শুধু পাঠিকারা চিঠি লেখে
এক গ্রামে এক বৃদ্ধ পেটুক ব্রাহ্মণ। তাঁর এমনিতে কোনও দোষ নেই। শুধু খেতে খুব ভালবাসেন।
বৃদ্ধ মানুষটি ভাল। সবাই তাঁকে খাওয়াতেও ভালবাসে। পাড়ার লোক একবার একটা বিরাট নৌকা ভাড়া করে পিকনিক করতে গিয়েছে। পিকনিক হবে গ্রাম থেকে দূরে। একটা নদীর চড়ায়।
নৌকো ভর্তি চাল, ডাল, তেল, কাঠ নিয়ে সবাই পিকনিক করতে রওনা হল। যাওয়ার সময় তারা ব্রাহ্মণকে নিয়ে যেতে ভুলল না। আহা, গরিব ব্রাহ্মণ লোকটি খেতে ভালবাসে। আমাদের সঙ্গে ও পিকনিক যাবে।
নৌকো যখন চড়ার ধারে ভিড়তে গিয়েছে ঘাট থেকে, তার একটু আগে নৌকোর গলুই ধাক্কা খেল বড় পাথরে। নৌকো উলটে গেল।
ব্রাহ্মণ সাঁতার জানতেন, তিনি সাঁতরিয়ে চড়ায় উঠলেন, বাকি সব জলে ডুবে মারা গেল।
অত ভাল ভাল খাবার সব জলে গেল। পেটপুরে খাওয়া হল না। ব্রাহ্মণ খাবারের শোকে কিছুক্ষণ কাঁদলেন।
ওই চড়ায় অন্য যে লোকজন ছিল তারা এসে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?” তখন ব্রাহ্মণ বললেন, “আমার গ্রামের লোকেরা সব জলে ডুবে মারা গিয়েছে।”
লোকজন আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। হঠাৎ ব্রাহ্মণের কী একটা খেয়াল হল। তিনি কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “ওরে আমার কী সর্বনাশ হল রে।”
যাঁরা ব্রাহ্মণের পাশে ভিড় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণকে প্রশ্ন করলেন, “যারা মারা গিয়েছে তারা সবাই কি আপনার আত্মীয়স্বজন?”
ব্রাহ্মণ বললেন, “না, না, না এর মধ্যে আমার আত্মীয় নেই।” তখন সবাই বলল, “তবে এত দুঃখ কীসের আপনার।” ব্রাহ্মণ বলল, “আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।” আবার জিজ্ঞাসা, “কী সর্বনাশ?” ব্রাহ্মণ বলল, “পনেরো বিশটা লোক একই দিনে মরে গিয়েছে। তার মানে একই দিনে শ্রাদ্ধ হবে। যেখানে পনেরো বিশটা শ্রাদ্ধ ধীরেসুস্থে কয়েক বছরে খেতাম, এবার একদিনেই সব ক’টা শ্ৰাদ্ধ খেতে হবে। আমার ক্ষতি আপনাদের কী করে বোঝাব।”
গল্পটা কেমন যেন চেনা চেনা, নিতান্ত গ্রাম্য গল্প। অনেকদিন আগে অল্প বয়সে শোনা, কিংবা হয়তো শস্তার বাংলা জোক বুকে পড়েছিলাম। কিন্তু এবার আমাকে এই গল্পটি পাঠিয়েছেন রামপুরহাট থেকে স্বপ্না চক্রবর্তী।
তিনি লিখেছেন গঙ্গারামের মোটা গল্পগুলির চেয়ে আমাদের এই গেঁয়ো গল্প অনেক ভাল। আপনার কলমে একবার পরীক্ষা করে দেখবেন।
তবে অন্য একটি গল্প পরীক্ষা না করেই বলতে পারি সত্যিই চমৎকার, গল্পটি কেয়া দত্ত পাঠিয়েছেন নববারাকপুর থেকে। হয়তো সত্যি গল্প। কেয়া দত্ত লিখেছেন, “সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে একটা চোর ধরা পড়েছিল, আমার গুরুগম্ভীর নীতিবাগীশ শ্বশুরমশাই তাকে খুব ধমকালেন তারপরে বললেন, “তোর লজ্জা করে না, লোকের বাড়িতে চুরি করিস।” শ্রীমান চোর অম্লান বদনে বলল, “সেই জন্যই তো রাতের বেলায় অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চুরি করতে আসি।”
এই সময় গঙ্গারাম বলল, “আপনাকে শুধু পাঠিকারা চিঠি লেখে কেন? পাঠক নেই?” আমি বললাম, “এত কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।”
হাতিবাগানের বেলা চক্রবর্তীর গল্পটা শোন। বেলা চক্রবর্তী বলছেন, তার দেওর আর্ট কলেজে পড়ছে। আর বাড়ির সব সাদা দেয়ালে তুলি দিয়ে, পেনসিল দিয়ে যা ইচ্ছে ছবি এঁকে যাচ্ছে। সেদিন ওর দেওর শুধু পেনসিল দিয়ে এমন সুন্দর মাকড়সার জাল দেয়ালে এঁকেছে যে বাড়ির কাজের মেয়ে বারবার ঝাঁট দিয়েও সেই জালটা সরাতে পারেনি, সে বুঝতেই পারেনি ওটা সত্যিকারের জাল নয়। এটুকু শুনে গঙ্গারাম বলল, “অসম্ভব।” আমি বললাম, “অসম্ভব কেন?”
গঙ্গারাম বলল, “কোনও কাজের মেয়ে দেয়াল ঝাঁট দেয় না, তা ছাড়া এক জায়গায় একাধিক ঝাঁট দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কোনও কাজের মেয়েই তা দেবে না।”
গঙ্গারাম বলল, “এসব গল্প লিখে বাজারে আপনার দুর্নাম হবে।”
আমি আর কী বলব। চুপ করে থাকলাম।
গঙ্গারাম বলল। “তার চেয়ে আমার বন্ধু শিবলাল শীলের গল্পটা লিখুন।”
“শিবলাল শীল আবার কে? তার গল্পটাই বা কী?” আমি প্রশ্ন করি।
গঙ্গারাম বলল, “শিবলালের বউ ফুলশয্যার রাতে শিবলালকে বলে, তুমি দাড়ি কামাওনি।”
শিবলাল বলল, “আমি দৈনিক অন্তত বিশ-পঁচিশবার দাড়ি কামাই।”
শিবলাল প্রাচীন ক্ষৌরকার বংশের সন্তান। শিবলালের ভাষায় চুল-দাড়ি কামিয়ে তারা পয়সা কামায়। দৈনিক বিশ-পঁচিশবার দাড়ি কামানো তার কাছে কিছুই নয়। সেটাই তার জীবিকা। কিন্তু এটুকুতে তো আর গল্প হয় না। “বাকিটুকু পরের দিন হবে।” বলে গঙ্গারাম চলে গেল।