ঘণ্টাধ্বনি

ঘণ্টাধ্বনি

মৃত্তিকার পিসির বাড়িটা একটু সাবেকি ধাঁচের। গেট খুলে ভিতরে ঢুকলেই বাঁধানো তুলসীমঞ্চ, তার পেছনে বড় একটা উঠোন। উঠোন পেরোলেই মোটামুটি বড় একটা বাড়ি, যার গা থেকে বেশ একটা সহজতার গন্ধ ভেসে আসছে। মৃত্তিকা দরজার কড়া নাড়তেই এক ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন।

মাথা নিচু করে ঢুকো কিংশুকদা, নইলে মাথায় লাগবে, মৃত্তিকা বলল।

তারপর কিংশুক নতমস্তকে ওর কথা শুনছে দেখে মায়াদিকে বলল, এই কিংশুকদা। আমাদের নাটকের ডিরেক্টর।

নাটক? মায়ার চোখে ভ্রূকুটি।

আরে, তোমায় বলেছিলাম না আমি হিরোইনের পার্ট করছি একটা নাটকে। কিংশুকদাই তো অভিনয় করাচ্ছে আমাদের দিয়ে।

নাটক, ডিরেক্টর, অভিনয়, এ সব কথাই মৃত্তিকা পাখিপড়া করতে করতে এসেছে কিংশুককে। ও মায়ার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলল, একটু চা খেতে এলাম আপনাদের বাড়ি।

উঠোন পেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে, দুটো সিঁড়ি উঠলে বসার ঘরের দরজা। সেই রাস্তাটুকু পেরোতে যতটা সময় লাগে তার ভিতরে মায়া খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলল, নাটক তো আজ বাড়িতেই চলছে।

মৃত্তিকা ত্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন কী হয়েছে বাড়িতে?

মায়া বলল, বড়মা’র আঙুল কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। সে কী রক্ত!

হাত কাটল কীভাবে?

ওই আমি একটু দোকানে বেরিয়েছি, তার মধ্যে নিজেই গেছে কইমাছ কুটতে।

কেন ময়না কোথায় গেছিল?

সে তো আজ কামাই দিয়েছে।

তা বেশ করেছে। কিন্তু এত যখন অসুবিধে তখন আজ কই মাছের ঝামেলা করার কী দরকার ছিল?

মায়া বসার ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলে দিয়ে হেসে বলল, ওমা, আজ এসেছে তো!

ব্যারাকপুর পেরোলেই টিউবলাইটের জোর একটু কমে যায়, খেয়াল করেছে কিংশুক। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক মৃত্তিকার পিসির বাড়ি তার ব্যতিক্রম। হাওদাখানার মতো বড় একটা ঘরে একটাই টিউব জ্বলছে, তবু কেমন ঝকঝকে হয়ে আছে চারপাশ। ডানদিকে একটা মাঝারি সাইজের সোফার সামনে ছোট একটা সেন্টার টেবিল। তার পিছনে দু’-তিনটে চেয়ার অনাবশ্যক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। উলটোদিকের চৌকিতে ধুতি আর হাফহাতা গেঞ্জি পরে আধশোওয়া যে-মানুষটি খবরের কাগজের পাতা ভাঁজ করছেন নিঃশব্দে তিনি নিশ্চয়ই মৃত্তিকার পিসেমশাই। আর ঠিক তার পায়ের কাছে শতরঞ্চিতে বসে যে-দোহারা চেহারার ছেলেটি বঁটিতে আনাজ কুটছে সে নিশ্চয়ই কৃষ্ণগোপাল নয়। নাকি সেই কৃষ্ণগোপাল?

মিনিট চল্লিশেক ধরে গঙ্গা দিয়ে অনেক ব্রিটিশ আমল, পুরনো নাটক, শিশির ভাদুড়ি, চা, পাঁপড় ভাজা, নতুন প্রজন্ম বয়ে যাওয়ার পর কিংশুক নিজেকে দোতলার একটা ঘরে আবিষ্কার করল যেখানে ও, মৃত্তিকা এবং কৃষ্ণগোপাল সত্যি সত্যিই একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে শুধুমাত্র নিজেদের বসার ভঙ্গিমা দিয়ে।

‘আপনি প্লিজ অন্যভাবে নেবেন না, আমরা একটা কথা জানাতে চাই আপনাকে’ কিংবা ‘হয়তো আমরা একটু দেরিই করে ফেললাম কিন্তু ভেবে দেখুন কৃষ্ণগোপালবাবু সব কিছু তো সময় মেনে হয় না’ অথবা ‘বুঝতে পারছি ব্যাপারটা ভীষণই অস্বস্তিকর কিন্তু এটার সঙ্গে খোলাখুলি মোকাবিলা না করলে হয়তো তিনটে জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে’ নাকি ‘আমার এই কথাটা এভাবে বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু সত্যিটা হল মৃত্তিকা আপনাকে নয়, আমাকে ভালবাসে’ কিংশুক কিছুতেই ওর বক্তব্যের উপক্রমণিকা ঠিক করে উঠতে পারছিল না। কৃষ্ণগোপাল খুব ঝকঝকে পালিশওয়ালা একটা লোক হলে হয়তো ওর অসুবিধে হত না। কিন্তু একজন রিসার্চ স্কলার যে কিনা আবার সহজ স্বাভাবিকতায় গামছা আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে বঁটিতে বাঁধাকপি ঝিরিঝিরি করে কাটতে পারে, তাকে শুধু বাকচাতুর্যে হারিয়ে দেবে ও? সেটা ঠিক হবে কি? কিন্তু হারজিতের কথা ও ভাবছেই বা কেন? মৃত্তিকা আর ওর প্রেম তো কাউকে হারিয়ে দেবে বলে জন্ম নেয়নি।

কথাবার্তা অবশ্য মৃত্তিকাই চালু করে দিল, কিংশুকদার কথা তোমায় আগে বলেছি?

কৃষ্ণগোপাল নম্রস্বরে মাথা নেড়ে বলল, না বোধহয়। তবে মায়াদি বলছিল যে উনি নাটক করান আর সেই নাটকে তুমি অভিনয় করছ।

কিংশুক বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। মৃত্তিকা কেন যে এই নাটকের মিথ্যেটা দিয়ে কথা শুরু করল, কে জানে!

মৃত্তিকা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, হ্যাঁ সেরকম একটা কথা হচ্ছে বটে।

কৃষ্ণগোপাল কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ভাল হল জানেন, আমি বরাবর চেয়েছি ও এরকম কিছুতে ইনভলভ্‌ড হয়ে থাকুক। আসলে এসব দিকে ওর একটা ন্যাক আছে তো। ওদিকে আমি আবার কালচারাল জিনিসপত্র ভাল বুঝি না।

মৃত্তিকা ঝাঁঝালো গলায় বলল, কিছুই বোঝো না তুমি। মাটিতে বসে বাঁধাকপি কাটছিলে কেন?

না, মানে, পিসেমশাই খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তাই ভাবলাম ময়না আসুক না আসুক, আমিই করে খাইয়ে যাই। আবার কবে ফিরি ঠিক তো নেই।

কোথায় যাচ্ছেন আপনি? কিংশুক দুম করে জিজ্ঞেস করে ফেলল।

কৃষ্ণগোপাল একটু লজ্জিত গলায় বলল, মানে পোস্ট-ডক্টরাল কাজকম্মো করার জন্য সানফ্রান্সিসকো যাচ্ছি। অবশ্য এখনই যাচ্ছি বলা বোধহয় ঠিক হবে না, পরশু আমার ভিসা ইন্টারভিউ। নাইন ইলেভেনের পর থেকে ওরা খুব কড়াকড়ি করে জানেন তো?

কিংশুক, ‘বেস্ট অফ লাক’ কিংবা আপনার ভিসা আটকাবে না’ জাতীয় একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মৃত্তিকা একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, তুমি যে নেব্রাসকা যাবে বলেছিলে?

কৃষ্ণগোপাল বলল, সেরকমই তো ঠিক ছিল। এরা যে ডাক দেবে, সেটা তিনদিন আগেও ভাবিনি।

ফেসিলিটি কীরকম দিচ্ছে এরা? নেব্রাসকার চেয়ে ভাল?

না, নেব্রাসকাতেই সুবিধে একটু বেশি ছিল বরং।

তা হলে এখানে মরতে যাচ্ছ কেন? মৃত্তিকার গলায় বিরক্তি।

কৃষ্ণগোপাল চোখ তুলে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল, তুমি যে বলেছিলে তুমি সমুদ্রের ধারে থাকতে ভালবাসো? নেব্রাসকায় তো ভীষণ বরফ আর ঠান্ডা, সানফ্রান্সিসকো তোমার খুব ভাল লাগবে দেখো।

মৃত্তিকা একটু কাঁপা গলায় বলল, শুধু আমার কথা ভেবে তুমি সানফ্রান্সিসকো চুজ করলে?

কৃষ্ণগোপাল মাথা চুলকে বলল, হ্যাঁ, মানে ওই আর কী! তবে তুমি এক্ষুনি নাটক ছেড়ে দিয়ো না। আমি যাব, একটু গুছিয়ে আবার এখানে আসব, সময় তো লাগবে। সেই সময়টা তুমি অভিনয় চালিয়ে যাও। কী বলেন কিংশুকবাবু?

আপনিই বলুন, কিংশুক যন্ত্রের মতো বলল।

না, মানে আমি এসে ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে ওর ভিসা-টিসার ব্যাপার আছে…

আর আপনাদের বিয়ে? কিংশুক প্রশ্ন করল।

কৃষ্ণগোপাল আবারও লজ্জা পেয়ে বলল, হ্যাঁ ওই সামাজিক ব্যাপারটা তো হতেই হবে। তবে সব মিলিয়ে বছরখানেক সময় আছে। তাই বলছিলাম মৃত্তিকা যখন ভালবাসে…

কিংশুক জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, ‘মৃত্তিকা যা ভালবাসে আপনি কি ওকে তাই করতে দেবেন সারাজীবন?’ কিন্তু তার আগেই কৃষ্ণগোপাল মাছের মাথা দেওয়া বাঁধাকপির তরকারিতে একটা ফিনিশিং টাচ দেওয়ার জন্য ওদের অনুমতি নিয়ে নীচে নেমে গেল। ও চলে যেতেই দরজায় আলতো করে ছিটকিনি তুলে দিয়ে মৃত্তিকা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল কিংশুককে। বলল, দেখলে তো কীরকম ছেলেমানুষ? আমি সি-সাইড পছন্দ করি বলে নিজের সুবিধে-অসুবিধে বিচার না করে সানফ্রান্সিসকো যাচ্ছে।

কিংশুক মৃত্তিকার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল, তুমিও যাচ্ছ তো সঙ্গে?

মৃত্তিকা চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী চাও?

সেটা আর এই মুহূর্তে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কি? কিংশুক হাসল।

তুমি এখন এসব কথা আমাকে বলতেই পারো। কারণ আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি সেটা, এককথায় বললে, অন্যায়।

ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্নই উঠছে না মৃত্তিকা। একজন অনিশ্চিত মানুষ, একটা অনিশ্চিত চাকরি, আর একটা অনিশ্চিত সম্পর্ক, এদের যা পরিণতি হওয়ার ঠিক সেই পরিণতিই হচ্ছে।

তুমি কি আমাকে লোভী ভাবছ?

আমার ভাবা, না-ভাবায় কী এসে যায় মৃত্তিকা?

বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি যখন কথা বলো, আমার মনে হয় আমি চাঁদে ভেসে বেড়াচ্ছি। কোনও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে না আমার ওপর।

তার মানে তুমি আমার কথা ভালবাসো।

আমি তোমার সঙ্গে তর্কে যাব না, কারণ তুমি বুঝতে পারছ আমি কী ফিল করি। কিন্তু কৃষ্ণকে কিছু বোঝানো যায় না। ও এমনই নির্ভরশীল আমার ওপরে যে…

যে? কিংশুক একটা আওয়াজ করল জিভ দিয়ে।

জানি না। ওই যে একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল সাইকোলজিতে যেখানে… কিংশুক সম্পূর্ণ আন্দাজে ওকে থামিয়ে বলল, একটা কুকুরকে রোজ ঘণ্টা বাজিয়ে খাবার দেওয়া হত। তারপর দেখা গেল খাবার দেওয়া হোক বা না হোক ঘণ্টা বাজালেই কুকুরটার মুখ দিয়ে লালা নিঃসরণ হতে থাকে।

এগজ্যাক্টলি। আমি কৃষ্ণগোপালের কাছে ওই ঘণ্টার আওয়াজটার মতো। আমি ওর, এই ধারণাটার ওপর ভিত্তি করে কৃষ্ণ নিজের প্রতিক্রিয়া, নিজের কাজের পদ্ধতি ঠিক করে। ওই ধারণাটাই ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ও আমাকে কতটা পেল, সেটা নয়। সেটা ও বুঝতেও পারে না সম্ভবত।

আমেরিকায় পোস্ট-ডক্টরাল করতে যাচ্ছে যে-লোকটা, তাকে একটু বেশি বোকা ভেবে ফেলছ না তো?

একদম বোকা ভাবছি না। ওর লক্ষ্য আছে, সেটা ও পূরণও করবে। কিন্তু ওর গন্তব্য নেই কোনও। ও আমার মনের কথা জীবনেও পড়তে পারবে না।

খুব ভাল বাঁধাকপি তো রাঁধতে পারবে, কিংশুক হাসল।

মৃত্তিকা ওকে জড়িয়ে ধরে মুখটা ওপরে তুলল। কিংশুক প্রথমে আলতো, পরে সাপটে চুমু খেল ওকে। বলল, ঘোড়ার পিঠের ওপর যে-জকিটা থাকে ঘোড়া হারলেও সে কম-বেশি মাইনে পায়। কিন্তু গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে যে লোকটা বাজি ধরে, সে একদম বরবাদ হয়ে যায়। জানো?

মৃত্তিকা ওর বুকে নিজের মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল, খুব ক্ষতি করে দিলাম গো তোমার!

কিংশুক প্রাণপণে কান্না চেপে বলল, ভাগ্যিস!

সিঁড়িতে কৃষ্ণগোপালের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *