6 of 8

প্রতিযোগিতা

প্রতিযোগিতা

এ-এস-ডি-এফ-জে কোলন এল-কে-জে-এইচ। টাইপরাইটারে যাঁরা ইংরেজি টাইপ করতে পারেন তাঁরা জানেন যে ওই টাইপরাইটিং মেশিনের কী-বোর্ডে অক্ষরগুলো ইংরেজি বর্ণমালা অনুসারে সাজানো নয়, সেগুলো ব্যবহার ও প্রয়োজন অনুসারে ধাপে ধাপে বাঁয়ে ডাইনে সাজানো। উদ্ধৃত বর্ণগুলি মেশিনের কী-বোর্ডের একটি ধাপ। আমি কিন্তু টাইপ করতে জানি না। তবে টাইপরাইটিং শিক্ষার এই প্রথম ধাপটি আজও আমার মনে আছে, এই ৪৫ বছর পরেও। সেটা ১৯৫১ সাল। গ্রীষ্মকাল। আমি সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্ট বেরবে মাস তিনেক পরে। হারুমামা এসে বাবাকে বললেন, ‘জামাইবাবু, খোকনকে টাইপ শিখতে বলুন। আজকালকার দিনে টাইপ শিখলে চাকরি-বাকরি পাওয়া সহজ।’

‘খোকন’ মানে আমি। তখন পরীক্ষা-শেষে দীর্ঘ ছুটিতে খাই-দাই, ঘুরে বেড়াই। সকালবেলা কিছুক্ষণ কালীপণ্ডিতের টোলে যাই সংস্কৃত পড়তে, সেটা সংস্কৃত শেখার আগ্রহে নয়, কালীপণ্ডিত ছাত্রপ্রতি কিছু সরকারি বৃত্তি পান, তাই তাঁর সাহায্যার্থে বাবার তাগিদে সংস্কৃত শিক্ষার চেষ্টা। হারুমামার কথা বিস্তারিত বলার কিছু নেই। তিনি এই খণ্ড রচনার সূত্রপাত কাহিনীর নায়কমাত্র। আমার ক্ষেত্রে খলনায়ক। পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে আমাদের ছোট শহরের বাড়ির গলির মুখে তাঁর শ্বশুরবাড়ির বৈঠকখানাঘরে হারুমামা টাইপরাইটিং স্কুল করেছিলেন৷ ‘দি গ্রেট বেঙ্গল কমার্শিয়াল কলেজ’ নাকি কী যেন নাম দিয়েছিলেন সেই শিক্ষালয়ের। পরে অবশ্য, বোধহয় রাজনৈতিক কারণেই তিনি নামটা বদল করেছিলেন বলে মনে পড়ছে, বোধহয় এবার নামকরণ হয়েছিল ‘টাঙ্গাইল কমার্শিয়াল কলেজ।’

তা সেই টাইপরাইটিং স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি টাইপ শিখতে লাগলাম, বলা উচিত, প্রবল উৎসাহে টাইপ করতে শেখায় উদ্যোগী হলাম। দুঃখের বিষয়, আমার অন্যান্য বহু প্রচেষ্টার মতোই জীবনে সফল হওয়ার এই প্রচেষ্টাও অচিরেই বাধাপ্রাপ্ত হল।

তখনও টাইপশিক্ষার প্রথম দফাতেই আটকিয়ে আছি অর্থাৎ মাত্র কয়েকদিন হয়েছে। ওই সামান্য শব্দসম্ভারেই আবদ্ধ থেকে দৈনিক একশোবার গ্ল্যাড (Glad) এবং দু’শো বার স্যাড (Sad) শব্দটি তৈরি করছি। তবে টাইপমেশিনগুলো ছিল ঝরঝরে, অতি রদ্দি তথা পুরনো, কোনও কোনওটি অতিকায় আয়তনের, বোধহয় টাইপরাইটার প্রচলিত হওয়ার প্রথম যুগের জার্মান মডেলের। ওই সুদূর মফস্বলে অতগুলো জরাজীর্ণ টাইপরাইটার কী করে সংগ্রহ করেছিলেন হারুমামা সে বিষয়ে আমার কোনও ধারণা নেই।

এই স্যাড-গ্ল্যাড করতে করতে একদা আমার বাঁ হাতের তর্জনী জি অক্ষরটির গোল গর্তে আটকে গেল। টাইপমেশিনের ওই জি অক্ষর-সহ অন্যান্য বহু অক্ষরচিহ্ন বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। সেখানে পিচবোর্ডে এই আকারে গোল করে অক্ষর লিখে সেঁটে দেওয়া ছিল। তার ফাঁক দিয়ে আঙুল গলে যাওয়াতেই এই বিপত্তি।

আঙুল তো আটকিয়ে গেল, সে আর খোলে না। পরে সেই টাইপরাইটার শূন্যে তুলে অনেক কসরত করে তর্জনী উদ্ধার হয়। এ গল্প আর বাড়িয়ে লাভ নেই। হারুমামার স্কুলে আমার টাইপ-শিক্ষার ওখানেই ইতি। জীবনে আর টাইপ শিখিনি, টাইপ মেশিন দেখলেই এখনও কেমন একটা আতঙ্ক হয়। টাইপ না শেখায় আমার কি কোনও ক্ষতি হয়েছিল? টাইপ না শিখেই একটা জীবন, পঁয়ত্রিশ বছরের সরকারি চাকরিসহ, মোটামুটি ভালই কাটিয়ে দিয়েছি। অফিসের কাজকর্মে টাইপ করার প্রয়োজনে টাইপিস্টরা ছিলেন। আর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাস্তাঘাটে টাইপ করিয়ে নিয়েছি। আগে চার আনা, ছয় আনায় হয়ে যেত, এখন গোটা পাঁচেক টাকা লাগে। আর এ রকম টাইপিস্ট কেমন সহজলভ্য, প্রত্যেক পাড়াতে, প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। আসলে আমার নিজের কোনও ব্যক্তিগত সাহায্যের জন্য টাইপ-শিক্ষার কথা হারুমামা বলেননি, তাঁর বক্তব্য ছিল টাইপ শিখলে চাকরি পাওয়া সোজা হবে।

এবার চাকরিটার কথা ভাবা যাক। চাকরিটা হল টাইপিস্টের চাকরি। বলতে গেলে নিয়মমাফিক ইনক্রিমেন্ট ছাড়া সারাজীবনে কোনও উন্নতি নেই। যোগ্যতার কোনও সুবিচার নেই। ইংরেজিতে যাকে ‘হোয়াইট কলার জব’ অর্থাৎ বাবুপেশা বলে তারই সর্ব নিম্নস্তরের জীবিকা। সারাদিন ঘাড় গুঁজে, মেরুদন্ড বাঁকা করে পরিশ্রম। নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের কোনও সুযোগ নেই। মেধা বিকাশের প্রশ্ন তো আসেই না। তা হলে ব্যাপারটা কী হল?

এক চোদ্দো-পনেরো বছরের নাবালকের মনে যে উচ্চাশার বীজটি বপন করার চেষ্টা হয়েছিল, সেই উচ্চাশাটি বস্তুত একটি টাইপিস্টের চাকরি পাওয়া।

শুধু আমার ক্ষেত্রেই এমন হয়েছিল, একথা বলতে পারব না। সেই সময়ে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল টাইপ-স্কুল। হাজার হাজার হারুমামা লক্ষ লক্ষ নাবালককে টাইপিস্ট হওয়ার স্বপ্নে দীক্ষিত করেছিলেন। যার অন্য কিছু যোগ্যতা নেই, কোনওরকমে মাধ্যমিক পাশ করেছে, সে যদি টাইপ শিখে কাজ পায় সে তো ভালই। কিন্তু সেজন্য গলিতে গলিতে টাইপ স্কুলের দরকার নেই। অত টাইপিস্টের চাকরি সংসারে নেই, যেমন দরকার নেই অতি হাল আমলের প্রথম বর্ষায় হঠাৎ আগাছার মতো সর্বত্র গজিয়ে ওঠা কম্পিউটার শিক্ষালয়গুলোর। এত ছেলেমেয়ে কম্পিউটার শিখে কী কাজ পাবে? সম্পূর্ণ কম্পিউটার-নির্ভরশীল অফিস সারা কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে ক’টা আছে? ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পার্সোনাল কম্পিউটার ব্যবস্থা করার আর্থিক সামর্থ্যই বা কয়জনের আছে? কম্পিউটার শিখে লাভ নেই, এই বিজ্ঞানের যুগে এমন মূর্খের মতো একথা বলব না। কিন্তু যারা শিখছে, শেখার পরে দীর্ঘদিন অনভ্যাসে এবং চর্চার অভাবে তাদের অনেকেরই অধীত জ্ঞান ঝাপসা হয়ে আসবে। জীবিকার কোনও কাজে লাগবে না। এর চেয়ে অনেক ভাল হত যদি এই সময়টা তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যয় করত। এরই পাশাপাশি অন্য আর একটি ব্যাপার এই সূত্রে ভেবে দেখা যাক। ছেলেরা মাধ্যমিক পাশ করার পরে অভিভাবকেরা ছেলেকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াবেন, তা সে যে ধরনের ছাত্রই হোক। অভিভাবকবৃন্দ এ ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। সবাই বিজ্ঞানে সুবিধা করতে পারবে না, সবাই ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হবে না, হতে পারবেও না। অথচ সাহিত্য বা দর্শন, ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভাল ফল করলে জীবিকার সুবিধে হত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ক্লাসে ভর্তির জন্য কী পরিমাণ হুড়োহুড়ি হয়, তদ্বির হয়—সেটা কারও অজানা নয়। কিন্তু বছরে কতজন নতুন সাংবাদিকের চাকরি হওয়া সম্ভব? তা ছাড়া সাংবাদিকতার ডিপ্লোমা থাকলেই সংবাদপত্র চাকরি দেয় না। আবার ডিপ্লোমা না থাকলেও সাংবাদিকের চাকরি হয়। প্রার্থীর সাংবাদিকতার যোগ্যতা আছে কিনা, সে কতটা বুঝমান, সে কেমন লিখতে পারে, সাংবাদিকতার ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে এগুলিই প্রধান বিবেচ্য। তেমনই শত শত উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ছেলেমেয়ে ভালভাবে এম এ পাশ করার পর বছরের পর বছর এম-ফিল করছে, ডক্টরেট করছে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে অধ্যাপনার চাকরির চেষ্টা করছে।

ভাল ছাত্ররা গবেষণা করবে না, ডক্টরেট করবে না, অধ্যাপনা করবে না—সেকথা বলছি না। কিন্তু তাদের সকলের জন্যে অধ্যাপনার চাকরি হবে না। দূর ভবিষ্যতেও অধ্যাপনার বৃত্তি জোটা সকলের ক্ষেত্রে অসম্ভব। ইতিমধ্যে ডক্টরেট বেকারের প্রজন্ম শুরু হয়ে গেছে। রসিকতা নয়, এ হল নির্মম সত্য। যত ডক্টরেট হচ্ছে তত অধ্যাপকের শূন্য পদ দেশে নেই। বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিভাগ মিলিয়ে কয়েকশো ছেলেমেয়ে প্রথম শ্রেণীতে এম এ পাশ করে, তা সত্ত্বেও তাদের সকলের জন্য অধ্যাপনার কেন, শিক্ষকতার পদও হয়তো জুটবে না। অথচ সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের, জীবনবিমার প্রথম শ্রেণীর পদগুলোর জন্য পরীক্ষা রয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে এবং জাতীয় বৃহৎ ব্যবসায় সংস্থাগুলিতেও উচ্চপদে সরাসরি নিয়োগ করা হয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। তা ছাড়া রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাৎসরিক পরীক্ষা রয়েছে উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগের জন্য। এম ফিল বা ডক্টরেট করতে যতটা পড়াশোনা ও অভিনিবেশের প্রয়োজন হয় তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম, বেশি মনোযোগী হওয়ার দরকার পড়ে না প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য।

আসলে যেটা অভাব সেটা প্রতিযোগিতার মনোভাবের। এই মনোভাব ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা উচিত। মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকেরা যতটা বিচলিত হয়ে পড়েন, তার এক চতুর্থাংশ পরিমাণ উদ্দীপনা যদি ছেলেমেয়ের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যাপারে দেখান, সুফল অনেক বেশি পাওয়া যাবে।

একজন উচ্চ বা মাঝারি মানের ছাত্রের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ভাল চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। প্রায় সব চাকরির পরীক্ষাতেই একাধিকবার, তিনবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকে, ইচ্ছে করলে ঘষেমেজে ছাত্র নিজেই নিজেকে ঠিক করে নিতে পারে। তবে ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা থাকা চাই, চেষ্টাও চাই। যারা চিনেবাদাম বা ত্রিফলার চাটনি বেচে, তাদের মতো সীমিত আকাঙ্খার গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে থাকলে কোনও লাভ নেই।

কিছুকাল ধরে একটা নতুন ধরনের হীনম্মন্যতা দেখা দিয়েছে। সেটা হল ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানের অভাব বা কথা বলতে না পারা নিয়ে। স্বভাবতই যারা বাংলা স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছয় তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছেলেমেয়েদের বোলচাল, চাকচিক্য দেখে একটা কেমন যেন হকচকিয়ে যায়। সেই হিন্দি বলয়ে যাকে পিছডিবর্গ না কী যেন বলে, সেইরকম একটা শ্রেণীবিভাগ আর কী! এ প্রসঙ্গ অবশ্য বহু-আলোচিত। এ বিষয়ে আমার আর আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে একটা ঝকঝকে নতুন গল্প বলব।

তার আগে হীনম্মন্যতার প্রসঙ্গটা একটু ছুঁয়ে যাই। প্রথমত চেহারা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামায়। তেইশ-চব্বিশ বছরের বাঙালি যুবক, সে রকম লম্বা নয়, সে রকম ফর্সা নয়, মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, হয়তো গলার কণ্ঠা ফুটে আছে, হয়তো দাঁত উঁচু, সে আয়নায় দাড়ি কামানোর সময় নিজেকে দৈনিক খুঁটিয়ে দেখে, সে ভাবতেই পারে আমাকে কি ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ সাহেব হিসাবে মানাবে? এই চেহারা নিয়ে পার পাব না, চাকরির পরীক্ষাতে উতরিয়ে গেলেও ইন্টারভিউয়ের সময় বাদ পড়ে যাব। যত সব বাজে চিন্তা! সিনেমায় দূরর্শনে রাজপুরুষদের যেমন চেহারা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বা পুলিশ সাহেব যেমন দেখতে হয়, তার সঙ্গে বাস্তবের তেমন মিল নেই। অধিকাংশেরই সাধারণ চেহারা, দু’-একজন সুপুরুষ বা সুন্দরী অবশ্যই আছে, আবার মড়াখেকো চেহারার আমলারও অভাব নেই। সাক্ষাৎকারের সময় চেহারা একটু কাজে লাগে বইকি, কিন্তু সেটাই সব নয়। বুদ্ধিমান মানুষের চেহারা নিয়ে লোকে একটা খুব মাথা ঘামায় না, ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রবীণ সদস্যরাও ঘামাবেন না।

আর একটা কথা, বড় চাকরির সাক্ষাৎকার ঠিক প্রশ্নোত্তর-পর্ব নয়। এক ধরনের আলোচনা সভার মতো। যেখানে বেশি বোলচাল না দেখিয়ে একটু গোছগাছ করে কথা বলতে পারলেই বেশি উপকার। সব জিনিস জানতে হবে, জানা থাকবে এমন কোনও কথা নেই, কিন্তু যতটুকু জানা আছে সে ব্যাপারে মনের ভাব পরিচ্ছন্ন করে প্রকাশ করতে পারলে লাভ হবে।

এরপর শিক্ষাগত যোগ্যতার কথায় আসি। একথা সত্যি যে, সর্বভারতীয় এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় যারা ভাল ফল করে তাদের অনেকেই নামকরা ভাল ছাত্র। কিন্তু একথাও ঠিক যে, বহু সাধারণ বা মাঝারি মানের ছাত্র-ছাত্রীও এ রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, ভাল ফল করে ভাল চাকরি পায়। সাধারণত শিক্ষাগত নিম্নতম যোগ্যতা স্নাতক হলেই চলে। সেজন্য অনার্স বা এম এ হওয়ার দরকার নেই। প্রথম শ্রেণীরও দরকার নেই। নেহাত সাদামাটা স্নাতক—যদি তার লেখাপড়ার ভিত শক্ত থাকে—ঠিক বিষয় নির্বাচন করে বি এ পরীক্ষা পাশ করার জন্য যে পরিশ্রম করেছে, সম পরিমাণ পরিশ্রম করলে ভাল ফল অবশ্যই পাবে।

এসব ব্যাপারে ভাগ্য-টাগ্য তেমন কাজে লাগে না, যা কাজে লাগে তা হল ঠিক মনোযোগ এবং তৎসহ অধ্যবসায়, সেই সঙ্গে ইংরেজিটা একটু রপ্ত করতে হবে। সেটা চলনসই হলেও চলবে। উপদেশ দেওয়া আমার ধাতে সয় না। বুঝতে পারছি বক্তৃতাবাজি বেশি হয়ে গেল। অবশেষে পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো ইংরেজি মাধ্যম, যাকে বলে ইংলিশ মিডিয়াম-সংক্রান্ত একটি আনকোরা গল্প বলে এই নিবন্ধ বন্ধ করছি।

এ ভারী দুঃখের গল্প। গভীর রাতে বাড়িতে শোওয়ার ঘরের গরাদ ভেঙে চোর ঢুকেছিল। সে তার বুদ্ধিমতো নিঃশব্দে কাচ হাসিল করছিল। কিন্তু হঠাৎ দরজা ভেবে দেওয়াল আয়নার মধ্যে দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কাচ ভেঙে রক্তারক্তি হয়ে সে আর্ত চিৎকার করে ওঠে এবং তারই পরিণতিতে বাড়ির লোকেদের হাতে সে বন্দি অথবা গ্রেফতার হল। থানায় ফোন করা হল, দারোগাবাবুও এলেন—

কিন্তু চোরকে দেখে সবাই তাজ্জব! এ কী রকম চোর? নওল কিশোর! রোগা ছিমছাম, অনেক পাকা চোরের এ রকম চেহারা হয়। কিন্তু এর গলায় নেকটাই। নেকটাই গলায় বেঁধে কেউ চুরি করতে বেরোয়? জেরা করে তার কাছে যা জানা গেল তা খুবই মর্মান্তিক। ছেলেটি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ড্রপ-আউট। এখন চুরি করে বেড়াচ্ছে।

শিশুকাল থেকে সে সারাদিন টাই পরে থাকায় অভ্যস্ত। স্কুলের ইউনিফর্মে গলায় নেকটাই-সহ সাজিয়ে তার মা তাকে অতি সকালবেলায় স্কুলবাসে তুলে দিত। বিশ্বসংসার পাক খেয়ে ঘন্টা তিনেক ধরে সেই বাস স্কুলে পৌঁছত। তারপর আবার বিকেলে ঘন্টা তিনেক পাক খেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেটি বাড়ি ফিরত, সারাটা দিন গলায় টাই শক্ত করে বাঁধা।

সেই থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে। গলায় টাই শক্ত করে বাঁধা না থাকলে সে কোনও কাজ করতে পারে না, অসহায় বোধ করে। তাই চুরি করার সময়েও টাই পরে বেরিয়েছে। এই নেকটাই পরিহিত চোরের গল্প তাদের জন্য যারা ইংরিজি শিক্ষার অভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগছে।

কিছুই আসে যায় না। চলনসই শুদ্ধ ইংরেজি রপ্ত করতে একজন স্নাতকের খুব অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। উত্তরপত্র যখন ইংরেজিতে লেখা ছাড়া উপায় নেই, শুদ্ধ ইংরেজি শিখতেই হবে। সাধারণ জ্ঞান একটু বাড়াতে হবে। এর জন্য বই না পড়ে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়লে কাজে লাগবে। তবে প্রতিযোগিতায় সফল হতে প্রথমত চাই পরিশ্রম করার ইচ্ছা, অন্তত কয়েক মাসের জন্য। সেইসঙ্গে নৈরাশ্যের, হীনম্মন্যতার ভাব ছাড়তে হবে। তবে সবার উপরে চাই উচ্চাশা, সফল হওয়ার প্রবল ইচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *