সেই চেয়ার

সেই চেয়ার

শুধুমাত্র কেয়া মৈত্রর বাড়িতে এলেই এই চা-টা খেতে পাওয়া যায়। উনি বলেন, উনি নাকি কলকাতারই কোনও দোকান থেকে কেনেন, কিন্তু কোন দোকান ভুলেও তার নাম বলেন না। বলে দিলে যদি সংস্থিতা আর ওঁর বাড়িতে না আসে! সংস্থিতা ওঁকে বোঝাতে পারে না শুধু চায়ের ফ্লেভারের টানে মানুষ মানুষের কাছে আসে না, মানুষ আসে মানুষের টানে। কিংবা কে জানে, কেয়া মৈত্র হয়তো সবটাই বোঝেন। বুঝেও একটু মজা মেশানো গোঁয়ারতুমি করেন।

তুমি চাইলে তোমার জন্য আমি কিছুটা চা প্যাক করিয়ে দিচ্ছি। ঘরে নিয়ে যাও, যখন ইচ্ছে করবে খাবে, কেয়া মৈত্র আজও বললেন।

ম্যাম, আপনি এরকম করলে আমি পরদিন থেকে আর এই চা-টা খাব না, সংস্থিতা বলল।

বেশ চায়ের কথা থাক। তোমার কথা বলো।

আমার নতুন কোনও কথা নেই ম্যাম।

ও মা, সে কী! কেয়া মৈত্র একটু অবাক হলেন।

জলভরা কলসির দিকে যেভাবে পাথর ছুড়ে মারে বাচ্চারা, ওঁর বিস্ময়ের দিকে সেভাবে একটা কিছু ছুড়বে বলে সংস্থিতা বলল, শিকল লোহারই হোক বা সোনার, মানুষকে বেঁধেই রাখে।

কেয়া মৈত্র বললেন, বাঁধন নিয়েই আমরা হাঁটি-চলি-দৌড়োই।

সংস্থিতা ওঁকে থামিয়ে বলল, বাঁচি, মরি। কিন্তু চায়ের দোকানের নামটা কাউকে বলি না।

কেয়া মৈত্র হো-হো করে হেসে উঠলেন। সেই হাসিটার হাত ধরে সংস্থিতা সাত-আট বছর ঘুরে এল।

তুমি করবে, তুমি? পিডি, মানে প্রলয় দত্ত অনুরাধাকে জিজ্ঞেস করলেন।

অনুরাধা দোনোমনা করছিল। এমন সময় কেয়াদি সংস্থিতার দিকে আঙুল তুলে পিডিকে বললেন, এই মেয়েটাকে দিয়ে করাও না, ও ভাল পারবে।

কী পারবে, কেন পারবে, কীভাবে পারবে কিছুই সে-মুহূর্তে জানত না সংস্থিতা। শুধু এগিয়ে গিয়েছিল কেয়াদির ব্যক্তিত্বের অমোঘ আকর্ষণে। সেই আকর্ষণ থেকে সান্নিধ্য, সান্নিধ্য থেকে সম্পর্ক। যদিও কোনও এক অজানা কারণে কেয়াদিকে ও বরাবরের মতো আজও ম্যাম বলে। কেয়াদি সরাসরি ওর অধ্যাপিকা ছিলেন না বলেই হয়তো একটা দূরত্ব, একটা সম্ভ্রমের জায়গা ওর আর কেয়াদির নৈকট্যের ভিতরে হালকা কোনও শেডের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বিজন সেতু পেরিয়ে আর একটুখানি গেলেই কেয়াদির বাড়ি। ফ্ল্যাট নয়, বাড়ি। ছিমছাম দোতলা। সামনে খুব সুন্দর একফালি বাগান আছে। আগে বাড়িটার দোতলার বারান্দায় বসলে অনেকখানি দেখতে পাওয়া যেত। ইদানীং বড় বড় মাল্টিস্টোরিড উঠে ভিউটা আটকে দিয়েছে কিন্তু বাড়িয়ে দিয়ে গেছে শব্দ। দক্ষিণ কলকাতার কেন্দ্র থেকে বাইপাসে ঢুকে পড়ার শব্দ। ওই অতঅত গাড়ির অত রকম শব্দ মিলেমিশে একটা ভজকট আওয়াজ তৈরি হয় আর সেই আওয়াজটাকে সংস্থিতার অন্য একটা আওয়াজের সমান্তরাল বলে মনে হয়। ছোটবেলায় গ্রামে দাদুর বাড়িতে গেলে বিকেলের সমস্ত হুটোপাটির মধ্যে ও কিছুটা আতঙ্কের সঙ্গে অপেক্ষা করত একটা শব্দের জন্য। সূর্যাস্তের আগে-পরে বাগাল ছেলের তীক্ষ্ণ শিসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোরুর গলায় বেজে ওঠা ঘন্টির টাংটুং শব্দ। সেই শব্দটা যেমন কিছু না বলেও বলে দিত, সময় শেষ, খেলার সময় শেষ, ওই বাস-অটো-ট্রামের কর্কশ আর্তনাদও যেন একজোট হয়ে বলতে চায়, প্রেমের সময় শেষ, সম্পর্কের সময় শেষ। আর কীভাবে কে জানে কল্লোলের গলায় সেই শেষ পাতের এঁটোকাঁটা উঠে আসে। ও একটা সিগারেট ধরিয়ে অবলীলায় বলে, তোমার না পোষালে তুমি রিলেশনশিপটা শেষ করে দাও।

স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকায় সংস্থিতা, তার মানে? এটা কি রিকশার ভাড়া নাকি যে পোষালে যাব, না পোষালে নয়?

আমি তত্ত্বকথায় যেতে চাই না সংস্থিতা। আমি টায়ার্ড হয়ে ফিরে আসার পর একটু স্বস্তি চাই। আমোদ চাই একটু, কল্লোল বলল।

টায়ার্ড? তুমি টায়ার্ড হও কীভাবে? তুমি তো কাজেই যাও না! পড়ে পড়ে ঘুমোও, নয়তো মদ খেতে শুরু করো দুপুর থেকে…

করি তো বেশ করি। তোমার কী?

একটা ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে জানো তো তোমাকে! তোমার লাইফ তুমি ধ্বংস করলে আমার ব্যাং! কিন্তু আমি তো তোমার লাইফের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি, তাই না? কপালের ঘাম মুছল সংস্থিতা।

হো-হো করে হেসে উঠল কল্লোল, তাই বলল, তুমি তোমার নিজের জন্য চিন্তিত! বেসিক্যালি আমরা সবাই কী ভীষণ স্বার্থপর, তাই না?

সংস্থিতা উত্তর দেয় না। বাইরে একটা হাওয়ার আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। সংস্থিতা উঠে গিয়ে দরজাটা আরও হাট করে খুলতে গিয়ে দেখে গত বর্ষায় বেড়ে গেছে বলে দরজাটা ঠিকঠাক খুলছে না। ওর মনে হতে থাকে ও নিজেও মানসিকতায় অনেকটা বেড়ে গেছে কল্লোলের থেকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আউটগ্রো’ করা, সেই আউটগ্রো করেছে। ওর মুকুলিত হওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি কল্লোল আর সংস্থিতা ওকে অতিক্রম করে যে-জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে কল্লোলকে ছুঁতে গেলে ওকে পিছনদিকে নিজেকে বাঁকাতে হয়। ঘাড়ে ব্যথা করে, কোমরে ব্যথা করে।

আমাদের কত দিনের প্রেম কল্লোল? সংস্থিতা জিজ্ঞেস করল।

আমাদের তো লাভ-হেট রিলেশনশিপ। আমার লাভ আর তোমার হেট। কল্লোল সোফায় আধকাত হয়েই সিগারেটের শেষ টুকরোটা ছুড়ে দিল ট্র্যাশক্যানের দিকে। সামান্য দূর গিয়েই ওটা মুখ থুবড়ে পড়ল।

সংস্থিতা মাটি থেকে টুকরোটা তুলে নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোমার যখন পক্স হয়েছিল তুমি মশারির ভিতর বসে কাতরাতে সারাদিন আর আমি এই মেঝেতে বসেই পরীক্ষার পড়াগুলো তোমায় পড়ে পড়ে শোনাতাম, একবার নয় বারবার পড়ে শোনাতাম। সেটাও কি ঘৃণা ছিল কল্লোল?

কারও জন্য কিছু করে অতবার করে শোনাতে নেই। অবশ্য সেই কাজটা করার জন্য তোমার মনে এখন যদি অনুতাপ জাগ্রত হয়ে থাকে, তা হলে অন্য কথা।

অনুতাপ সেই কাজটার জন্য হয়নি, অনুতাপ হচ্ছে সেই কাজটার পরিণতি দেখে। প্লিজ কল্লোল বেরিয়ে এসো। কাম আউট।

কোত্থেকে বেরিয়ে আসব? কাম আউট অফ হোয়াট?

যে-গর্তটায় তুমি নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছ, সেখান থেকে।

আমি কোনও গর্তে নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলিনি, তুমি ভুল করছ। আমার বসটা একটা খেঁকুটে লোক, আমি তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে পারছিলাম না, তাই আমি ওই চাকরির মুখে একটা লাথি মেরে বেরিয়ে এসেছি।

তুমি তো আগের চাকরিটার মুখেও ঘুসি মেরে বেরিয়ে গিয়েছিলে, সংস্থিতা গলা নামিয়ে বলল।

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কারণ, সেখানেও নিশ্চয়ই আমার কোনও না কোনও প্রবলেম হচ্ছিল। তুমি মুখে বলো যে আমাকে ভালবাসো, কিন্তু আমার সমস্যাগুলো বুঝতে চাও না।

এগুলোকে সমস্যা বলে না কল্লোল। এগুলো প্রত্যেকটা বাতিক।

বাতিক? আমার প্রবলেমগুলো বাতিক?

ডেফিনিটলি। তুমি আসলে এই সমস্যাগুলো ভেবে ভেবে তৈরি করো, চাকরি ছেড়ে দেওয়ার অজুহাত হিসেবে।

কেন?

কেন আবার কী! তুমি কোনও কাজ করতেই চাও না। তুমি চাও সারাদিন বসে বসে মদ খেতে, ডিভিডিতে সিনেমা দেখতে কিংবা কম্পিউটারে চ্যাট করতে, নয়তো ঘুমোতে।

তোমার স্পনসরশিপে সংস্থিতা?

না, আমার স্পনসরশিপে নয়। টাকাটা তোমার বাবা দিচ্ছেন নাকি মহারানি ভিক্টোরিয়া দিচ্ছেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না কল্লোল। টাকাটা তোমায় একটা ভেড়া বানিয়ে দিচ্ছে।

বেশ তো আমি ভেড়া। তুমি তোমার পছন্দমতো একটা গাধা, ঘোড়া কিংবা সিংহ খুঁজে নাও না! আমি তো আটকে রাখিনি তোমায়, কল্লোল হাই তুলল।

রাগে আগুন হয়ে দরজার কাছ থেকে সরে এসে ওর শার্টটা খিমচে ধরল সংস্থিতা, কেন আটকাচ্ছ না কল্লোল? কেন? আর যদি আটকাবেইনা, তা হলে এতদিন আটকে রাখলে কেন? আমি তো ছ’-সাত বছর ইয়ারকি মারছিলাম না তোমার সঙ্গে। সারাজীবনের জন্য নিজেকে ইনভেস্ট করেছিলাম তোমার কাছে, তোমার ভরসায়।

কল্লোল হাত দুটো আকাশে তুলে দিয়ে বলল, আই অ্যাম সরি সংস্থিতা। আমি কোনও ডিভিডেন্ড দিতে পারব না তোমায়। আমার সব কিছু ক্র্যাশ করে গিয়েছে।

কিচ্ছু ক্র্যাশ করেনি, কল্লোল। এসো আমরা আর একবার চেষ্টা করি একসঙ্গে।

কোনও লাভ নেই। গুলতির থেকে ঢিলটা ছিটকে বেরিয়ে গেছে। আমার প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন অসাড় লাগে এখন। তুমি ঠিকই বলেছ, হয়তো সব কিছুই আমার বাতিক! কিন্তু কী ব্যাপার জানো, ওই বাতিকই আমার বস। আমি আর অন্য কোনও বসকে সহ্য করতে পারি না। তাই ছাড়ার জন্যই চাকরি ধরি। আর সেই ছাড়ার সুখটা এত অসহ্য যে আবার ধরতে ইচ্ছে করে।

একবার কোনও সাইকায়াট্রিস্টের কাছে চলো না? আমি নিয়ে যাব।

কী বলবে সাইকায়াট্রিস্ট? সেই তো ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াবে। তার চেয়ে আমি এমনিই ঘুমোই।

সংস্থিতা দরজাটা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বড় রাস্তার একটা হাতের মতো ঢুকে যাওয়া এই গলিটা প্রশস্ত এবং নির্জন। এই বাড়িটার তিনতলা আর চারতলায় কল্লোলদের দুটো ফ্ল্যাট। কত বছর ধরে এখানে আসছে সংস্থিতা। তবে কল্লোলের বাবা স্ত্রী-বিয়োগের পরে আর ওপরের ফ্ল্যাটটায় থাকেন না। কল্লোলের দিদি-জামাইবাবুর কাছে চলে গেছেন প্যারিসে। তাই কল্লোল একা এবং মাঝেমধ্যে ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আয়েশ করে দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে। বারান্দার উলটোদিকের ফুটপাথে স্ট্রিটলাইটের নীচে একটা বাচ্চা খাতার ওপর কম্পাস দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকার চেষ্টা করছিল। সংস্থিতা ওই মাথাগরম অবস্থাতেও অনেকক্ষণ ধরে দেখল দৃশ্যটা। ওর মনে হতে থাকল ওই বৃত্তটাই বোধহয় স্বপ্ন। সমস্ত কাজ আর বিশ্রাম দিয়ে ওকেই ছোঁওয়ার চেষ্টা করে মানুষ। অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যে ওই বিন্দুটা, যেখানে কম্পাসের একটা কাঁটা রেখে বাচ্চাটা ‘গোল’ আঁকার চেষ্টা করছিল, সংস্থিতাকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। ওই গোলটাই তা হলে সেই পৃথিবী যার ভিতরে থাকার জন্য অহর্নিশ পরিশ্রম করতে হয়!

সংস্থিতা কল্লোলকে বলার চেষ্টা করল, ওই বাচ্চাটা যেমন কম্পাসের একটা কাঁটা স্থির রেখেছে একটা কোনও বিন্দুর ওপরে, তুমি আমার হৃদয়ে তোমার একটা সত্তাকে স্থির রাখো। বাকিটুকুকে ছড়িয়ে দাও। তারা পৃথিবী তৈরি করুক আবার সেই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণও করুক একইসঙ্গে। সংস্থিতা বলতে চাইল, কিন্তু ওর গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। কল্লোল যেমন ঝিম মেরে বসে ছিল, তেমনই ঝিম মেরে বসে রইল। সংস্থিতা ওর দিকে তাকিয়ে ফুটপাথে বসে থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকাল আবার। কোনও যোগসূত্র পেল না দুটো দৃশ্যের মধ্যে। ভয় পেল খুব। আর ভয় পেয়ে বরাবরের মতো বীজমন্ত্র জপ করতে শুরু করল মনে মনে।

তুমি কবে দীক্ষা নিয়েছ? কেয়া মৈত্র জিজ্ঞেস করলেন।

অনেকদিন, আমার তখন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স, সংস্থিতা একবার চোখ বন্ধ করল।

তারপর থেকে নিয়মিত জপ-ধ্যান করো? কেয়া একটু যেন অবাক গলাতেই জিজ্ঞেস করলেন।

ধ্যান করে উঠতে পারি না। তবে জপ করি প্রতিদিন।

সেই একশো আট বার না কতবার করে করার নিয়ম আছে, না?

ওটা মিনিমাম। বাড়ালে ভাল, আরও ভাল নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও, মানে ধরুন, যখনই মনের মধ্যে টানাপড়েন চলে, তখনই জপ করতে শুরু করা।

একটা কথা বলছি সংস্থিতা, কিছু মনে কোরো না। জপের মন্ত্র তো সাধারণত একাক্ষর, দু’অক্ষর বা ওইরকম হয়। এবার আমি যদি একটা কোনও গানের বা কবিতার লাইন, ধরো, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’ এটাই বারবার বলতে থাকি আমার মানসিক অস্থিরতার সময় এবং বলে যদি স্বস্তি পাই, তা হলে রবিঠাকুরের ওই লাইনটাকে কি আমি আমার মন্ত্র বলে মনে করতে পারি না?

নিশ্চয়ই পারেন, একশোবার পারেন। তবে এই মন্ত্রের সঙ্গে আমার মন্ত্রের একটা তফাত আছে।

কী?

এটা মন্ত্র আর আমারটা সিদ্ধমন্ত্র।

মানে?

মানে ধরুন, আপনি প্রচণ্ড খিদের সময় কিছু খেতে চাইলেন আর আমি আপনাকে চাল, ডাল, তেল, নুন, ঘি, কাঁচালঙ্কা সব দিলাম। এখন এই জিনিসগুলো সবই খাদ্যবস্তু, কিন্তু এগুলোকে খাওয়ার জন্য আপনাকে উনুন ধরাতে হবে কিংবা গ্যাস জ্বালাতে হবে। এটা হল মন্ত্র। আর সিদ্ধমন্ত্র হল, আপনি খেতে চাইলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে গরম এক থালা ভাত, ডাল, তরকারি এনে দিলাম। ব্যস, আপনি খাওয়া শুরু করে দিন।

শুরু তো করব, কিন্তু তুমি মাছও দিয়ে একপিস! আমার স্বামী যদিও মারা গেছেন, আমি মাছ-টাছ খাই, কেয়া হাসতে হাসতে বললেন।

সংস্থিতা বিব্রত হয়ে বলল, এমা, আমি তা মিন করিনি। আমি জাস্ট উদাহরণ হিসেবে…।

কেয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দুর পাগলি! আমি মজা করছিলাম। কিন্তু সিরিয়াস যে-প্রশ্নটা আমার মনের মধ্যে ঘুরছে-ফিরছে তা হল মন্ত্র, সিদ্ধমন্ত্র হয় কীভাবে?

সংস্থিতা খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, কার্তুজ যেভাবে গুলি হয়ে ওঠে। আমি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, নাড়াচাড়া করতে করতে আপনার দিকে ছুড়ে দিলাম, আমার ছোড়া বুলেটে কি আপনি মারা যাবেন? কিন্তু ওই একই বুলেট যদি কোনও রাইফেলের ভিতর থেকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসে…

কেয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি গতির কথা বলছ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি শব্দের ভিতরে প্রচণ্ড গতি, ভয়ংকর তেজ ভরে দেননি? আপাতনিরীহ কতগুলো শব্দকে মর্মভেদী কোনও পঙ্‌ক্তিতে রূপান্তরিত করেননি?

সংস্থিতা সামান্য ফাঁপরে পড়ে বলল, নিশ্চয়ই করেছেন, কিন্তু আমি বলতে চাইছিলাম কবিতার শক্তি আর সাধনার শক্তি বোধহয় ঠিক একই রকম নয়। কবিতার পিছনে কিছুটা হলেও কবির আত্মপ্রীতি কাজ করে। তিনি নিজের মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীকে বুঝতে চান, ধরতে চান…

আর সাধকের ক্ষেত্রে?

সাধক বা ঋষির রাস্তা ভিন্ন। তাঁকে সারা পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে নিজেকে বুঝতে হবে বা বলা ভাল নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে বিশ্বপৃথিবীর হিতার্থে।

তাই? কেয়া অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ। তবে রবীন্দ্রনাথের কথা আলাদা। উনি যেখানে কালি-কলম আর কাগজ এক করেছেন সেখানেই সরস্বতী। কিন্তু তারপরও একটা ব্যাপার থাকে। আপনি ভীষণ বিপদে পড়লে তো আর রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রার্থনা করতে পারবেন না, ঠাকুর আমায় রক্ষা করো বলে, কিংবা ইংরেজরা তো ঝামেলায় পড়লে শেক্সপিয়রের কাছে গিয়ে মাথা ঠুকতে পারে না!

দাঁড়াও, দাঁড়াও, কার নাম করলে? কেয়ার চোখে অনেক দূরের কোনও ছবি।

শেক্সপিয়রের, কেন? সংস্থিতা একটু ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল।

কেয়া একটু চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো। তুমি তো জানো, আমার ছেলে হওয়ার পরই অরুণাংশুর হার্টের অসুখ ধরা পড়ে। আমার শ্বশুরমশাই প্রতিপত্তিশালী লোক ছিলেন, বড় ছেলের জন্য কোনও চিকিৎসাই তিনি বাদ রাখেননি। সেসব চলতে চলতে একসময় ঠিক হল, ও বিলেতে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে, সঙ্গে যাব আমি। বাবানের তখন সাড়ে তিন-চার বছর বয়স। তবু ওকে আমি শাশুড়ি-মা’র কাছে রেখে যেতে রাজি হলাম, কারণ ওইটুকু বাচ্চাকে লন্ডনে কার কাছে রেখে এ-ডাক্তার ও-ডাক্তার করে বেড়াব! আর তা ছাড়া অরুণাংশু নিজেও রাজি ছিল না। ও বলল, বাচ্চারা সব বুঝতে পারে, বাবা মরণাপন্ন, বাবা এখানে চিকিৎসা করাতে এসেছে, এই ব্যাপারটা তুমি কিছুতেই বাবানের কাছে বেশিদিন চেপে রাখতে পারবে না। আর যখনই ও ব্যাপারটার একটা অস্পষ্ট আন্দাজ করতে শিখবে মনে-মনে, ওর ওপরে একটা সাংঘাতিক নেগেটিভ চাপ পড়বে।

বাবানকে ছাড়া এতদিন আমরা থাকব? আমি মিনমিন করে বললাম।

বাবানকে ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি যাতে চলে যেতে না হয়, সেজন্যই তো যাচ্ছি! অরুণাংশু বলল।

আমি কোনও কথা না বলে ডান হাতটা দিয়ে ওর মুখ চাপা দিলাম।

তারপর? গেলেন লন্ডন? সংস্থিতা তর সইতে না পেরে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, জীবনের ওই তিন সপ্তাহের আনন্দ এখনও আমার শিরা-উপশিরায় ঘুরে বেড়ায়! এত আহ্লাদ, এত পুলক আমাদের দু’জনের মধ্যে উড়ে বেড়াত, মনে হত যেন আমরা হনিমুনে এসেছি। রোগ-বিসুখের কথা মাথায় থাকত না এক-এক সময়। অবশ্য প্রাথমিকভাবে একজন বড় ডাক্তার খুব ভরসা দিয়েছিলেন আর সেটাও আমাদের ফুর্তির একটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল বলতে পারো। সে যাই হোক, লন্ডনের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে আমরা ঠিক করলাম শেক্সপিয়রের জন্মস্থান দেখতে যাব।

কী যেন নাম জায়গাটার?

স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভন! কেয়া একটু থেমে থেমে বললেন। তারপর সামনে তাকিয়ে আছেন কিন্তু কিছু দেখছেন না এরকম ভঙ্গিতে বললেন, অ্যাভন নদীর তীরে একটা বড় গঞ্জ-শহর বলতে পারো। অনেক রকম পসরার বিকিকিনি চলত নিত্যদিন। তবে ইংরেজরা যেহেতু একটু কেঠো, মানুষে-মানুষে মেলামেশা হলে যে-ভাইব্রেশন তৈরি হয়, তার তেমন আঁচ পেতাম না। সেই আঁচ পেলাম স্ক্র্যাটফোর্ডের শেক্সপিয়র সেন্টারে গিয়ে। তুমি আমার ক্লাস করোনি কখনও, করলে জানতে আমি ক্লাসে প্রথমেই বলতাম…

সংস্থিতা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, জানি, শেক্সপিয়র একজন ভারতীয় নাট্যকার! কথাটা আমাকেও বলেছেন দু’-একবার।

কেয়া হেসে ফেললেন, লোকটা ওই নামেই ব্রিটিশ। কিন্তু মেজাজে পুরোপুরি উপমহাদেশীয়। ওর নায়িকারা অধিকাংশই নিষ্কলঙ্ক অপাপবিদ্ধ হয়ে বাঁচতে চায় আর নায়কগুলোকে দেখলে মনে হবে, লখনউ কিংবা পুরনো দিল্লির কোনও মহল বা বাজার থেকে বেরিয়ে এল এইমাত্র। আসলে শেক্সপিয়রের চরিত্রদের মধ্যে ভীষণ উত্তাপ। যে-উত্তাপ গড়পড়তা ইংরেজের মধ্যে একেবারেই নেই। সে না থাক, কিন্তু ওই স্ট্র্যাটফোর্ডে একটা চেয়ার সংরক্ষিত আছে। বলা হয়, শেক্সপিয়র ওই চেয়ারটায় বসে লিখতেন। ওখানে ঘুরতে আসা টুরিস্টদের বিশ্বাস যে, ওই চেয়ারে বসে যদি কিছু মন থেকে চাওয়া যায়, তা হলে শেক্সপিয়র সেই মনোবাসনা পূর্ণ করেন।

আপনি চেয়েছিলেন?

হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। কিন্তু অরুণাংশুর হার্টের যে-ভালভটা খারাপ সেটা ঠিক হয়ে যাক, ও অনেকদিন বাঁচুক, এরকম কিছু চাইনি। আমি বিড়বিড় করে বলেছিলাম, শেক্সপিয়র আমি যেন সারাজীবন তোমার সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকতে পারি। আমি যেন সেই সমুদ্রটাকে ধারণ করতে পারি নিজের মধ্যে, যাতে শুধু তুমিই ঢেউ। শেক্সপিয়র আমার কথা রেখেছেন সংস্থিতা। আমি ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে অনুভব করেছি কেউ যেন আমার সামনে একটা রবারের বল ছুড়ে দিচ্ছে। সেই বলটাই হ্যামলেট, সেই বলটাই পোরশিয়া। আমি পোষা কুকুরের মতো ছুটে গিয়ে সেই বলটা মুখে করে তুলে এনেছি, তার ভিতরের সমস্ত স্পন্দন উজাড় করে দিয়েছি আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছে, কিন্তু স্পন্দন ফুরোয়নি। তাই আমি আবার ছুটে গেছি সেই রবারের বলটার দিকে। বাস্তব ছেড়ে ছুটে গেছি আমার নিয়তির দিকে। অরুণাংশু ঘুরে আসার পর এক বছরও পুরো বাঁচেনি। কিন্তু সেই প্রার্থনাটা বেঁচে আছে। অরুণাংশু স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু স্ক্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভনের সেই আর্ট গ্যালারি, সেই থিয়েটার হল, সেই লাইব্রেরি আর সর্বোপরি সেই চেয়ার, যে-চেয়ারে আমি মাত্র পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের জন্য হলেও একটাই মাত্র প্রার্থনা করার শর্তে বসেছিলাম, আমার মাথার মধ্যে অনবরত পাক খায়।

সংস্থিতা কেঁদে ফেলল। ওকে কাঁদতে দেখে কেয়াদিও কাঁদলেন একটু। তারপর চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আমি যদি সেদিন অরুণাংশুর প্রাণভিক্ষা চাইতাম, তা হলে ও বেঁচে যেত?

সংস্থিতা কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলল, ওখানে কি শুধু একটাই প্রার্থনা করা যায়?

তুমি দশটা করলেই বা কে জানছে! কিন্তু তিরিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড সময় তো! আর তা ছাড়া জনশ্রুতি যে, শেক্সপিয়র একটিই মাত্র প্রার্থনা মঞ্জুর করেন তাই… আচ্ছা তুমি কি জপ করে ওঠার পরে অনেক কিছু চাও?

সংস্থিতা আবারও চুপ করে গেল। জপের শেষে সংস্থিতাও কোমায় চলে যাওয়া ওর আর কল্লোলের সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন চাইতে পারেনি। কারণ চাওয়া যায় না। কিন্তু ঠিক কী চেয়েছিল, সেটাও ওর মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। সংস্থিতা মুখ তুলে তাকাল কেয়াদির উৎসুক মুখের দিকে। বলল, অনেক কিছু চাইব ভাবি, কিন্তু শেষে ওই একটা জিনিসই চাই।

কী বলো তো? কেয়ার গলায় আগ্রহ।

আপনার বাড়ির ওই স্পেশাল চা, সংস্থিতা হেসে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *