6 of 8

বাঁকা কথা

বাঁকা কথা

আজকাল বাঁকা কথা খুব চলছে। আজকাল সোজা কথা কেউ সোজা করে বলতে চায় না।

সেই সুকুমারের রায়ের অবাক জলপান নাটকে ঘোর গ্রীষ্মে এক পিপাসার্ত ব্যক্তি ‘জল পাই কোথায়?’ জানতে চেয়ে বেকায়দায় পড়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল এটা জলপাইয়ের সময় নয়, কাঁচা আম চাইলে পেতে পারেন। ওই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি যখন বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, তিনি জলপাই নয় জলের খোঁজ করছেন, তাকে শুনতে হল,

‘জল চাচ্ছেন তো জল বললেই হয়, জলপাই বলবার দরকার কী? জল আর জলপাই কি এক হল? আল আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা আর মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন?’…ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ভয়ানক ব্যাপার! এ অবশ্য আজকের নয়, আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে সুকুমার রায় এইরকম বাতচিতের বা কথোপকথনের কথা ভেবেছিলেন।

কী গেরো বাবা! দারুণ অগ্নিবাণে জর্জরিত এক ব্যক্তি তৃষিত হৃদয়ে জলের খোঁজ করছেন, আর তাকে জলপাই থেকে আলুবোখরার কথা বলা হচ্ছে!

সুকুমার রায় চিরস্মরণীয়। তাঁকে আমরা অবিলম্বে আবার স্মরণ করব। আপাতত নিকট কথায় আসি।

নিকট কথা মানে অতি নিকট ব্যাপার। আমার প্রধানা শ্যালিকা অনন্তকাল পরে অতি দূর দেশ থেকে সেদিন আমাদের বাড়িতে এলেন। আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাবেন।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি তার ভগিনীকে বললেন, ‘খুব ভাল খেলাম। তোরা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।’

আমার স্ত্রী খুবই ভালভাবে তাঁর অগ্রজাকে জানেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত পরিষ্কার-পরিষ্কার করছ কেন?’

দিদি বললেন, ‘ডাল-ভাত, চচ্চড়ি-তরকারি, মাছ-মাংস সব কিছুতে সাবানের গন্ধ পেলাম। তবু পরিষ্কার পরিষ্কার বলা চলবে না!’

এইসব তুচ্ছ পারিবারিক ব্যাপার থেকে এবার আমরা আদালতের খোলা সীমানায় যাব।

আদালতের কথাবার্তার ধরনধারণই আলাদা। মাননীয় বিচারক উকিল মহোদয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার মক্কেলের বিরুদ্ধে কীসের অভিযোগ?’

উকিলবাবু বললেন, ‘ইয়োর অনার, অতি সামান্য ব্যাপার। আমার মক্কেল একটা দোকান খুলেছিলেন।’

বিচারক বললেন, ‘দোকান খোলার মধ্যে দোষের কী হল?’

এবার আসামির উকিলবাবু কিছু বলার আগেই সরকারি প্রসিকিউটর বললেন, ‘হুজুর, সে দোকানটা ওর নিজের দোকান নয়।’ অর্থটা প্রাঞ্জল করে বলা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিটি একটি দোকান খুলে চুরি করতে ঢুকেছিল।

অতঃপর একটু সংবাদপত্রের ভাষায় আসি। ‘শীর্ষ সম্মেলন’ কথাটা সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রায়ই দেখি। সেই শীর্ষ সম্মেলনের কথা বলি।

সম্প্রতি এক পর্বত অভিযাত্রী দল প্রচণ্ড কষ্ট করে ভয়াবহ তুষারঝড়, বরফ-ধস পার হয়ে অবশেষে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাল। কিন্তু সেখানে তাদের আগেই একদল লোক উঠে বসে আছে।

একটু এগিয়ে যেতে অভিযাত্রী দল বুঝতে পারল, যাঁরা পর্বতচূড়ায় বসে আছেন তাঁরা সবাই কেউকেটা লোক, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধান।

এঁদের দেখে বিস্মিত হয়ে অভিযাত্রী দলের অধিনায়ক বললেন, ‘মান্যবরগণ, আপনারা এখানে এই পর্বতশীর্ষে কী করছেন?’ উত্তর পাওয়া গেল, ‘কেন, বুঝতে পারছেন না! শীর্ষে সম্মেলন চলছে!’

বাঁকা কথার প্রসঙ্গ উঠলেই সর্বপ্রথমে সকলের মাননীয় উকিলবাবুদের কথাই মনে আসে।

উকিলবাবুরা নমস্য, তাঁদের কথা একটু পরে তেমন সুযোগ ও সাহস করে বলা যাবে। কিন্তু একটা কথা পাঠক-পাঠিকাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাঁকা কথার ব্যাপারে ডাক্তারসাহেবরাও কম যান না। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

এক গোলমেলে এবং বেশ খারাপ দেখতে রোগিণীর বুকের অসুখ এবং শ্লেষ্মার ধাত, ডাক্তারসাহেব তাঁর এক্স-রে তুলিয়েছেন।

ভদ্রমহিলা খুব পরিষ্কার স্বভাবের নন। অন্তত ডাক্তারসাহেবের তাই মনে হয়েছে। রোগিণীটি নানারকম বায়নাক্কা তুলে, ঝগড়া করে ডাক্তারকে তাতিয়ে তুলেছেন। সুতরাং ভদ্রমহিলা যখন ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমার এক্স-রে’-টা কেমন দেখলেন?’…

…ডাক্তারবাবু বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, ‘দেখুন একটা কথা বলছি, ভেতরে বাইরে এত কুৎসিত—আজ পর্যন্ত এত রোগী দেখলাম, এমন আর দেখিনি।’

এবার দ্বিতীয় উদাহরণে যাই। সেটি অবশ্য এত সরেস এবং সরস নয়। তাই সংক্ষিপ্ত করে বলি এবং ডালপালা ছেঁটে কথোপকথনের আদলে বলি:—

রোগী: ডাক্তারবাবু, আমার ডান পায়ের হাঁটুতে খুব ব্যথা হয়েছে।

ডাক্তারবাবু: এ রকম ব্যথা কি আপনার আগে কখনও হয়েছিল?

রোগী: হ্যাঁ, গত বছরেও ঠিক এই বর্ষার সময়ে ডান পায়ের হাঁটুতে এই ব্যথাটা হয়েছিল।

ডাক্তারবাবু: তা হলে আপনার সেই ব্যথাটাই ফিরে এসেছে।

বলাবাহুল্য, সব ডাক্তারবাবু ঠিক এ রকম উচ্চাঙ্গের ডায়গনসিস করেন না। যে ডাক্তারবাবু দম্ভভরে বলেছিলেন যে, ‘আমি যদি কারও ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করি সে ম্যালেরিয়াতেই মারা যাবে—টাইফয়েড বা সান্নিপাতিক বা নিউমোনিয়ায় নয়। কখনও ভুল ডায়গনসিস আমি করি না।’ সেই চিকিৎসক মহোদয়ও এই সূত্রে স্মরণীয়।

ডাক্তারবাবুদের সম্পর্কে না বুঝে একটু কড়া কথা বলা হয়ে গেল। ডাক্তার-উকিল চটানো উচিত নয়। এবার চিকিৎসকদের সম্পর্কে একটা নরম নরম গল্প বলি।

যেমন হয়, হয়ে থাকে। এক ডাক্তারবাবুর চেম্বারে প্রতি সকালবেলায় প্রায় নিয়মিত এক পরিচিত বিনা ভিজিটের রোগী গিয়ে অত্যাচার করেন। এই রোগী ভদ্রলোেক খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুরছেন-ফিরছেন আর মুখে সর্বদা কাতরোক্তি করছেন, ‘মরে গেলাম, মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, মাথাব্যথায় মরে গেলাম।’

ডাক্তারবাবু জানেন পুরো ব্যাপারটা মানসিক। এর তেমন কোনও চিকিৎসা নেই। কিন্তু প্রতি সকালবেলা এই ভদ্রলোকের অত্যাচার তাঁর অসহ্য হয়ে উঠেছে। অবশেষে একদিন তিনি মুখ খুললেন। সেই রোগী এসে যেই বলেছে, ‘ডাক্তার, আমার মাথাব্যথা…’ ডাক্তারবাবু তাঁকে বাক্য সম্পূর্ণ না করতে দিয়ে বললেন, ‘আমারও মাথাব্যথা।’

বয়োঃজ্যেষ্ঠ পূর্বপরিচিত রোগী বললেন, ‘সে কী হে? তোমার আবার মাথাব্যথা কীসের?’

ডাক্তারবাবু নির্বিকার মুখে ঘোষণা করলেন, ‘আপনিই আমার মাথাব্যথা, বুঝতে পারছেন?’

তবে সব ডাক্তারবাবু এ ধরনের কথা স্বজ্ঞানে বলেন না। ডাক্তারবাবুদের কারও কারও অনেকরকম খারাপ অভ্যাস থাকে—নেশা, ভাং, ড্রাগ ইত্যাদি তো হাতের আমলকী। পঞ্চ ম’কার তদুপরি রেস, জুয়া, শেয়ার বাজারে ফাটকাবাজি—বিপদ আর নেশা চিরদিন জোট বেঁধে আসে।

আসলে অনেক ডাক্তারই প্রকৃতঅর্থে ডা. জেকিল এবং মি. হাইড। এইরকম এক ডাক্তারকে এক জ্বরকাতর রোগী মধ্যসন্ধ্যায় ফোন করেছিলেন, ‘স্যার, প্রচণ্ড জ্বর এসেছে, এখন একশো দুই চলছে, কী করব?’ শেয়ার বাজারের অঙ্ক চোখের সামনে, হাতে হুইস্কির গেলাস, কানে টেলিফোন, ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কত? একশো দুই? চুপচাপ থাকুন—একশো পাঁচ হলেই বেচে দেবেন।’

পুনশ্চ:

বাঁকা কথার শেষে ডাক্তারবাবুকে এবার একটু নির্বাক করে দিই।

স্মৃতিভ্রংশের এক রোগী ডাক্তারবাবুর কাছে এসেছিলেন। ডাক্তারবাবু যথারীতি তাঁকে কয়েকটি মেমোরি পিল খেতে দেন। কয়েকদিন পরে ডাক্তারবাবুর কাছে রোগীটি ফিরে আসতে ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘পিলগুলো খেয়েছেন?’

রোগী মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘না ডাক্তারবাবু, ভুলে গেছি।’

বাঁকা কথার অবশেষে আইনের আঙিনায় যেতে হচ্ছে। না হলে বাঁকা কথা অপূর্ণ থেকে যাবে।

কাঠগড়ায় জনৈক সাক্ষী আবোলতাবোল, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে থাকায় হাকিম সাহেব তাঁকে ধমকিয়ে দেন, ‘বাজে কথা বলবেন না। এই মামলা সম্পর্কে আপনি সত্যি সত্যি যেটুকু জানেন সেটুকু বলুন।’

সাক্ষী বিনীতভাবে জানালেন, ‘হুজর, সে আমি পারব না।’

হাকিম অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন পারবেন না?’

সাক্ষী বললেন, ‘হুজুর, এর আগেও আমি কয়েকবার আদালতে সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু প্রত্যেকবারই দেখেছি, যেই সত্যি কথা বলতে গেছি, হয় এই পক্ষের উকিলবাবু না হয় ওই পক্ষের উকিলবাবু আমাকে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়েছেন।’

বলাবাহুল্য, এই সাক্ষীর মতো অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। উকিলবাবুদের সামনে সত্যি কথা বলে পার পাওয়া কঠিন।

কিন্তু এর চেয়েও সেই সাক্ষী ভদ্রলোক যাঁকে জজসাহেব ধমকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি শপথ নিয়েছেন সত্যি কথা বলবেন বলে, এখন সত্যি কথা না বললে আপনার কী হতে পারে জানেন?’

নির্বিকার মুখে সাক্ষী বললেন, ‘হ্যাঁ, জানি।’

জজসাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কী জানেন?’

সাক্ষী বললেন, ‘আমি সত্যি বললে আমার পক্ষ হারবে। সত্যি না বললে আমার পক্ষ জিতবে।’

অন্য একটি জটিল মামলায় এক ডাক্তার সাক্ষীর কথায় তিতিবিরক্ত হয়ে রাগী উকিলবাবু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানুষের মাথায় ঘিলু কতটা থাকে?’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তার ঠিক নেই। একেক জনের একেক রকম।’

উকিলবাবু বাধ্য হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার মাথায় কতটা ঘিলু আছে?’

আদালত বাধা দেওয়ার আগেই ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনার চেয়ে কিছুটা বেশি।’

আমরা বাঁকা কথার শেষ প্রান্তে এসেছি। আদালত কক্ষে শেষবার ঘুরে যাই।

উকিল আদালতকে জানালেন, ‘স্যার, আমার পক্ষের দু’জন সাক্ষী অনুপস্থিত। আজকের মামলা মুলতবি রাখা হোক। আমাকে পরে একটা তারিখ দিন।’

জজসাহেব আদালতের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার মামলা মুলতবি রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই দেখুন সাক্ষী দু’জন এসে গেছে।’

উকিলবাবু মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন সত্যিই সাক্ষী দু’জন এসে গেছে, কিন্তু তিনি তবুও মামলা মুলতবি রাখতে চাইলেন। বিস্মিত জজসাহেব বললেন, ‘কিন্তু, কেন?’

উকিলবাবু বললেন, ‘এই সাক্ষী দু’জন মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এরা আমাকে কথা দিয়েছিল যে আদালতে আসবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *