6 of 8

শিবরাম চক্রবর্তী

শিবরাম চক্রবর্তী

ঠিক পঁচিশে বৈশাখের মুখোমুখি ‘কথাসাহিত্য’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কাছ থেকে চিঠি পেলাম। শিবরাম চক্রবর্তী স্মারক সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। লেখা চাই। মে মাসের মধ্যেই দিতে হবে।

বাংলায় বৈশাখ, ইংরেজিতে মে দুই-ই রবীন্দ্রনাথের মাস। কথাসাহিত্যের চিঠি পেয়ে মনে পড়ে গেল বহুকাল আগে শিবরাম চক্রবর্তীর অল্পবিস্তরের একটি কবিতা।

অল্পবিস্তর ছিল শিবরাম চক্রবর্তীর সাপ্তাহিক কলাম আনন্দবাজারে। সেখানে শিবরাম চক্রবর্তী শুধু নিজের টীকা-টিপ্পনি মন্তব্যাদি ছাপতেন তাই নয়, বাইরে থেকে পাঠানো চিঠিপত্র থেকে অনেক কিছু উদ্ধৃত করে ছাপতেন।

একথা স্বীকার না করলে গুরু পাপ হবে এই অল্পবিস্তরের পৃষ্ঠাতেই হাস্যকর লেখায় আমার হাতেখড়ি। অল্পবিস্তরই আমাকে প্রথম খ্যাতির স্বাদ দিয়েছিল। শিবরাম চক্রবর্তী আমার মজাগুরু। তাঁরই হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের প্রাসাদের সরস মিষ্টান্নের ভাঁড়ার ঘরে প্রবেশ করেছিলাম।

সে যা হোক, পঁচিশে বৈশাখের কথা দিয়ে আরম্ভ করেছিলাম। প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখে অল্পবিস্তরের সেই আশ্চর্য কবিতাটি আমার আবার মনে পড়ে। কত কী ভুলে গিয়েছি চল্লিশ বছরে কিন্তু সেই কবিতাটি আশ্চর্য মনে আছে।

চাকর পরিলো ধুতি

গিলে করা পাঞ্জাবি

তাহারে কহিনু ডাকি

আজ “তুই কোথায় যাবি”?

কোঁচাটি লইয়া হাতে

হাসি হাসি বদনে

কহিল “যাইব আমি রবীন্দ্রসদনে।”

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শিবরাম আমার সঙ্গেও একটা ব্যক্তিগত রসিকতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন পিতৃতুল্য। বয়সের হিসাবে আমার বাবার চেয়েও বেশ কয়েক বছরের বড়। তবু ছোটখাটো ব্যাপারেও হালকা রসিকতা করতে ছাড়তেন না।

তখন আমি বেকার, একুশ-বাইশ বছর বয়স, সদ্য এম. এ পরীক্ষা দিয়েছি, কলেজ স্ট্রিট-এর ফুটপাতে ইতস্তত হাঁটতে হাঁটতে শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা। তখন আমার সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠতা। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে তাঁর মেসের ঘরের দেয়ালে আমার নাম ঠিকানা লেখা হয়ে গিয়েছে। শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে যেমন কখনও কখনও থাকত, সেদিন একটি মেয়ে ছিল।

আমাকে দেখে শিবরাম চক্রবর্তী কাছে ডাকলেন। এবং হঠাৎ মেয়েটিকে দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই একে বিয়ে করবি?”

আমি স্তম্ভিত, মেয়েটি তথৈবচ। আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল, “না। একে আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমার পছন্দ আপনাকে, আমি আপনাকে বিয়ে করব।”

শিবরাম চক্রবর্তী গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে পারব না। আমার তো পাত্রী ঠিক আছে।”

মেয়েটি চেপে ধরল। আপনার যত সব বাজে কথা। আপনার পাত্রীকে কখনও দেখতে পাই না কেন। শিবরাম বললেন, “কীভাবে দেখবেন? সে তো গিয়েছে ঝরিয়ায়।”

আমরা দু’জনেই অবাক হয়ে প্রশ্ন কররাম, ঝরিয়ায়? শিবরাম মৃদু হেসে বললেন, “শোনোনি ঠাকুর গান লিখেছেন, ‘ফাগুনের ফুল গেছে ঝরিয়া’।”

শিবরামের অনুরূপ আর একটি রসিকতার কথা মনে পড়ছে। ম্যাকমেহন লাইন অতিক্রম করে উত্তর সীমান্তে চিন যখন বিস্তর ভারতীয় এলাকা দখল করে নিল শিবরাম বলেছিলেন অল্পবিস্তরের কলামে, রবীন্দ্রনাথ তো আগেই বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তো লিখেই গিয়েছেন, “একদিন চিনে নেবে তারে।”

শিবরামকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। সব গল্প বলা যাবে না। শুধু দুঃখের ঘটনা বলি। শরৎচন্দ্রের ‘দেনা পাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন শিবরাম চক্রবর্তী। নাটকের নাম হয় যোড়শী। শিশির ভাদুড়ী পরিচালিত ও অভিনীত ষোড়শী খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক ব্যাপারে শিশির ভাদুড়ীর ব্যবহারে শিবরাম ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। তিনি তখন শিশির ভাদুডডীর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “শিশির ভাদুড়ী নহ তুমি বোতলের—”

শরৎচন্দ্রের কাছেও শিবরাম এই প্রসঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও কোনও সুরাহা হয়নি। শরৎচন্দ্রের পরিষদ-প্রধান ছিলেন অবিনাশ ঘোষাল। অল্প কিছুদিন আগে শরৎচন্দ্রের প্রিয় কুকুর ভেলি মারা গিয়েছে।

শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে এসে, শিবরাম লিখলেন সেই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি,

“ভেলির বিনাশ নাই ভেলি অবিনাশ”

শিবরাম, শুধু শিবরাম, শুধু শিবরাম চক্রবর্তী পারতেন এমন সরস প্রতিশোধ নিতে। শিবরাম চক্রবর্তী অমর রহে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *