হাসির উপন্যাস
কবিতা দিয়ে নয়, আমার সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল উপন্যাস রচনা করে। যতদূর মনে পড়ে, সেটা ছিল হাসির উপন্যাস, এই অর্থে যে, সেটি পাঠ করে লোকের হাস্য সম্বরণ করা কঠিন হত। অন্তত আমার মাতৃঠাকুরানি সেই অভিমত দিয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয়, আমার সেই রচনা আমার মা ছাড়া আর কারও পাঠ করার সৌভাগ্য হয়নি।
তখন আমার বয়স ষোলো, আমার পরের ভাই বিজনের দশ-এগারো। একদিন আমি গভীর মনোযোগ সহকারে উপন্যাস লিখছিলাম, এমন সময় বিজন কী একটা গোলমাল করে। আমি তাকে কানে ধরে একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম। একটু পরে আমি যখন লেখা বন্ধ করে একটু উঠে গিয়েছিলাম, বিজন আমার সেই পাণ্ডুলিপি তুলে নিয়ে রান্নাঘরে কাঠের উনুনের মধ্যে ফেলে দেয়। আমি মা-কে গিয়ে নালিশ জানাতে মা মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘সে কি, বিজন কি উপন্যাস পড়তে শিখেছে?’
এই উপন্যাসটি ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু একথা বলা চলে বাংলায় হাসির উপন্যাস প্রায় নেই।
পরশুরামের মতো হাসির গল্পের লেখক পৃথিবীর যে-কোনও ভাষাতেই বিরল। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী থেকে নবনীতা দেবসেন, ইন্দ্র মিত্র—এঁরা সব অসামান্য, অতুলনীয় হাসির গল্প লিখেছেন। কিন্তু উপন্যাস। নৈব নৈব চ।
এমনকী, সেই অর্থে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ও কোনও হাসির উপন্যাস লেখেননি। অসামান্য ব্যঙ্গতির্ষকে ভরা উপন্যাসগোত্রীয় গ্রন্থগুলি আসলে উপন্যাস নয়। দুই শতাব্দীর ইতিহাসে একমাত্র ঔপন্যাসিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘কঙ্কাবতী’ শুধু হাসির উপন্যাস নয়, ও রকম মানবিক গুণসম্পন্ন মর্মস্পর্শী রচনা যে-কোনও ভাষাতেই বিরল। এরই কিছু পরে কেদারনাথ, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের রচনা অবশ্য আমার খুব প্রিয় নয়।
আর-একটি উপন্যাসোপম রচনামালার উল্লেখ না করা অনুচিত হবে। সেটি হিমানীশ গোস্বামীর ‘সাধু সিরিজ’ যথা, লন্ডনের পাড়ায় পাড়ায়, লন্ডন শহরে সাধু ঘটক ইত্যাদি। কেন যে হিমানীশ গোস্বামীর লন্ডন অমনিবাস কোনও প্রকাশক আজও ছাপেননি সে রহস্য আমার জানা নেই।
অবশেষে আমার নিজের কথায় আসি। এতকাল ধরে কত লোক যে আমাকে হাসির উপন্যাস লিখতে বলেছেন, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি যে সত্যি কোনও হাসির উপন্যাস লিখিনি, তা নয়। একবার এক পুজো সংখ্যায় ‘কবিতা ও ফুটবল’ নামে একটি সম্পাদক-ঠকানো উপন্যাসিকা লিখেছিলাম।
কেউ কেউ সে-কাহিনী পড়ে হেসেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটি ধোপে টেকেনি।
অন্যদিকে মাত্র কয়েক বছর আগে একটি বিখ্যাত বাংলা মাসিক পত্রে বৎসরাধিককাল একটি ধারাবাহিক হাসির উপন্যাস লিখেছিলাম। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘সর্বনাশ’। বাংলা সাহিত্যের এক নম্বর প্রকাশকের গদি থেকে সেটি বই হয়ে বেরিয়েছিল, কিন্তু পাঠক-পাঠিকারা খুব আদর করে সে-বই গ্রহণ করেছেন এমন মনে হয় না।
তবু, উপন্যাস লেখার স্বপ্ন আমি ছাড়িনি। হাসির উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে না হোক, পর্বে পর্বে দু’-একটি করে মোক্ষম রসিকতা থাকবে। উপন্যাস লেখা আরম্ভ করার আগেই সেই রসিকতাগুলি আমি সাজিয়ে ফেলেছি।
তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি:—
(এক) কাহিনীর নায়ক একটি পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করছে। সে একটি বাঁশের খুঁটি ধরে ডুব দিচ্ছে। বাঁশের খুঁটিটির উপর একটি সাইনবোর্ড লাগানো—‘এই পুকুরের জলে সাঁতার কাটা নিষেধ।’ জনৈক পাহারারত পুলিশ তাকে বলল, ‘আপনি নোটিশে কী লেখা আছে দেখেননি?’ নায়ক জবাব দিল, ‘হ্যাঁ তা দেখেছি।’ পাহারাদার বলল, ‘তা হলে?’ নায়ক বলল, ‘লেখা আছে সাঁতার কাটা নিষেধ, আমি তো সাঁতার কাটছি না, ডুব দিচ্ছি।’
(দুই) অসুস্থ নায়িকার বিছানার পাশে নায়ক বসে আছে। নায়িকা বলছে, ‘আমি মরে গেলে তুমি কী করবে?’ ‘আমি সারাজীবন ধরে কাঁদব।’ নায়িকা, ‘কেমন করে কাঁদবে একটু দেখাও।’ নায়ক, ‘তুমি আগে মরে দেখাও।’
(তিন) শেষপর্বের আগের পর্ব। নায়ক উন্মাদ হয়ে গিয়েছে।
সে তার জামাকাপড় হাতে উলঙ্গ হয়ে একটা পার্কের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নায়কের এক বন্ধু নায়কের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কী ব্যাপার?’
নায়ক বলল, ‘একটা ঝোপঝাড় কোথাও পাচ্ছি না, যার পিছনে গিয়ে এই জামাকাপড়গুলি পরতে পারি।’
এরপরে আমি অবশ্য কবুল করতে পারি যে, হাসির উপন্যাস লেখার মাল-মশলা সংগ্রহ হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু উপন্যাসাকারে পরিবেশন করলেই হবে।