6 of 8

শব্দকল্পদ্রুম

শব্দকল্পদ্রুম

এই রম্য নিবন্ধটির বিষয় শব্দদূষণ। এ রকম একটি গুরুতর বিষয়কে প্রথমেই হালকা করে নিলাম মহামহিম সুকুমার রায়ের সাহায্যে নামকরণ করে।

সুকুমার রায় এক কাল্পনিক শব্দদূষণের জগৎ তৈরি করেছিলেন।

ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম শুনে লাগে খটকা—

ফুল ফোটে? তাই বল আমি ভাবি পটকা!

সেই ফুল তো ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম করে ফুটল। তারপর সে ফুলের গন্ধ সাঁই সাঁই পন পন করে ছুটতে লাগল, হুড়মুড় ধুপধাপ করে হিম পড়তে লাগল। অবশেষে ঝুপ-ঝুপ-ঝপাস, গব-গব-গবাস—চাঁদ ডুবে গেল।

আসল শব্দদূষণের ব্যাপারটা অবশ্য এত মজার নয়। দূষণ নানারকম আছে। বায়দূষণ, জলদূষণ, সমাজদূষণ, খাদ্যদূষণ— এইরকমই একটি হল শব্দদূষণ।

তবে সবচেয়ে আদি দূষণ হল একটি রাক্ষস। রামায়ণ মহাকাব্যে আরণ্যকান্ডে তার কথা আছে, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনুবাদিত বাল্মীকি রামায়ণের ওই আরণ্যকাণ্ডে একবিংশ থেকে ষডবিংশ সর্গ দ্রষ্টব্য।

দূষণ ছিলেন রাবণ রাজার মাসতুতো ভাই। বলতে গেলে রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং লঙ্কাকান্ডের সূত্রপাত হয়েছিল দূষণ এবং তার অন্য ভাই খর রাক্ষসের দ্বারা। এই খর এবং দূষণ পঞ্চবটি বনে তাদের বোন সুপর্ণখার কারণে রাম-লক্ষ্মণকে আক্রমণ করে এবং সদলবলে নিহত হয়।

আদি দূষণকে রাম-লক্ষ্মণ নিহত করেছিলেন, কিন্তু একালের দূষণগুলিকে নির্মূল করার ক্ষমতা বোধহয় কোনও রাম-লক্ষ্মণের নেই।

অন্য দূষণের কথা থাক, শব্দদূষণের কথাই বলি। প্রথমে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি।

দক্ষিণ কলকাতায় পণ্ডিতিয়া রোডে আমি এক যুগেরও বেশি কাল অতিবাহিত করেছি। রাস্তার ওপরে একতলার ফ্ল্যাটে থাকতাম। আমি যখন ও-পাড়ায় যাই সে ছিল শান্ত নির্জন পল্লী। ক্রমশ তার চেহারা বদলাতে লাগল। পুরো রাস্তা মোটর সারাইয়ের গ্যারেজ আর কারখানায় ভরে উঠল।

সেসব কারখানার কোনওটায় পুরনো গাড়ি চেঁচে রং করা হয়, কোনওটায় ইঞ্জিন ওভারলিং হয়, সবচেয়ে অসহ্য ও মর্মান্তিক ব্যাপার হল শেষের দিকে, এক ভদ্রলোক ঠিক আমাদের ফ্ল্যাটের উলটোদিকে গাড়ির হর্ন সারাইয়ের আস্তানা করলেন। এই ভদ্রলোকের অধিকাংশ খদ্দেরই ছিল ট্যাক্সিওয়ালা।

ট্যাক্সিওয়ালারা গভীর রাতে নিজেদের ভাড়া খাটা শেষ করে ওইখানে হর্ন সারাতে আসত। আবার ওই সময়টা ভদ্রলোকের পক্ষেও সুবিধাজনক ছিল। ভদ্রলোক বোধহয় দিনের বেলায় কোথাও চাকরি-বাকরি করতেন। তিনি সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এক ঘুম দিয়ে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে কারখানায় এসে কাজ শুরু করতেন।

শিবরাম চক্রবর্তী এক অলৌকিক গাড়ির কথা বলেছিলেন, যে গাড়ির হর্ন ছাড়া আর সবই বাজে। এখানে বাজে শব্দের দু’রকম মানে, এই দু’রকম মানেই ভদ্রলোকের কারখানায় আগত গাড়িগুলি সম্পর্কে প্রয়োগ করা যায়। সারারাত ধরে চলত হর্ন সারানোর কাজ। আমাদের রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল, প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। প্রতি রাতে এ জিনিস সহ্য করা অসম্ভব।

কিন্তু এ জিনিস আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। একদিন বা দু’দিন নয়, একমাস বা দু’ মাস নয়, বছরের পর বছর। চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করতে রাজি হন না। এরাও বৎসরান্তে কালীপুজো, শীতলাপুজোয় হাজার টাকা চাঁদা দেয়, দুর্গাপুজোয় পাঁচ হাজার। অবশ্য থানা পুলিশ করতে পারতাম। কিন্তু মনে কেমন সন্দেহ হচ্ছিল, তাতে তেমন কোনও লাভ হবে না। মধ্যে থেকে একজন খারাপ শত্রু তৈরি হবে।

স্বৰ্গত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা মনে ছিল। সেই সময় তিনি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ‘সুনন্দর জার্নাল’ লিখতেন। তখন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাসায় বিছানায় শয্যাসঙ্গী। তাঁর শোয়ার ঘরের জানলার সামনে সে সময় বারোয়ারি মাইকে হিন্দি গান বাজছে তারস্বরে। আবেদন-নিবেদনে কোনও কাজ হয়নি। মাইক দিনের পর দিন বেজেছে এবং এই অত্যাচারেই তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান। এবং সেটাই যে তাঁর পরিণতি হবে শেষ কিস্তি ‘সুনন্দর জার্নাল’-এ সেটা তিনি আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন।

শব্দের একটি মোহ আছে। পুরাণের ঋষিরা বলেছেন শব্দব্রহ্ম।

আপনি কখনও ক্যানেস্তারা বাজিয়ে দেখেছেন? দেখবেন, কিছুক্ষণ বাজানোর পর মন বেশ মজে যায়, মনে হয় আরও জোরে জোরে বাজাই।

বাদ্যযন্ত্র বাজানোর এবং গানের সঙ্গতের ব্যাপারে কথিত আছে যে, শিক্ষানবিশদের এ ব্যাপারে সুরের দেবতার আশীর্বাদ আছে, যাতে তারা নিজেরা বেসুরো বাজালে বা বেসুরো গাইলেও তাদের নিজের কানে সেটা ধরা না পড়ে বরং মধুর শোনায়। তা না হলে নতুন আনাড়ি শিক্ষার্থীরা কখনও গান শিখতে বা বাজনা বাজানো শিখতে চাইবে না। নিজেদের অক্ষমতা বুঝতে পেরে সংগীতের সাধনা থেকে বিরত হবে, কিংবা সুরচর্চা ছেড়ে দেবে।

তা এই বেসুরো গান বা বাজনা যে গাইছে বা বাজাচ্ছে তার কানে সুমধুর শোনালেও তার প্রতিবেশীদের, তার বাড়ির লোকজনের কথা একবার ভাবুন।

তবু বেসুরো গান সাধা সহ্য করা যায়, কিন্তু যতই সুরেলা ও মধুর হোক না, গান যদি অসময়ে বেজায়গায় উচ্চনাদে গীত হয়, সে অনেক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে।

আমার এক ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর বাড়িতে পৌত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটিই গান প্রায় সাতদিন ধরে মাইকে সজোরে বাজানো হয়েছিল এবং সেই গানটি হল, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ভরা।’ একটি শিশুর মুখেভাতের উপযুক্ত গানই বটে। আসলে গান বাজানো হচ্ছে তো হচ্ছেই—কী গান, কেন গান, অন্যদের অসুবিধে হচ্ছে কি না কে খেয়াল করে, কে তোয়াক্কা করে!

সম্প্রতি মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট মাইক বাজানোর ব্যাপারে কয়েকটি নির্দেশ জারি করেছেন।

কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনগামী জাহাজে এক ভয়াবহ শব্দ বিপর্যয়ে পড়েছিলেন। স্কুলপাঠ্য রচনায় শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই অংশটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাঙালি পাঠকের সুপরিচিত। তবুও শব্দদূষণসূত্রে কিঞ্চিৎ প্রক্ষিপ্ত অংশ স্মরণ করা যেতে পারে:—

…একপ্রকার তুমুল শব্দ কানে পৌঁছল, যাহার সঙ্গে তুলনা করি এমন অভিজ্ঞতা আমার নাই। গোয়ালে আগুন ধরিয়া গেলে একপ্রকার আওয়াজ উঠিবার কথা বটে, কিন্তু ইহার অনুরূপ আওয়াজের জন্য যতবড় গোশালার আবশ্যক, তত বড় গোশালা মহাভারতের যুগে বিরাট রাজার যদি থাকিয়া থাকে তো সে আলাদা কথা, কিন্তু এই কলিকালে…

…কাবুল হইতে ব্রহ্মপুত্র ও কুমারিকা হইতে চিনের সীমানা পর্যন্ত যত প্রকারের সুরব্রহ্ম আছেন, জাহাজের এই আবদ্ধ খোলের মধ্যে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে তাহারই সমবেত অনুশীলন চলিতেছে। এ মহাসংগীত শুনিবার ভাগ্য কদাচিৎ ঘটে…

…মহাকবি শেক্সপিয়ার নাকি বলিয়াছেন, সংগীতে যে মুগ্ধ না হয় সে খুন করিতে পারে—কিন্তু মিনিটখানেক শুনিলেই যে মানুষের খুন চাপিয়া যায় এমন সংগীতের খবর বোধকরি তাঁহার জানা ছিল না।

তবু ভাগ্য ভাল, শরৎচন্দ্রের সেই আমলে মাইক ছিল না। এই মহাসংগীত যদি মাইকে গীত হত, তা হলে কী অবস্থা হত, সেটা কল্পনা করাও কঠিন।

মহামান্য আদালত অবশ্য মাইক ব্যবহারের সময়কাল এবং শব্দাঙ্ক (অর্থাৎ কতটা জোরে মাইক বাজাবে) সেটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। হয়তো এতে কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে।

কিন্তু শব্দরাক্ষস শুধু মাইকনির্ভর নয়। বাড়ির পাশের কারখানায় হাতুড়ি পেটার শব্দ আছে, টিন, ঘন্টার শব্দ আছে। মোটর গাড়ির হর্ন, সে যে কত রকমের গোলমেলে হতে পারে তার কোনও তুলনা নেই।

সর্বোপরি আছে বাজি, বোমা ও পটকা। পুজো-পার্বণে, খেলার মাঠে, বিসর্জনের ঘাটে, বিয়ের মিছিলে এবং আত্মকলহে বাজি-বোমার অফুরন্ত ব্যবহার। এগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে রক্ষা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *