১০. কনে দেখা

কনে দেখা

চাকরি নেওয়ার পর থেকে দাদা অবকাশের চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টো ফেলতে শুরু করেছেন। বৈঠকঘর থেকে বেতের সোফা বিদেয় করে নরম গদিঅলা কাঠের সোফা বসিয়েছেন। চার পাঅলা একটি টেলিভিশন কিনে বৈঠকঘরে বসিয়েছেন। বিশাল সেগুন কাঠের পালঙ্ক বানিয়ে আনলেন অভিনব এক হেডবোর্ড সহ, আঙুর গাছের তলে পুরুষ রমণী উলঙ্গ শুয়ে আছে। হেডবোর্ডের দুপাশে আবার ছোটছোট নকশাকাটা ড্রয়ার। এক একটি আসবাব আসে বাড়িতে আর আমরা দূর থেকে কাছ থেকে ছুঁয়ে না ছুঁয়ে দেখি। আয়নার টেবিলও আনলেন, সেটিও বিশাল, নানারকম নকশা অলা। সিংহের পা অলা দশজনে বসে খাবার এক খাবার টেবিল আনলেন। আবার থালবাসন রাখার জন্য আলমারি আনলেন, সেও বিশাল, সামনে কাচ লাগানো। এতসব আজদাহা আসবাবে এমন হল, যে, ঘরে হাঁটার জায়গা রইল না। দাদা খুব গর্ব করে জানিয়ে দিলেন, সব ফার্নিচার সেগুন কাঠের, আর আমার দেওয়া ডিজাইন। লোকেরা, যারাই বাড়িতে আসে, চোখে বিস্ময় নিয়ে দাদার আসবাব দেখে যায়। এরকম আসবাব আর কোথাও তারা দেখেনি। নিজে নকশা এঁকে একটি সবুজ রঙের ইস্পাতি আলমারিও বানালেন, তাঁর সবচেয়ে আনন্দ, এরকম আর অন্য কারও বাড়িতে নেই।

তা ঠিকই, নেই। বৈঠকঘরের সামনের ঘরটি দাদা বানালেন তাঁর আপিসঘর, একটি ড্রয়ারঅলা টেবিল পাতলেন;ফাইসন্স কোম্পানির যাবতীয় কাগজপত্র, ওষুধের ব্যাগ, সব সাজিয়ে রাখলেন সে টেবিলে।

এত আসবাব বানানোর মূল কারণটি হল দাদা বিয়ে করবেন। বউ আসবে, একটি গোছানো বাড়ি পাবে অর্থাৎ তৈরি সংসার পাবে। দামি দামি কাচের বাসনপত্র কিনে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছেন, চাবি তাঁর পকেটে।

আত্মীয় স্বজনরা ঘুরে ঘুরে দাদার সাজানো ঘরদোর দেখে বলে যান নোমানের তো সবই হইল, এইবার একটা বউ হইলেই হয়।

 

বিয়ে করবেন বলে প্রায় কয়েক বছর থেকে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছেন দাদা। মেয়ে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু কোনও মেয়েকে পছন্দ হচ্ছে না। বিভিন্ন বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসে, অথবা প্রস্তাব পাঠানো হয়, তিনি আত্মীয় বা বন্ধু সঙ্গে নিয়ে মেয়ে দেখে আসেন, যাবার সময় প্রতিবারই এলাহি কাণ্ড ঘটান, ঘন্টাখানিক সময় নিয়ে পুরো-সাবান খর্চা করে স্নান করেন, স্নান সেরে অসম্ভব বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে মুখে পনডস ক্রিম আর পাউডার মাখেন, হাতে পায়ে জলপাই-তেল আর শরীরের আনাচ কানাচে তো আছেই, বুকে পেটে পিঠে, হাতের নাগালে শরীরের যা কিছু পান, মোটেও কাপর্ণ্য না করে সগু ন্ধী ঢালেন। এমনিতে সগু ন্ধীর ব্যাপারে দাদা বেশ হিশেব করে চলেন, বাড়িতে এক দাদারই সগু ন্ধীর আড়ত, মাঝে মাঝে কোথাও বেড়াতে যাবার আগে, দাদা একটু সেন্ট দিবা? যদি বলি, প্রথম বলে দেন, নাই। গাঁই গুঁই করলে কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি ইত্যাদি সব প্রশ্ন করেন, উত্তর পছন্দ হলে তিনি তার ঘরের গোপন এক জায়গা থেকে সগু ন্ধীর শিশি বের করে বারবার বলেন এইটা হইল আর্থমেটিক, বা এইটা হইল ইন্টিমেট, মেইড ইন ফ্রান্স, মেইড ইনটা দাদা বলবেনই, তারপর এক ফোঁটা মত কিছু দিয়ে বলবেন ইস অনেকটা পইড়া গেল!

কি দিলা দেখলামই না তো!

আরে ওইটুকুর মধ্যেই তো দুইশ টাকা চইলা গেছে।

দাদা বাড়ি না থাকলে খুঁজে ওই গোপন জায়গায়, জুতোর ভেতর, সুগন্ধীর শিশি আর পাইনি, নতুন জায়গায় শিশি রেখেছেন লুকিয়ে, মা-বেড়াল যেমন বাচ্চা-বেড়ালের ঘাড়ে কামড় দিয়ে জায়গা বদলায়, দাদাও তেমন সগু ন্ধীর শিশির জায়গা বদলান। যাই হোক, প্রচুর সময় নিয়ে সাজগোজ করে, আয়নার সামনে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেন দাদা। আমাদের জিজ্ঞেস করেন কী, সুন্দর লাগতাছে না! আমরা একবাক্যে বলি, নিশ্চয়ই। নিঃসন্দেহে সুন্দর দেখতে দাদা, চুল যেমন ঘন কালো, নাক টিকলো, বড় বড় চোখ, চোখের পাপড়ি, দৈঘের্ প্রস্থে রীতিমত সপুুরুষ। চকচকে জুতো পায়ে, গরমকালেও স্যুট টাইপরা দাদা চমৎকার হাসি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন মেয়ে দেখতে আর প্রতিবারই ফেরেন মলিন মখু করে। প্রতিবারই পকেটের সোনার আংটি পকেটেই থাকে, কাউকে আর দেওয়া হয় না।

কী দাদা, মেয়ে কেমন দেখলা? জিজ্ঞেস করি।

দাদা নাক কুঁচকে বলেন আরে ধুর!

প্রতিবারই তিনি বাড়ির সবাইকে বৈঠকখানায় বসিয়ে দেখে আসা মেয়ের খুঁত বর্ণনা করেন।

 

বাবা একবার দাদাকে পাঠালেন তাঁর এক চেনা লোকের মেয়েকে দেখে আসতে। দাদা দেখেও এলেন। বাবা বাড়ি ফিরে দাদাকে নিয়ে বসলেন, মেয়ে পছন্দ হইছে?

দাদা সঙ্গে সঙ্গে মুখের যা কিছু কোঁচকানোর আছে কুঁচকে বললেন না।

কারণ কি? মেয়ে ত শিক্ষিত !

হ শিক্ষিত।

বি এ পাশ করছে!

তা করছে।

মেয়ে ফর্সা না দেখতে?

হ ফর্সা।

চুল লম্বা না?

হ।

মেয়ে তো খাটো না!

না খাটো না।

বাবা এডভোকেট।

হ।

বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিল ত অনেকদিন।

হ।

শহরে দুইডা বাড়ি!

হ।

ভাল বংশ।

হ।

মেয়ের কাকারা তো সব ভাল চাকরি করে। একজন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার।

হ।

মেয়ের ফুপাতো একটা ভাই ত লন্ডনে থাকে।

হ।

মুরব্বি কারা কারা ছিল?

মেয়ের ভাই ছিল, বাবা ছিল।

বড় ভাই না ছোট ভাই?

বড় ভাই।

বড় ভাই তো বিয়া করছে কয়দিন আগে, খুব বড়লোকের মেয়েরে বিয়া করছে।

মেয়ের বাবা ডিস্ট্রিক জাজ ছিল।

হ।

ওদের বাড়িঘরের অবস্থা নিশ্চয়ই ভাল।

হ ভাল। ড্রইংরুমে দামি সোফা টোফা আছে।

টেলিভিশন আছে তো!

হ।

কি খাওয়াইল?

তিন রকমের মিষ্টি খাওয়াইল, চা খাওয়াইল।

মেয়ের কথাবার্তা কেমন? আচার ব্যবহার?

তা ভাল।

ভদ্র তো!

হ ভদ্র।

শান্তশিষ্ট মেয়ে!

হ।

তাইলে পছন্দ হইল না কেন?

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু

কিন্তু কি?

ঠোঁটটা…

ঠোঁটটা মানে?

নিচের ঠোঁটটা চ্যাপ্টা না, উঁচা। উঁচা ঠোঁটের মেয়েদের আমার দুইচোখখে দেখতে ইচ্ছা করে না।

হুম।

 

দাদার জন্য চ্যাপ্টা ঠোঁটের মেয়ে দেখা শুরু হল। একটি মেয়ের খবর এল, টাঙ্গাইলে বাড়ি, তার বোনের বাড়ি ময়মনসিংহ, আমাদের পাড়াতেই। মেয়েকে টাঙ্গাইল থেকে বোনের বাড়ি আনানো হল। কনে দেখার দিন তারিখ ঠিক হল। দাদা যথারীতি সেজে গুজে আমাকে আর ইয়াসমিনকে নিয়ে ও বাড়িতে গেলেন। মেয়ের বোন দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে বসালেন। কিছু টুকটাক কথাও বললেন, যেমন, তুমি তো এবার মেডিকেলে ভর্তি হলে, তাই না?

তোমার নাম কি?

ইয়াসমিন! আমার ভাইঝির নামও ইয়াসমিন।

আমার মেয়েও তো বিদ্যাময়ী ইশকুলে পড়ে,ও আজকে ওর মামার বাড়ি গেছে।

আজকাল গরমও পড়েছে খুব, এই গরমে রাত্রে আবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাচ্ছে!

আচ্ছা কী খাবেন বলেন, চা না ঠাণ্ডা?

এধরনের অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যাপারটি ঘটল, ট্রেতে চা বিস্কুট নিয়ে ডানো ঢুকল ঘরে। অপলক তিনজোড়া চোখ ডানোর দিকে। ডানো অপ্রস্তুত হেসে বসল একটি চেয়ারে। চা খাওয়া হচ্ছে, এবং সঙ্গে চলছে অপ্রয়োজনীয় কথা।

টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী কলেজ আর আগের মত নাই, একসময় খুব নাম ছিল।

পোড়াবাড়ির চমচমএর সাইজ আগের চেয়ে ছোট করে ফেলল, আবার দামও বাড়ায়ে দিল!

ডানো খুব কাজের মেয়ে, আমার বাসায় আসলে তো ও-ই সব কাজ করে।

বাড়িঘর গোছানো, রান্নাবান্না, সব ও করে, আবার বাগান করারও শখ আছে। নিজের জামাকাপড় নিজেই শেলাই করে, দরজির কাছে দেয় না।

টাঙাইলে কাদের সিদ্দিকীর বাড়িটা চেনেন, কাছেই নাথবাবুর বাড়ি, ওইখানে আমি মাসে একবার যাই।

ও বাড়ি থেকে হেসে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরোতেই দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী, পছন্দ হইছে?

দাদার নাক চোখ ঠোঁটের দিকে দুজোড়া চোখ।

চোখগুলা সুন্দর। ইয়াসমিন বলল।

ঠোঁট তো চ্যাপ্টাই। আমি বললাম।

দাদার নাক কুঁচকোলো এবার, বেশি চ্যাপ্টা।

বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হল, ঠোঁট বেশি চ্যাপ্টার কারণে ডানোকে দাদার পছন্দ হয়নি।

মাস কয় পর খবর এল, ডানোর সঙ্গে টাঙ্গাইলের নামী মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর বিয়ে হয়ে গেছে।

শুনে দাদাকে বললাম, ইস কি মিসটা করলা, ওরে বিয়া করলেই পারতা!

দাদা বললেন ভাগ্যিস করি নাই। ওর সাথে নিশ্চয় কাদের সিদ্দিকীর প্রেম ট্রেম ছিল।

 

এমনিতে কোনও সুন্দরী মেয়ের বিয়ের খবর শুনলে দাদার মন খারাপ হয়ে যায়, আহা আহা করেন, যেন হাতের নাগাল থেকে চমৎকার লেজঅলা পাখিটি চকিতে উড়ে গেল। দিলরুবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দাদা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, মেয়েডা একেবারে শীলার ট্রু কপি ছিল।

ছিল কি !এখনও তো শীলার ট্রু কপি।

বিয়া হইয়া গেছে তো!এখন থাকলেই কি ..

হুম।

ওর একটা বইন আছে না? লতা! লতাও কিন্তু সুন্দরী ছিল।

ছিল কি এখনও সুন্দরী।

আচ্ছা লতারে প্রস্তাব পাঠানো যায় না?

কিন্তু ও তো তোমার অনেক ছোট।

তা অবশ্য ঠিক।

আর লতার সাথে শুনছি কার নাকি প্রেমও আছে।

তাইলে বাদ দে!

ময়মনসিংহ শহরে যত সুন্দরী আছে, কলেজে পড়ছে বা আইএ বিএ পাশ করেছে, সবাইকে এক এক করে দাদার দেখা হয়ে গেছে, কিন্তু কাউকে পছন্দ হয়নি। এবার ঝুনু খালা বললেন চল ঢাকায় মেয়ে দেখাই, একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইল এইবার।

ওর বাড়ি কুমিল্লা, বাবা কলেজের প্রফেসর। রুনুখালা আরও খবর দেন।

মেয়েটা আমার খুব ভক্ত, সারাক্ষণই ঝুনু আপা ঝুনু আপা করে। রোকেয়া হলে, আমার পাশের রুমে থাকে।

দেঁতো হেসে রুনুখালা বললেন।

সুন্দরী কি না কও। দাদার প্রশ্ন।

খুব সুন্দরী।

দাদার পা ডানে বামে নড়তে থাকে দ্রুত।

ঠোঁট চ্যাপ্টা তো!

হ চ্যাপ্টা।

বেশি চ্যাপ্টা না তো আবার?

না বেশি চ্যাপ্টা না।

ঠিক হল, ঢাকার নিউমার্কেটে এক আইসক্রিমের দোকানে লাভলি আর তার এক বান্ধবী বসে থাকবে, দাদা দূর থেকে দেখবেন। দাদার পছন্দ হলে পরে আরও এগোনো হবে। দাদা ঢাকা গিয়ে নিউমার্কেটে হাঁটাহাঁটি করে সময় মত আইসক্রিমের দোকানের সামনে গেলেন, মেয়ে দেখলেন। ঝুনু খালাকে চোখটা ট্যারা মনে হইল বলে ময়মনসিংহে ফিরে এলেন।

ময়মনসিংহের আশেপাশের শহর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোনা সবখানেই দাদা মেয়ে দেখতে গিয়েছেন। মুখ মলিন করে ফিরে এসেছেন। এরপর সিলেট! সিলেটে যাবেন মেয়ে দেখতে। প্রস্তাবটি এসেছে দাদার সঙ্গে এক লোক চাকরি করে, তার থেকে। সিলেটে আমিও যাব বলে গোঁ ধরলাম, গোঁ এ কাজ হল। দাদা আমাকে নিয়ে সিলেট রওনা হলেন। সারা ট্রেনে বলতে বলতে গেলেন, সিলেটের মেয়েরা কিন্তু খুব সুন্দরী হয়।

আমি বললাম, ফটোতে তো মেয়েরে সুন্দরীই মনে হইতাছে।

তা মনে হইতাছে। ফটোতে সব খুঁত কিন্তু ধরা পড়ে না।

 

সিলেটের দরগা রোডে ফাইসন্স কোম্পানীর সপুারভাইজার মুনির আহমেদএর বাড়ি উঠলাম রাতে। বিশাল বাগানঅলা সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই আমাকে অস্থিরতায় পায়। দাদা চল শহরটা ঘুইরা দেখি।

দাদার তখন শহর ঘুরে দেখায় মন নেই। মেয়ের ফটোটি বারবারই বুক পকেট থেকে বের করে কড়া আলোর তলে ফেলে দেখেন, আমাকেও দেখতে দেন ফটো, বলেন তর কি মনে হয়, আবার ভাল কইরা দেখ তো!

বলি দেখছিই তো কত বার!

আবার দেখ। বারে বারে দেখলে কিছু একটা ধরা পড়ে।

ধৎু । সিলেটে আইলাম কি বাসায় বইসা থাকতে! চল না একটু ঘরু তে যাই!

তর ধৈর্যশক্তিটা একটু কমই নাসরিন। দাদা বেজার হয়ে বলেন।

এত দূর জানির্ কইরা আইছি। শরীরে ধূলাবালি ভর্তি। গোসল টোসল করতে হইব।

কি হইব গোসল না করলে? আইসা কইর।

নাক টাক তো ঠিকই আছে কি কস! ফটোর দিকে চোখ দাদার।

আমি জানালায় বসে যতটুকু দেখা যায় বাইরেটা, দেখতে থাকি।একাই যদি বেরিয়ে পড়তে পারতাম শহরটিতে! রিক্সা নিয়ে ঘুরে ঘুরে একাই যদি দেখতে পারতাম সব!

পরদিন মেয়ে দেখা হল। মেয়ের বাবা পুলিশ অফিসার, মেয়ে বিএ পাশ।

সবই ভাল,হেভি ফর্সা মেয়ে, কিন্তু…সামনের দাঁত দুইটা একটু উঁচা। ব্যস। মেয়ে নাকচ করে দিয়ে দাদা আমাকে নিয়ে শাহজালালের মাজার দেখতে গেলেন। মাজার দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ইচ্ছে ছিল না, তারচেয়ে শহরময় হুডফেলা রিক্সায় ঘুরে শহরের স্বভাব চরিত্র জানতে পারলে আমার আনন্দ হত।

মাজারে হাজার হাজার লোক গিজগিজ করছে। পুকুরের কিনারে দাঁড়িয়ে লোকেরা কালো কালো মাছকে খাবার দিচ্ছে, মাছগুলো শরীর ভাসিয়ে খাবারগুলো মুখে নিয়ে জলে ডুব দিচ্ছে আবার! বাহ! দাদা বললেন এই মাছগুলারে খাবার দেয় কেন মানুষ জানস? খাবার দিলে নাকি সওয়ার হয়। হযরত শাহজালাল নিজে আল্লাহর কাছে খাবারদেনেঅলা লোকদের জন্য বেহেসতের তদবির করেন।

এরপর দাদা তাঁর জুতো খুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন জুতাগুলা লইয়া এইখানে দাঁড়া, আমি মাজারের ভেতরটায় যাইয়া দেইখা আসি। শাহজালালের কবর ওইখানটায়। আমারেও নিয়া যাও।

না, ওইখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ।

উঁচু সেই কবরঘরে দাদা একা গেলেন, আমি ঘরটির দিকে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, মেয়েরা ওখানে গেলে অসুবিধেটা কোথায় হয়, কার হয়!

ট্রেনে করে ময়মনসিংহে ফেরার সময়, দাদাকে বললাম তাইলে সিলেটের মেয়েরেও তোমার পছন্দ হইল না।

দাদা বললেন সিলেটের মেয়েরা এমনিতে সুন্দরই হয়।

তাইলে পছন্দ হইল না কেন?

পছন্দ হইছে।

তাইলে যে কইলা দাঁত উঁচা।

আরে ওই দাঁতালরে না তো!

তাইলে কারে?

মুনির ভাইএর বউরে।

কও কি!

ঠোঁটগুলা দেখছস! ওই রকমের ঠোঁট চাইতাছিলাম আমি।

তারে তুমি বিয়া করবা? চোখ কপালে তুলে বলি।

বিয়া করব কেমনে? সে ত অলরেডি ম্যারেড!

দাদা অনেকক্ষণ জানালায় উদাস তাকিয়ে থেকে ফস করে বললেন, ঠোঁটের ওপরের তিলটা দেখছস?

কার ঠোঁটের ওপরে?

মুনির ভাইএর বউএর।

তুমি তো দেখতে আইছিলা পুলিশ অফিসারের মেয়েটারে। তার তিলের কথা কও।

তার ত একটা তিল আছে গালে।

দেখিও নাই তার গালের তিল। উঁচা দাঁতের মেয়েদের দিকে আসলে বেশিক্ষণ তাকাইতে হয় না। চোখ টনটন করে।

 

নামের ব্যাপারেও দাদার আসক্তি কাজ করে। একবার এক মেয়েকে প্রস্তাব পাঠানো হল, কারণ দাদা জেনেছেন মেয়ের নাম নীলাঞ্জনা। নীলাঞ্জনাকে দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল।

এই মেয়ে সুন্দরী না হইয়া যায় না।

কি কইরা বুঝলা যে সে সুন্দরী?

এত সুন্দর নাম যার, সে কি দেখতে খারাপ হইতে পারে!

নীলাঞ্জনাকে দেখে এসে অবশ্য দাদা সারাদিন ছি ছি ই করলেন। মাজেদা নামের এক মেয়ে, যদিও খুবই সুন্দরী, দাদা নাম শুনেই নাকচ করে দিলেন, দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা। তাঁর বক্তব্য, মাজেদা নাম শুনলেই আমার বমি আসে। এত বাজে নামের মেয়েদের সুন্দরী হওয়ার কোনও কারণই নাই।

আমরা,বাড়ির লোকেরা, দাদার বিয়ের আশা অনেকটা ছেড়েই দিই। একজনই আশা ছাড়েন নি, তিনি দাদা নিজে। তাঁর গভীর বিশ্বাস, দেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে তিনি অচিরে বিয়ে করছেন।

বিশ্বাসটুকু আছে বলেই তিনি দিব্যি স্ফূর্তিতে জীবন কাটাতে থাকেন। গানের একটি যন ্ত্র কিনেছেন। আগের গানের যন্ত্রটি মেইড ইন রাশিয়া, যেটি তিনি উদয়ন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন, বাবার ঘরে ছিল, সে ঘর থেকে, এক রাতে বাবা ছিলেন না বাড়িতে, ঘর বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল, তাই করতেন তিনি, দরজায় তালা লাগিয়ে বাইরে বেরোতেন, জানালার শিক ভেঙে ঢুকে যা যন্ত্রপাতি ছিল চোর নিয়ে গেছে, সেই বিশাল গানের যন ্ত্র মেইড ইন জার্মানি, ছোটদা সারাই করতে নিয়ে পরে যেটি সারাই ছাড়াই ফেরত দিয়েছিলেন, সেটিও। বড়মামা বলেছিলেন দাদাকে উদয়ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, প্রতিযোগিতায় যে প্রশ্ন তার উত্তরও তিনি একরকম বলে দিয়েছিলেন দাদাকে, বলেছিলেন ঘুণাক্ষরেও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের কাউকে না জানাতে যে দাদা তাঁর কেউ হন। প্রথম পুরস্কার মস্কো ভ্রমণ, দ্বিতীয় পুরস্কার গানের যন,্ত্র তৃতীয় পুরস্কার ক্যামেরা। বড়মামার প্রভাব কতটুকু খেটেছিল তা কেউ জানে না, কিন্তু দাদা দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে মহানন্দে গানের যন্ত্রটি বগলদাবা করে বাড়ি এনে রাজ্যির গানের ক্যাসেট কিনে সেসব শুনতে শুরু করে দিলেন। তখনও দাদা হেমন,্ত মান্না, সন্ধ্যা, সতীনাথ থেকে বের না হওয়া মানুষ। চুরি হওয়ার পর অনেকদিন গানহীন ছিল বাড়ি। নতুন যন ্ত্র কেনার পর দাদা ঢাকা থেকে পছন্দ করে গানের ক্যাসেট নিয়ে এলেন। এবার ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুল গীতি। ফিরোজার প্রেমে উতলা হয়ে তিনি নিজে ফিরোজার আরও গানে মন দিলেন। গানের যন্ত্রের শব্দ বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের কাছে ডাকেন, বেসুরো গলায় ফিরোজার সঙ্গে গাইতে থাকেন নিজে আর থেকে থেকেই আবেগের আহা আহা। কমল দাশগুপ্তর জন্য ফিরোজার ভালবাসার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে ….বইলা কি টানটা দিছে দেখ। কমল দাশগুপ্ত যেদিন মারা গেল, তার কফিনের সামনে বইসা এই গানটা গাইছিল ফিরোজা। গানটি শুনতে শুনতে দাদার চোখ বারবার ভিজে ওঠে।

গানের মোহ দাদার সামান্য দূর হয় যখন তিনি ভিসিআর নামের একটি যন ্ত্র অমৃতর দোকান থেকে ভাড়া আনলেন। এরপর প্রায়ই এক রাত কি দুরাতের জন্য ভিসিআর ভাড়া এনে যত হিন্দি ছবি আছে বাজারে, দেখতে শুরু করে দেন দাদা। অমৃত গোলপুকুরপাড়ে নতুন একটি ভিডিও ক্যাসেটের দোকান শুরু করেছে, বড় দেখতে-সুন্দর ছেলে, জ্যোতির্ময় দত্তের সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করবে করবে করছে। ব্যবসায় কড়া সবুজ বাতি জ্বলছে অমৃতর। ময়মনসিংহে যখন প্রথম দুএকটি ভিসিআর এসেছিল, বিষয়টি ছিল আহামরি উত্তেজনার, কোনও কোনও অন্ধকার সিঁড়ি আর দরজাজানলাবন্ধকরা বাড়িতে মোটা টাকায় টিকিট বিক্রি করে সারারাত হিন্দি ছবি দেখানো হত। ছোটদা আমাকে একবার তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ভিসিআরএ ছবি দেখাতে। ঝিরঝির করা ছবি চোখের সামনে নিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকা আমার সম্ভব হয়নি। ছবি শেষ না করেই বাড়ি ফিরেছি। সেই আমার প্রথম ভিসিআরএ চোখে-খড়ি। এরপর যন্ত্র ভাড়া করে ছবি দেখতে দেখতে দাদা যখন হিন্দি ছবির উত্তেজনায় একটি যন্ত্র কিনেই ফেলেন আর রাত জেগে দিন জেগে দেখা কেবল নয় ছবি গিলতে শুরু করেন, প্রথম প্রথম সামনে বসেছি। কিন্তু দিন দিন আশ্চর্য ধর্মেন্দ্রর জন্য ঘোড়া কে রাখল এই ফাঁকা মাঠে? একটু আগে তো কোনও ঘোড়া ছিল না! হেমামালিনী হঠাৎ লাফ দিয়া গান শুরু কইরা দিল কেন? গান কি কোনও মানুষ এইভাবে রাস্তায় নাচতে নাচতে গায়? মন্তব্যের মাছি বাড়ির অন্য দর্শকদের নিমগ্নতার দিকে ভনভন করে উড়ে যেতে থাকে। আজগুবি মারদাঙ্গা ছবি দেখার কোনও রুচি আমার হয়নি। কিন্তু দাদা,ছবি যেরকমই হোক, পাছায় জিগাইরা আঠা লাগাইয়া বসে থাকেন সামনে। বরং বেছে বেছে যেখানে মারামারি নেই, আজগুবি গল্প নেই, হাস্যকর অবাস্তবতা নেই সেরকম ছবি আমি দেখি। অমিতাভ রেখা আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। তারও চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে শাবানা আজমি স্মিতা পাতিল নাসিরুদ্দিন শাহ। দাদা আমার রুচির দিকে অবজ্ঞা ছুঁড়ে বলেন, আইন্ধার ছবিগুলা আর আনিস না। বস্তির জীবন আমরা প্রত্যেকদিনই দেখতাছি, পর্দায় দেহনের কোনও মানে নাই। আন্ধাইর ছবি ছাড়া অন্য যে কোনও গল্পের যে কোনও পরিচালকের যে কোনও শিল্পীর যে কোনও ছবি দেখতে দেখতে দাদা একদিন একটি ছবির জালে পুঁটি মাছের মত আটকা পড়লেন। ছবিটির নাম মোগল ই আযম। মোগল ই আযমের প্রেমে অনেকটা উন্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। ছবিটি ননস্টপ চলতে লাগল। সংলাপ তিনি মখু স্থ আওড়াতে লাগলেন। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ছবিটি একাধিক বার দেখালেন, নানিবাড়ি থেকে নানিকে, হাশেমমামাকে, পারুলমামিকে, এমনকি টুটুমামা আর শরাফমামাকে ডেকে এনেও দেখালেন। ছবি চলাকালীন দাদা বাংলায় বর্ণনা করেন কি ঘটছে, কে কি বলছে, যদিও হিন্দি সকলেই জানে, তারপরও দাদা অনুবাদ করেন, আর থেকে থেকে আহা আহা উহ উহ। হাশেমমামা পুরোনো ছবির খুব ভক্ত। ছোটবেলার দেখা হিন্দি আর উদর্ু ছবির গান তিনি ফাঁক পেলেই গেয়ে বেড়ান। টেনে হিঁচড়েও ফজলিখালাকে ছবিটির সামনে বসাতে পারেননি দাদা। ফজলিখালা টেলিভিশনের দিকে তাকান না গুনাহ হবে বলে। মা ছবি পেলে গুনাহর কথা ভুলে যান। মোগল ই আযম দেখার লোভ সংবরণ করা মার জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে বলে তিনি আল্লাহ এবং তাঁর আদেশ নির্দেশ আপাতত বালিশের তলে চাপা দিয়ে এসে ছবি দেখে নিয়ে আসর বা এশার নামাজের পর মোনাজাতের হাত তুলে নিজের গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। আল্লাহর অসীম দয়া, তিনি ক্ষমা করেন তাঁর সন্তপ্ত বান্দাদের, মা জানেন।

বাড়িতে যে অতিথিই আসে, চা বিস্কুটএর বদলে দাদা মোগল ই আযম দিয়ে আপ্যায়ন করা শুরু করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *