6 of 8

পরিবার পরিকল্পনা

পরিবার পরিকল্পনা

হালকা লেখা লিখে লিখে অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে এত চপলতা পোষায়, না মানায়? অনেক ভেবেচিন্তে এবার একটা গুরুগম্ভীর বিষয় নিলাম, আরম্ভও করছি গুরুগম্ভীর ভাবে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ও বহুপঠিত ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে কালিদাসের কালের সূত্রে বলেছিলেন, ‘সময় যেন তখনকার পর হইতে ক্রমে ক্রমে ইতর হইয়া আসিয়াছে।’ এই উদ্ধৃতি হয়তো এই আলোচনায় একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে কিন্তু কথাগুলি মনে পড়ল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ পাঠ করে। এবার ভাষণ দিতে এসেছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্যার জন একল্‌স। প্রসঙ্গক্রমে জন একল্‌স একটি মারাত্মক বক্তব্য রেখেছেন, যার সারমর্ম হল, সভ্যতা ক্রমশ ইতর হয়ে যাচ্ছে, যাবে। যারা বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান তাদের ছোট পরিবার, সুখী পরিবার, তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কম। ক্রমশ তুলনামূলকভাবে পৃথিবীতে রুচিশীল, শিক্ষিত লোকের বংশধরদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর বেড়ে যাচ্ছে অশিক্ষিত, রুচিহীন মানুষদের জগৎ। আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে, গ্রন্থ থেকে, শিক্ষকদের কাছ থেকে যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার পাই তারই নাম সভ্যতা। সভ্যতার প্রগতিশীল বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমৃদ্ধ হয় মানবসমাজ। দুঃখের কথা, যে লোকেরা এই বিধানকে গতিশীল রাখে তারা ক্রমশ অতি নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। স্থূল রুচি, কৃষ্টিহীন মুখে ভরে যাচ্ছে মানবসমাজ।

স্যার জন একল্‌সের বক্তব্যটি আপাতদৃষ্টিতে প্রতিক্রিয়াশীল মনে হতে পারে। তিনি বলেছেন এখন আর এভলিউশন নয়, ডিভলিউশন হচ্ছে, ‘ইতর হইয়া আসিতেছে।’

এই জটিলতার কচকচির মধ্যে না থেকে বরং একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাই। ‘কয়েকজন’ নামে আমাদের একটা পারিবারিক পত্রিকা ছিল, তার দেখাশোনা করতাম আমি কিন্তু কোনও এক নৈতিক কারণে আইনত সম্পাদনা করতেন শ্রীযুক্তা মিনতি রায়, আমার বিদুষী স্ত্রী। পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হত, সম্পাদিকা মিনতি রায়। সম্পাদিকা সমেত পত্রিকার যথাসাধ্য দেখাশোনা করেন তারাপদ রায়।

তা, এই কাগজের জন্য আমরা মাঝে মধ্যে এদিকে ওদিক দু’-একটা বিজ্ঞাপন চাইতাম। একবার একটি আবেদন পাঠিয়েছিলাম পরিবার পরিকল্পনা দফতরে। দফতরের আধিকারিক আমাদের একটি সাইক্লোস্টাইল করা সার্কুলার লেটার পাঠান এর উত্তরে। তাতে প্রশ্ন ছিল, বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে কিন্তু তার আগে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে আমরা কী করেছি সেটা জানাতে হবে।

প্রশ্নটি পেয়ে প্রথমে আমাদের বুঝতে একটু সময় লাগে। তারপর প্রশ্নের উদ্দেশ্য বোঝামাত্র আমরা পরিবার পরিকল্পনা প্রচারাধিকারিককে জানাই যে, আমাদের ‘কয়েকজন’ কাগজে মোটামুটি নিয়মিত লেখক যোলো-সতেরোজন। এঁদের মধ্যে সুধেন্দু মল্লিক এবং শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, দু’জন ব্যাচেলার আর তা ছাড়া শরৎ-বিজয়া মুখোপাধ্যায় কবি-দম্পতি এবং সম্পাদক-সম্পাদিকা সমেত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হিমানীশ গোস্বামী, সন্দীপন, নবনীতা, অলোকরঞ্জন, আলোক সরকার বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এই রকম যোলোজন লেখক-লেখিকা, তাঁদের অর্ধাঙ্গ বা অর্ধাঙ্গিনী নিয়ে মোট আটাশজন; এঁদের সকলের ছেলেমেয়ে সবসুদ্ধ মোট তেরোজন। আমরা বিনীতভাবে জানতে চেয়েছিলাম, পরিবার পরিকল্পনার জন্যে অথবা নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপন পেতে গেলে আমাদের কী করতে হবে। এই তেরোটি শিশুকে কি গলা টিপে মেরে ফেলব। বলা বাহুল্য আমাদের এই চিঠির জবাব বা পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপন কিছুই আসেনি অতঃপর।

গত সপ্তাহেই পাকিস্তানের কথা লিখেছি। পরিবার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কথা এবারেও উল্লেখ করতে হচ্ছে। সংবাদটি কতটা নির্ভরযোগ্য জানি না, কিন্তু দেশি, বিদেশি প্রায় সমস্ত কাগজে দিন দশেক আগে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানে নাকি পরিবার নিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এ নাকি ভীষণ অশাস্ত্রীয় ব্যাপার। অথচ এদিকে কিন্তু পুরনো পূর্ব পাকিস্তানে, এপাশের বাংলাদেশে একেবারে অন্যরকম। বাংলাদেশ বেতার খুললেই শোনা যায় পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে জোর প্রচার। এর অধিকাংশ কথিকা খুবই চমৎকার, রুচিশীল এবং বুদ্ধিদীপ্ত। এপারে আকাশবাণীতে বা দূরদর্শনে এই রকম মানের কথিকা বিরল। সে যা হোক, পরিবার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি জিনিস ভেবে দেখার আছে। এখন যেমন অধিকাংশ শিক্ষিত দম্পতির একটি করে সন্তান, এটা যদি তিন পুরুষ ধরে চলে তা হলে কাকা, মামা, পিসি, মাসি থাকবে না। এখনই প্রায় বিরল হয়ে এসেছে এইসব ডাইনোসরেরা। খুড়তুতো কাকা কিংবা মাসতুতো মাসি এখনও জুটছে কিন্তু এক পুরুষ পরে খুড়ো না থাকায় খুড়তুতো থাকবে না, মাসি না থাকায় মাসতুতো থাকবে না। উঠে যাবে ভাইফোঁটা, মুখেভাতে মামার হাতে পায়েস খাওয়া। তাই তাই তাই মামার বাড়ি যাই’ কথার কোনও মানেই থাকবে না। কোনও শিশুকেই শেখানো যাবে না,

‘মাসি পিসি বনগাঁবাসী

বনের ধারে ঘর,

কখনও মাসি বলে না যে

খই মোয়াটা ধর।’

কারণ সে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করবে মাসি পিসি কী? বোঝানোও যাবে না কারণ মাসি-পিসি না থাকলে এ ব্যাপারটা বোঝানো সোজা নয়। মাসি থেকে যাবে শুধু পুরীধামে জগন্নাথদেবের আর কাকা থাকবে বায়সকণ্ঠে।

কাল্পনিক হাহুতাশ থাক। সত্যি কথাটা হল, অধিক সন্তানের ব্যাপারটা আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি সমাজে আর মোটেই পছন্দসই নয়। আমার এক প্রতিবেশী একটি ছোট কারখানা চালাতেন। সেখানে নয়টি ছেলেমেয়ের বাবা জগমোহন নামে এক কর্মচারীকে তিনি করুণাবশত পঁচিশ টাকা বেশি দিতেন মাস মাইনেয়। একদিন অন্য এক কর্মচারী প্রতিবাদ করে, ‘আমি আর জগাদা একই কাজ করি। জগাদাকে পঁচিশ টাকা মাইনে বেশি দেন কেন?’ আমার প্রতিবেশী মালিক ভদ্রলোক থমকে গেলেন, যে ছেলেটি প্রতিবাদ করছে সে বেশ ভদ্র ও শিক্ষিত, তাকে বোঝানোর জন্যেই খুব গুছিয়ে নরম করে বললেন, “তুমি রাগ করছ কেন? তোমার মাত্র একটি মেয়ে আর তোমার জগদার নয়টি ছেলেমেয়ে। সামান্য পঁচিশটি টাকা ওকে বেশি দিয়েছি।’ এই ব্যাখ্যা উত্তেজিত প্রতিবাদকারীকে মোটেই দমিত করল না বরং সে বলে বসল, ‘দেখুন দাদা, আমার ধারণা ছিল আপনি আমাদের মাইনে দেন আমরা এখানে যা উৎপাদন করি সেইজন্যে। বাড়িতে যা উৎপাদন করি সে জন্যে নয়।’

পরিবার পরিকল্পনার শেষ গল্পটি এক বধির বৃদ্ধকে নিয়ে। পথের পাশে বৃদ্ধের বেগুন ক্ষেত, তাতে কিছু কিছু বেগুন ফলেছে। বেগুন ক্ষেতের পাশে সরকারি রাস্তা। সেই রাস্তার ধারে একটা কালভার্টের উপরে বৃদ্ধ বেগুন ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এক আধা-পরিচিত ব্যক্তি পথ দিয়ে যেতে যেতে নমস্কার করে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাল?’ বৃদ্ধ ঘাড় দুলিয়ে বললেন, ‘মোটামুটি।’ লোকটি তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছে, জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেপিলে, মানে ছেলোপিলে কেমন আছে?’ বুডোর মন তখন বেগুন ক্ষেতে নিমগ্ন। বুড়ো ভাবলেন বেগুনের কথা জিজ্ঞেস করছে, বললেন, ‘তা, আর তেমন কই। কখনও দুটো-চারটে হয়, কখনও আট-দশটা।’

প্রশ্নকারী পথিক স্তম্ভিত, ‘এত ছেলেপিলে? সে কী? এদের মানুষ করবেন কী করে?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘আর বোলো না। দু’-একটাকে ভেজে খাই। দু’-একটাকে পুড়িয়ে খাই, বাকিগুলি সেদ্ধ। কোনওরকমে চলে যায়।

স্তম্ভিত পথিক হাঁ করে সেই বেগুন-বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমরাও হাঁ করে তাকিয়ে আছি মানবসমাজের দিকে। কবে শুরু হবে পুড়িয়ে, সেদ্ধ করে, ভেজে খাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *