সংসার ধর্ম
হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এক বছর, না কম না বেশি। বছর শেষ হলে ঢাকায় পাকাপাকি ভাবে নিজের সংসারে ফিরব এরকমই কথা রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্রও মোংলা মিঠেখালির পাট চুকিয়ে ঢাকায় ফিরবে। শুরু হবে সংসার আমাদের। কোনও ছেদ না পড়া সংসার। পাকাপাকির আগেই অবশ্য নানা ছুতোয় আমার ঢাকা যাওয়া হতে থাকে, রুটিনে এক মাস গ্রাম পড়ল তো ঢাকা যাও, পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল তো ঢাকা যাও। ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙে টুকরো হয়নি, সামান্য ফেটেছে, ওটুকুর জন্যই হাড়ের ডাক্তার প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়ে বললেন, পুরো এক মাস। স্ত্রীরোগপ্রসুতিবিদ্যা বিভাগে তখনও আমার ডিউটি শেষ হয়নি, অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন, গলার দড়িতে নব্বই ডিগ্রি কোণে ঝুলে থাকা হাত দেখেই বললেন, ভাঙলা? হুম, ভাল একটা কারণ জুটে গেল ফাঁকি মারার, কি বল? না, জোবায়েদ হোসেন এটি ঠিক বলেননি। ডিউটিতে ফাঁকি মারার গোপন কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না।
হাত ভাঙা তো গা-গরম হওয়া বা খুসুখসে কাশির মত নয়, রীতিমত বড় একটি ঘটনা, এই ঘটনায় নিদ্বির্ধায় প্রশিক্ষণ কামাই করা যায়, বাঘ হয়েও জোবায়েদ হোসেন মেনেছেন, আমি না মানার কে! মা দুদিন মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন, গোসল করিয়ে জামা পরিয়ে দিলেন। মাকে ঠেলে সরিয়ে একদিন ঢাকায় রওনা হই। ঢাকা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হত না যদি না রুদ্র ময়মনসিংহে এসে সে রাতের ব্যাপারে স্বীকার করত যে সে রাতে সে মাতাল ছিল, যা করেছে কোনও সুস্থ মস্তিস্কে করে নি। আজকাল ঢাকা যেতে বাড়িতে কোনও কৈফিয়ত দিই না যে সার্টিফিকেট তুলতে হবে বা অপারেশন করাতে হবে বা অন্য কোনও বড় কারণ যে কারণে ঢাকা না গেলেই নয়। দিব্যি ঢাকা যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই, কোথায় থাকব কার বাড়িতে তাও বলি না, বলি না কারণ বাড়ির সবাই জানে আমি কোথায় কার কাছে যাই। এ নিয়ে কেউ আমার সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসে না। আমার ঢাকা যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই কলকলে বাড়িটি হঠাৎ চপু হয়ে যায়। ওই নৈঃশব্দ থেকে আমি নিঃশব্দে মিলিয়ে যাই। বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা যাওয়ার বাস, ঘন্টায় ঘন্টায় ছাড়ছে।
রুদ্র আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, যেহেতু আমার ডান হাতটি অকেজো। গোসলখানায় নিয়ে আমার কাপড় জামা খুলে গায়ে জল ঢেলে সাবান মেখে গোসল করিয়ে দেয়। গোসল করানোর সময় আমার শরীর স্পর্শ করে তার শরীরের ভেতর ফুঁসে উঠতে থাকে আরেকটি শরীর। নরম তোয়ালেয় গা মাথা মুছিয়ে আমাকে ঘরে আনে, শুইয়ে দেয়। উর্ধাঙ্গ অচল হলে কি হবে, নিম্নাঙ্গ তো অচল নয়। রাতে যখন গাছপালা দুলিয়ে মেঘ জমিয়ে ঘরে তুমুল তুফান তোলে রুদ্র, সেই তুফানে চৌকি ভেঙে পড়ে তলায় তোশক বালিশ সহ আমি। ভাল হাতটি ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙেনা। এর পরের তুফান মেঝের ওপর বয়, মেঝে ভেঙে নিয়ে নিচতলায় না পড়লেও মজবুত দেখে বড় একটি খাট কেনা হয়, যেন কোনও ঝড় তুফানে না ভেঙে পড়ে। বড় বিছানায় শুয়ে অভ্যেস আমার। হাত পা ছড়িয়ে শুতে না পারলে ঘুম ভাল হয় না। তার ওপর আবার কোলবালিশের ব্যাপারও আছে। মাথার বালিশকে কোলবালিশ করে আপাতত ঝড় তুফান শেষে নিদ্রা যাই। খাট কিনে তোশক বালিশ কিনে টাকা ফুরিয়ে যায়। টাকা ফুরোলে রুদ্র যা করে, মোংলা রওনা হয়। এবার আমাকে নিয়ে মোংলা যাবে সে। আমি বাধা দিই না। রুদ্রর সঙ্গ আমার প্রার্থিত। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে যেতে হলেও যাব, আর এ তো শ্বশুর বাড়ি!
হাত ভাঙা বলে কোনও লাল কাতান পরার দায় নেই, একরকম বাঁচি। লম্বা একটি ঢিলে জামা পরে থাকি, পরতে খুলতে সুবিধে। ঢাকা থেকে রেলে করে, লঞ্চে করে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মোংলায়, রূপসার ঘোলা জলের পাড়ে সেই নিঝুম বাড়িটিতে আবার, দোতলার ঘরটিতে আবার। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ, অথচ মনে হয় কেউ নেই বুঝি, কেউ ছিল না বুঝি! মানুষ খুঁজতে আমাকে ঘরে ঘরে উঁকি দিতে হয়। রুদ্রর মা তাঁর ভারি শরীরটি নিয়ে শুয়ে আছেন পালঙ্কে। বাকি ঘরগুলোয় আছে বাকিরা। বাকিরা যা কিছুই করছে, নিঃশব্দে করছে। পিঠাপিঠি ভাই বোন, অথচ কোনও চড়চিমটি-চুলোচুলো নেই। গোসলের সময় গোসল করছে, খাওয়ার সময় খাচ্ছে, ঘুমের সময় ঘুমোচ্ছে। চাবি দেওয়া যন্ত্রের মত, কাঁটায় কাঁটায় ঘটে যাচ্ছে সব, কিছুই পড়ে থাকছে না, কিছুরই এদিক ওদিক হয়না, এমন নিয়ম, পালনের প্রশ্ন ওঠে না, দেখলেই হাঁসফাঁস লাগে, আমি কোনও রুটিন মেনে চলতে পারি না, ক্ষিধে লাগলে খেয়ে উঠি, গোসল করে পরে খেতে হবে এমন নিয়মের মধ্যে নিজেকে কখনই ফেলতে পারি না, আজ গোসল করি তো কাল করি না, আজ নাস্তা খাই তো কাল খাই না, দুপুরে কোনওদিন ঘুমোই, কোনওদিন ঘুমোই না, রাত নটা বা দশটা বাজলেই আমার ঘুমোতে যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। কখনও আটটায় যাই, কখনও দশটায়, কখনও আবার সারা রাত্তির যাওয়াই হয় না। আমার উপস্থিতি এ বাড়িটির মন্থর ছন্দে একটুকু পরিবর্তন আনে না। অবকাশে যেরকম উৎসব শুরু হয় নতুন কেউ এলে, তার কিছুই ঘটে না এ বাড়িতে। সম্ভাষণও এমন শীতল, যেন মানুষগুলো সকাল বিকাল আমাকে দেখছে, যেন আমি এ বাড়িতে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে বাস করছি। ইচ্ছে করে বাড়িটির মরচে ধরা দরজা ভীষণ ধাক্কা দিয়ে খুলি, মাকড়শার জালগুলো সরাই। মানুষ একটু চিৎকার করুক, গলা ছেড়ে গান গাক, উঠোনের কাদায় হঠাৎ পিছলে পড়ে যাক, কেউ কাউকে ধমক লাগাক, কেউ তর্কে করুক কিছু নিয়ে, কিছু একটা ঘটুক, কেউ কিছু একটা করুক, হো হো করে হাসুক, হাসতে যদি না পারে তবু কিছু একটা করুক, না হয় কাঁদুক। তবু কিছু করুক। আমিই ওদের গায়ের শ্যাওলা সরিয়ে বলি, চল গল্প করি, চল তাস খেলি। বিছানায় সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসে আসর জমাতে চাই, জমে না। কারও কোনও গল্প নেই। অসম্ভব নিস্পৃহতার আঁচলে ওরা মুখ লুকিয়ে রাখে। ভাঙা হাত, তবু শুয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না, কিছু একটা করার তীব্র আকাঙক্ষা রক্তের কণার সঙ্গে মাথা থেকে পা অবদি দৌড়োয়। সারা বাড়িতে কোনও বই নেই যে পড়ব, সময় আমার প্রতি লোমকূপে বাবলা গাছের কাঁটা হয়ে বেঁধে। সময় আমার খুব বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, চাবুকে চাবুকে আমাকে রক্তাক্ত করতে থাকে। প্রতিদিন সকালে বা দুপুরে বেরিয়ে যায় রুদ্র, অসহ্য অপেক্ষার প্রহর কাটাই একা একা, মধ্যরাতে মাতাল স্বামী ঘরে ফেরে। দিনগুলো এভাবেই পেরোতে থাকে। এভাবেই রাতগুলো। ঘর থেকে বেরোতে গেলেই একটি কিম্ভূতকিমাকার না এসে আমাকে অচল করে রাখে। তবওু গোঁ ধরে যাবই যাবই বলে এক রাতে বেরোলাম, একটি হোটেলে সে গেল, একটি আড্ডায়, মদের আড্ডায়। বন্দরে ভদ্রলোকদের যাওয়ার জায়গা বলতে এই হোটেলটিই, রুদ্র বলে। গুমোট ঘরের বাইরে এসে আমি ফুসফুস ভরে হাওয়া নিতে চেয়েছিলাম, হাওয়া জোটে, মদগন্ধময়হাওয়াই জোটে।
প্রাণ ফিরে পাই যেদিন বন্দর ত্যাগের আয়োজন হয়, যদিও ঢাকার পথে নয়, যাত্রাটি আরও গভীর গ্রামের পথে, তবু এ বাড়ির শুয়ে বসে থাকা জীবনটি শেষ করার জন্য আমি আকুল হয়ে রওনা হই। গ্রামে নিশ্চয়ই বন্দরের মত শ্রমিকের উৎপাত নেই, রুদ্রর হাত ধরে সেইসব শস্যের সবুজ ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটতে পারব, যেসব ক্ষেতের কথা বারবার সে লিখেছে কবিতায়। মিঠেখালি গ্রামটি নিশ্চয়ই ছবির মত সুন্দর একটি গ্রাম, যে গ্রামের সৌন্দর্য রুদ্রকে বারবার টেনে আনে এখানে। কোথায় বসে সে কবিতা লেখে, কোন বৃক্ষতলে সে উদাস বসে আমাকে ভাবে, কোন ভরা জ্যোৎস্নার মাঠে সে একা একা দৌড়ে যায়, দুচোখ ভরে দেখব সব। মোংলা থেকে ছইঅলা নৌকোয় মুখ আড়াল করে আরও সব মেয়েমানুষের সঙ্গে খাল পেরিয়ে মিঠেখালি যেতে হয়। গভীর গ্রামের ভেতর চারদিকে ফসলের ক্ষেত, কিছু গোলপাতার ঘর এদিকে ওদিকে, মাঝখানে গাছগাছালি ঘেরা বড় একটি দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটি পুকুর, পুকুরে শান বাধাঁনো ঘাট। সন্ধে হলেই বাড়ির ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়িতে প্রচুর হারিকেন জ্বলে। ঝাড়বাতি থাকলে এটিকে সত্যিকার জমিদার বাড়িই বলা যেত। অবাক হই, এই ঘোর গহীন গ্রামে কে এনেছে ইট পাথর, কে গড়েছে এই বাড়ি! রুদ্রর নানার বাড়ি এটি। নানার দাপট ছিল এলাকায়, তার চেয়ে বেশি দাপট ছিল তার বড়মামার। গ্রামগঞ্জের দাপুটে অনেক লোক একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনিও ছিলেন। রুদ্রর মেজমামাও স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন না। এমন পরিবারে মানুষ হয়ে রুদ্র অন্যরকম। নিজে সে নিজের নাম রুদ্র রেখেছে। না রাখলে পিতৃদত্ত মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামটি নিয়েই তাকে জীবন কাটাতে হত। কবিতা লেখে স্বাধীনতার পক্ষে, মসনদে রাজাকারের ফিরে আসায় প্রচণ্ড ক্ষোভে সে বলে, জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন। কবিতায় শকুন বলে গাল দিলেও রুদ্রর অগাধ শ্রদ্ধা দেখি তার সেই মামাদের জন্য। গোবরে পদ্মফুলটির জন্য গৌরব হয় হয় করেও হয় না। গ্রামের বাড়িতে যখন থাকে সে, তার বড়মামার ঘরে থাকে। ঘরে বড় বড় দুটো পালঙ্ক, বড় বড় কাঠের আলমারি, বড় বড় চেয়ার। সবই বড় বড়। জমিদারি গন্ধ বেরোচ্ছে সব কিছু থেকে। বড়মামা বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর বউ আছেন, বউটি একদিকে তার বড়মামি আরেকদিকে বড়ফুপু। রুদ্র কাকু বলে ডাকে তাঁকে। কাকুর কথা সে আমাকে চিঠিতে লিখেছে অনেক। কাকুর নিজের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। রুদ্রকেই তিনি নিজের ছেলের মত লালন পালন করেছেন। এখানে জানালার কাছে বড়মামার পুরোনো টেবিলটিতে বসে রুদ্র কবিতা লেখে, বড়মামার পালঙ্কে নরম গদিতে ঘুমোয়। ঘুমোয়, চাকরবাকর আরদালি খানসামা তার আদেশ পালনের অপেক্ষায় থাকে। মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয় সে এ বাড়িতেই। এমন জমিদারি আমি যখন ফ্যালফ্যাল করে দেখছি, রুদ্র বলে, আরও ছিল, এখন তো পড়তির মুখে! এখন পড়তির মুখে না হয়ে উঠতির মুখে হলে সম্ভবত আনন্দ হত তার! যৎসামান্য অবশিষ্ট আছে, আগে অনেক ছিল, আরও ছিল! সেই আগের আরোর জন্য, আগের অঢেলের জন্য, অনেকের জন্য রুদ্রর গর্ব হচ্ছে টের পাই। ধনসম্পত্তি নিয়ে তার অহঙ্কার সে চাইলেও গোপন করতে পারে না। কিন্তু দরিদ্রকে শোষণ না করে কেউ কি এত ধনসম্পত্তি করতে পারে? পারে না, মন বলে, পারে না। রুদ্র তো সেই আশিভাগের পক্ষে কবিতা লেখে, যারা তার দোতলার ঘরটিতে কখনও পৌঁছতে পারে না, নিচের সিঁড়ি থেকেই যাদের হটিয়ে দেয় পাইক পেয়াদারা। যারা রোদে পুড়ে পুড়ে ক্ষেতে লাঙল দিচ্ছে, ওইসব বরগাচাষীরা, যাদের শ্রমের ফসল উঠছে এ বাড়ির গোলায়! যাদের আর রুদ্রর মধ্যে অনেক ফারাক। আমি মেলাতে পারি না। সা−ম্যর জন্য চিৎকার করে কবিতা পড়ে রুদ্র, সাম্য কি সত্যিই সে মন থেকে চায়! ঘরের চার দেয়াল ক্রমশ পা পা করে এগোতে থাকে আমার দিকে। রুদ্রকে বলি, চল বাইরে বেরোই।
বাইরে কোথায় যাবে?
গ্রাম দেখতে।
গ্রামে তো দেখার কিছু নেই।
দেখার কিছু থাকবে না কেন?
দেখার কিছু নেই, শুধু ক্ষেত।
ক্ষেতই দেখব।
ক্ষেত দেখে কি করবে? এসব ধানের ক্ষেত দেখার কোনও মানে হয়?
চল দুজন হাঁটি গ্রামের পথে। তুমি তো আমাকে চিঠিতে কতবার লিখেছো, যে, তোমার নাকি ইচ্ছে করে দিগন্ত অবদি সুবজ ধানের ক্ষেত দেখাতে আমাকে? দেখাতে গ্রামের আশ্চর্য সুন্দর রূপ!
খামোকা বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে বসে কাকুর সাথে গল্প কর। বীথি ওরা আছে, ওদের সাথে সময় কাটাও।
সময় তো আমি রুদ্রর সঙ্গে কাটাতে চাই। কথা বলতে বলতে দপু রু গড়িয়ে যাবে, বিকেল গড়িয়ে যাবে, টের পাবো না। রাতের কালো পর্দা এসে আমাদের মুখ ঢেকে দেবে, আমরা যে পরস্পরকে আর দেখতে পাচ্ছি না, টের পাবো না। আমাদের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আমরা থাকব, আমাদের স্পর্শের কাছে থাকব, আমাদের অনুভবের কাছে, টের পাবো না। জীবনের টুকরো টুকরো নিয়ে, টুকরো টুকরো জীবন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, অথবা কোনও কিছু না নিয়ে, মনে যা আসে তাই নিয়ে, সপুুরি গাছের মাথায় এইমাত্র যে পাখিটি এসে বসল, সেই পাখিটি নিয়ে, একটি বালক দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপঁ দিল, সেই বালকটি নিয়ে। কিন্তু আমি চাইলেও রুদ্রর নিস্পৃহতা লক্ষ করি, সে একা একা শুয়ে থাকতে চায় পালঙ্কটিতে। তার বুকের লোমে আঙুলে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে জীবনে কি কি আমার ইচ্ছে করে, কি কি করে না বলব, চায় না সে। আমার হাঁটুর কাছে তার মাথা, তার হাঁটুর কাছে আমার, এভাবেই শুয়েই স্মৃুতি থেকে কবিতা পড়ে যাব যে যতটা জানি, চায় না সে। সে চায় সারাদিন আমি বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে কাটাই, রাতে শুতে আসি তার বিছানায়। ঢাকার রুদ্র আর মিঠেখালির রুদ্রকে আমি শত চেষ্টা করেও মেলাতে পারি না।
কাকুর সঙ্গে গল্প করতে গেলে তিনি আলমারি খুলে শাড়ি বের করেন আমার জন্য, গয়নার বাক্স খুলে ভারি ভারি গয়না পরিয়ে দেন গায়ে। স্বামীকে সুখী করার জন্য যা যা করতে হয় স্ত্রীদের, তার সবই যেন আমি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাই, কর্তব্যকাজে যেন কখনও অবহেলা না করি। কাকুর উপদেশের সাগরে আমি খড়কুটোর মত ভাসতে থাকি। কাকু না হয় পুরোনো কালের মানুষ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একশ রকম কর্তব্যের কথা তিনি জানেন, কিন্তু নতুন কালের মানুষ বীথির কাছে গিয়ে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্তত একটি কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। রূপসী বীথির রূপসী কপাল নিভাঁজ পাওয়ার আশায় বসে থাকি, ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। বীথি সারাদিনই সংসারের নানারকম সমস্যা নিয়ে এর ওর সঙ্গে কথা বলছে, আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বলে বৌদি বস, কিন্তু সমস্যার খুব কাছে আমি বসে থাকি, তা সে চায় না। বীথির সমস্যার অন্ত নেই। তার অভিযোগের শেষ নেই। বাবা মা মেজমামা কাকু সবার বিরুদ্ধে তার গণ্ডা গণ্ডা অভিযোগ। মোংলা বন্দরের সংসার তাকে দেখাশোনা করতে হয়, এ সংসারও। মেজ মামার ছেলে মণির সঙ্গে বীথির বিয়ে হয়েছে। সম্পর্কের শেকলে মোংলা আর মিঠেখালির মানুষেরা খুব শক্ত করে বাধাঁ, বীথির মেজমামাই বীথির শ্বশুর, সম্পর্কগুলো কি রকম একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে আছে শেকলের মত! শেকল নিয়ে রুদ্রর মা মোটেও ভাবেন না, সংসারের কোনও কাজ নিয়েও ভাবেন না অথচ অগুনতি দুর্ভাবনা নিয়ে মিঠেখালির বাড়ি এসেও পালঙ্কে শুয়ে দিন কাটান। তাঁর সেবায় আমি সামান্যও ব্যবহৃত হতে পারি কি না জানতে যখন ঘরে ঢুকি, তিনি কাউকে জলদি করে ডেকে বলেন, দেখ তো শহিদুল্লাহর বউএর কিছু লাগবে কি না দেখ!
না, আমার কিছু লাগবে না, আমি এমনি এসেছি। বিব্রত শাশুড়ির সামনে ঘোমটা- মাথার ততোধিক বিব্রত বউটি বলে।
এমনি এসে তাঁর ঘরে কেউ বসে থাকলে তিনি যে বিব্রত হন বেশ বুঝতে পারি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আমার যে গল্প করার ইচ্ছে, তা বলে তাঁকে আরও বিব্রত করতে ইচ্ছে করে না।
বিকেলে রুদ্র একা বেরোবে বাইরে। তার কাজের অন্ত নেই। কেন যাচ্ছে!, যেও না, প্লিজ, থাকো, আমার এসব ছেঁদো অনুরোধ পুকুরে ঢিলের মত ছুঁড়ে দিয়ে সে মোংলা বন্দরে যায়, ফিরে আসে গভীর রাতে, এক শরীর ঝাঁঝালো গন্ধ নিয়ে।
গন্ধ কেন?
এই একটু মদ খেয়েছি।
কেন খেয়েছো?
খেতে ইচ্ছে করেছে তাই খেয়েছি।
তোমাকে আর কত বলব মদ খেও না! তুমি কি কোনওদিন আমার কথা শুনবে না?
ঘরে কাকু আছেন, অন্য বিছানায়, রুদ্র ভ্রুক্ষেপ করে না, যত রাতই হোক তার শরীর চাই।
তুমি কি কেবল শরীরই বোঝো রুদ্র? মন বোঝো না?
না রুদ্র মন বোঝে না, সে বিশ্বাস করে শরীরেই বসত করে মনরূপ পাখি। শরীর মেলালে মনের দেখা মেলে।
রুদ্রর শরীর চাই। প্রতি রাতেই তার চাই, যে করেই হোক, যে পরিবেশেই হোক, চাই। পূর্ণিমায় যখন গ্রাম ভেসে যাচ্ছে, আলোয় আমার মন ভাসছে, রুদ্রকে নিয়ে ছাদে যাই পূর্ণিমা দেখতে। ঝকঝকে চাঁদের তলে শীতল পাটিতে শুয়ে আছি, আলোয় আমার মন নাচছে, তার একটি হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে আলোয়-ভেজা শীতে কাঁপি, এভাবেই চল সারারাত চাঁদের আলোয় স্নান করি, চল সারারাত, চল সারারাত এভাবেই। আলোয় আমার মন উড়ছে। রুদ্র আলোয় ভাসতে চায় না, উড়তে চায় না, সে আমার শরীরে ডুবতে চায়। ওই ছাদে যে কেউ চলে আসতে পারের বিপদের দুআঙুল দূরে দাঁড়িয়ে সে শরীর ভোগ করে। বেঘোরে ঘুমোয়। আমি আর চাঁদ জেগে থাকি একা একা, সারারাত একা একা।
ঘরে বসে থাকব আর খাবার চলে আসবে ঘরে, এ খুব আরামের হয়ত, কিন্তু আমার দ্বিধা হয় এ বাড়ির সমস্ত আরাম আয়েশে গা এলিয়ে দিতে। এ আমার শ্বশুর বাড়ি না হোক, শাশুড়ির বাড়ি তো। নিজেকে সংসারের প্রয়োজনে লাগাতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আমি একটি বাড়তি মানুষ, হুকুম খাটার লোকের অভাব নেই বাড়িতে। জমিদারের বাড়িতে যা হয়। এ বাড়ির বড় বড় জিনিসগুলো আমার বোধগম্য হয় না সহজে। রুদ্র যখন বীথির সঙ্গে জমিজমা ধান চাল সহায় সম্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলে, আমি বেশির ভাগই বুঝি না। রুদ্র পরে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে, ভীষণ এক জটিল অবস্থার মধ্যে আছে এই জমিদারি। মিঠেখালির জমি থেকে যা আয় হয়, তার মায়ের ভাগ সে নিয়ে যায় এখান থেকে। বহু বছর হল এভাবেই নিচ্ছে সে ভাগটি। ভাগ নিয়ে কিছু সে নিজের জন্য রেখে বাকিটা রেখে যায় বন্দরের সংসার-কাজে। কিন্তু রুদ্র এখন ভাগের ধান বিক্রিতে বিশ্বাসী নয় আর। অনেকদিন থেকে সে তার মাকে বলছে যেন মেজ মামা জমি ভাগের ব্যবস্থা করেন। তার মায়ের ভাগেরটুকু থেকে কিছু বিক্রি করে সে ঢাকায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। রুদ্র ঢাকার পঞ্চাশ লালবাগের বাড়িটিতেও তার মায়ের ভাগ দাবি করে, ওটিও ছেড়ে দিতে সে রাজি নয়। বীথি তার দাদাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে সমর্থন জানিয়ে যায়। জমি ভাগ করতে মেজ মামা রাজি হন না। বড়মামার পর এখন মেজই হর্তকর্তা, তিনি না চাইলে ভাগ সম্ভব নয়। জমিজমা বিষয়ক জটিলতা থেকে আমার মন উঠে দৌড়ে যায় শান বাধাঁনো পুকুরঘাটে। চল যাই, হাঁসের সাঁতার দেখি বসি। চল, পুকুরে গোসল করি। আমার আবদার শুনে বাড়ির সবাই হাসে, রুদ্রও হাসে। যেন আমার বোধ হয়নি বুদ্ধি হয়নি, যেন জীবন কাকে বলে তার কিছুই আমি এখনও জানি না। আমি আমার শিশুসুলভ অপরিপক্বতা দিয়ে কেবল লোক হাসাতে পারি। পুকুরে বাইরের মানুষ গোসল করতে আসে, ও পুকুরে বাড়ির বউএর নাওয়া চলবে না। গোসল করতে হলে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভেতরের পুকুরে। ভেতরের ঘোলা পুকুরে আমি পা ডুবিয়ে বসে থাকি।
দোতলার জানালা থেকে আমি তাকিয়ে থাকি পুকুরটির দিকে। পুকুরটিকেও আমার মত খুব একলা মনে হয়। যেন দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তারও কোথাও কোনও পুকুরে গোসল সারা হয়নি। গায়ে শ্যাওলা জমে আছে পুকুরের। এই পুকুরটির পানি দিয়েই এ বাড়ির রান্নাবান্না ধোয়া পাকলা অযু গোসল সব হয়। পানি খাওয়াও হয়। বড় বড় মটকিতে বর্ষার সময় বর্ষার জল জমিয়ে রাখার নিয়ম। মটকিগুলো উঠোনেই পড়ে থাকে। সারাবছর মটকির পানিও খাওয়া হয়। ফুরিয়ে গেলে পুকুরের পানি। একদিন পানি খেতে গিয়ে গেলাসের পানিতে দেখি অনেকগুলো কিড়ে কিলবিল করে সাঁতার কাটছে। অন্যরা দিব্যি কিড়েঅলা পানি খেয়ে নিচ্ছে। আমি হা হা করে থামাতে এলে বীথি বলল, ও কিড়ে কোনও ক্ষতি করে না, ও খাওয়া যায়। বীথি আমাকে পানির উৎসের কথা বলে, বলে কি করে খাবার পানি সংগ্রহ করে ওরা। আমি থ হয়ে বসে থাকি। দেখে হাসে সবাই। আমাকে খুব অদ্ভুত চিড়িয়া কিছু ভাবে নিশ্চয়ই ওরা। পানিহীন দিন কাটতে থাকে আমার। দিনে যে দুকাপ চা খাওয়া হয়, তা দিয়ে পানির অভাব পুরণ করি শরীরের। রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে অনেকগুলো ফানটা কোকোকোলা আনিয়ে দিয়েছে আমার জন্য। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি পুকুরটিতে লোকেরা সাবান মেখে গোসল করছে। বুঝি না, কি করে এত নিশ্চিন্তে এই পুকুরের পানিই পান করছে সবাই! এত জমি এত টাকা, অথচ কোনও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা কি কেউ করতে পারে না? রুদ্র বলে, ব্যবস্থা করার কোনও প্রয়োজন নেই। এই পানি খেয়ে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে, কখনও কোনও অসুখ হয়নি। কাকুর ঘরটিতে বসে আমার অলস অবসর সময় কাটতে থাকে। এ বাড়িতেও বই খুঁজি। হাদিস কোরানের ওপর কিছু বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই, কিছু পঞ্জিকা আছে শুধু এ ঘরে বসেই পুরোনো পঞ্জিকা খুলে রুদ্র একদিন আমার জন্মতারিখ বের করেছিল। আরবি সালের বারোই রবিউল আওয়াল আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পড়েছে ইংরেজি কোন সালে, আটান্ন থেকে চৌষট্টি পর্যন্ত খুঁজে বের করে জানিয়েছিল বাষট্টি সালে। বাষট্টি সালের পঁচিশে আগস্টে। এই কাকুর ঘরে খামোকা কাজকম্মহীন বসে থাকতে রুদ্রর কোনও অসুবিধে হয় না। দীর্ঘ দীর্ঘ মাস এ ঘরেই বসে থাকে সে। এ ঘরে বসেই কবিতা লেখে, এ ঘরে বসেই ডাকে পাঠানো আমার চিঠি পড়ে, নিজেও লেখে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে জীবন স্যাঁতসেঁতে লাগে, রুদ্রকে যখনই বলি, চল ঢাকা ফিরে যাই। রুদ্র এক কথাই বলে টাকার যোগাড় হোক আগে। কি করে টাকার যোগাড় হবে আমার বোঝা হয় না। যেদিন আমরা মিঠেখালি ছাড়ি, তার আগের রাতে রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে মদ খেয়ে ফিরেছে। প্রায়-মাতাল রুদ্র একটি কাণ্ড ঘটাতে চায়। আমার বাধা না মেনে সে কাণ্ডটি ঘটায়। তার মেজ মামার আলমারির তালা ভেঙে জমির দলিল বের করে আনে। দলিল হাতে তার। যে দলিলটি পেতে বছরের পর বছর সে অপেক্ষা করেছে। সে এখন দিব্যি কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তার মার ভাগের জমি বিক্রি করে দিতে পারে যে কারও কাছে। কিন্তু বাড়ির কেউই রুদ্রর এই কাণ্ডটিকে সমর্থন করে না। কাকু এত যে তার আদরের, তিনিও করেন না, রুদ্রর মা, যাঁর জমি, তিনিও তার পুত্রের এমন অসভ্যতা মেনে নেন না, বীথিও না, যে কি না তার দাদার প্রতি কাজে বাহবা দিয়ে আসছে। রুদ্রর পদক্ষেপটি সম্পূর্ণই বিফলে যায়। মেজমামার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর হাতেই শেষ অবদি তুলে দিতে হয় দলিলটি। চলে যাওয়ার দিন রুদ্র আমাকে ঠেলে পাঠায় মেজমামাকে যেন পা ছুঁয়ে সালাম করি, কদমবুসি করি। রুদ্রর আদেশ আমি নতমুখে পালন করি, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একশ কর্তব্যের এটি একটি।
রুদ্রর অনেক কিছু বিফলে যায়। নটা পাঁচটা চাকরি তার পোষাবে না বলেছিল, তারপরও ঢাকায় সে চাকরির জন্য ধরনা দেয়। চাকরি পাওয়া হয় না। পত্রিকা অফিসগুলোয় ঘোরে, ওখানেও ব্যবস্থা হয় না কিছুর। অন্তত কোনও পত্রিকায় যদি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তার একটি চাকরি জুটত। কে দেবে চাকরি! নামি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের আলিশান বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করে তিনি যদি অন্তত চিত্রনাট্য লেখার কোনও কাজ রুদ্রকে দেন, সৈয়দ হক কথা দেন না। তিনি যে ছদ্মনামে বাংলা চলশ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে পয়সা কামাচ্ছেন, এ কথা অনেকেই জানে। সৈয়দ হকের ছোটভাই এর প্রকাশনী সব্যসাচী থেকে রুদ্রর তৃতীয় কবিতার বই মানুষের মানচিত্র বের হয়। এটুকুই। এর বেশি রুদ্রর ভাগ্যে কিছু জোটে না। মানুষের মানচিত্র যেবার বেরোলো বইমেলায়, প্রতিদিন বিকেলে মেলায় গিয়ে সে ঠায় বসে থেকেছে বইয়ের স্টলটিতে। তার বসে থাকার কারণে যদি বিক্রি হয় বই অথবা কেউ যদি বই কিনে বইয়ে সই চায়। মেলা ভাঙা পর্যন্ত রুদ্র বসে থাকে। রুদ্র কেবল কবিতা লিখে আর কবিতার বই ছেপেই শান্ত হয় না। সুযোগ পেলেই নানারকম দলে ভিড়ে যায় । সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে রুদ্র আর তার বন্ধুরা। এরশাদ বিরোধী নানা রকম অনুষ্ঠান করছে এই জোট। কিন্তু ঢাকায় রুদ্রর দীর্ঘদিনের অনপু স্থিতির কারণে সাংস্কুতিক জোটে তার বড় দাযিত্বটি অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়। নিজের হারানো পদটি ফিরে পেতে সে হন্যে হয়ে ঘোরে, ফিরে পাওয়া হয় না। রুদ্র জানে যে পাকাপাকি ভাবে ঢাকা না এলে সংসার তো তার করা হবেই না, দেশের সাহিত্যঅঙ্গনে প্রতিভাবান তরুণ কবি হিসেবে তার যে একটি পরিচিতি হয়েছে, সেটিকেও কিছু হিংসুক কবিকুল বিনাশ করতে চেষ্টা করবে।
রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার। আমি বলি, তুমি কবিতা লেখ, আমি সংসার চালাবো। টাকা পয়সা রোজগার নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। প্রথমেই নিজের টাকায় যে জিনিসটি কিনি সে বইয়ের আলমারি। রুদ্রর পুরোনো বাঁশের তাক থেকে তার বইগুলো নিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখি। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়ি যেতে আসতে ইস্পাতের দোকানে থেমে কাপড় চোপড় রাখার আলমারি কিনেও তাজমহল রোডের ঘরে তুলি। দুজনের কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখি ওতে। একটু একটু করে সংসারের জিনিস কেনা শুরু করতে হবে, সে রুদ্রও জানে। অবকাশ থেকে আমার কাপড় চোপড় বইপত্র হাজার রকম টুকিটাকি জিনিস ট্রাংকে করে তাজমহল রোডে নিয়ে এসেছি। মন প্রাণ শরীর সব ঢেলে দিই সংসার সাজানোয়। রুদ্রর টাকা উড়তে থাকে মেথরপট্টির মদের আড্ডায়, সাকুরায়। সাকুরায় প্রায় রাতে যায়, ওখানে মদ নিয়ে বসে। বন্ধুদের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে বলতে মদ পান করে, ম্যাচবাক্সে আঙুলের টোকা দিয়ে দিয়ে আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস .. গেয়ে ওঠে মাতাল রুদ্র। প্রায়ই। মধ্যরাতে টলতে থাকা রুদ্রকে নিয়ে রিক্সা করে বাড়ি ফিরি। রুদ্র মদ খাচ্ছে না, মদ রুদ্রকে খাচ্ছে। মদ ছাড়া সন্ধে বা রাত তার কাটে মন মরা। আমি তাকে কেঁদে বোঝাই, ধমকে বোঝাই, রাগ করে, আদর করে বোঝাই যে মদ খাওয়া শরীরের জন্য ভাল নয়। রুদ্র সব বোঝে, আবার কিছুই বোঝে না। মদ যদি না জোটে, কিছু একটার দরকার তার হয়ই, গাঁজা নয়ত চরস। কালো চরস কাগজে মুড়ে রাখে, সেগুলো গুঁড়ো করে সিগারেটের খোলে ঢুকিয়ে খায় সে। রুদ্রকে এসব খাওয়া বন্ধ করার জন্য নিশিদিন অনুরোধ করেও কোনও লাভ নেই। সে তার নেশা করেই যাবে যে করেই হোক। আমিও মদ খাবো, আমিও গাঁজা চরস খাবো- যেদিন বলি, সে বাধা দেয় না। বরং পিঠে চাপড় মেরে উৎসাহ দেয়। চরস ভরা সিগারেট এগিয়ে দেয় আমার দিকে, দু টান দিয়ে কেশে নাশ হই। সাকুরায় মদের গেলাস এগিয়ে দেয় বিষম উৎসাহে, গন্ধ শুঁকতেই বিবমিষা আমাকে গ্রাস করে ফেলে বলে এক গেলাস কমলার রসে তিন ফোঁটা ভদকা মিশিয়েও মদে আমার শুরুটা করে দিতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। গলা ছিঁড়ে যায় ঝাঁঝে, দু চুমুক পান করার পর সে আমাকে বাহবা দেয়, এই তো বেশ হচ্ছে, এভাবে চালিয়ে যাও, হয়ে যাবে। কিন্তু হয় না। রুদ্রর পথ অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। সে একাই তার পথে চলতে থাকে, সঙ্গে কিছু মদারু গাঁজারু বন্ধু। মদের আড্ডায় সঙ্গী হয়ে মাগনা মদ খেতে বন্ধুরা সন্ধের পরই ভিড় জমাতে থাকে। রুদ্রর হস্ত উদার হস্ত পেটে মদ পড়লে পারলে দশ বারোজনকে মাগনা মদ খাওয়াতে রাজি হয়ে যায়। রুদ্রর এই জনমদসেবায় সংসার খরচের টাকা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। টাকা ফুরোনো মানে তার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া। এভাবে কি চলে রুদ্র? চলে না সে জানে, কিন্তু আর কোনও উপায় নেই। আমি সংসারের খরচ বহন করতে পারি, কিন্তু তাই বলে রুদ্রর মদের টাকা যোগাতে তো পারি না। আমার প্রশিক্ষণ-ভাতার টাকায় এত তো কুলোবে না। রুদ্র জানে যে কুলোবে না, তাই তাকে মোংলা পাড়ি দিতেই হয়।
যতদিন সে মোংলা বা মিঠেখালিতে পড়ে থাকে, ততদিন আমি ডাক্তারি প্রশিক্ষণে মন নিবেশ করি, না করতে পারলেও অন্তত উপস্থিতিটি রাখি। রুদ্র ঢাকায় ফিরলেই প্রশিক্ষণ গুল্লি মেরে তার কাছে চলে যাই। রুদ্রই আমার ঠিকানা, তাকে নিয়ে আমার সংসারের স্বপ্ন-চারা লকলক করে বড় হতে থাকে, বৃক্ষ হতে থাকে। রুদ্রর ছোট বোন মেরি এখন ঢাকায়, লালবাগে মেজমামার বাড়িতে থেকে লালমাটিয়া কলেজে আইএ ভর্তি হয়েছে। শুনে রুদ্রকে বলি, মেরিকে এ বাড়িতে নিয়ে এসো। এখান থেকে কলেজ কাছে হবে। মামার বাড়িতে থাকার চেয়ে ভাইএর বাড়িতে থাকা ভাল। এখানে নিজের বাড়ির মত থাকতে পারবে। রুদ্র প্রথম রাজি হয় না। এ বাড়িতে কি করে থাকবে মেরি! আরাম আয়েশের ব্যবস্থা নেই, কাজের লোক নেই, আমাদেরও পাকাপাকি থাকা হচ্ছে না এখানে। আমার প্রশিক্ষণ তো খুব শিগগির শেষ হয়ে যাচ্ছে, রুদ্র না থাক, আমি তো থাকতে পারব মাসের বেশির ভাগ সময়ই, হয়ত পাঁচ সাতদিনের জন্য যাবো। এক সন্ধেয় লালবাগ থেকে মেরিকে নিয়ে আসি আমরা। মেরি থাকা শুরু করার পর বাড়িটিকে সত্যিকার বাড়ির মত লাগে। গীতার কাছ থেকে রান্নাবান্না করার জন্য সবুজ নামের এক কিশোরিকে নিয়ে আসি। প্রতিদিন সংসারের টুকিটাকি জিনিস কিনছি। এক ঘোরের মধ্যে বাঁচি। কিন্তু সব ফেলে ময়মনসিংহ যেতেই হয় যেহেতু প্রশিক্ষণ আমার এখনো শেষ হয়নি। ময়মনসিংহ থেকে যখনই ঢাকায় ফিরি, আমার সংসারটিকে অনেকটাই পাল্টো যেতে দেখি। দেখি রুদ্রর আরেক বোন সাফিকে মোংলা থেকে রুদ্র ঢাকা নিয়ে এসেছে। রুদ্রর ভাইবোনগুলো সব দেখতে এক, সবগুলো মুখে তাদের মায়ের মুখ । সাফি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, বিয়ের জন্য বসে আছে। মোংলার চেয়ে ঢাকায় পাত্র পাওয়া সুবিধে বলে রুদ্র ওকে ঢাকায় এনেছে। বাড়িটি এখন আর কোনও ছন্নছড়া দম্পতির ছন্নছাড়া সংসার বলে মনে হয় না, বাড়িটি নপুূর পরে নাচে, কলবল খরবল করে বাড়িটি কথা কয়। আমার ভাল লাগে, ভাল লাগে এ ভেবেও যে রুদ্র তার দুবোনের সামনে নিজের মান বাঁচাতে আর মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরবে না। ভাল লাগে রুদ্রর সংসারি হওয়া দেখে। কিন্তু, একবারও কি সে আমাকে জানাতে পারত না যে সে সাফিকে ঢাকায় নিয়ে আসছে! আমি একটু একটু করে টের পাই, সংসারের অনেক সিদ্ধান্ত সে একা নিচ্ছে। মেরি আর সাফি শোবার ঘরে থাকছে, বড় বিছানাটিতে। আলমারিতে ওদের কাপড় চোপড়, জিনিসপত্র। আমার কাপড়গুলো এক পাশে এক কোণে সরে যাচ্ছে। আমার জায়গা দিন দিন কমতে কমতে ছোট হয়ে আসছে। আমি আর রুদ্র সামনের পড়ার ঘরটিতে ভেঙে পড়া চৌকির ছোট তোশকটি বিছিয়ে ঘুমোই। কৃচ্ছউস!ধন করি। অথবা কেষ্ট পেতে চাই। কষ্ট করিলে নাকি কেষ্ট মেলে। সংসারের মধ্যে রুদ্রকে নিয়ে সন্ন্যাসযাপন করেও তাকে আমার সারাক্ষণের জন্য পাওয়া হয় না। তার সময় হয় মোংলা যাওয়ার। আমাকে চুমু খেয়ে, ভাল থেকো লক্ষ্মী সোনা, ভাল থেকো প্রাণ ইত্যাদি বলে সাফির হাতে সংসার খরচের টাকা দিয়ে রাতের ট্রেন ধরতে চলে যায়। সংসার নিজের টাকায় সাজিয়েছি, কিন্তু সংসার খরচের টাকা আমার হাতে না দিয়ে বোনের হাতে দেওয়ায় সংসার নিয়ে আমার উত্তেজনায় একটি ছোট্ট ঢিল পড়তে গিয়েও পড়েনি, আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার এই সংসার আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে।
রুদ্র বলেছে, বড় একটি বাড়ি প্রয়োজন, কারণ তার ছোট ভাই আবদুল্লাহকেও ঢাকায় এনে সে ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে বাড়ি খুঁজতে থাকি। পছন্দ হয় না বেশির ভাগ, পছন্দ হলে ভাড়া বেশি। ভাড়া কম হলে ঘর ছোট, জায়গা কম। খুঁজতে খুঁজতে একদিন ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে একটি বাড়ি পছন্দ হয়। বাড়িভাড়া এক মাসের জমা দিয়ে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকি। ফিরে এলে মুহম্মদপুরে তাজমহল রোডের বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র ইন্দিরা রোডের নতুন বাড়িতে নিয়ে যাই। দুটো শোবার ঘর, একটি বড় একটি ছোট, বড় একটি বৈঠক ঘর, বড় শোবার ঘরের পাশে একটি টানা বারান্দা। সাফি বড় শোবার ঘরটি পছন্দ করে ওর জন্য, সাফির প্রস্তাবে রুদ্র রাজি হয় না, মেরি আর সাফি দুজনকেই সে বুঝিয়ে বলে বড় ঘরটিতেই তার এবং আমার থাকা উচিত। আমাদের জন্য নতুন একটি খাট কিনে বড় শোবার ঘরে পাতে। নিজের লেখার টেবিলটিও। নতুন একটি আলমারি কেনাও হয় এ ঘরের জন্য, সেটি জানালার কাছে। আবদুল্লাহর জন্য একটি ছোট খাট কিনে বৈঠক ঘরে পেতে দেওয়া হয়। ছোট শোবার ঘরে আগের বড় খাটটি আর আগের ইস্পাতের আলমারিটি মেরি আর সাফির জন্য বসানো হয়। ওদিকে ময়মনসিংহে হাসপাতালে যেতে আসতে পথে যে আসবাবপত্রের দোকান পড়ে, ওখান থেকে খাবার টেবিল, চেয়ার, সোফা ইত্যাদি যা বানাতে দিয়েছি, ময়মনসিংহে নিয়ে গিয়ে ট্রাক ভাড়া করে আসবাবের দোকান থেকে সমস্ত আসবাব নিয়ে এমনকি অবকাশ থেকেও একটি পুরোনো চেস্ট অব ড্রয়ার আর একটি −শ্বত পাথরের টেবিল তুলে নিয়ে দুজন ঢাকায় ফিরি। একটি সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ি, একটি সুখের শান্তির সংসার ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু নেই। নিপুণ হাতে সংসার সাজাই। সংসারের হাজার রকম জিনিস ঘোরের মধ্যে কিনে নিই, সঞ্চয় যা ছিল সব ঢেলে, স্থির হই সংসারে। প্রশিক্ষণ সমাপ্ত। আর ময়মনসিংহে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এবার তোমার খবর কি রুদ্র! আমি তো তোমার কাছে চলে এসেছি, আমার অনপু স্থিতি তোমাকে যে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন দিত, এলোমেলো জীবন দিত, সে জীবন আর দেবে না। এই দেখ, আমার সমস্ত নিয়ে আমি এখানে। তোমার কাছে। রুদ্র কথা দেয়, সেও তার সংসারে পাকাপাকি চলে আসছে, আর যেন তাকে টাকার জন্য ছুটতে না হয় কোথাও। একটি ছোটখাট হলেও ছাপাখানা খুলতে পারে এমন টাকা যে করেই হোক, নিয়ে আসবে মোংলা বা মিঠেখালি থেকে। তার বাবা বা মায়ের কোনও জমি বিক্রি করে। ঢাকায় সে ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। বাবা মার সম্পত্তি থেকে যে ভাগ তার পাওয়ার কথা, সেটি এখনই সে নিয়ে নেবে।
ছাপাখানা। ছাপাখানা। রুদ্র সব পরিকল্পনা করে ফেলে , কোথায় হবে। কেমন হবে। প্রতিদিন তাকে কাছে পাবো, এই সুখে আমি তিরতির করে কাঁপি। আর কোনওদিন তাকে প্রতিমাসের খরচ আনতে দূরে যেতে হবে না। আর কোনওদিন নিঃসঙ্গতার কষ্ট তাকে ছিঁড়ে খাবে না। আমার স্বপ্নের বৃক্ষ ছেয়ে যাচ্ছে ফুলে।
কিন্তু, মোংলা থেকে ফিরে আসে খবর নিয়ে যে তার মেজো মামার কাছ থেকে মায়ের জমি আলাদা করে যে বিক্রি করে ঢাকায় একটি ছাপাখানা দেবে বলেছিল সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং ঢাকায় পাকাপাকি এখনও বসবাস তার সম্ভব নয়। তবে নিজে সে একটি ব্যবসা শুরু করেছে মোংলায়, চিংড়ির ব্যবসা। ব্যবসাটি দেখাশোনা করার লোক আছে। তার খুব না গেলেও চলবে। বছরে দুবার গিয়ে দেখে এলেই হবে। বেশ তো, এবার মন দিয়ে ঘর সংসার করি চল। এতকাল যে স্বপ্নটি লালন করছি আমরা, দুজন একসঙ্গে থাকব, একজন আরেকজনকে ছেড়ে কখনও দূরে যাবো না। শুরু করার আগে বিয়ের অনুষ্ঠান করে নিই। চল ঘটা করে জানাই সবাইকে যে বিয়ে করেছি। বিয়ে তো সামাজিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য রুদ্র নিজে নিমন্ত্রণ পত্র লেখে।
আমরা জ্বালাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘসে অপরূপ হৃদয়ের আলো।
কোনও শাদা শাড়ি পরে বিধবা সেজে বিয়ে করব না, লাল বেনারসি চাই, সঙ্গে সোনার গয়না। রুদ্র রাগ করে খরুচে মেয়ের বেআক্কেলি তালিকা দেখে। কিন্তু আমার ভাষ্য, বউ যখন সাজব আর সব বাঙালি বউএর মতই সাজব। রুদ্রকে কিনে দিই যা যা পরবে সে বিয়ের অনুষ্ঠানে। রুদ্রর চেয়ে আমার উৎসাহ বেশি। শহরের একটি চিনে রেস্তোরাঁকে উনত্রিশে জানুয়ারি তারিখের রাতের জন্য তৈরি থাকতে বলি। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিমন্ত্রণ করব। যেখুক সবাই আমি ভাল আছি, সুখে আছি। যেহেতু ভাল থাকা সুখে থাকা শাড়ি গয়না দিয়েই বিচার করে মানুষ। ঢাকায় ঈদ করে ময়মনসিংহে ফিরে গেলে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়া যে করছস, তা তর জামাই কি শাড়ি দিল ঈদে? আমি কোনও উত্তর দিই নি। না ঈদে কোনও শাড়ি রুদ্র আমার জন্য কেনেনি। আমরা যেহেতু ধমের্ বিশ্বাস করি না, ঈদে বিশ্বাস করি না। শাড়ির প্রশ্ন আসে না। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঈদে বিশ্বাস করি না বলে নয়, আমি আমার স্বনির্বাচিত স্বামীর কাছ থেকে শাড়ি গয়না পাচ্ছি না বলে। শাড়ি গয়না সুখ দেয় বলে মা হয়ত বিশ্বাস করেন না, কিন্তু শাড়ি গয়না স্ত্রীকে ভালবাসলেই স্বামীরা উপহার দিতে পারে। মা ভালবাসার সন্ধান করেন, আমার জন্য রুদ্রের। রুদ্রর টাকা কত আছে, সে কোনও উপহার দিতে সক্ষম কি না তা না দেখে একজন ডাক্তার মেয়ের জন্য যে ধরনের স্বামী পাওয়া যায়, সে সব স্বামীর যে যোগ্যতা থাকে দামি শাড়ি গয়না উপহার দেওয়ার তা থেকেই বিচার করা হয় আমি আদৌ যোগ্য স্বামী পেয়েছি কি না। রুদ্রর যোগ্যতা নিয়ে সকলের সন্দেহ আমার মনে হুল ফোটাতে থাকে। সামজিক নিয়ম কানুন অস্বীকার করি বলে ভাবি, কিন্তু সমাজে বাস করে তার সবটুকু হয়ে ওঠে না ডিঙোনো। বিয়ের অনুষ্ঠানে −ঝঁপে বৃষ্টি আসা রাতে লাল বেনারসি শাড়ি পরা সোনার অলংকার পরা লাল টুকটুক বউ চিনে রেস্তোরাঁয় যায়। বউকে ঠিক বউএর মত লাগে না, বউএর মাথায় ঘোমটা নেই। কিন্তু তবু তো বউ। রুদ্রর লেখক বন্ধুরা আসে, আমার দুচারজন ডাক্তার বন্ধু আসে, দপু ক্ষের আত্মীয়রাও আসেন, আমার আত্মীয়দের মধ্যে বড়মামা তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে, ছোটদা গীতাকে নিয়ে, রুনুখালা তাঁর বরিশালি স্বামী নিয়ে। অনুষ্ঠান বলতে খাওয়া আর গল্প গুজব। ক্যামেরার সামনে মুখে ভুবনমোহিনী হাসি নিয়ে যার সঙ্গে যার যত বিরোধই থাক না কেন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাওয়া, ফটো তোলা।
ছোটদার বাড়িতে, রুনুখালার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আসি রুদ্রকে নিয়ে। মা ঢাকায় এলে মাকে নিয়ে নিজের সংসার দেখিয়ে আসি। সামাজিকতা শেষ হয়। এবার কি? এবার রুদ্র মোংলা চলে যাবে, চিংড়ির ব্যবসা। বাড়িভাড়া আর সংসার খরচের টাকা বোনের হাতে দিয়ে মোংলা চলে যায় বরাবরের মত। প্রশিক্ষণ ভাতার জমানো টাকা সব অকাতরে ঢেলে বাড়িঘর সাজিয়ে, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবীদের বিয়ের খবর প্রচার করে ভাল আছি সুখে আছি বুঝিয়ে, সংসার করছি জানিয়ে, ময়মনসিংহে নিজের যা কিছু জিনিসপত্র ছিল সব নিয়ে এসে, এমন কি নিজের শেকড়টি তুলে নিয়ে ঢাকায় পুঁতে, ভালবাসার মানুষকে নিয়ে একটি সাজানো গোছানো দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখা মেয়ে লক্ষ্য করি নিজের সংসারে নিজে আমি গৌণ একজন মানুষ। রুদ্র কি আমাকে বিশ্বাস করে না যে আমি এই সংসারের দায়িত্ব নিতে পারব? এরকম তো নয় প্রশিক্ষণের জন্য আমার আবার ময়মনসিংহে দৌড়োতে হবে। ও পাট তো চুকেছেই। তবে কেন এই অবিশ্বাস! কেন এই আস্থাহীনতা! তীব্র অপমানবোধ আমাকে থাবা দিয়ে ধরে। রুদ্রর ভাই বোনগুলো চমৎকার। ওদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল মানুষ। মোংলা বন্দরের বাড়িতে যেমন সবাই ঝিমিয়ে আছে বলে মনে হত এ বাড়িতে তা নয়। আবদুল্লাহ বাইরের গাড়িবারান্দায় ক্রিকেট খেলে, ইশকুলে বন্ধু বান্ধব হয়েছে অনেক। মেরিরও তাই। বন্ধু বান্ধবী বাড়িতে আসছে। হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আমিও কদিন হৈ হুল্লোড়ে যোগ দিয়ে নিজেকে পরিবারের একজন ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু চেষ্টা করলেই যে হয় তা নয়। সংসারে আমার কোনও সিদ্ধান্ত নেই। ভূমিকা নেই। দায়িত্ব নেই। সবুজ চলে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে নার্গিসের ছোট বোন বিলকিসকে নিয়ে এসেছিলাম। বিলকিসও চলে গেছে। ওরা মোংলা থেকে কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটি ঘরদোর গুছিয়ে রাখে, রাঁধে বাড়ে, ওদের খাওয়ায়। কি বাজার হবে, কি দিয়ে কি রান্না হবে সব সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্রর বোনেরা। টেবিলে খাবার দেওয়া হলে ডাক পড়ে আমার। খেয়ে চলে আসি নিজের ঘরে। বুঝি এ বাড়িতে আমি অতিথি ছাড়া কিছু নই। রুদ্র নিজে টাকা রোজগারের পথ পেয়ে গেছে। পরিবারের অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলেটি হঠাৎ খুব গুরুত্বপূণর্ হয়ে উঠেছে কারণ সে পরিবারের বড় একটি দায়িত্ব নিয়েছে। বীথি সংসার করছে, সাইফুল মেডিকেলে পড়ছে। বাকি ছ ভাই বোনকে লালন পালন করার দায়িত্ব নিয়েছে রুদ্র। তিনজন এসে গেছে ঢাকায়, বাকি তিনজন আসছে। এই বড় দায়িত্বটি পেয়ে সে উত্তেজিত। রুদ্রর স্বপ্নে আমাকে নিয়ে একান্ত করে একটি সংসার পাতা নেই। ঢাকায় বাস করারও কোনও স্বপ্নটিও নেই আর। ওসব পুরোনো স্বপ্নকে ঠেলে সরিয়ে অন্য স্বপ্ন শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, রুদ্রর স্বপ্নে চিংড়ির ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হওয়া আছে, স্বপ্নের মধ্যে সুষ্ঠু ভাবে তার ছভাইবোনকে বড় করা আছে। রুদ্র বলে যায় দু সপ্তাহ পর ফিরবে, দু মাস চলে গেলেও ফেরার নাম নেই। ওদের সংসারে থেকে ওদের অন্ন ধং্ব স করতে আমার লজ্জা হয়। ছোটদার বাড়ি চলে আসি। গীতার নতুন একটি বাচ্চা হয়েছে। এ বাচ্চাজ্ঞট হওয়ার সময় ক্লিনিকে ডাঃ টি এ চৌধুরি যখন বাচ্চাজ্ঞট প্রসব করাচ্ছিলেন, ডাক্তার বলে আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ভেতরে যেতে। বাচ্চাজ্ঞটর জন্ম আমার দেখা।ছোটদা নাম দিয়েছেন ঐন্দ্রিলা কামাল। ডাক নামটি আমি দিই, পরমা। পরমাকে লালন পালন করার জন্য গীতা চাকরি ছেড়েছে। ছোটদা আর গীতা দুজনই নতুন বাচ্চা নিয়ে খুশিতে লাফাচ্ছে। সুহৃদকে কাছে রাখার কোনও উৎসাহ নেই, দু বাচ্চাকে দেখাশোনা করার ঝামেলা গীতা নিতে পারবে না বলে ঢাকায় এনেও, কিছুদিন পরই সুহৃদকে যেখানে মানায়, সুহৃদের যাদের জন্য টান, তাদের কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার অলস অবসর কাটতে থাকে ছোটদার বাড়িতে। কখনও কখনও ঝুনু খালার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। ঝুনু খালার কাছে শুনি বরিশালি স্বামীটি নাকি বড়মামার কাছে মোটা অংকের টাকা ধার চেয়েছেন। অত টাকা বড় মামার নেই যে ধার দেবেন। ঝুনু খালাকে প্রায়ই নাকি বরিশালিটি বলছেন, ফকিরের জাতরে বিয়া করে কি ঠকা ঠকেছি! আমাকে সামনে পেলেই তিনি ঝুনু খালার বয়স বেশি, ঝুনু খালা ছলে বলে কৌশলে বিয়ে করেছেন তাঁকে, তাঁর আরও ভাল পাষনী জুটতে পারত ইত্যাদি বলেন। রুনুখালার বাড়িতেও আমার ভাল লাগে না সময় কাটাতে। আমি ময়মনসিংহে ফিরি। ময়মনসিংহেও আর আগের মত ভাল লাগে না। অতিথি-মত লাগে অবকাশেও। রুদ্র ঢাকায় ফিরে এলেই আমি ও বাড়িতে যাই। রুদ্র সংসারের একজন হয়ে যায়, অতিথি আমি অতিথিই থাকি। তাকে বলি, বারবার বলি, রাগ করে বলি, আদর করে বলি, বুঝিয়ে বলি, চিংড়ির ব্যবসা ছেড়ে তুমি ঢাকায় থাকা শুরু কর, ঢাকায় কিছু কর। কিন্তু ওই ব্যবসা ছেড়ে আসা সম্ভব হবে না তার। অনেক টাকা খাটিয়েছে, লেগে থাকতে হবে। রুদ্র লেগে থাকে ব্যবসায়, আমি লেগে থাকি রুদ্রে।
ফেব্রুয়ারি মাসটি রুদ্র যে করেই হোক ঢাকা থাকে। এ মাসে বই ছাপা, এ মাসে বইমেলা, এ মাসে মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পাঠ। জানুয়ারির শেষ দিকে রুদ্র তার স্বৈরাচার নিপাত করতে নিজের হাতে অস ্ত্র নেওয়ার তীব্র ইচ্ছে প্রকাশ করা কবিতাগুলো জড়ো করতে থাকে, বই ছাপবে। প্রকাশক খুঁজে লাভ হয়নি। নিজেই ছাপবে সে বই। আমাকেও বলে আমার কবিতা জড়ো করতে। গত কয়েক বছরের লেখা কবিতাগুলো খুঁজে খুঁজে আটত্রিশটি কবিতা জড়ো করি। কবিতাগুলো রুদ্রর কবিতার মতই বেশিরভাগ অন্যায় অত্যাচার বৈষ−ম্যর বিরুদ্ধে, এবং অবশ্যই স্বৈরাচারের বিপক্ষে। দুটো পাণ্ডুলিপি নীলক্ষেতে শ্মশ্রুমণ্ডিত শ্রীমণ্ডিত কবি অসীম সাহার ছাপাখানা ইত্যাদি প্রিন্টাসের্ দিয়ে আসি ছাপতে। প্রতিদিন বিকেলে দুজন ইত্যাদিতে গিয়ে প্রুফ দেখে আসি কবিতার। শাদামাটা পঈচ্ছদ তৈরি করে বই দুটো ছেপে বাধাঁই হয়ে বেরিয়ে আসে, রুদ্রর বইএর নাম ছোবল, আমারটির নাম শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা। এই প্রথম একটি কবিতার বই বের হল আমার। আনন্দধারা নিরবধি বইতে থাকে আমার ভুবনে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন দুজন মেলায় যাই। একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে বইমেলার প্রবেশদ্বারে ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের স্তন ও নিতম্ব মর্দন করার জন্য ওত পেতে থাকা থাবাগুলো থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে মেলায় ঢুকি। মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পড়ে সারাদিন মেলার ঘাসে, খাবার দোকানে, একাডেমির সিঁড়িতে, বইয়ের স্টলে, কবি লেখকদের সঙ্গে লম্বা লম্বা আড্ডা দিয়ে আমাদের চমৎকার সময় কাটতে থাকে। আড্ডার মূল বিষয় সাহিত্য এবং রাজনীতি। বাংলা একাডেমির মঞ্চে তো বটেই ভাষা আন্দোলনের এই মাসটিতে বিভিন্ন মঞ্চে রুদ্রও কবিতা পড়ে, রুদ্রর সঙ্গে যেহেতু আছি আমি, যেহেতু আমার কবিতা লেখার অভ্যেস আছে, আমাকেও কবিতা পড়তে বলা হয়, পড়ি। মেলার বিভিন্ন স্টলে দুজনের বইগুলো বিক্রির জন্য দেওয়ার পর প্রতিদিনই খবর নিয়ে দেখি রুদ্রর বই বিক্রি হচ্ছে কিছু আমার কিছুই নয়। মেলা শেষ হলে শিকড়ে বিপুল ক্ষুধার অবিক্রিত বইগুলো বাড়িতে ফেরত আনতে হয়। খাটের নিচে প্যাকেট বন্দি পড়ে থাকে বই। কবিতা যে আমার জন্য নয়, তা বেশ বুঝি। আমার যে এককালে কবিতা লেখার অভ্যেস ছিল, সেঁজুতি নামে পত্রিকা ছেপেছিলাম, সেসব এখন ইতিহাস, কবিতা লিখি না আর, কবিতা লেখা হয় না, পারি না—রুদ্রর বউ হিসেবেই আমি পরিচিত হয়ে উঠি সবখানে। কক্সবাজারে কবিতা পড়তে যাওয়ার আমন্ত্রণ জোটে রুদ্রর। বেশ কজন কবি রওনা হন কক্সবাজারে। রুদ্রর সঙ্গী হয়ে আমি। দুপুরে মহাদেব সাহা সমুদ্রে স্নান করতে নামেন লুঙ্গি পাঞ্জাবি আর কাঁধে গামছা নিয়ে। রুদ্র খালি গা। আমি ক্যাঙ্গারু গেঞ্জি আর জিনস। সূর্যাস্তের সময় সৈকতের বালুতে বসে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটি হয়। অনুরোধে ঢেকি গেলার মত কবিতা পড়তে হয় আমাকে ওখানেও।
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে মুহম্মদ নূরুল হুদাকে। কিছু তরুণ কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হল। রুদ্রকেও। সে ফরিদপুরেও গেল আমাকে সঙ্গে নিয়ে। দল বেঁধে গ্রামে গিয়ে কবি জসিমুদ্দিনের বাড়ি দেখে এলাম, এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে র বিখ্যাত ডালিম গাছটিও। রুদ্রর সঙ্গ এবং জীবনের এই প্রচণ্ড গতি ও ছন্দ আমাকে অপার আনন্দে ডুবিয়ে রাখে। জীবন তো আমার আর সাধারণ দশটি বাঙালি বধূর মত হতে পারত। তেল ডাল নুনের হিসেব করে সংসার কাটতে পারত। সমাজের কুসংস্কার আর বিধি নিষেধ অমান্য করেই তো আমরা এতদূর এসেছি। তবে আর অত বেশি সামাজিক হওয়ারই বা স্বপ্ন দেখা কেন! রুদ্রর সঙ্গে আলাদা করে একটি সংসার হল না বলে আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা একটি আক্ষেপকে আমি ঝেঁটিয়ে বিদেয় করি। রুদ্র এখন নিজের সংসারটিকে চাইছে অন্য যে কোনও সংসার থেকে সম্পণূর্ আলাদা। জগত থেকে আলাদা হয়ে, মানুষ থেকে আলাদা হয়ে দুজনে স্বাথর্প রের মত কোনও খাঁচা তৈরি করার নাম সংসার নয়। বাইরের মুক্ত জগতে আমরা বাস করব, একটি বৈষম্যহীন সুস্থ সুন্দর সমাজের জন্য আমরা লড়াই করে যাবো, এভাবেই আমরা যাপন করব বিশ্বাসে ও ভালবাসায় আমাদের যৌথ জীবন। পরষ্পরের আমরা সহযাষনী বা সহযোদ্ধা হব। ক্ষুদ্র স্বা−র্থর লেশমাত্র যেখানে থাকবে না। রুদ্রর ভাইবোনেরা মোংলা বন্দরের স্যাঁতসেঁতে সম্ভাবনাহীন পরিবেশ থেকে ঢাকায় এসে নিজেদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে এক একজন বিশাল ব্যক্তি হয়ে দেশ ও দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। ওদের আমরা আমাদের আদর্শে গড়ে তুলব।
