জাল সই

জাল সই

বাঁচতে কে চায় না? সবাই চায়। আর বেঁচে থাকতে গেলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চাই। সঙ্গে চাই একটু-আধটু যৌনতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি চাই মদ। অনিরুদ্ধ অন্তত সেরকমই ভাবে। না ভেবে ওর উপায়ও নেই এখন। দুপুর গড়াতে শুরু করলেই ওর ভিতরে একটা অস্থিরতা শুরু হয়। বিকেলের দিকে সেটা ছটফটানিতে গিয়ে পৌঁছোয়। তখনই অনিরুদ্ধর শিরা-উপশিরা বেয়ে বয়ে চলা রক্তের স্রোতে জন্ম হয় এক-একটা অক্ষরের। অক্ষরগুলো নিজেরাই নিজেদের জুড়ে জুড়ে তৈরি করে এক-একটা নাম। সেই নামগুলো ধাক্কা মারে ওর মাথায়। মাঝির বৈঠার ধাক্কায় যেমন দু’ভাগ হয়ে যায় জল, ওই নামগুলোর ধাক্কায় দু’ভাগ হয়ে যায় অনিরুদ্ধর সন্ধ্যার আগের জীবন এবং সন্ধ্যার পরের জীবন। ও খুঁজে বেড়াতে শুরু করে নামের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা লোকগুলোকে। খুঁজে পেলে ঠাহর করার চেষ্টা করে, কার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে মদ খাওয়া যাবে।

আজ যেমন ও খুঁজে পেয়েছে স্নিগ্ধদেবকে। ইচ্ছেমতো মাখামাখি করতে পারবে এমন মেয়ে যদি কেউ স্নিগ্ধদেবকে দেয়, তার জন্য স্নিগ্ধদেব জান লড়িয়ে দেবে। তখন তাকে বিরিয়ানি খাওয়াতে, মদ গেলাতে একটিবারের জন্যও আটকাবে না ওর। অনিরুদ্ধ তাই প্রথমেই ওর অফিসে গিয়ে পিয়নের হাত দিয়ে একটা চিরকুট পাঠাল। চিরকুটে একটা কথাই লেখা—সুরমিতা দাস কলকাতায় এসেছে। চিরকুটটা ওপরে যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের ভিতরই হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে এল স্নিগ্ধদেব, অনিরুদ্ধর চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছে সুরমিতা?

অনিরুদ্ধ ভুরু নাচিয়ে বলল, হোটেল মুনলাইটে। তিনশো সাত নম্বর ঘরে। চলে যাও।

স্নিগ্ধদেব হতাশ গলায় বলল, একা চলে যদি যেতে পারতাম, তা হলে কি তুমি হোটেলের নামটা আমায় বলতে? চলো, সঙ্গে চলো!

অনিরুদ্ধ জিভটা বাইরে বের করে একটু আওয়াজ করল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা স্নিগ্ধ, ওই যে ইয়ং ছেলেটাকে দিয়ে চিরকুটটা পাঠালাম ওর মাইনে এখন কত?

স্নিগ্ধদেব একটু অবাক গলায় বলল, কে রবি? ও তো বছর তিনেক হল ঢুকেছে। আট হাজার মতো পেত হয়তো।

নতুন পে কমিশনের রিপোর্ট লাগু হবার পর কত পায়? অনিরুদ্ধ স্নিগ্ধদেবের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল।

তেরো-সাড়ে তেরো পায়, স্নিগ্ধদেব হাই তুলল।

তিন বছর আগে চাকরিতে ঢোকা ফোর্থ ক্লাস স্টাফের মাইনে সাড়ে তেরো হাজার টাকা। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কী করল বলো তো?

আমি কি তোমার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারি বেতন কাঠামো নিয়ে আলোচনা করার জন্য নীচে নামলাম অনিরুদ্ধ? স্নিগ্ধদেব বিরক্ত গলায় বলল।

তা নয়, তবে আমি ভাবছিলাম গ্রুপ ডি স্টাফের মাইনে যদি মাসে পাঁচ হাজার বেড়ে থাকে, তোমার মতো ক্লাস ওয়ান অফিসারের কত বেড়েছে।

আমি ক্লাস ওয়ান অফিসার নই অনিরুদ্ধ।

ওয়ান, টু, থ্রি যা-ই হও, মাসে পনেরো হাজার তো বেড়েছে।

সত্যিই এতটা বাড়েনি।

অতটা না হলেও কাছাকাছি। আমাকে দু’হাজার দেবে আজ?

কেন দেব বলো তো? সুরমিতা দাস কি আমার সঙ্গে শোবে?

সেটা তোমরা ঠিক করবে, আমি আলাপটা জমিয়ে দিয়ে চার পেগ খেয়ে চলে আসব।

স্নিগ্ধদেব ওর গালের চাপদাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলল, মাল খাওয়ালে মেজাজ নরম হবে বলছ?

শুধু মেজাজ নয়, সবকিছুই নরম হয়ে যাবে আরও। তুমি এত বড় খেলোয়াড় তারপরও তুলতে পারবে না?

খুব শক্ত পিচ, আমি জানি না কিছু করতে পারব কিনা।

ডিপ্রেসিং কথাবার্তা বোলো না তো। সেই যে বোকারোয় তুমি নখরা করেছিলে তাতে কি কিছু হয়নি? হয়েছে বলেই আজ দেখা করতে রাজি হয়েছে। আজও আবার মাটি কোপাতে হবে। জল আজ নয় কাল উঠবেই।

স্নিগ্ধদেব আবারও দাড়ি চুলকে বলল, বুঝলাম। কিন্তু বোকারোয় আমি কী যেন করেছিলাম?

অনিরুদ্ধ রুমালে নাক ঝেড়ে বলল, ন্যাকা চৈতন্য!

বোকারোয় কী কী হয়েছিল মনে মনে ভাবার চেষ্টা করছিল অনিরুদ্ধ। কিন্তু একচুমুক করে হুইস্কি ওর ভিতরে ঢুকছিল আর মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল একটু করে। সুরমিতার সঙ্গে, এই ঘরেরই অন্যদিকে কথা বলছে স্নিগ্ধদেব। অনিরুদ্ধ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আধকাত হয়ে শুয়ে আছে। হ্যাঁ, কীভাবে যেন আলাপ স্নিগ্ধদেব আর সুরমিতার? মনে পড়ছে না। ঘটনাটা কিংশুককে বলেছিল অনিরুদ্ধ। হাসতে হাসতে প্রায় উলটে পড়েছিল কিংশুক। বলেছিল, সত্যি পিয়ালের কাঁধে বন্দুক রেখে হেভি বাজি মারলে তোমরা। কিন্তু পিয়ালের কাঁধে বন্দুক থাকবে কেন? পিয়ালের কাঁধে তো গিটার থাকার কথা। ও অবশ্য গিটার বাজায় না। তবু গান তো গায়!

দু’জন মিলে এতক্ষণে কী বদামি শুরু করেছে কে জানে। করুক গে! অনিরুদ্ধ টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।

বড় লাইটটা নিভিয়ে দেব অনি?

স্নিগ্ধদেবের গলা কানে এল।

থাক না, লাইট থাক না। মৃদু অনুযোগের একটি মহিলা কণ্ঠ।

আপনি বুঝতে পারছেন না ওর চোখে কষ্ট হচ্ছে। কাউকে কষ্ট দেওয়া কি আমাদের উচিত? স্নিগ্ধদেবের গলা নরম হয়ে গলে যেতে লাগল।

ঘরের লাইটটা নিভে গেল একটু পরেই। একটা ডিম আলো শুধু জ্বলতে থাকল কোথাও। অনিরুদ্ধ দেখতে পাচ্ছিল একটা পলকা প্লাইউডের দরজা ওর সামনে। দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেই অনেক অনেক ঘুম। ও সেই ঘুমের ভিতর ঢুকবে বলে পা বাড়াচ্ছে, তখনই একটা ঝাপটাঝাপটি কানে এল। অনিরুদ্ধ পাত্তা দিল না। হাতের এক ধাক্কায় প্লাইউডের দরজাটা ঠেলে ওই ঘুমের সাম্রাজ্যে গিয়ে ঢুকল। আর ঢুকতেই ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পিয়ালের।

কী খবর অনিরুদ্ধদা? অনেক অনেকদিন তোমার কোনও খোঁজ নেই? আমি এর মধ্যে মোবাইলে ফোন করেছিলাম একবার কিন্তু… পিয়াল থেমে গেল।

পাসনি তো? কী করে পাবি! সে-সময়টা আমার মোবাইলে ভ্যালিডিটি ছিল না। আচ্ছা ভ্যালিডিটি মানে কী রে পিয়াল? বৈধতা? নাকি বহাল থাকা, বলবৎ থাকা?

যাই হোক না কেন, তাতে তোমার কী? তোমার চাকরিটা বহাল আছে তো?

না, নেই। কেন নেই বল তো পিয়াল? আমি কী এমন দোষ করেছিলাম যে প্রমিত ব্যানার্জি সিঙ্গাপুর থেকে একটা ফোন করে আমার চাকরিটা খেয়ে নিল?

প্রমিত ব্যানার্জি? তুমি তো তার একনম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে অনিরুদ্ধদা।

চামচা বল, পিয়াল, চামচা বল।

কিন্তু লোকটা তো নির্ভর করত তোমার ওপর।

আমি ওর অ্যাটাচিটা বয়ে নিয়ে যেতাম, যখন ও অফিস থেকে বেরোত। সেটাকে কি নির্ভরতা বলে? ক্ষমতা যার আছে, তার ওপরেই লোকে নির্ভর করে।

ব্যাপারটা কী হয়েছিল?

আমি সই জাল করেছিলাম।

কার?

প্রমিত ব্যানার্জির। মানে উনি তাই বলেন।

বলেন মানে, তুমি সত্যি সত্যি জাল করোনি?

কে জানে, আমার ঠিক মনে পড়ে না। আমার শুধু মনে পড়ে যে নিজেকে প্রমিত ব্যানার্জির ছায়া ভেবে ওর হয়ে একটা কথা দিয়েছিলাম।

কাদের?

কোনও একটা সংস্থাকে, কয়েকটা লোককে। ওরা একটা অনুষ্ঠান চালাতে চাইছিল আমাদের চ্যানেলে। কমিশনড প্রোগ্রাম। আমি কথা দিয়েছিলাম যে প্রোগ্রামটা আমাদের চ্যানেলে টেলিকাস্ট হবে।

সিরিয়াল?

না রে, সিরিয়াল নয়, ওই যে ফ্যাক্ট বেসড প্রোগ্রামগুলো হয় না, অনেকটা সেইরকম। সমাজের কোথায় কী জাল-জোছুরি হচ্ছে তাই নিয়ে আধঘণ্টার এক-একটা এপিসোড। আমি একটা ডেমো দেখেছিলাম। খারাপ না, ভালই। কিন্তু আমার ওদের কথা দিয়ে দেওয়াটা প্রমিত ব্যানার্জি নিতে পারল না বুঝলি। মানে ছায়াটা শরীরের চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা নিতে পারল না।

কিন্তু তুমি ওর হয়ে সইটা করতে গেলে কোন আক্কেলে?

সইটা যতদূর মনে পড়ে, করিনি। কিন্তু ওরা কীসব কাগজপত্র দেখাল, তাতে আমার সইয়ের মতোই একটা কালির দাগ ওপর থেকে নীচে নামতে নামতে বাঁদিকে বেঁকে গেছে। আমি সেই বাঁকটার সামনে দাঁড়িয়ে চুপ করে গেলাম জানিস।

কেন অনিরুদ্ধদা?

আসলে ওরা আমাকে কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছিল।

তুমি টাকা নিয়েছিলে?

হ্যাঁ, তিন মাস মাইনে পাইনি। প্লাস অন্তরার ডাক্তার, ওষুধপত্রের পিছনে অত খরচ, আমি টাকা নিয়েছিলাম। আসলে ওই পার্টিটাও এত মরিয়া ছিল যে আমাকেই হনুমান ঠাওরেছিল। রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেই সব ঘ্যাচাং হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল, আমাকে ডুবিয়ে নিজেরা বাঁচতে চাইল।

যাই বলল অনিরুদ্ধদা, কাজটা করা তোমার ঠিক হয়নি। তুমি ওদের একটু ঝুলিয়ে রাখতে পারতে…

বললাম তো, আমি নির্ভরতার ওপর ভরসা করে আমার ভ্যালিডিটি পেরিয়ে গেছিলাম। আমি ওই অবৈধ কাজটি করামাত্র আমার ভ্যালিডিটি শেষ হয়ে গেল। আউট অফ সার্ভিস হয়ে গেলাম। আমার আগের সমস্ত রেকর্ড স্লেটের গায়ে ভিজে ন্যাতা বুলিয়ে তুলে দেওয়া হল। আমি কী কী করেছি প্রমিত ব্যানার্জির জন্য তার একটা চিহ্ন রইল না কোথাও! মরুভূমির গায়ে ক্যাকটাসের মতো শুধু সেই সই কিংবা জাল সই জেগে রইল।

তুমি আর কাউকে ধরলে না? যে তোমার হয়ে একটু বলতে পারত।

কাকে ধরব? চ্যানেলে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিল মৈনাক পাল। তাকে রেজিগনেশন দেওয়ানোর সমস্ত প্ল্যান তো ছকেছিলাম আমি। ছকেছিলাম প্রমিত ব্যানার্জির কথায়। ওই লোকটা থাকলে হয়তো…

প্রমিত ব্যানার্জি কী বলল, যখন তুমি চলে আসছ?

আমাকে তো ও ডাকেনি। আমিই চাকরি যাওয়া সত্ত্বেও গেট ক্র্যাশ করে ঢুকেছিলাম ওর চেম্বারে। ভেবেছিলাম আমাকে দেখলে ওর মন হয়তো একটু গলবে। কিন্তু গলল না। আমি বললাম, শুনুন, একবার আমার কথা একটু শুনুন, কিন্তু বাঁ হাতটা ওপরে তুলে থামিয়ে দিল আমায়। বলল, তুই কথা বলিস না অনিরুদ্ধ, তোর কথা শুনলে আমার জলাতঙ্ক হয়।

জলাতঙ্ক হয় বলল?

হ্যাঁ রে পিয়াল, বলল। আমার তখন বলা উচিত ছিল আমি ওকে কতবার মেয়ে সাপ্লাই দিয়েছি, আমাকে কতভাবে কত জায়গায় প্রক্সি দিতে বাধ্য করেছে ওই লোকটা। কত খবর চেপে দিয়েছে, কত প্রোগ্রামের অ্যাঙ্গল বদলে দিয়েছে, কত কিছুকে ফালতু জাহির করে দেখিয়েছে আর বিনিময়ে লাখ-লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছে, তার অনেকগুলোর তোলাবাজের ভূমিকায় আমি ছিলাম। বিনিময়ে পাঁচশো, হাজার টাকা হয়তো আমিও পেয়েছি, কিন্তু সে তো ফাইভ কোর্স ডিনারের পর মুখশুদ্ধির মৌরি। কিন্তু এসব কথা আমি বলতে পারিনি। বেরিয়ে এসে আমি ঠাকুরকে ডাকছি, ঠাকুর আমায় রক্ষা করো, অন্তরাকে ডাকছি…

অন্তরাকে ডাকছ কেন? অন্তরা কি ঠাকুর? পিয়াল অনিরুদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

ঠাকুরই তো৷ অন্তরাকে আমি দেবীজ্ঞানে ভক্তি করি, কন্যাজ্ঞানে স্নেহ করি, হৃৎপিণ্ড জ্ঞানে ভালবাসি। আমি অন্তরাকে ডাকছি আর বলছি, অন্তরা আমি পৃথিবীতে তোমা বিনে অন্য কোনও মেয়েকে স্পষ্ট দেখতে পাই না, তুমি আমায় সংহত করো, জাগ্রত করো আমায়। আমি একদম রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি, আমাকে কাউকে না কাউকে ঘরে ফেরার পথ জিজ্ঞেস করতে হবে, তুমি বলে দাও কী ভাষায় জিজ্ঞেস করব। আমাকে ঠাকুর দয়া করলেন নাকি অন্তরা দয়া করল আমি ঠিক জানি না রে পিয়াল, কিন্তু আমার গলা দিয়ে ভক করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল তিরবেগে, ভৌ।

ভৌ?

হ্যাঁ, ভৌ। অপমান আর যন্ত্রণাই আমার ভিতরটা মন্থন করে এই কনসেপ্টটা নিয়ে এল। আমি তো কুকুরের মতোই প্রতিদিন প্রভুর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতাম। এবার আমার প্রভুই যখন বলছেন যে, আমার গলা দিয়ে বেরোনো আওয়াজে জলাতঙ্ক হয়, তখন আমি কী গাব, কী শুনাব! উর্ধ্বতন-অধস্তনের মধ্যে, উত্তমর্ণ-অধমর্ণের মধ্যে যে-কোনও সম্পর্কই কি প্রভু আর কুকুরের সম্পর্ক? আমার মাথার মধ্যে বুদবুদের মতো বার্স্ট করল আইডিয়াটা। তখনই একদিন সায়ন্তনের সঙ্গে দেখা। ‘না’ বলবে ধরে নিয়েই ওকে বললাম, একটু মদ খাওয়াবেন? আপনাকে একটা কনসেপ্ট দিতে পারি।

সায়ন্তন বলল, চলুন, এমনিই খাওয়াচ্ছি।

চার পেগ মতো খাওয়ার পরে আমি আমার মাথার ভিতরের সবকিছু উজাড় করে দিলাম ওর সামনে।

সায়ন্তন আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চাপা গলায় বলল, আমি আবার একটা সুনামির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

আমাকে কিছু টাকাও অ্যাডভান্স করার কথা বলেছিল। কিন্তু আমি নিইনি। আমার তো এই টুকটাক উঞ্ছবৃত্তি করে এখন চলে যাচ্ছে। রেডিয়ো স্টেশনটা নামুক বাজারে, একটা বিস্ফোরণ ঘটুক, লোকে নড়ে-চড়ে বসুক, তখন টাকা নেওয়া যাবে।

কিন্তু কনসেপ্ট তোমার, সেটার একটা স্বীকৃতি থাকবে না?

স্বীকৃতি মানে? ওমুক হিট বিজ্ঞাপনটা এই লোকটার তৈরি, এরকম বলা যায় নাকি?

বেশ, না-ই বা গেল। কিন্তু রয়্যালটি?

না রে, নিজের সন্তান বেচে পয়সা নেওয়া যায় না। কিন্তু বাদ দে, সন্তানের কথা থাক।

কেন থাকবে কেন অনিরুদ্ধদা? তুমি বলছিলে অন্তরার ওষুধপত্র, ডাক্তার—কী হয়েছে অন্তরার? নতুন কোনও খবর আছে?

নতুন খবর? হ্যাঁ, নতুন, আবার নতুন নয়। অন্তরার শরীরের মধ্যে একটা ছায়া এসেছিল জানিস। কোনও একটা গ্যালাক্সির, কোনও একটা নক্ষত্রের ছায়া। তো সেই ছায়াটা নষ্ট হয়ে গেছে।

ছায়া কীভাবে নষ্ট হবে অনিরুদ্ধদা? ছায়া তো পচনশীল নয়।

তুই ঠিক বলেছিস পিয়াল। কিন্তু তবুও কীভাবে কে জানে ছায়াটা নষ্ট হয়ে গেছে। আরও মুশকিল হচ্ছে যে নষ্ট হয়ে গিয়েও ছায়াটা দৃশ্যমান।

তুমি কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না অনিরুদ্ধদা।

আমিও তোকে বোঝাতে পারছি না রে। তুই অন্তরার কাছে ডিটেলে বুঝে নিস পিয়াল।

অন্তরার কাছে?

হ্যাঁ, অন্তরা তো তোর ক্লাসমেট। একদিন যাস ওর কাছে। ও তোর গান বড় ভালবাসে, ওকে গান শোনাস কয়েকটা, একটু বসিস ওর কাছে। ছায়াটার কথা জিজ্ঞেস করিস…

ঘুম ভেঙে গেল অনিরুদ্ধর। ও ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখল, ঘরে তখনও নীল আলোটা জ্বলছে। দু’বার চোখে হাত বুলিয়ে চোখটা সইয়ে নিয়ে অনিরুদ্ধ দেখল, হাঁটুর ওপর মুখটা গুঁজে চুপ করে বসে রয়েছে সুরমিতা। স্নিগ্ধদেবকে দেখা যাচ্ছে না। দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে অনিরুদ্ধ বলল, আলোটা জ্বালবেন?

সুরমিতা কোনও কথা না বলে আলোটা জ্বেলে দিল। একটা নীলরঙের চাদরে নিজেকে ঢেকে বসে আছে সুরমিতা। এতক্ষণ কী হয়েছে না হয়েছে ওর আন্দাজ করতে ইচ্ছে হল না। জিজ্ঞেস করল, স্নিগ্ধদেব কোথায়?

চলে গেছে, সুরমিতা নিচু গলায় বলল।

চলে গেছে? আমার টাকা না দিয়ে চলে গেল?

কীসের টাকা? সুরমিতা সরল গলায় বলল।

অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওই একটা লেখার জন্য কিছু সম্মানদক্ষিণা পাওয়ার ছিল। বলেই উঠে দাঁড়িয়ে একটু টাল খেতে খেতে ঘর সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে যখন বেরোল, দেখল সুরমিতা খুব সহজ নিশ্চিন্ততায় ব্লাউজের ভিতর হাত দু’টো গলাচ্ছে। অনিরুদ্ধ নির্বিষ কৌতূহলে ওর সম্পদের দিকে একবার তাকাল। তাকাতেই মনে হল, ওকে টাকা না দিক স্নিগ্ধদেব সুরমিতার অঙ্গে নিশ্চয়ই নিজের সই দিয়ে গেছে। আসল সই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *