6 of 8

শিশু বিষয়ে

শিশু বিষয়ে

ছাদের ওপরে ঠাকুরমা আমের আচার রোদে দিয়েছেন। বারবার ছাদে উঠে গিয়ে দেখে আসছেন কাকে মুখ দিচ্ছে কি না। তিনি প্রত্যেকবারই দেখলেন তাঁর প্রিয় বালক নাতিটি আচারের বয়ামের কাছ ঘেঁষে বসে আছে। ঠাকুরমা ভাবলেন, ভালই তো, থাকুক না এখানে—কাক আসতে সাহস পাবে না।

কিন্তু নাতিটি একেবারে বয়াম ঘেঁষে বসে আছে। ঠাকুরমা সিঁড়ির ওপরে থেকেই বললেন, ‘দাদু, অত বয়ামের কাছ ঘেঁষে বসতে হবে না।’

পরেরবার ছাদে উঠেও ঠাকুরমা দেখলেন নাতিটি বয়ামের কাছ ছাড়েনি, বরং আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এবার ঠাকুরমা বললেন, ‘দাদু, তোমাকে না বললাম বয়ামের কাছ ঘেঁষে বসবে না!’

নাতি বলল, ‘আর বসব না ঠাকুরমা, আর বসে লাভ নেই।’

ঠাকুরমা বললেন, ‘কী লাভ নেই?’

নাতি বলল, ‘বয়ামে আর এক ফোঁটা আচারও নেই।’

অন্য একটা গল্প বলি।

দুই ভাই, জগাই এবং মাধাই। আগে অবশ্য তাদের নাম জগা এবং মধু ছিল, তবে সামান্য বয়েস বাড়তে তারা এত দুষ্ট হয়েছে যে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নামবদল হয়ে তারা এখন জগাই, মাধাই হয়েছে।

জগাই-মাধাইয়ের বাবা একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখেন বাড়ির বাইরের ঘরে কাচের শার্শি ভাঙা, বাইরের ঘরে জগাই-মাধাই দু’জনায় পরস্পর ধুন্ধমার লড়াই করছে। তাদের মা বোধহয় আশেপাশের কোনও বাড়িতে গল্পগুজব করতে গেছেন, সেই সুযোগ দু’ভাই সদ্বব্যহার করছে।

দুই হাতে দুই ভাইয়ের কান ধরে পিতৃদেব প্রশ্ন করলেন, ‘জানলার কাচ কে ভেঙেছে?’

জগাই বলল, ‘মাধাই।’

মাধাই বলল, ‘জগাই।’

দুই ভাইকে কষে দুটো করে থাপ্পড় লাগালেন, পরে জানা গেল, প্রকৃত অর্থে কেউই মিথ্যে বলেনি। জগাই মাধাইয়ের মাথা লক্ষ করে একটা পেপার ওয়েট ছুড়েছিল। মাধাই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার মাথা সরিয়ে নেয়, ওটা গিয়ে জানালার কাচে লাগে, কাচ ভাঙে। জগাই অবশ্যই দায়ি, কারণ সেই ঢিলটা ছোড়ে। আবার মাধাইও দায়ি, কারণ সে তার মাথা সরিয়ে না নিলে ঢিলটা কাচে লাগত না।

এই জগাই একবার ক্লাসের পরীক্ষায় অত্যন্ত কম নম্বর পেয়েছিল। বাবা ধরলেন, ‘তুমি এত কম নম্বর পেলে কী করে?’

জগাই অম্লান বদনে জবাব দিল, ‘আমি যে ক্লাসের সবার শেষে, লাস্ট বেঞ্চের লাস্টে বসেছিলাম।

জগাইয়ের পিতৃদেব অবাক, ‘তার জন্য কী হয়েছে?’

জগাই ব্যাখ্যা দিল, ‘সবার নম্বর দিতে দিতে আমার পর্যন্ত এসে মাস্টারমশাইয়ের নম্বর কম পড়ে গিয়েছিল।’

আর মাধাই হল সেই শিশু যাকে ‘কাক কেন কালো?’ জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, ‘কাক আর কী করবে? ওর যে মা কালো, বাবাও কালো, তাই ও নিজেও এত কালো হয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জগৎপারাবারের তীরে শিশুরা করে খেলা।’

শুধু জগৎপারাবারের তীরেই নয় শিশুরা মাঠে-ঘাটে, রাস্তায়-ফুটপাথে, ঘরে-বারান্দায়, ছাদের কার্নিশে, জানালার রেলিংয়ে—এমনকী গাছের ডালে, পুকুরের জলে খেলা করে। তাদের খেলার কোনও সময় অসময় নেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমোনো পর্যন্ত সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা তারা সবসময় খেলা করে। শিশুরা খাওয়া নিয়েও খেলা করে।

এই আমারই ছোটবেলার কথা মনে পড়েছে। ভাতের থালা সামনে, কিন্তু ভাত খাচ্ছি না। মা তখন এসে ভাত-ডাল-তরকারি ঘন করে মেখে ছোট ছোট দলা বানাচ্ছেন, গোল গোল ডিমের মতো দলা। তারপর বলতেন, ‘এই হল হাঁসের ডিম’, আমি হাঁসের ডিম খেতাম, তারপর ‘এই বাঘের ডিম’, ‘এই ঈগলের ডিম’, ‘এই গণ্ডারের ডিম’ …এইভাবে চলত—আমিও খেয়ে নিতাম।

আমি কি আর জানতাম না যে ওগুলো ভাতের দলা, বাঘের বা ঈগলের ডিম নয়! সব শিশুই যেমন জানে আমিও জানতাম। কিন্তু সেও ছিল একটা খেলা, খাওয়া-খাওয়া খেলা।

শিশুদের নিয়ে আরও বেশ কয়েকটা গল্প হাতের কাছে রয়েছে। পরে কোথায় হারিয়ে ফেলব, তার থেকে আরেক দফা লিখে রাখি।

শিশুরা কী জন্য যে কী চায়, সেটা সবসময়ে জানা যায় না। তারা ঠাকুরদার মোটা কাচের চশমা নিয়ে রোদ্দুরে আতস কাচের মতো করে ধরে শুকনো ঘাসে কিংবা ছেঁড়া কাগজে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে। ফলে সে ঠাকুরদার কাছে যখন তাঁর চশমাটা অল্পক্ষণের জন্য চায়, সে বৃদ্ধ বুঝতে পারেন না ওই হাই পাওয়ারের চশমা ওইটুকু শিশুর কী কাজে লাগবে।

একটি শিশু যখন গামছা চায়, ধরে নেওয়া যায় সে স্নান করার জন্য গামছা চাইছে না—সে বাড়ির সামনের সদ্য জমা হাঁটুজলে ওই গামছা দিয়ে জালের মতো করে মাছ ধরবে, তা সে জলে মাছ থাকুক বা না থাকুক।

শিশুরা পেনসিলকাটা ছুরি চায় পেনসিল কাটার জন্য নয়, বাড়ির জানলা-দরজা অথবা স্কুলের বেঞ্চে কাঠ কেটে নিজের নাম খোদাই করবে বলে।

তালিকা বিস্তৃত করে লাভ নেই। এবার আমি যে গল্পটি বলতে যাচ্ছি, সেটি খুবই বিপজ্জনক।

সন্ধ্যাবেলা। লোডশেডিং চলছে। শোবার ঘরে একটি বালক মোমবাতি জ্বালিয়ে স্কুলের পড়া করছে। তার মা রান্নাঘরে রান্না করছেন।

হঠাৎ বালকটি রান্নাঘরে ছুটে এল, ‘মা, তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল দাও।’

মা জল দিলেন, ছেলেটি জল নিয়ে শোবার ঘরে ছুটে গেল। তারপর এক মিনিট পরে বালকটি আবার ছুটে এল, ‘মা, আরেক গ্লাস জল দাও।’

আবার বালকটি জল নিয়ে ছুটে গেল। তারপর আবার জল চাইতে এল। চারবারের বার মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পড়াশুনো না করে এত জল দিয়ে কী করছ?’

বালকটি বলল, ‘কী করব! মোমবাতিটা উলটিয়ে গিয়ে বিছানায় আগুন ধরে গেছে, কিছুতেই নিবছে না।’

এই বালকটি খুবই সরল। এবার এক ধূর্ত বালকের কাহিনী বলি।

এই ধূর্তটিকে মাস্টারমশাইরা সবাই ভাল করে চেনেন। তাঁদের সব ক্লাসেই এ রকম বালক বা বালিকা দুয়েকটি সবসময়েই থাকে।

মাস্টারমশাই ক্লাসে বাক্যরচনার পাঠ নিচ্ছেন। বাক্যরচনার ক্লাসে অনেকরকম মজার মজার ব্যাপার ঘটে। হয়তো কোনও ছাত্র বাক্যরচনা করল, ‘কলকাতার চিড়িয়াখানায় একটি তুলসীবনের বাঘ আছে।’ আরেকজন বলল, ‘সুখের পায়রার মাংস অতি সুস্বাদু।’ এমনকী এও দেখা গেছে যে, ‘বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি দু’জনেই বিধবা।’

এসবের মধ্যে যথেষ্টই হাসির ব্যাপার আছে। কিন্তু যে বালকটিকে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ দিয়ে বাক্যরচনা করতে দেওয়া হয়েছিল, সে যা করেছিল সেটা তার ধূর্ততার নিদর্শন। সে অনেক ভেবেচিন্তে লিখেছিল, ‘শিক্ষক মহাশয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটি দিয়ে বাক্যরচনা করতে দিয়েছেন।’

এই বাক্যরচনার জন্য ধূর্ত বালকটি কি নম্বর পাবে? শুধু মাস্টারমশাই এবং ঈশ্বর বলতে পারবেন।

শিশুদের নিয়ে অনেক হল। এবার শেষ করি যমজ শিশু দিয়ে।

দুই যমজ ভাই। বছর পাঁচেক বয়স। তাদের বাড়িতে এক ভদ্রলোক এসেছেন। বাইরের ঘরে দু’জনে খেলছে, তাদের ভদ্রলোক বললেন, ‘এই যে খোকারা, তোমাদের মা-বাবা কোথায়?’

ভাইদের মধ্যে একজন উত্তর দিল, ‘আমার মা রান্নাঘরে রান্না করছে আর ওর বাবা শোয়ার ঘরে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছে।’

ভদ্রলোক তাজ্জব হয়ে গেলেন। দুই যমজ ভাই নিজেদের মধ্যে মা-বাবা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। একজনের ভাগে বাবা, একজনের ভাগে মা।

শিশুকাহিনী সহজে ফুরবার নয়। অন্যসব উলটো-পালটা লেখার চেয়ে এ অবশ্য অনেক সরল ব্যাপার।

সর্বত্রই শিশু খুব সহজলভ্য। কিন্তু তাদের সব থেকে বেশি ঝোঁক সভা-সমিতির প্রতি। গ্রামগঞ্জে, মফস্বলে—এমনকী কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় যেখানেই কোনও অনুষ্ঠান, জলসা বা সভা-সমিতি হোক, শিশুরা অবশ্যই ভিড় জমাবে। সে সভা রবীন্দ্রজয়ন্তীর জলসা হতে পারে কিংবা পরিবার পরিকল্পনার সরকারি প্রচারের জমায়েত হতে পারে। মাইক-প্যান্ডেল-মঞ্চ এসব থাকলেই ঝাঁকে ঝাঁকে শিশু এসে যাবে—ঠেকানো যাবে না।

তাই অনুষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঠিক মঞ্চের সামনে কয়েক হাত জায়গা শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট করে ফরাস পেতে রাখেন, বালখিল্যদের জন্যে ঢালাও বন্দোবস্ত।

সত্যি কথা বলতে কী, আমি এমন অনেক সভা দেখেছি, যেখানে বয়স্ক শ্রোতার সংখ্যা বড়জোর দশ-পনেরো। তাঁরা সামনের দুই সারি কাঠের চেয়ারে ইতস্তত অবিন্যস্তভাবে বসে আছেন। আর তাঁদের ঠিক সামনেই ফরাসের ওপর শ’আড়াই শিশু খলবল করছে।

আমার এক সুরসিক বক্তৃতাবাজ বন্ধু যখন কোনও সভায় যেতেন, বলতেন, ‘যাই, শিশুপাল বধ করে আসি।’

এ শিশুপাল মহাভারতের চরিত্র নয়, এ হল শিশুর পাল—শিশুপাল। ষষ্ঠী তৎপুরুষ। যারা সভামঞ্চের সামনে ফরাসে বসে থাকে।

শিশুদের বিষয়ে দু’-একটা পুরনো গল্প মনে পড়ছে।

‘কান্ডজ্ঞানে’ এক যুগ আগে দু’টি শিশুর কথা বলেছিলাম। বলা বাহুল্য, তারা আর শিশুটি নেই। দু’জনই এখন সরকারি হিসেবে প্রাপ্তবয়স্ক। গত নির্বাচনে সাতসকালে গিয়ে পরমোৎসাহে ভোট দিয়ে এসেছে। এবং তারা এখন এতই সাবালক যে, কাকে কিংবা কোন দলকে ভোট দিয়েছে, সেকথা ফাঁস করেনি। কিছু প্রশ্ন করলে মিটিমিটি হেসেছে।

এর মধ্যে প্রথমজন ছিল প্রকৃত বিচ্ছু। তখন তার চার-পাঁচ বছর বয়স। তাদের বাড়িতে একদিন সন্ধ্যাবেলা আড্ডা দিতে গেছি, শিশুটির বাবার জন্য বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছি, এমন সময় সে ঘরে প্রবেশ করল, আর আমাকে দেখেই বাড়ির মধ্যে ছুটে গিয়ে একটা বাটি নিয়ে এল।

তারপর হাতের বাটিটা আমাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’

আমি সরলভাবে বললাম, ‘বাটি।’

শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলল—‘তোর বউয়ের সঙ্গে সাঁতার কাটি।’

ক্ষুদ্র শিশুটির এই দূরাভিলাষ দেখে সেদিন চমৎকৃত হয়েছিলাম।

দ্বিতীয় শিশুটি অবশ্য এতটা গোলমেলে ছিল না। তার একটা বাঁধা গৎ ছিল। তাদের বাড়িতে কোনও অবিবাহিত বা অবিবাহিতা ছেলেমেয়ে এলে সে প্রশ্ন করত, ‘আচ্ছা বাটা (Bata) বানান কী?’

যেই উত্তর আসত ‘বি এ টি এ’—সে বলত, ‘তুমি বিয়ে-টিয়ে কিছু করবে না?’

পুনশ্চ:

এক দুরন্ত শিশুর পিতৃদেবকে তার এক প্রতিবেশী সেই শিশুর বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। নালিশের বিষয়বস্তু হল, ‘আপনার ছেলেটি আজ দুপুরে ঢিল ছুড়ে আমার সামনের বারান্দার কাচের জানলা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।’

একথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই উক্ত পিতৃদেব জানতে চাইলেন, ‘আপনার জানালার কাচ ভেঙেছে কী?’

প্রতিবেশী বললেন, ‘না ভাঙেনি—ভাঙতে পারেনি।’

পিতৃদেব একথা শুনে নিশ্চিতভাবে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনি ভুল করেছেন, আমার ছেলে কিছুতেই ঢিল ছোড়েনি। সে ঢিল ছুড়লে আপনার জানলার কাচ ভাঙতই ভাঙত।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *