১৩বি ও সান্তাক্লজ

১৩বি ও সান্তাক্লজ

বিরাট বড় একটা দুর্গ আর তার চারপাশে পরিখা কাটা। সেই পরিখা আবার সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত। জল ঢুকছে, বেরোচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যটা দেখতে পায় অন্তরা। আজ বহুবছর হল। সেই কবে কার্জন পার্কে পাশাপাশি বসে চিনেবাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে অনিরুদ্ধ ওকে এইরকম একটা জায়গায় হনিমুনের কথা বলেছিল। ওরা হনিমুন করতে গিয়েছিল পুরীতে, যেমন আর পাঁচজন যায়। কিন্তু তাই নিয়ে কখনও কোনও ক্ষোভ ছিল না অন্তরার। আসলে অনিরুদ্ধ আর ওর মধ্যে ভালবাসা এত প্রবল ছিল যে অন্য সব অভাব, অভিযোগের ভিতরও তা ঝিলমিলিয়ে উঠত।

তাই বলে অনিরুদ্ধর গোঁয়ারতুমি, ওর কারণে-অকারণে ছোট-ছোট মিথ্যে বলে কাজ হাসিল করার স্বভাব অন্তরার আগেও ভাল লাগত না, পরেও লাগেনি। কিন্তু ওই বদভ্যেসগুলো আগে অতটা প্রকটও ছিল না। অন্তরা আশা করেছিল একটা ভাল চাকরি, উপার্জনের নিশ্চয়তা, এইগুলো ওর স্বভাবটাও পালটে দেবে। সেই কারণেই ও প্রমিত ব্যানার্জির বাড়িতে অনিরুদ্ধর সঙ্গে বেশ কয়েকবার গেছে। অনিরুদ্ধ ওকে বুঝিয়েছিল যে এই সেই লোক, যে ওদের ভবিষ্যৎ পালটে দিতে পারে। প্রথমদিন ওখানে যাওয়ার আগে অন্তরা জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লোক তোমাদের ওই প্রমিত ব্যানার্জি?

অনিরুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে চুপ করে ছিল একটু। তারপর বলেছিল, যেরকমই হোক তোমার দিকে খারাপ চোখে তাকাবে না।

কেন আমাকে ডিসকাউন্ট দেবে শুনি?

অনিরুদ্ধ কোনও উত্তর না দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল অন্তরার পায়ের সামনে। মুখ ঘষতে শুরু করেছিল ওর কোমরে, পেটের খোলা জায়গায়। অনিরুদ্ধর গোঁফ ছিল তখন। সেই গোঁফের খোঁচায় সুড়সুড়ি আর অস্বস্তি মিলেমিশে একটা ভাল লাগা তৈরি হচ্ছিল অন্তরার মধ্যে। পাহাড়ি নদীর তিরতিরে জলের মতো ভাললাগা। তিরতিরে, কিন্তু ঠান্ডা। বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। ও তাও অনিরুদ্ধর মাথাটা না সরিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে খারাপ চোখে দেখবে না কেন?

অনিরুদ্ধ আবেগে বসে যাওয়া গলায় বলল, কোথাও না কোথাও একটা সম্রম সবার ভিতরেই কাজ করে।

অন্তরা একটা অসহ্য আনন্দে ভেসে গেল। কিন্তু অনিরুদ্ধ মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিল নিজেকে। ওর মাথাটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল অন্তরার কোমর থেকে। অন্তরা দুটো হাতে শক্ত করে ওর ঘাড়টা বেড় দিয়ে ফেলেছে বলে পারল না। না পেরে অনুনয়ের গলায় বলল, ছাড়ো সোনা, চলো এবার।

অন্তরা দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, যাব না। আমরা আজ সন্ধ্যাটা সেলিব্রেট করব। শুধু আমরা দু’জন।

ওরকম বললে হয়? প্রমিত ব্যানার্জির বাড়ির পার্টি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে নেমন্তন্ন পেতে হয় জানো?

কিন্তু নেমন্তন্ন পেয়ে কী লাভ হয়?

অনিরুদ্ধ অবাক চোখে তাকাল অন্তরার দিকে, কী লাভ হয়? তুমি জানে এই স্পেশাল পার্টিটাতে ইনভিটেশন পাওয়ার জন্য কত কাঠিবাজি করেছে কত লোক। সেখানে আমি তো বলতে গেলে প্রায় মুফতেই নেমন্তন্ন পেয়ে গেলাম। এরপরও যদি তোমাকে নিয়ে না যাই, কীরকম খারাপ দেখাবে বলো তো?

অন্তরা চুপ করে গেল। ও কিছুতেই বুঝতে পারল না রাতের একটা পার্টিতে যেতে পারা, না-পারা নিয়ে এত পলিটিক্স করবে কেন লোক। আবার ভাবল, ট্যাবলয়েডের ওই লেখালেখি, যাকে অনিরুদ্ধ নিজেই বলত, ‘আচার-কাসুন্দি’, সেই ‘আচার-কাসুন্দি’ ঘাঁটাঘাঁটি থেকে তুলে এনে প্রমিত ব্যানার্জিই ওকে এই টিভি চ্যানেলে সুযোগ দিয়েছেন, কমবেশি স্নেহও করেন ওকে। তা উনি যখন নেমন্তন্ন করেছেন তখন অনিরুদ্ধর যেতেই হবে ওর বাড়িতে, আর অন্তরারও যাওয়া উচিত অনিরুদ্ধর সঙ্গে। তাতে যদি ওর উন্নতি হয়!

অনিরুদ্ধর ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর অন্তরার বাবা বারবার জিজ্ঞেস করতেন, ঠিক কী কাজ করে অনিরুদ্ধ, ওর উন্নতির কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা। মা একধাপ এগিয়ে জিজ্ঞেস করত, খাওয়াতে পরাতে পারবে তো?

আমাকে খাওয়া-পরার জন্য বিয়ে করতে হবে কেন? আমি চাকরি করতে পারব না? অন্তরা জবাব দিত।

কিন্তু মাথা ঠান্ডা হয়ে গেলে অন্তরা বুঝল চাকরি জোগাড় করা অত সহজ নয়। তবু চেষ্টার শেষ রাখেনি ও। অনিরুদ্ধকে মাঝে মাঝে বলত সে ব্যাপারে, কিন্তু কেমন একটা অদ্ভুত উদাসীনতার সঙ্গে অনিরুদ্ধ শুনত সেইসব কথাগুলো। যেন অন্তরার চাকরি নিতান্তই অন্তরার নিজস্ব ব্যাপার, ওদের সম্পর্কের ভিতর তার অনুপ্রবেশ একান্তই অবাঞ্ছিত। কিন্তু ওদের দেখা-সাক্ষাতের পর যে যার বাড়ি ফেরার সময় অন্তরার কাছ থেকে কুড়ি-তিরিশ কিংবা পঞ্চাশ টাকা চাইতে একটুও বাধত না অনিরুদ্ধর। অন্তরা ওর টিউশনির টাকা থেকে যতটা পারত অনিরুদ্ধকে দিত। পরে বুঝেছিল সেই টাকাগুলো নিয়ে অনিরুদ্ধ এখানে সেখানে মদের ঠেকে গিয়ে বসত। এন্ট্রি ফি হিসেবে ওই যৎসামান্য টাকা দাখিল করত আর আস্তে আস্তে গলা ভেজাতে শুরু করত। তারপর একদিন মাতাল হয়ে উঠল অনিরুদ্ধ। কিন্তু ততদিনে অন্তরা ওকে বিয়ে করে ফেলেছে। বাড়ির প্রায় অমতে নমো নমো করে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল ওর বিয়ের। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বিশেষ কাউকেই বলেনি। সংস্থিতা ছিল ওর সঙ্গে সকাল থেকে। পিয়ালও অবশ্য এসেছিল। কিন্তু পিয়ালকে অন্তরা বলেনি। গানের সূত্রে পিয়ালের সঙ্গে অনিরুদ্ধর একটা আলাদা মাখামাখি তৈরি হয়েছিল। পিয়ালের গান নিয়ে ও লিখেও ছিল বোধহয়। তার জেরে কিংবা সংস্থিতাকে দেখার লোভে পিয়াল এসেছিল অনিরুদ্ধর সঙ্গে। পাঁচজন বরযাত্রীর একজন হিসেবে।

তোমার দাদা-বউদি এল না কেন? বিয়ের রাতেই অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিল অন্তরা।

বউদি আসে নাকি! বউদির পিসতুতো বোনের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এসেছিল, আমি না করে দিয়েছিলাম না? অনিরুদ্ধ উত্তর দিয়েছিল।

উত্তরটা পুরোপুরি সঠিক নয়, অন্তরা পরে জেনেছিল। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে অনিরুদ্ধকে বঞ্চিত করবে বলে ওর দাদা অনেকদিন থেকেই প্যাঁচ কষছিল। বিয়ের সময় ওকে কিছু টাকাপয়সা ধরিয়ে দিয়ে দলিলপত্রে সইসাবুদ করিয়ে নিয়েছিল। অনিরুদ্ধর মা তাই নিয়ে পরে অনেক কেঁদেছেন অন্তরার কাছে, মূলত ওঁর চাপেই অনিরুদ্ধ পরে আরও কিছু টাকা পায় পৈতৃক বাড়িতে নিজের অংশটুকু দাদার নামে লিখে দেওয়ার জন্য। সেই টাকাতেই ওদের এই দু’কামরার ফ্ল্যাট, যেটা না থাকলে আজ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হত।

কিন্তু সেদিন যখন অন্তরা একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে আর ওর নাভিতে মাথা ঘষছে অনিরুদ্ধ, অন্তরার সত্যিই মনে হয়েছিল ঘরটা যেন একটা পাঁচ মাথার মোড় আর পাঁচ দিক দিয়ে বাস-ট্রাম- ট্যাক্সি-অটোরিকশা হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওদের ছুঁতে পারছে না। এতটাই সুখী ছিল সেদিন অন্তরা। সেই সময়টা, বিয়ের পর ওই একমাত্র সময় অনিরুদ্ধর নেশা বলতে শুধু ও। চ্যানেলে কাজ পেয়ে অনিরুদ্ধর প্রতিপত্তি বেড়েছে, বেড়েছে মাইনে, অন্তরার বাঁ চোখের কোণ নাচছে আর ওদের নৈশকালীন খুনসুটিতে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে একটা স্বপ্ন, একটা আলো। অনিরুদ্ধর দমবন্ধ করা আদরের নীচে ডানা মেলতে মেলতে অন্তরার মনে হত প্রবাসে থাকা মানুষ কেন বলে মরার আগে দেশে ফিরতে চাই! মানুষকে তো একাই মরতে হয়। যদি ফিরতেই হয় তা হলে আগে ফিরতে হবে, বেঁচে থাকা যখন ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, তখন ফিরতে হবে! অনিরুদ্ধ যেমন প্রতি রাতে ফিরে আসে ওর কাছে।

প্রমিত ব্যানার্জিকে খারাপ লাগেনি অন্তরার। ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরেছিলেন ভদ্রলোক। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অনিরুদ্ধ কেন রাতের আড্ডায় বেশিক্ষণ থাকতে চায় না, আজ বুঝলাম। একটু থেমে যোগ করেছিলেন, এরকম ড্যাজলিং বউ থাকলে তো আমি রাতে আড্ডাই দিতাম না, বলে আবারও হেসে উঠেছিলেন হো-হো করে।

অন্তরার ভাল লেগেছিল সেই হাসি। ঠিক তখনই সেখানে এসে হাজির হয়েছিল রণপ্রিয় রায়, যার নাম অনিরুদ্ধই দিয়েছিল ‘রমণপ্রিয় রায়’। অন্তরা লোকটির কথা শুনেছে অনেক, কিন্তু সেই প্রথম দেখল। মাঝবয়সি, চোখে রিমলেস চশমা, মাথার মাঝখানে ছোট্ট একটা স্টিলের বাটি বসানোর মতো টাক। সামনে এসেই প্রমিতকে জিজ্ঞেস করল, কাকে ড্যাজলিং বললে প্রমিত? প্রমিত ব্যানার্জি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অন্তরাকে আর রণপ্রিয় রায় তৎক্ষণাৎ ওর সামনে এসে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল ওকে বেশ কয়েকবার। তারপর আলতো করে বলল, আপনি ঝলমলে, তবে আপনার ঝলমলানি নিচু চাবির ঝলমলানি।

অন্তরা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল।

রণপ্রিয় ওর চোখে চোখ রেখে বলল, আপনি আই-ল্যাশ ব্যবহার করেন?

অন্তরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কই না তো!

করবেন না, একদম করবেন না। আপনার অপরিমেয় স্নিগ্ধতা, কৃত্রিম চোখের পাতায় নষ্ট হয়ে যাবে। অন্তরা দেখল প্রমিত ব্যানার্জি ঘরের অন্য একটা কোণে হাসছে এবং হাসাচ্ছে। ঠিক ওর পিছনেই আজ্ঞাবহ মোসাহেব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর বর। ও হতাশ চোখে তাকাল রণপ্রিয়র দিকে।

রণপ্রিয় উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল, জাস্ট দ্যাট। ঠিক এই দৃষ্টিটাই আমি চাইছিলাম। সঙ্গমের প্রাক-মুহূর্তে ঘাইহরিণীর চোখে যে-দৃষ্টিটা থাকে, এটা ঠিক সেরকম। আচ্ছা আপনি কখনও হরিণ-হরিণীর সঙ্গম দেখেছেন?

অন্তরার কান গরম হয়ে উঠল। ও একটু সরে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল রণপ্রিয় ওর পিছন পিছন যাচ্ছে। ও দাঁড়িয়ে পড়ল আবার, বলল, আমি ওসব দেখি না।

রণপ্রিয় চাপা উল্লাসের গলায় বলল, দেখতে হবে, আমি অনেক কষ্ট করে জিয়োগ্রাফির চ্যানেল থেকে একটা সিডি জোগাড় করেছি। ওদের লন্ডন অফিস থেকে। এই শেষ যেবার লন্ডন গেলাম, সেবার।

লন্ডনের সেই বিখ্যাত ঘড়িটার কী যেন নাম? অন্তরা কথা ঘোরাবার মরিয়া চেষ্টায় বলল।

ঘড়ি? ঘড়ির কথা তুলছেন কেন? ঘড়ি হচ্ছে পৃথিবীর সব রোম্যান্সের শত্রু। ওই টিকটিক শব্দটাই অসহ্য! সব উত্তেজনা, সমস্ত সম্ভোগের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর জন্যই যেন ওর সৃষ্টি। আপনি বিগ বেনের কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন, আপনার তো জিজ্ঞেস করা উচিত টেমস নদীর কথা। টেমস নদীর উপর দিয়ে শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য একটা নতুন সেতু হয়েছে জানেন?

না, জানতাম না। কীরকম ব্রিজটা? কথা ঘুরছে আশা করে অন্তরার গলায় স্বস্তি।

রণপ্রিয় বলল, সেতুর তো রকমফের থাকে না কোনও। সেতুর একটা ধর্ম, একটাই পরিচয়। সে নদীর ওপর ঝুঁকে নদীকে ছুঁতে চায়। পুরুষ যেমন নারীকে।

অন্তরার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করল।

রণপ্রিয় ওর হাতে ধরা গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, অনিরুদ্ধ, মানে আপনার বিবাহিত বন্ধু যে-চ্যানেলে কাজ করেন সেই চ্যানেলে খুব শিগগিরই আমি একটা টক-শো হোস্ট করতে যাচ্ছি। ওটা প্রতি শুক্রবার আর শনিবার রাত সাড়ে এগারোটা থেকে সম্প্রচারিত হবে। ফোনে যৌনতা সংক্রান্ত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ওই অনুষ্ঠান থেকে দেওয়ার চেষ্টা করব। আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যেই হয়তো শুটিং শুরু হয়ে যাবে। আপনার বিবাহিত বন্ধু বলছিলেন যে টেলিকাস্টও বেশ তাড়াতাড়ি…

অন্তরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, উনি আমার স্বামী।

রণপ্রিয় গলা দিয়ে একটা চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ‘স্বামী’ শব্দটার মধ্যে একটা দাসত্ব-শৃঙ্খল আছে। সেটা ঠিক আপনার সঙ্গে যায় না। আপনার পায়ে আমি রুপোর কড়া দেখতে চাই না, রুপোর মল দেখতে চাই।

অন্তরা হঠাৎ গলা উঁচু করে ‘অ্যাই শুনছ’ বলে অনিরুদ্ধকে ডাকল। অনিরুদ্ধ তখন নিজের মদের গ্লাসটা অন্য কার একটা হাতে তুলে দিয়ে পীড়াপিড়ি করছে। অন্তরার ডাক কানে পৌঁছোতে ওকে হাত দেখিয়ে ইশারা করল। কী ইশারা করল, অন্তরা বুঝতে পারল না।

রণপ্রিয় বলল, আপনার বিবাহিত বন্ধু থুড়ি স্বামী উদার প্রকৃতির। উনি আপনাকে আনন্দ অবগাহন করতে বলছেন। আচ্ছা আমার মনে হয়, আপনি স্লিভলেস ব্লাউজ পরলেও উনি ওজর আপত্তি তুলবেন না। তাই না?

অন্তরা স্থান-কাল-পাত্র ভুলে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, আপনি তখন থেকে এসব অশ্লীল কথা আমাকে বলছেন কেন বলুন তো?

অশ্লীল? আপনার অশ্লীল ঠেকছে আমার কথাবার্তা? আমি তো শুধু আমার মুগ্ধতার কথা বলছিলাম। আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি আপনার ঊর্ধ্ববাহু জলপ্রপাতের মতো ভারী ধারালো ও কমনীয়। আপনার হাত অবগুণ্ঠনের মধ্যে থাকা মানে সৌন্দর্যের অবরুদ্ধ হয়ে থাকা। আপনি পরেন না হয়তো, কিন্তু এরপর থেকে প্লিজ স্লিভলেস পরবেন, রণপ্রিয়র গলা আবেগে কাঁপছিল।

আপনি সরুন, সামনে থেকে সরুন প্লিজ! আমি একটু টয়লেটে যাব, অন্তরা ওকে কাটানোর অন্য উপায় না খুঁজে পেয়ে বলল।

গভীর রাতে প্রচণ্ড রেগেমেগে অনিরুদ্ধকে ওইসব কথাগুলো বলার সময় অন্তরা ভেবেছিল অনিরুদ্ধও রেগে উঠবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ হো-হো করে হেসে উঠল, কে রণপ্রিয়? ও একটা হাফ-উন্মাদ। আগে ‘বিভাজিকা’, ‘বিভাজিকা’ করে পাগল হত, এখন ওর নতুন অবসেশন হয়েছে মেয়েদের হাত।

অন্তরা অন্যদিকে ফিরে শুতে শুতে বলল, মদের নেশায় তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি তো?

অনিরুদ্ধ আবার ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, প্লিজ রাগ কোরো না, তুমি যখন ডাকলে তখন আমি প্রমিতদার বড় শালাকে একটা ককটেল বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। প্রমিতদার বউয়ের ব্যাপার, বুঝতেই পারছ। বাই দ্য ওয়ে প্রমিতদার কিন্তু তোমাকে বেশ ভাল লেগেছে, আমায় বলছিল।

আমার কাউকে ভাল লাগেনি, কিছু ভাল লাগেনি, অন্তরা অনিরুদ্ধর বুকের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দিল।

অনিরুদ্ধ ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, তোমার রাগ হয়েছে? ওই রমণপ্রিয় ঢ্যামনার জন্য? আরে ওকে সবাই চেনে, ও একটা ঢোঁড়াসাপ। ফণা ওঠে না।

অন্তরা গলা নিচু করে বলল, তোমার?

কী বলতে চাইছ? অনিরুদ্ধর গলা গম্ভীর।

আমি মা হতে চাই অনি… অন্তরা জড়িয়ে ধরল ওর স্বামীকে।

রিপোর্ট যেদিন পজিটিভ এল অন্তরার মনে হয়েছিল ও নেচে নেয় একপাক। যে-প্রেম কোনও ফুচকাওয়ালার আধা পরিষ্কার হাতডোবানো জলের স্রোতে বা ড্যাম্পধরা সিনেমা হলের ভিতরে শুরু হয়েছিল, অনেক মুহূর্ত পেরিয়ে তা যেন আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। কিন্তু তখন থেকেই চাপ বাড়ল অনিরুদ্ধর ওপর। প্রমিত ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠায় ওদের অফিসে মৈনাক পালের ঘনিষ্ঠরা যতরকমভাবে সম্ভব বাঁশ দেওয়া শুরু করল অনিরুদ্ধকে। সেই শত্রুতা সামলাতে গিয়ে অনিরুদ্ধ আরও আরও ঢলে পড়তে থাকল প্রমিত ব্যানার্জির দিকে। অন্তরা একদিন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তোমার প্রমিতদা তোমায় ব্যবহার করছে না তো?

আমার আর প্রমিতদার সম্পর্কটা অদ্ভুত। ও আমায় বাঁচাবে কেন যদি ওকে আমি সাহায্য না করি? অনিরুদ্ধ মুচকি হাসল, তোমাকেও একটু সাহায্য করতে হবে, বুঝলে?

আমাকে? অন্তরা অবাক।

হ্যাঁ তোমাকে ডার্লিং। প্রমিতদার মেয়েকে একটু বাংলা-টা দেখিয়ে দিয়ে আসতে হবে। ওর অন্য সবকিছুরই প্রাইভেট টিউটর আছে।

ও, বাংলাটা শুধু ফোকটে শিখতে চায়?

না না, ফোকটে কেন? টাকা দেবে প্লাস তোমাকে নিয়ে যাবে, দিয়ে যাবে ওদের ড্রাইভার।

কিন্তু আমার এই অবস্থায়? অন্তরা পেটের ওপর একটা হাত রাখল।

অনিরুদ্ধ এগিয়ে এসে হালকা করে জড়িয়ে ধরল ওকে, প্রেগন্যান্সির সময় যত কাজকর্মের মধ্যে থাকবে তত ভাল থাকবে শরীর।

তোমার কোনও সুবিধে হবে? অন্তরা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল।

আমাদের সুবিধে হবে, অনিরুদ্ধ একটা চুমু খেল ওর কপালে।

তারপর থেকে সপ্তাহে একদিন, কোনও সপ্তাহে দু’দিন করে অন্তরা যেতে শুরু করল প্রমিত ব্যানার্জির বাড়িতে। ওর স্ত্রীকে দেখলে বোঝা যায়, উনি প্রথম যৌবনে রীতিমতো সুন্দরী ছিলেন। ধনীদের যৌবন সহজে ফুরোয় না। কিন্তু ওঁকে দেখলে অন্তরার মনে হত, ভদ্রমহিলার মন কীরকম একটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে উনি আলাদা করে কথা বলতেন অন্তরার সঙ্গে। দেশ-বিদেশে বেড়ানোর গল্প। কুর্গে বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঘন কফির বাগানে হাঁটতে হাঁটতে উনি কীভাবে হারিয়ে গেছিলেন, কাজিরাঙায় স্পেশাল পারমিশন জোগাড় করে কীভাবে দেখেছিলেন দুর্লভ প্রজাতির হরিণ, নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউনে পাহাড় আর হ্রদের রাজসিক সৌন্দর্যের ভিতরে কীভাবে এয়ারক্র্যাফটের ভিতর থেকে প্যারাশুটে চেপে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোক, হৃৎপিণ্ড কাপানো রোম্যান্সের ভিতর পাখির চেয়ে দ্রুতগতিতে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে, এই সব গল্প করার সময় মুখচোখ আলোয় ভরে যেত প্রমিত ব্যানার্জির স্ত্রী রুবির। অন্তরা হঠাৎই একদিন খেয়াল করেছিল ভদ্রমহিলার ‘ঘর’ বলতে তেমন কিছু নেই, ‘বাহির’টাই সব।

ওদের দুই মেয়ে অজন্তা, ইলোরাকে দেখার জন্য কাজের লোকের ছড়াছড়ি। সাড়ে তিন হাজার স্কোয়্যারফিট ফ্ল্যাটে কতগুলো যে ঘর-বারান্দা, অন্তরা ঠাহর পেত না। অনিরুদ্ধ বলত ছোট-বড় ফ্ল্যাট নাকি প্রমিত ব্যানার্জির কলকাতায় আরও খান চারেক আছে, তার সঙ্গে রায়চকে বাংলো। কোত্থেকে আসে এত পয়সা? একটা চ্যানেলের প্রধান সাংবাদিক কিংবা বিশ্লেষক কিংবা অ্যাঙ্কর হয়ে? অনিরুদ্ধ হাসত। বলত, ওসব ভাবতে যেয়ো না, মাথা খারাপ হয়ে যাবে। প্রমিত ব্যানার্জির বড় মেয়ে অজন্তাকে পড়াতে পড়াতে অন্তরা ভাবত টাকা সবকিছু পারে, শুধু একটা বিলাসবহুল হোটেলকে ঘর করে তুলতে পারে না। তা হলে আর মাথা খারাপ করে লাভ কী!

তোমার শরীর এখন কেমন? ঠিকঠাক তো? দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন রুবি।

অন্তরা হেসে উত্তর দিত, হ্যাঁ, ঠিকই আছে

রুবি বলতেন, আগে একটু খেয়ে নাও, তারপর পড়ানো-টড়ানো।

দু’-তিনরকম ফলের জুস, টোস্ট, চিজ, কেক আরও কত কী খাবার আসত অন্তরার জন্য। অন্তরা মনে মনে নিজের অনাগত শিশুকে বলত, খা রে ব্যাটা! পেটের ভিতর যতদিন আছিস ততদিনই এসব খেয়ে নে।

প্রমিত ব্যানার্জির সঙ্গে যে দু’-একদিন দেখা হত, উনি মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে একটি বাক্যও খরচ করতেন না। বরং অনিরুদ্ধ ওঁর কতটা কাছের, অনিরুদ্ধর ওপর উনি কতটা নির্ভর করেন, এইসব কথাই বলতেন সাতকাহন করে। গর্বে আরও দু’ইঞ্চি ফুলে যেত অন্তরা। ওর মনে হত অনিরুদ্ধ, ও আর ওদের বাচ্চাটা একটা বৃহৎ কোনও সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত, যা আকাশের মেঘের মতো উঁচুতে ভেসে বেড়ায়, বাধাহীন।

রক্তস্রোত যখন বাধা না মানা প্লাবনের মতো বইছে, ও সেই অবস্থাতেই মোবাইলে ফোন করে ধরার চেষ্টা করল অনিরুদ্ধকে, পেল না। প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল প্রমিত ব্যানার্জির বাড়ির একটা বাথরুমে, ইতালিয়ান মার্বেলের ওপর তুবড়ে যাওয়া জীবনের লাল রঙা ক্কাথের ভিতরে, যতক্ষণ পর্যন্ত না অজন্তার ভয়ার্ত ফোন পেয়ে রুবি ব্যানার্জি বাড়িতে এলেন।

নার্সিংহামে যে-ক’টা দিন ও ছিল, তার খরচাপাতি প্রমিত ব্যানার্জির পকেট থেকেই গিয়েছিল। কিন্তু ওর নাভির সঙ্গে প্রায় সাতমাস জুড়ে ছিল যার প্রাণকেন্দ্র, সেই সন্তানের মৃত্যুকে নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিতে চাইছিলেন উনি। অন্তরা সহ্য করতে পারেনি। ও চিৎকার করে উঠেছিল একসময়, আপনিই তো তখন মোবাইলে বললেন, কী অন্তরা তুমি নাকি আমার মেয়ের সঙ্গে খেলতে রাজি হচ্ছ না? খেলো, খেলো, ও যা করতে বলছে করো। নইলে ও ফোন করে করে আমার মাথাটা খেয়ে নেবে। কী বলেননি?

প্রমিত ব্যানার্জি গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, কে জানে আমার তো এসব কিছু মনে পড়ছে না।

মনে পড়ছে না? আপনার মনে পড়ছে না? অন্তরা ওর শরীরে বিঁধে থাকা স্যালাইনের নল অগ্রাহ্য করে উঠে বসল বিছানায়। আপনাদের বাড়ির জিমে যে-দুটো সাইকেল ফিক্স করা, তার একটায় অজন্তা উঠে বসল আর একটায় বসার জন্য আমার ওপর চাপাচাপি শুরু করল, আমি রাজি না হওয়ায় আপনাকে ফোন করতে শুরু করল, আপনি ফোনে আমাকে বললেন আর…

প্রমিত অন্তরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর অমনি তুমি উঠে বসলে সাইকেলে?

অনিরুদ্ধ হঠাৎ মধ্যে পড়ে বলল, প্রমিতদা হয়তো এমনিই তোমাকে বলেছিলেন। তুমি অত সিরিয়াসলি নিতে গেলে কেন! আর নিয়েই যখন ফেলেছ, তখন বাদ দাও।

কী বাদ দেব? আমার বাচ্চা, আমাদের বাচ্চা… অন্তরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর দিকে।

ওদের দু’জনের নীরবতার মধ্যে গলা খাঁকারি দিল প্রমিত, অন্তরা তুমি কত টাকা চাইছ?

মানে? অন্তরা বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে তাকাল।

মানে ঠিক কত টাকা পেলে তুমি ওই সাইকেলের গপ্পোটা বাজারে ছড়াবে? না?

অনিরুদ্ধ বলে উঠল, না না, প্রমিতদা আমরা টাকা চাইছি না। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে…

প্রমিত অনিরুদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুই চুপ কর। অন্তরা তুমি বলো। কত টাকা পেলে তোমার মনে হবে তুমি লুজার হলে না?

অন্তরার নিশ্বাসের কষ্ট শুরু হল। টাকা’, ‘লুজার’ এই শব্দগুলো কাকে বলছে প্রমিত? চব্বিশ ঘণ্টা আগে যার মিসক্যারেজ হয়েছে? পেটের ভিতর ধকধক করতে থাকা একটা প্রাণ যাকে ছেড়ে ওই ইতালিয়ান মার্বেলের ওপর লেপটে গেছে? নাকি এতক্ষণে ধুইয়ে ‘ক্লিন’ করে দেওয়া হয়েছে? অন্তরা সহ্যের সীমা দেখতে পেল না ভেজা চোখে। বলল, আপনি প্লিজ এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাবেন আমার সামনে থেকে?

অনিরুদ্ধ হাঁ হাঁ করে উঠল, কাকে কী বলছ অন্তরা!

অন্তরা ঠান্ডা গলায় বলল, তুমিও বেরিয়ে যাও প্লিজ।

অনিরুদ্ধ বলল, হ্যাঁ, বেরিয়ে তো যাবই। সবাই বেরিয়ে যাবে। তুমি একা এখানে মহারানির মতো বসে থাকবে। মনে রেখো, প্রমিতদা না থাকলে ওই সরকারি হাসপাতালের লোহার খাটে আরও দু’জনের সঙ্গে ভাগ করে শুয়ে থাকতে হত। খাটের নীচে বেড়াল কুকুর ঘুরে বেড়াত।

অন্তরা কোনও জবাব দিতে পারল না আর। কীরকম একটা আচ্ছন্নতা ওর চোখ দুটোকে গ্রাস করল। সেই অবস্থায় ও আবছা দেখতে পেল, ওদের পুরনো ভাড়াবাড়ির সেই উঠোনটা, যেখানে ওদের আশ্রিত নেড়িকুকুর ব্রাউনি তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাচ্চা দিয়েছিল পাঁচটা। বাচ্চাগুলোর জন্য মাটি খুঁড়ে বানিয়েছিল একটা বড় গর্ত। ওকে দূর থেকে খাবার দেওয়া হত সেসময়। কে যেন একটা পলিথিন শিট দিয়ে ব্রাউনির বাচ্চারা যাতে জলে না ভেজে, তার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল, হিংস্র ঘোলাটে একটা দৃষ্টি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্রাউনি। একটা কুকুর যদি তার বাচ্চাদের জন্য এতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা হলে মানুষ কীভাবে মেনে নেয় সব? প্রশ্নটা অন্তরার মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে ট্র্যাঙ্কুইলাইজারের খপ্পরে গিয়ে পড়ল। লুপ্ত হল চৈতন্য। লুপ্ত হয়ে গেল চরাচর।

তুই তারপরও থাকিস কী করে ওর সঙ্গে? একটা লাথি মেরে বেরিয়ে আসিস কেন? সংস্থিতা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ঘটনাটা ঘটার বেশ কিছুদিন পরে।

অন্তরা চুপ করে ভাবছিল গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। ও একটা ল ফার্মে চাকরি পেয়েছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চাকরি। গোদা বাংলায় অবশ্য ক্লার্ক কাম রিসেপশনিস্টও বলা যেতে পারে। অফিসেই কাজ, মাঝে মাঝে হাইকোর্ট কিংবা জেলা আদালতেও ছুটতে হয়। তা হোক, কাজের পরিবেশ ভালই। সংস্থিতাই করে দিয়েছিল কাজটা, ওর কোনও এক রিলেটিভের রেফারেন্সে। সকালে বেরিয়ে আসে, দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনেই লাঞ্চ করে, রাত্রে হোম ডেলিভারি। অনিরুদ্ধকে বলা আছে, ও না খেলে যেন আগে থেকে বলে দেয়। যেহেতু এখন অন্তরার টাকাতেই সংসার চলে, অনিরুদ্ধ যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক, ফোনে ওকে সন্ধে সাতটার মধ্যে জানিয়ে দেয় খাবে কি খাবে না। ইতিমধ্যে চাকরি গেছে অনিরুদ্ধর, প্রমিত ব্যানার্জির গুঁতোতেই গেছে। সেসময় বহু অনুনয়-বিনয় করেছে ও অন্তরার কাছে। একটিবার প্রমিতের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অন্তরা যায়নি। এমনকী ওর দাদার বাড়ি থেকে অনিরুদ্ধর মা-ও ফোন করেছিলেন অন্তরাকে। ছেলের কথা শুনে ওঁর হয়তো ধারণা হয়েছিল যে অন্তরা একটিবার বললেই অনিরুদ্ধ ফেরত পেয়ে যাবে চাকরি। হয়তো পেতও। কিন্তু অন্তরা বলেনি। একেবারে ডিভোর্সের কথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিল। চাকরি করে পায়ের নীচে একটু জমি পেলেই ওই অপদার্থ, আত্মসম্মানজ্ঞানহীনকে ছেড়ে ও চলে যাবে, এমনটাই ঠিক করা ছিল মাথার মধ্যে। কিন্তু সান্তাক্লজের জন্য পারল না। সংস্থিতাকে সেটাই বলল ও।

সান্তাক্লজ? সংস্থিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, রে। আমি গোলপার্কের কাছে ওই বড় জামাকাপড়ের দোকানে ঢোকার সময় দেখি বাইরে সান্তাক্লজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড গরম, জুন মাস তার মধ্যে কে ওই লোকটা অত ভারী জামা, টুপি, ফলস দাড়ি পরে হাতে লিফলেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কৌতূহলবশত ওর হাত থেকে একটা লিফলেট নিয়ে দেখি অফ সিজনে উলের জিনিসপত্র সস্তায় দেওয়া হচ্ছে, তারই বিজ্ঞাপনে নেমেছে সান্তা। লিফলেটটা দেখে আবার মুড়িয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। ঢুকে গিয়েছি দোকানে। টুকটাক কেনাকাটা করছি অনেকক্ষণ ধরে, হঠাৎ আমার মনে হল একবার টয়লেটে যাওয়া দরকার। যত বড় দোকানই হোক, এ তো আর মল নয়! আমাকে পিছনের একটা ঘুপচিমতো জায়গায় নিয়ে গেল ওদের একটা মেয়ে। সেখানে বাথরুমে ঢোকার আগে দেখি, ওপাশের অন্ধকারে টুপি আর দাড়িটা বাঁহাতে নিয়ে বালতি থেকে মগে করে জল তুলে মুখে ছেটাচ্ছে সান্তা মানে অনিরুদ্ধ।

অনিরুদ্ধ? সান্তা সেজেছিল?

হ্যাঁ, ঘণ্টায় কুড়ি টাকার জন্য। পিছনে পায়ের শব্দে চমকে আমাকে দেখল। আমিও দেখলাম। তুই তো আমাকে জানিস আমি জীবনে কোনওদিন বড়দিনের গিফট-টিফট চাইনি সান্তা-ফান্তার থেকে। আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে ওসবের চল ছিল না। কিন্তু ওই বাঁহাতে টুপি আর দাড়ি নিয়ে জলে ভেজা মুখ তুলে অনিরুদ্ধ যখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার মনে হল, জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে সান্তাক্লজই যেন আমার থেকে কিছু চাইছে, চাইছে যেন আমি ওকে কোনওদিন ছেড়ে না যাই।

সংস্থিতা ধরে যাওয়া গলায় বলল, ঠাকুর তোদের ভালবাসাকে নিশ্চয়ই পূর্ণতা দেবেন!

অন্তরা হেসে বলল, নাও দিতে পারেন, ভালবাসা ব্যাপারটাই তো অগঠিত, অপূর্ণ। কিন্তু তুই ফোনে পিউয়ের ব্যাপারে যা বলছিলি, সেটাতে স্টিক করে থাকবি তো?

ডেফিনিটলি থাকব। এখানে তো কোনও ভালবাসা, কোনও সান্তাক্লজ নেই। শুধু অনেক পয়সা আর পয়সার জোরে চিটিংবাজি আছে।

তা হলে প্রাথমিকভাবে একটা ১৩বি ধারায় মামলা রুজু করতে হবে।

১৩বি মানে?

মিউচুয়াল ডিভোর্সের মামলা তো ওই সেকশনেই হয়।

আর যদি মিউচুয়াল না দেয়? সংস্থিতার গলায় ভয়।

তা হলে অন্য রাস্তা নিতে হবে। তুই ভাবিস না, আমি ব্যাপারটা দেখছি। তারপর তুই মিস্টার গুহর সঙ্গে কথা বলবি, অন্তরা বলল।

সে না হয় বলব, কিন্তু ল ফার্মে কাজ করতে করতে আমার বন্ধু এখন অর্ধেক উকিল হয়ে উঠেছে বল, সংস্থিতা হাসল।

বাড়ি ফেরার রাস্তায় সংস্থিতার হাসিটা বিঁধতে শুরু করল অন্তরাকে। ও তো ওকালতি বুঝতে চায়নি, ১৩বি বুঝতে চায়নি। ও শুধু চেয়েছিল ঘর-গৃহস্থালির ভিতরের ভালবাসাটুকু বুঝতে পারেনি। পারেনি বলেই হয়তো পাতালের প্ল্যাটফর্মে নামতে নামতে অন্তরা মনে মনে বলল, সেই আগেকার মতো আমার জিভের ভিতর তোমার জিভটা দিয়ে একটা ক্যাম্পফায়ার জ্বালিয়ে তোলো না সান্তা। চারপাশ বড় বেরং, বেজান হয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *