স্থির হয়েও চঞ্চল

স্থির হয়েও চঞ্চল

ওদের বাড়ির বাঁজা পেঁপে গাছটায় যে-বছর পেঁপে ধরল, পিয়ালের মায়ের কী আনন্দ! পাড়ার এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে খবর দিয়ে আসতে গেল। রাতে পিয়ালকে বলল, সেই তোর বাবা থাকতে শেষবার ফল দিয়েছিল গাছটা। আজ আবার এত বছর পর। ইস, মানুষটা বেঁচে থাকলে কী খুশিই না হত! আঁচলে চোখ মুছল মা।

পিয়াল খাওয়া থামিয়ে বলল, একবার ফল দিয়েছিল?

হ্যাঁ দিয়েছিল তো। অবশ্য তখন তুই ছোট। তোর মনে থাকার কথা নয়।

আমার নাই বা থাকল তোমার তো আছে। তুমিও তা হলে অন্যদের দেখাদেখি গাছটাকে বাঁজা বলো কেন? একবার যে ফল দেয় সে কি কখনও বাঁজা হয়?

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তাও ঠিক। আবার জানিস একবার ফল দিলেই হয় না। বছর বছর দিতে হয়। নইলে লোকে মনে রাখতে পারে না।

পিয়াল সেই কথার উত্তরে সেদিন আরও অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু আজ ওর মনে হয় মায়ের কথাই ঠিক। ঠিক বলেই পিয়ালকে প্রতি মুহূর্তে শুনতে হয় যে ওর পুরনো গান নতুনের চাইতে ভাল। আবার সেই রকম গান কবে পাওয়া যাবে সেই প্রশ্নের উত্তরে ওর একটাই কথা বলতে ইচ্ছে হয় যে, কোনওদিন পাওয়া যাবে না। মাটি বদলে গেছে, সার বদলে গেছে, আবহাওয়া বদলে গেছে, গাছের ফল এক থাকবে কী করে? সেই কথা না বলে ও বলে, পুরনোগুলো বেশি ভাল লাগলে ওগুলোই শুনুন না। কিন্তু উত্তর শুনে প্রশ্ন-করিয়েরা খুশি হয় না। আর তখনই পিয়ালের মনে ওই পেঁপে গাছটার ছবি ভেসে ওঠে, বছর বছর নতুন ফল দিতে না পারায় যে বাঁজা বনে গিয়েছিল।

প্রেম পেঁপে নয় ঠিকই, কিন্তু সংস্থিতাকে অত তীব্রভাবে ভালবাসার পর থেকে পিয়ালও ওই ব্যাপারে বন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। গল্পের মজার দিকটা হল সংস্থিতা ওর প্রেমটাকে ঠিকঠাক বোঝেইনি কোনওদিন। বন্ধু হিসেবে পিয়ালের ভীষণ কাছের ছিল, একটা মায়া কাজ করত ওর পিয়ালের ওপরে। কিন্তু সেই মায়াটা পিয়ালের মুখে টিফিন ভরে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পিয়ালের এখন অন্তত তাই মনে হয়। নইলে অতি তুচ্ছ একটা ব্যাপার অত সিরিয়াসলি নিল কেন সংস্থিতা? কেন আর তারপর থেকে কোনও সম্পর্কই রাখল না পিয়ালের সঙ্গে?

সতীর্থ বলে, ওইভাবে দাগা দিয়ে বেরিয়ে গেল বলে তুই ওরকম কুলুঙ্গিতে রেখে ফুল-বেলপাতা দিচ্ছিস এখনও। নইলে নরমাল পরিস্থিতিতে তোর আজকে যা স্ট্যাচার তুই ওরকম একটা পাতি মেয়েকে পাত্তাই দিতিস না। পিয়াল যথারীতি তর্ক করে না সতীর্থর সঙ্গে। কিন্তু ওর খুব খারাপ লাগে। সংস্থিতা পাতি? তা হলে দামি কে? টুয়া? সতীর্থকে না জানিয়েই ও যাকে সঙ্গে নিয়ে বর্ধমান এসেছে?

কাল রাত থেকে টুয়া এসএমএস-এর পর এসএমএস পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে ওর জন্মদিনটা ও পিয়ালের সঙ্গে কাটাতে পারে কিনা। পিয়াল বলেছে, আমি কলকাতায় থাকছি না কাল।

টুয়া এসএমএস করেছে, আমি তো কলকাতার সঙ্গে আমার জন্মদিনটা কাটাতে চাইছি না।

পিয়াল লিখেছে, বর্ধমান যাওয়া-আসা, একটু রাত হতে পারে কিন্তু ফিরতে। তোমার বাড়িতে চিন্তা করবে না?

টুয়া লিখেছে, যতদিন পর্যন্ত না আপনি বাবাকে দিয়ে একটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি লিখিয়ে নিচ্ছেন আমার ব্যাপারে, ততদিন বাড়ির লোক চিন্তা করবেই।

পিয়াল লিখেছে, তুমি যে-কথাগুলো বলছ তার কী মানে দাঁড়ায় তুমি জানো?

টুয়া উত্তর দিয়েছে, আমি যে-পাগলামিগুলো করছি, তার থেকে কোনও গান দাঁড়ায় কিনা আপনি আমাকে বলুন।

শেষ গানটা গাইতে গাইতে পিয়াল বুঝতে পারছিল আজ ও ছাপিয়ে গেছে নিজেকে। প্রেম আবারও ওর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, রাজি হয়েছে ওর পিঠে সওয়ার হতে।

আমাকে প্রথমবার দেখে তোমার কী মনে হয়েছিল? দ্বিতীয়ত, আমার এমন কী আছে যাকে তুমি হিংসে করো? তৃতীয়ত, আমাকে জড়িয়ে তোমার কোনও ইচ্ছে আছে কি? চতুর্থত, আমার ভিতরে এমন কী আছে যা তুমি কোনও দিন ভুলতে পারবে না? টুয়ার পাঠানো এই এসএমএস-টার উত্তর টুয়া এসএমএস-এ চায়নি। পিয়ালের মুখে শুনতে চেয়েছিল। গত রাতে পিয়াল সেরকম প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল ওকে। কিন্তু আজ কৃষ্ণসায়রের টলটলে জলের সামনে ঘাসের ওপর টুয়ার পাশে বসে পিয়ালের মনে হচ্ছিল প্রশ্নগুলো প্রশ্নপত্রে থাক, উত্তরগুলো ফুলস্কেপ কাগজে থাক, টুয়া শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাক বিরামহীন।

অনুষ্ঠান শেষে ও যখন ‘আমি একটু আধ ঘণ্টার জন্য আসছি, তোরা জিনিসপত্র গুছিয়ে খেয়ে নে’ বলে হলের বাইরে বেরোচ্ছিল তখন ওর ব্যান্ডের রাঘব, তুহিন কিংবা চাঁদুর মুখ দেখেই পিয়াল বুঝতে পারছিল ওরা সব বুঝতে পেরেছে। বড় গাড়িটাতে করে আর সকলের সঙ্গে পিয়াল যখন এল না, তখনই কি বুঝতে পারেনি? পিয়ালের লজ্জা করছিল। কিন্তু কীভাবে সবাই খুশি হয়, তাই নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক ল্যাজেগোবরে হয়েছে ও। আজ তাই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই কাজ করছিল পিয়াল আর টুয়াকে নিয়ে বর্ধমানের এই অপূর্ব দিঘিটার সামনে চলে আসা তারই একটা স্যাম্পল।

আমি আসায় তুমি কত ভাল গাইলে দেখলে? টুয়া একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক বলল।

শুনলাম, পিয়াল বলল।

বেশ এবার তবে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।

তোমাকে প্রথমবার দেখে আমার মনে হয়েছিল তোমাকে আরও অনেক আগে কেন দেখিনি।

দেখোনি কারণ তখন আমি বাচ্চা ছিলাম, এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর।

তোমার চশমাটাকে আমি ভীষণ হিংসে করি। ও কেন সারাক্ষণ তোমার চোখ দুটোকে ছুঁয়ে থাকবে?

টুয়া চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলে বলল, মাইনাস পয়েন্ট টু ফাইভ, না পরলেও চলে। চশমাহীন টুয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল পিয়াল। টুয়া ওর মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল, আমার অ্যাকোয়ারিয়ামের গোল্ড ফিশটা আমার দিকে ঠিক এইভাবে তাকিয়ে থাকে।

তাই? তোমায় চেনে?

চেনে মানে? সারাদিন নড়ে না, চড়ে না, কিন্তু যেই আমি জলের মধ্যে একটা আঙুল ডোবাই এপাশ থেকে ওপাশ চরকিপাক খেতে থাকে।

টুয়ার শেষ কথাগুলো ভাল শুনতে পেল না পিয়াল। ওর মাথার মধ্যে তখন একটা গান, যার দুটো লাইন টুয়াকে প্রথমবার দেখে এসেছিল, লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে।

অলরাইট এবার তৃতীয় প্রশ্নটার উত্তর দাও, টুয়া আদেশের ভঙ্গিতে বলল।

পিয়াল মনে মনে বলল, আমার ইচ্ছে শুধু তোমার দাদার ছেলের পিসেমশাই হওয়া। মুখে বলল, তুমি চাও আমি গিটার বাজিয়ে গান করি?

টুয়া বলল, ডেফিনিটলি, তা নইলে মুড আসে?

বহুদিন আগে সংস্থিতা বারণ করে বলেছিল, গিটার হাতে ট্যাংটাং করিস না, তোকেও আর পাঁচজনের মতো লাগবে। তখন সদ্য সদ্য গিটার শিখেছে পিয়াল। প্রবল ইচ্ছে বাজানোর, কিন্তু সেই ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংস্থিতার আদেশ শিরোধার্য করেছিল। আজ কত কত বছর পরে ঘামে ভেজা পাগড়ির মতো সেই আদেশ মাথা থেকে নামিয়ে রেখে ও টুয়ার ওর জন্য নিয়ে আসা গিটারটার রানওয়েতে পাক খেতে খেতে ডানা মেলল সুরে।

…রোদ্দুরে তোর মুখ আতসকাচ

অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে সোনা মাছ

স্থির হয়েও চঞ্চল…

টুয়া বিভোর গলায় বলে উঠল, তারপর?

পিয়াল তখন সুর দিয়ে বাতাস কাটছে—

…অসুর সিংহের পাশেই রাজহাঁস

ফুটছে কাশফুল তাই বারো মাস

নামছে খুশির ঢল…

টুয়া বলল, আমার জন্মদিন এবার ফুরোবে না দেখো।

পিয়াল সেই প্রথম দেখায় ফিরে এসে বলল

দাঁড়িয়ে আছিস ছবির মতো

তোর যত সুখ, দুঃখ যত

বল আমাকে বল…

টুয়া হঠাৎ ওর মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বন্ধু মহা ইরিটেটিং লোক তো! কনস্ট্যান্ট ফোন করে যাচ্ছে।

পিয়াল গানের ঘোরের মধ্যে থেকেই বলল, কে সতীর্থ? ধরে নাও, একবার ধরে নাও।

টুয়া মোবাইলের পক্ষে একটু চড়া গলায় বলল, হ্যাঁ, কী হয়েছে? কী প্রবলেম?

প্রবলেম আমার নয়, পিয়ালের। ওকে বললা সংস্থিতা ওর সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে, ওর প্রাইভেট নম্বর দেব কি? সতীর্থ কড়া গলায় বলল।

ওসব সংস্থিতা-ফংস্থিতা যেই হোক, বলে দিন পিয়াল এখন কথা বলতে পারবে না।

তুমি পিয়ালকে একবার জিজ্ঞেস করে নাও…

জিজ্ঞেস করার কী আছে? বললাম তো ওই সংস্থিতার সঙ্গে এখন কথা বলতে পারবে না।

পিয়াল ওর ঘোরের মধ্যে প্রথমবার নামটা খেয়াল করেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার নামটা যেন দশ মন পাথরের মতো নেমে এল ওর মাথায়। ও একটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টুয়ার হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল, কী হয়েছে সংস্থিতার, সতীর্থ?

ওর সেই উঠে দাঁড়ানোয় টুয়ার ওকে দেওয়া গিটারটা ধপ করে পড়ল ঘাসের ওপর। গিটারের গায়ে লেগে থাকা সুরের বিন্দুগুলো ছড়িয়ে গেল মাটিতে, গড়িয়ে গেল কৃষ্ণসায়রের জলে। টুয়া সেই দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল, কে? সংস্থিতা কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *