এসো আমার ঘরে এসো

এসো আমার ঘরে এসো

তোমার কেন মনে হল যে রূপমতী ওর নিজের ফ্ল্যাটেই আছে? তনুশ্রী জিজ্ঞেস করল।

ওই বাইরে থেকে তালা ঝুলছে ব্যাপারটা শুনে মনে হয়েছিল, কিংশুক বলল।

বাইরে থেকে তালা তো ঝোলাতেই পারে। আমরাও তো কোথাও বেরোতে গেলে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাই, তনুশ্রী সহজ গলায় বলল।

কিংশুক চুপ করে গেল। ও চাইলে তনুশ্রীকে বলতেই পারত মৃদুলদার ফ্ল্যাটে যেদিন মৃত্তিকাকে নিয়ে গিয়েছিল ও, সেদিন মৃদুলদা বেরিয়ে যাওয়ার সময় দারোয়ানকে দিয়ে ফ্ল্যাটের বাইরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিংশুক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তালা ঝোলাচ্ছ কেন মৃদুলদা?

মৃদুলদা বলেছিল, আমার খোঁজে অনেকে দুমদাম এসে পড়ে রে! তালা দেখলে তারা ফিরে যাবে।

কিংশুক বলেছিল, কিন্তু তোমার দারোয়ান তো নীচ থেকেই বলে দিতে পারবে তুমি বাড়ি নেই।

মৃদুলদা একটু গম্ভীর গলায় বলেছিল, লক্ষণ আমার কাজের লোক নয় সুকু। ওকে এই বাড়ির বারোটা ফ্ল্যাটের ফাইফরমাশ খাটতে হয়। ও যখন দোকানে যাবে কিংবা কাপড় ইস্ত্রি করাতে যাবে, তখন যদি এসে পড়ে কেউ? তুই চিন্তা করিস না, লক্ষণকে বলা আছে ও ঘণ্টা তিনেক পরে তোর তালা খুলে দেবে। নাকি আরও বেশি সময় লাগবে?

মৃদুলদার শেষ কথাটা খারাপ লেগেছিল কিংশুকের। মৃদুলদা কি ভাবছে ও ফুর্তি করতে চেয়ে মৃদুলদাকে ব্যবহার করছে? অবশ্য তখনও ও জানত না মৃদুলদার আয়ু আর ঘণ্টা চারেক।

সেদিন ও বলতে গেলে চুপ করে বসেছিল মৃত্তিকার সামনে। কোনও আকর্ষণ কাজ করছিল না। ওর শুধু মনে হচ্ছিল, সেই কোন ছোটবেলা থেকে ওকে সকলের চেয়ে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারা মৃদুলদা ওকে ব্যঙ্গ করে গেল?

কিন্তু জীবন মৃদুলদাকে নিয়ে অত বড় ব্যঙ্গ করল কেন? যে-লোকটা সময় মেপে প্রত্যেকটা কাজ করত তার সময় যে এমন ক্ষমাহীনভাবে মাপা আছে সে জানত না? যে-দরজাটা খোলার কথা ছিল, লক্ষণ সেটা তিন ঘণ্টার অনেক আগেই খুলে দিয়েছিল, কিন্তু মৃদুলদার সেই অগস্ত্য যাত্রা অনেক জানলা বন্ধ করে দিয়ে গেছে কিংশুকের, হাজার টানাটানিতেও যারা আর খুলবে না।

বাসবদার ভাইঝিকে ভিতরে নিয়ে যখন চুল্লি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংশুক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটা মেয়ে অ্যানাসথেসিয়ার ডোজ বেশি হয়ে যাওয়ায় চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল ও কিছুতেই মানতে পারছিল না। তার আগে ওর সামান্যই পরিচয় বাসবদার সঙ্গে। কিন্তু সেদিন অনিরুদ্ধর পীড়াপীড়িতে ও যেতে বাধ্য হয়েছিল কেওড়াতলা শ্মশানে। অনিরুদ্ধ তখন সদ্য সদ্য লাথ খেয়েছে প্রমিত ব্যানার্জির থেকে। পাগলের মতো একে-ওকে ধরে বেড়াচ্ছে একটা চাকরির জন্য। কিন্তু চাকরি তো দূরস্থান, ওকে দেখলে তখন ওর বহুদিনের পুরনো বন্ধুরাও ফুটপাথ বদল করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। হয়তো বাসবদা ওকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকবেন, তাই বাসবদার শোকে ওঁর পাশে থাকার জন্য অনিরুদ্ধ খেপে উঠেছিল। কিন্তু টিটকিরি, তামাশার ভয়ে ও তখন চেনা-জানা মহলে একা-একা যেতেই পারছে না। তাই কিংশুক।

কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হল না। জবাজার থেকে কিংশুককে সঙ্গে নিয়ে অনিরুদ্ধ বাসবদার ভাইঝির শেষযাত্রার খাট কিনে এনেছিল ফুটপাথ থেকে এবং ছ’শো কুড়ি টাকা লাগলেও ছ’শো টাকা নিয়েছিল বাসবদার কাছ থেকে। কিংশুক সাক্ষী। কিন্তু সেই খাট-বিক্রেতা ছেলেটা কেওড়াতলায় চলে এসে ওদের খুঁজে বের করল আর ওরা টাকা না দিয়েই খাট নিয়ে চলে এসেছে বলে চেঁচাতে লাগল। ওর সঙ্গের দুটো ছেলে চেঁচাতে শুরু করল আরও জোরে। আর তখনই শুরু হল ফিসফাস। অনিরুদ্ধ দেয়নি, অনিরুদ্ধ নিশ্চয়ই ওই শেষ শয়ানের খাটের পয়সাও চুরি করেছে। চেনা-আধো চেনা মিডিয়ার লোকের ভিতর থেকেই উঠে এল সেই গুনগুনানি। কিংশুক প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ানো সত্ত্বেও উঠে এল, কেউ কেউ টাকাটা আবার দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে বললেন ওই খাট-বিক্রেতার সঙ্গে। আর তখনই একটা পাহাড়ের মতো অনিরুদ্ধর পিছনে দাঁড়ালেন বাসবদা। বললেন, “আমার যে-সর্বনাশ আজকে হয়েছে তাতে ছ’শো কেন ছ’হাজার টাকা আবার দিতে হলেও কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু আমি দেব না। কারণ ওদের দু’বার টাকা দিলে অনিরুদ্ধকে চোর প্রমাণ করা হয়। আর আমি জানি, অনিরুদ্ধ চোর নয়।’

অনিরুদ্ধকে জীবনে ওই একবার কাঁদতে দেখেছিল কিংশুক। সেই মুহূর্তেই বাসবদাকে ভারী ভাল লেগেছিল ওর। ‘অনিরুদ্ধ চোর নয়’, ওই তিনটে শব্দে অনিরুদ্ধর সম্মান নীলে চোবানো কাপড়ের উজ্জ্বলতার মতো বেড়ে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল ফিসফাস।

তনুশ্রীর সঙ্গে ওর মেলামেশা যখন এর-ওর-তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তখন ফিসফাস শুরু হবে বলাই বাহুল্য। তনুশ্রীকে সেই কথাটা বলায় তনুশ্রী বলল, আমাদের বেঁচে থাকার পুরো ভিত্তিটাই নেগেটিভ, তুমি খেয়াল করেছ? আমি যদি পাঁচটা লোককে গিয়ে বলি কিংশুকের সঙ্গে আলাপ হল, ও মহা হারামি, আমার বুকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সবাই বলবে, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’ আমরাও জানতাম ব্যাটা আসলে এই রকম, প্রমাণ পাচ্ছিলাম না এই যা। আবার তুমি যদি বলো, তনুশ্রী তো বিশ্ব-বদ, তো সকলে বলবে সে আর বলতে। মৈনাক পালের সঙ্গে শুয়ে নিশ্চয়ই পয়সা পায়নি তাই লোকটাকে ফাঁসাল।

কিংশুক অন্যমনস্ক গলায় বলল, আর যদি বলি যে, আমাদের পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করে খুব ভাল লেগেছে?

তনুশ্রী হাসল, তা হলেই ভুরু কুঁচকে যাবে লোকজনের। কী ব্যাপার, ওরা দু’জন দু’জনের প্রশংসা করছে কেন? তলে তলে কি ফিক্সিং হল দু’জনের?

কিংশুক ওর হাত দুটো ধরে বলল, তোমার মতো স্ট্রেটফরোয়ার্ড আর সৎ মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি তনুশ্রী।

কিন্তু আমার নামে রটনা আছে কিংশুক। ছাপ্পাও আছে হয়তো গায়ে।

তাতে কী? আমি তো স্ট্যাম্প জমাই না তনুশ্রী।

আমাকে বিয়ে করতে চাও কিংশুক? তনুশ্রী একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

সম্ভবত, জবাব দিল কিংশুক।

উত্তর কলকাতার সাবেক একটা হলে ওরা সিনেমা দেখতে ঢুকেছিল।

বেরিয়ে কিংশুকের কী মনে হল বলল, চলো, তোমাকে ট্যাক্সি করে কিছুটা এগিয়ে দিই। অত পয়সা খরচ করতে তনুশ্রী বারবার করে বারণ করল ওকে কিন্তু কিংশুক শুনল না। ট্যাক্সির ভিতর তনুশ্রী ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল, আমি ওইসব পিআর এজেন্সি-ফেজেন্সি ছেড়ে দেব, আমার পোষাচ্ছে না।

কিংশুক বলল, আমি বললে তো বলতে ওই গা-জোয়ারি শুরু হল।

তনুশ্রী বলল, বলতাম না, মোটেই বলতাম না। আমার বর আমার ওপর ডমিনেট করবে, আমার বরাবরের ইচ্ছে।

কিংশুক একটু আতঙ্কের গলায় বলল, চালাতে পারব তনু? এই তো রোজগার!

তনুশ্রী কিংশুকের ঠোঁটে একটা আঙুল চাপা দিয়ে বলল, প্লিজ ওই কথাটা বোলো না। খারাপ লাগে। আমি একদম বসে থাকব না দেখো, ইনফ্যাক্ট আমি একটা চাকরি পেয়েছি অলরেডি। ওই যে বাইপাসে হার্টের হাসপাতালটা আছে, ওখানে রিসেপশনে। তোমার আপত্তি নেই তো?

কীসের আপত্তি?

না, মানে আপাতত আউটডোরে পেশেন্টদের নাম লিখতে হবে। তোমাকে, আমাকে তো অনেকে চেনে, তাই ভাবছিলাম…

তোমাকে, আমাকে চেনে মানে? আমরা তো ফিল্মস্টার নই। আর তুমিও তো বারে নাচতে যাচ্ছ না তনু!

তনুশ্রী জড়িয়ে ধরল ওকে, আর কিংশুক পকেটে হাত না দিয়েই বুঝল ট্যাক্সিটা ছাড়ার সময় এসে গেছে।

তুমি কিন্তু আমায় অটোয় উঠিয়ে দিয়ে তারপর ফিরবে, তনুশ্রী ট্যাক্সিভাড়া দিতে ব্যস্ত কিংশুককে বলল।

কিংশুক কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। আর তখনই যেন আকাশ ফুঁড়ে ওদের সামনে আবির্ভূত হল রণপ্রিয় রায়। অনেকটা ঝুঁকে সেলাম জানাবার কায়দায় তনুশ্রীকে বলল, আপনি আমায় স্মৃতির সারণিতে রাখুন বা না রাখুন, আমি আজও আপনার রূপমুগ্ধ।

তনুশ্রী আঁতকে উঠল। কিংশুক একটা হালকা মেজাজ তৈরির চেষ্টায় বলল, আমি আপনার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক, রণপ্রিয়দা। একদা আলাপ হয়েছিল, চিনতে পারছেন কিনা জানি না।

রণপ্রিয় বলল, আপনার বান্ধবী আমার স্মৃতিকে এমুখী করে তুলেছে। আমি শুধু ভাবছি আমার ‘হ্যালো সেক্সি’ অনুষ্ঠানের জন্য আমি ওকে কেন সঞ্চালিকা হিসেবে ভাবিনি পূর্বে।

আমি করব না, তনুশ্রী বিরক্ত গলায় বলল।

আপনার সঙ্গোপন সলতেকে উসকে দিয়ে দেখুন একবার, সে কিন্তু অন্য কথা বলবে। আপনি খবর পড়ার জন্য নন, আপনি আমাদের অবচেতনকে মোহিত করুন।

কিংশুক হঠাৎ রণপ্রিয়র একটা হাত ধরে বলল, রণপ্রিয়দা তনুশ্রী কাজটা করবে না। আপনি সাদা বাংলা বোঝেন না?

রণপ্রিয় মন্দ্রস্বরে বলল, আমি ভাষার ভিতরে যে-সাতটা রং বিচ্ছুরণ ঘটায়, তাদের বোঝার চেষ্টা করি। সেই বিচ্ছুরণই তো সুধাসিন্ধু উথলে তোলে নারী শরীরে। আর সেই সিন্ধু যখন প্রত্যঙ্গের দেওয়াল ভেঙে প্রবাহিত হতে শুরু করে…

অ্যাই ঢ্যামনা, চুপ করবি? তনুশ্রী ওর কথার মধ্যেই বলল।

রণপ্রিয় হতাশ গলায় বলল, তা হলে আমায় একবার অ্যানাকোন্ডা দেখিয়ে দিন।

অ্যানাকোন্ডা? এখানে? কিংশুক চমকে উঠল।

রণপ্রিয় বলল, আপনি ওই গায়ের পশমি আবরণ সরালেই আপনার অ্যানাকোন্ডার মতো ধারাল বাহু আমাকে…

তনুশ্রী কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে এবার স্যান্ডেল খুলে মারব কিন্তু।

কিংশুক ওর গা-ঢাকা লাল নকশাকাটা কালো শালটার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আজ স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছ?

তনুশ্রী একটু বিব্রত গলায় বলল, আসলে এই শাড়িটার সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ ওটাই ছিল তাই, তুমি পছন্দ করো না, তাই না?

আরে ধুত, আমার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়। আমি ভাবছি আমি বুঝতে পারলাম না, ও কীভাবে বুঝল? কিংশুক বলল।

রণপ্রিয় ঘোর লাগা গলায় বলতে থাকল, ওই ট্রেনিং পাওয়া কুকুরগুলো যেমন না-ফাটা বোমার গন্ধ পায়, আমিও তেমনি গন্ধ পাই। ফরসা হাত, তামাটে হাত, হাতির দাঁতের মতো হাত, অজগরের মতো হাত…

কিংশুক হেসে ফেলল। বলল, ওকে একবার দেখিয়ে দাও তনু। ওর স্বপ্ন সফল হোক!

তনুশ্রী একটু অবাক চোখে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে ফুটপাথের রেলিংটার কাছে সরে গিয়ে গা থেকে শালটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়াল আর রণপ্রিয় হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

অটোয় ওঠা পর্যন্ত তনুশ্রী কোনও কথা বলছিল না। কিন্তু অটোয় ওঠার মুহূর্তে কিংশুকের হাত ধরে একটা টান দিল। কিংশুক বলল, আমি সেই নর্থে ফিরব, আমার দেরি হয়ে যাবে তনু।

হোক, আমাকে আমার বাড়ির স্টপ পর্যন্ত পৌঁছে দাও, তনুশ্রী গম্ভীর গলায় বলল।

কিংশুক বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে বসল ওর পাশে।

কিন্তু ওর বাড়ির স্টপেজের আগের স্টপেজে একটি লোক নামামাত্র যখন ওরা দু’জনই মাত্র যাত্রী রইল অটোতে, তনুশ্রী চেঁচিয়ে উঠল, আমার মোবাইল! আমার মোবাইলটা কোথায় কিংশুক?

মুহূর্তের মধ্যে অটোকে বেশি ভাড়া কড়ার করে উলটোদিকে ঘোরাল কিংশুক।

হাজরায় পৌছে তনুশ্রী প্রায় ছুটতে ছুটতে সেই রেলিংটার সামনে এল, তারপর বলল, ওই শয়তানটাকে অত আশকারা দিলে বলে আমার মোবাইলটা গেল।

কিংশুক অপরাধীর গলায় বলল, আসলে লোকটা জ্যোৎস্নারাতে তাজমহল কিংবা ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে লোকে যে-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেরকমভাবে তাকিয়েছিল তোমার দিকে, আমার মনে হল…

তনুশ্রী কিংশুককে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার কী মনে হল তাই দিয়ে ফোন উদ্ধার হবে? কখন থেকে বলছি তাও ফোন করছ না কেন আমার মোবাইলে?

কী করে করব? আমার মোবাইলে চার্জ আছে একরত্তি? বলতে বলতেই কিংশুকের চোখে পড়ল পাবলিক বুথটা। ও তনুশ্রীকে বলল বুথটার ভিতরে ঢুকে নিজের নম্বরে ফোন করতে কিন্তু তনুশ্রী কেমন একটু শিউরে উঠে ওকে ফোন করতে বলল।

আরে বাবা, একটা মেয়ে ফোন করে কান্নাকাটি করলে অনেক দাগি চোরও মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয় অনেক সময়, কিংশুক বলল।

ফেরত দিক না দিক আমি পাবলিক বুথ থেকে ফোন করতে পারব না, তনুশ্রী ঝঝাল গলায় বলল।

কিংশুক রেগে গিয়ে বলল, কেন পারবে না?

মোবাইলে ব্যালান্স ছিল না বলে আমি পাবলিক বুথ থেকে ফোন করেছিলাম মৃদুলদাকে। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মৃদুলদা… তনুশ্রী কেঁদে ফেলল।

কিংশুকের ভিতর কে জানে কেন কোনও বিস্ফোরণ ঘটল না। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, কেন ফোন করেছিলে মৃদুলদাকে?

মৃদুলদা সেদিন রাতে আমাকে নিয়ে একটা ফটোশুট করবে ঠিক করেছিল কিন্তু আমি যেতে পারব না বলতেই রেগে গিয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করল…

কিন্তু তুমিই বা ডোবাচ্ছিলে কেন মৃদুলদার মতো এককথার লোককে?

আমি কী করব? প্রমিত ব্যানার্জি ওই রাত আটটাতেই দেখা করতে চাইল যে!

প্রমিত ব্যানার্জি? তোমার সঙ্গে? রাতে? কেন?

আমি জানি না তুমি বিশ্বাস করবে কিনা, কিন্তু সেদিন ও আমাকে ও অভিযোগটা যেন আমি উইথড্র করে নিই।

তাতে ওর লাভ?

মৈনাক পাল আবার অফিসে ঢুকলে ওর বশংবদ হয়ে থাকবে। সে জায়গায় অন্য কেউ এলে ওকে আবার তাকে ম্যানেজ করতে হবে…

তুমি রাজি হলে ওর প্রস্তাবে?

হতাম না। কিন্তু বাবার ওষুধ আর আয়ায় জেরবার হয়ে আছি তো, তাই আবার ফ্রিলি চাকরিটা করতে পারব এই ভরসায় রাজি হলাম। তোমায় বলেছিলাম কিংশুক আমি সারেন্ডার করিনি কখনও, কিন্তু সঙ্গে এটা বলিনি যে সমঝোতা করেছি অনেকবার, তনুশ্রী চুপ করে গেল।

কিংশুক ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল, ওটা বলার মতো কিছু নয় তনু। সমঝোতা না করলে আমরা বাঁচব কীভাবে!

তনুশ্রী ওর চোখে চোখ রেখে বলল, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রমিত ব্যানার্জির প্রস্তাব ওর চেম্বারে মানলেও, পরে মানতে পারিনি।

কেন?

মৃদুলদা আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে ফোনটা কেটে দিয়েছে আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে যখন কেউ না জানলেও আমি জানলাম যে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মৃদুলদা…

মৃদুলদা মারা গেছে, তখন? কিংশুক ওর কথাটা সম্পূর্ণ করে দিল।

তখন আর প্রমিত ব্যানার্জির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ওই চ্যানেলে ঢুকতে পারিনি। আমার অসম্ভব পাপবোধ হচ্ছিল।

তুমি তো কোনও পাপ করোনি, কিংশুক বলল।

কেন আবার চাকরির লোভ চাগাড় দিল মাথায়? মৃদুলদা তো কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছিল এজেন্সি করার জন্য তা হলে সেই কাজটাই মন লাগিয়ে করার কথা ভাবলাম না কেন, কেন ওর মতো মানুষকে দেওয়া কথার খেলাপ করলাম? কেন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলাম লোকটাকে? তনুশ্রী হাহাকারের গলায় বলল।

ওরা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিল, হঠাৎ কিংশুক সামনে পাওয়া একটা এটিএম কাউন্টারে ঢুকে পড়ল। বেরিয়ে এসে বলল, ভাগ্যিস এটিএম কার্ডটা সঙ্গে ছিল। তারপর হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল। তনুশ্রী অন্ধের মতো অনুসরণ করল ওকে। কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না।

শরিকি বাড়ি, ইতিউতি অজস্র নজর, কিংশুক তবু আধো-অন্ধকার খাড়া সিঁড়ি দিয়ে তনুশ্রীকে নিয়েই দোতলায় উঠল। পেছনের ঘরে ঢুকে বলল, মা একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে।

খাওয়াদাওয়ার শেষে কিংশুকের মায়ের ঘরে বসে থাকা তনুশ্রীর কপালে লম্বা করে একটা টিপ এঁকে দিল কিংশুক। বলল, মৃদুলদার হাতে বানানো প্রথম টিপ।

তনুশ্রী কিছু না বলে চোখ দুটো বন্ধ করল। টপটপ করে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ দিয়ে।

কিংশুক হাত দিয়ে সেই জল মুছিয়ে দিল না। শুধু ভাবতে থাকল কাল মন্দিরে বিয়েটা সেরে আসার পর এমনকী নোটিশ অনুযায়ী ওদের রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পরও চারপাশ থেকে কত কথা, কত নোংরা উড়ে আসবে, সেসবের মোকাবিলা করে তনুশ্রীর মৃত্যুপথযাত্রী বাবা এবং খানিকটা অসহায় মাকে সামলে ওর নিজের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে একটা মোটামুটি সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারবে তো? ওর বাবা-মা ওকে ভুল বুঝবেন না হয়তো। কিন্তু সাহস দেবেন কি?

ভাবতে গিয়ে ওর আবার বাসবদার ভাইঝির মৃত্যুদিনের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। মৃত মানুষের খাটের পয়সা চুরির অপবাদের সামনে পড়ে চোখের জল ফেলতে থাকা অনিরুদ্ধকে নিয়ে ও শ্মশানের যে-দিকটায় কাঠের চুল্লি সাজানো হয় সেদিকে এসেছিল। তখনই দেখেছিল মানুষ পোড়ানোর জায়গায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে কুকুর। শ্মশানে কাজ করা ছেলেটা বলেছিল, ওরা ওখানে গরম পায়। যে তাপে মানুষ পুড়ে খাক হয়ে যায় সেই তাপেরই ওমটুকু আরাম দেয় কুকুরদের।

‘তাপ’। ‘ওয়ামর্থ।

সায়ন্তন কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেই স্বপ্নের রেডিয়ো স্টেশন হয়তো শুরুই হবে না, তবু সমস্ত সমাপ্তির ভিতরও অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যাবে ‘ভৌ’!

বুকে কাঁটা বিঁধলেও নির্ভুল সুরে গান গাইবে পাখি। গাইবে, রক্ত ঝরাতে ঝরাতেই। পাথরে ফসিল আর অর্কিড এমন পাশাপাশি লেপটে থাকবে যে একটাকে অন্যটার থেকে আলাদা করা যাবে না। সমস্ত কসমেটিক্স ছাপিয়ে ওই সিঁদুর আর ছাই মিশিয়ে তৈরি করা টিপ জ্বলজ্বল করবে। ঝলমল করে উঠবে সব মৃত্যু পেরিয়ে।

তনুশ্রী নিচু গলায় বলল, মাকে ফোনে জানিয়েছিলাম। মা খুশি।

কিংশুক বলল, এই বাড়িতে এসে তুমি খুশি তো?

তনুশ্রী বলল, এই বাড়ি বলছ কেন, এটা তো এখন আমারও বাড়ি। তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, বাথরুমে কীভাবে যাব একটু বলবে গো?

কিংশুক উঠে এসে হাত ধরল তনুশ্রীর। অজগর নয়, অ্যানাকোন্ডা নয়, নেহাতই শালুক-শাপলার মতো হাত। কিংশুক সেই হাত ধরে বলল, পুরনো বাড়ি, শ্যাওলা। তুমি আমার সঙ্গে এসো তনু…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *