ফেরার পথ নাই

ফেরার পথ নাই

চেনা রাস্তায় মানুষ যখন হারিয়ে যায়, চেনা লোকজনের ভিতর মানুষের যখন নিজেকে একা লাগে, সে কী করে? অনিরুদ্ধ জানে না। শিয়ালদা ফ্লাইওভার টপকে এই রাস্তায় নামামাত্র অজস্র বাস-ট্রাম-গাড়ি-ট্যাক্সির মধ্যে দিয়ে গলে ও একটা কোথাও পৌঁছোতে চাইছে। সেই জায়গাটা কোথায়? কে সেখানে অপেক্ষা করছে ওর জন্য? সেই লোক কি ওর চেনা না অচেনা?

তোমাকে অসহ্য লাগে, অসহ্য! তোমায় দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় তোমার জন্য আমার কী ক্ষতি হয়েছে জীবনে, কী সর্বনাশ হয়েছে আমার তোমাকে বিয়ে করে, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অন্তরা বলছিল।

অনিরুদ্ধ ওর থেকে একটু সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সর্বনাশ মানেই কিন্তু ধ্বংস নয়, জানো!

মানে? অন্তরা মুখ ঝামটা দিল।

‘কলকাতায় দক্ষিণ ভারতীয়রা’ বলে আমি ধারাবাহিক একটা লেখা লিখেছিলাম। তোমার মনে আছে? সেসময় এক কন্নড় ভদ্রলোক আমায় বলেছিলেন, ইংরেজি থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করতে গিয়ে ওঁর বড় ভুল হয়েছিল। ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’ এই লাইনটায় সর্বনাশ ব্যাপারটার মধ্যেও একটা রোম্যান্স আছে, চার্ম আছে। কিন্তু ইংরেজিতে ‘ডেসট্রাকশন’ বললেই একটা ধ্বংসস্তূপের ছবি ভেসে ওঠে মাথায়।

তোমার এইসব রাবিশ গাঁজাখুরি বন্ধ করবে? অন্তরা খেঁকিয়ে উঠল।

খারাপ লাগল অনিরুদ্ধর। ও খুব আশা করেছিল, গল্পটা চলাকালীনই অন্তরা বলে উঠবে, ‘সেই এস কে মুথাপ্পা তো?’ আর ওদের খচাখচি পলকে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে একটা খোশগল্পের চেহারা নেবে। এভাবেই হয়ে এসেছে এতকাল। এভাবেই টিকে গেছে ওরা। কিন্তু আর বোধহয় নয়…

ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা না হলে সব প্রবলেমই ক্রিটিক্যাল হয়ে ওঠে। তবে আমার মনে হয় এক্ষেত্রে একটা অপারেশন করালে প্রবলেম অনেকটাই সল্‌ভ হয়ে যাবে, ডাক্তার সামন্ত অন্তরাকে প্রাথমিকভাবে দেখে বললেন।

অপারেশন করাতেই হবে? ওষুধপত্র দিয়ে কাজ চালানো যাবে না?

ডাক্তার সামন্ত একটু বিরক্তির গলায় বললেন, এই আপনাদের একটা অদ্ভুত মাইন্ডসেট জানেন তো। ওষুধে যদি কাজ হত আমি অপারেশনের কথা বলতাম?

অন্তরা এই সময় বলল, আপনি ওর কথা বাদ দিন তো ডাক্তারবাবু, আপনি যা বলবেন তাই হবে।

অনিরুদ্ধ অন্তরার দিকে একটিবারও না তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই তাই হবে। কিন্তু কী হবে সেটা তো আমাকে বুঝতে হবে।

ডাক্তার সামন্ত বললেন, বোঝাব, তবে এখন নয় পরে। আগে মিসেসের আলট্রাসোনোগ্রাফিটা করে আনুন।

বাইরে বেরিয়েই বার্স্ট করল অন্তরা। কিন্তু কী এমন খারাপ কথা বলেছে ও? আর তা ছাড়া অপারেশন ড. সামন্তই করুন আর যেই করুন, অপারেশন করবে কিনা সেই সিদ্ধান্তটা তো ওকে আর অন্তরাকেই নিতে হবে। অতই সোজা? বাসবদার ভাইঝি মরে গেল না ছোট্ট একটা অপারেশন করাতে গিয়ে? কী হয়েছিল? না, অ্যানাসথেসিয়ার ডোজ একটু বেশি পড়ে গিয়েছিল। সামান্য একটু বেশি। যার জন্য রুগি আর কোনওদিন জাগলই না। অন্তরার যদি সেরকম হয়… আতঙ্কে শিউরে উঠে অন্তরার হাতটা ধরল অনিরুদ্ধ। একটা ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল অন্তরা। আবারও খারাপ লাগল অনিরুদ্ধর এবং আবারও ও কিছু বলল না।

কী বলবে? সেই হানিমুনে পুরীতে গিয়ে অন্তরা ওকে বলেছিল, সমুদ্রের ঢেউ আর সি-বিচের বালির সারারাত কী এত ঝগড়া বলো তো? নিজেরাও ঘুমোবে না, অন্যদেরও ঘুমোতে দেবে না?

অনিরুদ্ধ ওর বউকে জাপটে ধরে বলেছিল, শুধু ঝগড়াটাই দেখলে, ভালবাসা দেখলে না?

আজ মনে হয়, ঝগড়াই। আর যখন ঝগড়াই, তখন আওয়াজ না করেই করা উচিত। অন্যদের ঘুমোতে দেওয়া উচিত। দু’জন দু’পাশ ফিরে শুয়ে থাকাটা একরকম অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল অনিরুদ্ধর। কিন্তু চেন্নাই চলে যাওয়ার আগে একদিন সংস্থিতা এল ওদের ফ্ল্যাটে আর ঘুমের তলা থেকে কে যেন কুড়িয়ে নিয়ে এল জাগরণ, ছাইভস্মের ভিতর থেকে ঝলমলিয়ে উঠল বহুবর্ণ পাথর। সেই দিনগুলো, যখন অনিরুদ্ধ সংস্থিতাদের কলেজের বাইরে অপেক্ষা করত আর অন্তরা ওর প্রিয়তম বান্ধবীর সঙ্গে হেঁটে বেরিয়ে যেতে যেতে ইশারায় ওকে পিছু নিতে বলত, ফিরে এল। বিস্মৃতির কুয়োর ভিতর থেকে দড়ি-বালতি ছাড়া, উঠে এল যেন। ওদের ঘরের খাটটার এক কোণে বসল। অন্তরার দেওয়া চা খেল। সংস্থিতার আনা মিষ্টি খেল। আর চলে যাওয়ার আগে সংস্থিতার মুখ দিয়ে বলল, একটা দুর্ঘটনার কাছে জীবনটাকে বন্ধক রাখিস না অন্তরা। ছাড়িয়ে আন। আবার আগের মতো করে বাঁচ।

অন্তরা বলল, আমাকে বলছিস কেন, ওকে বল।

সংস্থিতা বলল, তোদের দু’জনকেই বলছি, আর-একবার চেষ্টা কর।

অন্তরা বলল, চেষ্টা করিনি নাকি? সন্ধে হলেই ওর মদের নেশায় কুকুরের মতো লোকের পিছন পিছন ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করার জন্য পায়ে মাথা কুটতে বাকি রেখেছি শুধু।

সংস্থিতা বিরক্ত গলায় বলল, কেন খাও অনিরুদ্ধদা? কল্লোলকে না হয় কল্লোলের দিদি প্যারিসে নিয়ে গেছে, তোমার লিভার পচলে তোমাকে কে কোথায় নিয়ে যাবে?

ওর বন্ধুরা নিয়ে যাবে, পটলডাঙায়, অন্তরা বলল।

অনিরুদ্ধ যেন শুনতে পায়নি এভাবে বলল, কল্লোল প্যারিসে গেছে?

সংস্থিতা গলা নামিয়ে বলল, ওর দিদি কলকাতায় এসে আমাকে ফোন, করেছিল। বলল যে খুব খারাপ অবস্থা কল্লোলের। ওদের পক্ষে এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়, তাই ভাইকেও নিয়ে যাচ্ছে।

তোকে যেতে বলল সঙ্গে? অন্তরা বলল।

একবারও নয়। ওর দিদি জানে আমাদের ব্রেক-আপের কথা, সংস্থিতা বলল।

তা হলে ফোন করল? অন্তরা জিজ্ঞেস করল।

সেটা সৌজন্য অন্তরা। আমার সঙ্গে কল্লোলের একটা সম্পর্ক ছিল, ওর দিদি আগে আগে ইন্ডিয়ায় এলে আমরা আড্ডা দিয়েছি বহুবার, সেই জায়গা থেকেই কথা বলার জন্য ফোন করেছিল।

অন্তরা আমার সঙ্গে ঠিক করে কথাও বলে না জানিস তো, অনিরুদ্ধ যেন কথাটা এক্ষুনি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, এভাবে বলল।

অন্তরা একটা ঘেন্নার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের সন্তানের খুনির সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে যার বাধে না, তার সঙ্গে কথা বলতে আমার রুচিতে বাধে।

সংস্থিতা দেখল অনিরুদ্ধর মুখটা কালো হয়ে গেল। ও অন্তরার হাতটা চেপে ধরে বলল, বাদ দে না অন্তরা, ওই প্রসঙ্গটা। অনেকদিন তো হয়ে গেল।

তুই নিজে কখনও প্রেগন্যান্ট হলে বুঝতি, একশো বছরেও বাদ দেওয়া যায় না, অন্তরার মুখটা বেঁকে গিল কান্নায়।

সংস্থিতা ওকে জড়িয়ে ধরল, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু জীবনে কিছু কিছু জিনিসকে একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দেখতে হয়। তোরা তো নতুন করে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতেই পারিস।

কে করবে প্ল্যান? আমার অনেক প্রবলেম শুরু হয়েছে আর অনিরুদ্ধ মদ খেয়ে ফিরে এসে কুকুরের ডাক ডাকে, অন্তরা ঝাঁঝিয়ে উঠল।

অনিরুদ্ধদা রাতে বাড়ি ফিরে কুকুরের ডাক ডাকে? সংস্থিতা হতভম্ব।

আরে না না, ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়, অনিরুদ্ধ ধামাচাপা দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করল।

অন্তরা বলল, ও ভয় পাচ্ছে। ওর মাস্টারপ্ল্যান যদি তুই কোথাও ফাঁস করে দিস।

অনিরুদ্ধ নেহাতই লজ্জা পেয়ে বলল, বাজে বোকো না অন্তরা। সংস্থিতা কীরকম মেয়ে আমি জানি। আর তা ছাড়া ‘ভৌ’ যখন চালু হবে তখন তার থিম সং পিয়ালই গাইবে।

সংস্থিতা নড়েচড়ে বসল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না অনিরুদ্ধদা।

অন্তরা বলল, আরে ওরা একটা রেডিয়ো স্টেশন খোলার তাল করছে, সেখানে মানুষ ফোন ধরে ‘ভৌ’ ‘ভৌ’ করবে।

মানে? সংস্থিতা চোখ কপালে তুলল।

সংস্থিতা ব্যাপারটায় অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই, বলে অনিরুদ্ধ সংক্ষেপে ওকে ওদের খসড়াটা শোনাল।

সংস্থিতা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল, হেসে উঠল খিলখিল করে। তারপর দুম করে জিজ্ঞেস করল, পিয়াল থিম সং গাইবে ওই কথাটা আমাকে শোনালে কেন অনিরুদ্ধদা?

অন্তরা বলল, তোকে শোনাল কারণ ও ভাবল ওই কথাটা শুনলে তোর লেজ নড়ে উঠবে।

অনিরুদ্ধ হঠাৎ রেগে গেল, সব কিছুকেই হেয় কোরো না অন্তরা। পিয়াল আজও সংস্থিতাকে ভালবাসে।

কিন্তু আমি কি বাসি অনিরুদ্ধদা?

অনিরুদ্ধ বলল, ভালবাসার ব্যাপারটা আমরা কেউই ঠিক জানি না। কিন্তু একটু ভেবে দেখো তো ব্যাপারটা এরকমই কিনা?

সংস্থিতা বলল, বেশ, সময় নিয়ে ভেবে তোমায় জানাব। কিন্তু তুমি অন্তরাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটা জায়গায় যাবে।

কোথায় বলো তো?

আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা, ফোন নম্বর দিচ্ছি, তার কাছে।

কীসের ডাক্তার?

কীসের ডাক্তার তুমি বুঝতে পারছ না? তোমাদের কি আমি এখন ইএনটি স্পেশ্যালিস্টের কাছে পাঠাব? সংস্থিতা রাগী গলায় বলল। তারপর হেসে ফেলল। আর সেই হাসি সংক্রামিত রোগের মতো ছড়িয়ে গেল গোটা ঘরে। অনিরুদ্ধ, অন্তরাও যোগ দিল তাতে।

কিন্তু হাসির উলটোপিঠেই কান্না। অন্তরা যে-মুহূর্তে বুঝল যে অনিরুদ্ধ ওকে সংস্থিতার বলে যাওয়া ডাক্তারের কাছে আনেনি, ও বিগড়ে গেল। অনিরুদ্ধ ওকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করল যে আটশো টাকা ভিজিট দিয়ে সংস্থিতার রেফার করা ডাক্তারকে পরে দেখালেও চলবে, এই মুহূর্তে মোটামুটি ভাল একজন ডাক্তারকে কনসাল্ট করে দেখাই যাক না কী হয়! কিন্তু অন্তরার ওই এক গোঁ, টাকাটা তো আমিই দিতাম।

অনিরুদ্ধ ধৈর্য হারিয়ে বলল, আমি দিতাম, আমি দিতাম করছ কেন? তুমি রোজগার করো, আমি জানি।

আর তুমি যে করো না, সারা দুনিয়া জানে।

তুমিই জানিয়েছ।

বেশ করেছি। আচ্ছা, কত টাকা বাঁচল এই ডাক্তারকে দেখিয়ে? কত মদ হবে সেই টাকায়?

আমি মদ খাব বলে টাকাটা বাঁচাচ্ছিলাম না অন্তরা। এই তোমার মাথায় হাত রেখে বলছি, তুমি বিশ্বাস করো, অনিরুদ্ধর গলা বসে গেল।

তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারি না। তবু বলল, অন্তরা বলল।

আমি অনেকের কাছ থেকে ডাক্তার সামন্তর কথা শুনেছি, উনি ভাল ডাক্তার।

কিন্তু গৌরব বক্সি তো এই ফিল্ডে বেস্ট, তাই না?

কে বেস্ট সেটা কে ঠিক করে বলো তো? মানলাম নামজাদা প্রজনন বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে একজন ডাক্তারের আটশো টাকা ভিজিট কেন হবে, অন্তরা?

হাজার-হাজার লোক তো দেখাচ্ছে…

মানুষ হয়তো নিরুপায়, অনিরুদ্ধ বলল।

কীসের নিরুপায়? অন্য ডাক্তার নেই? তবু কেন আসছে লোকে? ওই যে হেল্‌থ ম্যাগাজিনটা পড়ছিলাম, পাতায় পাতায় সব নাম-ঠিকানা সমেত উপকৃত রুগিদের ছবি! তারা সবাই বলছে ডাক্তারবাবু ভগবান, অন্তরা বলল।

অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে বলল, মানুষই ভগবান হয়। কিন্তু আগে ভগবান হয়ে মানুষ ফুল-বেলপাতা, নকুলদানা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এসব চাইত। এখন মানুষ ভগবান হয়ে আটশো টাকা ভিজিট চায় শুধু। মানুষ ডাক্তার হলে কত আর ভিজিট পেত বলো?

ইয়ারকি মেরো না, ভাল লাগছে না।

আমি ইয়ারকি মারছি না। আমি শুধু বলছি মানুষের সঙ্গে ভগবানের ফারাক কত কমে এসেছে। মাত্র চার-পাঁচশো টাকার ফারাক।

এক ধরনের মানুষের সঙ্গে কুকুরের ফারাক বোধহয় আরও কমে এসেছে। দু’দলকেই যখন ইচ্ছে লাথি মেরে বের করে দেওয়া যায়, তাই না?

ঠিক বলেছ অন্তরা, একদম ঠিক। আমি নিজেই তো তাদের দলে পড়ি, বলে হো-হো করে হেসে উঠল অনিরুদ্ধ।

আজ কলেজ স্ট্রিটের সেই নির্দিষ্ট বইয়ের দোকানটায় বাসবদাকে না পেয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো এ-ফুটপাথে, ও-ফুটপাথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনিরুদ্ধর মনে হচ্ছিল ও কেন হাসল গতকাল? কেন ও অন্তরাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল না সেইসব রাস্তায়, সেইসব অন্ধকারে, যেখানে ওরা পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করত, পরস্পরকে ছেড়ে যেতে চাইত না? ও কেন বলতে পারল না যে অন্তরার টাকায় অন্তরা ওই গৌরব বক্সিকে ভিজিট দেবে, সেটা ও মানতে পারেনি বলেই দু’দিন আগে সায়ন্তনের কাছে টাকা চাইতে গিয়েছিল। কিন্তু তিনতলায় ওঠার মুখে যে-চিৎকারটা কানে আসছিল, ওদের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দেখল সেটাই প্রলয়।

তোমার প্যারানোইয়া হয়ে গেছে, রূপমতীর গলা পেল অনিরুদ্ধ।

ওকে তাই হয়েছে আমার। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? সায়ন্তনের গলা উঁচু তারে বাঁধা।

আমার আবার কী হবে? নাথিং।

দেন হোয়াই আর ইউ ফ্লার্টিং ওপেনলি উইথ দ্যাট গাই রূপু?

ওদের কলিং বেলে হাত রেখে কিন্তু না বাজিয়ে অনিরুদ্ধ আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল ঠিক কী হয়েছে ওদের মধ্যে।

হি ইজ মাই ফ্রেন্ড সানি। ও লন্ডনে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে যদি কোনও গিফট আনে আমার জন্য, হাউ ক্যান আই সে নো? রূপমতী বলল।

গিফট? বই, জুয়েলারি, হ্যান্ডব্যাগ অন্য কোনও গিফট ওর চোখে পড়ল না? ও ব্রা নিয়ে এল তোমার জন্য? সায়ন্তন উত্তেজিত।

এটা একটা ফরাসি ডিজাইনারের কালেকশন। জাস্ট একটা ব্রা নয়, রূপমতী আদুরে গলায় বলল।

আমি ওরকম হাজারটা এনে দেব তোমাকে। বাট রূপু, ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে তুমি এড়িয়ে চলবে, প্রমিস মি, ইউ আর ওনলি মাইন। শুধু আমার তুমি, না না, আমাকে রেজিস্ট কোরো না।

ও সানি, নট নাও, আমি মুলতানি মাটি মুখে লাগিয়েছি…

ওটা মাটি নয়, চন্দন, আমার মুখেও লেগে যাক রূপু…

তারপর শুধুই শব্দ। হ্রস্ব, দীর্ঘ। আর শব্দের ভিতরে শব্দচিহ্নিত কোনও ক্রিয়া। আদিম, চিরনতুন।

বেল না বাজিয়েই চলে এল অনিরুদ্ধ। ‘মাটি নয় চন্দন’, সায়ন্তনের ওই কথাটা কানে বাজছিল ওর। ভালবাসাই তো পারে মাটিকে চন্দন করে তুলতে, তা হলে ভালবাসা অন্তরা আর ওর সম্পর্কটাকেও নিশ্চয়ই ঝিনুকের মতো জাগিয়ে তুলতে পারবে বালির ভিতর থেকে।

কিন্তু গতকালের পর থেকে ওর শুধু মনে হচ্ছে বাঁধন আলগা হয়ে গেলে শুধু সম্পর্ক কেন, কিছুই টেকে না।

বাসবদা আজ ওর সঙ্গে দেখা করবে বলেছিল। অদ্ভুত জ্ঞানী মানুষ এই বাসবদা। তার সঙ্গে প্রখর রসবোধ। কিন্তু সংবাদপত্রে পুলিশ আর আইন-আদালত রিপোর্ট করে গেলেন সারাজীবন। ওঁর লেখার শিরোনামগুলো এখনও চোখে ভাসে অনিরুদ্ধর। ‘গোলাপি সায়া পরা টাটকা যুবতীর লাশ’!

মরে যাওয়া যুবতী টাটকা হয় কী করে?

অনিরুদ্ধ একবার জিজ্ঞেস করেছিল বাসবদাকে। তখন বাসবদাদের কাগজ বন্ধ হব-হব করছে। বাসবদা তবু নির্বিকারচিত্তে জবাব দিয়েছিল, মাংসের গন্ধ না পেলে কি শকুনের ডানায় বাতাস লাগে রে বাচ্চু! ক্রাইমের গায়ে একটু সেক্স না দিলে লোকে পয়সা খরচ করে কিনে পড়বে কেন?

গল্পটা শুনে সায়ন্তন ওকে বাসবদার খোঁজ করতে বলেছিল। ‘ভৌ’-তে নাকি এরকম লোকের দরকার। কিন্তু কোথায় বাসবদা? মাইনে ছাড়া, পিএফ ছাড়া সারভাইভ করছে? ভাবতে ভাবতে কলেজ স্ট্রিটের দোকানটার কথা মনে পড়ল। বাসবদার কোনও ফোন নম্বর ওরা দিতে পারল না, তবে মঙ্গলবার আসতে বলল। আজ মঙ্গলবার, বাসবদা এল না কেন?

মদ নিয়ে সবার অত খোঁটা, অনিরুদ্ধ ভেবেছিল আজ থেকেই ছাড়বে মদ। কিন্তু বাসবদার অসাক্ষাৎ ওর ভিতরে এমন একটা তোলপাড় শুরু করল যে ওই সোনালি তরল ওকে প্রাণপণে টানতে শুরু করল। কোথায় যাবে ও এখন? মধ্য কলকাতার সেই গোলমেলে পানশালায়?

গলির মুখের মোবাইলের দোকানের বাচ্চা ছেলেটা ওকে দেখে হাসল। সায়ন্তনের চোট লাগা দামি মোবাইলটা এখান থেকে তিনশো টাকায় সারিয়ে সাতশো টাকার বিল করিয়েছিল ও, মালিককে কিছু দিতে হয়নি, ওই ছেলেটাকে কুড়ি টাকা দিয়েছিল। তাই হাসল হয়তো।

আপ মুঝসে পুলওভার খরিদে থে, ইয়াদ হ্যায়? লম্বা লোকটা ওর উলটোদিকের চেয়ারে এসে বসল।

পুলওভার, শীত ঘুম, সাপ, সার্কাস সব দুলতে লাগল অনিরুদ্ধর মাথার ভিতর। লোকটা বলল, যিতনা দিল করে পিয়ো। বিল কা ফিকর মত করো।

অনিরুদ্ধ বলতে চাইল, কিঁউ? কিন্তু বলল, শুক্রিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *