ফুটবল, পাখি

ফুটবল, পাখি

ছেলেবেলায় লোকের অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। কেউ ভাবে ডাক্তার হবে, কেউ বা ভাবে নাবিক হবে, কিন্তু ‘আমি একজন মাতব্বর হব’ এরকম ভাবে সচরাচর লোকে ভাবে না। সতীর্থও ভাবেনি। কিন্তু যাদের ভিতরে ও বড় হয়ে উঠল, তারা নিজেরা ঠ্যাঁটগোবিন্দ হয়ে বসে থেকে সতীর্থকে সব জায়গায় এগিয়ে দিতে দিতে ওর মধ্যে একটা নেতার জন্ম দিয়ে দিল। এখন সেই নেতাকে সামলাও!

পিয়াল যেমন। একেবারে জেলি ফিশের মতো নরম তুকতুকে একটা মন নিয়ে কলকাতায় এসেছিল। যে যা বলছে, তাই বিশ্বাস করছে। ভাবটা এমন যেন আগুনে ঝাঁপাতে বললে ঝাঁপিয়ে পড়বে, শুধু একটু মিষ্টি করে বলতে হবে। অসহ্য লেগেছিল সতীর্থর। আরও অসহ্য লেগেছিল, কারণ ওর গলার মধ্যের জাদুকে লোকে নিজেদের দু’-চার আনার সুবিধের জন্য ব্যবহার করছিল। সতীর্থ সেই সময় রুখে না দাঁড়ালে আজ পিয়ালের স্টার হওয়া বেরিয়ে যেত, শিয়ালদা-নৈহাটি কিংবা হাওড়া-ব্যান্ডেল লাইনে ট্রেনে-ট্রেনে গান গেয়ে ফিরত।

তবে পিয়াল মনে রেখেছে। যে-কোনও কাজের আগে দশবার ফোন করে ওকে। কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না সতীর্থর সঙ্গে কথা না বলে, আর ফাংশন কিংবা ফেস্টে গাইবে কি গাইবে না, কত টাকা নেবে সেই ব্যাপারটা তো সতীর্থই ঠিক করে মূলত। সতীর্থ জানে, পিয়ালের ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা সবাই খুব ভালভাবে নেয় না সেটা। বিশেষ করে তুহিন ওকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। টাকা-পয়সার বাঁটোয়ারা কিংবা প্রোগ্রাম নেওয়া না নেওয়ার ব্যাপারে ও যে অনধিকার চর্চা করছে, তুহিন সেটা হাবেভাবে, ইদানীং কথাবার্তাতেও বুঝিয়ে দেয়।

সতীর্থ পাত্তা দেয় না। ও জানে ড্রাম বাজিয়ে তুহিন ঘেউঘেউ করতে পারে ওই দূর থেকে। কাছে এসে কামড়াতে পারবে না। কারণ পিয়ালকে ওদের দরকার, পিয়ালের গলাই ওদের রুজি-রুটির সবচেয়ে বড় ভরসা। সতীর্থকে চটিয়ে সেই ভরসার জায়গাটা ওরা নষ্ট করবে না।

শুধু আমাকে ভরসা বলছিস কেন? জুবিন কি ভরসা নয়? পিয়াল জিজ্ঞেস করে ওকে।

এই এক অদ্ভুত মনোবৃত্তি পিয়ালের। নিজেকে প্রতিভাবান নয় ভেবে ও ভীষণ তৃপ্তি পায়, নিরাপত্তা পায়। সতীর্থ বলে, জুবিন হয়তো তোদের অধিকাংশ গানগুলো লেখে। সুরও করে তোর সঙ্গে। কিন্তু ওর সেই স্টেজ প্রেজেন্স নেই, যেটা তোর আছে। বুদ্ধিমান ছেলে, সেটা বোঝে বলেই পিছনে থাকে।

কিন্তু আমি ওকে আমাদের সঙ্গে মঞ্চে উঠতে বলি, জানিস তো!

ও কেন তোর সঙ্গে মঞ্চে উঠতে যাবে পিয়াল? তুই কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা হাতে নেওয়ামাত্র একটা ঝড় তৈরি হয়। তার পাশে জুবিনের গলা বল, উপস্থিতি বল, একটা তালপাতার পাখার হাওয়া বলে ঠেকবে, ও ওই অপমান মেনে নেবে?

আমরা তো একসঙ্গে কাজ করি সতীর্থ, আমাদের মধ্যে এত ইগো থাকবে কেন? পিয়াল কষ্টের গলায় জিজ্ঞেস করে।

সতীর্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, এগিয়ে নিয়ে যা, প্রশ্নটাকে এগিয়ে নিয়ে যা। আমরা কেন পরস্পরের সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে ভাবতে পারব না, কেন একে অন্যের কাজকে আমাদের কাজ ভেবে আনন্দ পেতে পারব না, ক্যারি অন। তুই কি বুঝতে পারিস না নাকি কায়দা মারিস?

একে কায়দা কিংবা বিনয় ভাবলে খুব ভুল হবে। আমি অন্তর থেকেই ব্যাপারটা ধরতে চাই। কোথায় লাগে?

স্বার্থে লাগে রে শালা! অহংকারে লাগে। আমি তোর বন্ধু কিন্তু তুই আমার জুতোয় পা না ঢোকানো পর্যন্ত।

আমি তোর জুতোয় পা ঢোকাতে যাবই বা কেন? তোর আর আমার পায়ের মাপ তো আলাদা।

সতীর্থ জুতোর নীচে সিগারেটের শেষটা পিষে দিয়ে বলে, তুই বুঝবি না পিয়াল। ধান-চাল দিয়ে লেখাপড়া শিখেছিস তো, তুই কোনওদিন বুঝবি না।

হো-হো করে হেসে ওঠে পিয়াল। এই কথাটা শুনলেই। আর সেই হাসির ছররা হঠাৎ খোলা জানলার ভিতর দিয়ে ঘরে এসে পড়া আলোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু।

আশমানিকে প্রথমবার দেখেও ভেসে গিয়েছিল সতীর্থ। টাকা-পয়সার ব্যাপারে কথা ফাইনাল না করেই কথা দিয়ে দিয়েছিল।

আশমানি এসেছিল ওদের অফিসের কালচারাল সেক্রেটারির সঙ্গে। ‘কুঠার’, মানে পিয়ালদের ব্যান্ডের একটা অনুষ্ঠানের জন্য। অনুষ্ঠানটা হওয়ার কথা ছিল ওদের অফিসের আয়োজনে। মঞ্চে উঠে পিয়াল যখন গাইছে, ওর গানে গলা মেলাচ্ছে ব্যান্ডের অন্যান্যরা, কি-বোর্ড আর ড্রামসের আওয়াজে পুরো হলটা কাঁপছে, সতীর্থ একটু কাঁপা-কাঁপা হাতেই উইংস-এর ধারে ঠিক ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আশমানির হাতটা ছুঁল। ছুঁয়ে বলল, খুশি তো?

আশমানি ঘাড়টা অল্প ঘুরিয়ে বলল, খুশি তো বটেই। কিন্তু সেটা আপনার বন্ধুর গান এত কাছে থেকে শুনতে পাওয়ার জন্য নাকি আপনি আমার এত কাছে এসে দাঁড়ানোর জন্য ঠিক বুঝতে পারছি না।

সতীর্থ তাড়াতাড়ি আশমানির হাত থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, সরি। আমি কিছু ভেবে আপনার হাত ধরিনি।

আশমানি হেসে বলল, আমি অনেক কিছু ভেবে হাতটা সরিয়ে নিতে বললাম। অফিসের লোকজন সব আশেপাশে আছে।

দিনদশেক পরের একটা রোববার সন্ধ্যায় ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুটে কামড় দিয়ে সতীর্থ আশমানিকে জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে আসতে বললেন কেন?

আশমানি টি-পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে নরম চোখে সতীর্থর দিকে তাকিয়ে বলল, চা খাওয়াব বলে।

সতীর্থ ওকে ইশারায় এক চামচ চিনি দিতে বলে বলল, রোববার সন্ধেগুলো আমি সাধারণত চা খাই না।

আশমানি চোখ বড় করে বলল, কী খাওয়া হয় তা হলে?

রাম।

একদম খাবেন না। লিভার পচিয়ে দেয়। আমি দেখেছি।

দেখতেই পারেন। কিন্তু যে-পৃথিবীতে আমরা বেঁচে থাকি, তার ভিতরে ক’টা জিনিস টাটকা বলুন তো?

আপনাকেই তো খুব ফ্রেশ মনে হল আমার। এভাবে বলছি বলে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু, আপনি প্লিজ ওই কড়া মদগুলো খাবেন না।

সতীর্থ একটু চমকে গিয়ে বলল, মদের কোনটা কড়া, কোনটা নরম আপনি জানেন!

আশমানি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, জানতে হয়েছে। প্রিয়মের বাবা ওই বড় বোতলগুলো খুলে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলত, মানুষের যে- মদে নেশা হয় সে মদ খেলে আমার শুধু পেচ্ছাপ পায়। ঘোড়াকে খাওয়ালে ঘোড়ার নেশা হবে, কুকুরকে খাওয়ালে কুকুরের, আমার সেরকম মদ চাই। যতদিন পেরেছে ওই মদই খেয়েছে।

আশমানির মুখে ‘পেচ্ছাপ’ শব্দটা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল সতীর্থ। পলকে সামলে নিয়ে বলল, প্রিয়মের বাবা?

মারা গেছে। আজ তিন বছর চার মাস এগারো দিন। আশমানি খুব সহজ গলায় বলে বলল, লিভারটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল একদম। শেষদিকে কিছু খেতে পারত না। ব্লাড বেরোত ক্রমাগত। ইউরিন দিয়ে, স্টুল দিয়ে।

চা-টা বিস্বাদ হয়ে গেল সতীর্থর। ও কোনওমতে আরও দুটো চুমুক দিয়ে বলল, আমি একটু বাথরুমে যাব।

আশমানি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন।

সেদিন ওকে বসার ঘর সংলগ্ন বাথরুমে যেতে না বলে বেডরুমের লাগোয়া বাথরুমে কেন যেতে বলেছিল আশমানি, সতীর্থ ভেবে পায়নি আজও। নানা রকম কথা মনে হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো হল, বোধহয় প্রিয়মের বাবার ছবিটা একবার সতীর্থকে দেখাতে চাইছিল আশমানি। দেয়ালের ভিতর ঢুকে যাওয়া র‍্যাকগুলোর সবচেয়ে ওপরেরটায় একটা ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো একজন ঝাঁকড়াচুলো মানুষ যিনি, ঘোড়ার মতো, কুকুরের মতো নেশা করতে চেয়েছিলেন।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে খানিকটা ভদ্রতাবশতই, “প্রিয়ম কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল সতীর্থ।

আশমানি কোনও কথা না বলে ওকে পাশের ঘরের মুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে বলল, আচ্ছা থাক। পরদাটা তুলে ধরল হাত দিয়ে, সতীর্থ দেখল, কম পাওয়ারের বাল্‌বের আলোয় একটা বাচ্চা প্রাণপণে কীসব আঁকছে। ঘরের ভিতরে ঢুকে ও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বাচ্চাটার ড্রয়িং খাতার দিকে তাকিয়ে। একটা নদী, নদীর গা ঘেঁষে একটা জঙ্গল। কিন্তু জঙ্গলটা ঘিঞ্জি, বড় বেশি ঘিঞ্জি। চার-পাঁচটা গাছ মুছে দিলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে সতীর্থ আশমানির ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, কী নাম বাবু তোমার?

প্রিয়ম সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুটো হাত দিয়ে সতীর্থর হাতটা ওর মাথার ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম দিয়ে তোমার কী দরকার? নিজের নাম বলো।

সতীর্থ বিস্মিত হলেও স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলল, আমার নাম তো সতীর্থ। আমি শুনেছি তোমার নাম ‘পি’ দিয়ে শুরু। ঠিক শুনেছি?

প্রিয়ম জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক শুনেছ না ভুল শুনেছ নিজে বোঝো গিয়ে। আমাকে জ্বালাতন কোরো না, আমি ড্রয়িং করছি।

সতীর্থ অবাক হয়ে দেখল ওর সঙ্গে প্রিয়ম প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করছে দেখেও আশমানি পাথরের স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা কথাও বলছে না। কোনওভাবে কথা শেষ করার জন্য সতীর্থ বলল, ঠিক আছে তুমি আঁকো, আমরা বাইরে বসছি। কিন্তু এই ছোট আলোয় আঁকলে তো চোখ খারাপ হয়ে যাবে প্রিয়ম, আমি বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিচ্ছি কেমন? বলে সতীর্থ ভুলভাল একটা-দুটো সুইচ টিপে শেষমেশ জ্বালিয়ে ফেলল টিউবলাইট। আর তখনই ঘটে গেল কাণ্ডটা।

প্রিয়ম একটা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে সতীর্থর দিকে দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরল সতীর্থকে। তারপর নিজের মুখটা নামিয়ে এনে কামড়ে ধরল ওর কনুইয়ের কাছটা। সতীর্থ ‘আঃ লাগছে’ জাতীয় আওয়াজ করেও ছাড়াতে পারল না ওকে। তখনই আশমানি নিজের ছেলের শার্টের পিছনটা ধরে টানতে শুরু করল, মানুষকে কামড়াচ্ছিস, তুই কি কুকুর? ছাড়, ছাড় বলছি।

সতীর্থ আর আশমানির মাঝখানে প্রিয়ম দেওয়াল হয়ে ছিল বলে আশমানি টেরও পেল না সতীর্থ ওর ডান পাটা দিয়ে প্রিয়মের কচি পা দুটো প্রায় পিষে দিচ্ছে। প্রিয়ম সেই যন্ত্রণায়, মুখ ফাঁক করে চিৎকার করতে গিয়ে সতীর্থর হাত থেকে নিজের দাঁত তুলে নিতে বাধ্য হল। আর ও একার জোরেই প্রিয়মকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছে ভেবে কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা তৃপ্তি মেশানো গলায় আশমানি বলল, ও আর কিছু করবে না। আপনি ও ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।

ও ঘর বলতে আশমানি হয়তো বসার ঘরই বুঝিয়েছিল কিন্তু মিনিটপাঁচেক পরে নিজের বেডরুমে এসে সতীর্থকে পা ঝুলিয়ে খাটে বসে থাকতে দেখে ও খুব একটা অবাক হল না। তবে আঁতকে উঠল সতীর্থর কনুইয়ের কাছ থেকে গড়িয়ে নামতে থাকা দু’-তিন ফোঁটা রক্ত দেখে। আঁতকে উঠে হাতটা একবার ধরল তারপর ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তুলো আর ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে সতীর্থর হাতটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। অ্যান্টিসেপ্টিকে ভেজা তুলো সতীর্থর হাতে প্রিয়মের দাঁতের চাপে তৈরি হওয়া ক্ষতর ওপর বোলাতে বোলাতে আশমানি কেঁদে ফেলল হাউহাউ করে, ও ছিল না, এরকম ছিল না। একদম নরমাল একটা বাচ্চা ছিল। কিন্তু ওর বাবার ওইভাবে মরে যাওয়াটা নিতে পারেনি। অবাধ্য হয়ে গেছে, আমি জানি না আমি কী করব, কীভাবে ওকে নিয়ে একা একা সারভাইভ করব।

রক্তের ওপরে অ্যান্টিসেপ্টিক, অ্যান্টিসেপ্টিকের ওপরে আশমানির চোখের জল, সতীর্থর হাতটা একটা কিম্ভুত ককটেলের জ্বালায় জ্বলছিল, সেই জ্বালাটা কীভাবে কে জানে মাথায় উঠে এল। ও আশমানিকে এক টানে নিজের বুকে টেনে নিল। কপালে, গালে, গলায় চুমুর বৃষ্টি করতে করতে থিতু হল ঠোঁটে। আশমানির ভারী নীচের ঠোঁটটা নিজের দু’ঠোঁটের মধ্যে ভরে মরণ-বাঁচন শুষতে লাগল।

আশমানি তাল রাখতে না পেরে নিজের ঠোঁটটা সরিয়ে নিল একসময়। বলল, জ্বালা করছে।

সতীর্থ ওর চোখের দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে বলল, ভাল লাগছে না?

আশমানি চোখ বুজে ফেলে বলল, ভাল লাগছে কিন্তু জ্বালাও করছে।

সতীর্থ বলল, আমি কাঠঠোকরা তো, গাছের গায়ে ঘষতে ঘষতে আমার ঠোঁট শক্ত হয়ে গেছে। তোমার ঠোঁটের চামড়া ফেটে যাচ্ছে আমার চুমুতে।

আশমানি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল, চামড়া না, ওটা গাছের বাকল। তুমি জিভে নিয়ে দেখো।

ক্রমে শুধু বাকল না, ফুল, ফল, পাতা সবকিছু মোচন করতে শুরু করল আশমানি। সতীর্থর দুটো পা আড়াআড়ি মাটির গভীরে নেমে যাওয়া কোনও শিকড়ের মতো ধরে রাখল ওকে আর বাঁধ দিয়ে ঘেরা খ্যাপা নদীর জলোচ্ছ্বাসের মতো আশমানি আছড়ে পড়তে থাকল সতীর্থর শরীরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। তারপর একমাত্র উজাড় হয়ে গেলে যে পূর্ণতা পাওয়া যায়, সেই পূর্ণতায় সতীর্থকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে বলল, আজ প্রায় সাড়ে চার বছর পর আবার আমার সঙ্গে ঘটল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো তো, আমার এই শরীরটা যেন দু’খণ্ড জিভের মতো পড়ে ছিল, তুমি ম্যাজিক করে দুটো খণ্ডকে জুড়ে দিলে।

সতীর্থ একটু অবিশ্বাসের গলায় বলল, এই এতদিন কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়নি তোমার?

আশমানি ওর বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, প্রিয়মের বাবা মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে শেষবার আমার কাছাকাছি এসেছিল। তারপর থেকে আমি আর এমন কাউকে পাইনি প্রিয়ম কামড়ে রক্ত বের করে দিলেও যে চুপ করে সহ্য করবে। আমায় বিয়ে করবে সতীর্থ?

একশোবারের মধ্যে নিরানব্বই বার ওকে কেউ এ প্রশ্নটা করলে সতীর্থ ‘না’ বলত কিংবা পাশ কাটিয়ে যেত। কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তে প্রিয়মের পা চিপে দেওয়ার সেই গোপন গ্লানিকে মহত্ত্বে ভাঙানো যাচ্ছে দেখে ও একটা মোহের ঘোরে বলে দিল, তুমি একা নও আশমানি, তুমি আর একা নও।

সেই গ্লানি যত ফিকে হতে শুরু করল, মহত্ত্বের নেশাও তত তরল হতে থাকল। ওদের পৈতৃক ফার্নিচারের ব্যবসায় যা আয় হয়, তাতে সতীর্থ যেরকম ফুটানি মেরে চলে তার সংস্থান হয় না। অনেকটা জমির ওপর ওদের ভাঙাচোরা তিনমহলা বাড়িটাকে প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়ে ফ্ল্যাট এবং ভাগের টাকা নেওয়ার ব্যাপারে সতীর্থ ওর কাকা-জ্যাঠাদের মত নিয়ে নিতে পেরেছে। সেই টাকায় ব্যাবসা মর্ডানাইজ করতে হবে, চাই কী অন্য ব্যাবসাতেও ঢুকতে হতে পারে এবং সেটা অবশ্যই পিয়ালকে সঙ্গে নিয়ে। কারণ এককালে পিয়াল যেভাবে ওর ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখনও ওপর-ওপর ব্যাপারটা সেরকম থাকলেও ভিতরে উলটো। সতীর্থ জানে পিয়ালের দৌলতে ও ব্যান্ডের টাকার যে-ভাগটা পায় সেটা নেহাতই ফোকটে। এই ম্যানেজারির কাজটা ব্যান্ডের অন্য যে-কোনও পারফরমিং মেম্বার করে দিতে পারত। করতে পারে না, কারণ পিয়াল চায় না। পিয়ালের সেই ভরসার ওপর দাঁড়িয়েই একটা বিপজ্জনক খেলা শুরু করেছিল সতীর্থ। আশমানির সঙ্গে। কিন্তু কতদিন খেলবে?

এমন নয় যে ও আশমানিকে ভালবাসে না। প্রবল ঝড়-বাতাসের মধ্যেও লাইটার যেমন এক ধাক্কায় জ্বালিয়ে দেয় গ্যাস ওভেন, আশমানি সেভাবেই জ্বালিয়ে তোলে ওর শরীর। দোতলা বাড়ির নীচের তলায় থাকা প্রিয়মের ঠাকুরদা-ঠাকুরমার উল্লেখ করে আশমানি বলে, ওঁরা চান আমি দমকলের গাড়ির মতো বেঁচে থাকি সারাজীবন। কিন্তু দমকলের গাড়িতে যখন আগুন লাগে তাকে নেভাবে কে?

সতীর্থ আবারও কাছে টেনে নেয় ওকে। বলে, তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে তুমি তো দেখতে বাধ্য, তাই না?

আশমানি ফুঁসে ওঠে, বাধ্য কেন?

না, তুমি যে চাকরিটা করো, সেটা…

সেটা তো কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে পাওয়া নয়। প্রিয়মের বাবার তো ব্যাবসা ছিল। ও যখন মাতাল হয়ে সবকিছু লাটে তুলে দিচ্ছে, আমি আমাকে আর প্রিয়মকে বাঁচাতে রাত জেগে পড়াশোনা করেছি, একটার পর একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। এটা ছাড়াও একটা লেগেছিল, কিন্তু সেটায় বদলি ছিল, তাই…

ও, আমি জানতাম না, সতীর্থ বলে।

আশমানি ওর কথা শোনেনি এমনভাবে বলে, আমি ওদের তখনই দেখব, যখন ওরা তোমাকে মেনে নেবে।

প্রিয়ম?

প্রিয়ম বদলাবে। তুমি দেখো, আশমানির গলায় স্বপ্ন।

কলকাতা সংলগ্ন এই নিচু-জমির অঞ্চলে পাড়া-কালচার বলে কিছু গড়েই ওঠেনি। গড়ে উঠলে পুত্রশোকে মুহ্যমান বৃদ্ধ-বৃদ্ধার যুবতী পুত্রবধূর কাছে এত ঘনঘন আসা ওর পক্ষে সম্ভব হত না। কিন্তু একদিন নেশার ঘোরে যে-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল ওই অকল্পনীয় হিংস্র বাচ্চা প্রিয়ম এবং তার ভালমানুষ ঠাকুরদা-ঠাকুরমার ভার সেই সম্পর্ক সইবে তো? ছোটবেলায় খুব ভাল গোলকিপার ছিল সতীর্থ। ওদের কোচ শঙ্করদা যে-কোনও বড় ম্যাচের আগে ওকে ডেকে বলতেন যে, আকাশের পাখিকে কখনও দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরা যায় না। কিন্তু ওই চামড়ার বড় বলকে যায়। কথাগুলো সতীর্থর কানে বাজে আজও। আশমানি যখন ওর ছাইচাপা ইমোশন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর জন্য, সতীর্থ ওকেও আঁকড়ে ধরেছিল।

কিন্তু ভাবনা তো পালটায়। পিয়ালের জন্য ছুটে এসেছিল ওই যে মেয়েটা, যাকে দেখলেই মনে হয় ভগবান একে হালকা একটা তুলি দিয়ে এঁকেছেন, সে যখন ওকে একটা ফোন করে জানতে চাইল পিয়ালের গানের উৎস কী, সতীর্থর ভাবনা পালটাতে শুরু করল। ওর মনে হল, ও বোধহয় এবার উড়ন্ত কোনও পাখিকেও আটকে দিতে পারবে। টুয়ার মতো হালকা তুলিতে আঁকা কোনও পাখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *