6 of 8

এত কঠিন অঙ্ক

এত কঠিন অঙ্ক

আমার একটি পুরনো গাড়ি আছে। গাড়িটা নিয়ে একটা গল্পও আছে, সে গল্পটা বোধহয় অনেকেই জানেন। গল্পটা তেল-খরচ নিয়ে।

এই জ্বালানি দুর্মূল্যের যুগে গাড়িওলা গৃহস্থেরা মাঝে মধ্যেই আলোচনা করেন কার গাড়ি কত লিটার তেলে কত কিলোমিটার যায়। আমি চুপ করে শুনি, তারপর সবার শেষে বলি, “আমার গাড়ি প্রতি লিটার তেলে ত্রিশ কিলোমিটার যায়।”

সবাই হইচই করে ওঠে, ত্রিশ কিলোমিটার প্রতি লিটারে, ইয়ার্কি না কি? এমনিতেই ফিয়াট গাড়ি পুরনো মডেলের তার উপরে চল্লিশ বছরের ঝরঝরে, এ গাড়ি তো তেল খাওয়ার যম, তোমার গাড়ি এক লিটার পেট্রলে বড় জোর পাঁচ কিলোমিটার যাবে। তার বেশি এক মিটারও নয়।

আমতা-আমতা করে আমি স্বীকার করি, “ওই পাঁচ কিলোমিটার যায়।” সবাই চেপে ধরে, “তা হলে বাড়াবাড়ি করে ত্রিশ কিলোমিটার বললে কেন?” আমি বলি, “দ্যাখো আমার গাড়ি তো একটু পরে পরেই ঠেলতে হয়, এক লিটার পেট্রলে গাড়ি ত্রিশ কিলোমিটার ঠিকই যায়। তবে পাঁচ কিলোমিটার তেলে আর পঁচিশ কিলোমিটার ঠেলে।”

সুতরাং এ-গাড়ি আজকাল আমি আর চড়ি না বা চড়ার চেষ্টা করি না। টায়ার চুপসে, মাথা নিচু করে গ্যারাজে পড়ে আছে।

শুভানুধ্যায়ীরা কেউ কেউ পরামর্শ দেয়, এবার বেচে দাও। গাড়ি গ্যারাজে পড়ে থাকলে দাম পড়ে যাবে, অবশেষে এমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে, যখন আর গাড়ি হিসেবে নয়, পুরনো লোহা- লক্করের মতো বিক্রি করতে হবে।

আমি তা জানি। কিন্তু আমার একটু দুর্বুদ্ধি আছে।

পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। পুরনো গাড়ি অ্যান্টিক হলে দাম বহুগুণ চড়ে যায়। আমার বাষট্টি সালের মডেলের গাড়ির এখনও অ্যান্টিক মর্যাদা পেতে বহু বছর লাগবে। কিন্তু এটি একটি বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির গাড়ি (এখনও ব্লু বুকে তাঁরই নাম), কর্মজীবনের প্রথম ভাগে স্বহস্তে তিনি এ-গাড়ি চালাতেন। এবং এই কারণে দেশে বা বিদেশে কেউ হয়তো কোনও প্রতিষ্ঠান হয়তো এই গাড়িটি সংগ্রহ করতে পারে এবং সংগ্রহমূল্য নিশ্চয়ই যথেষ্ট হবে—এই আশায় গাড়িটি আমি ধরে আছি।

গ্যারাজ আমার একটাই। এই গাড়ির কোনও ব্যবস্থা না করে দ্বিতীয় কোনও গাড়ির কথা আমি ভাবছি না।

ট্রামে-বাসে ওঠা-নামা আমার স্থূল দেহ নিয়ে অসম্ভব। সুতরাং কোথাও যাতায়াত করতে হলে আর কারও গাড়ি কিংবা ভাড়াটে গাড়ির সাহায্য নিতে হয়। ভাড়াটে গাড়ি আগে থেকে বলে রাখতে হয়, আশু প্রয়োজনে কখনও কখনও ট্যাক্সিও ব্যবহার করতে হয়। অবশ্য যদি ট্যাক্সি মেলে।

সেদিন কলেজ স্ট্রিটে কী একটা কাজ ছিল। রাস্তায় বেরিয়েছিলাম একটা ট্যাক্সি ধরব বলে। একেবারে মুখোমুখি গঙ্গারামের সঙ্গে দেখা, সে আমারই কাছে আসছিল।

আমাকে দেখে গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় যাচ্ছেন?”

আমি বলাম, “কলেজ স্ট্রিট।”

গঙ্গারাম বলল, “গাড়ি কোথায়? পায়ে হেঁটে যাবেন? অনেকটা পথ কিন্তু।”

আমি বললাম, “পায়ে হেঁটে যেতে হবে কেন? একটা ট্যাক্সি নেব।”

গঙ্গারাম বলল,“ট্যাক্সির ভাড়া দিতে পারবেন?”

আমার খুব অপমানবোধ হল। রেগে গিয়ে বললাম, “তুমি কী ভাব? আমার ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই?”

গঙ্গারাম বলল, “দাদা, রাগ করবেন না। ভাড়ার টাকায় বলছি না। ভাড়ার হিসেবের কথা বলছি।”

“ভাড়ার হিসেব? সে আবার কী?” আমি অবাক হয়ে বলি।

গঙ্গারাম পালটা প্রশ্ন করে, “এর মধ্যে ট্যাক্সিতে চড়েছেন।”

আমি ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো সেই কালীপুজোর পরে দেশে ফিরেছি, তার আগে চার মাস, পরে আড়াই মাস, সবসুদ্ধ সাড়ে ছয় মাস, অন্তত এই সময়টুকু কলকাতার ট্যাক্সি চড়িনি। এসব না বলে আমি প্রশ্ন করি, “চড়ি না চড়ি, তাতে কী হয়েছে?”

গঙ্গারাম বলল, “আপনি পারবেন সাতাশকে মনে মনে দুই দিয়ে গুণ করে, তার সঙ্গে শতকরা চল্লিশ যোগ করে তার থেকে দুই বিয়োগ করতে?”

আমি হতবাক হয়ে বললাম, “এত কঠিন অঙ্ক আমাকে কষতে হবে কেন?”

গঙ্গারাম বলল, “না করলে ভাড়া দেবেন কী করে? ট্যাক্সির মিটারে যা উঠবে তাকে ডবল করে তার সঙ্গে চল্লিশ পারসেন্ট যোগ করে দুই বিয়োগ করে ভাড়া দিতে হবে। পারবেন হিসেবটা করতে?”

আমি জানি আমি পারব না। গঙ্গারামকে বললাম, “তা হলে তুমি সঙ্গে চলো৷” গঙ্গারাম সঙ্গে সঙ্গে রাজি। হাত তুলে একটা ট্যাক্সি থামাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *