই থেকে এ বেড়ালটিকে আমি আর কাউকে দিই না কোথাও ফেলে আসতে। থেকে গেছে এ বাড়িতে, রাতে বিছানায় আমার পায়ের কাছে ঘুমোয়। চেয়ারে বসলে লাফিয়ে আমার কোলের ওপর এসে বসে। বেড়ালটি ভাত আর মাছের কাঁটাকুটো খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে এ বাড়িতে। আমি খেয়ে পাতে সামান্য রেখে দিই বেড়ালটির জন্য। মাকে লুকিয়ে আমার নিজের ভাগের মাছের টুকরো থেকে কিছুটা ওর ভাতে মিশিয়ে দিয়ে দিই। বেড়ালটিকে বুকে জড়িয়ে আমি বসে আছি আমার ঘরে। অন্য ঘরে, যেটি একসময় ছোটদার ঘর ছিল, অসময়ে ইয়াসমিন ঘুমোচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে আবার ঘুমোবে সে। যেন ঘুমের মত এত সুখের জিনিস পৃথিবীতে আর নেই। ওর ঘাড়ের হাড়ে ব্যথা, পিঠের হাড়ে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা। দাদা আর হাসিনার নৃশংসতা ওকে এই অসখু গুলো দিয়েছে। ইয়াসমিনকে নিয়ে হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। মেডিসিনের অধ্যাপক প্রভাকর পুরকায়স্থকে দেখিয়েছি, তিনি ওর বুকে স্টেথোসকোপ বসাতে গিয়ে বারবারই চাপ দিচ্ছিলেন স্তনে। ও প্রভাকরের ঘর থেকে মুখে বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসে। এরপর ওর হাঁটুর ব্যথা এমনই তীব্র হয়ে উংল যে হাঁটু নিয়ে ও আর উঠতে বসতে পারছিল না। সেই হাঁটু পরীক্ষা করতে দাড়িঅলা হারুনুর রশিদ খানের কাছে যাই, তিনি হাড়ের ডাক্তার, কেবল ডাক্তার নন, রীতিমত অস্থিবিদ্যা-বিভাগের প্রধান। ইয়া লম্বা দাড়ি মুখে, মাথায় টুপি, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। কোনও অধ্যাপককে এই লেবাসে দেখে অভ্যেস নেই আমার। লেবাস যেমনই হোক, ডাক্তার ভাল তিনি। আমাকে চেনেন তিনি, আমার বাবাকেও। বাবা যখন হাসপাতালে ছিলেন, বাবাকে একটি তাবিজ দিয়ে এসেছিলেন বালিশের নিচে রাখতে। ওটি নাকি অসখুৃ ভাল করার ওষধু ।সেই ফর্সা লম্বা দাড়িঅলা ভাল ডাক্তার অস্থিরোগ চিকিৎসায় এক নম্বর তাবিজ কবজে আল্লাহ রসুলে বিশ্বাসী ইয়াসমিনকে তাঁর চেম্বারের রোগি দেখার টেবিলে শুইয়ে দিয়ে পর্দা ঢেকে দিয়ে ওর হাঁটু টিপতে টিপতে হাঁটু থেকে হাত ওপরে নিতে নিতে তলপেট -পেট টিপে টিপে বুকে গেলেন। বুক টিপে বাইরে থেকে ফুসফুস বা হৃদপিণ্ডের অস্তিত্ব বুঝতে চাইলেন কি!ইয়াসমিন বের হয়ে আমাকে শুধু বলল, আমারে আর কোনওদিন কোনও ডাক্তারের কাছে নিও না। আমার অসখু ভাল হওয়ার দরকার নাই। আমার অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে হারুনুর রশিদ খানের কাছে জিজ্ঞেস করি, আমার বোনের হাঁটু পরীক্ষা করার কথা ছিল আপনার, বুক পরীক্ষা করার নয়। বুকে কি ছিল পরীক্ষা করার? ইচ্ছে হয়েছে প্রভাকর পুরকায়স্থকে বলি, আপনার তো কোনও পারকিনসনস রোগ হয়নি যে বুকে স্টেথেসকোপ বসালে হাত বার বার সরে যায় চাকতি থেকে! ইচ্ছে হয়েছে, পারিনি। গলার কাছে শব্দগুলো কষ্ট হয়ে বিধঁ ছিল, বেরোতে পারেনি।
মা তখনও বাইরের অন্ধকারে, মার হাতের তসবিহ নড়ছে না।