ঢাকায় চন্দনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। স্বামী নিয়ে ও তার স্বামীর বোনের বাড়িতে ছিল ও। যতক্ষণ আমি ও বাড়িতে ছিলাম, চন্দনা আমার সঙ্গে কথা বলেছে গলা চেপে। স্বামীসহ একদিন এসেও ছিল আমাদের বাড়িতে, ইচ্ছে ছিল কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে যাবো সবাই মিলে। কিন্তু স্বামী বলল তার সময় নেই। আমার সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর কারণে চলে যেতে হয়েছে চন্দনাকে। চন্দনার জীবনটি দেখে আমার কষ্ট হয়েছে, এরকম একটি জীবনের স্বপ্ন কি ও দেখেছিল! না দেখলেও এ জীবনটিতেই ও এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গলা চেপে কথা বলা কুণ্ঠিত জীবনে। চন্দনার, আমার ধারণা হয়, আকাশ দেখারও অবসর জোটে না হয়ত। অথবা দেখতে হলেও স্বামী বা স্বামীর কোনও আত্মীয়ের অনুমতি নিতে হয়।
ফেব্রুয়ারির উৎসব ফুরোলে রুদ্র আমাকে জিজ্ঞেস করে এই সংসারে তোমার কনট্রিবিউশান কি? শুনে আমি লজ্জায় বেগুনি রং ধারণ করি। প্রতি মাসে রুদ্র যেমন টাকা ঢালছে সংসারে, আমি কেন ঢালছি না! আমার এই না ঢালার কারণটি খুব সহজ, আমার হাতে কোনও টাকা পয়না নেই ঢালার, সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করছি, চাকরিটি পেলেই, যেহেতু আমি নারী পুরুষে বৈষম্যহীন জীবনের পক্ষপাতি, আমি যে স্বামীর ওপর অর্থ নৈতিক নির্ভরতা চাই না সে আমি প্রমাণ করতে পারব তার ওপর সংসারের খরচ অর্ধেক যোগাড় করতে পারব। কিন্তু সরকারি চাকরি না হওয়াতক আমি কেন উপার্জন করার চেষ্টা করছি না, না করে নিজের শরীরটিকে একটি মেদবহুল মাংসপিণ্ড তৈরি করছি! রুদ্র বলে, যদিও আমার শরীরে মেদের ছিঁটেফোঁটা নেই বরং পিঠে পড়া লম্বা চুলগুলো গীতার প্রেরণায় ঘাড় অবদি কেটে ফেলে আরও হাড়সর্বস্ব লাগে দেখতে। রুদ্রর উৎসাহে সিদ্ধেশ্বরীতে তার বন্ধু সেলিমের ওষুধের দোকানের ভেতর ডাক্তারের চেম্বারটিকে রোগি দেখার জন্য আমার বসার ব্যবস্থা হয়। শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে
ডাঃ তসলিমা নাসরিন,
এম বি বি এস, বিএইচ এস আপার,
রোগী দেখার সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা
লেখা একটি সাইনবোডের্ ঝুলিয়ে দেয় সেলিম। ওখানে বিকেলে প্রজেশ কুমার রায় বসেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকেই পাশ করেছেন প্রজেশ, দাদার সহপাঠি ছিলেন ইশকুলে। প্রজেশ পিজি হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করেন, বিকেলে রোগী দেখতে বসেন বিএন মেডিকেল হলে। আমি প্রতিদিন হাতে স্টেথোসকোপ আর রক্তচাপ মাপার যন ্ত্র নিয়ে ফার্মেসিটিতে যাই। বসে থাকি চপু চাপ। রোগী আসার নাম গন্ধ নেই। রুদ্রকে বলি, ধুর রোগী আসে না, খামোকা বসে থাকা! রুদ্র বলে, উফ এমন বাচ্চাদের মত করো না তো! বসে থাকো, ধীরে ধীরে রোগী পাবে। দিন যায়, দু একটি রোগী যা মেলে তাতে আমার রিক্সাভাড়ার অর্ধেকও ওঠে না। কোনও একটি ক্লিনিকে চাকরি খুঁজতে থাকি। পত্রিকার পাতা দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো খুঁজতে খুঁজতে ইস্কাটনের একটি ক্লিনিকে চাকরি পেয়ে যাই। ডিউটি রাতে। মাসে দেড়হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ থেকে মাস মাস ভাতাও এই পেতাম। এ টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয় জানি। বাড়ি ভাড়াই বারোশো টাকা। কিন্তু তারপরও নিজে উপার্জন করার আনন্দই আলাদা। এ টাকায় নিজের হাত খরচ হবে, বাড়ির বাজার খরচাও হবে। ক্লিনিকে ঢোকার পর দেখি বাড়তিু উপার্জনের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আমি যদি অপারেশনে এসিস্ট করি, তবে পাঁচশ থেকে একহাজার টাকা পেতে পারি। যদি রোগীর মেন্সট্রুয়েশন রেগুলাশেন অর্থাৎ এবরশন করি, তবেও পাঁচশ টাকা পাবো। রাতে যদি রোগী আসে সে রোগী দেখা আমার দায়িত্ব। রোগি যে টাকা দেবে ক্লিনিকে, তার থেকেও পারসেনটেজ পাবো। বাহ! বেশ তো। চাকরিটি চমৎকার চলছিল। মালিক ভদ্রলোকটি বেশ আন্তরিক। তিনি আমাকে এবরশান এর কটি রোগী দিয়ে এ কাজে হাত পাকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু রোগীর ভিড় নেই এমন এক রাতে, দশটার দিকে, মালিক আমাকে দোতলায় তার আপিসরুমে ডেকে পাঠান। খুব জরুরি হলেই সাধারণত মালিক ডেকে পাঠান। কি কারণ ডাকার? না কোনও কারণ নেই, তিনি গল্প করবেন। আমি বলি আমার নিচে যেতে হবে, কারণ যে কোনও সময় রোগি আসতে পারে। আরে বাদ দেন, রোগী এলে নাসর্ আপনাকে ডাকবে, চিন্তু করবেন না। চিন্তা আমি ও নিয়ে করি না, কারণ জানি রোগী এলেই নাসর্ আমাকে খবর পাঠাবেন। চিন্তা করি মালিকের উদ্দেশ্য নিয়ে। মালিক কি কারণে আমাকে ডেকেছেন এখানে, কোনও জরুরি কথা কি আছে? থাকলে তিনি জরুরি কথাটি না বলে আমাকে বসতে বললেন কেন! বসলে ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে ঠিক কোন গলিতে আমার বাড়ি, তিনি প্রায়ই ওদিকে যান বলে কোনও এক বিকেলে আমার বাড়িতেও যাবেন, বলেন কেন! একজন কবিকে কি কারণে বিয়ে করেছি, কবিকে বিয়ে করে মোটেও বুদ্ধির কাজ করিনি, বলেন কেন! স্বামীকে আমার পাশে একদমই মানায় না, স্বামী নিয়ে আমি আদৌ সুখে আছি কি না ইত্যাদিই বা কেন! আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর এত ভাবনা কেন! আমি নিশ্চিত, এগুলো কোনও জরুরি কথা নয়। কথা বলতে বলতে যে মাঝে মাঝেই চুমুক দিচ্ছেন গেলাসে, না বললেও আমি বুঝি তিনি মদ্যপান করছেন। নিশ্চিন্তে বসে, মালিক যা চাইছেন, সুখ দুঃখের গল্প করা আমার হয় না। আমি তাঁর অবাধ্য হয়ে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে শাদা একটি কাগজে বড় বড় করে লিখি সজ্ঞানে য়ইচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি আমি।